আর্কাইভকবিতা

কবিতা

নাসির আহমেদ

প্রতীক্ষায় থেকো রৌদ্রদিনের

ফুলের বায়না ধরো না এখন, পাতাঝরা দিন কাঁপছে

তীব্র হিমের ছোবলে আমার ছোট্ট বাগান শীর্ণ

রোদ পলাতক! কুয়াশার ঘন কালো থাবা যেন হিংস্র

নেকড়ের ক্রোধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে দরিদ্র এই কুটিরে।

বসন্তমুখী প্রতীক্ষা নিয়ে ভালোবাসা আজ কাঁপছে

তোমার জন্য বাসন্তী রং ফুলের খোঁজেই ছুটছি

চেনা পৃথিবীর সেই রূপ-রং এখানে পাবে না আজকে

খুব মনে পড়ে কৃষ্ণচূড়ার আগুন ছড়ানো তোমাকে।

বিপরীত ঋতু, ভিন গোলার্ধে বৈপরীত্যে আমরা

দুজন দুদিকে। ভোলা-বরিশাল যদিও স্রোতের সখ্যে

আজো মিশে যায় একই জলাধারে, আমরাই বিচ্ছিন্ন।

এই শীত শেষে আসবেই আশা স্বপ্নের সে বসন্ত।

তীব্র শীতের এই কুয়াশায় তুমি যে একাকী কাঁপছ

আমি জানি আর জানে বাংলার শিশিরসিক্ত ঘাসেরা

কবিতার সাদা রাজহাঁসগুলো ভাসছে স্মৃতির দিঘিতে।

বসন্তে এস ছেঁড়াসুতো জোড়া দিয়ে সেই মালা গাঁথতে।

এখন কোথাও রৌদ্র দেখি না, কুয়াশার কালো তাণ্ডব!

দিন আসবেই ভালোবাসবার ফাগুনে আগুন-রৌদ্রের ।

————————————

মাহবুব বারী

একটি কাক

(মনিরা মনি-কে)

আমার সমস্ত কবিতা তোমাকে লক্ষ্য করেই

আর আমার বাকি জীবন…

তোমাকে তো বলেছি, বলিনি, মনে করো―

এই দেখো সেই খেলো খাতা―কী লেখা ?

চরণে চরণে ভালোবাসা, স্তবকে স্তবকে ভালোবাসা

আর শিরোনামে;

এখনও বিশ্বাস হয় না

তবে এই নাও তপ্ত লোনাজল, চোকের জল, রক্তের দানা

এই নাও আমার হলুদ মুখমন্ডল, জ্বলজ্বলে কাতর চোখ―

বিশ্বাস হয়, হয় না

এই নাও তবে সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, এই নাও কাটা হৃৎপিণ্ড

দুই টুকরো করে দিলাম তোমার দুই হাতে

দেখো এইখানে পাও কিনা, সেই অমর কবিতাখানি,

প্রচলিত কোনও ছন্দে নয়, শুধু তোমার ঞন্দে বর্ণে লেখা,

পড়ো, পড়তে থাকো, পড়তে থাকো, পড়তে থাকো―

এখনও বিশ্বাস হয় না―তবে

আমার হৃদপিন্ড এখন একেবারে স্তব্ধ করে দিলাম,

দেখো সাড়া নেই শব্দ নেই, একদম স্থবির হয়ে আছে

হাত দিয়ে দেখা, আমি আছি কিনা―নেই আমি নেই।

শুধু দূরে একটি কাক কা-কা-কা শব্দে

সকাল থেকে ডেকে যাচ্ছে।

—————————————

সোহরাব পাশা

একটি গল্পের জন্য

কবি কামাল চৌধুরী―বন্ধুকে

সে গল্পের দীর্ঘ শুরু শালপ্রাংশুছায়া

প্রফুল্ল রোদ্দুরে

নদী ডাকে অনন্ত যাত্রায়

তরঙ্গে ঝরে সোনার আলো

সন্ত্রস্ত মাছেরা জলভাঙে উজানের

বিশ্রুত শ্রাবণ ধারা

ঝরে অবিরল

নিভে যায় আগুনের ঘ্রাণ

কার্তিকের মাঠে

রোদ ভিজে আলো ঝরে

মেঘের লতাপাতা ও ফুলের ওপর

ঘুম ভাঙে পরাক্রান্ত রাত্রির

স্বপ্নের হাত ধরতে দৌড়োয় মানুষ

দেখা মেলে প্রিয় জীবননান্দের সাথে

আলোর কুসুম ফোটে

নির্মল ঘাসের ঠোঁটে-দগ্ধ মৃত্তিকায়

পাখি ডাকে হিজল পাতার জানালায়

এই বর্ণিল আয়োজন আলোকিত―দৃপ্ত ‘তর্জনীর’

একটি প্রিয় গল্পের জন্যে।

——————————-

মুস্তফা হাবীব

চাঁদ জোছনার গল্প

মানুষ বাঁচার জন্য সহস্র স্বপ্ন বোনে

চায় ঘর সংসার

স্বজনদের নিরাপদ বেষ্টনী

অবিশ্রাম সুবাতাস এবং

শস্যদানার পাশাপাশি

       ফুল পাখি বৃক্ষের শোভা।

এসব পেলে বেড়ে যায় স্বপ্নের বিস্তার

আরও অনেক কিছু চায়

হয়তো হতে চায় দেবদূত

নয়তো এক সাম্রাজ্যের অধিপতি।

মানুষ হয়েও থাকতে চায় না

মানুষের কাতারে অমলিন

ভুলে যায়, চাঁদ জোছনার সম্পর্ক

ক্ষমতায় কিনে নেয় নদী ও পাহাড়।

———————————————-

মাহমুদ কামাল

কাগজের বাঘ

বিরোধে বিরোধে বেলা চলে যায়

সময় চমক দিয়ে বলে

চলো সেইখানে চলো

যেখানে বাঘিনী ও পুরুষ

একসাথে থাকে।

এই বিকেলবেলায়

কীভাবে সময়ের সাথে

তাল রেখে বাঘিনীর বাড়ি যাই

ছোট এ জীবন তবু সিংহ নই, বাঘ নই

বিরোধে বিরোধে থেকে

কাগজের বাঘ হয়ে আছি

——————————-

সরকার মাসুদ

মর্মকথা

ব্যস্ত দিনের বোঁটা থেকে ঝরে পড়ে শেষ বিকেল

দিনান্তের হাওয়া পড়ে গেলে

ক্যানেলের ওপর ঝুঁকে থাকা সন্ধ্যাতারা

পরাজিত মানুষের মনে শেষ আশার প্রদীপ !

সকালে সূর্যমুখী ফুলের মাঠে হাজার সূর্য দোলে

সন্ধ্যায় ঐ ফুল, গাছপালা কালো হয়ে আসে

ভাঙা মন চিরদিন সবুজ মলম ভালোবাসে―

এসব কথার মর্ম বোঝা যাবে ঋতু বদলের দিন

তুমি বুঝবে ঐ সূর্যমুখী আর কুড়েঘরের মানে

বিকেলবেলা মানুষ কালভার্টে এসে বসে

কেন বসে, খোলা বাতাসের টানে ?

নাকি শুধু স্বভাবের দোষ-গুণ

তার মনে ইচ্ছার পাল তুলে দেয় ? 

—————————————-

আমিনুল ইসলাম

জলছবি

ফাগুনের রতিতৃপ্ত পৃথিবী চিৎ হয়ে ঘুমোয় বৈশাখে

হাওয়ারা উড়ায় তার দ্বিরঙা মেঘমেঘ আঁচল

নাভিটা উদোম

সানগ্লাস খুলে রেখে পাশে

রোদের কলমে

কবি তার প্রেয়সীর নাম লেখেন পৃথিবী

আকাশের গায়ে। মেঘের ছায়ায় বসে

আড়চোখে দেখে তা ডে-শিফটের ফেরেশতার দল।

—————————————–

হাসানাত লোকমান

তোমার জন্য পঙ্ক্তিমালা

তোমার জন্য ফুলের বাগান স্বপ্নবাড়ি বাঁধতে পারি

চন্দ্রকুসুম একলা রাতে কাঁদতে পারি

দখিনমুখী গোলাপ-গৃহ ছাড়তে পারি

জীবন-পাশায় হারতে পারি

তোমার জন্য সবুজ মাঠে ছক্কা ও চার মারতে পারি

নিঝুম রাতে দেয়াল লিখন লিখতে পারি

শুদ্ধ করে হৃদয়-ভাষা শিখতে পারি

জীবন বাজি মৃত্যু-মিছিল অগ্রভাগে থাকতে পারি

টুকটুকে লাল সূর্যটা বুকের ভেতর রাখতে পারি

তোমার জন্য রক্ত ঢেলে পিচঢালা পথ আঁকতে পারি।

তোমার জন্য ভাঙতে পারি

প্রেমের ভিক্ষা মাঙতে পারি

তোমার জন্য শত বছর কারাবরণ করতে পারি

তোমার জন্য রক্তজবা রণাঙ্গনে লড়তে পারি

পদ্মরাঙা স্বপ্নকথা স্বাধীনভাবে বলতে পারি

তোমার জন্য প্রতিবাদের অগ্নি হয়ে জ্বলতে পারি।

তোমার জন্য পুড়তে পারি

আগুন বুকে উড়তে পারি

তোমার জন্য এক জীবনে নির্বাসনও নিতে পারি

সাত সাগরের ভালোবাসা পরান ঢেলে দিতে পারি

তোমার জন্য নির্বিবাদে শান্তি-চুক্তি মানতে পারি

আকাশ থেকে সকল তারা একলা ছিঁড়ে আনতে পারি।

তোমার জন্য গড়তে পারি

আবার সুখে মরতে পারি

ভালোবাসা বুনতে পারি

মায়াপোড়া মাটির বুকে আনতে পারি শীতল বারি

তোমার জন্য সারা জীবন অপেক্ষাতে থাকতে পারি

কেবল পারি… আমিই পারি।

———————————————-

জুয়েল মাজহার

রাইকে হাওয়ায় লেখা চিঠি

তোমারে পাইমু, রাই আর কুনুদিন

না পেয়েও পাইবার ইশারার মতো?

না বলা কথার তলে ফল্গু হেন

বোঁচা নাকে তিলসহ, ভুরুতে জরুলসহ

লীলা-লাস্যসহ আর অধরে মধুর হাসিসহ?

লক্ষ্মীট্যারা নয়ানে ঝিলিকসহ

গ্রীবার মোচড়সহ, হাওড়ের হাঁসিনীর মতো?

তোমারে পাইমু, রাই, শইট্টার বনে

কাউয়ালুলির ঝোঁপে, মিঞ্জিরিতলায়

বিহানে বৈকালে আর কালাঞ্জিবেলায়

গুদারার ঘাট থিকা অল্প দূরে গোপাটে-জাঙ্গালে?

আমরা কমু না কথা

থাকবে না আমাদের মুখে কুনু রাও

―বোবা হয়া থাকব আর বলব কথা না বলা কথায়

হাওয়ায় লিখিয়া চিঠি, ওগো রাই, তোমারে পাঠাই

লতি দিয়া শুটকি আর হিদলের ঝালের সালুন

উন্দালে রান্ধনকালে করো তুমি আমারে ইয়াদ?

ইয়াদ করিয়া মোরে অহনো কি করো গুনগুন:

‘আমারে ফাউরিছ কেনে! ওরে ও নিঠুর কালা চান!’

একচোখ-কানা এক জখমিডানা ফেসকুন্দা পাখি

ঝিম মারা বৈকালেতে একা বইসা বাঁশের মাচায়

নিজের মর্মের গান গায় আর নিজেরে শোনায়

————————————————-

রেজাউদ্দিন স্টালিন

বিদ্যাসাগর একটা বই

বিদ্যাসাগর একটা বই―একটা নদী

নদীটি বয়ে যায় তার বুকের ভেতর―নাম দামোদর

মা ডাকলে প্রবল ঢেউয়ের মাথায় হাত

বুলিয়ে নিজের বুকের মধ্যে সাঁতরে তীরে ওঠেন

জন্মের পর থেকে ঈশ্বর হাতে চাঁদ নিয়ে মাথার উপর চেপে বসে আছে

নামে না

বিদ্যাসাগরের একজন বন্ধু

জন্মেছিল তাঁর জন্মের পাঁচশো

বছর পরে―মধুসূদন

বন্ধুর জন্য এখনও টাকা পাঠান টাইম মেশিনে

তার আছে নিজস্ব সুতিবস্ত্র

জ কেটে জামা আর ধ সেলাই করা ধুতি

 লক্ষ লক্ষ কন্যা―প্রত্যেকের নাম সীতা

কন্যাদের তিনি খেতে দেন

স্বরবর্ণ আর ব্যঞ্জনবর্ণ

তারা শশুর বাড়ি গেলে তিনি সেলফে

শুয়ে হাসেন

বিদ্যাসাগর একটা বই

থাকেন পৃথিবীর পাঠাগারে

———————————————-

সৈকত হাবিব

হত্যা ও হাল্লাজ

যখন তিনি বললেন, আনাল হক

থাকলেন না আর মনসুর হাল্লাজ

পরমের আলোকে আত্মলুপ্ত হয়ে

হারালেন সব ভয় আর লোক-লাজ

কেন তুমি মনসুর হাল্লাজকে

               হত্যা করো?

কারণ সত্যকেই তুমি ভয় করো!

ক্ষমতালিপ্সু ধর্মবণিক তুমি

       পরম-প্রেমের ছাই বোঝো!

যখন তুমি হাল্লাজকে হত্যা করো

কেবল কি সত্যকেই হত্যা করো!

পরমের প্রতি নিরঙ্কুশ প্রেমেরও কি

    তুমি হত্যাকারী হয়ে ওঠো না?

হাল্লাজকে টুকরো টুকরো করে তুমি

নিজের ভয়কেই খুন করতে চেয়েছ

ধর্মের মোড়কে এসব তোমার বুজরুকি

তাঁর পরমমিলনের পথকেই প্রশস্ত করেছ!

————————————————-

স্বপন নাথ

আশ্রয়ের পথে

বার বার ভ্রমণ করি

সীতানাথ বসাকের বাড়ি

যেখানে ঝরে পড়ে

কুয়াশাভেজা বর্ণমালা

টুপটাপ, সে কী ফুল

মায়াবী ফুলের কোরক

জলচিহ্নিত উঠানে

সমবেত স্বরে লেখা

কণ্ঠেরই বাণী।

রক্তলাল ক্যানভাস জুড়ে

তাপিত ঝড়ে

বারবার আমরা যেমন

অক্ষরের মায়ায় প্রাণে

ফিরে আসি

রক্তদাগেই আবার

দেখে নিতে হয়

আপন ভুবন ও নাম

যে আঁধারের গুহা থেকে

সুর হয়ে আসে আলো

ছিটকে থাকা টুকরো টুকরো

হাড়িপাতিলের

নমুনায় রঙ প্রলেপে

ভুলে যেতে থাকি ক্রম

ছলছল চোখে দূর কোনও

ছায়া মরীচীকা

জন্মধন্য বলতে

লজ্জা লাগে কি না

অথবা লজ্জা নেই কি না

ওই প্রশ্ন মুছে দিতে যাই

ছেনিকাটা বর্ণমালার

পাখিবাগানে বসে আছেন

বাঁশি হাতে দ্বৈপায়ন।

প্রত্যাখানের পথ থেকে ওঠে এসে

বলে যাই জন্মান্তর আমার―এস

পাঠ করি সে কাব্য।

—-

সচিত্রকরণ : রজত

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button