আর্কাইভগল্প

খেতাব : ইউনুস কানন

গল্প

সূর্যের তেজটা কমে এসেছে। মোমেনা বেগম ঘরের বারান্দায় বসে ছিলেন। কর্কস শব্দে একটা মোটর সাইকেল বাড়ির ভিতর ঢুকল। শুভেচ্ছা বিনিময়ের মাধ্যমে মোমেনা বেগমের হাতে একটা মোটা খামের চিঠি দিয়ে রওনা হলো। চিঠিটা পেয়ে তার একমাত্র মেয়ে ইরাকে ডাক দিলেন, ‘পড়ে দেখত মা। কী জন্য পাঠিয়েছে।’

চিঠিটা খুলতে খুলতে ইরা চিঠির ভিতর থেকে একটা নতুন গন্ধ অনুভব করছিল। মোটা কাগজে আলপনা আঁকা চিঠিটা সচারচর চোখে পড়ে না। প্রেরক রাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়। সরকারি চিঠি। মাকে ডেকে নিয়ে ইরা বেশ আগ্রহভরে চিঠিটা পড়া শুরু করল।

প্রিয় কোমলমতি

আমরা অত্যন্ত আনন্দের সাথে আপনাকে নিমন্ত্রণ দিচ্ছি, এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আপনার প্রয়াত স্বামী আতাউল গণি খাঁ রাষ্ট্রীয় খেতাব ও পদক (মরোণোত্তর) এ ভূষিত হওয়ায় আগামী ২৫ বৈশাখ, খেতাব ও সমপরিমাণ আর্থিক সুবিধা আপনার হাতে তুলে দেওয়া হবে। উক্ত খেতাব ও পদক এবং আর্থিক অনুদান সাদরে গ্রহণ করার জন্য আপনার শুভাকাক্সিক্ষসহ উপস্থিত থাকবেন।

শ্রদ্ধান্তে

সমাজকল্যাণ ও সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়।

চিঠির বক্তব্যটা শুনে মোমেনা বেগমের মনে খুব আরাম অনুভব হলো। পুরানো স্মৃতি ভেসে চোখের কোণে জল গড়িয়ে গেল। মায়ের মুখের দিকে চেয়ে বাবার শূন্যতা দোলা দিল মনে। মাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘মা তুমি খুশি হওনি?’

‘আমার খুশি আর অখুশি? সারা জীবন তোর বাবা কত সাধনাই না করেছে! গান লিখত, সেই গান গেয়ে অনেকেই সে-সময় বিখ্যাত কিন্তু পয়সার অভাবে তোর বাবা সংসার চালাতে হিমসিম খেয়ে যেত। মানুষটা বেঁচে থাকলে আজ তাঁর প্রাপ্যটা পেয়ে গর্বিত হতো।’

মায়ের কথা শুনে ইরাও চুপ হয়ে গেল।

সারাদিন কাঠফাটা রোদের পর বিকালটা বাতাসে ভরপুর। গাছের পাতাগুলো আজ প্রাণ খুলে হাসছে আর শো শো শব্দে বাতাস বইছে। প্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছে তবু মনের মধ্যে কেমন যেন একটা অস্বস্তি কাজ করছে। হাস্যোজ্জ্বল লম্বা মুখটা মলিন হয়ে এল। আটপৌরে শাড়ি পরে মোমেনা বেগম ঘর ছেড়ে বাইরে চলে গেলেন। পিছনে ইরাও।

মহিলারা মোমেনা বেগমকে ডাক দিচ্ছে, ‘ও বু, পিয়ন কী দিয়ে গেলো, আমাদের বললি না তো? ভাসুরের ব্যাংকে রাখা টাকা পয়সার হিসাব দিয়ে গেল নাকিরে? মিষ্টি খাওয়াতে হবে কিন্তু।’

মোমেনা বেগমের মুখটা ভার হয়ে আছে। তিনি ভাবলেন দুর্গন্ধ বাতাসে ছড়ানোর আগে ভালোটা বলে দেওয়াই মঙ্গল নতুবা এরা কে কী ভাবে? আর কী কথা ছড়ায়! শেষে ফুল দিয়ে দুর্গন্ধ ঢাকতে জীবন শেষ।

‘তোর ভাসুর যে গান লিখত, তার জন্য সরকার পুরস্কার এবং কিছু টাকা দেবে।’

ফুলমতি নেচে উঠে বলল, ‘খুব ভালো খুব ভালো, তা মুখটা গোমরা করে আছিস কেন রে?’

মোমেনা বেগম কোনও জবাব দিলেন না।

মধুবালা বলল, ‘পুরস্কার আনার দিন কিন্তু আমাদের নিয়ে যেতে হবে। সবাই দল বেঁধে যাব।’

কিছুক্ষণের মধ্যে সংবাদ চারিদিকে ছড়িয়ে গেল।

প্রতিবেশি বয়ঃজৈষ্ঠ রুস্তম আলী নিজেকে নিয়ে বেশ গর্ববোধ করল, আমাদের গ্রামের সন্তান রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পেতে যাচ্ছে। হোক তার মরণের পর। তবু রূপসপুর গ্রামের একটা নাম ডাক থাকবে। কোথাও সাদি সওদা আত্মীয়তা করতে গেলে আর আলাদা করে পরিচয় দিতে হবে না। গ্রামের নাম আর আতাউল গণি খাঁ, এটাই যথেষ্ট।

দুই

রাতটা গড়িয়ে গেল। সকালবেলা পাখির কিচিরমিচির শব্দে মোমেনা বেগমের ঘুম ভেঙে গেল। তার ভেতর সেই অস্বস্তি এখনও কাটেনি, ঘুরে ফিরে পিছনের কথাগুলো মনে পড়ে যাচ্ছিল, কষ্টের দিনগুলোর কথা কি ভোলা যায়? বাড়িটাও সেই আগের মতো রয়ে গেছে। উপরে টালি দিয়ে ছাউনি। মাটির ভিত। একটু ঝড়-বাতাস এলেই মনের মধ্যে ভয় ধরে যায়। কখন যেন ভেঙে পড়ে। অনায়াসে বৃষ্টির পানি টালি দিয়ে ভিতরে গড়িয়ে পড়ে। যাওয়ার যায়গা নেই। তাই আজ অবধি এখানে থেকে যেতে হয়েছে। মেয়েটাও বড় হয়েছে। এবার অনার্স ফাইনাল ইয়ার পরীক্ষা দেবে। পাশ করলে যদি একটা চাকরি পেয়ে যায় তবে ভালো একটা জামাই পাওয়া যাবে এবং নিজেকেও খরচ-খরচা দিয়ে চালিয়ে নেবে। মাঠে সামান্য ক্ষেত-খামার যা আছে বর্গা দেওয়া, বাড়িতে গাভি পালন, হাঁস-মুরগি পুষে কোনও রকমে দিন চলে যাচ্ছে। এসব ভাবতে ভাবতে বাইরে আলোকিত হয়। সূর্যটা উপরে ওঠে। আলো এসে মাটির বারান্দায় হোছট খায়। ইরাও ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ফ্রেস হয়ে নেয়। একটু পরে কলেজে ফরম ফিলাপ করতে যেতে হবে। ভালোভাবে পাশটা করতে পারলে একটা চাকরি, মায়ের কষ্টটা ভুলিয়ে দেওয়া, তারপর বাকি সব।

ইরা বাড়ির বাইরের দিকে উঁকি দিয়ে দেখল, দলবল নিয়ে কয়েকজন লোক যেন তাদের বাড়ির দিকে আসছে। আর একটু নিকটবর্তী হলে সে দেখল, হাতে ক্যামেরা, গায়ে মোটা খাকি কাপড়ের পোষাক পরিহিত দুজন লোক এবং পিছনে দুষ্টু ছেলেদের একটা জটলা। একটু বাদে তারা ইরার মুখোমুখি হলো, হাতে মাউথপিস ধরা ছেলেটাকে ইরা চেনে, সাংবাদিক সুজন, টিভিতে মাঝে মাঝে রিপোর্ট করে।

ইরাকে দেখে সরাসরি সুজন বলল, ‘আপনাদের বাড়িতে এলাম। আপনার মায়ের একটা সাক্ষাৎকার নিতে। পুরস্কারের সুসংবাদ পাওয়ার পর আপনার মায়ের অনুভুতি কেমন? পিছনের গল্প। আপনার বাবার বিষয়ে সার্বিক তথ্য আমরা দেশবাসীকে জানাতে চাই।’

ইরা তাদের স্বাগত জানাল। ঘর থেকে দুটি চেয়ার বের করে এনে বলল, ‘আপনারা এসেছেন ভালোকথা কিন্তু মা কথা বলবেন কি না, সেটা আমি গ্যারান্টি দিতে পারব না। মায়ের মনটা ভালো না।’

কথাটা শুনে সুজন আৎকে উঠে বলল, ‘বলেন কি? এমন একটা পুরস্কার, রাষ্ট্রীয় খেতাব, নাম ডাক, বিভিন্ন জায়গা থেকে যে অর্থ পাবেন তা দিয়ে বসে বসে খেতে পারবেন, সারা জীবন আর কিছুই করা লাগবে না। আপনার বাবার গানের রয়্যালিটি বেড়ে যাবে। বেশি টাকা পাবেন। আর এখন আপনার মায়ের মন ভালো নেই?’

ইরা বলল, ‘আপনার কথা সব ঠিক। তবে অন্য যে আরও কিছু আছে সেটা আপনি বুঝবেন না। আপনারা বসেন, আমি মায়ের সাথে কথা বলে আসি।’

ইরা মায়ের সাথে কথা বলতে ঘরের পিছনে চলে গেল। মোমেনা বেগম বাইরের কাজে ব্যস্ত।

মায়ের সাথে কথা বলে ইরা সামনে এল, ‘মায়ের মন ভালো নেই তাই তার পক্ষে আজকে সাক্ষাৎকার দেওয়া সম্ভব না। অন্য একদিন আসেন, মাকে বুঝিয়ে ম্যানেজ করব।’

সাংবাদিক সুজন বলল, ‘তাহলে আপনার মা কি পুরস্কার আনতে যাবেন না? এত বড় একটা সংবাদে তিনি যদি খুশি না হয়ে বেজার হন তাহলে পুরস্কার আনতে যাবেন কীভাবে?’

‘সেটা মা-ই ভালো বলতে পারেন। এ ব্যাপারে আমার কিছু বলার নেই।’

কথা শেষ না হতেই ইরা দেখল, তাদের বাড়িতে আরও কয়েক দলে লোক এসেছে, তাদের হাতেও ক্যামেরা, টিভির সাংবাদিক বাদেও পত্রিকার সাংবাদিক কয়েক জন এসে হাজির, সবাই সাক্ষাৎকার নিতে চায়, কিন্তু মাকে তো রাজি করানো গেল না। তাই সে সবাইকে ম্যানেজ করছে যেন কেউ অখুশি না হয়। ঘরে মাত্র দুটি চেয়ার ছিল সেটাতে তো লোক বসা, এখন আবার এদের বসতে দেবে কীসে। ইরা এদিক-ওদিক দৌড়াদৌড়ি করতে লাগল কিন্তু হাতের কাছে তেমন কিছু পেল না। বারান্দায় বিছানা পেতে দিয়ে কয়েকজনকে ডাক দিয়ে বলল. ‘আপনার এখানে বসেন।’ কেউ কেউ বসল আবার কেউ কেউ দাঁড়িয়ে থাকল। সাংবাদিকদের মধ্যে থেকে একজন বলল, ‘আমাদের বসতে দেওয়ার ব্যাপারে আপনাকে ছোটাছুটি করতে হবে না। আপনার মাকে ডেকে দিন, আমরা দু-একটা কথা বলে চলে যাই।’ তবু ইরার ছোটাছুটি থামে না। চাচাতো ভাই রাসেলকে কাছে পেয়ে বলল, ‘তোদের চোখ কি অন্ধ হয়ে গেছে? এত লোক দাঁড়িয়ে আছে, তোরা তো একটা কিছু করতে পারিস, যা কয়টা চেয়ার নিয়ে আয়।’ ইরার কথা শুনে রাসেল বাড়ির দিকে গেল।

স্বাধীন টিভির সাংবাদিক মঞ্জুর মোরশেদ। বয়স ঢের হয়েছে, চুল-দাড়ি সাদা হয়ে গেছে। তবু নেশার বসে এই পেশায় আছে। ইরাকে কাছে ডেকে বললেন, ‘শুনলাম, তোমার মা নাকি সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে রাজি নয়। আমাকে দেখিয়ে বলো, তিনি আপনার সাথে গল্প করতে এসেছেন। কোনও সাক্ষাৎকার নয়। দেখো আমরা এতগুলো লোক এসেছি। সবাই যদি কোনও কিছু না শুনে চলে যায়, ব্যাপারটা কেমন হয় তুমি একবার ভেবে দেখো আর তাকে একটু বোঝাও। আমরাতো মানুষ, আমাদের সাথে কথা বলা তেমন কিছু না। যাও।’

ইরা পুনরায় মায়ের কাছে গেল। বয়স্ক সাংবাদিকের কথামত মাকে বুঝিয়ে বলল। ব্যাপারটা মোমেনা বেগম ভেবে দেখলেন, আসলে তো তাই। এত লোককে বাড়ি থেকে খালি মুখে বিদায় দেওয়া ভালো দেখাবে না। মোমেনা বেগম রাজি হয়ে গেলেন। ইরাকে শর্ত দিয়ে বললেন, ‘ওদের বলবি, যেন আজে-বাজে প্রশ্ন না করতে।’

‘আরে দুর রাখো তো তোমার আজে-বাজে প্রশ্ন? আমি আছি না। যা বলতে হয় আমি বলব, তুমি দু-একটি কথা বলবে, বাকিটা আমি চালিয়ে নেব। চলো।’

দুজনে ধীর পায়ে সামনে এগিয়ে এসে পাশাপাশি আসনে বসলো।

চারিদিকে ক্যামেরা আর ক্যামেরা, ফোন, রেকর্ডার, কারো হাতে কাগজ-কলম।

মা থেমে গেলে মেয়ে সেটা ঝালিয়ে দিচ্ছে।

সাংবাদিক সুজন সাক্ষাৎকার শেষে ইরাকে একপাশে ডেকে নিয়ে নতুনভাবে সাক্ষাৎকার নিতে শুরু করল।

এটা যে মিছে একটা গল্পের মতো ভিডিও হয়ে যাচ্ছে যা প্রচারযোগ্য নয়, সেটা ইরা বুঝতে না পেরে অনর্গল বলেই যাচ্ছিল। একপর্যায়ে সুজন বলেই বসলো, ‘আপনার যে কর্মচঞ্চলতা, উদ্যম, চোখের চাহনি, সেটা হলিউডের নায়িকাদের মধ্যে দেখা যায়। আমার খুব ভালো লেগেছে আপনাকে।’ দুর্বল কথাটা শুনে ইরা হঠাৎ থেমে গেল। বেশ লজ্জ্বা। চোখ বাঁকা করে হালকাভাবে সুজনের দিকে তাকাল। চোখে চোখ পড়ে গেল। ইরার মুখটা লালে লাল। বলল, ‘দুধের উপর সর পড়লে খেতে সবারই ভালো লাগে।’

তিন

কলেজ থেকে ফিরছিল ইরা। পথিমধ্যে রাস্তায় দেখা হয়ে গেল সুজন সাংবাদিকের সাথে। ভ্যান থামিয়ে ইরার সাথে আরও কিছু বলতে চাইল সুজন। ইরা ব্যস্ততা দেখাল কিন্তু সুজন তাকে ছাড়ল না। বাধ্য হয়ে ভ্যানটা ছেড়ে দিয়ে সুজনের সাথে একান্তে কথা বলতে হলো ইরাকে।

‘আপনাকে তো সেলিব্রেটি বানিয়ে দিয়েছি। প্রতিবেদনটা দেখেছেন?’ সুজন বলল।

‘মায়ের সাথে যৌথ সাক্ষাৎকারটা দেখেছি কিন্তু আমার সাথে একান্তে যে কথা বললেন, সেটা তো দেখলাম না।’

‘একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সবকিছু সারতে হয়। ওটা দেখাতে চ্যানেল জায়গা দেয়নি। হয়তো কোনও একদিন আবার দেখতে পাবেন।’

‘আচ্ছা থাক। আর দেখাতে হবে না। যথেষ্ট হয়েছে।’

‘একজন গীতিকবিকে সরকার বেশ সম্মান দেখাল। এটা কিন্তু সচারচার হয় না।’

‘সব ঠিক আছে। লালনের কথায় আছে না? সময় গেলে সাধন হবে না।’

‘মানে?’

‘বাবা যদি গানটা না লিখত তাহলে সুর সঙ্গীত আর গায়কের গলায় আসতো কীভাবে? লেখাটা তো মূল, শেকড়। তবে তার জীবদ্দশায় সম্মানটা পাওয়া উচিত ছিল।’

‘সময়মত সব হয় না। সরকারের বুঝতে সময় লেগেছে। আর তার লেখা গান মানুষ এখন যেন বেশি করে শুনছে। তাই হয়তো সরকারের টনক নড়েছে। এই দেখো জীবনানন্দ দাশের কবিতা এখন মানুষ মুড়ির মতো খায় কিন্তু তার জীবদ্দশায় কি এত জনপ্রিয়তা পেয়েছিল? মোটেও না।’

‘কিন্তু তারপরেও বোধশক্তি লাগে। কবিদের বুঝতে জ্ঞান লাগে।’

সুজন একটু অন্য প্রসঙ্গ টেনে বলল, ‘এখন মা মেয়ের তো মধুচন্দ্রিমার সময়। কিন্তু আপনার মধুচন্দ্রিমা কবে হচ্ছে?’

‘বুঝলাম না। খুলে বলেন।’

‘বলছিলাম কী, আপনার মা কি জামাই পছন্দ করে রেখেছে?’

‘সেটা মা বলতে পারবেন। এখনতো আমার জন্য জামাইয়ের অভাব নেই। বোঝেন না, সুখের মাছি গন্ধে ওড়ে। তবে আমার পরিকল্পনা হলো, অনার্সটা শেষ করি। একটা চাকরি। চাকরির টাকায় মাকে একটু সুখ দেওয়া। মা তো সারা জীবন কষ্ট করে গেলেন। তার দেখাশুনার ব্যবস্থা করে নিজের জন্য মাথা গোজার ঠাই খোঁজা।’ ইরা সরলপাঠে বলে গেল।

‘আমার একটা আবেদন ছিল, ভেবে দেখবেন গ্রহণ করা যায় কি না?’

‘কারও না কারও সাথে গাঁটছাড়াতো বাঁধতে হবে সুতরাং ভেবে দেখব, কারা সুখের বন্ধু আর কারা দুখের সময় দুঃখটা ভাগ করে নেয়। আমি চলি।’

ইরা হনহন করে চলে গেলো। এভাবে সময়ে অসময়ে তার কাছে প্রস্তাব আসতেই থাকে কিন্তু সে রেগে যায় না। কারণ একসময়তো কেউ এভাবে বলত না। ভালোবাসার কথা জানাত না। এখন সুযোগ পেলেই সবাই জানাচ্ছে। সুতরাং রাগলে চলবে না। ধীর পায়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আতাউল গণি খাঁ নামটার মধ্যে বেশ যশ হয়েছে। তার মেয়ে, তারও কদর বেড়েছে। ভিটেমাটি পচা বাঁশ-খুটি তাদেরও কদর বেড়েছে। শৈল্পিক সৌন্দর্যে ভেসে উঠেছে। বাক্সের ভিতর থাকা বাবার পচা খাতায় লেখাগুলো স্বর্ণাক্ষরে জ্বলজ্বল করছে। সবাই সেগুলো নিয়ে যেতে চায়। নতুন করে সুর দিয়ে বাজাতে চায়। সেই সুরে তার মেয়েকেও বাজাতে চায়।

চার

সময়টা বেড়েই চলছিল। ২৫ বৈশাখ সামনে চলে আসছে। মোমেনা বেগম ভেবে কূলকিনারা পান না। স্বামীর খেতাব পাওয়ার খবরে তারও বেশ সম্মান বেড়েছে। বিভিন্ন লোক তাকে দাওয়াত দেয়। গল্প করতে সময় চায়। আর সাংবাদিকতো সবসময় বাড়িতে এসে ঘুরঘুর করে। কিন্তু এ সম্মানটা তো তার না। যাঁর, সেই আতাউল গণি খাঁ এখন নেই। এখন তাঁর খেতাবটা কি কারও নেওয়া উচিত? যাঁর প্রাপ্য ছিল সেইতো নিতে পারলেন না তাহলে আমাদের তা নিয়ে কী লাভ? কিন্তু তার রেখে যাওয়া ধনসম্পত্তি তো আমরা খাচ্ছি, জীবন ধারণ করছি। টাকা পয়সা এবং খেতাব বা সম্মান এক জিনিস নয়। উত্তরাধিকার হিসেবে পয়সা খাওয়া যায় কিন্তু খেতাব কি নেওয়া যায়? মোমেনা বেগম হিসাব মেলাতে পারেন না।

দিনের পর দিন ভাবতে ভাবতে তিনি কাবু হয়ে যান। এত ভাবনা আগে কখনও আসেনি। কিন্তু এখন তার মাথায় আসে। সিদ্ধান্তটা সঠিক না বেঠিক? বেঠিক হলে লোকেরা কী বলবে? মানুষতো থুথু ছিটাবে।

এক রাতে মোমেনা বেগম ইরাকে কাছে ডেকে বললেন―‘শোন ইরা, তোর শরীরে আতাউল গণি খাঁ, যাঁকে সবাই এক নামে চেনে, তাঁর রক্ত এবং আমারও। আবার আমি পেটে ধরেছি। সুতরাং তুই আমার কথার অবাধ্য হতে পারিস না।’

কঠিন কথাগুলো শুনে ইরা বলল, ‘মা আমি কি অন্যায় করেছি? তুমি এভাবে বলছ কেন?’

‘আমি তোর অন্যায়ের কথা বলছি না। বলছি, আমি যেটা ভালো মনে করি তোরও সেটা ভালো মনে করা উচিত।’

‘হ্যাঁ, সেটাই তো। বাবা নেই, তুমি ছাড়া আমার আর কে আছে? তোমাকে আমি আইডল হিসেবে মানি। তুমি যেটা বলবে, আমি সেটা করতে বাধ্য।’

‘সেটাই যদি হয় তবে একটা খাতা এবং কলম নিয়ে আয়।’

মায়ের কথামত ইরা উঠে গিয়ে একখানা খাতা এবং কলম নিয়ে এল।

মোমেনা বেগম ইঙ্গিত দিল লিখতে, ইরা শুরু করল।

প্রিয় মহোদয়

আমরা আপনাদের পাঠানো পত্র মারফত জানতে পেরেছি যে, আতাউল গণি খাঁ এ বছর রাষ্ট্রীয় খেতাব এবং আর্থিক অনুদান (মরোণোত্তর) এ ভূষিত হয়েছেন। সুসংবাদটা পেয়ে তাঁর পরিবারের সদস্য হিসেবে নিজেদের খুব গর্ববোধ মনে করছি। লোকেরা আমাদের সম্মান জানাতে বাড়িতে চলে আসছে। সে জন্য আপনাদের শুধু ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করব না। কিন্তু এই মহৎ কাজ করতে আপনাদের অনেক দেরি হয়ে গেছে। যাঁকে আপনারা পুরস্কারের জন্য মনোনীত করেছেন তিনি তো জীবিত নেই। সেটা আপনারা অবগত আছেন কারণ মরোণোত্তর হিসেবে দিয়েছেন। যেহেতু তিনি বেঁচে নেই তাই তাঁর অবর্তমানে তাঁর নামে পুরস্কার নেওয়া আমাদের পক্ষে অসম্ভব। কারণ এত বড় সম্মান, যার ওজন খুব বেশি, সেটা আমাদের মতো ছোট মানুষের পক্ষে বয়ে বাড়ি ফেরা সম্ভব নয়। সুতরাং তাঁর নামের পুরস্কারটা কোনও একটা যাদুঘরে যত্নসহকারে রেখে দেবেন।

শ্রদ্ধান্তে

মোমেনা বেগম

আতাউল গণি খাঁর স্ত্রী।

লেখাটা শেষ হয়ে গেলে মোমেনা বেগম ইরাকে নির্দেশ দিলেন, ভালো করে খামের ভিতর ভরে ঠিকানা লিখতে। ইরা সেটাই করল। তারপর বললেন, ‘কলেজে যাবার সময় পোস্ট অফিসে গিয়ে চিঠিটা রেজিস্ট্রি ডাকে পোস্ট করবি।’ ইরা মায়ের কথায় মাথা নাড়াল। মুখ তুলে ইরা মায়ের মুখের দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল। দেখল, মায়ের মুখটা মলিন এবং কঠোর। ইরা কোনও প্রশ্ন করতে পারল না। শুধু মায়ের মুখখানা দেখতে তার বেশ ভালো লাগছিল।

সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button