অনুবাদ গল্পআর্কাইভবিশ্বসাহিত্য

দক্ষিণ থেকে আসা লোকটি : রোয়াল্ড ডাল

অনুবাদ গল্প

বাংলা অনুবাদ : কুলদা রায়

[রোয়াল্ড ডাল-এর জন্ম বৃটেনে ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে। উপন্যাস, ছোটগল্প, কবিতা, সিনেমার চিত্রনাট্য লেখক হিসেবে তিনি সুখ্যাতি অর্জন করেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি বিমানবাহিনীতে উইং কমান্ডার হিসেবে কাজ করেছেন।

চল্লিশের দশকে তিনি শিশুদের জন্য লেখা শুরু করেন এবং সঙ্গে সঙ্গে বড়দের জন্যও লিখেছেন। তিনি একজন বেস্ট সেলিং লেখক। সারা পৃথিবীতে ২৫০ মিলিয়ন কপি বই বিক্রি হয়েছে তাঁর।

বিংশ শতাব্দীর অন্যতম মহান শিশুসাহিত্যিক হিসেবে তিনি পরিচিত। তার গল্পের শেষটায় থাকে অসামান্য চমক। যেকোনো পাঠকেরই পূর্বানুমাণকে তিনি ব্যর্থ করে দেন।

ডালের বই―Tales of the Unexpected, The Mystery Writers of America। প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার আলফ্রেড হিচকক তাঁর ‘হিচকক প্রেজেন্টস’ শোতে তাঁর বেশ কয়েকটি গল্পের চলচ্চিত্ররূপ গ্রহণ করেছেন। ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে তিনি মারা যান।]

প্রায় সাতটা বেজে গেছে। তাই একটা বিয়ার কিনে বাইরে যাব ভাবছি। তারপর সুইমিং পুলের পাশে একটা ডেক চেয়ার নিয়ে বসব। কিছু সময়ের জন্য বিকেলের সূর্য দেখতে পাব।

বারে গেলাম। বিয়ার নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম। বাগানের মধ্যে দিয়ে হেঁটে সুইমিং পুলের দিকে গেলাম।

বাগানটি খুব চমৎকার। লনটি খুব সুন্দর। আছে অ্যাজোলা ফুলের বেড। লম্বা নারিকেল গাছ। নারিকেল গাছটির মাথার উপর থেকে জোরালো হাওয়া বইছে। সে হাওয়ায় পাতায় পাতায় হিসহিস আর চড়চড় শব্দ হচ্ছে যেন তারা আগুনে পুড়ছে। পাতার নিচ দিয়ে ঝুলে পড়া বাদামি রঙের বড় বড় নারিকেলের কাঁদি দেখতে পাচ্ছি।

সুইমিং পুলের চারদিকে অসংখ্য ডেক চেয়ার পাতানো রয়েছে। রয়েছে সাদা সাদা টেবিল। আর কড়া উজ্জ্বল রঙের ছাতা। এই স্নানের জায়গাটিতে বসে আছে রোদে পোড়া নারীপুরুষেরা। পুলের মধ্যে তিন চারটি মেয়ে আর ডজন খানেক ছেলে জলকেলি করছে। করছে হৈ চৈ। একে অন্যের দিকে বড় আকারের রাবারের বল ছুড়ে মারছে।

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের লক্ষ্য করছি। এই মেয়েরা ইংলিশ। হোটেল থেকে এসেছে। ছেলেরা কোত্থেকে এসেছে জানি না। কিন্তু তারা মার্কিনিদের মতো আওয়াজ করছে। তবে আমার মনে হয় তারা শিক্ষানবিস নাবিক। ছোট ছোট নৌকায় চেপে তীরে এসেছে। জাহাজটি এই ভোরে পোতাশ্রয়ে পৌঁছেছে।

আমি সেখানে গিয়ে একটি হলুদ ছাতার নিচে বসলাম। সেখানে চারটি ফাঁকা আসন রয়েছে। গ্লাশে বিয়ার ঢেলে নিলাম। তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে আরাম করে বসলাম।

বিয়ার আর সিগারেট নিয়ে সূর্যের আলোতে এখানে বসে থাকাটা ভারি আরামদায়ক। আমি আরাম করেই বসেছি। সবুজ জলের মধ্যে স্নানার্থীদের জলখেলা দেখছি।

আমেরিকান নাবিকরা খুব ভালোভাবেই ইংলিশ মেয়েদের পটিয়ে ফেলেছে। তারা সুইমিং পুলের স্টেজের কাছে পৌঁছে গেছে। সেখানে তারা জলের ভেতরে লাফ দিয়ে পড়ছে। তাদের পা উপরের দিকে থাকছে।

ঠিক তখনই লক্ষ্য করলাম, একজন বুড়োটে লোক সুইমিং পুলের চারিদিকে খুব প্রাণবন্তভাবে হেঁটে বেড়াচ্ছেন। সাদা স্যুটে তাকে বেশ মানিয়েছে। খুবই দ্রুত হাঁটছেন তিনি। হাঁটছেন ছোট ছোট লাফ দিয়ে। গোড়ালির উপর ভর করে উঁচু হয়ে প্রতিটা লাফ তিনি দিচ্ছেন। মাথায় ক্রিম রঙের বড় একটি পানামা টুপি পরেছেন। লাফিয়ে লাফিয়ে তিনি লোকজন আর চেয়ারগুলো দেখতে দেখতে পুলের পাশ দিয়ে হেঁটে এলেন।

আমার কাছে এসে তিনি থামলেন। হাসলেন। হাসলেন তার বেশ খাটো খাটো দাঁতের সারি দেখিয়ে। তার দাঁতগুলো অসমান আর দাগলাগা। আমি তার দিকেও হাসলাম।

‘ক্ষমা করবেন প্লিজ, আমি কি এখানে বসতে পারি ?’

‘অবশ্যই।’ আমি বললাম, ‘বসুন না।’

তিনি চেয়ারটি পিছনে টেনে টুনে দেখলেন। চেয়ারটা ঠিক আছে কি না নিশ্চিত হলেন। তারপর বসলেন। পা দুটো ক্রস করে রাখলেন। তার জুতো জোড়া হরিণের নরম চামড়া দিয়ে তৈরি। বাতাস আসা যাওয়ার জন্য ছোট ছোট ফুটো আছে জুতোর সারা গায়ে।

‘খুব সুন্দর সন্ধ্যা।’ তিনি বললেন। ‘জ্যামাইকার এই জায়গার সব সন্ধ্যাই সুন্দর।’ তার উচ্চারণ ইতালিয়ান বা স্প্যানিশ―ঠিক কোনটি আমি ঠাহর করতে পারছি না। তবে আমি খুবই নিশ্চিত যে তিনি দক্ষিণ আমেরিকার কোনও দেশের লোকই হবেন। তাকে খুব কাছ দেখে বুঝলাম তার যথেষ্ট বয়স হয়েছে। প্রায় ৬৮ বা ৭০ বছর হবেন।

‘হ্যাঁ।’ উত্তর দিলাম। ‘জায়গাটি আশ্চর্যজনক সুন্দর, তাই নয় কি ?’

‘আর, আমি কি জিজ্ঞেস করতে পারি―ওরা কারা ?’ তিনি সুইমিং পুলে স্নানরতদের দেখিয়ে বললেন, ‘ওরা তো হোটেলের লোক নয়।’

‘তারা মার্কিন নাবিক বলেই আমার মনে হয়।’ তাকে উত্তর দিলাম। ‘তারা মার্কিন শিক্ষানবিস নাবিক।’

‘অবশ্যই তারা মার্কিন নাবিক। এরা ছাড়া আর কারা এই কালের পৃথিবীতে এরকম প্রচণ্ড হট্টগোল করতে পারে ? আপনি তো মার্কিন নন, তাই না ?’

‘না,’ উত্তর দিলাম। ‘না, তা নই আমি।’

হঠাৎ করে একজন মার্কিন নাবিক আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল। তার গা থেকে টপটপ করে পুলের জল ঝরে পড়ছিল। তার সঙ্গে একজন ইংলিশ মেয়েও দাঁড়িয়ে আছে।

‘চেয়ারগুলো কি কেউ নিয়েছে ?’ সে বলল।

‘না।’ উত্তর দিলাম তাকে।

‘যদি এখানে বসি তবে কি কিছু মনে করবেন ?’

‘ বসে পড়ো।’

‘ধন্যবাদ।’ সে বলল। তার হাতে একটি তোয়ালে ছিল। বসে পড়ে সে তার ভাঁজ খুলল। এক প্যাকেট সিগারেট আর লাইটার বের করল। মেয়েটিকে সিগারেট সাধল। সে নিল না। তারপর আমাকে সাধল। আমি একটি নিলাম। খাটো মানুষটি বললেন, ‘ধন্যবাদ। না। আমার মনে হয় আমার কাছে একটি সিগার আছে।’ কুমিরের চামড়া দিয়ে বানানো কেস থেকে তিনি নিজের জন্য একটি সিগার বের করলেন। আর একটি ছোট ছুরিও বের করলেন। সেটা দিয়ে সিগারের গোড়া ছাঁচলেন।

‘এই যে, তোমাকে আমার লাইটারটা দিতে দাও।’ মার্কিন ছেলেটি তার লাইটারটি বাড়িয়ে দিল।

‘ওটা এই বাতাসে জ্বলবে না।’

‘নিশ্চয়ই ওটা জ্বলবে। ওটা সবসময়েই কাজ করে।’

খাটো মানুষটি মুখ থেকে না ধরানো সিগারটি বের করে আনলেন। মাথাটি একটু তুলে ছেলেটির দিকে তাকালেন।

‘সব সময় ?’ তিনি আস্তে করে জিগ্যেস করলেন।

‘নিশ্চয়, এটা কখনওই জ্বলতে ব্যর্থ হয় না। আমার কাছে কখনওই নয়।’

খাটো মানুষটি মাথাটি তখনও এক দিকে কাত করে রেখেছেন। তিনি তখনও ছেলেটিকে নজর করে দেখছেন। ‘ভালো। ভালো। তুমি বলছ যে বিখ্যাত লাইটারটা কখনওই জ্বলতে ব্যর্থ হয় না। তুমি কি এটাই বলছ ?’

‘নিশ্চয়ই।’ ছেলেটি জবাব দিল। ‘ঠিক বলেছ।’ উনিশ কুড়ি বছর বয়স হবে ছেলেটির। তার লম্বাটে মুখ। রোদে পুড়ে হাল্কা বাদামি দাগ হয়েছে। পাখির মতো চোখা তার নাক। তার বুক অবশ্য খুব বেশি রোদে পোড়া নয়। সেখানেও বাদামি দাগ পড়েছে। তার চুলগুলো সামান্য লাল। ডান হাতে তার লাইটারটি ধরে রেখেছে। তার চাকা ঘষা দেবে দেবে করছে। ‘আমি কখনওই ব্যর্থ হইনি।’ সে বলল হাসতে হাসতে। একটু গর্ব করে বলল।’ আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি―এটা জ্বালতে ব্যর্থ হব না।’

‘এক মিনিট প্লিজ।’ ট্রাফিক পুলিশের হাত যেরকম করে গাড়ি থামায় ঠিক সে রকম করে সিগার ধরা হাতটি উঁচু করলেন তিনি। ‘এখন এক মুহূর্ত মাত্র।’ তার গলাটি ছিল কৌতূহলপূর্ণ নরম তবে চড়া নয়। পুরোটা সময়েই তিনি ছেলেটির দিকে চোখ পেতে রেখেছেন।

‘আমরা কি এটার উপরে একটা ছোটখাটো বাজি ধরব নাকি ?’ তিনি ছেলেটির দিকে তাকিয়ে হাসলেন। ‘তোমার লাইটারটি জ্বলে কি না সেটা নিয়ে একটি ছোটখাটো বাজি ধরব ?’

‘অবশ্যই। বাজি ধরব আমি।’ ছেলেটি বলল, ‘কেন ধরব না ?’

‘তুমি কি বাজি ধরতে পছন্দ করছ ?’

‘নিশ্চয়ই, আমি সব সময়েই বাজি ধরি।’

লোকটি থামলেন। সিগারটি পরীক্ষা করলেন। আমাকে অবশ্যই বলতে হচ্ছে যে, লোকটির ভাবসাব মোটেই ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে তিনি এর বাইরে কিছু একটা করতে চাইছেন। ছেলেটিকে বিব্রত করছেন। একই সঙ্গে তিনি তার কোনও ব্যক্তিগত গোপন ধান্দা তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছেন বলেও আমার কেন জানি সন্দেহ হচ্ছে।

ছেলেটির দিকে তিনি আবার তাকালেন। আর ধীরেসুস্থে বললেন, ‘আমিও বাজি ধরতে পছন্দ করি। কেন আমরা বিষয়টা নিয়ে ভালো একটা বাজি ধরছি না ? খুব বড়সড়ো একটা বাজি।’

‘এখন, এক মিনিট দাঁড়াও।’ ছেলেটি বলল। ‘আমি সেটা করতে পারি না। কিন্তু আমি পঁচিশ সেন্ট বাজি ধরব। এমনকি এক ডলার পর্যন্ত ধরব তোমার জন্য। অথবা এখানে শিলিং হিসেবে যা আসে তাই ধরা যায়―আমি অনুমান করছি।’

খাটো লোকটি তার হাতটা আবার নাড়ালেন। ‘কথা কোনও। এখন কিছু মজা করছি। আমরা একটা বাজি ধরি। তারপর চলো হোটেলে আমার ঘরে। সেখানে কোনও ঝোড়ো হাওয়া নেই। তুমি একবারও ব্যর্থ না হয়ে একটানা দশবার তোমার বিখ্যাত লাইটারটি জ্বালাতে পারবে না―এটা আমার বাজি।’

‘আমি বাজি ধরে বলতে পারি আমি পারব।’ ছেলেটি উত্তর দিল।

‘ঠিক আছে। ভালো। তাহলে আমরা একটা বাজি ধরছি, ঠিক ?’

‘অবশ্যই। আমি তোমাকে এক ডলার বাজি ধরব।’

‘না। না। আমি তোমার জন্য খুব ভালো একটা বাজি বানাব। আমি একজন ধনী মানুষ। আর খেলুড়েও বটে। শোনো। হোটেলের বাইরে আমার গাড়ি আছে। খুব ভালো গাড়ি। তোমার মার্কিনি দেশের গাড়ি। ক্যাডিলাক।’

‘দাঁড়াও একটুক্ষণ। ‘ছেলেটি তার ডেক চেয়ারে হেলান দিয়ে হাসল। ‘ওই মাল বাজিতে দিতে পারি না। এটা স্রেফ পাগলামি।’

‘মোটেই পাগলামি নয়। তুমি লাইটারটি পরপর দশবার ঘষে সফলভাবে জ্বালাবে। আর গাড়িটা তোমার হয়ে যাবে। এই ধরনের ক্যাডিলাক গাড়ির মালিক হতে ইচ্ছে করে না তোমার, হ্যাঁ কি না বলো ?’

‘নিশ্চয়। একটা ক্যাডিলাক গাড়ি পেতে ইচ্ছে করে।’ তখনও দাঁত বের করে হাসল ছেলেটা।

‘ঠিক আছে। ভালো কথা। আমরা বাজি ধরছি। আমি বাজির দান রাখছি আমার ক্যাডিলাক গাড়ি।’

‘তাহলে আমি কী বাজি রাখব ?’

খাটো লোকটি তার না ধরানো সিগারে তখনও লেগে থাকা লাল ফিতেটা সাবধানে খুলে ফেলল। ‘আমি কখনও তোমার সামর্থ্যরে বাইরে কিছু বাজি ধরতে বলিনি, বন্ধু। বুঝেছ ?’

‘তাহলে কী ধরব ?’

‘তোমার জন্য সহজ করে দিচ্ছি, ঠিক ?’

‘ঠিক, তুমি তাহলে সহজ করে দাও।’

‘খুব ছোট জিনিস―দেওয়ার সামর্থ্য আছে তোমার, ঘটনাচক্রে তুমি যদি বাজিতে হেরে যাও তাহলে তার জন্য খুব খারাপ বোধ করবে না। ঠিক ?’

‘কী রকম ?’

‘ধরো, হয়তো, তোমার বাঁহাতের কড়ে আঙুল।’

‘কী, আমার ?’ ছেলেটি হাসি থামাল।

‘হ্যাঁ, কেনো নয় ? তুমি জিতলে গাড়ি নেবে। আমি জিতলে আঙুল নেব।’

‘আমি বুঝতে পারছি না। তুমি কীভাবে এটা বললে―তুমি আঙুল নেবে ?’

‘কেটে নেব।’

‘হা ঈশ্বর! এ দেখি পাগলা বাজি। আমার তো মনে হয় আমি এই বাজির জন্য এক ডলারের বেশি ধরব না।’

খাটো লোকটি চেয়ারে এলিয়ে বসলেন। তার হাতের তালু দুটো সামনের দিকে খুলে দিলেন। তারপর অবজ্ঞা ভরে তার কাঁধ নাচালেন। ‘বেশ। বেশ। বেশ।’ তিনি বললেন, ‘আমি বুঝতে পারছি না। তুমি বলছ যে, ওটা জ্বলবেই। তবু বাজিটা ধরছ না কেন ? তাহলে এটা বাদ দেব, তাই না ?’

ছেলেটি শান্ত হয়ে বসে রইল। তাকিয়ে রইল পুলে স্নানরতদের দিকে। তারপর হঠাৎ করে মনে পড়ল সে সিগারেটটি ধরায়নি। সে ঠোঁটে রাখল ওটা। লাইটা হাতের মধ্যে রাখল। চাকাটা ঘষা দিল। শলতে জ্বলে উঠল। ছোট, স্থির ও হলুদ আলো ধরল। হাতের মধ্যে এমনভাবে ধরে রাখল যাতে বাতাস মোটেই তার নাগাল পেল না।

‘আমি কি লাইটারটা পেতে পারি ?’ আমি শুধালাম।

‘ওহো, দুঃখিত। আপনার যে লাইটার নেই সেটা ভুলে গেছি।’

লাইটারটার জন্য আমি হাত বাড়ালাম। কিন্তু সে উঠে দাঁড়াল। উঠে এসে নিজেই জ্বালিয়ে সিগারেট ধরিয়ে দিল।

‘ধন্যবাদ।’ তাকে বললাম। সে নিজের আসনে ফিরে গেল।

‘তুমি কি এখন ভালো বোধ করছ ?’

‘ভালোই।’ সে উত্তর করল। ‘এখানে খুব ভালো লাগছে।’

এরপর স্তব্ধতা নেমে এল। আর আমি দেখতে পারলাম, খাটো লোকটি তার বিদঘুটে প্রস্তাব দিয়ে ছেলেটিকে যথেষ্ট বিব্রত করতে সফল হয়েছে। সে সেখানে স্থির হয়ে বসে রইল। এটা স্পষ্ট যে তার মধ্যে এক ধরনের সামান্য উত্তেজনার জন্ম হচ্ছে। তারপর সে তার চেয়ার থেকে উঠি উঠি করল। আর তার বুক ঘষল। তার ঘাড়ে থাবড়া মারল। শেষে সে তার হাত দুটি হাঁটুর উপর রাখল। এবং আঙুল দিয়ে হাঁটুর বাটি টুকটুক করল। অচিরেই সে তার এক পাও টিপল।

‘তাইলে এখন, তোমার বাজিটা নিয়ে ভেবে দেখতে দাও।’ অবশেষে সে বলে উঠল। ‘তুমি বলেছ―তোমার ঘরে আমাদের যেতে হবে। যদি আমি টানা দশবার লাইটারটা ধরাতে পারি তাহলে ক্যাডিলাকটা আমার হয়ে যাবে। যদি আমি একবার ধরাতে না পারি তবে আমার বাঁহাতের কড়ে আঙুলটা হারাব। এই তো কথা ?’

‘নিশ্চয়ই। এটাই হলো বাজিটা। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে তুমি ভড়কে গেছ।’

‘আমি হেরে গেলে তুমি কী করবে ? যখন তুমি কাটবে তখন কি আমাকে আঙুলটি সোজা করে রাখতে হবে ?’

‘আরে না। সেটা ঠিক হবে না। তুমি হয়তো সেটা ধরে রাখতে চাইবে না। ধরে রাখার মতো অবস্থায় থাকবে না। আমি কী করব জানো―কাটা শুরু করার আগে আমি টেবিলে তোমার হাত বেঁধে ফেলব। সেখানে আমি দাঁড়িয়ে থাকব ছুরি হাতে। যদি তুমি লাইটার জ্বালাতে ব্যর্থ হও তবে তক্ষুনি আঙুলটা কাটার জন্য তৈরি থাকব।

‘ক্যাডিলাকটা কোন বছরের ?’ ছেলেটি জানতে চাইল।

‘দুঃখিত, আমি বুঝতে পারছি না।’

‘কোন বছর―কত বছর বয়স এই ক্যাডিলাকের ?’

‘ও। কত পুরনো ? হ্যাঁ―গত বছরের তৈরি। সম্পূর্ণ নতুন। কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছি, তুমি ঠিক বাজি ধরার মতো মানুষ নও। মার্কিনিরা কখনও হয় না।’

ছেলেটি একটু থামল। সে ইংলিশ মেয়েটির দিকে চকিতে তাকাল। তারপর চেয়ে দেখল আমাকে। ‘হ্যাঁ,’ সে জোরালোভাবে বলল,’ আমি বাজি ধরব।’

‘এই তো চাই।’ খাটো লোকটি শান্ত ভঙ্গিতে হাততালি দিয়ে উঠল। ‘ভালো।’ তিনি বললেন, ‘আমরা এখনি বাজিটা খেলব।’ ‘আর আপনি’, তিনি আমার দিকে ফিরলেন। বললেন, ‘আমার মনে হয় আপনি হলেন সেই উপযুক্ত লোক, যাকে কী বলে―রেফারি।’ তার মুখখানা বেশ ফ্যাকাসে। রঙহীন তার চোখ―খুব হালকা কালচে মণি সেখানে।

‘বেশ,’ আমি বললাম। ‘এটা উন্মাদ ধরনের খেলা―আমার মনে হচ্ছে। আমার মনে হয় না খেলাটিকে আমি খুব বেশি পছন্দ করব।’

‘না। না। আমিও।’ ইংলিশ মেয়েটি উঠল। এই প্রথম সে মুখ খুলল। আমার মনে হয় এটা নির্বোধ, হাস্যকর বাজি খেলা।

‘ছেলেটা হেরে গেলে আপনি কি সত্যি সত্যি ছেলেটার আঙুল কেটে নেবেন ?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

‘অবশ্যই নেব।’ সে জিতে গেলে ক্যাডিলাকটা তাকে দিয়ে দেব। চলুন এখন। আমার ঘরে যাওয়া যাক।

তিনি উঠে দাঁড়ালেন। ‘তুমি কিছু জামাকাপড় পরে নিতে পারো।’ তিনি বললেন।

‘না,’ ছেলেটি উত্তর দিল। ‘আমি এভাবেই যাব।’ তারপর সে আমার দিকে ফিরল। ‘আপনি যদি আসেন―রেফারি হন―তবে সেটা আমার ভালো লাগবে।’

‘ঠিক আছে।’ আমি বললাম। ‘আমি আসছি। কিন্তু বাজি খেলাটিকে আমি মোটেই পছন্দ করছি না।’

‘তুমিও আসো।’ সে মেয়েটিকে বলল। ‘এস―দেখো।’

বাগানের মধ্যে দিয়ে হোটেলের দিকে খাটো লোকটি আগে আগে পথ দেখিয়ে চললেন। এখন তিনি জন্তুর মতো প্রাণবন্ত, উত্তেজিত। এর আগে তিনি গোড়ালি তুলে যতটা লাফ দিয়ে দিয়ে হাঁটছিলেন তার চেয়েও এখন বড় বড় লাফ দিচ্ছেন এই উত্তেজনায়।

‘আমি হোটেলের বাড়তি অংশে থাকি।’ তিনি জানালেন। ‘তোমরা কি আগে গাড়িটিকে দেখতে চাও ? এটা এখানেই।’

যাতে আমরা গাড়িটি দেখতে পারি সেজন্য হোটেলের সামনের ড্রাইভওয়েতে তিনি আমাদের নিয়ে গেলে। তিনি থামলেন। সেখানে পার্ক করা একটি চকচকে হালকা সবুজ ক্যাডিলাক গাড়ি দেখালেন।’

‘এটা সেই গাড়ি। সবুজ গাড়ি। পছন্দ হচ্ছে তোমার ?’

‘হ্যাঁ, ওটা খুবই সুন্দর গাড়ি।’ ছেলেটা বলল।

‘ঠিক আছে। এখন এগিয়ে চলো। দেখি তুমি তাকে জিতে নিতে পারো কি না।’

আমরা তার পিছু পিছু হোটেলের বাড়তি অংশে গেলাম। তারপর একটি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলাম। তিনি দরোজা খুললেন। আমরা বেশ বড় সড়ো একটা ডাবল রুমে ঢুকে পড়লাম। একটা বিছানার নিচে একজন মহিলার কাপড় পড়ে ছিল।

‘শুরুতে,’ তিনি বললেন, ‘আমরা সামান্য একটু মারটিনি পান করি।’

একটু দূরে ছোট একটা টেবিলে পানীয়টা রাখা আছে। সেটা মেশানোর জন্য একটি নাড়নকাঠি, বরফ আর অনেকগুলো গ্লাস রেডি আছে। তিনি মারটিনি তৈরি করা শুরু করলেন। কিন্তু এর মধ্যে তিনি বেল বাজালেন। তখন দরোজায় করাঘাতের শব্দ হলো। একজন কালো পরিচারিকা এল।

‘আহ।’ জিনের বোতলটা নামাতে নামাতে বললেন। পকেট থেকে মানি ব্যাগ নিয়ে এক পাউন্ডের নোট বের করলেন। ‘তুমি আমার জন্য কয়েকটি কাজ করবে প্লিজ।’ তিনি পরিচারিকাকে পাউন্ডটি দিলেন।

‘তুমি ওটা রাখো।’ সে বলল। ‘এখানে আমরা এখন ছোট একটি খেলা খেলতে যাচ্ছি। আমি চাই তুমি যাও। গিয়ে আমার জন্য দুটো―তিনটে রিং নিয়ে এসো। কয়েকটি পেরেক দরকার। দরকার একটা হাতুড়ি আর ধারালো ছুরি। রান্নাঘর থেকে মাংস কাটা ছুরি চেয়ে আনবে। ঠিকঠাক বুঝতে পেরেছ ?’

‘একটি ধারালো ছুরি ?’ পরিচারিকা বড় বড় চোখ করে বলল। তার হাত দুটো সামনে জোড়া করে রাখল। ‘তুমি কি সত্যি সত্যি একটা ধারালো ছুরি চাইছ ?’

‘হ্যাঁ। হ্যাঁ। অবশ্যই। নিয়ে এস প্লিজ। তুমি ঐসব রিং আমার জন্য খুঁজে আনবে।’

‘হ্যাঁ স্যার। আমি চেষ্টা করব স্যার। অবশ্যই সেগুলো পাওয়ার চেষ্টা করব।’ এরপর সে চলে গেল।

খাটো লোকটি মারটিনি সবার হাতে হাতে পৌঁছে দিলেন। আমরা সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চুমুক দিতে লাগলাম। সেই রোদে পোড়া লম্বাটে মুখ আর চোখা নাকবিশিষ্ট ছেলেটিও চুমুক দিচ্ছিল। তার পরনে শুধু একজোড়া হালকা রঙের স্নানের খাটো প্যান্ট। শরীরটা নগ্ন। লম্বা মেয়েটার মাথায় সুন্দর চুল। তার পরনে হালকা নীল স্নানের পোষাক। সে তার চশমার উপর দিয়ে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আছে পুরোটা সময়। খাটো লোকটার পরনে শুভ্র পোষাক। তার চোখ বর্ণহীন। সেখানে দাঁড়িয়ে তার মারটিনি পান করছেন। আর হালকা নীলচে স্নানের পোশাক পরা মেয়েটাকে দেখছেন। আমি জানি না এটা কীভাবে খেলা হবে। দেখে মনে হচ্ছে লোকটা বাজির ব্যাপারে সিরিয়াস। আর সিরিয়াস মনে হচ্ছে ছেলেটার আঙুল কাটার ব্যাপারেও। কিন্তু ছেলেটা যদি হারে কী নারকীয় ব্যাপার ঘটবে ? তখন তাকে দ্রুত তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে সেই ক্যাডিলাক গাড়িতে করে যেটা সে জিতে নিতে পারেনি। এটা অবশ্য খুব ভালো কাজই হবে। এই সময়ে সত্যি সত্যি এটা ভালো কাজ হবে না ? যত দেখতে পারছি তাতে মনে হয় এটা জঘন্য নির্বোধ ফালতু ব্যাপার।

‘তুমি কি মনে করো না যে এটা নিঃসন্দেহে ফালতু বাজি ?’ আমি বললাম।

‘এটা খুবই ভালো একটা বাজি বলেই আমি করি।’ ছেলেটি উত্তর দিল। এর মধ্যে সে বেশ খানিকটা মারটিনি খেয়ে ফেলেছে।

‘আমি মনে করি এটা একটা বেকুবি আর হাস্যকর বাজি।’ মেয়েটি বলল। ‘যদি তুমি হেরে যাও তবে কী ঘটবে ?’

‘তাতে কিছু আসে যায় না। বিষয়টা নিয়ে ভেবে দেখা যাক। আমার বাঁহাতের কড়ে আঙুলটা আমার জীবনে কোনও কাজে লেগেছে বলে আমার মনে পড়ে না। এই যে এটা।’ ছেলেটা আঙুলটা তুলে ধরল। ‘এটা এই যে। এখন পর্যন্ত এটা আমার কোনও কাজে লাগেনি। তাহলে কেন আমি তাকে বাজিতে ধরব না। আমার ধারণা এটা খুবই ভালো একটা বাজি।’

খাটো লোকটি হাসল। মিশ্রিত পানীয় তুলে নিল। সবার গ্লাস আবার ভরে দিল।

‘শুরু করার আগে’, তিনি বললেন, ‘আমি গাড়ির চাবিটা রে… রে… রেফারির কাছে দেবো।’ পকেট থেকে একটা গাড়ির চাবি বের করে আমাকে দিলেন। ‘কাগজপত্র’, তিনি বললেন, ‘ মানে গাড়ির মালিকানার কাগজপত্র আর ইনস্যুরেন্স গাড়ির পকেট কে’সে আছে।’

তখন কালো পরিচারিকাটি আবার এল। তার একহাতে কসাইদের হাড়কাটার ধারালো ছুরি এবং অন্য হাতে একটা হাতুড়ি আর এক ব্যাগ পেরেক।

‘ভালো। তুমি সব জোগাড় করেছ। ধন্যবাদ। তোমাকে ধন্যবাদ। এখন তুমি যেতে পারো।’

পরিচারিকাটি দরজা বন্ধ করা অবধি তিনি অপেক্ষা করলেন। তারপর জিনিসপত্র একটা বিছানায় রাখলেন। বললেন, ‘তাহলে এখন আমরা আমাদের প্রস্তুত করি, ঠিক ?’ এবং ছেলেটিকে বললেন, ‘আমাকে একটু সহযোগিতা করো প্লিজ। টেবিলটা একটু সরিয়ে নেব।’

এটা হোটেলের লেখালেখি করার জন্য সাধারণ একটা টেবিল―আড়াই ফুট বাই তিন ফুট। আয়তাকার। উপরে শুষণি কাগজ, কালি, কলম আর কাগজ রাখা আছে। দেওয়ালের কাছ থেকে ওটা সরিয়ে ঘরের মাঝখানে তারা নিয়ে গেল। লেখার জিনিসপত্র সরিয়ে ফেলল।

‘তাহলে এখন,’ তিনি বললেন, ‘একটি চেয়ার,’ তিনি একটা টেনে এনে টেবিলের পাশে রাখলেন। তিনি খুব প্রাণবন্ত আর উদ্দীপ্ত হয়ে কাজ করছেন, যেন বাজি নয়―বাচ্চাদের উৎসবের জন্য একটি খেলার আয়োজন করছেন।

‘এই এবার, তিনি বললেন,’ পেরেকের মধ্যে আমি অবশ্যই রাখব।’ তিনি পেরেকগুলো বের করলেন। হাতুড়ি দিয়ে টেবিলের উপরে পেরেক পেটাতে শুরু করলেন।

আমরা সেখানে দাঁড়িয়ে আছি। আমরা মানে ছেলেটি, মেয়েটি, আর আমি, আমাদের হাতে মারটিনি ধরে আছি। খাটো লোকটার কাজ-কারবার লক্ষ করছি। টেবিলে ছয় ইঞ্চি দূরে দূরে দুটি পেরেক পুততে দেখলাম তাকে আমরা। বাড়িঘরের কাজে যেভাবে পেরেক পুরোটা পোতা হয় সেভাবে তিনি পুতলেন না। কিছুটা উপরের দিকে আপোতা রেখে দিলেন। কতটা শক্ত হয়েছে তা তার আঙুল দিয়ে পরীক্ষা করে দেখলেন।

‘যে কেউ দেখলে বুঝতে পারবে কুত্তার বাচ্চাটি এই ধরনের কাজ আগেও করেছে’―মনে মনে বললাম। তিনি মোটেই ইতস্তত করলেন না। টেবিল, পেরেক, হাড়কাটা ছুরি―কী কী তার দরকার আর সেগুলো কীভাবে ব্যবহার করতে হয় তা সব জানা আছে তার।

‘তাহলে এখন,’ তিনি বললেন, ‘আমাদের দরকার কিছু দড়ি।’ তিনি কিছু দড়ি খুঁজেও পেলেন। ‘ঠিক আছে, অবশেষে সবকিছু প্রস্তুত হয়েছে।’ ছেলেটিকে বললেন, ‘তুমি এই টেবিলের কাছে এসে বসো প্লিজ।’

ছেলেটি তার গ্লাস দূরে রেখে এসে বসল।

‘এখন দুই পেরেকের মাঝখানে তোমার বাঁ হাত রাখো। তোমার হাতটা ওখানে বেঁধে রাখার জন্যই পেরেক পুতেছি। ঠিক আছে, ভালো। এখন টেবিলের উপর তোমার হাতটি আমি দড়ি দিয়ে বাঁধব যাতে সেটা নড়াচড়া না করতে পারো।’

তিনি ছেলেটির কবজিতে দড়ি পেচালেন। দড়ির লম্বা অংশটি দিয়ে তার হাতে অনেকগুলো প্যাঁচ কষলেন। তারপরে সেটা পেরেকের সঙ্গে গিট দিলেন। খুব ভালোভাবে কাজটি করলেন। যখন তার কাজ শেষ হলো তখন ছেলেটি তার হাত নড়াচড়া করতে পারল না। তবে আঙুলগুলো নড়াতে পারল।

‘এখন কড়ে আঙুল ছাড়া অন্য আঙুলগুলো গুটিয়ে নাও প্লিজ। কড়ে আঙুলটা টেবিলে শোয়ানো অবস্থায় রাখো।’

‘চমৎকার। চমৎকার। আমরা এখন প্রস্তুত। তুমি ডান হাত দিয়ে লাইটারটা ব্যবহার করতে পারবে। একটুক্ষণ অপেক্ষা করো। প্লিজ।’

তিনি বিছানা টপকে ছুরিটা নিলেন। তারপর ছুরিটা হাতে নিয়ে টেবিলের পাশে দাঁড়ালেন।

‘আমরা সবাই তাহলে প্রস্তুত ?’ তিনি বললেন, “মিস্টার রেফারি, আপনি অবশ্যই ‘শুরু’ ঘোষণা করবেন।”

ছেলেটার চেয়ারের পাশে হালকা নীল স্নানের পোষাক পরে ইংলিশ মেয়েটি দাঁড়িয়েছে। সে শুধু সেখানে দাঁড়িয়ে আছে, তার মুখে কোনও কথা নেই। ছেলেটি শান্তভাবে বসে আছে। তার ডান হাতে লাইটারটি ধরে রেখে ছুরিটার দিকে তাকাচ্ছে। খাটো লোকটি আমার দিকে তাকালেন।

‘তুমি কি প্রস্তুত ?’ ছেলেটির কাছে জানতে চাইলাম।

‘আমি প্রস্তুত।’

‘আর তুমি ?’ খাটো লোকটিকে জিজ্ঞেস করলাম।

‘সম্পূর্ণ প্রস্তুত’, বলে তিনি ছুরিটি শূন্যে তুললেন। ছেলেটির আঙুল থেকে দুই ফুট উপরে ছুরিটা উঁচিয়ে রাখলেন ফস করে কাটার জন্য। ছেলেটি সেটা লক্ষ্য করল। কিন্তু চমকালো না। তার মুখ মোটেই কাঁপল না। কেবল তার ভ্রুগুলো উপরে তুলল। একটু কোঁচকালো।

‘সব ঠিকঠাক।’ বললাম আমি। ‘শুরু করো।’

ছেলেটি বলল, ‘আমি কতবার জ্বালচ্ছি তা আপনি একটু জোর গলায় গুণবেন প্লিজ।’

‘হ্যাঁ’, বললাম আমি। ‘আমি সেটা করব।’

বুড়ো আঙুল দিয়ে সে লাইটারের উপরটা উঁচু করল। আবার বুড়ো আঙুলটি দিয়ে সে লাইটারের চাকাটিকে সজোরে ঘষা দিল। স্ফুলিঙ্গ বের হলো। শলতেয় আগুন স্পর্শ করল। হলুদ রঙের ছোট একটা শিখা জ্বলে উঠল।

এক!― আমি ডাক দিলাম।

সে খুব জোরে চাকাটি ঘষল। আরেকবার ছোট শিখা জ্বলে উঠল শলতেয়।

দুই!

কেউ কিছু বলছে না। ছেলেটি লাইটারের দিকে চোখ রেখে আছে। খাটো লোকটি ছুরিটা শূন্যে উঁচিয়ে রেখেছেন। তিনিও লাইটারের দিকে চোখ পেতে আছেন।

তিন!

চার!

পাঁচ!

ছয়!

সাত!

সম্ভবত এটা খুব কাজের লাইটার। ঘর্ষণে বড় স্ফুলিঙ্গ বের হয়। আর শলতেটাও ঠিক মতো দূরত্বে আছে। আমি খেয়াল করছি বুড়ো আঙুলটা ফট করে উপর থেকে নিচের দিকে সরে এসে স্ফুলিঙ্গ বের করছে। তারপর একটু থামছে। তারপর বুড়ো আঙুলটি উপরে গেল আরেকবার। এটা হলো পুরোপুরি বুড়ো আঙুলের কাজ। বুড়ো আঙুলটি সবকিছু করছে। আমি একটি শ্বাস নিলাম। প্রস্তুত হলাম আট বলার জন্য। বুড়ো আঙুলটি চাকা ঘোরাল। ছোট স্ফুলিং বের হলো।

‘আট!’ বললাম আমি।

বলার সঙ্গে সঙ্গে দরজাটি খুলে গেল। আমরা সবাই দরজার দিকে ঘুরে একজন মহিলাকে দাঁড়ানো দেখতে পেলাম। কালো চুলের ছোটখাটো মহিলা। নিঃসন্দেহে বয়স্ক। সেখানে দুই সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থাকলেন। তারপর চেঁচিয়ে ‘কার্লোস! কার্লোস’ বলতে বলতে ছুটে এলেন। তিনি তার কবজি থাবা দিয়ে ধরলেন। তার হাত থেকে ছুরিটা কেড়ে নিয়ে বিছানার উপর ছুড়ে ফেললেন। তার সাদা স্যুটের কলার টেনে ধরলেন। তারপর খুব জোরে জোরে তাকে ঝাঁকাতে লাগলেন। তার দিকে দ্রুত লয়ে আর গলা উঁচিয়ে কথা বলতে লাগলেন। স্প্যানিশ জাতীয় ভাষায় তিনি প্রচণ্ডভাবে বাক্য ছোটালেন পুরো সময় জুড়ে। এত জোরে জোরে তিনি ঝাঁকালেন যে তাকে আর দেখতে পারা গেল না। তিনি ফ্যাঁকাসে হয়ে গেলেন। অস্পষ্ট আর ঘুরন্ত চাকার স্পোকের মতো দ্রুত নড়াচড়া করা একটা রেখা চিহ্ন হয়ে গেলেন।

তারপর মহিলাটি ঝাঁকি দেওয়া কাজটি একটু কমালেন। আর তখনি সেই খাটো লোকটাকে আবার দেখতে পাওয়া গেল। তাকে ঘরের মধ্য থেকে টেনে হিচড়ে নিলেন। তারপর ধাক্কা মেরে তাকে একটা বিছানায় ছুড়ে দিলেন। তিনি খাটের ধারে বসে চোখ পিটপিট করতে লাগলেন। তার ঘাড়ে তার মাথাটি ঠিক মতো আছে কি না সেটা পরীক্ষা করে দেখলেন।

‘খুব দুঃখিত আমি।’ মহিলাটি বললেন। ‘এই ঘটনার জন্য আমি ভয়ংকরভাবে দুঃখিত।’ তিনি চোস্ত ইংরেজিতে বললেন।

‘এটা খুবই খারাপ ঘটনা হয়েছে।’ তিনি বলে চললেন, ‘মনে হয় আমার ভুলেই এটা ঘটেছে। মাত্র দশ মিনিটের জন্য আমি তাকে একা রেখে গিয়েছিলাম। চুল পরিষ্কার করে ফিরে এসেছি। এর মধ্যে সে একই ঘটনা ঘটাল।’ তাকে অত্যন্ত দুঃখিত দেখাচ্ছিল। দেখাচ্ছিল গভীরভাবে উদ্বিঘ্ন।

ছেলেটি ততক্ষণে টেবিল থেকে তার হাতের বাঁধন খুলছিল। ইংলিশ মেয়েটি আর আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি।

‘সে ভয়ংকর মানসিক রোগী।’ মহিলাটি বললেন। ‘এর আগে আমরা যেখানে থাকতাম সেখানে বিভিন্ন ধরনের লোকের সাতচল্লিশটি আঙুল কেটে নিয়েছে। এগারোটি গাড়ি হেরেছে। তারপর তারা তাকে ওই এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার হুমকি দিয়েছে। এজন্য তাকে এই এলাকায় নিয়ে এসেছি।’

‘আমরা কেবল ছোট একটি বাজি ধরেছিলাম।’ বিছানা থেকে খাটো লোকটি বিড়বিড় করে বললেন।

‘আমার মনে হয় সে তোমার সঙ্গে একটি গাড়ি বাজি রেখেছিল।’ মহিলাটি শুধালেন।

‘হ্যাঁ।’ ছেলেটি জবাব দিল। ‘একটি ক্যাডিলাক।’

‘তার কোনও গাড়ি নেই। ওটা আমার গাড়ি। আর সেটা ওটাকে অসৎ কাজে ব্যবহার করছে।’ তিনি বললেন, ‘বাজি ধরার তার নিজের কিছু নেই বলে গাড়িটা বাজি ধরেই। আমি লজ্জিত। এর জন্য খুবই দুঃখিত।’ তিনি সম্ভ্রম জাগানিয়া সুন্দর একজন মহিলা।

‘বেশ।’ আমি বললাম, ‘তাহলে এখন এই যে আপনার গাড়িটা চাবি।’ বলে টেবিলের উপর চাবিটা রাখলাম।

‘আমরা খুব ছোট একটা বাজি খেলছিলাম।’ বিড়বিড় করে বলেই চলছিলেন খাটো লোকটি।

‘বাজি ধরার মতো তার কিছুই নেই।’ মহিলাটি বললেন, ‘এ জগতে তার কোনও কিছু নেই। এক কানা কড়িও নেই। সত্যি বলতে কি অনেক অনেক আগে আমি তার কাছ থেকে সবকিছু জিতে নিয়েছি। অনেক সময় লেগেছে এতে―অনেক অনেক সময়। এটা বেশ কঠিন কাজ ছিল। শেষপর্যন্ত আমি সবকিছু জিতে নিয়েছি।’ ছেলেটির দিকে তাকিয়ে মহিলাটি হাসলেন। ধীর লয়ে বিষাদ মাখা সেই হাসি। তারপর হেঁটে এগিয়ে গেলেন। টেবিলের উপর থেকে হাত দিয়ে চাবিটা নিলেন।

ঠিক তখনই আমি দেখতে পেলাম, তার হাতে―কেবল একটিই মাত্র আঙুল আছে। আর সেটা হলো তার বুড়ো আঙুলটি।

নিউইয়র্ক থেকে

সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button