অনুবাদ গল্পআর্কাইভবিশ্বসাহিত্য

সমকালীন আমেরিকান অণুগল্প : লিডিয়া ডেভিস

অনুবাদ গল্প

বাংলা অনুবাদ : ফারহানা আনন্দময়ী

[লিডিয়া ডেভিস আমেরিকার ম্যাসাচুসেটে জন্মগ্রহণকারী একজন জনপ্রিয় ছোটগল্প লেখক, ঔপন্যাসিক ও অনুবাদক। জন্ম ১৫ জুলাই ১৯৪৭। বর্তমানে নিউ ইয়র্ক শহরে বাস করেন। আমেরিকা অ্যাকাডেমি অফ আর্টস অ্যান্ড লেটারস থেকে ২০১৩ সালে ‘অ্যাওয়ার্ড অফ মেরিট’ লাভ করেছেন। এবং ‘ম্যান বুকার’ আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন গল্পগ্রন্থের জন্য।

The Collected Stories, Can’t and Won’t, Essays One তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহ।]

The Visitor আগন্তুক

আমরা জানতাম, গ্রীষ্মের ঠিক শুরুর মুখে একজন আগন্তুক আসবেন আমাদের বাড়িতে। কিছুদিন থাকবেন এখানে, অতিথি হয়ে। আগে কখনও আমরা তাকে দেখিনি তবে জানতাম―মানুষটির টাক মাথা, স্বভাবে কিছুটা অসংলগ্ন, অসংযমী, কথাবার্তা একেবারেই বলেন না―বলতে গেলে এবং নিজের কাজ নিজে করতে অসমর্থ। সবকিছুর জন্যেই তাকে নির্ভর করতে হয় অন্যের ওপরে। আমরা কিন্তু জানতাম না, ঠিক কতদিন তিনি আমাদের সঙ্গে আমাদের বাড়িতে থাকবেন। তবে এটা জানা ছিল, শুধু থাকা তো নয়, তার খাওয়া-পরা সবই আমাদের দায়িত্বে।

এ প্রসঙ্গে মনে পড়ল, একেবারে হাড্ডি-চামড়া লেগে যাওয়া এক ভারতীয় বৃদ্ধ এরকমই থাকতেন আমার বোনের বাড়িতে, লন্ডনে। বেশ কবছর আগের কথা এটা। প্রথম প্রথম তিনি থাকতেন বোনের বাড়ির পেছনের উঠোনটায়, তাঁবু খাটিয়ে। পরে তিনি বাড়ির ভেতরে থাকা শুরু করলেন। এমনি এমনি থাকতেন না, একটা কাজ বুঝে নিয়েছিলেন। বোনের সব বই তিনি বিষয়ভিত্তিক সাজিয়ে বইয়ের তাকে গুছিয়ে দিলেন। রহস্য, ইতিহাস, গল্প-উপন্যাস―এভাবে আলাদা আলাদাভাগে ভাগ করে গুছিয়ে রাখলেন। কাজটি যখন তিনি করতেন, প্রচুর ধুমপান করতেন; এত বেশি যে, সিগারেটের ধোঁয়ায় ভরে থাকত পুরো ঘরটা। কেউ যখন সেই ঘরে ঢুকে তার কাজের ধরন সম্পর্কে জানতে চাইত তখন তিনি বলতেন ঠিকই তবে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে, একটু থেমে থেমে। কয়েক বছর পরে লোকটি রোগে ভুগে কষ্ট পেয়ে মারা যান, লন্ডনের এক হাসপাতালে। নিজস্ব ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে নিজের জন্য সকল প্রকার চিকিৎসা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তিনি।

বোনের বাড়িতে থাকা ওই আগন্তুকের ঘটনাটা আমাকে মনে করিয়ে দেয় আরেকজন মানুষের কথা। আমার বন্ধুর বৃদ্ধ বাবার কথা। এতটাই বয়সি, আমার বন্ধু যখন শিশু তখনও তিনি বৃদ্ধ ছিলেন। কানে শুনতে পেতেন না। অর্থনীতির অধ্যাপক ছিলেন। বার্ধক্য তাকে এমন অবস্থায় নিয়ে গেল, জীবনের একটা পর্বে পৌঁছে নিজের পেশাব আর তিনি ধরে রাখতে পারতেন না―যখন তখন যেখানে সেখানে পেশাব করে দিতেন। একবার হলো কী, তার মেয়ের বিয়ের আসরে তাকে কিছু বলতে বলা হলো। তিনি কেমন অদ্ভুতভাবে নিঃশব্দে হাসতেই লাগলেন আর সাম্যবাদ নিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন। শুনেছি, এখন তিনি একটা নার্সিং সেন্টারে থাকেন। আমার বন্ধুটি জানায়, তিনি নাকি আকারে ছোট থেকে ছোটতর হয়ে যাচ্ছেন দিনকে দিন।

আমাদের বাড়িতে অতিথি হয়ে যে আগন্তুকটি আসবেন, তিনিও আমার বন্ধুর বাবাটির মতো। নিজে বাথরুমে যেতে পারবেন না। আমাদেরই স্নান করিয়ে দিতে হবে তাকে। রোদ-হাওয়া আসা-যাওয়া করতে পারে এমন একটি খোলামেলা ঘর আমরা গুছিয়ে রেখেছি তার জন্য, একদম আমাদের থাকবার ঘরের লাগোয়া। যেন রাত-বিরেতে কোনও প্রয়োজনে তিনি আওয়াজ দিলেই আমরা সাড়া দিতে পারি। এমনও হতে পারে, আগামীতে কোনও একদিন তিনি এসবের মূল্য ধরে আমাদের ফেরত দেবেন তবে আমরা আশাই করছি না সেটার। এখনও আমরা তাকে চোখে দেখিনি কিন্তু জানি, আমরা সানন্দচিত্তে তারই অপেক্ষায় আছি, আমাদের এই নিঃশর্ত আর নিঃস্বার্থ ‘হাত-ধরে-থাকা’ টুকু যার জীবনে স্বস্তি যোগ করবে।

A story told to me by a friend

বন্ধুর মুখেশোনা গল্পটি

আমার এক বন্ধু একবার আমাকে একটা গল্প বলেছিল, ওর এক প্রতিবেশীর গল্প। অনলাইনে যেসব ডেটিং সার্ভিস আছে, ওদের কোনও একটির মাধ্যমে লোকটি একজন অচেনা মানুষের সঙ্গে পরিচিত হলো। বন্ধু পাতালো। তার বন্ধু থাকত দূরের শহরে, নর্থ ক্যারোলাইনায়। পরিচয়, খুদে বার্তা বিনিময়, ফটো চালাচালি―এসবের পরে দুটো মানুষই জড়িয়ে গেল দীর্ঘ কথোপকথনের সম্পর্কে। প্রথমে তারা দীর্ঘ দীর্ঘ চিঠি লিখে ভাবনার আদানপ্রদান করত। পরের দিকে এসে তা ঘুরে যায় টেলিফোন আলাপের দিকে। তাদের পারস্পরিক রুচি, পছন্দ কোথাও গিয়ে এক সুঁতোয় মিলে গেল। কেবল আবেগের জায়গাতেই নয়, বুদ্ধিবৃত্তিক আলাপেও তারা দুজন খুব স্বচ্ছন্দ ছিল। এভাবে গড়াতে গড়াতে শারীরিকভাবে দুজন দুজনের প্রতি আকর্ষিত হতে শুরু করল। এবং সেটা তারা সাবলীলভাবে প্রকাশও করত অনলাইন আলাপে। পেশাগত দিক থেকেও তারা কাছাকাছি, আমার বন্ধুর প্রতিবেশী অ্যাকাউন্টেন্ট আর ওর বন্ধুটি স্থানীয় একটা ছোট কলেজে অর্থনীতি বিষয়ের সহযোগী অধ্যাপক।

কয়েক মাস পরে তারা বুঝল, সম্পর্কটা গভীরে পৌঁছেছে এবং সত্যিকারভাবেই তারা পরস্পর ভালোবাসার একটা সম্পর্ক লালন করছে। আমার বন্ধুর সেই প্রতিবেশীর মনে হতে থাকল, এটাই প্রার্থিত ছিল, এটার জন্যই এতদিনের পথচলা। এবার তারা দুজনেই ঠিক করল, সামনাসামনি দেখা হতে হবে। সামনে যে ছুটিটা ছিল, প্রতিবেশী লোকটি সিদ্ধান্ত নিল, উড়ে যাবে তার বন্ধুটির কাছে―যার সঙ্গে ছিল এতদিন তার অন্তর্জালিক ভালোবাসার সম্পর্ক।

যাত্রাপথে কয়েকবারই কথা হলো দুজনের। দু-তিনবার কথা হবার পরে লোকটি টের পেল, ওপর প্রান্ত থেকে আর সাড়া আসছে না। এমনকি, এয়ারপোর্টে ওকে স্বাগত জানাবার কথা থাকলেও, বন্ধুটিকে সে কোথাও পেল না। মানে, সে আসেইনি। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করবার পর খানিকটা বেদনা নিয়ে রওনা হলো বন্ধুটির বাড়ির ঠিকানা ধরে। ঠিকঠাক পৌঁছেও গেল। কতবার দরজায় ঘন্টি বাজালো। কোনও সাড়া নেই ভেতর থেকে। সাড়া আর পাওয়াই গেল না।

গল্পটির কিছু অংশ হয়তো হারিয়ে গেছে, আমার বন্ধুটির মুখেশোনা গল্পটি থেকে। তবে শেষটুকু ছিল এ  রকম―প্রতিবেশী লোকটি যখন দক্ষিণের শহরটির দিকে উড়েছে, তার বন্ধুটি তখনও ছিল। শেষবার যখন তাদের কথা হলো, তার কিছু পরেই বন্ধুটি হার্ট অ্যাটাকে মারা যায়। খবরটি সে পেয়েছিল ওর বন্ধুর প্রতিবেশী কিংবা স্থানীয় পুলিশের কাছে। কোনওভাবে সে অনুমতি জোগাড় করেছিল মর্গে ঢুকবার আর অন্তর্জালে দেখা তার বন্ধুটি প্রথমবারের মতো সামনে দাঁড়িয়ে চাক্ষুষ করবার এবং শেষবারের জন্যও। সে তার চোখে চোখে রাখল―একজন মৃত মানুষের সঙ্গে কাক্সিক্ষত দেখাটি করল―যে তাকে আশ্বস্ত করেছিল বাকিটা সময় সঙ্গী হয়ে থাকবার।

Everyone Cried প্রত্যেকেই কেঁদেছিল

জগতটা তো বেঁচে থাকবার জন্য অতটা সহজ নয় যতটা হলে কেবল হেসেখেলেই জীবন কেটে যায়। প্রত্যেকেই কখনও কখনও এতটাই মুষড়ে পড়ে, বিষণ্নবোধ করে তার চারপাশের ঘটনায়, যা বলবার নয়। কখনও তার বন্ধুর কোনও ছোট্ট কথার আঘাতে, কখনও পারিবারের আপনজনের অবজ্ঞায়-উপেক্ষায় কিংবা প্রিয় সঙ্গী বা কিশোর সন্তানের সঙ্গে তেতো তর্কাতর্কির জেরে।

সবসময় হয়তো কাঁদে না। কিন্তু কখনও নিজেকে এতটাই অসুখী-অসহায় মনে হতে থাকে তখন যেন কান্নাই একমাত্র উপশম হয়ে ওঠে মানুষের। এটা কিন্তু একেবারেই অস্বাভাবিক নয়। আমার অল্প বয়সে, একটা অফিসে কাজ করতাম আমি। খেয়াল করে দেখতাম, দুপুরের খাবার-সময় কাছাকাছি এলেই সহকর্মীরা ক্ষুধার জন্য হোক, ক্লান্তির জন্য হোক কিংবা প্রবল বিরক্তিতে হোক―তারা কাঁদতে শুরু করত। আর ঠিক এ রকম একটা সময়ে আমার বস কোনও ডকুমেন্ট এগিয়ে দিয়ে বলত, টাইপ করে আনুন। আমি কাগজটা একপাশে সরিয়ে রেখে বিরক্তস্বরে বলতাম, করব না আমি এখন। বস আরও জোরে চিৎকার দিতে থাকত, বলছি না, যান, এখুনি টাইপ করে আনুন। তিনি ফোনে কার সঙ্গে যেন খিটখিটে গলায় কথা বলছিলেন। ক্রোধে বা বিরক্তিতে তিনিও খটাশ করে রিসিভারটি ফোনের ক্রাডলে রেখে দিলেন। তারও তো তখন লাঞ্চের সময়। আমি তাকিয়ে দেখলাম, তার গাল বেয়েও ঝরছে হতাশার অশ্রু। এমনকি, ঠিক সেই সময়টাতে অফিসের কোনও আকস্মিক জরুরি কাজ তার সামনে চলে এলে, তিনিও হয়তো কাজটাজ ফেলে লাঞ্চে চলে যেতেন। আর যার কাজটি আটকে যেত এ কারণে, তার চোখও জলে ভরতো ওই সময়টায়। তার হতাশায়। 

লাঞ্চের পরপরই সকলেই আমরা খানিকটা ফুরফুরে হয়ে উঠতাম। নিজেদের মধ্যে হাসি-তামাশা, একটু জোরে আওয়াজ করে একে-ওকে ডাকাডাকি শুরু হয়ে যেত। ফোল্ডার হাতে নিয়ে বেশ প্রসন্ন মেজাজে ঘোরাঘুরি দেখা যেত। বিকেল পর্যন্ত কাজকর্ম জোরেশোরেই চলতো বেশ। কিন্তু বিকেল নেমে আসতেই আবার ক্ষুধা-ক্ষুধা ভাব, অবসাদ ঘিরে ধরত। সকাল গড়ানো সেই অবসাদের চেয়ে যেন দ্বিগুণ হয়ে ফিরত। আবারও তখন সকলে আমরা কাঁদা শুরু করতাম।

সন্ধ্যার মুখে কাঁদতে কাঁদতেই অফিস ছাড়তাম আমরা। লিফটে কিংবা সিঁড়িতে সহকর্মীরা একে অন্যকে কনুই দিয়ে গুঁতিয়ে আগে যাবার চেষ্টায় থাকতাম। সাবওয়ের দিকে যেতে পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া পথচারীর দিকে তাকাতাম, রাজ্যের ক্লান্তি আর বিরক্তি নিয়ে। সাবওয়ের টানেলে নামতে সমস্ত শক্তি দিয়ে ঠেলে নামতাম―উপরে উঠে আসা মানুষগুলো যেন অদৃশ্য কোনও ভারী বস্তু।

সময়টা ছিল গ্রীষ্মকাল। সাবওয়ে কারে তখন শীততাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ছিল না। কী বিশ্রী গরম! ব্যাকপ্যাক ঝুলিয়ে নিয়ে, চাপাচাপি করে দাঁড়ানো সকলে। স্টেশনে নেমে যাবার আগে মধ্যবর্তী সময়গুলোতে প্রায় সকলেই কাঁদছে, দেখতাম। চোখের জলের সঙ্গে ঘাম বেয়ে পড়ছে ঘাড় থেকে পিঠ, পিঠ বেয়ে পা, পা বেয়ে জুতোয়।

তবে কিছু মানুষ কিন্তু কাঁদত না। যারা আগেভাগে এসে বসবার জায়গা পেয়েছে, দিনের ক্লান্তি ঝরাতে ঝরাতে প্রিয় বাড়ির দিকে যাত্রা করেছে, তারা কিন্তু কাঁদে না। কী স্বস্তিতে একটু পরপর চোখের পাতা ফেলছে, হাতের বইটায় চোখ বুলাচ্ছে, জিভে আঙুল ভিজিয়ে পাতাও উল্টাচ্ছে। দূর ভাবনা কিংবা দুর্ভাবনা কোনওটাই ওদের গ্রাস করতে পারত না। অই অল্প মানুষ কিন্তু কাঁদত না। তাদের চোখ তখনও উজ্জ্বল। 

ওরা হয়তো সেদিন আর কাঁদেইনি বাকিটা সন্ধ্যা রাত। আমি নিশ্চিত জানি না, হয়তো বলছি কারণ আমি তো ওদের সঙ্গে ছিলাম না। আমি কেবল কল্পনা করে নিতে পারি। আমি সাধারণত কাঁদি না ঘরে গিয়ে, আমার কল্পনাটাও তাই সেই পথের যাত্রী। বললাম, সাধারণত কাঁদি না। কখনওই কাঁদি না, এমন কিন্তু নয়। আমিও কাঁদি ঘরে ফিরে। যদি দেখি টেবিলে রাখা রাতের খাবারটা ঠিক আমার পছন্দসই নয়। যদি দেখি রাত্রিটা খুব কাছে এগিয়ে আসছে, আমাকে ডাকছে ঘুমুতে যেতে। কিন্তু আমি তো তখন ঘুমোতে চাইনি। তারপরেও আমাকে যেতে হয়, কান্না নিয়ে গিয়েছি। কারণ পরদিন সকালে উঠে আবার আমি কাজে যেতে চাইনি। হয়তো আমার মতো আরও অনেকেই কখনও না কখনও কেঁদেছে ঘরে ফিরে। সারা সন্ধে ধরে কেঁদেছিল। প্রত্যেকেই কেঁদেছিল। প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসেব মিলাতে গিয়ে তারা কেঁদেছিল।

সচিত্রকরণ : রাজীব দত্ত

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button