আর্কাইভবইকথা

ভাষাশহিদদের জীবনসূর্যের গল্প : মাহমুদুল বাসার

বইকথা

রণজিৎ সরকারের লেখা শিশুদের উপযোগী বই ‘ভাষাশহীদদের গল্প’। এখানে গল্পের ঢঙে যেসকল ভাষাশহীদের নাম এসেছে তারা হলেন―রফিক, বরকত, শফিউর, জব্বার, সালাম, আউয়াল ও অহিউল্লাহ। কিশোর প্রজন্মের কাছে পরিবারের পিতা-মাতা কিংবা অন্য কোন অভিজ্ঞ অভিভাবকদের মুখ দিয়ে ভাষা শহিদদের জীবন দানের ইতিহাস তুলে ধরেছেন লেখক। এমন গৌরবময় রক্তাক্ত ইতিহাস গল্পের আকারের বলার মধ্যে লেখকের মুনশিয়ানা হলো সরল, অকপট ভঙ্গিতে গল্পগুলো বলে যাওয়া। লেখক পাঠকদের মধ্যে আগ্রহ তৈরিতে সক্ষম হয়েছেন। তাই বইটি পড়া শুরু করে থেমে যাওয়া সম্ভব হয়নি আমারও।

ভাষা আন্দোলন নিয়ে আমরা গবেষণামূলক, রাজনৈতিক চেতনা সমৃদ্ধ ইতিহাস পড়াতেই অভ্যস্ত। ‘ভাষাশহীদদের গল্প’ বইটি পড়াতে শুরু করে খুশি হলাম এ কারণে যে―অনাড়ম্বর গদ্যে লেখক―ভাষাশহীদদের অনেক খুঁটিনাটি তথ্য আমাদের জানিয়েছেন, যেসব ব্যক্তিগতভাবে আমার জানা ছিল না। আমাদের আত্মদানকারীÑ ভাষাশহিদদের সম্পর্কে এত তথ্য জানতে পেরে লেখককে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। তার পরিশ্রম ও দেশপ্রেমমূলক ইতিহাস চেতনা কে অভিনন্দন জানাচ্ছি।

এই বই লিখতে তিনি রাজনৈতিক টোন ব্যবহার করেননি। তবু রাজনৈতিক চেতনা এসে পড়েছে। ভাষা শহিদদের পবিত্র মৃতদেহ নিয়ে পাকিস্তান সরকার কি না কারসাজি এবং হৃদয়হীনতার পরিচয় দিয়েছেন তা এ বইয়ে সুনিপুণভাবে, নিখুঁত বর্ণনায় উঠে এসেছে। পাকিস্তান যে একটা ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র ছিল তার মুখাকৃতি অঙ্কন করেছেন লেখক পরোক্ষ কৌশলে। তাছাড়া ভাষাশহিদরা কে কোথায় কীভাবে শহিদ হয়েছেন তার জীবন, সচিত্র বর্ণনায় তুলে এনেছেন। এক্ষেত্রেও নিশ্চিদ্র নিখুঁত তথ্য অবহিত হয়েছে আমাদের, যার অনেক কিছুই জানা ছিল না আমার। তাদের কবর হয়েছে কখন কীভাবে তারও নির্ভরযোগ্য বর্ণনা পেয়েছি। এত বড় ত্যাগ স্বীকারে যারা অমরত্বের শিলাপাটে নাম লিখে গেছেন, তাদের সবকিছুই আমাদের জানতে ইচ্ছা করে। লেখক সেই দাবি অনেকটাই পূরণ করেছেন।

কীভাবে কোন পরিবেশে আমাদের ভাষা শহিদেরা ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঘটনায় কিংবা তার পরের ঘটনাবলিতে জড়িয়ে পড়লেন তার বিশ্বস্ত বর্ণনা এসেছে।

লেখক ভাষা শহিদদের প্রত্যকের ব্যক্তিগত পরিচয় জন্ম তারিখ, পিতাÑমাতা স্ত্রীÑসন্তান ভাইবোনসহ তাদের আত্মীয়-স্বজনের ও পরিচয় তুলে ধরেছেন। তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার দিকটিও সবিস্তার তুলে ধরেছে গল্প বলার  ঢঙে।

আমি নিজেও লেখালেখি করি বলে বুঝতে পারছি, তথ্যগুলো সংগ্রহ করতে কতটা পরিশ্রম করেছেন তিনি। শুধু দায় সারাভাবে অথবা চতুর যশপ্রার্থী লেখকদের মতো ইন্টারনেট তথ্যগুলো বসিয়ে দেননি। কষ্টার্জিত অভিজ্ঞতা থেকে পরিমিত তথ্য দিয়ে ঘটনাগুলো এমনভাবে বলে গেছেন যেন শিশুদের কোমল হৃদয়ে চেতনার ফুল ফোটে। লেখার কী সার্থকতা যদি―পাঠকের মনে চেতনার বীজ বপন না করে? রণজিৎ সরকারের বইটি পড়তে পড়তে আমি নিজেও শিশুদের মতো হয়ে গিয়েছিলাম। যেন আমি বাবার মুখ থেকে―রফিক, বরকত, শফিউর, জব্বার, সালাম ও অহিউল্লাহর জীবন বিসর্জনের গল্প শুনছি।

লেখককে সাধুবাদ জানাই। তার বইয়ের বহুল প্রচার কামনা করি।

বীরশ্রেষ্ঠদের বীরগাথা গল্প

শিশুদের জন্য বই লেখা তাও আবার মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে―বেশ দায়িত্বশীল ব্যাপার। বড়দের বই লেখার সময় অযত্নশীলতা বা অসতর্কতা যতটুকু চলে, শিশুদের বেলায় তা হবে আত্মঘাতী। খুব সুন্দর বিষয় যে, রণজিৎ সরকারের ‘বীরশ্রেষ্ঠদের গল্প’ বইয়ে অযত্নশীলতার ছাপ পাওয়া যায়নি। আলোচনার জন্য বইটি এক বসাতেই পড়ে ফেলেছি।

বীরশ্রেষ্ঠদের ওপর লেখা পড়েছি বিচ্ছিন্নভাবে, বিভিন্ন পাঠ্যবইতে। রণজিৎ সরকারের লেখার ফলে সাতজন বীরশ্রেষ্ঠর সংক্ষিত জীবনী পড়ার সুযোগ হলো আমার। পারিবারিক আবহ তৈরি করে শিশুর কৌতূহলজনক প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে ১৯৭১ সালের বীরশ্রেষ্ঠদের ত্যাগের ইতিহাস তুলে ধরেছেন লেখক। এতে শিশুদের উপযোগিতা বিষয়ক, চিন্তা, দর্শন ও শৈশবকাল ফুটে উঠেছে। এককথায় বলা যায়, শিশুমনোবিজ্ঞানের সরাৎসার। দেশমাতৃকার শ্রেষ্ঠ সম্ভনদের দেশের জন্য আকুণ্ঠ চিত্তি জীবন দানের রক্তাক্ত ইতিহাস গল্পের মতোই লিখেছেন লেখক। তার লেখার কৌশল চমকপ্রদ। সংলাপধর্মী কাহিনিগুলো মনে গভীরভাবে দাগ কেটে যায়।

শুরু করেছেন ল্যান্স নায়েক মুন্সী আবদুর রউফকে দিয়ে। এই মহান মুক্তিযোদ্ধার সমাধি হয়েছে রাঙামাটিতে। এখানেই বেড়াতে এসেছে এক দম্পতি, তাদের শিশুপুত্রকে সঙ্গে নিয়ে। রাঙামাটির সবকিছু দেখা হয়েছে। হঠাৎ পুত্রর মনে হলো বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আবদুর রউফের সমাধিস্থান দেখা হয়নি। তারপর তারা সেখানে যান। রউফ সম্পর্কে ওই শিশু নানা প্রশ্ন করতে থাকে, তার বাবা-মাকে। এভাবে শিশুর কৌতূহলের উত্তর দিতে দিতে রউফের ত্যাগের অসামান্য কাহিনি বর্ণিত হয়েছে।

এ বই পড়ার সময় আমাদের শিশুরা লক্ষ্য করবে যে, বীরশ্রেষ্ঠ রউফ মাত্র অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন মেধাবী ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও পিতৃহীন হওয়ার কারণে অভাবী সংসারের দায়িত্ব নেওয়ার তাগিদে সেনাবাহিনীতে চাকরি নিয়েছিলেন। এই যে বাংলাদেশের নিম্নমধ্যবিত্ত, টানাপড়েনের সংসার থেকে বেরিয়ে আসা  এরাই মুক্তিযুদ্ধে বীরের মতো লড়াই করে জীবন দিয়ে দেশ স্বাধীন করে দিয়ে গেছেন। যারা বলেন, ‘পাকিস্তান না হলে বাংলাদেশ হতো না,’ তারা কি কথাটা একটু তলিয়ে ভাবেন?

বীরশ্রেষ্ঠ সিপাই মোহাম্মদ মোস্তাফা কামাল মাত্র পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছিলেন। তা পিতা ছিলেন সৈনিক বিভাগের হাবিলদার। একেবারেই সাধারণ পরিবার। এই সাধারণ পরিবারেরর ছেলেটি যদি বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের কিংবদন্তি না হতেন তাহলে কি তাকে কী মনে রাখত কেউ? উচ্চশিক্ষা নয়, ধন নয়, মান নয়, অন্য কোনও কীর্তি নয় স্বাধীনতার জন্যে আত্মত্যাগের কারণে বীরশ্রেষ্ঠরা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানের স্বীকৃতি পেয়েছেন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা এমনই ব্যাপক ছিল। যেসব স্তরের মানুষ এতে স্বেচ্ছায় জড়িয়ে পড়েছিলেন। তাই দেখি ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান উচ্চ মধ্যবিত্তের হলেও স্বাধীনতার নেশায়, দেশ প্রেম ও নাড়ির টানে মৃত্যুকে হাতের মুঠোয় বন্দি করে দুঃসাহসী ভূমিকা নিয়ে জীবন বিসর্জন দিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বিমান বাহিনী গড়ে তোলবার স্বপ্ন দেখে তিনি দেশে থেকে পাকিস্তানে ফিরে গিয়েছিলেন বিমান ছিনতাই করতে। কাহিনিটি লেখক চমৎকার করে ফুটিয়ে তুলেছেন।

ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ ছিলেন কৃষকের সন্তান। তিনিও মাত্র সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছিলেন। মাত্র দশ বছর বয়সে মাতৃহীন হয়েছিলেন। ১৩ বছর বয়সে পিতৃহীন হন। এই সবহারা বীর সম্পর্কে লেখক বলেন, ‘১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান বাহিনীর পাশবিক নারকীয় কর্মকাণ্ড দেখে নূর মোহাম্মদ স্থির থাকতে পারেননি। বিবেকের নির্ভুল নির্দেশেই তিনি যোগ দিলেন মুক্তিযুদ্ধে।’ হ্যাঁ, সাত বীরশ্রেষ্ঠই বিবেকের নির্ভুল নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানে সেরা লড়াই চালিয়ে জীবন দিয়ে শ্রেষ্ঠ বীরত্বের ইতিহাস রেখে গেছেন।

 লেখক : প্রাবন্ধিক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button