সুব্রত বড়ুয়ার ইতিহাসের পলাশি : পবিত্র সরকার
সুব্রত বড়ুয়ার সাহিত্যকর্ম : আলোচনা
ইতিহাস কেন পড়ি আমরা ? এক বিশুদ্ধ জ্ঞানের জন্য, কোনও স্থানে অতীতে কী ঘটেছিল তা জানার একটা মূল্য আছে। কিন্তু এ মূল্য আমাদের নিজেদের সময়ের আর অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত। ইতিহাসের গ্রন্থবিশেষে নির্বাচন তো থাকেই। অনন্ত সময় আর অনন্ত স্থান-পরিসরের বিপুল ব্যাপ্ত ইতিহাস, তা কারও পক্ষে লিখে ফেলা যেমন অসম্ভব তেমনই কারও একার পক্ষে পড়ে ফেলাও অভাবনীয়। তাই আমরা কাল আর স্থান দুটি মাত্রাই খণ্ড খণ্ড করে দুয়ের একটি ক্ষুদ্র সমাপতন-বিন্দু বেছে নিয়ে ইতিহাস পড়ি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কোনও নির্দিষ্ট স্থান, ঘটনা বা ব্যক্তির জীবনের ইতিহাস। পড়ি শুধু জ্ঞান-বিনোদনের জন্য নয়। সময়, স্থান আর সমাজ-প্রতিবেশের যে ধারাবাহিকতার মধ্যে আমাদের অবস্থান সেখানে আমরা কেমন করে পৌঁছালাম তা বুঝাবার জন্য যেমন তেমনই তার থেকে শিক্ষা নেওয়ার জন্যও; যাতে আমাদের বর্তমান আর ভবিষ্যৎ অতীতের ভুল শুধরে আর একটু অর্থপূর্ণ হতে পারে।
বলা বাহুল্য, আমরা সকলে ইতিহাস সৃষ্টি করি না; আমাদের বেশির ভাগের জীবন ব্যক্তি আর পরিবারের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ, আর নিজেদের আয়ুষ্কালের বাইরে আমাদের কোনও স্মরণীয়তা তৈরি হয় না। কিন্তু অন্যদিকে আবার কিছু লোককে ইতিহাসই বিশেষ অবস্থায় ফেলে সৃষ্টি করে―যারা নিজেরা আবার বৃহৎ অঞ্চলের ইতিহাস সৃষ্টি বা নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের কাজগুলো আমাদের দৈনন্দিন হাটবাজার অফিস-কর্মস্থল-বিনোদনের বহু―আর চির-আচরিত কাজ নয়, সেগুলো বহু মানুষের জীবন জড়িয়ে বড় বড় সিদ্ধান্তের কাজ, জনতাকে নেতৃত্ব দেওয়ার কাজ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, সাম্রাজ্যশাসন, সাম্রাজ্য দখল ইত্যাদি কাজ―যদিও গণতন্ত্রে পৌঁছে সেসব কাজের চরিত্র বেশ বদলে গেছে। কিন্তু আমাদের উপমহাদেশে গণতন্ত্রের বয়স তো খুবই কম।
তা হোক, আমাদের নিজেদের স্বার্থেই সামন্ততন্ত্রকে সরিয়ে সাম্রাজ্যবাদ কী করে আমাদের দক্ষিণ এশিয়াতে কায়েম হলো তার ইতিহাস আমাদের জানা দরকার, যেমন জানা দরকার সেই সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, বিশ শতকের মাঝামাঝি তার অপসারণ, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার ছদ্মবেশে নতুন সাম্রাজ্যবাদের উদ্ভব, তাকে সরিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা। সবই এক প্রাসঙ্গিক ধারাবাহিকতার অঙ্গ, আমাদের এখনকার অস্তিত্বের গোড়াকার কাহিনি, যা না জানলে আমাদের নিজেদের জানাই অসম্পূর্ণ থেকে যায়। সেখানেই সুব্রত বড়ুয়ার বইটির বিশেষ মূল্য চিহ্নিত।
তাই বাংলাদেশের প্রসিদ্ধ কথাসাহিত্যিক ও শিশুদের লেখক শ্রী সুব্রত বড়ুয়ার বইটি আমি আগে পড়িনি বলে অপরাধ বোধ করছি। ইতিহাস তো জ্ঞানের বই, স্কুলে কলেজে পাঠ্য হিসেবে তা আমরা সকলে উপভোগ করি কি না সন্দেহ, পরীক্ষার প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য তার উপযোগ করেছি বলা যায়। তাও যে গল্প-উপন্যাসের মতো সুখপাঠ্য হতে পারে সুব্রতবাবুর বইটি তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে রইল। প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় সে কথা বলেছেন, লিখেছেন যে, এ বই ‘অতীত ইতিহাস সম্বন্ধে আগ্রহী সাধারণ মানুষের জন্য’। স্কুলপাঠ্য ইতিহাস, আর গম্ভীরমুখ বিশেষজ্ঞদের জন্য তথ্যপূর্ণ জ্ঞানগর্ভ ইতিহাস, এ দুয়ের বাইরে যে সুখপাঠ্য ইতিহাসের পদার্পণ ঘটেছে, তার ইতিহাসও খুব বেশি দিনের নয় এবং খুব বেশি মানুষ এই কাজে অর্থাৎ ইতিহাস পাণ্ডিত্যের ফুটনোটধর্ষিত এলাকা থেকে বার করে সুরম্য আখ্যানের রূপ দিতে এগিয়ে আসেননি। এটা একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক কাজ বলে আমি মনে করি। কারণ ইতিহাস যে শুধু পরীক্ষায় পাশ এবং গবেষণার বিষয় নয়, তা যে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন ও ব্যবহার্য জ্ঞানের এক আবশ্যিক অংশ তা আমরা অনেক সময় ভুলে থাকি।
দুই
পলাশির যুদ্ধ বাংলার ইতিহাসের পক্ষে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ আরও এই কারণে যে, পরে বিশেষত ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে হিন্দু নাট্যকার ও লেখকদের লেখায়, হয়তো তাঁদের অসচেতনতায়, যে সাম্প্রদায়িকতার স্পর্শ ঘটেছিল, তার সঙ্গে সিরাজ-উদ্দৌলা আখ্যানের একটা জটিল ও বিপ্রতীপ সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়, তাও আমাদের বুঝে নেওয়া দরকার। আমি এ কথা অন্যত্রও লিখেছি যে, ওই শতকের সত্তরের বছরগুলোর একাধিক মঞ্চস্থ বাংলা নাটকে এবং বাংলা গল্প-উপন্যাসে, স্বাধীনতা-যুদ্ধ হিন্দু-মুসলমান যুদ্ধের শাসকদের রূপককে আশ্রয় করেছে, যেখানে দেখানো হয়েছে হিন্দু শাসক ভারতের স্বাধীনতার রক্ষাকারী আর বহিরাগত মুসলমান শাসক সেই স্বাধীনতা হরণকারী। এই নাট্যকার বা লেখকদের পক্ষে খেয়াল করা সম্ভব হয়নি যে, সামন্তযুগে প্রজার স্বাধীনতা আর গণতন্ত্রে প্রজার স্বাধীনতার অর্থ এক নয় আর হিন্দু শাসক হলেই হিন্দু প্রজার সুখসমৃদ্ধি আর মুসলমান শাসক হলেই মুসলমান প্রজার সুখসমৃদ্ধি উপচে পড়বে (এবং হিন্দু প্রজার কষ্ট)―এই সমীকরণ সর্বত্র অভ্রান্ত নয়। মুসলমান শাসক বা প্রতিপক্ষ ‘খলচরিত্র’ আর হিন্দু শাসক ‘দেশপ্রেমিক’ এই সরল ছক সিরাজ-উদ্দৌলা আর মিরকাশিম, কখনও বা ঈশা খাঁ এসে ভেঙে দেন, হিন্দু ঐতিহাসিক নাট্যকাররাও তা স্বীকার করে নেন এক সময় কিন্তু তখন সম্ভবত বড় দেরি হয়ে গেছে। বাংলার বিভাজিত রাজনীতি দেশভাগের দিকে অন্ধভাবে এগিয়ে চলেছে।
তিন
এখানেই সুব্রত বড়ুয়ার বইটির আসল মূল্য। পলাশির যুদ্ধ আমাদের সেই বিদেশিদের হাতে পরাধীনতার ইতিহাসের সূচক, যে বিদেশিরা এদেশে স্থায়ী আবাস তৈরি করেনি, কখনও এ দেশকে আপন মনে করেনি। তা আবার সমগ্র এশিয়ায় নানা ইংরেজদের সাম্রাজ্য বিস্তারের ইতিহাসের ভূমিকা। আখ্যানটি সুব্রতবাবু চারটি পরিচ্ছন্ন অধ্যায়ে সাজিয়েছেন―ইউরোপীয় (মূলত পর্তুগিজ, ফরাসি, ডাচ) জাতির আগমন, ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি (ব্রিটিশ বাণিজ্যলিপ্সু), পলাশির পটভূমি (ব্রিটিশের সাম্রাজ্যস্বপ্ন) আর পলাশির যুদ্ধ (সাম্রাজ্যের ভিত্তিস্থাপন)। ব্যাপক ক্ষেত্র থেকে ক্রমশ তাঁর বৃত্তটি ছোট হয়েছে এবং তাঁর এই ‘ইতিহাসের সহজপাঠ’ একটি মনোরম আখ্যানের রূপ নিয়েছে। একজন কথাকার যদি ইতিহাস লিখতে এগিয়ে আসেন, এমন কথাকার যাঁর ভাষা বা কালক্রম নিয়ে কোনও পরীক্ষা-নিরীক্ষার আগ্রহ নেই, পাঠকের কাছে ঘটনাগুলো সহজ ও আকর্ষক করে পরিবেশন করাই লক্ষ্য―তাহলে যা হয় এখানেও তাই হয়েছে, বইটি ইতিহাসের একটি রম্যপাঠ হয়ে উঠেছে। তিনি কম্পানির রাজত্বের প্রতিষ্ঠাতে এসেই থেমেছেন, কারণ পলাশি প্রসঙ্গ তাঁকে ওখানেই ইতি টানতে বাধ্য করেছে। সত্যকার রাজকীয় শাসনের জন্য দক্ষিণ এশিয়া আরও কিছুদিন অপেক্ষা করবে। কম্পানির শাসনের নমুনা তাঁর স্বচ্ছন্দ কথনশৈলীর একটু নমুনা দিই :
‘১৭৫৭ সালের পর থেকে মীরজাফর বাংলার নবাব থাকলেও আসলে রবার্ট ক্লাইভই বাংলার শাসন পরিচালনা করতে শুরু করেন। ব্যবসার ব্যাপারেও ইংরেজরা তাদের পুরনো নীতি বাদ দেয়, নতুন নীতি চালু করে। আগে তারা রপ্তানির মাল কেনার দাদন দিত। কিন্তু এখন থেকে তারা এজেন্ট রাখতে শুরু করে। কোম্পানির কর্মচারীরাও তাদের নিজেদের আলাদা ব্যবসা চালাতে থাকে। তাছাড়া মালামাল কেনার সময় তারা জোর খাটাত এবং দাম কম দিত। এতে বাংলার বণিকেরা অসহায় হয়ে পড়ে, বাংলার কারিগর ও চাষিরা তাদের তৈরি জিনিস ও শস্যের ন্যায্য মূল্য পাওয়া থেকে বঞ্চিত হতে থাকে। মোট কথা, বাংলার মসনদে একজন পুতুল নবাব বসিয়ে ইংরেজ কোম্পানিই সেচ্ছায়ের (শব্দটি নিয়ে আমাদের খটকা লাগল : স্বেচ্ছাচারের হবে কি ?) সঙ্গে দেশ শাসন করতে থাকে।’
আমরা লক্ষ করি, বাক্যসংগঠনে ছোটখাটো বিরোধ তৈরি করে সুব্রত গদ্য-বিবৃতির মধ্যেও এক ধরনের প্রচ্ছন্ন নাটক তৈরি করেছেন। তা তাঁর বর্ণনার আকর্ষণ বাড়িয়েছে। আর ইতিহাসের মধ্যে প্রাকৃতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, ব্যক্তিগত আর গোষ্ঠীগত কোনও তথ্যই তাঁর আখ্যান থেকে বাদ পড়েনি। বাঙালি জাতির ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ খণ্ড তিনি এমন করে সাধারণ বাঙালি পাঠকের জন্য প্রস্তুত করেছেন বলে তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানাই। আমি আশা করব, তিনি এবং তাঁর পথ অনুসরণ করে আরও বাঙালি কথাশিল্পী এভাবে ইতিহাস, দর্শন, বিজ্ঞান ইত্যাদি আমাদের ছাত্র ও সাধারণ শিক্ষার মানুষের জন্য এই সহজ আখ্যানের মতো পরিবেশন করবেন, ব্রিটিশ কথাশিল্পী এইচজি ওয়েলস যেমনভাবে সাধারণ পাঠকের জন্য পৃথিবীর ইতিহাস সাজিয়ে দিয়েছিলেন বা মার্কিনি উইল ডিউর্জান্ট, দর্শনের ইতিহাসকে পৌঁছে দিয়েছিলেন সাধারণ মানুষের আয়ত্তে। আমাদের রবীন্দ্রনাথের বিশ্বপরিচয়টিও আমরা ভুলি কী করে ? লেখকদের এ এক ধরনের সামাজিক দায়িত্ব পালন, নিজেদের সৃষ্টিক্ষেত্রের বাইরে এসে সাধারণ মানুষের জ্ঞানসঞ্চয়ের জন্য অন্য কিছু লেখা, সহজ, সর্বজনবোধ্য ভাষায়।
লেখক : ভাষাতত্ত্ববিদ, সাবেক উপাচার্য
রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়