আর্কাইভপ্রচ্ছদ রচনাসাক্ষাৎকার

‘প্রকৃতির অপরূপতা আমার মনে কবিত্বের বীজ রোপণ করেছে’ : আখতার হুসেন

প্রচ্ছদ রচনা : মুখোমুখি শিশুসাহিত্যিক আখতার হুসেন

একান্ত আলাপচারিতায় আনজীর লিটন

[আখতার হুসেন আমাদের সাহিত্যজগতের অন্যতম পুরোধা শিশুসাহিত্যিক। জন্ম : ১৯৪৫ সালের ১ নভেম্বর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার আমনুরায়। রেলকর্মচারী পিতার কর্মস্থল ছিল সেসময় এই আমনুরা। পৈতৃক নিবাস নাটোর জেলার লালপুর উপজেলাধীন নুরুল্লাপুর গ্রামে। শিক্ষাজীবন পার করেন খুলনা, পাকশী, আমনুরা, গফরগাঁও ও ময়মনসিংহে। পেশাগত জীবনের শুরু সাংবাদিকতা দিয়ে। চাকরি করেছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় অনেক পত্রপত্রিকায়। দীর্ঘদিন চাকরি করেছেন তৎকালীন সোভিয়েত দূতাবাসের তথ্যবিভাগে অনুবাদক-সম্পাদক হিসেবে। বর্তমানে তিনি একটি প্রকাশনা সংস্থার পাণ্ডুলিপি সম্পাদক। প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য : গল্প―সমুদ্র অনেক বড়, রামধনুকের সাঁকো, দি টাইগার ও অন্যান্য গল্প, যেতে যেতে যেতে, হইটি টইটি টই, পাজি বেড়ালের শাস্তি; অনুবাদ গল্প―সাত সাগরের পার ও নির্বাচিত কিশোর গল্প; ছড়া―উল্টোপাল্টা, হালচাল, সোনায় মোড়া ছড়া, এক ঘড়া ছড়া; কিশোর কবিতা―হৈ হৈ রৈ রৈ, প্রজাপতি ও প্রজাপতি, আমার দুটো ডানা, ও হাওয়া ও হাওয়া এবং সেই যে আমার প্রাণের মিতে নদী, কেমন আছ আমার বাংলাদেশ, সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি, কাজে হব বড়, কুট কুট কুট কুট্টুস ফুট ফুট ফুট ফুট্টুস; উপন্যাস―ফ্রিডম ফাইটার, নায়ের ছোট্ট মাঝি, কর্ণকুসুম ও কালোপাখার প্রজাপতি; নাটিকা―খেলাঘরের পুতুলগুলো; জীবনী―ছোটদের চারণ কবি মুকুন্দদাস, ছোটদের জাতির জনক, ছোটদের জোয়ান অব আর্ক ও ছোটদের মণি সিংহ ইত্যাদি। এটি তাঁর স্বরচিত গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত তালিকা।

সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ আখতার হুসেন পেয়েছেন ‘আলাওল সাহিত্য পুরস্কার’, ‘বাংলা একাডেমি পুরস্কার’, ‘বাংলাদেশ শিশু একাডেমি পুরস্কার’, ‘ভাষা শহীদ আবদুল জব্বার স্মৃতিপদক’, ‘মনিরউদ্দীন ইউসুফ সাহিত্য পুরস্কার’, ‘এম নুরুল কাদের শিশুসাহিত্য পুরস্কার’, অগ্রণী ব্যাংক-শিশু একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার’, ‘বাংলা একাডেমি কবীর চৌধুরী শিশুসাহিত্য পুরস্কার,’ ‘লেখিকা সংঘ সাহিত্য পদক’, ‘প্রকৃতি সংবর্ধনা স্মারক’, ‘বজলুর রহমান সম্মাননা স্মারক’ ও ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস স্টাডিজ অনুষদ প্রদত্ত মুক্তিযোদ্ধা শব্দসৈনিক সম্মাননা’সহ আরও অনেক সংবর্ধনা স্মারক। সম্পাদনা করেছেন উল্লেখযোগ্য অনেক গ্রন্থ। তিনি সরকারের গেজেটভুক্ত শব্দসৈনিক বীর মুক্তিযোদ্ধা।

আখতার হুসেন বাংলা একাডেমির ফেলো।

শিশুসাহিত্যিক আখতার হুসেনের এই সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শিশুসাহিত্যিক ছড়াকার বাংলাদেশ শিশু একাডেমির মহাপরিচালক আনজীর লিটন। এই সাক্ষাৎকার হয়ে উঠেছে আনজীর লিটনের প্রশ্নের ধারায় আখতার হুসেনের সামগ্রিক সাহিত্যিক জীবনের সংক্ষিপ্ত আখ্যান।]

আনজীর লিটন : আখতার হুসেন নামটি কীভাবে উদযাপন করেন আপনি ?

আখতার হুসেন : লেখালেখির মাধ্যমে। লিখতে পারছি এটাই তো বড় আনন্দের বিষয়। লেখালেখি ঘিরে জীবনের সব স্মৃতি জড়ো হয়েছে। সেসব স্মৃতির পাতা খুলে দেখি লেখলেখি করতে এসে কত মধুর অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি।

আনজীর লিটন : এমন একটা মধুর অভিজ্ঞতার কথা শোনাবেন কি ?

আখতার হুসেন : তখন আমি জার্মানি থেকে ফিরেছি দেশে। ’৮৬ সালের দিককার কথা। আমার হাতে কাজ-কর্ম নেই। আমার পরিচিত একজন বলল, পাসপোর্ট ভিসা ছাড়াই ইন্ডিয়া যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবে। আমিও রাজি হলাম। তখন অবৈধভাবে ভারত থেকে শাড়ি-কাপড় আনা-নেওয়া করত একদল চোরাকারবারি। তাদের সঙ্গে আমাকেও পাঠিয়ে দেওয়া হলো। আমার সঙ্গে আমার এক বন্ধু ছিল। গ্রামের পথ পেরিয়ে, ঝোপ-ঝাড় ঘেরা পথ পেরিয়ে, আমরা হাঁটতে লাগলাম। চাপাইনবাবগঞ্জের একটা সীমান্ত এলাকা। তখন দুপুর। একটা জঙ্গলের পাশে এসে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। অনেক ক্ষুধার্ত ছিলাম সবাই। পকেটে তেমন টাকা-পয়সা নেই। খাবারও নেই। হঠাৎ শুনতে পেলাম একদল শিশু ছন্দ-সুরে বলছে, ‘হ্যারে! খবরটা কি উড়ো ?’ চমকে উঠলাম আমি। কানখাড়া করে শুনলাম। হ্যাঁ, সত্যি সত্যি শিশুরা একসুরে বলছে, ‘হ্যারে! খবরটা কি উড়ো ?’ শব্দটা যেদিক থেকে আসছিল, আমি সেদিন হাঁটতে শুরু করলাম। হাঁটতে হাঁটতে একটু দূরে গিয়ে দেখি একটি স্কুল। ক্লাস টু-এর শিক্ষার্থীরা পড়ছে ‘হ্যারে! খবরটা কি উড়ো ?’ আমি আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না। ঢুকে পড়লাম ক্লাসে। টিচারকে বললাম, আপনি যে ছড়াটি পড়াচ্ছেন সেটি আমি লিখেছি। টিচার আমার দিকে বিস্ময়ভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকালেন। বললেন, পাগল নাকি! বললাম, আমি পাগল না, আমি লেখক। এই ছড়া আমি লিখেছি।

ছাত্ররা হো হো করে হেসে উঠল। টিচার বললেন, ঠিক আছে, এটা যে আপনার ছড়া তার প্রমাণ দিতে হবে। ছড়াটা বলেন, কি লিখেছিলেন ? আমি গড়গড় করে ছড়াটি মুখস্থ বলতে লাগলাম। বলা শেষ হলে সবাই হাততালি দিয়ে উঠল। টিচার আমাকে নিয়ে গেলেন হেডমাস্টারের রুমে। হেডমাস্টার আমার পরিচয় জানতে পেরে লেখক হিসেবে আমাকে খাতির করলেন। বললেন, চলেন আমার বাড়িতে। দুপুরে খাবেন। বললাম, আমার সঙ্গে আরও অনেকে আছে। হেডমাস্টার বললেন নিয়ে আসেন। তারপরে যা ঘটল চোরাচালানিদের ওই গ্রুপের সদস্যকে নিয়ে হেডমাস্টারের বাসায় দুপুরের খাবার খেলাম। সেই কথা এখনও মনে পড়ে। লেখক জীবনের এই স্মৃতি আমার সব বেদনা ভুলিয়ে দেয়। তখনি আমি নিজের সঙ্গে নিজে আনন্দ উদযাপন করি।

আনজীর লিটন : আমি মনে করি, যারা শিশুসাহিত্য রচনায় নিবেদিত, তাঁদের শৈশব ও কৈশোরকালের প্রভাব এক্ষেত্রে একটা বড় ভূমিকা পালন করে থাকে। আপনার সেই শৈশব ও কৈশোরকাল সম্পর্কে কিছু বলবেন কি ?

আখতার হুসেন : প্রশ্নটা করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আপনি ঠিকই বলেছেন, শৈশব-কৈশোরের স্মৃতি শিশু-সাহিত্য রচয়িতাদের যে অনেক রসদ জুগিয়ে থাকে তার বড় প্রমাণ বাংলা সাহিত্যের অনেক বড় বড় শিশুসাহিত্যিকের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কাজী নজরুল ইসলাম। এ দুই মহান কবি বড়দের জন্য কবিতা লেখার পাশাপাশি সমৃদ্ধ শিশুসাহিত্যও যে রচনা করেছেন, তার মূলে রয়েছে তাঁদের দুজনের বিচিত্র শৈশব-কৈশোরকাল।

আমি, আমার নিজের ভাষায় বলি, তেমন বড় শিশুসাহিত্যিক গোছের কেউ নই। লেখার চেষ্টা করে যাচ্ছি মাত্র। প্রতি মুহূর্তে মনে হয়, সদ্যই লেখালেখি শুরু করেছি। তবু বলি, আমার শৈশব-কৈশোরকাল ছিল খুবই বৈচিত্র্যে ভরা। আমার আব্বা ছিলেন রেলের কর্মচারী। আমরা তখন এখান থেকে সেখানে যাতায়াত করতাম রেলগাড়িতে চড়েই। রেলগাড়ির ইঞ্জিন ছিল কয়লাচালিত। সেই ইঞ্জিন যে ট্রেনের কামরাগুলো টেনে নিয়ে যেত, তার একটা ছন্দ ছিল এই রকমের―ঘ্যাট ঘ্যাট ঘ্যাটা ঘ্যাট/ঘ্যাট ঘ্যাট ঘ্যাটা ঘ্যাট। এই যে ছন্দোময় শব্দ চলন্ত রেল গাড়ির, একেবারে শৈশব-কৈশোর থেকেই মনে তা গেঁথে যায়। যেন ছড়ারই ছন্দ। ফলে প্রাথমিকভাবে আমার লেখা ছড়াতেও ছন্দের ভুল থাকত না।

শৈশব-কৈশোরে প্রকৃতিরও সান্নিধ্য পেয়েছি, বলতে গেলে গভীরভাবেই। আমার জš§ ১৯৪৫ সালের ১ নভেম্বর বর্তমান চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার আমনুরায়। রেলের বাসায়। আমনুরা ছিল আমার নানার কর্মস্থল। তিনিও রেলের কর্মচারী ছিলেন। আমার আব্বারও এখান থেকেই চাকরিজীবনের সূচনা। ব্রিটিশ ভারতে। তারপর শুরু হয় তাঁর বদলি-জীবনের। মায়ের কোলে বসে আব্বার প্রথম বদলির জায়গা শিলিগুড়ি যাই। মা এবং আব্বার মুখ থেকে হিমালয় পর্বতের কথা শুনেছি। এরপর আব্বার বদলির সূত্রে কত না জায়গায় থেকেছি! থেকেছি সান্তাহার, রাজশাহী, খুলনা, এখনকার ঝিনাইদহের মোবারকগঞ্জ (আমাদের সময় এই রেল স্টেশনের নাম ছিল ‘আলীগঞ্জ’), পাকশী, তারপর পাকশী থেকে সোজা বর্তমানে নেত্রকোনা জেলার অন্তর্গত শ্যামগঞ্জ (জংশন স্টেশন), ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত গফরগাঁও, সিলেট জেলার শ্রীমঙ্গল, কুলাউড়া, আবার ময়মনসিংহের কেরটখালী, ঢাকা, সবশেষে ভৈরববাজারে।

এতক্ষণ বললাম শুধু জায়গাগুলোর নাম। এসব জায়গার জল-মাটি ও অপরূপ প্রকৃতির কথা বলতে গেলে সহজে ফুরোবে না।

যেসব জায়গায় আব্বার চাকরির সূত্রে থেকেছি সেসব জায়গার স্মৃতি, দুরন্তপনা, প্রকৃতির অপরূপতা আমার মনে কবিত্বের বীজ রোপণ করেছে। এখনও সেসব জায়গার স্মৃতি আমার মনের আয়নায় জ্বলজ্বলে। সেসব স্মৃতি, বিশেষত শৈশব-কৈশোরের, আমার লেখার প্রধান উৎস।

আনজীর লিটন : আমার বাবাও ছিলেন রেলস্টেশন মাস্টার। আমারও শৈশবকাল কেটেছে রেল কলোনিতে। আমার কাছে মনে হয়, হাজার মানুষের এক আত্মার নাম রেল কলোনির-জীবন। আপনি কী বলেন ?

আখতার হুসেন : একদম ঠিক কথা। আমার শৈশব-কৈশোরকালের বন্ধুরা ছিল নানা পেশার মানুষের সন্তান। মেথর, সুইপার, খালাসি, পয়েন্টসম্যান, স্টেশনমাস্টার, রেলের ড্রাইভার, গার্ড, টিটি―তাদেরকে নিয়েই ছিল আমার কলোনির জীবন। একসময় রেল কলোনিতে যারা থাকতেন তাদের সবাই ছিলেন যেন এক পরিবারের সদস্যের মতো। সুখে-দুখে একসঙ্গে জীবন কাটাতেন। আমার মনে পড়ে প্রতি বছর আমরা নাট্য উৎসব করতাম। আমি অভিনয় করতাম। আহা, আমার রেল জীবনের স্মৃতিগুলো ভোলার মতো নয়।

আনজীর লিটন : প্রথম লিখতে শুরু করেন কবে ? প্রথমেই কি শিশুসাহিত্য রচনা শুরু করেছিলেন ?

আখতার হুসেন : আমার লেখালেখির শুরু ১৯৬১ সাল থেকে। আমার বয়স তখন মাত্র ১৬ বছর। গফরগাঁও সরকারি ইসলামিয়া হাই স্কুলে ক্লাস এইটে পড়ি। না, প্রথমেই আমি শিশুসাহিত্য রচনা করিনি। বড়দের উপযোগী ছোটগল্প লিখেই আমার সাহিত্য-জীবনের সূচনা। অনুবাদে তখন খুব ছোটগল্প পড়তাম, বিশেষ করে উর্দু, হিন্দি ও পাঞ্জাবি লেখকদের গল্পের অনুবাদ। আমার বড়দের উপযোগী প্রথম ছোটগল্প পর পর দুই সংখ্যায় ছাপা হয় দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার মহিলা পাতায়। গল্প দুটো লিখেছিলাম আমার আর আমার মায়ের নাম মিলিয়ে ‘আসিয়া আখতার’ নাম দিয়ে। আমার স্পষ্ট মনে আছে, ক্লাস এইট থেকে ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়া পর্যন্ত ১১৩টি বড়দের ছোটগল্প লিখেছিলাম। এবং চারটি উপন্যাসও লিখেছিলাম। সেগুলো বছর তিনেক পরেই ছিঁড়ে ফেলেছিলাম। বাংলা এবং বিদেশি সাহিত্যিকদের অনেকের লেখার প্রভাব সেসব লেখায় ছিল বলেই আমি এ কাজ করেছিলাম। কিন্তু এর পরেই আমি ছোটদের উপযোগী গল্প লিখতে শুরু করেছিলাম। এটা ১৯৬৪ সালের দিকের কথা। ছড়াও লিখছি তখন। টুকটাক কিশোর কবিতাও।

আনজীর লিটন : আপনার প্রথম ছড়া ছাপা হয় কখন, কোনখানে  ?

আখতার হুসেন : আমার জীবনের প্রথম ছড়া ছাপা হয় আবদুল গাফফার চৌধুরী সম্পাদিত অর্ধসাপ্তাহিক সোনার বাংলায়। আব্বার চাকরির সূত্রে আমি তখন থাকি কুলাউড়ায়। ১৯৬৪ সালের কথা। সোনার বাংলার ছোটদের পাতা সম্পাদনা করতেন শিশুসাহিত্যিক রফিকুল হক, পরবর্তীকালে তিনি ‘দাদু ভাই’ নামে খ্যাত হন ছোটদের পত্রিকা কিশোর বাংলা সম্পাদনা করতে গিয়ে। কিন্তু আমি তাঁকে রফিক ভাই বলেই ডাকতাম। এরপর আমাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সংবাদ-এর ‘খেলাঘর’, আজাদ-এর ‘মুকুলের মহফিল’, পাকিস্তানি খবর-এর ছোটদের বিভাগ, জেবু আহমদ সম্পাদিত মাসিক পত্রিকা খেলাঘর―প্রায় সব পত্রিকায় আমার লেখা ছাপা হয়েছে। আমার লেখা ছাপাতে কেউ দ্বিধা করেননি।

তবে এখানকার ‘শিশু’ এবং ধান শালিকের দেশেও আমার কম লেখা ছাপা হয়নি। এখনও হয়। কিশোর বাংলা ও দৈনিক যুগান্তর-এর ‘আলোর নাচন’ এবং দৈনিক সমকাল-এর ‘ঘাস ফড়িঙের দেশে’ও আমার, বলতে গেলে প্রায় নিয়মিত লেখা ছাপা হয়েছে, এখনও হয়। প্রথম আলোর ‘গোল্লাছুট’ এবং কিশোর আলো ও বিজ্ঞান চিন্তায়ও আমার কম লেখা ছাপা হয়নি। এখনও হচ্ছে।

আনজীর লিটন : আপনি ছড়া ও কিশোর কবিতা লিখিয়ে হিসেবে পরিচিত হলেও ছোটদের জন্য গদ্যও কম লেখেননি। এ সম্পর্কে একটু কিছু বলবেন কি ?

আখতার হুসেন : দেখুন, ১৯৭০ সালে প্রকাশিত হয় আমার প্রথম গ্রন্থ ছড়ার নয়, ছোটদের গল্পের বই। নাম সমুদ্র অনেক বড়। প্রকাশিত দ্বিতীয় বইটি ছড়ার। নাম হালচাল। সমুদ্র অনেক বড় প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, সত্যি বলতে কী, ভীষণ সাড়া পড়ে যায়। পাকিস্তানি আমল তখন। এখনকার যেটা জনতা ব্যাংক, সেটার নাম ছিল তখন ‘ইউনাইটেড ব্যাংক’। তারা ছোটদের জন্য লেখা বই পুরস্কৃত করত।

১৯৭০ সালের পুরস্কার পেয়েছিলাম আমরা দুজন। না না তিনজন। সত্যেন সেন, আমাদের সত্যেনদা তাঁর গল্পের বই পাতা বাহার বইয়ের জন্য, সুকুমার বড়ুয়া তাঁর প্রথম ছড়ার বই পাগলা ঘোড়ার জন্য। আর আমি সমুদ্র অনেক বড়র জন্য। পুরস্কারের অর্থ মূল্য ছিল ১০ হাজার টাকা। আমরা সবাই তখন মোটামুটি অর্থকষ্টে ছিলাম। দশ হাজার টাকা তিনজনের মধ্যে ভাগ করে পেলেও সোয়া তিন হাজার টাকা করে পেতাম। সে সময় ওই টাকাই কম ছিল না। পুরস্কারের নাম ছিল ইউনাইটেড ব্যাংক পুরস্কার। স্বাধীনতার পর এই ব্যাংকটির নাম হয় জনতা ব্যাংক। তো যা-ই হোক, পাকিস্তানি সেই ব্যাংকের পুরস্কারের টাকা আমাদের ভাগ্যে জোটেনি দেশ জুড়ে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়ে যাওয়ার ফলে। তবে এ নিয়ে কোনও দিন আক্ষেপ করিনি। ভালোই হয়েছে একদিক থেকে। অপ্রাসঙ্গিক হলেও আরেকটা বিষয় জানাই। আমি যখন ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের ইসলামিয়া হাইস্কুলের ক্লাশ সিক্সে ভর্তি হই তখন প্রথম দিন পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত গাওয়ার জন্য অনেকের সঙ্গে আমাকেও লাইনে দাঁড় করানো হয়। কিন্তু অন্যদের চেয়ে আমার গলার স্বর মোটা ছিল বলে আমাকে বাদ দেওয়া হয়। আর কোনও দিন আমাকে ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’―পাকিস্তানের এই জাতীয় সংগীত গাওয়ার জন্য ডাকা হয়নি। এখন ভাবি, বেশ গর্বের সঙ্গেই ভাবি, পাকিস্তানি কোনও পুরস্কার না পেয়ে ভালোই হয়েছে, পাকিস্তানি জাতীয় সংগীত না গাইতে পেরেও ভালোই হয়েছে। আমি আরও গর্বিত যে, সমুদ্র অনেক বড় বই নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা লিখেছিলেন সন্তোষ গুপ্ত, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ এবং শাহরিয়ার কবির। বুক ভরে ওঠার মতো আলোচনা।

ও হ্যাঁ, প্রসঙ্গে ফিরে আসি। আমার ছোটদের গদ্যের বইয়ের সংখ্যাও কম নয়। যেমন গল্পের বই আছে তেমনি উপন্যাসও আছে।

আনজীর লিটন : কিশোর কবিতা কখন থেকে লিখতে শুরু করেন  ?

আখতার হুসেন : বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কিশোর কবিতা লিখতে শুরু করি ১৯৬৫ সালের পর থেকে। দুটো গদ্য কিশোর কবিতাও লিখেছিলাম তখন। সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে এসে আমার প্রথম কিশোর কবিতার বই হৈ হৈ রৈ রৈ বের হয়। এর পর বের হয় প্রজাপতি ও প্রজাপতি। এখন আমার কিশোর কবিতার বইয়ের সংখ্যা একেবারে কম নয়।

আনজীর লিটন : আপনি এক্সেপ্শনাল দুটো বই লিখেছেন। উপদেশমূলক কবিতার বই এবং কাহিনিভিত্তিক উপদেশমূলক কবিতার বই―যথাক্রমে সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি এবং কাজে হব বড়। চল্লিশের দশকের মধ্যভাগ থেকে যে দুটি ধারার কবিতা দুই বাংলাতেই কোনও কবিকেই লিখতে দেখা যায়নি, সেই ধারার পুনর্জীবনে আপনি নব্বইয়ের দশক থেকে সক্রিয় হয়ে উঠলেন কোন্ লক্ষ্য থেকে, একটু খুলে বলবেন কি  ?

আখতার হুসেন : সমাজের অবক্ষয়, মানুষের লোভ-লালসা মাত্রাহীনভাবে বেড়ে যাওয়া―এসব লক্ষ্য করে আমার মনে একটা ধারণা জš§ নেয় যে, আমি পুলিশ বা দারোগা নই যে, সেই শক্তির জোরে সমাজের এই কালিমা দূর করব বা রোধ করব। আমি কবি, আমার ক্ষুদ্র কবিত্ব শক্তি দিয়ে উপদেশমূলক কবিতা লিখি না কেন! এসব কবিতা পাঠ করে শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে বড়রাও পাঠ করে যদি তাদের চরিত্র নির্মল করার চেষ্টা করে তাহলে আমার জীবন সামান্য হলেও ধন্য হবে। ফলে এই দুই ধরনের কবিতা লিখতে শুরু করি। তারই ফসল আমার দুটো বই―সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি এবং কাজে হব বড়। এ ব্যাপারে আমি গর্ব করতে পারি যে, আমার সমকালে এ জাতীয় কবিতা আর কেউ লিখছেন বলে মনে হয় না। তবে গদ্যে অনেকেই উপদেশমূলক বই লিখেছেন।

আনজীর লিটন : আপনি তো ছোটদের জন্য নাটক, জীবনী এবং গানও লিখেছেন।

আখতার হুসেন : ছোটদের নাটক আপনার শিশু একাডেমি থেকেই বেরিয়েছিল সেই আশির দশকে―খেলাঘরের পুতুলগুলো। বহু জায়গায় মঞ্চস্থ হয়েছে। টেলিভিশনেও হয়েছে। লিখেছি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মওলানা আবুল কালাম আজাদ, মণি সিংহ এবং ফ্রান্সের বীরকন্যা জোয়ান অব আর্কের জীবনী। অনেক জনপ্রিয় ধ্রুপদী গল্পের পুনর্লিখন করেছি। সম্পাদনা করেছি বাংলা ও বিশ্বসাহিত্যের অনেক বিষয়ের গ্রন্থের। এখন লিখছি ছোটদের নাটক। আমার লেখা ছোটদের গানও বেশ জনপ্রিয়, বিশেষত দেশজুড়ে খেলাঘরের ভাইবোনদের মধ্যে।

আনজীর লিটন : আপনার লেখালেখির জীবন, সেই জীবনকে উৎসাহিত যাঁরা করেছেন, তাঁদের কথা যদি একটু বলেন…।

আখতার হুসেন : প্রথমেই বলতে হবে আমার আব্বার কথা। যে বয়সে ‘আউট বই’ পড়া নিষিদ্ধ ছিল তখনকার দিনে, বিশেষত স্কুলের শিক্ষার্থীদের, সেই তখন, আমি যখন ক্লাশ ফোরে পড়ি, তখন সহজ-সরল ভাষায় লেখা জীবনের প্রথম আউট বই ‘আঙ্কেল টমস কেবিন’ আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন আমার আব্বা। মা-ও আমাকে উৎসাহ দিতেন।

এছাড়া আমি আমার লেখকজীবনে আর যাঁদের কাছে অশেষ কৃতজ্ঞ, তাঁরা হলেন কবি হাবীবুর রহমান (ভাইয়া), আতোয়ার রহমান, রোকনুজ্জামান খান (দাদাভাই), শিশুসাহিত্যিক ফয়েজ আহমদ, রফিকুল হক (দাদুভাই), দৈনিক সংবাদ-এর সম্পাদক বজলুর রহমান, আফলাতুন ভাই এবং প্রয়াত শিশুসাহিত্যিক নিয়ামত হোসেন।

আনজীর লিটন : আমাদের শিশুসাহিত্য সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন…।

আখতার হুসেন : বলা চলে আমাদের শিশুসাহিত্য ছড়া-কবিতার সাম্রাজ্য। আমরা এ দুটি বিভাগের লেখা নিয়ে রীতিমতো গর্ব করতে পারি। কিন্তু আমরা বলতে গেলে খুবই দীন এবং দরিদ্র হাসির গল্প, নাটক ও বিজ্ঞান বিষয়ে লেখার পাশাপাশি ছোটদের নানা বিষয়ের প্রবন্ধ লেখার ব্যাপারে।

আনজীর লিটন : আপনি তো তখনকার পশ্চিম জার্মানিতে ছিলেন। কেমন কেটেছে সেসব দিন ?

আখতার হুসেন : ছোট্ট করে বলি, আমি যদি সে দেশে না যেতাম, তাহলে বুঝতামই না সভ্য হওয়ার জন্য মানুষের কত কিছুর দরকার। পারস্পরিক আচরণ, কথা বলা, নৈতিক মূল্যবোধ―এসব কিছুর মধ্যে সভ্য মানুষ হওয়ার উপাদান রয়েছে।

আনজীর লিটন : আপনার বয়স এখন আশি ছুঁই ছুঁই। এ বয়সে এসে আপনার অনুভূতি সম্পর্কে কিছু বলবেন  ?

আখতার হুসেন : দেখুন, জš§ালে একদিন না একদিন মৃত্যু আমাকে বা আপনাকে অনিবার্যভাবে স্পর্শ করবেই। ফলে আয়ুষ্মান হওয়ার জন্য আপনাকে সচেষ্ট হতে হবে। বিশেষ করে সৃজনশীল মানুষদের, তিনি শিল্প বা সাহিত্যের যে ক্ষেত্রেই কাজ করুন না কেন, বাঁচতে জানতে হবে। কারণ তিনি যত আয়ুষ্মান হবেন ততই তিনি আমাদের সৃষ্টির সম্ভারে আমাদের জীবনকে ঋদ্ধ করতে পারবেন।

আনজীর লিটন : আর বেদনা ?

আখতার হুসেন : বেদনা দুরকম। একটা হলো হৃদয়টাকে ভেঙে মুচড়ে দেয়। আরেকটা মনের ভেতরে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা-প্রত্যয় তৈরি করে দেয়, আমি বেদনা জয় করব। তবে বেদনা কোনও দিন মুছে যায় না। হৃদয়ে মিশে থাকে।

আনজীর লিটন : আচ্ছা, আপনার সুখের সংজ্ঞা কী ?

আখতার হুসেন : সুখ আসলে দুর্লভ জিনিস। নানাভাবে সুখ অর্জন করা যায়। এর কোনও নির্দিষ্ট সংজ্ঞা আমার কাছে নেই। এখনও লেখা ছাপা হলে খুশি হই। এটাকে সুখ হিসেবে দেখি। পরিশ্রমের জন্য পাওয়া পুরস্কারের অপর নাম সুখ।

আনজীর লিটন : আপনি সুখে থাকুন। ধন্যবাদ আখতার ভাই।

আখতার হুসেন : আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ। আপনিও সুখে থাকুন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button