‘শিল্প ও প্রেমে কোনও ফাঁকি চলে না’ : সুব্রত বড়ুয়া
প্রচ্ছদ রচনা : মুখোমুখি কথাসাহিত্যিক সুব্রত বড়ুয়া
আলাপচারিতায় সৈকত হাবিব
[সুব্রত বড়ুয়ার জন্ম ১ জানুয়ারি ১৯৪৬, চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে। পিতা : অন্নদাচরণ বড়ুয়া, মাতা : সরোজিনী বড়ুয়া।শিক্ষাজীবনের সূচনা নিজ গ্রামের ছিলোনীয়া ফ্রি প্রাইমারি বিদ্যালয়ে। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর চতুর্থ শ্রেণি থেকে ম্যাট্রিক পর্যন্ত পড়েছেন চট্টগ্রাম শহরস্থ মিউনিসিপাল মডেল হাই স্কুলে। সেখান থেকে ১৯৬১ সালে ম্যাট্রিক পাস করার পর ভর্তি হন চট্টগ্রাম কলেজে উচ্চমাধ্যমিক (বিজ্ঞান) শ্রেণিতে। সেখানে পদার্থবিজ্ঞানে সম্মান নিয়ে বিএসসি শেষ করে এমএসসি শেষ পর্ব পড়েন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৬৭ সালে স্নাতকোত্তর।
কর্মজীবন শুরু চট্টগ্রাম শহরের সেন্ট প্লাসিডস হাই স্কুলে বিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে, ১৯৬৯ সালের জুলাই মাসে। সে বছর ডিসেম্বর মাসে যোগ দেন চট্টগ্রামের রাঙ্গুনীয়া কলেজে পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে। পরের বছর ঢাকায় বাংলা একাডেমিতে যোগ দেন সহকারী অনুবাদক হিসেবে (১৯৭০ সালের ৫ ডিসেম্বর)। ৩২ বছর বাংলা একাডেমিতে কাজ করার পর ২০০২ সালের ডিসেম্বরে পরিচালক হিসেবে অবসর নেন।
১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ পর্যন্ত খণ্ডকালীন (সহকারী ম্যাগাজিন সম্পাদক) দৈনিক ইত্তেফাকে কাজ করেন সাহিত্য সম্পাদক রোকনুজ্জামান খানের সহকারী হিসেবে।
প্রথম বই চাঁদে প্রথম মানুষ প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সালে, চট্টগ্রামের বিখ্যাত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে। দ্বিতীয় বই গল্পগ্রন্থ জোনাকির শহর প্রকাশিত হয় ১৯৭০ সালে।
প্রকাশিত বই : গল্পগ্রন্থ : জোনাকি শহর; কাচপোকা; আত্মচরিত ও অন্যান্য গল্প; অনধিকার; তৃণা; মধ্যাহ্নের পাখি ও গল্পসংগ্রহ। বিজ্ঞানবিষয়ক বই : বিজ্ঞানের ইতিকথা : সন্ধানী মানুষ; বিদ্যুতের কাহিনী; গ্রিনিচ মানমন্দির; সৌরজগৎ; পরমাণুর পরম কথা; শিশু-কিশোর বিজ্ঞানসমগ্র; আকাশ জুড়ে মেঘ জমেছে; বিজ্ঞানচর্চা : প্রসঙ্গ অনুষঙ্গ; কণা, কোয়ান্টাম ও তরঙ্গ (অনুবাদ)। ইতিহাসবিষয়ক বই : আমাদের এই বাংলাদেশ/এই আমাদের বাংলাদেশ; ইতিহাসের পলাশী; ইতিহাসে বাংলাদেশ; বাংলার সংগ্রাম বাংলার বিদ্রোহ এবং বাঙালি ও বাংলাদেশ। অনুবাদ : এমিল ও গোয়েন্দা বাহিনী; শঙ্খচিল; দি রাইট স্টাফ; এগারোটি বিদেশি গল্প; আমেরিকার ভৌগোলিক রূপরেখা; উপন্যাসের বিষয়-আশয়; পদার্থবিজ্ঞানে সংকট ও সম্মানীয়া বারাঙ্গনা (নাটক)। শিশুসাহিত্য : দিনগুলি হায় সোনার খাঁচায় (উপন্যাস); কিশোরসমগ্র; রেলগাড়ি কতদূর (গল্প) ও জাদুর বাঁশি (অনুবাদ)। উপন্যাস : গ্রহণের দিন; ধলপহর। কবিতা : হলুদ বিকেলের গান; কবিতাসংগ্রহ। প্রবন্ধ : বাঙালির ইতিহাস ও সংস্কৃতি; সাহিত্য সমাজ ও বিজ্ঞান; রবীন্দ্রনাথ ও বিজ্ঞান; রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞানভাবনা; রবীন্দ্রনাথ ও জগদীশচন্দ্র; বাংলা পরিভাষার সন্ধানে ও গুণীজন প্রিয়জন। জীবনীগ্রন্থ : সংঘরাজ শীলালঙ্কার মহাথেরো; শহীদুল্লা কায়সার; মোহাম্মদ আবদুল জব্বার : জীবন ও কর্ম; জীবনানন্দ : কিশোর জীবনী; অশোক বড়ুয়া; দস্তয়েভস্কি; বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়; অনিসুজ্জামান জীবনকথা; বঙ্গবন্ধুর জীবনকথা; টুঙ্গিপাড়ায় সেই অদম্য কিশোর; গল্পে গল্পে জীবনানন্দ ও দুই ভুবনের দুই সারথি। পরিভাষা : পরিভাষা অভিধান/ব্যবহারিক পরিভাষা। বর্তমানে মাসিক সাহিত্যপত্র কালি ও কলম-এর সম্পাদক হিসেবে কর্মরত।
উল্লেখযোগ্য পুরস্কার: চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান পরিষদ স্বর্ণপদক, শিশু একাডেমি পুরস্কার, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার এবং একুশে পদক।]
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি সৈকত হাবিব
সৈকত হাবিব : নতুন বছরের শুরুতেই আপনি জীবনের নতুন বছরে (৭৮ বছরে) পদার্পণ করতে যাচ্ছেন। আপনাকে অভিবাদন। এই মুহূর্তে কেমন বোধ করছেন ?
সুব্রত বড়ুয়া : বয়সের এই হিসেব ম্যাট্রিক সার্টিফিকেট অনুযায়ী। আসল বয়স আরও বছরখানেক বেশি হবে। তবে নিজেকে বয়োবৃদ্ধ ভেবে সবসময় গুটিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে না। আরও পড়তে ও কাজ করে যেতে চাই।
সৈকত হাবিব : জীবনের দীর্ঘ পথ পেরিয়ে এলেন। জীবন সম্পর্কে কোনও সত্য উপলব্ধি ?
সুব্রত বড়ুয়া : জীবনের পথটা কেবল সামনের দিকে, পেছনে ফেরা যায় না। সরল সাদাসিধে জীবনযাপনই কাম্য। নিজের যথার্থ ও সত্যিকারের প্রাপ্যটুকুই কেবল পেতে চাই।
সৈকত হাবিব : যাকে বলে কর্মমুখর জীবন আপনি এখনও তা যাপন করছেন। কিন্তু আপনার কাজ ও আচরণে মুখরতার চেয়ে নৈঃশব্দ্য বেশি। অথচ কাজের পরিমাণ ঈর্ষণীয়। এই বৈশিষ্ট্য কি সহজাত, নাকি অর্জিত ? কিংবা এর নেপথ্যে কি কোনও চিন্তা বা দর্শন কাজ করেছে ?
সুব্রত বড়ুয়া : মনে হয়, এ বৈশিষ্ট্য আমি কিছুটা আমার মায়ের কাছ থেকে পেয়েছি। কোনও চিন্তা বা দর্শন কাজ করছে না। কাজ করেছি নিজের ইচ্ছা ও আনন্দ থেকে। আমার কাজ যদি কারও ভালো লাগে কিংবা কোনও কাজে আসে তাহলেই কাজের সার্থকতা বলে মনে করি।
সৈকত হাবিব : সৃষ্টির এই প্রেরণা কোথা থেকে কীভাবে এল বলে মনে হয় ?
সুব্রত বড়ুয়া : বাবা বই পড়তেন। বাড়িতে ছোটখাটো লাইব্রেরি ছিল। সেখানে ছিল রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, নবীনচন্দ্র সেন, অন্নদাশঙ্কর রায়, নাট্যকার বিধায়ক ভট্টাচার্যসহ বেশকিছু লেখকের গল্প-উপন্যাস-কবিতাসহ নানা ধরনের বই। সেখান থেকে বই ও লেখালেখির প্রতি আগ্রহ। তবে লেখার আগ্রহ বেড়ে যায় চট্টগ্রাম কলেজে পড়তে এসে। এ সময় বিশেষভাবে চট্টগ্রাম কলেজের পাঠাগার, ইউসিস লাইব্রেরি ও ব্রিটিশ কউিন্সিল লাইব্রেরি থেকে বিচিত্র বিষয়ে পড়াশোনার সুযোগ পাই। সে সময় নাথানিয়েল হথর্ন, ওয়াল্টার স্কট, হেমিংওয়ে, জন স্টেইনবেকসহ অনেকের উপন্যাস পড়েছি। এগুলো অনেক প্রেরণা দিয়েছে।
সৈকত হাবিব : এ সূত্রেই আরেকটি কৌতূহল, আপনার আদর্শ বা প্রিয় লেখক কারা?
সুব্রত বড়ুয়া : অনেকেই আছেন। তবে বিদেশিদের মধ্যে তলস্তয়, দস্তয়েভস্কি, চার্লস ডিকেন্স, ওয়াল্টার স্কট, হেমিংওয়ে, স্টেইনবেক, হাওয়ার্ড ফাস্ট আর বাঙালিদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ, তারাশঙ্কর, মানিক, বিভূতিভূষণ, জীবনানন্দ, অমিয়ভূষণ, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদের নাম এ মুহূর্তে মনে পড়ছে।
সৈকত হাবিব : সাহিত্য সংস্কৃতির প্রায় সব শাখাতেই কাজ করেছেন। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ইতিহাস, শিশুসাহিত্য, জীবনী, বিজ্ঞান, অনুবাদ, ভাষা ও শিক্ষা। কোন মাধ্যমটি আপনার প্রিয় ?
সুব্রত বড়ুয়া : গল্পই আমার প্রিয় মাধ্যম। তবে খুব বেশি গল্প যে লিখেছি তাও নয়। আসলে খুব বেশি লেখার দরকারও পড়ে না। কেবল নিজের ভাবনা ও অনুভবের কথাই বলার চেষ্টা করেছি নিজের মতো করে।
সৈকত হাবিব : কিন্তু আমার তো মনে হয়, আপনার গল্পই সবচে কম পঠিত ?
সুব্রত বড়ুয়া : বাংলা সাহিত্যেরও তো সেরা অনেক গল্পই অপঠিত বা অল্পপঠিত। আমার ক্ষেত্রে একটা কারণ হতে পারে ষাট-সত্তর দশকের পর গল্প লিখেছি খুব কম। আরেকটা কারণ হতে পারে আমার নিরীক্ষাপ্রবণতা। আবার নানা মাধ্যমে কাজ করেছি বলে হয়তো পাঠকদের দৃষ্টি এদিকটায় কম পড়েছে।
সৈকত হাবিব : যেহেতু সাহিত্য ও চিন্তনচর্চার বিচিত্র মাধ্যমে আপনার সহজ যাতায়াত তাই বাংলাদেশের সাহিত্য ও চিন্তাচর্চার সার্বিক মান সম্পর্কে আপনার মত আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ…
সুব্রত বড়ুয়া : বাংলাদেশের সাহিত্য ও চিন্তনচর্চা আশাব্যঞ্জক। তবে আরও বেশি সঠিক দিকনির্দেশনা প্রয়োজন। সাহিত্যবিচার বিষয়ে যথেষ্ট যত্নবান হতে হবে।
সৈকত হাবিব : ‘দিকনির্দেশনা’ ও ‘সাহিত্যবিচার’ ব্যাপারটা যদি একটু খোলাসা করতেন―
সুব্রত বড়ুয়া : বলতে চাইছি, প্রকৃত গঠনমূলক ও নিরপেক্ষ সাহিত্যবিচারের অভাব…
সৈকত হাবিব : অর্থাৎ সমালোচনা- সাহিত্য দুর্বল ?
সুব্রত বড়ুয়া : আমাদের এখানে সমালোচনার নামে যা লেখা বা বলা হয় তা অতি-প্রশংসা। এটি সাহিত্য মূল্যায়নে সুস্থতার পরিচায়ক নয়। এসব দেখে আশঙ্কা হয়, বিশ্বসাহিত্য ও বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে হয়তো আমাদের লেখক-সমালোচক-পাঠকের তেমন ঘনিষ্ঠ পরিচয় নেই।
সৈকত হাবিব : আপনি বাংলা ভাষার একজন শব্দশিল্পী ও মুক্তিযুদ্ধের শব্দসৈনিক। স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে বাংলা ভাষা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তবতা সম্পর্কে যদি দয়া করে কিছু বলেন…
সুব্রত বড়ুয়া : বাংলা ভাষার চর্চা এবং মাতৃভাষার ব্যাপক ব্যবহার নিয়ে আরও উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি ও ইতিহাস বিষয়ে সাধারণ মানুষকে ব্যাপকভাবে জানাতে হবে।
সৈকত হাবিব : নানাভাবে তো জানান দেওয়া চলছে। কিন্তু সমস্যার জায়গাটা কোথায় বলে মনে করছেন ?
সুব্রত বড়ুয়া : মুক্তিযুদ্ধের পর অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে এসেছি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসচর্চার নামে এখনও যা চলছে, তার বেশির ভাগটাই উচ্ছ্বাস ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর প্রেক্ষাপট, সংকট-সমস্যা, সমাজ- ইতিহাস-রাজনৈতিক বাস্তবতা, জনসাধারণের আশা-আকাক্সক্ষা, চেতনার পরিপ্রেক্ষিত ও প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি ইত্যাদির নিরপেক্ষ বিচার-বিশ্লেষণ তেমন হয়নি। তাই এখনও প্রধানত আবেগের চর্চা বলেই মনে হয়। এখন নিরপেক্ষ ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ তুলে ধরার প্রয়োজন ও গুরুত্ব অনেক বেশি।
সৈকত হাবিব : আপনি দীর্ঘদিন বাংলা একাডেমির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরিচালক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেছেন। আপনি কি মনে করেন প্রতিষ্ঠানটি তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছে ? আর ইদানীং তার পুরস্কার ও কার্যক্রম নিয়েও অনেক বিতর্ক তৈরি হচ্ছে। এসব সংকট উত্তরণে আপনি কি কোনও পরামর্শ দিতে চান ?
সুব্রত বড়ুয়া : বাংলা একাডেমির কাছ থেকে এ দেশের মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি। তাই প্রশ্ন ও বিতর্কও বেশি। বাংলা একাডেমিতে উপযুক্ত জনশক্তি থাকা জরুরি। সে দিকটি নানাভাবে ব্যাহত হয়েছে বলে মনে হয়। এ বিষয়ে আরও যত্নবান হওয়া প্রয়োজন।
সৈকত হাবিব : কী ধরনের যত্ন আসলে প্রয়োজন বলে মনে করেন ?
সুব্রত বড়ুয়া : বাংলা একাডেমির প্রধান কাজ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গবেষণা। কিন্তু এই গবেষণা বলতে আমরা কী বুঝব―সে বিষয়ে ধারণা স্পষ্ট হওয়া দরকার। বাংলা একাডেমির কাছে জনগণের প্রত্যাশার একটি হচ্ছে এই প্রতিষ্ঠান অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে একাডেমিক কাজ করবে। আরেকটি প্রত্যাশা, এ দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতিতে বিশ্বচেতনার যে আবহ তা সঞ্চারিত করবে। এর জন্য প্রয়োজন অত্যন্ত দক্ষ জনশক্তি ও যথার্থ যোগ্য পরিচালনা, যার বেশ ঘাটতি রয়েছে।
সৈকত হাবিব : সম্প্রতি আপনি বাংলাদেশের অন্যতম সাহিত্য পত্রিকা কালি ও কলম-এর সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। বাংলাদেশে সাহিত্য পত্রিকার সংকট ও সম্ভাবনা বিষয়ে যদি একটু আলোকপাত করেন ?
সুব্রত বড়ুয়া : কালি ও কলম-এর প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক আবুল হাসনাতের আকস্মিক মৃত্যুর ফলে দায়িত্ব আমাকে গ্রহণ করতে হয়েছে। নিজেকে এর জন্য তৈরি করতে হচ্ছে। তবে ভালো লেখার অভাব আছে। আরও বেশি পরিশ্রমী লেখক চাই।
সৈকত হাবিব : পরিশ্রম ? সেটি একজন লেখক কী প্রক্রিয়ায় করতে পারেন ?
সুব্রত বড়ুয়া : চোখ, কান, মন ও হৃদয় খোলা রেখে জগৎ-সংসার থেকে তাবৎ কিছু গ্রহণ করার চেষ্টা করতে হবে। এবং প্রতিনিয়ত নিজের পঠনপাঠন ও যোগ্যতা বাড়িয়ে যেতে হবে। একটি কথা মনে রাখা দরকার, শিল্প ও প্রেমে কোনও ফাঁকি চলে না। ফাঁকি থাকলেই ধরা পড়ে যাবে। সেই ফাঁকি ঢাকবার জন্য যত কায়দাকানুনই করা হোক না কেন, তাতে কোনও কাজ হবে না; কখনও হয়নি।
সৈকত হাবিব : কিন্তু এখন তো ফাঁকির প্রবণতাই বেশি―
সুব্রত বড়ুয়া : ফাঁকির প্রবণতা সবসময় ছিল, থাকবে। এ দিয়ে বাজিমাৎ করার মানুষও থাকবে। কিন্তু আমাদের চেষ্টা হবে সেই ফাঁকিকে দূরে ঠেলে দিয়ে জীবনসন্ধানী দৃষ্টিভঙ্গি তৈরির চেষ্টা করা।
সৈকত হাবিব : সত্তর বছরের সজ্ঞান ও সক্রিয় জীবন আপনার। এ জীবনের অভিজ্ঞতা, অর্জন আর বাস্তবতাকে যদি মূল্যায়ন করতে বলি ?
সুব্রত বড়ুয়া : অভিজ্ঞতা ও অর্জন বিষয়ে কখনও তো তেমন করে ভাবিনি। জীবনে চলাটাই বড় ব্যাপার। তাতে প্রাপ্তি- অপ্রাপ্তি, দুঃখকষ্ট তো থাকবেই। সবকিছু গ্রহণ করার শক্তি অর্জনের বোধটাই আসল। প্ররিশ্রম আর সততাই বড় মূলধন বলে মনে করি।
সৈকত হাবিব : আপনার প্রিয় বই সম্পর্কে শুনতে চাই… ?
সুব্রত বড়ুয়া : বিশ্বসাহিত্য ও বাংলা সাহিত্যের সেরা বইগুলো পড়ার চেষ্টা করেছি। কেবল চোখ আর মন দিয়ে নয়, হৃদয় দিয়েও। এ মুহূর্তে মনে পড়ছে: দস্তয়েভস্কির ইডিয়ট ও ব্রাদার কারামাজোভ, তলস্তয়ের ওয়ার অ্যান্ড পিস ও আন্না কারেনিনা, হাওয়ার্ড ফাস্টের স্পার্টাকাস ও মোজেস: প্রিন্স অব ইজিপ্ট, হেমিংওয়ের ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি ও ফর হুম দ্য বেল টোলস, স্টেইনবেকের অব মাইস অ্যান্ড মেন, রবীন্দ্রনাথের গোরা ও চোখের বালি, শরৎচন্দ্রের গৃহদাহ, বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী ও আরণ্যক, মানিকের পদ্মা নদীর মাঝি ও পুতুল নাচের ইতিকথা, তারাশঙ্করের হাঁসুলী বাঁকের উপকথা ও কবি, অমিয়ভূষণের রাজনগর ও নয়নতারা, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লাল সালু ও কাঁদো নদী কাঁদো, আবু ইসহাকের সূর্য দীঘল বাড়ি, শওকত ওসমানের জননী, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের চিলেকোঠার সেপাই।
সৈকত হাবিব : কোনও বিশেষ আনন্দ-বেদনার স্মৃতি ?
সুব্রত বড়ুয়া : প্রিয়জন ও আপনজনদের সঙ্গে মিলন ও বিচ্ছেদের স্মৃতি।
সৈকত হাবিব : একজন লেখকের প্রধান কী যোগ্যতা থাকা দরকার বলে মনে হয় ?
সুব্রত বড়ুয়া : প্রথম ও প্রধান যোগ্যতা হলো যে ভাষায় তিনি লিখবেন সে ভাষা ভালোভাবে আয়ত্ত করা আর মনের চোখটা খোলা রাখা এবং ইতিহাস- ঐতিহ্য-সমাজ ইত্যাদি সম্পর্কে খোলা মনে জানার চেষ্টা করা।
সৈকত হাবিব : তরুণ লেখকদের প্রতি আপনার কোনও পরামর্শ/নির্দেশনা ?
সুব্রত বড়ুয়া : নিজের লেখা নিজেই বিচার করে দেখুন। জানা ও দেখার শক্তিটা নিরন্তর বাড়িয়ে যেতে থাকুন। তবে সবচেয়ে বড় কথা, জীবনকে দেখা ও উপলব্ধি করার চেষ্টা এবং বিপুল পাঠ দরকার।
সৈকত হাবিব : আপনার চর্চার অন্যতম বিষয় শিশুসাহিত্য, বিজ্ঞান, শিক্ষা ও ভাষা। বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষা-পরিস্থিতি সম্পর্কে যদি মূল্যায়ন করতেন ?
সুব্রত বড়ুয়া : শিক্ষা নিয়ে তো অনেকেই ভাবছেন। তাঁদের চিন্তাভাবনার কথা তাঁরা বলছেনও। যাঁরা শেখাবেন তাঁদের আরও যোগ্য করে তুলতে হবে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষকতার পেশার প্রতি মেধাবীদের আকর্ষণ আরও বাড়ানোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
সৈকত হাবিব : বহুকাল ধরেই পাঠ-সংস্কৃতির দৈন্যের কথা আমরা জানি। এর জন্য কি আমাদের শিক্ষা-ব্যবস্থারও কোনও দায় আছে ?
সুব্রত বড়ুয়া : একসময় স্কুল-কলেজের পাঠক্রমে সাহিত্যে জোর দেওয়া হতো। এখন সেটি সেভাবে আর নেই। অথচ প্রথাগত শিক্ষার মধ্য দিয়েই মানুষ সাহিত্য-সংস্কৃতি-ইতিহাস-সমাজ ইত্যাদি জানার সুযোগ পায় এবং আরও উৎকর্ষের দিকে এগিয়ে যায়। কিন্তু শুধুই পরীক্ষা পাসের শিক্ষাপদ্ধতি ও ভোগের সংস্কৃতি মানুষের জীবনদৃষ্টিকে পূর্ণতা দিতে পারে না। আমাদের জীবনের সর্বক্ষেত্রে ভোগসর্বস্বতার মনোভাব থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা থাকা দরকার।
সৈকত হাবিব : জীবনের কোনও স্বপ্ন/প্রত্যাশা ?
সুব্রত বড়ুয়া : নিজেকে আরও বেশি পাঠ ও চিন্তার দিকে নিয়ে যেতে চাই। সহজ আনন্দই জীবনের লক্ষ্য।
সৈকত হাবিব : এমন কোনও সৃষ্টি বা লেখা, যা এখনও আপনার স্বপ্ন…
সুব্রত বড়ুয়া : একটি আত্মজৈবনিক উপন্যাস লেখার ইচ্ছে ছিল। সেটির আকাক্সক্ষা এখনও আছে ?
সৈকত হাবিব : শেষ করার আগে, আপনার সুস্থ, সক্রিয় ও সৃষ্টিশীল শতায়ু প্রার্থনা করছি।
সুব্রত বড়ুয়া : যতদিন বাঁচি সক্রিয়ভাবে যেন থাকি, চিন্তার সক্রিয়তা যেন থাকে। এই প্রার্থনার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।