আর্কাইভগল্প

অবনীশের গল্প : সুব্রত বড়ুয়া

আবার পড়ি : সুব্রত বড়ুয়ার গল্প

একদিন খুব ভোরে, তখনও নিদ্রিত শহরের ঘুম ভাঙেনি, রাস্তার আলো নেভেনি, ফর্সা সকালের ফুটফুটে আলো তরুণীর নিরাবরণ বক্ষের মতো হঠাৎ কালো ব্লাউজের বাইরে বেরিয়ে আসেনি—ঠিক তখনই অবনীশের সঙ্গে দেখা। কেন জানি না, অকস্মাৎ নিয়ম ভঙ্গ করে অবনীশের ঘুম ভেঙেছিল। অবনীশ তারপর একবার বালিশের পাশে রাখা হাতঘড়িটার কালো ডায়ালে সময় খুঁজে খুঁজে হতাশ হয়ে হাই তুলল। মাথার নিচে বালিশের ওপর একটা হাত বেওয়ারিশ ফেলে রেখে কিছু একটা ভাবতে চাইল। অমনি সময়ে অবনীশ এবং আমি—আমরা দুজন আজন্ম-পরিচিত বন্ধু ও শত্রু পরস্পর মুখোমুখি হয়ে গেলাম।

অবনীশ অনেক রাতে ঘুমোয়। তার ঘুম ভাঙে দেরিতে। প্রতিদিন উঠে ডানপাশে খোলা জানালা দিয়ে সূর্যের নিজস্ব রোদগুলো নামতে দেখে। সে জানে—সূর্য বিরাট এক পারমাণবিক শক্তি-কেন্দ্র। ওখানে প্রতিনিয়ত বিপুল বিরাট ব্যাপ্তিতে পারমাণবিক বিক্রিয়া ঘটে চলেছে। হাইড্রোজেনের অসংখ্য পরমাণু প্রতি মূূহূর্তে ফিউশন প্রক্রিয়ায় রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে নিরীহ হিলিয়ামে।

গ্রিক দার্শনিক ডেমোক্রিটাস একদিন, বহুকাল আগে, নদীতীরে প্রফুল্ল বালিরাশির ওপর হাঁটতে হাঁটতে অকস্মাৎ, পদার্থের মৌলকণা অণু সম্পর্কে পরম ভাবনায় নিমজ্জিত হয়েছিলেন। হিরোশিমা-নাগাসাকি ১৯৪৫ সালের আগস্ট মাসে মানুষের প্রতিভার আগুনে দগ্ধ হয়েছিল। ১৯১১ সালে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী রাদারফোর্ড পরমাণুর চেহারা চিনেছিলেন। অবনীশের জন্ম বিশ শতকের চতুর্থ দশের মাঝামাঝি সময়ে, অবশ্যই আণবিক যুগে এবং সেজন্যই সে অবিচ্ছিন্ন বস্তুপ্রবাহে বিশ্বাস করে না। কেননা বস্তু ক্রমশ খণ্ডিত হতে থাকলে একসময় মৌলঅণুতে এসে থমকে দাঁড়াবে। অতএব অবনীশ কখনও অবিচ্ছিন্ন ভাবনায় নিমজ্জিত থাকতে পারে না—ভাবনাগুলো ক্রমশ পরস্পরের কাছ থেকে সরে যায়, যেন সম্পর্কহীন। এমনি সময়ে অবনীশ হাই তুলে একটা কিছু ভাবতে গিয়ে আমার মুখোমুখি হলো—অথবা আমি অবনীশের। মশারির নিচে কেমন এক জড়ানো অন্ধকার যেন সার্কাসের বাঘের মতো ঘাপটি মেরে শুয়ে ছিল বুক পেতে। আমি অবনীশকে জিজ্ঞেস করলাম—‘ছেলেবেলার দেখা সেই সার্কাসের কথা তোমার মনে পড়ে ?’ আমার কথা শুনে, যেন আমি সাংঘাতিক একটা কিছু বলে ফেলেছি—অবনীশ হাসল। ওর হাসিটুকু আমি দেখতে পেলাম না। শব্দহীন অনাড়ম্বর হাসি অথচ কেমন রহস্যময়, ঠিক বুঝতে পারছি অবনীশ একবার হাসল। তারপর সে ভাবল তার ছেলেবেলার সেই সার্কাস দেখতে যাবার কথা। পুরোনো চলচ্চিত্রের মতো কোথাও ঝাপসা, কোথাও সম্পূর্ণ অন্ধকার, কোথাও বা বেশ স্পষ্ট। অবনীশ একবার পিঠের ডানদিকে ব্যথা অনুভব করল। বৃষ্টি যদি শীতের হাওয়াকে সিক্ত করে তাহলে অই জায়গায় মৃৃদ কনকনে ব্যথা অনুভূত হয়—মৃদু যন্ত্রণা সারাক্ষণ সিরসির করে চেতনার মধ্যে, বোধের মধ্যে—খেলনা রেলগাড়ির মতো শুধু ঘুরতে থাকে। ছেলেবেলায় সার্কাস দেখতে গিয়ে মনে পড়ছে—গ্যালারি ভেঙে পড়তে পড়তে বেঁচে গিয়েছিল। বালার এক বন্ধু, বেশ দশাসই চেহারার একজন, সেদিন ডান হাত দিয়ে অবনীশের নিশ্চিত মৃত্যু অথবা অঙ্গহানি প্রতিরোধ করেছিলেন। তারও আগে আর একবার প্রথম সেই সার্কাস দেখতে গিয়ে সার্কাসের চারজন জোকারকে দেখে ভীষণ মজা পেয়েছিল এবং বিরাট লৌহপিঞ্জরে জনৈকা মোহিনী যুবতীকে অসম্ভব দ্রুততায় বিচিত্র কলাকৌশলে মোটর সাইকেল চালাতে দেখে সে, সপ্তম কি অষ্টম বর্ষীয় বালক; রীতিমত অভিভূত হয়েছিল।

আজকাল জগতে অধিকাংশ পরিচিত-অপরিচিত মানুষকে তার জোকার বলে ভ্রম হয়, যেন এখানে সবাই তেমনই রংদার জামা-পোশাক পরে সকলকে তোষণের জন্য দাঁড়িয়ে আছে, ব্যস্ত হচ্ছে প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় ক্রীড়াকুশলতায়। কিংব সেসব যুবতীকুল যারা মোটর সাইকেল চালনায় অনভিজ্ঞ অথচ যাবতীয় আকর্ষণীয় বিচিত্রতর কলাকৌশলে পারঙ্গম তাদের দেখেও ইদানীং আর সে তেমন অভিভূত হয় না।

এসব কথা আমারও জানা। তবু সে আবার বেশ খুঁটিয়ে, থেমে থেমে—সমস্ত ঘটনার চতুর বর্ণনা দিল এবং মাঝপথে বার বার কিছু একটা যেন ভেবে নিয়ে আশ্বস্ত হতে চেষ্টা করল। আমি অবনীশকে নিয়ে কয়েকটা গল্প লিখেছি। সেই সূত্রে, বলা যায় অবনীশের অনেক কিছুই আমার কাছে নতুন করে প্রতিভাত হয়েছিল, যেন আমি একজন অবনীশকে নতুন করে আবিষ্কার করছিলাম ক্রমশ। প্রথমবার, যখন আমি অবনীশকে নিয়ে গল্প লিখলাম, তখন অবনীশ সমস্তটা পড়ার পর বলেছিল, ‘দুর—এসব কি গল্প ?’ ‘গল্প কী ?—আমি অবনীশকে প্রশ্ন করতেই লাজুক অবনীশ তৎক্ষণাৎ উত্তর দিতে ব্যর্থ হলে—আমার মনে হয়েছিল—আসলে ওকে নিয়ে গল্প লিখতে যাওয়া আমার উচিত হয়নি। জীবনের—মানুষের জীবনে যে কয়েকটি দিন নির্দিষ্ট নির্ধারিত, তা থেকে কিছু একটা অংশ তুলে দিলেই গল্প হয় না।

এতক্ষণে অবনীশ বলল—‘জানো, ভোর রাতে ঘুম ভেঙে গেলে আমার ভীষণ খারাপ লাগে। কেমন যেন সবকিছুই এলোমেলো হয়ে যায়। মশারির ভেতরের এই আড়াই হাত বাই সারে পাঁচ হাত জায়গাটা হঠাৎ ক্রিকেট মাঠের মতো বিশাল হয়ে ওঠে। তখন নিজেকে একটা ক্রিকেট বলের মতো মনে হয়। তুমি তো ক্রিকেট বল চেন। সেই শক্ত নিরেট বল। মনে হয়, দুর্দান্ত এক ফাস্ট-বোলার আমাকে প্রতিবার ছুড়ে মারছে দারুণ আর প্রতিবার বিপরীতে উইকেটের সামনে দাঁড়িয়ে চৌকস এক ব্যাটসম্যান নিপুণ কায়দায় ব্যাট ঘুরিয়ে ওভার-বাউন্ডারি মারছে এবং আমি যথার্থ পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোনাকুনি উপরে উঠে গিয়ে চরম দূরত্বে মুখ থুবড়ে পড়ে গিয়ে গড়াতে গড়াতে অনেক দূরে চলে যাচ্ছি। এবং অনতিবিলম্বে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ফিল্ডার আমাকে কুড়িয়ে নিয়ে আবার সেই বোলারের হাতে ফেরত পাঠাচ্ছে। আর বোলার ফের বিশ কদম পিছিয়ে গিয়ে একই ভঙ্গিতে পুনরায় ছুড়ে মারছে আমাকে।

হেসে বললাম, ‘তোমার যত্তসব বাজে চিন্তা’। স্কুলে থাকতে ক্রিকেট খেলায় ক্যাচ ধরতে গিয়ে অবনীশ একবার হাতের আঙুলে খুব ব্যথা পেয়েছিল। অবনীশ ততক্ষণে একটা সিগারেট ধরিয়েছে। তারপর প্যাকেটটা আবার বালিশের পাশে রেখে দিয়ে আরাম করে ধোঁয়া ছেড়ে বলল—আমার ঘরটা তোমার পছন্দ হয় ?

অন্ধকারে আমি ওর ঘরটা একবার দেখলাম। চারদিকে দেয়াল, দুদিকের দেয়ালে তিনটে দরজা, অন্যান্য ঘরের সঙ্গে সংযোগের জন্য, তিন-চতুর্থাংশ উচ্চতায় দুদেয়ালে সিমেন্টের বড় তাক, তাকের ওপর কি আছে দেখা গেল না। দেয়ারের সাদা রং স্পষ্ট, উপরে ছাদের নিচে পাখার পয়েন্টটা ঝুলে আছে একটু। বললাম—আছে এক রকম। অবনীশ আমার উত্তর শুনে যেন মজার একটা ব্যাপার পেয়েছে হাতের কাছে—হাসল আবার। হাল্কা সহজ হাসি!

বলল—তাহলে দ্যাখো, ঘরটা সম্পর্কে তোমার নির্দিষ্ট কোনও মত নেই অথচ এর অস্তিত্ব সত্য এবং আপাতত আমার মালিকানাধীন এ কথাও সত্য। তোমার মত থাক বা না থাক তাতে আমার ও আমার ঘরের অস্তিত্বের কোনও ক্ষতি নেই।

বললাম—‘এ সবের সঙ্গে তোমার চিন্তার কী সম্পর্ক ?

অবহেলায়, অত সহজে, যেন আমাকে জব্দ করেছে তেমনি ভঙ্গিতে সে বলল—‘অই অস্তিত্বের সম্পর্ক।’

অস্তিত্ব। অবনীশের কথাটা ভাবিয়ে তুলল। আজকাল সে নিশ্চয়ই খুব বেশি এসবই পড়ছে। অথচ ওর বালিশের পাশে দেখতে পাচ্ছি কাফকার ডায়রি। রাতে ঘুমোবার আগে সম্ভবত বইটিই পড়েছিল। সারা ঘরে সিগারেটের টুকরো ছড়ানো—পোড়া, অর্ধদগ্ধ। টেবিলের ওপর বই-পত্তর এলোমেলো, বাসি খবরের কাগজটা লুটোচ্ছে ঘরের মেঝেয়।

অবনীশ এমনিতে বেশ গুছিয়ে চলে—হিসেব করে এবং সম্ভবত তার চরিত্র ও পরিবেশের তুলনায় একটু বেশি হিসেব করেই। বাইরে থেকে ওকে দেখলে বোঝা যায় না ঠিক কতখানি আবেগপ্রবণ এবং ছেলেমানুষ সে।

বচর পাঁচেক আগে আমি অবনীশকে নিয়ে গল্প লিখতে শুরু করি। তখন অবনীশ নামটা আমার কাছে খুব সুন্দর মনে হয়েছিল। অবশ্য অবনীশ নামের অধিকারী অই সুখী সুখী চেহারার যুবকটাকে আমার খুব ভালো লাগত এমন কথা বুকে হাত দিয়ে বলতে পারিনে। সত্যি বলতে কি—মাঝে মাঝে ওকে আমার ভীষণ অসহ্য মনে হয়। আর এখন, সে কি না অস্তিত্বের প্রশ্ন তুলছে যেন ওই অস্তিত্বের ব্যাপারটায় আসলেই সে বিব্রত। ওর দিকে তাকালাম। হাসছে একটু। যেন আমাকে জব্দ করতে পেরেছে এমন একটা ভাব। যেন জব্দ করাটা একটা মজার খেলা—খেলতে খেলতে বেশ একটু আরাম পাওয়া যায়।

অন্ধকারে ওর হাসিটা ছুরির ফলার মতো চকচক করে ঝিলিক দিয়ে উঠল। সিগারেট জ্বলছে অবনীশের হাতে—যখনই সেটায় টান দিচ্ছে ঈষৎরক্তিম আভায় সমস্ত মুখটা ওর ক্ষণকালের জন্য উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে। বললাম, অস্তিত্বের সম্পর্ক সবসময়ে সত্যিকারের সম্পর্ক হয় না।’

আমার কথায় অবনীশ হো হো করে হেসে উঠল। এমন হাসি, ওর মশারির ছাদ তরঙ্গ হলো, ঘরের নিস্তব্ধ বায়ু ক্রমশ স্ফীত হলো, টেবিল-চেয়ার চার-চারটে দেয়াল পরস্পর পরস্পরের দিকে স্থির চোখ রেখে কাঁপতে লাগল। হাসি একসময় স্থিত হলে, তার আগে আমি ওর হাসির ঢেউয়ে যেন তলিয়ে যাচ্ছি—মনে পড়েছিল, অনেকদিন ওকে অমন হাসতে দেখিনি।

তারপর বলল—সত্যিকারের সম্পর্ক বলতে কি বোঝাতে চাও তুমি ? পরম একটা কিছু ? নাকি প্রচলিত অর্থে যা কিছু আমরা সত্য বলে মনে করি!

অবনীশের কথার উত্তরে কী বলা যায়—ভাবতে লাগলাম। জুতসই একটা উত্তর খোঁজার চেষ্টা করতে লাগলাম অনবরত।

সে প্রায় নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে মশারির বাইরে সিগারেট ছুড়ে মারার আগে আর একবার টেনে নিল। ঘরের ঠিক মধ্যিখানে গিয়ে সিগারেটের অংশটি জ্বলতে লাগল। পোড়া সিগারেটের কড়া গন্ধ ঝাঁঝালো—ক্রমে হাওয়ায় ছড়িয়ে পড়ল একটু একটু করে। বাইরে অন্ধকার ক্ষয়ে যাচ্ছে ধীরে। বরফের টুকরো খোলা হওয়ায় যেমন ক্ষয়ে যায় ঠিক তেমনই অন্ধকার ক্রমশ আলোয় বদলে যাচ্ছে। বিন্দু বিন্দু আলো জমা হয়ে এবার একটি উজ্জ্বল ফর্সা সকাল তার নিরাবরণ দেহটা তুলে ধরবে।

আমার বাইশ বছরের অবনীশকে মনে পড়ল। কলেজ-ইলেকশন, পার্টি—প্রাকটিক্যাল ক্লাস এবং গৃহ-প্রত্যাবর্তন ও ক্লান্তি। অবনীশ তখনও চশমা নেয়নি। সিগারেট প্রায় খায় না, নিবিড় আগ্রহে ‘সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশ’ পড়ে। অথবা ফ্যারাডের সূত্র কিংবা এলসিআর সার্কিটের ডিজাইন ও সমীকরণ মুখস্থ করে।

একদিন সকালে অবনীশ বেড়াতে গিয়েছিল এক বন্ধুর সঙ্গে। ভেসপা-স্কুটার দুরন্ত ছোটে, প্রায় আশি মাইল পথ কখন শেষ হয়ে গেল টের পেল না। বিকেলে সমুুদ্র হাতছানি দিয়ে ডাকল। সন্ধ্যায় ছাত্রীর বাসায় পড়াতে গিয়ে দেখল—ফর্সা মেয়েটি কালো শাড়ি, কালো ব্লাউজ এবং কপালে একটি কালো টিপ পরে যেন বারবার একই ভঙ্গিতে পড়ে যাচ্ছে—

‘পথিক! তুমি কি পথ হারাইয়াছ ?’

এসব গল্প আমার অবনীশের কাছে শোনা।

গল্প! না, ঠিক গল্প নয়। অবনীশ আমাকে এমনিতে কিছু কিছু ভাবনা ও ঘটনা নিবেদন করত। কাউকে না কাউকে তো বলতেই হয়।

আমি সেগুলো একত্রে গেঁথে একটি গল্প তৈরি করতে চাইতাম।

তাছাড়া গল্প বলব কাকে!

বাইশ বছরের অবনীশ সেদিন একটি যুবক-হৃদয়কে খুশি করার জন্য, একজন তরুণীকে তার সজ্জার শুভেচ্ছা জানাবার জন্য বার বার দুটো চোখকে ব্যবহার করেছিল। তরুণী শব্দোচ্চারণ করতে গিয়ে চোখের ওপর চোখ স্থির রেখে জন্মলব্ধ রমণীর নিজস্ব মহিমা ও মোহের নিপুণ প্রয়োগে একটি সন্ধ্যা, সন্ধ্যার অন্ধকার ও আলোটি পরম কৃতার্থ করেছিল। অবশেষে শব্দ, শব্দের নরম পুতুলটি যাদুকরীর মতো হাতের মুঠোয় রেখে অস্ফুটে বলেছিল—‘কি দেখছেন ?’

‘তোমাকে।’

এ সমস্ত কথা অবনীশের কাছে শোনা আমার। সেই বাইশ বছরের তারুণ্যমিশ্রিত যুবক-হৃদয়ের অবনীশ।

বলতে বলতে অবনীশ হেসেছিল।

সেদিন আমি ওকে স্পর্শ করেছিলাম। সেই প্রথম কোনও মেয়েকে ভালো লাগার জন্য স্পর্শ করা। সারা দেহে, সমস্ত অনুভবে কেমন এক সর্বগ্রাসী চেতনা। আমার মনে হয়েছিল, যেন এক নিবিড় সুখের সমুদ্রে তলিয়ে যাচ্ছি। রাতে ঘুমোতে গিয়ে ঘুম আসেনি অনেক রাত অবধি। এক সময় মশারির নিচে শুয়ে শুয়ে ভীষণ হাসি পেয়েছিল আমার।

অবনীশকে হাসতে দেখে আমার বেশ মজা লাগল হঠাৎ। আমি অবনীশকে জানি। ওকে নিয়ে আমি বেশ কয়েকটা গল্প লিখেছি। মনীষা ও অবনীশের গল্প।

না, সেদিনের—সেই সন্ধ্যার তরুণী মনীষা নয়। মনীষার কথা বলতে গিয়েই অবনীশ একদিন অই ঘটনার কথা বলেছিল। উনসত্তরের নভেম্বরে বুলগেরিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে অবনীশের সঙ্গে দেখা। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে উত্তরের শীতার্ত হাওয়া দেহের মধ্যে কাঁপন ধরায় না। চট্টগ্রাম শহরের একমাত্র শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিলাসবহুল সিনেমা হলের সামনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে অবনীশ সিগারেট টানছিল।

অবনীশ আমাকে দেখতে পাওয়ার আগেই আমি ওকে দেখতে পেয়েছিলাম। ডাক দিতেই অবনীশ ফিরে তাকিয়ে উল্লসিত হয়ে উঠল। অবনীশকে নিয়ে গল্প লেখা শেষ হয়েছে এক বছর আগে।

অবনীশ ভাবছিল এক কাপ কফি খেলে কেমন হয়।

তারপর কাচের ভারী দরজা ঠেলে দিতেই সরে গেল। নিচের চত্বরে টেবিলে ছাড়া ছাড়া লোকজন। দোতলায় সিঁড়ি দিয়ে আমি ও অবনীশ অর্থাৎ অবনীশ ও আমি উপরে উঠে গেলাম।

এক কোনায় দুজন লোক বসে। পদশব্দে একবার দুজন একই সঙ্গে চোখ তুলে তাকিয়ে পরক্ষণেই নিজেদের সংলাপে নিমগ্ন হয়েছিল। আমরা পাশের দিকের একটা টেবিলে দুজন দুজনের মুখোমুখি—যেন আমি ও অবনীশ, আমরা দুজন পরস্পর পরস্পরের মধ্যে ধীরে ধীরে এক হয়ে যাচ্ছি।

স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম সবকিছু।

আমাদের দুজনের মাঝখানে টেবিল। টেবিলের ওপর স্বচ্ছ কাচ। কালো সোফা। মাইক্রোফোনের সাউন্ড বক্স সিঁড়ির গোড়ায় সমানে মোহন শব্দ ছুড়ে দিচ্ছে—জনৈকা কিন্নরকণ্ঠীর গান—সেই প্রেম, ভালোবাসা, ভালোবাসার আর্তি, বিরহের বেদনা, আর্ত হৃদয়ের যন্ত্রণা ইত্যাদি।

অবনীশ রহস্যময় হাসতে হাাসতে বলল—কনগ্রাচ্যুলেশনস।

আমি অবাক।

অবনীশ, সিগারেট-খোর অবনীশ হাসতে হাসতে বলল—‘তোমার দূরদৃষ্টির জন্য ধন্যবাদ।’ আমি অবাক হয়ে তাকালাম।

আমাকে নিয়ে লেখা তোমার গল্পের কথাই বলছি।

গল্পের সঙ্গে জীবনের কি কোনও সম্পর্ক থাকে ?

অথচ কি আশ্চর্য, তোমার গল্পের পরিণতি কি সাংঘাতিক ভাবে মিলে যাচ্ছে।

মনীষা হারিয়ে গেছে ?

না, যাচ্ছে। আজ। সম্ভবত এই মুহূর্তেই।

বলতে বলতে কথার ফাঁকে অবনীশ আর একটা নতুন সিগারেট ধরিয়ে নিল। ওয়েটার কফির পেয়ালা রেখে গেলে কালো কফির কাপে দ্রুত মুখ নামাল যেন কত কালের তৃষ্ণার্ত।

সত্যি!

মিথ্যে বলেছি কখনও ?

বলতে বলতে আর একবার হাসল সে। সেই হাসি। ছুরির চকচকে ফলার মতো তীক্ষè, অথচ মধুর, মনোরম।

আমাকে এখানে দেখে তুমি অবাক হচ্ছ ? কফির কাপের বদলে হুইস্কির গ্লাস হলেই ভালো মানাত, তাই না ? তোমরা তো অই সমস্তই লিখে থাকো।

আমি ওকে দেখলাম। পরিষ্কার সাদা শার্ট, হাফ-হাতা সোয়েটার, ক্লিনশেভড মুখ। বেশ স্মার্ট লাগছিল ওকে। সচরাচর স্যান্ডেলের বদলে পায়ে চকচকে জুতো। দামি বিদেশি সিগারেটের প্যাকেটটা সামনে টেবিলের ওপর পড়ে আছে অবহেলায়।

ব্যাপারটা তুমি বেশ সহজে নিয়েছ অবনীশ!

‘ও, আমাকে বিয়েতে নিমন্ত্রণ করেনি। করলে তাও যেতাম। আসলে আমার বেশ মজাই লাগছে। পুরো ঘটনা আমি কদিন বারবার ভেবেছি। যতবার ভেবেছি বেশ মজা পেয়েছি। অবশ্য কষ্ট হয়নি, এমন নয়। তবু সবকিছু আমার কাছে অদ্ভুত, অভিনব মনে হয়েছে। ভেবে দ্যাখো—দীর্ঘ চার বছর আমরা বেশ প্রেম প্রেম খেললাম। আর তুমি তো জানোই, ওর দেহটাও আমার খুব একটা অপরিচিত নয়। খানিকটা অভ্যেসও হয়ে গিয়েছিল। আচ্ছা! তোমার কি মনে হয়—এক একটা মেয়ের শরীরে এক এক রকম গন্ধ থাকে। ওর দেহের গন্ধটা বেশ নেশার মতো। আমার মনে হতো—দেহটা পুরোপুরি অধিকার করলে যেন আমি কোথাও ডুবে যাচ্ছি। আচ্ছা, ওর স্বামীর, আই মিন, ওর হাজবেন্ডেরও কি এই রকম কিছু মনে হবে ?’ অবনীশের কথা শুনতে শুনতে আমার মনে হলো, অবনীশ একটা গাঢ় গভীর সাদা কাচ। হাত দিতেই আমি ওর ভেতরে পৌঁছে যাচ্ছি।

ঠিক যেমন ভারী জমাট কুয়াশার মধ্যে আমরা ঢুকে যাই, আবছা ধূসরতার মতো।

আমি চিৎকার করে বলতে চাইলাম—অবনীশ, আমি তোমার হৃদয় খুঁজছি—তোমার হৃদয় কোথায়, আমার হাতে তুলে দাও, আমি স্পর্শ করে দেখি। তোমার কি হৃদয় নেই অবনীশ ?

অথচ শব্দ নেই। শুধু সেই রেকর্ডের গান, আর্ত নায়িকা, বিরহবিধুরা নায়িকা তার কিন্নরীর মতো কণ্ঠে একটি গানের কলি বারবার বারবার ঘুরে ঘুরে ঘুরে ঘুরে ঘুরে গেয়ে যেতে লাগল। অবনীশ বিছানার মধ্যে নড়ে উঠল। ওর ভাঙা চৌকি বেদনাহতের মতো শব্দ ছুড়ল। বাইরে অন্ধকার দুহাতে তার কালো ব্লাউজের বোতাম খুলতে শুরু করেছে।

আমি বললাম—অবনীশ! মনীষাকে তোমার মনে পড়ে ?

পড়ে।

তুমি কষ্ট পাও ?

পাই।

ভুলে থাকতে পারো ?

পারি না।

ভুলে থাকতে পারো ?

পারি।

কোনটা সত্য ?

একটিও না।

আজ ভোরে হঠাৎ ঘুম ভাঙল কেন ?

জানি না।

তুমি স্বপ্ন দেখেছিলে ?

মনে পড়ছে না।

তুমি কিছু ভেবেছিলে ?

মনে নেই।

তুমি কি কিছু চেয়েছিলে ?

বুঝতে পারছিনে।

জীবন কি ?

হয়তো স্বপ্ন।

ভালোবাসায় বিশ্বাস করো ?

অবিশ্বাস করি না।

ভালোবাসায় অবিশ্বাস করো ?

বিশ্বাস করি না।

মৃত্যু কী ?

সত্য।

মরতে চাও ?

ভয় পাই।

বাঁচতে চাও ?

মরতে ভয় পাই।

বাঁচতে চাও ?

বড় কষ্ট!

অবনীশ, আমি তোমাকে বুঝতে পারছি না।

আমিও নিজেকে বুঝতে পারি না।

তারপর অবনীশ দেখল, চারটি সাদা দেওয়ালের অভ্যন্তরে একটি ঘর। সে ঘরের তিনটি দরজা, তিনটি জানালা—অই ছয়টি খুলে দিলেই আলো আসবে, হাওয়া আসবে। বন্ধ করে দিলেই অন্ধকার, নষ্ট হাওয়া।

অবনীশ, সাতাশ বছরের যুবক। অবনীশের জীবনে গল্প নেই—ঘটনা আছে কিছু। সেসব ক্রমে পুরোনো হয়ে যাচ্ছে। অবনীশ পুরোনো হয়ে যাচ্ছে। কেননা—ঘটনাগুলো এমন যেসব কিছু বেশ রসালো করে বললেও ঠিক গল্প হয়ে ওঠে না। গল্প অন্য জিনিস।

হায়! আমি অবনীশকে নিয়ে গল্প লিখেছিলাম।

অবনীশের গল্প অন্য আর সব অবনীশদের সঙ্গে সমান্তরাল।

অবনীশ নিজেকে বুঝতে পারে না!

আমিও অবনীশকে বুঝতে পরি না।

আমরা দুজনে অতঃপর পরস্পর পরস্পরের সমান্তরাল রেখা হয়ে এগিয়ে চলি। সমান্তরাল রেখা। তারা উভয়ে অনন্তে গিয়ে পরস্পরের হাত ধরে।

অবনীশ, তুমি কী ভাবছ ?

ভাবছি।

কী ভাবছ ?

ভাবছি, আমরা বেঁচে থাকি কেন ?

মরি না বলেই।

আমার উত্তর শুনে অবনীশ দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

একেক সময় আমার ভীষণ ক্লান্তি লাগে। জীবন খুব দীর্ঘ বলে মনে হয়। আমার কী করার আছে ? কিছুই না। আমরা যা কিছু করি অথবা করি না—তার সবকিছুই অর্থহীন। কিংবা আমরা যেন আসলে কিছুই না। যেন কোনও এক ভাবনার মধ্যেই এই জীবন ধারণ, বেঁচে থাকা।

এ তো জীবনের কথা নয় অবনীশ। দর্শনের কথা।

দর্শন কি জীবন থেকে আলাদা ?

অবনীশ। তুমি কি বলতে চাও ?

আসলে আমি কিছুই বলতে চাইনে।

তারপর—অনেকক্ষণ নীরবতার বিশাল দৈত্যটা বসে রইল আমাদের মাঝখানে। অবনীশ নতুন একটি সিগারেট ধরিয়ে বলল : আমি যখন ছোট ছিলাম—বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম। কেমন বড় সেটা কখনও বুঝতে পারিনি—কেউ বুঝিয়ে দেয়নি। তারপর বয়স বাড়ল, ছেলেবেলার সবকিছু কেমন যেন বিবর্ণ ফ্যাকাশে হয়ে আসতে লাগল নিজের কাছে। ভালোবাসলাম। ভালোবাসা ভেঙে গেল। ভেঙে যাওয়ার দুঃখটা আঁকড়ে ধরতে চাইলাম—ধরে রইলাম… কিছু দিন আচ্ছন্নতার মধ্যেই কাটল। অবশেষে সেটা কেমন ঝাপসা হয়ে এল। মনে হলো—আসলে ভালোবাসা-টাসা একটা ঘটনামাত্র। এটা কোনও পরম কিছু নয়। আমরা যেন অন্য কিছু চাই। কী ? সেটা কিছুতেই ধরতে পারলাম না।

আমি একটা ফাঁপা ভাবনার মধ্যে ডুবে যেতে লাগলাম। বললাম : তুমি পলায়নবাদী, হতাশাগ্রস্ত। এটা বেঁচে থাকার লক্ষণ নয়।

আমরা কেউ বেঁচে থাকি না। যেটা সত্য সেটা বেঁচে থাকা নয়—একটা নেশার মধ্যে ডুবে থাকা। তাকে বাঁচা বলা যায় না।

তাহলে জীবন কী ?

একটা স্বপ্ন। নেশার ঘোরে স্বপ্ন দেখা। নেশাটা কেটে গেলেই সবকিছু ভীষণ রকম অনাবৃত—নগ্ন।

একবার একটা জবাই করা গরু দেখেছিলাম। কসাইরা তার গায়ের চামড়া খুলে নিচ্ছিল। চামড়াহীন গরুটা বীভৎস দেখাচ্ছিল।

বাইরে দিনের আলো উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল। আমি বললাম—যাই। অবনীশ মাথা নেড়ে সায় জানাল।

অবনীশ দেখল—আর একজন অবনীশ ছায়ার মতো হালকা হয়ে হঠাৎ তার শরীরের সঙ্গে, চিন্তার সঙ্গে, চেতনার সঙ্গে জড়িয়ে গেল।

তারপর অবনীশ একটা হাই তুলল। গায়ের আড়মোড়া ভাঙল। আঙুলগুলো টানটান করে জড়তা ভাঙতে চাইল।

তারপর সে শুনতে পেল—কল থেকে পানি পড়ছে, কাক ডাকছে, রেডিওতে গান, পাশের বাড়িতে বাচ্চা ছেলের কান্না।

হঠাৎ তার মনে পড়ল—এত দিনে যদি মনীষার সন্তান হয়ে থাকে—তাহলে সেও অমনি করে কাঁদে আর হাসে। হাসে আর কাঁদে। পালা কতবার বদল হয়, বদল হয়, দল হয়, ল হয়, হয় য়।

 সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button