আর্কাইভপ্রচ্ছদ রচনা

আখতার হুসেনের ছড়াসাহিত্য―শিশুমনের ঝুমঝুমি : আহমেদ সাব্বির

আখতার হুসেনের সাহিত্যকর্ম : আলোচনা

‘শিশুসাহিত্য’ শ্রুতিমধুর এবং আদরণীয় একটি নাম। স্নিগ্ধ রঙধনুর মতো এই নাম বাংলা সাহিত্যে খুব বেশি প্রাচীন না হলেও শিশুসাহিত্যের স্রোত প্রাচীনকাল থেকেই প্রবাহিত। বাংলা ভাষার জন্ম থেকে শিশু-কিশোর রচনার উপস্থিতি পাওয়া যায়। শৈশব সম্পর্কে ধারণার পরিবর্তন ঘটে অষ্টাদশ শতকের দিকে। তখন শিশুসাহিত্যের একটি বৈচিত্র্যময় ধারা প্রকাশ পেতে শুরু করে। বাংলা ভাষায় শিশুসাহিত্যের গোড়াপত্তনকাল ভাবা হয় আঠারশ সালকে। মদনমোহন তর্কালঙ্কার, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অক্ষয় কুমার দত্ত, স্বর্ণকুমারী দেবী প্রমুখের রচনার মাধ্যমে শিশুসাহিত্য পরিপূর্ণতা পায়, যা আজকের দিনে অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ একটি ধারা। তাঁদের রচনায় থাকত লোককাহিনি, রূপকথা, ধর্মীয় ও  উপদেশমূলক কবিতা। শিশুদের মধ্যে নীতিজ্ঞান ও সামাজিক মুল্যবোধ জাগ্রত করাই ছিল শিশুসাহিত্যের মূল সুর।

শিশুসাহিত্যের আধুনিক অধ্যায়টি শুরু হয় ষাটের দশকে। বাঙালির সার্বভৌম ও স্বাধীনতার অঙ্কুরোদম অধ্যায় এবং সংস্কৃতির জাগরণের কাল তখন। আমাদের সংকটাপন্ন একটি জাতির সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলন শুরু হয় গত শতকের ষাটের দশকেই। একই সঙ্গে শিশুসাহিত্য চর্চার হাওয়া বদলাতে শুরু করে। উৎসে ফেরার তৃষ্ণায় একঝাঁক তরুণ সাহিত্যের চিরচেনা স্রোতে নতুন ঢেউ জাগাতে চাইলেন। ভাষা ও ভাবনায় আঙ্গিকগত নতুনত্ব সৃজনে সফলও হতে শুরু করলেন। সেই স্রোতে যাঁদের নাম উজ্বল হয়ে আছে তাঁদেরই একজন কৃতীপুরুষ আখতার হুসেন।

ছড়া-কবিতা-গল্প-উপন্যাস প্রায় সকল শাখাতেই তিনি সক্রিয়। সাহিত্য সংস্কৃতির ধ্যানমগ্ন চর্চা ও আন্দোলনে তিনি ছিলেন অগ্রগণ্য। বিশেষ করে আজকের দিনে আমাদের শিশুসাহিত্যের যে আধুনিক রূপ তার সূচনালগ্নের সৈনিক আখতার হুসেন। প্রখ্যাত সাংবাদিক কবি সন্তোষ গুপ্তের মূল্যায়ন: ‘বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যের যে চলমান ধারা, সেই ধারার মধ্যে এক নতুন ধারা নিয়ে এসেছেন আখতার হুসেন। তিনি পুরনো সাহিত্যের পিঁড়িকে উল্টে দিয়েছেন।’

গল্প ও গদ্য রচনার মাধ্যমে আখতার হুসেন লেখালেখি শুরু করেন। ছোটদের জন্য লেখা ‘সমুদ্র অনেক বড়’ গল্পগ্রন্থ প্রকাশের পর তিনি শিশুসাহিত্যিকের মর্যাদা পেতে শুর করেন। গল্প লিখতে লিখতে তিনি একসময় ছড়া-কবিতা রচনায় মনোনিবেশ করেন। এর অন্য একটি কারণও ছিল। তিনি ছিলেন রেল কর্মচারী বাবার সন্তান। এগারো ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন বড়। স্বল্প আয়ের বড় পরিবার সামলাতে বাবা হিমশিম খেতেন। পিতার আর্থিক টানাপোড়েন সামলাতে তাকে তরুণ বয়সেই জীবন ও জীবিকার সংগ্রামে নামতে হয়েছিল। ব্যস্ততার কারণে গদ্য চর্চায় সময় দিতে পারছিলেন না তিনি। সাহিত্যচর্চাকে সচল রাখতে তিনি গল্পের পাশাপাশি ছড়া-কবিতা-গান লিখতে শুরু করেন। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তার ছড়া-কবিতাও প্রকাশ পেতে থাকে। অল্প সময়ের মধ্যেই তার শিশুতোষ ছড়া ছড়িয়ে পড়ে বাংলা সাহিত্যের উঠানে। স্বকীয়তা ও শৈলিতে আখতার হুসেন হয়ে ওঠেন আধুনিক ছড়াকবিদের একজন।

ছড়া হচ্ছে স্বতঃস্ফূর্ত একটি আর্ট। ছোট্ট পরিসরে শব্দের ঝংকার ও ছন্দের জাদুতে ছড়া হয়ে ওঠে শ্রুতিস্নিগ্ধ শিল্প। ছড়ার শক্তি অবিনাশী। খাঁটি ছড়া টিকে থাকে যুগ যুগ ধরে। একটি জনগোষ্ঠী মুখে মুখে মনের ফুর্তিতে টিকিয়ে রাখে ছড়াকে। মায়ের মুখে শোনা অসংখ্য ঘুমপাড়ানি লোকছড়া আজও সেই স্রোতে মিশে আছে।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে লাল সবুজের বাংলাদেশের জন্ম হয়। জন্ম হয় বাঙালি সংষ্কৃতি চর্চার নতুন বদ্বীপের। শিশুসাহিত্য চর্চায়ও নতুন হাওয়া বইতে শুরু করে। বিশেষ করে ছড়াসাহিত্যের আধুনিক প্রকরণ নিয়ে নানামুখী নিরীক্ষা ও নির্মাণের যে ধারা অব্যাহত ছিল তার সুফল আসতে থাকে আশির দশকে। শিশুমনে সাহিত্যের সুষমা ছড়িয়ে দিতে স্কুলের পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে একটি করে ‘চয়নিকা’ বই দেওয়া হতো। আজ যেমন ক্লাসে ‘বাংলা সহপাঠ’ পড়ানো হয়। শিশুদেরকে কৌতূহলী ও কল্পনাপ্রবণ করে গড়ে তোলাই ছিল চয়নিকা বইয়ের উদ্দেশ্য। বাংলার পল্লি গাঁয়ে তখনও বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি। টর্চ, হ্যাজাক আর কেরোসিন কুপির সেই যুগে আজকের মতো ডিজিটাল ডিভাইস ছিল না। ছিল না ভার্চুয়াল সংযোগ। সেই যুগে পল্লিগ্রামে, ধূসর মফস্স্লে শিশুদের চয়নিকা বই ছিল একমাত্র সুখপাঠ্য গ্রন্থ। শিশুদের সেই চয়নিকা বইতে থাকত সাদাকালো ছবির সঙ্গে অপূর্ব সব ছড়া, গল্প, রূপকথা। শ্রেণিকক্ষে বাংলা স্যার চয়নিকা পাঠ করে শোনাতেন। শিশুর সরলতা আর মমতার মিশেল থাকত তাঁদের পাঠে। দলবদ্ধ শিশুরা চয়নিকা বই পাঠ করে দারুণ মজা পেত। ছড়ার ছন্দে রঙিন হয়ে উঠত তাদের মন। চয়নিকার বইয়ের একটি ছড়া শিশুদের অত্যন্ত প্রিয় ছিল। ছড়াটির নাম: ‘হ্যা রে খবরটা কি উড়ো ?’ লেখক আখতার হুসেন।

হ্যা রে খবরটা কি উড়ো ?

শুনতে পেলাম নিখিলপুরে চার চারটে বুড়ো

কাঁদেন কেবল লাগিয়ে চোখে শুকনো মরিচ গুঁড়ো।

আরে, কী বললি দুরো

খাবার সময় খায় কি জানিস ? বিশটা রুইয়ের মুড়ো।

বয়স ওদের জানিস কত ? আটশ নাকি পুরো।

হ্যারে খবরটা কি উড়ো ?

আখতার হুসেন এই ছড়া দিয়ে সকল বয়সি শিশুদের মন জয় করে নেন। চয়নিকা বইয়ের মুদ্রিত অক্ষর থেকে বেরিয়ে মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে যাওয়া ছড়াটি আজও টিকে আছে সদর্পে। কেন টিকে আছে ছড়াটি ? কেন শিশুরা আজও পাঠ করে সুখ পায় ? তার রহস্য ভেদ করতে ঢুকতে হয় ছড়াটির অন্তরে। একটি ছড়া তখনই চিরকালীন হয়ে ওঠে যখন সে সমকালকে অতিক্রম করতে পারে। ভাষা ও ছন্দের জড়তা কাটিয়ে সরস ও সাবলীল শিল্পগুণে ছড়াটি হয়ে উঠেছে মৌখিক ঐতিহ্য। আরেকটি বিষয় হলো লেখকের প্রকাশ ভঙ্গি। ছড়াটিতে আখতার হুসেন কয়েকটি ইঙ্গিত ছুঁড়ে দিয়েছেন। যেমন―উড়ো খবরের কৌতূহল, উদ্ভট গল্প ও ভণিতার আশ্রয়। সেই গল্পের চরিত্র চারটি পেটুক বুড়ো। বুড়োদের বয়স অস্বাভাবিক এবং ক্ষুধা সর্বগ্রাসী। তাদের অনুভূতি আত্মকেন্দ্রিক বলে কান্নার ভান করার জন্য মচিরগুঁড়ো চোখে লাগিয়ে তারা কান্না করে। আটশ বছর ধরে তারা ক্ষমতার জোরে বেঁচে থাকতে চায়। আখতার হুসেন তার উদ্ভট শিশুতোষ একটি ছড়ার মধ্য দিয়ে ক্ষমতার শোষণ এবং শোষিতের বঞ্চনার গল্প বলেছেন। শিশুরা এই গল্প পড়ে নির্মল আনন্দ পেলেও বড়দের চেতনায় চাবুক-আঘাত করেছেন।

শিশুরা কৌতূহলপ্রবণ। উদ্ভট গল্প, অবাস্তব ঘটনা তাদের মনে উদ্দীপনা সঞ্চার করে এবং আনন্দ জোগায়। শিশুদের আমরা যতটা সহজ সরল ও স্বাভাবিক ভাবি আসলে ততটা সহজ নয়। সুশৃঙ্খল তো নয়ই বরং কোমলতার আবরণে প্রতিটি শিশুমন অবুজ, কঠোর, উদাসীন আর অবাস্তব। শিশুরা কি চায় তা তারা নিজেরাই জানে না। সোজাসাপটা কোনও কিছুই ওরা সাদরে গ্রহণ করে না। ওরা শক্তিতে, বুদ্ধিতে বড়দের কাছে পেরে ওঠে না বলেই সংসারে বাধ্য হয়ে বড় হয়। শিশুদের সোজাসাপটা কথা বলে ভাব জমানো যায় না। ওরা রহস্য আর রোমাঞ্চপ্রবণ বলেই উলটোপালটা ও উদ্ভট বিষয়গুলোই ওদের কাছে প্রিয়। একজন শিশুসাহিত্যিককে শিশুদের সরলতা, কৌতূহল ও খামখেয়ালির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে লিখতে হয়ে। আখতার হুসেন শিশুদের মনোজগত খুব ভালো বুঝতে পারতেন বলেই তার ছড়া হয়ে উঠেছে শিশুদের নিজস্ব সম্পত্তি।

পথখানা/ আগে আমি/ ভালো করে/ মাপলং

দেখলাম/ বেশ দূরে/ ভয়ে তাই/ কাঁপলং

শেষে ভয়/ করে জয়/ বাসে আমি/ চাপলং

আসলাম/ সোজা চলে/ ঢাকা থেকে/ জাফলং (একঘড়া ছড়া, প্রথমা প্রকাশনী)

 আখতার হুসেনের ছড়ার ছন্দ শিশুর মতোই চঞ্চল। শব্দগুলো তিড়িংবিড়িং লফিয়ে চলে আবার টগবগ করে ছুটতে থাকে। ছুটতে ছুটতে গল্প হয়ে ছড়ায় রূপ নেয়। শিশুরা গল্প শুনতে ভালোবাসে। রঙিন রূপকথার রাজ্যে ভেসে বেড়াতে চায়। সেই গল্পে রহস্য থাকতে হয়। রোমাঞ্চ থাকতে হয়। গল্পের নায়কের স্থানে তারা নিজেদের বসাতে চায়। আখতার হুসেনের প্রতিটি ছড়ায় একটি গল্প থাকে। সেই গল্পের থাকে এক বা একাধিক চরিত্র। চরিত্রগুলো আবার পাগলাটে ধরনের। এজন্য শিশুরা তার ছড়া পড়ে আনন্দে দুলে ওঠে। তার ছড়ার শক্তি নিখুঁত ছন্দ ও সরল ভাষা :

ঝোল খাও/ ঘোল খাও/ ডাল খাও/ ঝাল খাও/ খাও খাও হাপ্পুস হুপ্পুস।

লাফ খাও/ ঝাঁপ খাও/ জলে দাও/ টলে দাও/ দাও দাও ঝাঁপ্পুস ঝুপ্পুস।

(একঘড়া ছড়া, প্রথমা প্রকাশনী)

আখতার হুসেনের ছড়াগ্রন্থ পাঠ করে অন্ত্যমিলের একটি ভিন্ন কৌশল খুঁজে পাওয়া যায়। সেটি হলো একটি শব্দের সঙ্গে আ-কার, ই-কার অথবা অনুস্বর যোগ করে শব্দকে নতুনভাবে উপস্থাপন করা। যেমন―মাপলং-কাপলং, ইট্টিং-ফিট্টিং, লাফায়িং-ঝাঁপায়িং, খাচ্ছিং-যাচ্ছিং ইত্যাদি। এটা তার নিজস্ব স্টাইল ভাবা যেতে পারে। কারণ বেশির ভাগ ছড়াতে তিনি শব্দের বাঁকবদল ঘটিয়ে অন্ত্যমিলের বাদ্য তৈরি করেছেন। তাতে ছড়ার চিরায়ত ভঙ্গি ও গতি একটুও বাধাগ্রস্ত হয়নি।

বাঘ হচ্ছে হিংস্র জন্তু। জনমনে ভীতি সঞ্চারে বাঘের হুংকার ভয়ংকর। বাঘের আতঙ্ক একটি মিথ হয়ে মিশে আছে আমাদের সমাজে। প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনে, অস্তিত্ব রাক্ষা ও ক্ষমতার দাপট বোঝাতে আমরা বাঘের গর্জনের আশ্রয় নিই। আখতার হুসেন বাঘের সেই চিরায়ত চরিত্রকে ভেঙে শিশুদের মনের মতো করে শান্ত সুবোধ, তুলতুলে আরামপ্রিয় বাঘের ছবি এঁকেছেন। যেন সব বাঘই এমন:

বাঘটা না খুব ভালো/ বয়সটা অল্পই

পথেঘাটে দেখা হলে/ জুড়ে দেয় গল্পই।

বলে―আর মাংসটা/ করি না তো ইট্টিং

শরীরটা আছে তবু/ খুব ভালো ফিট্টিং।

রাগটাগ নেই আর/ ডাকি নাকো হাল্লুম

এইতো দুপুরবেলা/ ডাল-ভাত খাল্লুম।

বনে আর যাই নাকো/ থাকি আমি গোয়ালেই

নাক ডেকে ঘুম দিই/ গান গেয়ে শোয়ালেই।

(একঘড়া ছড়া, প্রথমা প্রকাশনী)

ছড়া অর্থবোধক বা ইঙ্গিতপূর্ণ হতে হবে এমন নয়। আগডুম বাগডুম, আটুল বাটুল সামলা সাঁটুল, হাট্টিমাটিম টিম, ইচিং বিচিং ইত্যাদি অসংখ্য ছড়া লোকছড়ার উদাহরণ হিসেবে টিকে আছে শত বছর ধরে। এসব ছড়ার গভীরে ইঙ্গিত ও রহস্য আন্দাজ করা যায়। ছড়াগুলো এমন চটুল তালের যে কবিতা থেকে সহজেই আলাদা হয়ে ওঠে এবং বক্তব্যের নিরাভরণ আঙ্গিক স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ভাব ও ভাষায় ছড়া সুরাশ্রয়ী বলেই ভাবনা যেটাই হোক, ভাষার সরলতা ও ছন্দের ঝংকারে অনন্য হয়ে পাঠকের মনে ধরা দেয়। আখতার হুসেনের ছড়ায় ছড়ার মূল সূর ও সঙ্গতি খুব ভালোভাবে ফুটে ওঠে। যুক্তি কিংবা ভাবনার পারম্পর্য সবসময় লক্ষ্য করা না গেলেও খামখেয়ালি আর উদ্ভট গল্প তার ছড়াকে আলাদা বৈশিষ্ট্য দান করে। তিনি অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে ছড়াগুলো কেবল ছড়ার কাঠামোতেই নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছেন। শিশুতোষ ছড়ার রঙিন মোড়টি তিনি জীবনবোধ ও  চারপাশের ঘটনাগুলো লিখে দিয়েছেন শৈল্পিকভাবে।

সার্থক ছড়া রচনার ক্ষেত্রে ভাষার সরলতা বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শব্দের দুর্বোধ্যতা ও বাক্যের  জটিলতা এক ধরনের দুর্বলতা যা ভাষাকে আড়ষ্ট করে রাখে। সাবলীল ভাষা পাঠযোগ্য হয়ে ওঠে অনায়াসেই। আখতার হুসেনের ছড়ার ভাষা সহজ ও মিষ্টি। এক ধরনের মায়া ও দরদি ভাষায় তিনি ছড়া লেখেন যা সকল শ্রেণির পাঠকের কছে শ্রুতিমধুর এবং সুখপাঠ্য হয়ে ওঠে। খুব বেশি হইচই কিংবা বাজখাঁই চিৎকার নেই তার ছড়ায়। আবেগের পীড়ন বা শব্দের চাবুক কোনওটাই তার ছড়ায় লেখার হাতিয়ার হয়ে ওঠেনি। উচ্চমাত্রার মজা বা অতিমাত্রার আমোদ-মশকারও লক্ষ্য করা যায় না। যা আছে তা হলো প্রীতিমাখা ভালোবাসা আর নির্মল আনন্দ। শিশুদের জন্য লিখতে গিয়ে তিনি বড়দের কলম ধরেননি। ধরেছেন শিশুদের রঙ পেন্সল ও চকখড়ি। বড়দের শোরগোল, মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা, রাজনীতি, সামাজিক বৈষম্য,  শ্রেণি সংগ্রাম সরাসরি শিশুসাহিত্যে প্রতিস্থাপন না করে ছেলেমানুষী বেশ ধারণ করে লিখে গেছেন। এই প্রাঞ্জলতাগুণেই তিনি সার্থক ছড়ালেখক। প্রায় যুক্তাক্ষর বর্জিত ছোট ছোট বাক্যে তিনি গভীর ভাবকে ছড়ায় ফুটিয়ে তোলেন। তার ছড়া তখন আর গ্রন্থে আটকে থাকে না। মুদ্রিত অবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে ঠাঁই পায় পাঠকের হৃদয়ে।

একজন লেখক নানাভাবে অন্য লেখকের চিন্তা ও লেখা দ্বারা প্রভাবিত হন। প্রভাবিত হয়েই তিনি নিজেকে ভাঙেন এবং গড়েন। এই যুগে শিল্প সাহিত্যের কোনও সৃষ্টিই মৌলিক নয় বলা যায়। অনেক আগেই সৃষ্টি হওয়া বিষয় বা ঘটনার রূপান্তর ঘটানোই আধুনিক সাহিত্যিকের কাজ। ফলে নিরন্তর নিরীক্ষার মধ্যমে লেখক খুঁজতে থাকেন নতুন পথ, পথের ছবি। আখতার হুসেনের লেখায়ও অনেক গুণী লেখকের প্রভাব খুঁজে পাওয়া যায়। ছড়া নির্মাণের ক্ষেত্রে তিনি কখনও সুকুমার রায়, কখনও সুনির্মল বসু আবার কখনও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ফর্ম ধারণ করেছেন। যেমন তার ‘সাঁই বাবা’ ছড়াটিতে রবীন্দ্রনাথের ‘দামোদর শেঠ’ ছড়ার কিছুটা মিল খুঁজে পাওয়া যায় :

কোথা থেকে এল এক শানদার সাঁই বাবা

এসেই সে বলে বসে, খানাদানা চাই বাবা।

ক্ষুধায় যাচ্ছি মরে

নাড়ি ভুঁড়ি নড়েচড়ে

পোলাও, মাংস এনো, বেশি নেই খাঁই বাবা।

(সোনায় মোড়া ছড়া, অনিন্দ্য প্রকাশ)

বড়দের জগতে বেড়ে উঠলেও শিশুরা সেই জগতের সবকিছু বুঝে চলতে পারে না। শিশুদের কোমল মনে আধো স্বপ্ন আধো জাগরণ খেলা করে। নিজস্ব জগতে কল্পনার ভেলায় ভেসে ওরা আনন্দ পায়। রঙিন শৈশবে ওরা রাজত্ব করে সুখ পায়। ওদের কল্পনা আর বড়দের বাস্তবতার ব্যবধান আকাশ পাতাল বলেই শিশুরা তাল মেলাতে হিমসিম খায়। কিছুটা বাধ্য হয়ে খাপ খাইয়ে চলার চেষ্টা করে। শিশুদের নিজেদের জগত খামখেয়ালির খেলা আর হাসি―আমোদের ছবি দিয়ে ঠাঁসা। উদ্ভট উলটোপালটা গল্পই ওদের প্রিয়। আর আধুনিক যুগের শিশুরা আরও বেশি সচতুর। ওরা সহজে সবকিছু বিশ্বাস করে না বরং যাচাই করে দেখে। ওদের সহজে ভোলানো যায় না। বশ করাটাও অত্যন্ত কঠিন আজকের দিনে। সে কারণে একজন শিশুসাহিত্যিককে শিশুদের মনস্তত্ব নিয়ে আকাশ-পাতাল ভাবতে হয়। দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে ওদের রূপকথার রঙ পাল্টায়। খেলনার উপকরণ, ছবির বিষয়, হাসি আমোদের গল্পও পাল্টায়। শিশুসাহিত্যিককে এজন্য অবশ্যই আপডেটেড বা আধুনিক চিন্তা করে লিখতে হয়। আখতার হুসেনের ছড়ায়ও আধুনিক বিষয় লক্ষ্য করা যায়। শিশুদের সমকালীন ভাবনা তার ছড়ায় সাজানো থাকে। বড়দের জটিল জীবনের বিষয়গুলো তিনি অত্যন্ত কৌশলে শৈল্পিকভাবে শিশুদের সামনে তুলে ধরেন।

বড়দের উদ্ভট আচরণে শিশুরা খুশি হয়। বড় যদি চলতে গিয়ে ধপাস করে আছাড় খেয়ে পড়ে কিংবা পিঁপড়ের কামড় খেয়ে তিড়িং করে লাফিয়ে ওঠে, শিশুরা তখন খিকখিক করে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে। আখতার হুসেন তার ছড়ায় বড়দের খাই খাই স্বভাব, লোভ লালসা, স্বার্থপরতা ও মন্দ দিকগুলো প্রসন্ন রসিকতায় শিশুদের উপযোগী করে উপস্থাপন করেছেন। তখন তার ছড়া আর শিশুতোষ থাকে না। শিশুদের সীমানা পেরিয়ে বড়দেরও রস গ্রহণের বিষয় হয়ে ওঠে :

নিজাম আলী দারোগা

হ্যাংলা কাঠি, যা রোগা

ঘুরতে এলেন বারো গাঁ

কিন্তু কি এক ব্যাপার হতেই

বলল সবাই, ছাড়ো গাঁ।

(দারোগা, উল্টোপাল্টা)

ছড়ায় রস সৃষ্টির অন্যতম উপাদান অর্থহীন কথা বা ননসেন্স। ননসেন্স রসের স্রষ্টা লুই ক্যারল, এডওয়ার্ড লিয়র এবং অনন্য সুকুমার রায়কেই ভাবা হয়। বাংলা সাহিত্যে ননসেন্সের জাদুকর সুকুমার রায়ের ছড়া অর্থহীন খামখেয়ালিতে পরিপূর্ণ। আখতার হুসেনের কিছু কিছু ছড়ায় ননসেন্সের নির্যাস পাওয়া যায়। তিনি ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান কাউকে সরাসরি আক্রমণ না করে উদ্ভট আচরণের মাধ্যমে ছড়ায় ফুটিয়ে তুলেছেন যা কষ্টকল্পিত নয় বরং আমাদের চেনাজানা চরিত্রগুলোর সঙ্গে মানানসই :

কেউ জানে না নাম কি যে তার

বলেন কথা কম কম

ভাতের সঙ্গে খান মাখিয়ে

পোড়াবাড়ির চমচম।

যায়নি জানা কোথায় বাড়ি

নেই কেন তার মোটর গাড়ি

হঠাৎ করে দাওয়াত পেলে

করেন ভাড়া টমটম

ব্যাপার দ্যাখো, তখন নাকি

বৃষ্টি পড়ে ঝমঝম।

(কোথাকার কি, উল্টাপাল্টা)

অযথা বল প্রয়োগ, চিৎকার চ্যাঁচামেচি শিল্প-সাহিত্যের অংশ হতে পারে না। যারা একটু-আধটু চেষ্টা করেছেন তারা অকালেই ঝরে গেছেন। ছিটকে পড়েছেন ধ্যানমগ্ন সাধনা থেকে। ছড়ার ক্ষেত্রেও একই উদাহরণ প্রযোজ্য। ছড়া লিখতে হলে স্নিগ্ধ ছন্দ আয়ত্ত করতে হয়। গভীর ভাব সরল দোলনায় বসাতে হয়। তা না হলে ছড়া হোঁচট খায়। পাঠক স্রোতাও চিৎকারকারীকে হটিয়ে দেয়। আখতার হুসেন ছড়াগুলো শিল্পরসে ভিজিয়ে পাঠকের কাছে হাজির করেছেন।

গাইয়ে এল, গাইয়ে এল

নামকরা এক গাইয়ে

গানটা গেয়ে সেই গাইয়ে

দিচ্ছে রে ভয় পাইয়ে।

গান শুনে তার সুরের জ্বালায়

সবাই দে ছুট, দৌড়ে পালায়

গাইয়ে তবু গান শোনাতে

হেসেই বলে―‘আইয়ে’

কিন্তু সবাই বলছে রেগে

‘আর নয় ভাই যাইয়ে’।

(হাল্লুম হুল্লুম, পরিবার পাব্লিকেশন)

একজন শিশুসাহিত্যিককে শিশুদের জীবন ধারণ করে লিখতে হয়। বড়দের স্বভাবসুলভ স্বাভাবিক দৃষ্টিভঙ্গি ছেঁটে ছোটদের শিশুসুলভ মন দিয়ে তারা দেখেন সমাজ, জীবন ও পৃথিবীকে। এজন্য একজন লেখককে সজাগ দৃষ্টিভঙ্গি ও নিরলস অনুশীলন চালিয়ে যেতে হয়। আখতার হুসেনও তেমন একজন লেখক যিনি আচরণে শিশুত্বকে ধারণ করেন। প্রখ্যাত কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হক আরেক খ্যতিমান শিশুসাহিত্যিক এখলাস উদ্দিন আহমদের শিশুসাহিত্য নিয়ে আলোচনায় লিখেছিলেন―‘বাল্য- কৈশোরের আলো-আঁধারির জগৎ নিয়ে যে লেখক সারা জীবন কাটিয়ে দিতে পারে, আমি তাকে ঈর্ষা করি।’

একজন প্রকৃত শিশুসাহিত্যিক সেই যিনি বড়দের সমস্যা-সংঘাত-সংগ্রাম সহ্য করে চিরকাল বসবাস করেন শিশুস্বর্গে। শিশুদের রাজ্যপাটে শিশুরা যেমন অস্থায়ী বাসিন্দা তেমনি শিশুসাহিত্যিকও চিরদিন শিশুজগতের মেহমান হয়ে লিখে যান। আখতার হুসেন তার সুদীর্ঘ জীবনে ছোটদের জন্যই লিখে চলেছেন। তিনি বড়দের জন্য অল্পসল্প ফরমায়েসি লেখা লিখলেও তার মনোযোগ কেবল শিশুসাহিত্য সৃষ্টিতে। গল্প, উপন্যাস, কিশোর কবিতা, নাটক সবকিছুতেই তার সফল বিচরণ। সবকিছু ছাপিয়ে তার  শিশুতোষ ছড়া স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে পাঠক হৃদয়ে চিরস্থায়ী আসন পেয়েছে। ষাটের দশক থেকে শুরু করে তিনি আজও তরুণ লেখকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিশুদ্ধ ছড়া লিখে চলেছেন। আশি ছুঁই ছুঁই বয়সেও তাঁর আছে দুর্দান্ত এক শিশুমানস। তার দুরন্তসব ছড়াগ্রন্থে শিশু-কিশোরদেরই জয়গান। সেই জয়গান শৈশব জয়ের, বড়দের ছেড়ে আসা বর্ণিল দস্যিপনার।

 লেখক : প্রাবন্ধিক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button