আর্কাইভগল্প

অনধিকার : সুব্রত বড়ুয়া

আবার পড়ি : সুব্রত বড়ুয়ার গল্প

তখন অপরাহ্ণ। দুপুরের তীক্ষè তীব্র রোদ ক্রমে ম্লান পাণ্ডুর হয়ে আসছে। ক্ষয়ে যাচ্ছে সময়। চৈত্রের বেহিসেবি বেপরোয়া হাওয়া ছুঁয়ে যাচ্ছিল বৃক্ষ ও বৃক্ষরাজি। একেক সময় হাওয়া কেমন বেপরোয়া হয়ে ওঠে, যেন দুর্বিনীত বালক সব শাসনের বাইরে চলে গিয়ে হো হো করে হাসে, হাসতে হাসতে বেসামাল হয়ে যায়। ঋতুর হিসেবে এই চৈত্র বসন্তের সখা বটে কিন্তু দিন রাত চব্বিশ ঘণ্টায় তারও বারো রকমের বায়নাক্কা। শেষ রাতে হাড়-কাঁপানো শীতের তাড়নায় কুকড়ে ওঠে মানুষ, দুপুরে গায়ে ঘাম-ঝরানো গরম। এরই নাম বসন্ত। তবু এই পড়ন্ত বিকেলের হাওয়া ভারি মনোরম। এক স্নিগ্ধ আবেশের পরশ বুলিয়ে দিয়ে যায় সারা দেহে। দেহ ? হ্যাঁ, দেহই তো। দেহ ছাড়া আর কিই-বা অবশিষ্ট আছে এই শরীরে। শরীর! অনাদিনাথ আসলে নিজের এই ভগ্নস্বাস্থ্য কৃশকায় শরীরের কথাই বলেন।

অনাদিনাথ নিজের কথা ভাবতে গিয়ে নিজের মনেই হেসে ওঠেন। দুপুরের তীক্ষ্ণ তীব্র রোদ ক্রমশ স্তিমিত হয়ে আসতে থাকলে অনাদিনাথ পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে এই পুকুর-পাড়ে বসেন। পশ্চিম আর উত্তরে খোলা মাঠ। সেই মাঠের ওপর দিয়ে মা ধরণির শরীরের সঙ্গে লুটোপুটি খেলতে খেলতে রোদেরা ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে আসে। অনাদিনাথ পুকুর-পাড়ে বসে রোদের এই খেলা দেখেন। দক্ষিণে গা-লাগানো নতুন বসতবাড়ির ভিটে হয়েছে বটে তবু পূর্ব-দক্ষিণ কোণ বরাবর দৃষ্টি ছড়াতে বাধা নেই। সেদিকে তাকালেই চোখে পড়ে তেমাথার পুরনো বটগাছ—বিশাল এই বৃক্ষের প্রকাণ্ড শাখাগুলো দুলতে দুলতে গিয়ে বুঝিবা ছুঁয়ে যায় নিচের মাঠের মাটি। ছেলেপুলেরা ওখানে গিয়ে ভিড় জমায়, কচি-কণ্ঠের কোলাহলে মাঝে মাঝে অনাদিনাথের ভাবনার সুতো ছিঁড়ে যায়। তিনি তখন সেই ঝাঁকড়া-চুলো বটগাছ, মাঠ, মাঠের শাসন পেরিয়ে শ্মশানের জোড়া অশ্বত্থ গাছের দিকে তাকাতে তাকাতে অন্য কথা ভাবেন।

জন্ম থেকেই অনাদিনাথ অবিকল শ্মশানটি দেখে আসছেন। মনে হয়, অই শ্মশানের কোনও পরিবর্তন নেই। মায়ের কথা অনাদিনাথের খুব বেশি মনে পড়ে না। অনাদিনাথ যখন মাকে হারান তখন ভালো করে বুদ্ধিই হয়নি তাঁর। সেই ভীষণ শান্ত আদুরে অথচ জেদি মহিলার কথা তাঁর স্মৃতিতে কিছু নেই। তবু কখনও কখনও স্বপ্নের মতো আবছা স্মৃতি এসে আচ্ছন্ন করে দেয় তাঁকে; যেন কোনও গভীর অন্ধকার থেকে একটি বুভুক্ষু দীর্ণ হাত এসে অবলীলায় স্পর্শ করে তাঁর শীর্ণ আর্ত হৃদয়। তখন অনাদিনাথ নিজের অজ্ঞাতসারেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে শ্লথকণ্ঠে ‘মা’ বলে ডাক দিয়ে ওঠেন; মনে হয় এই একটি দীর্ঘ বিলম্বিত লয়ের শব্দে তাঁর হৃদয়ের সমস্ত আর্তি মুহূর্তে বাক্সময় হয়ে ওঠে। ষাটের ঘরে পৌঁছে যাওয়া অনাদিনাথ তখন অনুভব করেন—নিতান্ত অকারণে তাঁর আঁখিপল্লব হয়ে উঠেছে আর্দ্র। ভারী হয়ে উঠেছে গলার স্বর। আর গভীর এক বেদনা যেন তাঁকে অধিকার করে রেখেছে সারা জীবনের মতো।

অনাদিনাথ একবার হাই তোলেন।

অনাদিনাথের এই এক একক নিজস্ব সময়। এই সময়ে এখানে এসে বসলে তিনি যেন তাঁর আত্মস্থ সময়কে ফিরে পান। অথচ এর বাইরে, বাড়ির ভেতরে পৌঁছলেই অনাদিনাথ পৌঁছে যান এক জমজমাট সংসারে। সেখানে তাঁর ঘর-ভরা লোকজন, মানুষ। এরা তাঁর আপনজন, আত্মীয়-স্বজন। অনাদিনাথ এদের মাঝেই বেঁচে আছেন, তবু মাঝে মাঝে মনে হয় তাঁর—তিনি যেন এদের কেউ নন। যে সম্পর্ক তাঁকে এই মানুষগুলোর কাছে ধরে রেখেছে সে সম্পর্ক রক্তের বটে কিন্তু তাতে তিনি আজ আর তেমন উষ্ণতার কোনও কারণ দেখেন না। অনাদিনাথ তাঁর এই ষাট বছরের জীবনে দেখেছেন—মানুষের জীবনটা বড় বিচিত্র।

ষাট বছর! ষাট বছর মানে অনেক সময়। অনাদিনাথের পিতা ষাট বছর বাঁচেননি। পঞ্চাশ ছুঁতে না ছুঁতেই তিনি চিরকালের সেই রহস্যময় গোপন অথচ অমোঘ আহ্বানে সাড়া দিয়েছিলেন। ভারি হাসি-খুশি দিলখোলা মানুষ ছিলেন লোকটা। জীবনে কোনও কিছুতেই যেন দুঃখ ছিল না তাঁর! বোনদের বিয়ে দিতে দিতে কপর্দকশূন্য হয়েছিলেন তিনি। শেষ জমিটুকুও বন্ধক পড়েছিল মহাজনের ঘরে। তাতেও যেন বিন্দুমাত্র আক্ষেপ ছিল না মানুষটির! কেউ কিছু বলতে গেলেই স্বচ্ছ সরল একটি হাসির আঘাতে উড়িয়ে দিতেন সব কিছু। ভারি কষ্ট আর দুখের মধ্যে জীবনের প্রথম দিনগুলো কেটেছে অনাদিনাথের। স্কুলের ভালো ছাত্র ছিলেন তিনি কিন্তু পয়সার অভাবে থার্ড ক্লাসে উঠেই পড়া ছাড়তে হয়েছিল তাঁকে। আজকাল কি যেন বলে ওটাকে। হ্যাঁ, ক্লাস এইট, মানে অষ্টম শ্রেণি। তবু সেই থার্ড ক্লাসের বিদ্যে নিয়েও এতকাল পর্যন্ত কাজ চালাতে অসুবিধে হয়নি অনাদিনাথের।

পুকুরটা অনাদিনাথের নিজস্ব। এর চারিদিকের বেশকিছু জমিও তাঁর। পুকুর-পাড়গুলোয় আম-জাম-সুপারি আর নানারকম গাছ। তারই ছায়া বিস্তৃত হয়ে আছে অনেকখানি জায়গা জুড়ে। সেবার, যেবার তাঁর বড় মেয়েটার জন্ম হলো, সেবারই পুকুরটা কাটিয়েছিলেন তিনি। শান-বাঁধানো ঘাট দিয়েছিলেন পুকুরে। বাড়িতে বাঁশের ঘর ভেঙে মাটির কোঠা উঠল। অনাদিনাথের তখন তুঙ্গে বৃহস্পতি, ঘরে অচলা লক্ষ্মী।

থার্ড ক্লাসে উঠে স্কুল ছাড়তে হয়েছিল অনাদিনাথকে। সেদিন ভীষণ কেঁদেছিলেন তিনি। আর মাত্র তিনটি বছর। তাহলেই এন্ট্রান্স পাস হয়ে যায়। তখন মোটামুটি ভরসা করার মতো একটা চাকরি জোটাতে আর বাধা কোথায়। কিন্তু না, অনাদিনাথ পারেননি। দিনে যার দুবেলা অন্ন জোটে না, তার আবার স্কুলে পড়ার শখ! হিতৈষী আত্মীয়-স্বজনরা খেঁকিয়ে উঠেছিলেন অনাদিনাথের আবদারে।

কে যেন যাচ্ছে পাশের পথটা দিয়ে। পশ্চিমের মাঠে তিনটি ছেলে বেশ মনোযোগ দিয়ে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে। অনেক উপরে স্থির-বিন্দুর মতো হয়ে আছে লাল ঘুড়িটা। ঐ মাঠের মাঝখান দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে একটা সরু খাল। বর্ষার সময় কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় খালটা। এখন খড়খড়ে শুকনো। মানুষের জীবনটাও বোধ হয় এমনিই। অন্তত অনাদিনাথ তো তাই-ই ভাবতে চেয়েছিলেন। থার্ড ক্লাসে স্কুল ছেড়েছিলেন তিনি। তারপর এক দোকানে শিক্ষানবিশির চাকরি। ভোর সকালে উঠে দোকান খুলতে হতো। সারাদিন বেচা-বিক্রি। রাতে ক্লান্ত শরীরে বসতে হতো বেচা-বিক্রি, জমা-খরচের হিসাব মেলাতে। কতই-বা বয়স তখন অনাদিনাথের। বড় জোর চৌদ্দ কি পনেরো। অই বয়সেই গোটা সংসারের দায়িত্ব চেপেছিল মাথায়। মাঝে মাঝে মনটা ভীষণ বিদ্রোহ করে উঠত। বই-খাতা হাতে স্কুলের ছাত্র দেখলেই হু হু করে কান্না আসত তাঁর। আর বাড়ির জন্যে ভীষণ খারাপ হয়ে যেত মনটা। তবু বাঁচতে হবে। এভাবেই মানুষ বেঁচে থাকে। মাঝে মাঝে বাড়িতে গেলে প্রৌঢ় পিতা বুকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কাঁদতেন।

—আমি তোর অক্ষম বাপ। বাপের কর্তব্য আমি কিছুই করতে পারিনি।

অনাদিনাথ তখন রাগ আর দুঃখ—এই দুইয়ের মাঝে দুলতেন। মাঝে মাঝে দু-একটা কটু কথা ওঁকে বলতেন না, তাও নয়। তিনি সেসব শুনে রাগতেন না একটুও, হেসে উঠতেন হো হো করে। বলতেন, ‘তুই-ই আমার বাপরে অনাদি, আমি তোর বাপ নই’।

অনাদিনাথ এসব কথায় আরও রেগে উঠতেন। কিন্ত ব্যস। তারপর আবার যথারীতি ফিরে আসতেন সেই দোকানে।

শহরের এক প্রান্তে তেজারতি কারবার। ঐ দোকানেই অনাদিনাথ কাজ নিয়েছিলেন। বুড়ো মালিকের আপনজন বলতে কেউ ছিল না তেমন। দুই মেয়ের বিয়ে আগেই দিয়েছিলেন তিনি। ব্যবসার টান তখন ভাটার দিকে। অই সময়েই এসে অনাদিনাথ জুটেছিলেন। মালিক লোকটি অনাদিনাথের হাতে সবকিছু সঁপে দিয়ে সরে গিয়েছিলেন এককোনে। বাজারে তাঁর বিরাট দেনার বোঝা। বললেন, দোকানটা টিকে থাকলে আমার দেনাটা শোধ করিস বাপ।

তারপর সস্নেহে অনাদিনাথকে কাছে টেনে নিয়ে বলতেন—‘আমার মন বলছে, তুই পারবি অনাদি। তোর বুদ্ধি আছে, চেষ্টা আছে—তোর হবে। তবে একটা কথা মনে রাখতে হবে—কাউকে ফাঁকি দিবি না। ভগবানের উপর ভরসা রাখবি। তিনিই তোকে টিকিয়ে রাখবেন।’

না, অনাদিনাথ কাউকে ফাঁকি দেননি। বেশি দিন টেকেনি সেই বুড়ো লোকটা। মরার আগে অনাদিনাথকেই দিয়ে গিয়েছিলেন তিনি দোকানটা, সঙ্গে অবশ্য দেনার বোঝাটাও! তবে ততদিনে দোকানের হাল ফিরেছে, যেন জোয়ারের নদীর হাওয়া লেগেছে পালে। দেনার বোঝা অনেকখানি হালকা করে এনেছিলেন অনাদিনাথ। বাড়িতে ভিটেবাড়িটুকু ছাড়িয়ে নিয়েছিলেন মহাজনের হাত থেকে। দু-এক টুকরো জমি-জমাও হচ্ছিল তাঁর। অনাদিনাথ তখন আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন। আর স্বপ্ন মানেই বাঁচা।

তখন সেই সময়ে অনাদিনাথকে বিয়ে করিয়েছিলেন তাঁর বাবা। অনাদিনাথের মোটেই ইচ্ছে ছিল না। কতই-বা বয়স। আঠারো-উনিশ বছর! তা সেকালে ওই বয়সেই ছেলেদের বিয়ে হতো। অনাদিনাথের তবু ইচ্ছে ছিল না। তিনি ভেবেছিলেন—আর একটু গুছিয়ে টুছিয়ে নিয়ে তারপর বিয়ে করবেন। কিন্ত পিতার অনুরোধ ফেলতে পারেননি। অসুস্থ বাবা প্রায় ছেলেমানুষের মতো বায়না ধরেছিলেন যেন। অনাদিনাথের নিজেরও কি ভেতরে ভেতরে একটু ইচ্ছে ছিল না ? সেসব দিনের কথা অনাদিনাথের এখনও স্পষ্ট মনে আছে। চোখ বুজলেই যেন তিনি অনায়াসে ফিরে চলে যান সেই অতীত জীবনে। তাঁর বাবা বলতেন, ঘরে লক্ষ্মী না থাকলে বাণিজ্যে লক্ষ্মী আসবে কোত্থেকে।

অনাদিনাথ এখন অসুস্থ। চার বছর ধরে শয্যাশায়ী তিনি। যেটুকু হাঁটাচলা সে শুধু এই বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যেই। এই পুকুর-পাড়ে এসে বসা কিংবা খুবই ধীরে ধীরে গ্রামের পথটুকু দিয়ে হাঁটা। হ্যাঁ, জীবনের শেষ অধ্যায়ে পৌঁছে গেছেন তিনি। হয়তো আর বেশি দিন সময় নেই। একদিন হঠাৎ করে এসে হাজির হবে সেই অমোঘ আহ্বান। তখন আর কারও দিকে ফিরে তাকানো চলবে না। পেছনে পড়ে থাকবে এই সাজানো সংসার, বাড়-বাড়ন্ত ঘর-গেরস্থালি, এক টুকরো উষ্ণ স্মৃতি। তবু মানুষ এরই জন্যে প্রাণপাত করে, এরই জন্যে পৃথিবীটি করে তোলে দুর্বিষহ। অনাদিনাথ নিজেও কি করেননি ? এক একবার সব কিচু চুলচেরা হিসেব করার ইচ্ছে হয় তাঁরও। আবার মনে হয়—তাঁর কর্মের বিচারের ভার তো তাঁর নিজের উপরে নেই!

আজকাল এসব কথা অনাদিনাথকে মাঝে মাঝে বড় বেশি অধিকার করে রাখে। কখনও কখনও মনে হয় তাঁর—জীবনের অনেক সময় তিনি শুধু শুধু অপচয় করেছেন। সেই কিশোর বয়সে বাধ্য হয়ে একদিন এই সংসারের জোয়াল কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন, তারপর তা আর কোনও দিন কোনও কারণেই এক মুহূর্তের জন্যও নামাতে পারেননি কাঁধ থেকে। অথচ এসবের কি সত্যিই খুব বেশি প্রয়োজন ছিল ? জীবনে বেঁচে থাকার জন্য মানুষের কতটুকুই বা দরকার!

না, খুব বেশি প্রয়োজন নেই। আজ, জীবনের ষাটটি বছর পেরিয়ে এসে অনাদিনাথের মনে হচ্ছে, ব্যবসা আর টাকা পয়সার পেছনে জীবনের বেশির ভাগ সময়ই নষ্ট হয়েছে তাঁর। মানুষ সুখ চায়। অনাদিনাথও জীবনে সুখ চেয়েছিলেন। প্রথম জীবনের দারিদ্র্যের কথা মনে রেখে তাঁর মনে হয়েছিল—দুনিয়াতে বেঁচে থাকার জন্যে অনেক টাকা চাই। সেদিক থেকে অবশ্য মা লক্ষ্মী ফিরিয়ে দেন নি তাঁকে। তাঁর এই একার জীবনে তিনি যা করেছেন—তাতে তাঁর তিন ছেলের জীবনটুকু অক্লেশে কেটে যেতে পারত। কিন্তু তারও কি দরকার আছে খুব একটা ? বড় দুছেলেই তো মোটামুটি জীবনে প্রতিষ্ঠিত। একজনের ব্যবসা, অন্য জনের চাকরি। আর দুটোই বেশ ভারিক্কি ধরনের। মোটামুটি গুছোনো জীবন তাদেরও। এইটুকু ভাবতে গিয়ে অনাদিনাথ বেশ একটু তৃপ্তি বোধ করেন। এক মুহূর্তের জন্যে মনটা তাঁর দারুণ রকম হালকা মনে হয়।

থার্ড ক্লাশ থেকে পড়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন অনাদিনাথ। এই আক্ষেপ তাঁর সারা জীবন যায়নি। এখনও যা কিছু হাতের কাছে পান, তা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েন। প্রায় সবসময়ই দু-একটা বইও কিনেছেন। এই গ্রন্থের সঞ্চয়ই কম নয় তাঁর। সেই প্রথম থেকেই তাঁর মনে সুপ্ত একটি আশা ছিল, নিজে যা পারেননি, তাঁর সন্তানদের মধ্যে দিয়ে যেন তা পুরণ করতে পারেন তিনি। সেজন্য ছেলেদের লেখাপড়ার ব্যাপারে একটুও কার্পণ্য ছিল না তাঁর। ভালো স্কুলে, ভালো কলেজে পড়িয়েছেন তিনি তাদের। আর এদিক খেকে খুব বেশি নিরাশও হননি। বড় ছেলে কমার্সে ডিগ্রি নিয়ে ব্যবসা করতে নেমেছে, মেজ ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ ডিগ্রি নিয়ে প্রথমে কলেজের মাস্টার, পরে কী একটা বিশেষ রিসার্চের কাজে যুক্ত। আর সবচেয়ে ছোট ছেলেটা এখন কলেজের ছাত্র। এসব কথা ভাবতে গেলে মনে মনে তৃপ্তির একটা স্বাদ পান অনাদিনাথ। কিন্তু তবু কি তৃপ্তি। মাঝে মাঝে তাঁর মনে হয়—তিনি যা চেয়েছিলেন তার কিছুই হয় নি। সমস্ত কিছুই আসলে বাইরের একটা ব্যাপার। এতে তাঁর কিছুই করার নেই। না আনন্দ, না দুঃখ। আসলে তিনি নিজে পড়ে আছেন বিরাট একটা ফাঁকির মধ্যে। সেই ফাঁকিটুকুই যেন বিরাট বিশাল এক অন্তহীন শূন্যতায় নিক্ষেপ করে তাঁকে। অনাদিনাথ তখন অসহায়।

ডানদিকের একটা গাছের ডাল নড়ে উঠল দ্রুত। অনাদিনাথ তাকিয়ে দেখলেন—একটা কাঠবিড়ালি গাছ থেকে নেমে দৌঁড়োচ্ছে। কোথায় যেন একটা পাখি ডাকছিল। পাখিটা চোখে পড়ে না। ঘাটের দিকে জলের শব্দ উঠল। চকিতে একটা মাছের রুপালি শরীর একবার ঝলসে উঠে আবার হারিয়ে গেল জলের নিচে। অনাদিনাথ সেদিকে তাকালেন। শান-বাঁধানো ঘাটটা পুরোনো হয়ে গেছে। দু-একটা সিঁড়ি খসে পড়েছে, শ্যাওলা জমেছে। অনাদিনাথ অনেকদিন থেকে ভাবছিলেন ঘাটটা আবার নতুন করে সারানো দরকার। পুকুরের পাড়ে অনেক আগাছা জন্মেছে—ওগুলো পরিষ্কার করানো দরকার। কিন্তু কারও আর দৃষ্টি নেই ওদিকে। কেউ কোনও কাজের নয়। যতক্ষণ না তিনি নিজে দেখছেন—ততক্ষণ কোনও কাজই আর হচ্ছে না। এই অসুস্থ অবস্থায়ও মরতে মরতে তাঁকে ছুটতে হবে। যেন মস্ত একটা দায় পড়েছে তাঁর। না, আর কিছুই করবেন না তিনি। কোনও দায় পড়েনি তাঁর। যারা বেঁচে থাকবে, দায়টা তাদেরই। অনাদিনাথ ভেতরে ভেতরে রেগে উঠলেন ভীষণ। কেন রাগ, কার ওপর রাগ, কোনও কিছুই স্পষ্ট নয়। তবু সাংঘাতিক একটা ক্ষোভ আর ক্রোধ অনাদিনাথকে যেন অনেকক্ষণ ধরে আচ্ছন্ন করে রাখে।

বড় দুছেলে তাদের স্ত্রী-পুত্র নিয়ে দুই শহরে আছে। অনাদিনাথের মনে হয়, তারা অনেক দূরে, দূরের মানুষ হয়ে আছে। যেন তারা তাঁর আত্মজন নয়, অন্য কেউ—অন্য কোনও মানুষ! জীবন এই রকম। পিতার মৃত্যুর পর ভয়ানক মুষড়ে পড়েছিলেন অনাদিনাথ। তাঁর মনে হয়েছিল—পৃথিবীতে তাঁর আর কোনও অবলম্বন রইলো না, আপনজনও না। আজকাল নিজের মৃত্যুর কথা খুব বেশি করে মনে পড়ে অনাদিনাথের। মৃত্যুকে তাঁর বড় ভয়। জগৎ সংসারের এই আলো, এই মানুষজন, পৃথিবী—সবকিছুই একদিন হঠাৎ নিভে যাবে দুচোখ থেকে—কথাটা ভাবতে ভারি কষ্ট হয় অনাদিনাথের। যেকোনও সাংঘাতিক একটা গল্পের ভয়ংকর কোনও জন্তুর মতো তাড়িয়ে নিয়ে যায় তাঁকে। তবু এও সত্য। সত্যটি ধারণ করার শক্তি অর্জনের চেষ্টা করেন তিনি মনে মনে। তখন কৈশোর আর যৌবনের দিনগুলোর কথা আবার খুব মনে পড়ে যায়। যেন পেছনে ফেলে আসা সমস্ত জীবনটাই আবার ঘুরে ঘুরে তাঁর কাছে ফিরে আসে।

একবার খুব থিয়েটার করার নেশা জমে গিয়েছিল। চেষ্টা তদবির করে বেশ একটা দলও গড়ে তুলেছিলেন তাঁরা। আর সেই দল নিয়েই নাটক। এই গ্রামদেশে বেশ একটা সাড়া পড়ে গিয়েছিল সেবার। শহর থেকে দুটো মেয়ে এসেছিল পার্ট করার জন্যে। অনাদিনাথের তখন প্রথম মেয়ে জন্মেছে। বাড়িতে নিজের জমিতে নতুন চাষবাস শুরু হয়েছে। সংসার বেশ জমজমাট। বেশ জমেছিল সেবার সেই নাটক। অনাদিনাথ নিজে নাটকে পার্র্ট করেননি কিন্তু সবকিছুর ব্যবস্থাপনা ছিল তাঁরই হাতে। যেন আসলে তিনি নিজেই ছিলেন সেই কেন্দ্রীয় চরিত্র—যার ইচ্ছেয় ঘটনার গতি কখনও দ্রুত, কখনও শ্লথ হয়।

আহ! সেসব দিনের কথা অনাদিনাথের খুব মনে পড়ে। বড় উজ্জ্বল আর রঙিন দিন ছিল। আজকাল আর তেমন কিছু হয় না, তেমন উৎসাহ-উদ্দীপনা আজকালকার ছেলেদের মধ্যে তিনি দেখেন না। কেমন যেন মনমরা আর বিষণ্ন সবাই। জিনিস-পত্রের দাম বাড়ছে—দাম বেড়েছে। বেঁচে থাকাটাই আজ এসব মানুষের সবচেয়ে বড় সমস্যা। কিন্তু সমস্যা কি তখনও ছিল না ? অনাদিনাথ নিজেও কি কম কষ্ট করেছেন জীবনে ? দোকানটা দাঁড় করাতে তাঁকে কি কম পরিশ্রম করতে হয়েছে ? সেই ভোর রাতে ঘুম থেকে উঠে আবার মধ্যরাত পর্যন্ত অমানুষিক পরিশ্রম! এর মধ্যে, তাঁর মেজ ছেলের বয়স যখন সাত, তখন একবার আগুন লেগে পুড়ে গেল দোকান। এক সঙ্গে একই সারিতে বাইশটা দোকান পুড়েছিল সেবার। অনাদিনাথ তখন প্রায় সর্বস্বান্ত। যা কিছু সম্পদ তার সবই ভস্মীভূত! ভয়ানক মুষড়ে পড়েছিলেন তখন অনাদিনাথ। হাতে টাকা-কড়িও কিছুই ছিল না। ভেবেছিলেন আর হয়তো কোনও দিনই তিনি নতুন করে ব্যবসা দাঁড় করাতে পারবেন না। এখানেই তাঁর শেষ। যৌবনের সেই প্রচণ্ড উদ্যম আর পরিশ্রম করার ক্ষমতাও বুঝি আর তেমন নেই। সেদিন, সেই সন্ধেয়—আগুনের লাল লকলকে শিখা দেখতে দেখতে অনাদিনাথ যেন সার্বিক পরাজয়ের সম্ভাবনায় অস্থির হয়ে পড়েছিলেন।

তবু আবার শুরু করেছিলেন অনাদিনাথ। শুরু না করে তাঁর আর উপায়ও ছিল না। ছেলেরা তখনও ছোট, সবেমাত্র বড় মেয়েটার বিয়ে হয়েছে। অগত্যা অনাদিনাথ আবার প্রচুর ধারদেনা করে ব্যবসা শুরু করেছিলেন। আবার সেই প্রচণ্ড পরিশ্রম। না, অনাদিনাথ জীবনে সুখ পাননি, স্বস্তিও না। সারা জীবন যেন কঠিন এক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এগোতে হয়েছে তাঁকে। কারও কারও জীবনে হয়তো এমনিই হয়। জীবনে সামান্যতম মুহূর্তও তারা অবসর পায় না। কিন্তু এই সংগ্রামই কাল হলো। অত্যধিক পরিশ্রমে শরীর ভেঙে পড়েছিল অনাদিনাথের। ব্যবসাটা আবার মোটামুটি দাঁড়াল বটে কিন্তু অনাদিনাথ নিজে আর ভালোভাবে দাঁড়াতে পারলেন না। কঠিন অসুখে দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী হয়ে থাকলেন তিনি। ডাক্তার আর ওষুধের পেছনে জলের মতো টাকা ঢাললেন।

অনাদিনাথের দুই ছেলে তখন কলেজে পড়ছে। অই ছেলেদের দিকে তাকিয়ে অনাদিনাথ মনে বল পেতেন। তাঁর সকল স্বপ্ন আর আশা যেন ওদের মাঝেই প্রতিফলিত দেখতে পেতেন তিনি। এই হয়তো মানুষের জীবন। মানুষ তার সন্তানের মাঝেই হয়তো নিজের স্বপ্ন আর আকাক্সক্ষার প্রতিচ্ছবি দেখে। এই আশা নিয়েই হয়তো মানুষ বেঁচে থাকে। অনাদিনাথও বেঁচে ছিলেন।

অনাদিনাথ আজও তেমনি বেঁচে আছেন। অপরাহ্ণের তীক্ষ্ম তেরছা রোদ এখন বিকেলের হালকা আলোয় মিশে যাচ্ছে। সব দুপুরই এক সময় বিকেল হয়ে যায়। অনাদিনাথ একবার উঠে দাঁড়ালেন। হাঁটতে তাঁর কষ্ট হয়। তবু পায়ে পায়ে একটু একটু এগিয়ে গেলেন তিনি। এই বিকেলটা বড় মনোরম!

দক্ষিণ-পুব দিকে তাকিয়ে দেখলেন, ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিলের কাঁচা রাস্তায় ধুলো উড়িয়ে দক্ষিণ দিকে একটা জিপ চলে যাচ্ছে। আজ সকালে তাঁর মেজ ছেলে কর্মস্থলে ফিরে গেল। সেই ছেলের দেড় বছরের শিশুটার কথা বড় মনে পড়ছে অনাদিনাথের। হঠাৎ কখনও ছুটতে ছুটতে ‘দাদু’ বলে কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ত সে। টাল সামলাতে না পেরে অনাদিনাথ পড়ে যেতেন। দুর্বল শরীর তাঁর। তবু বড় ভালো লাগে। যেন পরম এক পুলক জাগে মনে। নাতিটার জন্য খুব খারাপ লাগছে তাঁর। দাদুÑদাদু। মনে মনে, যেন প্রায় নিজের সঙ্গে কথা বলছেন তিনি, বিড় বিড় করে বললেন অনাদিনাথ। তাঁর চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে। অনাদিনাথ যেন তাঁর সামনের এই বৃক্ষরাজিকেই ডেকে বললেন—দাদু, দাদু, আয়, আয়!

আহ! শব্দগুলো হাওয়ায় হারিয়ে যায়। নাকি কোথাও আবার বেঁচে থাকে! আমাদের এই এত দিনকার জীবন—কোথায় একসময় হারিয়ে যায়। কোথায়! দাদু, দাদু! আয়, আয়!

অনাদিনাথ তাঁর দুর্বল কম্পমান হাত দুটো বাড়িয়ে দিলেন। তাঁর সেই প্রসারিত হাতের মাঝ দিয়ে খেলে বেড়াতে লাগল হাওয়ার চঞ্চল শিশুরা। অনাদিনাথ! এখন বড় অসময় অনাদিনাথ। আমাদের পৃথিবীটার ভৌগোলিক আয়তন ঠিকই আছে বটে কিন্তু তার পরিধি বেড়ে গেছে হাজার গুণ। অনাদিনাথের সেই ছোট্ট সংসার আজ অনেক বড়, অনেক বিশাল হয়ে পড়েছে। একদিন তাঁর ছেলেরা ছিল তাঁর পাশেই; আজ তারা অনেক দূরে। জীবন মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। অনাদিনাথের জীবনও যেন আজ বড় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। বড় অসহায় বোধ করেন অনাদিনাথ। আসলে সব মানুষই কি এমনি একা আর অসহায়।

মেজ ছেলেটাকে বড় ভালোবাসতেন তিনি। যেন তার মধ্যে তিনি তাঁর নিজের ছায়াকেই প্রত্যক্ষ করতেন। লেখাপড়ায় সেই ছিল সবচেয়ে কৃতী আর উজ্জ্বল। হয়তো এ কারণেই অনাদিনাথ বড় দুর্বল ছিলেন তার প্রতি। প্রায় মাসখানেক ছুটি কাটিয়ে আজই চলে গেল সে। অনাদিনাথের খুব খারাপ লাগছে এখন। যেন কেমন এক শূন্যতা তাঁকে ঘিরে আছে, আচ্ছন্ন করে আছে। বড় ফাঁকা লাগছে তাঁর সবকিছু।

ছেলেকে নিয়ে একবার ভারি মুস্কিলে পড়েছিলেন তিনি। মেয়েকে চিনতেন অনাদিনাথ। তাঁর শহরের বাসায় অনেক কবার এসেছিল সে। তারপর! কোথায় যেন কী হয়ে গেল। বড় চাপা স্বভাবের ছেলে তাঁর। কিছুই মুখ ফুটে বলত না। চাইত নাও কিছু। নিজের বইপত্র, লেখাপড়ার জগৎ নিয়েই ব্যস্ত থাকতো সে। সে সময় অনাদিনাথ অনেকবার ভেবেছিলেন—একবার ছেলেকে ডেকে কিছু কথা বলবেন। তারপর কী ভেবে আর বলেননি। হয়তো ভেবেছিলেন—বড় হয়েছে ওরা। ওদের নিজেদের ব্যাপারে ওরা নিজেরাই ভালো বুঝবে। জীবনে আরও কত দুঃখ আর বাধা আসবে। অনাদিনাথ তো তখন আর বেঁচে থাকবেন না। হ্যাঁ, ওদের নিজেদের মতোই বেঁচে থাকতে দাও। সত্যিকারের জীবনকে চিনে নিতে দাও। কথাটা আজ আবার মনে পড়ল অনাদিনাথের। না, সেই মেয়েকে তিনি আর দেখেননি। তারপর ছেলে তার নিজের পছন্দমতই বিয়ে করেছে। তবু এখনও ছেলের মুখের দিকে তাকালে তাঁর মনে হয় যেন গভীর এক বিষাদ বুকে পুষে রেখেছে সে। অনাদিনাথের তখন বড় কষ্ট হয়। কী কষ্ট!

বিকেলটা এবার ধীরে ধীরে সন্ধ্যে হয়ে আসছে। চারদিকে ধূসর এক আলোর রেখা ছড়িয়ে পড়ছে ক্রমশ। অনাদিনাথ শুধু একা এই ধূসর রাজ্যে জেগে আছেন। অথচ তাঁর চারদিকে জেগে আছে অন্য এক জীবন। অন্য মানুষেরা বেঁচে আছে সেখানে। সবাই বাঁচে তবু কি ভীষণভাবে আলাদা প্রত্যেকটি মানুষ।

অনাদিনাথ এখন বেঁচে আছেন। জীবনের শেষ সময়ে এসে পৌঁছেছেন তিনি। এতো পরিশ্রম আর কষ্ট না হলে শরীরটা আর একটু ভালো থাকত তাঁর। হয়তো আরও কদিন বেশি বাঁচতেন। আরেকটু সুখ, আরেকটু শান্তি ? অপরাহ্ণ বিকেল হয়ে গেছে। বিকেল থেকে সন্ধ্যে। অনাদিনাথ এবার এখান থেকে উঠবেন। ঘরে গিয়ে তাঁর সেই নির্ধারিত শয্যায় পৌঁছে যাবেন তিনি। সেখানে ওষুধের শিশি, থার্মোমিটার, হট-ওয়াটার ব্যাগ আর রাজ্যের সব জিনিসপত্তর। আর কিছু বই। মাঝে মাঝে অনাদিনাথ অইসব বই পড়েন, নাড়াচাড়া করেন।

অনাদিনাথ যতই বাড়ির দিকে এগোচ্ছেন—শুনতে পাচ্ছেন ঘর-গেরস্থালির পরিচিত নানা শব্দ। মানুষের বেঁচে থাকার শব্দ, জীবনের শব্দ। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে তিনি যেন শুনলেন—দাদু! আয়, আয়!

আহ! দাদু! অনাদিনাথ যেন অন্য মানুষ হয়ে যাচ্ছেন!

সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button