আর্কাইভগল্প

খেলনা পুতুল : আখতার হুসেন

আবার পড়ি : আখতার হুসেনের কিশোরগল্প

সেই ধূসর গোধূলিবেলায় লোকটাকে এই শহরে সবাই নতুন দেখল।

তার চেহারা, পোশাকের ধরন-ধারণ পথের দুপাশের সবাইকে আগ্রহী করে তুলল। কিন্তু কেন জানি, কেউ তাকে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করার সাহস করল না, তোমার নাম কী, বাড়ি কোথায়, কোথা থেকে এলে, কী করো ইত্যাদি ইত্যাদি।

লোকটা হেঁটে যাচ্ছিল মাটির দিকে চোখ রেখে। তার চলার ধরনে মনে হচ্ছিল, যেন সে বহু দূর থেকে হেঁটে আসছে। তার চোয়ালের দুপাশ বেয়ে ঘাম ঝরে পড়ছিল। কাঁধে একটা বিরাট ঝোলা, তাতে তাকে বড় বেমানান দেখাচ্ছিল। চুল উসকোখুশকো, যেন তেল পড়েনি অনেক বছর। দাড়ি-গোঁফও খোঁচা খোঁচা―জেলখানার নির্দোষ আসামিদের মতো।

হাঁটছিল কিন্তু সামনে-পেছনে কোনও দিকেই খেয়াল নেই। তার পেছনে তখন পথে পথে ঘোরা এক ঝাঁক ছেলেমেয়ে। হইচই করে  ক্ষেপাতে শুরু করেছে। কিন্তু লোকটা পেছন ফিরে একটা ধমকও দিচ্ছে না। এতটুকু বিরক্তির ছাপও নেই তার চোখেমুখে।

লোকটা একসময় হাঁটতে হাঁটতে শহরের বাইরে ছোটদের খেলার জন্যে যে বড় মাঠটা, তার ধারে এসে দাঁড়াল।

বিকেলের শুরু। ছেলেমেয়েরা হইহল্লা আর ছোটাছুটি করে খেলাধুলোয় ব্যস্ত। কিন্তু হঠাৎ সে ওদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বসল। লোকটার চেহারা কী বিদ্ঘুটে, আর কাঁধে অত বড় একটা ঝোলাই-বা কেন ? এ নিশ্চয়ই ছেলেধরা! মাঠের সবাই খেলাধুলো থামিয়ে থমকে দাঁড়াল এবং চিৎকার করে উঠল―‘ছেলেধরা! ছেলেধরা! পালাও, পালাও, সবাই পালাও। আমাদের ধরতে এসেছে দুষ্টু ছেলেধরা!’

অল্পক্ষণের মধ্যেই মাঠটা খালি হয়ে গেল।

পরের দিন লোকটাকে আবার ছোটদের সেই খেলার মাঠের ধারে দেখা গেল। কাঁধে তার সেই মস্ত ঝোলা, সেই তেমনি উসকোখুশকো চেহারা। এতটুকু অদল-বদল নেই।

ছেলেমেয়েরা আজও লোকটাকে তাদের মাঠের ধারে দেখতে পেয়ে আগের মতোই অবাক হলো কিন্তু গতকালকের মতো ভয় পেয়ে মাঠ ছেড়ে পালাল না। তাকে নিয়ে তারা নানা রকম জল্পনাকল্পনা করতে শুরু করল। আর সেই লোকটা, সেই লোকটা মুখে মিষ্টি হাসি টেনে ছেলেমেয়েদের উদ্দেশে হাত তুলে বলল, ‘আমাকে ভয় পাওয়ার কী আছে, ভাইবোনেরা ? আজকের এই সুন্দর বিকেলটা তোমরা মিছেমিছি নষ্ট কোরো না।’

কিন্তু ছেলেমেয়েদের ভয় তবু ভাঙল না। তারা ভাবতে লাগল, লোকটার হাতে-পায়ে ধারালো নখটখ নেই সত্যি, কিন্তু মনটায় কী না কী আছে, কে জানে ? মন দিয়েই তো সব কথা। দুষ্টু লোকের আর কিছু না হোক, কথাগুলো মিষ্টি হয়ে থাকে। তারা ভেবে চলল, লোকটা নিশ্চয়ই ভালো মানুষ নয়। না-হলে দুনিয়ার আর সব জায়গা ছেড়ে এই খেলার মাঠের ধারে এসে দাঁড়াবে কেন ? তাদের মনে পড়ল লিটুর কথা। সেই লিটু, চটপটে, চালাক-চতুর লিটু। তাদের খেলার সাথি। একটা লোকের সঙ্গে ওর স্কুল থেকে ফেরার পথে এক শনিবার বিকেলে পরিচয় হয়েছিল। তারা নিজেরাও দেখেছে, কী মিষ্টি সেই লোকটার ব্যবহার! লিটুকে রোজ নানান রকম খেলনা পুতুল উপহার দিত, দিত মিষ্টি, টফি, লজেনচুস। তারপর একদিন খবর রটল, লিটুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যাপারটা কি সহজে ভোলা যায় ?

‘আমাকে বিশ্বেস করো,’ লোকটা আবার হাত তুলল, ‘বিশ্বেস করো, আমি তোমাদের কোনও ক্ষতি করতে আসিনি। আমাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, ভাইবোনেরা। তোমরা যেভাবে খেলাধুলো করছিলে, সেভাবেই সেটা চালিয়ে যাও।’

কিন্তু ছেলেমেয়েরা খেলাধুলো করবে কি, লোকটার কথায় এবার খেপে উঠল এবং হাতের সামনে ইটপাটকেল যা পেল, তা-ই তুলে নিয়ে ছুড়ে মারতে লাগল তার দিকে তাক করে।

ছেলেমেয়েদের ছুড়ে দেওয়া ইটপাটকেলগুলো লোকটার শরীরে, নাকে, মুখে, দাঁতে অবিরাম আঘাত হানতে লাগল। ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরতে লাগল তার শরীর বেয়ে। সে বৃথাই চেষ্টা করল ওদের ঢিলের আঘাত থেকে বাঁচবার।

‘আমাকে মেরো না,’ লোকটা চিৎকার করে উঠল। ‘আমাকে মেরো না, আমাকে মেরো না।’ কিন্তু ছেলেমেয়েরা তার দিকে ঢিল ছুড়ে দিয়ে এমনভাবে হইহল্লা করছিল যে তার তুলনায় লোকটার আর্তচিৎকার বড়ই ক্ষীণ মনে হলো। অবশেষে যখন সে দেখল, ছেলেমেয়েদের হাত থেকে বাঁচবার আর কোনও পথ নেই, তখন সে দৌড়াতে লাগল প্রাণপণে। আর ঠিক তখনি, হ্যাঁ, ঠিক তখনি, ছেলেমেয়েরা দেখতে পেল, পষ্ট দেখতে পেল এক অবাক-করা ব্যাপার।

প্রথমটায় বিশ্বেস হলো না। বার কয়েক চোখ কচলাল। কিন্তু না, এতটুকু ভুল নেই। ছেলেমেয়েরা পষ্ট দেখতে পেল, লোকটার শরীরের রক্ত ফিনকি দিয়ে যেসব জায়গায় ঝরে পড়েছে, সেসবখানে সৃষ্টি হয়েছে নানান রঙের, নানান আকারের খেলনা পুতুল।

‘রক্ত থেকে খেলনা পুতুল, রক্ত থেকে খেলনা পুতুল। কী অবাক ব্যাপার! কী মজার ব্যাপার!’ ছেলেমেয়েরা আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল এবং ছুটোছুটি-হুটোপুটি করে খেলনা পুতুলগুলো দুহাতে কুড়িয়ে নিতে লাগল।

লোকটা তখন সন্ধের আঁধারে হারিয়ে গেছে।

এরপর হপ্তা খানেক আর লোকটাকে মাঠের ধারে দেখা গেল না। ছেলেমেয়েরা কত ইট-পাটকেল মাঠের মাঝখানটায় জড়ো করে রেখেছে, লোকটা এলেই তা ছুড়বে। যত রক্ত, ততই খেলনা পুতুল―এর চেয়ে মজার ব্যাপার আর কী হতে পারে ? ছেলেমেয়েরা চঞ্চল হয়ে উঠল সেই লোকটার প্রতীক্ষায়।

গোধূলিবেলার তখনো শুরু হয়নি। পাখিরা আকাশের বুকে ডানা মেলে দিয়ে তখনও সাঁতার কাটছে। আর ঠিক তখুনি সেই লোকটাকে ছেলেমেয়েরা দেখতে পেল। আনন্দে-উল্লাসে ফেটে পড়ল, ‘আসছে, আসছে, ওই যে লোকটা আসছে।’ হ্যাঁ, লোকটা এগিয়ে আসছে তাদের দিকেই। সেই তেমনি কাঁধে ঝোলা, উসকোখুশকো চেহারা, ক্ষতস্থানগুলোয় পট্টি বাঁধা। মুহূর্তে ছেলেমেয়েরা ঢিল হাতে দাঁড়িয়ে পড়ল।

লোকটা ছেলেমেয়েদের উদ্দেশে তার ডান হাতখানা উঁচিয়ে কী যেন বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তাকে ওরা সে সুযোগ না দিয়ে অবিরাম ঢিল ছুড়তে লাগল। লোকটা ঢিলের আঘাত সহ্য করতে না পেরে মুহূর্তে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। ছেলেমেয়েরা তখনও ঢিল ছুড়ে চলেছে। সেই মুখ থোবড়ানো অবস্থায় লোকটার ক্ষতস্থান বেয়ে অঝোরে রক্ত ঝরতে লাগল মাটিতে। কিন্তু কী অবাক-করা ব্যাপার, আজ আর সেই রক্ত থেকে খেলনা পুতুল নয়, ছেলেমেয়েরা পষ্ট দেখতে পেল, খেলনা পুতুল নয়, সৃষ্টি হলো একটা চিতে বাঘ।

‘বাঘ, বাঘ, চিতে বাঘ!’ ছেলেমেয়েরা ভয় পেয়ে একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল। ‘পালাও, পালাও!’ অল্পক্ষণের মধ্যেই মাঠটা খালি হয়ে গেল। ওরা যে যেদিকে পারল প্রাণপণে পালিয়ে বাঁচল।

তখন সন্ধে হাঁটি হাঁটি পা পা করে নেমে আসছে। পাখিরা ঘরে ফিরছে গান গেয়ে গেয়ে।

এ ঘটনার পর থেকে ছেলেমেয়েরা কেমন যেন হয়ে গেল। ওদের প্রত্যেকের চলাফেরায়, হাবভাবে আর চেহারায় কেমন যেন একটা চিন্তার ছাপ। খেলার মাঠে আর খেলতে যায় না। ছুটোছুটি আর হইহুল্লা করে না। মন খুলে হাসে না, গায় না। একদিন ঠিক করল, ওরা লোকটাকে খুঁজে বের করবে এবং তার সঙ্গে সবাই মিলে যে দুর্ব্যবহার করেছে, তার জন্যে ক্ষমা চেয়ে নেবে।

এক ঝকমকে সকালে ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে লোকটাকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়ল ঘর ছেড়ে। কিন্তু সারা শহর ঢুঁড়েও সেই অদ্ভুত লোকটাকে পাওয়া গেল না। এমনকি কেউ খোঁজও দিতে পারল না, লোকটা কোথায় থাকে, কী করে বা এই শহরের বাইরে কোথাও তাকে পাওয়া যেতে পারে কি না ? খেলার মাঠের ধারেও এরপর লোকটাকে কেউ আর আসতে বা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেনি।

দিন যতই পেরিয়ে যাচ্ছিল, সেই অদ্ভুত লোককে ছেলেমেয়েরা ভুলবে কি, তার স্মৃতি তাদের মনে আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠতে লাগল।

সেদিন বিকেলে ছেলেমেয়েরা তাদের খেলার মাঠের মাঝখানটায় জটলা পাকিয়ে বসে ছিল। বসে বসে ভাবছিল সেই অদ্ভুত লোকটার কথা। তাকে ওরা কত দুঃখ দিয়েছে, কত কষ্ট দিয়েছে! ভাবতে ভাবতে একসময় ওদের সবার চোখে জল এল। অঝোরে তা দুগণ্ড বেয়ে ঝরতে লাগল মাটিতে। আর কী অবাক ব্যাপার, ছেলেমেয়েরা দেখল, পষ্ট দেখল, তাদের চোখের জলের প্রতিটি ফোঁটা মাটিতে পড়ছে আর তার থেকে সৃষ্টি হচ্ছে খেলনা পুতুল। রংবেরঙের খেলনা পুতুল। আর এগুলো দেখতে সেই পুতুলগুলোর মতোই, অদ্ভুত লোকটার রক্ত মাটিতে পড়ে যে রকম খেলনা পুতুল সৃষ্টি হতো; এতটুকু ভুল নেই, অবিকল সেই রকম খেলনা পুতুল।

সচিত্রকরণ : ধ্রুব এষ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button