আর্কাইভপ্রচ্ছদ রচনা

আখতার হুসেনের মেলা মানেই অবাধ স্বাধীনতা : সুজন বড়ুয়া

আখতার হুসেনের সাহিত্যকর্ম : আলোচনা

এ কথা এখন সর্বজনস্বীকৃত যে, শিশুসাহিত্য একটি বিশেষ ধরনের সাহিত্যপ্রকরণ। ছোটদের লেখালেখি করার জন্য লেখকের বিশেষ কিছু গুণ থাকতেই হয়। প্রধান গুণটি হলো ছোটদের মনোজগৎ সম্পর্কে সচেতনতা। এর সঙ্গে প্রকাশভঙ্গির সরলতা ও ভাষা প্রয়োগে মাত্রাবোধ সরাসরি যুক্ত। কেননা ছোটদের জন্য রচিত সাহিত্য যদি শিশুসাহিত্য হয়, তবে তা অবশ্যই শিশুদের মতো সহজ সরল চঞ্চল পেলবতাময় আকর্ষণীয় হওয়া চাই। আমাদের পরম সৌভাগ্য যে, আমাদের শিশুসাহিত্য অনেকটাই এ রকম। স্বাধীনতা-পূর্ব সময় থেকেই আমাদের জাতীয় চেতনায় উজ্জীবিত জীবনমুখী আধুনিক শিশুসাহিত্য বিকাশের পর্বটি সূচিত হয়েছিল। যাদের হাতে এ পর্বের সূচনা তাদের মধ্যে অন্যতম আখতার হুসেন (১৯৪৫)।

আখতার হুসেন লেখালেখি শুরু করেছিলেন গত শতকের ষাটের দশকের প্রথম ভাগে। সেই যে শুরু আর পেছন ফিরে তাকাননি। লিখে গেছেন নিরলস। গল্প, উপন্যাস, জীবনী, নাটক, ছড়া-কবিতা-গান কী লেখেননি! তবে বেশির ভাগ লেখাই তিনি লিখেছেন ছোটদের জন্য। প্রস্তুতি নিয়েছিলেন বড়দের সাহিত্য করার, বিশেষ করে কথাসাহিত্য। জীবনের টানাপোড়েনে তা আর হয়ে ওঠেনি। হয়ে গেলেন ছোটদের লেখক। তাঁর সারা জীবনের পঠনপাঠন, মেধা, অনুধাবন, উপলব্ধি, অভিজ্ঞতা সব তিনি নিংড়ে দিয়েছেন ছোটদের লেখায়। ছোটদের লেখাও যে বিশেষ ধরনের মনন ও শিল্পগুণ সমৃদ্ধ হয়ে উন্নত ও অগ্রসর সাহিত্যের পর্যায়ভুক্ত হতে পারে আখতার হুসেনের প্রতিটি লেখা সেই সত্যকে তুলে ধরে, তা তিনি গদ্য-পদ্য যা-ই লিখুন না কেন।

প্রথম জীবনে আখতার হুসেন প্রচুর লিখেছেন হাস্যরসাত্মক ও ব্যঙ্গ-বিদ্রুপাত্মক ছড়া। এর মধ্যে তাঁর সমাজ সচেতনতামূলক বক্তব্যধর্মী ছড়ার কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান ও অসহযোগ আন্দোলনের সময় তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে ছড়াকারদের সোচ্চার ভূমিকার কথা সবারই জানা। যাদের ছড়া পশ্চিমা শাসকচক্রের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল তাদের শীর্ষে ছিলেন আখতার হুসেন। কিন্তু তাঁর প্রথম প্রকাশিত বইটি গল্পের। ১৯৭০ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ সমুদ্র অনেক বড়। বইটি সে সময় ইউনাইটেড ব্যাংক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিল।

আখতার হুসেনের লেখক চারিত্র্য সমসাময়িক অন্য লেখকদের চেয়ে নিঃসন্দেহে স্বতন্ত্র। তাঁর সমসাময়িক লেখক কারা ? আত্মপ্রকাশের সময় বিবেচনায় অনেকের মধ্যে ছিলেন মাহমুদউল্লাহ, শাহরিয়ার কবির, মুনতাসীর মামুন, আলী ইমাম প্রমুখ। এঁদের প্রত্যেকেরই লেখালেখির নিজস্ব পরিমণ্ডল আছে। এতজন খ্যাতিমান সমসাময়িক লেখকের মাঝেও আখতার হুসেন স্বমহিমায় উজ্জ্বল। তাঁর বিশেষ কৃতিত্ব হলো, তিনি শিশুসাহিত্যের সব শাখায় সমান দক্ষতায় বিচরণ করেছেন। গদ্য-পদ্য সব ক্ষেত্রে তিনি নিজস্ব একটি শৈলী তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। গল্প রচনার ক্ষেত্রে তাঁর আদর্শ অস্কার ওয়াইল্ড এবং হান্স অ্যান্ডারসেন। রূপকথাধর্মী প্রতীকী গল্প রচনায় তাঁর জুড়ি মেলা ভার। তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রকাশিত গল্প গ্রন্থগুলো হলো―সমুদ্র অনেক বড়, রামধনুকের সাঁকো, দি টাইগার ও অন্যান্য গল্প, আয় আয়। ফ্রিডম ফাইটার তাঁর একটি পাঠকনন্দিত কিশোর উপন্যাস। ছড়ার বইগুলো হলো, হালচাল, উল্টাপাল্টা ইত্যাদি।

ছোটদের কবিতাচর্চায় তিনি যেন আরও বহুমুখী প্রতিভাচারণায় উদ্দীপিত। সাধারণ কবিতা যেমন লিখেছেন তেমনি তার পাশাপাশি লিখেছেন পুরাণ ও ইতিহাস আশ্রয়ী কাহিনিমূলক কবিতা ও উপদেশমূলক কবিতা। গত চল্লিশ বছরের অধিক কাল ধরে বাংলাদেশে কিশোর কবিতার যে প্রাবল্য সুস্পষ্টভাবে লক্ষণীয় তার অন্যতম অগ্রপথিক আখতার হুসেন। নিজে সক্রিয়ভাবে যেমন চমকপ্রদ বিচিত্র বিষয়ে অসামান্য আবেগঘন সব কিশোর কবিতা লিখেছেন তেমনি কিশোর কবিতার ধারাটি সুসংহত করার লক্ষ্যে উত্তর প্রজন্মের কবি-কর্মীদের উৎসাহ যুগিয়েছেন নিয়মিত। ঢাকার বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে সম্পাদনা করেছেন এ ধারার বেশ কয়েকটি বই। যেমন : বাংলা সাহিত্যের সেরা কাহিনিভিত্তিক উপদেশমূলক কবিতা, বাংলা সাহিত্যের সেরা কিশোর কবিতা, বাংলা সাহিত্যের সেরা দেশপ্রেমের কবিতা। সুজন বড়ুয়ার সঙ্গে যৌথভাবে সম্পাদনা করেছেন ছোটদের প্রিয় কবিতা এবং সুজন বড়ুয়া ও রহীম শাহর সঙ্গে যৌথভাবে সম্পাদনা করেছেন বাংলাদেশের বাছাই কিশোর কবিতা। এসব সংকলনগ্রন্থ বাংলাদেশে কিশোর কবিতা চর্চার ধারাটিকে বেগবান করেছে। কিশোর কবিতা এখন স্বতন্ত্র সাহিত্যধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।

শিশুসাহিত্যের সব শাখায় দক্ষতার সঙ্গে বিচরণ করলেও আখতার হুসেন সৃজনশীলতার চূড়ান্ত প্রতিফলন ঘটিয়েছেন কিশোর কবিতা চর্চায়। সংখ্যায় তাঁর প্রকাশিত বই হয়তো বেশি নয় তবু তার সেরা কাজ এ মাধ্যমে। কিশোর কবিতার বইগুলোর নাম প্রজাপতি ও প্রজাপতি, আমার দুটো ডানা, ও হাওয়া ও হাওয়া, সেই যে আমার প্রাণের মিতে নদী, সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি, কাজে হব বড়। তাঁর সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি শিরোনামে উপদেশমূলক কবিতাগ্রন্থ এবং কাজে বড় হব শিরোনামে উপদেশমূলক কাহিনি কবিতাগ্রন্থ দুটি বংলা কাব্যসাহিত্যে অত্যন্ত মূল্যবান সংযোজন। তাঁর কাব্যগ্রন্থ দুটি গত শতকের চল্লিশের দশক থেকে বিস্মৃতপ্রায় উপদেশমূলক কবিতা রচনার ধারাটির পুনরুজ্জীবনে সমসাময়িক লেখকদের নিঃসন্দেহে উদ্বুদ্ধ করবে। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে তাঁর একটি নতুন বই, মেলা মানেই অবাধ স্বাধীনতা।

আমাদের আজকের প্রধান আলোচ্য বিষয় আখতার হুসেনের সর্বশেষ প্রকাশিত কিশোর কবিতাগ্রন্থ মেলা মানেই অবাধ স্বাধীনতা। বিশটি কবিতা স্থান পেয়েছে এ গ্রন্থে। বিশটি কবিতার মধ্যে সবচেয়ে ছোট কবিতাটি ষোলো পঙক্তির। বাকি কবিতাগুলো আকারে বেশ দীর্ঘ। সেদিক থেকে মোটামুটি হৃষ্টপুষ্ট গ্রন্থ মেলা মানেই অবাধ স্বাধীনতা। গ্রন্থটির সূচিপত্রে চোখ বুলালেই মনে হবে আখতার হুসেন বিষয়-বৈচিত্র্যের মেলা বসিয়েছেন এখানে। বই, জাতির পিতা শেখ মুজিব, কবি নজরুল, মেলা, মা, বাবা, আকাশ, নববর্ষ, সওদাগর, কম্পিউটার, লাল নীল শাদা ঘুড়ি, জোনাকি, কালো মেঘ শাদা মেঘ, জ্যৈষ্ঠ, হ্যামিলনের বাঁশিঅলা, ছোট পাখি, বাতিঘর, ঝড় ইত্যাদি বিষয়-অনুষঙ্গ নিয়ে মূলত এসব গ্রন্থের কবিতা। সব কটি কবিতাই বর্ণনাধর্মী। বর্ণনাধর্মিতা আখতার হুসেনের প্রিয় কাব্যকৌশল। কবিতার ইমারত গড়ার জন্য মূল যে বিষয়টি তিনি অবলম্বন করেন তার আনুষঙ্গিক সব কাঁচামাল অক্লেশে নিয়ে তিনি হাজির হন সেখানে। বোঝাই যায় এটি খুব অনায়াসসাধ্য কাজ তাঁর জন্য। বিষয়োপযোগী উপমা চিত্রকল্প সহযোগে জুতসই শব্দ চয়নে প্রাণবন্ত বর্ণনায় তিনি যেমন সাবলীল তেমনি তিনি যথাযথ ছন্দ-অন্ত্যমিল বুননেও অত্যন্ত স্বতঃস্ফূর্ত। তাই কবিতাগুলো দীর্ঘ হলেও তেমন ক্লান্তিকর মনে হয় না। সুখপাঠ্য কাব্য রসনায় মন ভরিয়ে দেয় তার কবিতা।   

বইয়ের দু-একটি কবিতার বিষয় ও গঠন-কৌশল নিয়ে এবার কিঞ্চিৎ আলোকপাত করতে পারি আমরা। বইয়ের নাম কবিতা মেলা মানেই অবাধ স্বাধীনতা। এ কবিতার কিশোরটি মামার সঙ্গে মেলায় ঘুরতে গিয়ে হারিয়ে যায়। তারপর সে একা ঘুরে ঘুরে মেলার সব মজার মজার দৃশ্য উপভোগ করতে থাকে। কবির ভাষায় :

মেলায় গেলে মাথার কি ঠিক থাকে!

এ নয়তো ও আমাকে ডাকে

চোখ কিংবা হাতের ইশারায়―

আয় না রে তুই আমার কাছে আয়।

ভালুকের নাচ, নাগরদোলা, ম্যাজিকঅলা, বাউলের দল, মিঠাইঅলা, হরবোলা, বায়স্কোপ, মাটির পুতুল, টাটকা পাঁপড় ভাজা, ঝুমঝুমি, বেলুন, লাটাই ঘুড়ি ইত্যাদি ঝলমলে আকর্ষণে থই হারিয়ে বেভুল ঘুরতে থাকে কিশোরটি। শেষে মামা তাকে খুঁজে পেয়ে রাগ করলে কবিতার কিশোরটি বলে :

বলি তাকে―না হারিয়ে গেলে

মেলার স্বাদ কি খুব সহজে মেলে ?

মেলা তো নয় খাঁচার আবদ্ধতা

মেলা মানেই অবাধ স্বাধীনতা।

‘আকাশের সঙ্গে কথা’ কবিতার বিষয় উপস্থাপনটা এবার দেখা যাক। আকাশকে কবি এখানে তুলে এনেছেন বিভিন্ন লাগসই উপমা তুলনায় ছবির মতো করে। কবিতার কিশোরটি আকাশকে ডেকে বলছে :

তুমি কি আমার মতো দুষ্টু দামাল ছেলে

নাকি খুব শান্ত ছেলে

সারাক্ষণ বইয়ের ওপর গম্ভীর চোখটি মেলে

অক্ষর কেবল গেলো ?

মনে তো হয় না আমার

যদি বই-পোকাই হবে তাহলে কেনই তবে

সারাদিন-রাত্রি জুড়ে 

আঁকবে এতই ছবি ?

মনে হয়, ঠিক ধরেছি তুমি হয় আঁকিয়ে বড়

নয়তো মস্তো কবি। অথবা দুটো তুমি

ব্যস্ত দুইয়ের কাজে

তোমার ওই মনের ভেতর দুইয়েরই ঘণ্টা বাজে।

তাই তো কবিতারই ভাবটি রেখায় এঁকে

তোমারই বুকের পটে হাসছ ছড়িয়ে রেখে।

তারপর আকাশকে বলা হচ্ছে, বিরাট ফুলের বাগান আঁকছ, যেখানে পরিরা গান গেয়ে নেচে আত্মহারা হয়। একটু পর সাপের মতো নদী আঁকছ, অথবা অকূল সাগর, আঁকছ মত্ত হাতি, সিংহ, ভয়াল বাঘ, যার গর্জনে আত্মা খাঁচা ছাড়া হয়। এভাবে আছে রাতের আকাশের মনোরম ছবি। লক্ষ তারার মেলা, চাঁদের হাসি ইত্যাদি। কবিতার কিশোরটিও ছবি আঁকে কিন্তু আকাশের রং-বৈচিত্র্যের কাছে সে হার মানে। সবিস্ময়ে সে আকাশের প্রতি প্রশ্ন রাখে :

তোমার ওই বাক্স রঙের খুবই বিরাট আকাশ

না হলে এত্ত যে রং কোথা পাও মাস, বারো মাস ?

কৌতূহলপ্রিয় কিশোর মনের সহজ প্রকাশ এই কবিতা।

মানুষের জীবনে সুদৃঢ বটবৃক্ষের যে নিরাপদ ছায়া, যে নির্ভীক অকম্পিত আলো তার নাম বাবা। এই বাবাকে নিয়ে বইতে আছে চার পৃষ্ঠার একটি কবিতা। সাত মাত্রা মন্দাক্রান্তা ছন্দে লেখা কবিতাটি। শেষ পঙক্তিগুলো এ রকম :

বাবাকে মনে হয় নাবিক যেন তিনি, আমরা দিকহারা

সে এক জাহাজের যাত্রী ভীত-প্রাণ

শঙ্কা ভয়ে তিনি অভয় দেন আর জাহাজখানি তাঁর

কূলের অভিমুখে কেবল নিয়ে যান।

বিজ্ঞানের মহাবিস্ময় কম্পিউটারের সর্বমুখী অগ্রযাত্রা ও বিচিত্র ব্যবহার নিয়েও একটি বেশ দীর্ঘ কবিতা আছে এ বইতে। সে কবিতার কিছু পঙক্তি :

‘আকারে সে ছোট বাক্সের মতো

তার সেই খোপে বিস্ময় কত!

নানা ধরনের ছোট আর বড়

বই অভিধান করা আছে জড়ো।

কত বিষয়ের কত না ভাবের

ঠিক-ঠিকানা নেই সে সবের

যেন রস বিশাল এক পাঠাগার

মহাজাদুকর কম্পিউটার।’

‘ও কালো মেঘ ও শাদা মেঘ’ কবিতাটি আকাশে দুরকম মেঘের দ্বন্দ্ব সংঘাতে প্রকৃতির ওপর বিরূপ প্রভাবের নিপুণ চিত্র। রূপক অর্থে এটি শাদা কালো বর্ণ-বৈষম্যের প্রেক্ষাপটে বিশ্বব্যাপী শান্তি সম্প্রীতি আবাহনের কবিতা।

‘তোমার মতোই আমি’ কবিতাটির উপজীব্য মা-ছেলের চিরন্তন ভালোবাসাময় খুনসুটি। দুরন্ত ছেলেকে সবরকম দুষ্টুমি থেকে আগলে রাখার জন্য দুপুরে ঘুম পাড়াতে চায় মা। কিন্তু ছেলে মাকে ঘুম পাড়িয়ে উঠে চলে যায় বাইরে। বাগানের গাছের ডালপালা ঝাঁকিয়ে, সাঁতার কেটে পুকুরের শান্ত বুকে ঢেউ জাগিয়ে নিঝুম দুপুরের নীরবতা ভাঙায়। মা রেগে গিয়ে ছেলের এমন দুষ্টুমির কারণ জানতে চাইলে ছেলে যুক্তি দেখায়, আমি খেলাধুলা না করে চুপচাপ ঘরে বসে থাকলে মা তুমি বলো, তোমার কিছু ভালো লাগে না, তুমি আমাকে হাসাবার চেষ্টা করো, তেমনি গাছপালা পুকুর প্রকৃতি চুপচাপ থাকলে আমারও কিছু ভালো লাগে না। তাই আমি তোমার মতোই প্রকৃতির নীরবতা ভাঙাই। ছেলেদের বুদ্ধিদীপ্ত দুরন্তপনার এক বাস্তব প্রকাশ এটি। এই কবিতার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এতে ছন্দ আছে, অন্ত্যমিল নেই। যেমন :

তোমার মতো আমিও মাগো নিথর কোনও কিছু

দেখতে পেয়ে থির থাকতে একটু পারি নাকো।

তাইতো আমি গাছের থেকে গাছের পরে উঠে

নাচিয়ে দিই ডাল ও পালা; নিথর জলে জলে―

সাঁতার কেটে ছন্দ তুলি হাওয়ার মতো করে।

একইভাবে ‘ও জোনাকি’ কবিতাটিতেও ছন্দ আছে কিন্তু নির্দিষ্ট দূরত্বে নির্ধারিত অন্ত্যমিল নেই। এমনি নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার ছাপ স্পষ্ট কবিতাগুলোতে। হয় ছন্দ প্রয়োগ, নয়তো পঙক্তি-পর্ব বিন্যাস, অথবা বিষয় ভাবনার বৈচিত্র্য কিংবা প্রকাশ নৈপুণ্য কোনও না কোনও নতুনত্বের স্বাদ আছে। এই ধারায় ‘বই আমার বই’, ‘আজ বছরের শুরু’, ‘হব না কখনও তেমন সওদাগর’, ‘আমরা সবাই লাল, নীল, শাদা ঘুড়ি’, ‘জ্যৈষ্ঠ তুমি’, ‘পাখিটা ছোট তবু’, ‘সবার মতো’, ‘তুমি হও বাতিঘর’, ‘আয়রে জলদি ঝড়’ ইত্যাদি কবিতা উল্লেখযোগ্য। শুভ সম্প্রীতি ও কল্যাণের বাণী সমৃদ্ধ এসব কবিতা। বিখ্যাত জার্মান কাহিনি হ্যামিলনের বাঁশিঅলার ভাবার্থের রূপান্তর করে লেখা হয়েছে একটি সুন্দর কবিতা। জুলুমবাজ ইঁদুররূপী মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের বিনাশের জন্য এ কবিতায় আহ্বান করা হয়েছে হ্যামিলনের বাঁশিঅলাকে।

বইয়ের ব্যতিক্রমধর্মী কবিতা হিসেবে আমি শনাক্ত করতে চাই ‘মা’ কবিতাটিকে। আদর্শচ্যুত হয়ে ধ্বংসাত্মক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়া ছেলের জন্য মায়ের উদ্বেগময় আকুলতা কবিতাটির বিষয়বস্তু। সন্তানের প্রতি মায়ের স্নেহ-মমতা-ভালোবাসা সবসময় অকৃত্রিম ও পবিত্র। সন্তান যতই বিপথে যাক মায়ের কাছে তার মর্যাদা কখনও ক্ষুণ্ন হয় না।  সন্তান সবসময় মায়ের কাছে সাত রাজার ধন, তা সে পুত্র সন্তান বা কন্যা সন্তান হোক। নষ্টভ্রষ্ট পুত্র সন্তানের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে মায়ের করুণ আর্তি ও জীবন যাপন নিয়ে বয়স্কজন পাঠ্য কবিতা হয়ে থাকতে পারে কিন্তু কিশোর কবিতা সম্ভবত এই প্রথম। কিশোর কবিতার বিষয় হিসেবে হয়তো এটি কিছুটা নেতিবাচক তবু উপস্থাপনার গুণে কবিতাটি হৃদয় ছুঁয়ে যায়।

আখতার হুসেনের মেলা মানেই অবাধ স্বাধীনতা বইতে যেমন শিশুমনস্তত্ত্ব-নির্ভর কৌতূহলোদ্দীপক বিষয়-অনুষঙ্গ রয়েছে তেমনি প্রায় দার্শনিকতাপূর্ণ গুরু-গম্ভীর অনেক ভাবনা-বিষয়ও এখানে উঠে এসেছে। বইটি পড়তে পড়তে মনে হয়েছে কিশোর কবিতাকে আধুনিক ও বড়দের কবিতার মতো বহুমুখী করে তুলতে গিয়ে আমরা কখনও কখনও অতি মাত্রায় স্বাধীনতা নিচ্ছি, কিশোরের জীবন-জগৎ, ভাবনার চৌহদ্দি ও কৈশোরের সীমানা ছাড়িয়ে যাচ্ছি। এমনিতেই শিশুসাহিত্য সম্পর্কে বড় অভিযোগ হলো, শিশুসাহিত্যে শিশু-কিশোর মন-মানসের চেয়ে বয়স্ক দৃষ্টিকোণ বেশি প্রাধান্য পায়। কিশোর কবিতায়ও কি বয়স্ক দৃষ্টিকোণ বেশি প্রকাশ পাচ্ছে না ? কখনও কখনও কিশোর কবিতার বিষয়-অনুষঙ্গ ঠিক কিশোরের নিজস্ব মনে হয় না, মনে হয় আরোপিত ও কষ্টকল্পিত। আমরা যারা কিশোর কবিতাকর্মী তারা যেন বিষয়টার প্রতি সচেতন হই। আমরা যেন সৃষ্টিসুখের উল্লাসে বর্ণনার রেলগাড়ি রচনা না করি। আমাদের মূল উদ্দিষ্ট পাঠক কারা, তাদের ধৈর্যের সীমা, গ্রহণ ক্ষমতা ইত্যাদি যেন বিস্মৃত না হই। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অগ্রগতির কল্যাণে বর্তমান যুগের শিশু-কিশোরদের আমরা যতই বুদ্ধিদীপ্ত ও পরিপক্ব প্রজন্ম মনে করি না কেন তবু কবিতা, বিশেষ করে কিশোর কবিতার শর্ত ও সীমাবদ্ধতা আছে। আমরা যেন সে দিকটাও মনে রাখি।

মেলা মানেই অবাধ স্বাধীনতা বইটির কবিতাগুলো আখতার হুসেন লিখেছেন বেশ কবছর আগে। বিলম্বে হলেও এমন একটি বই প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণের জন্য আখতার হুসেনকে অভিনন্দন। বইটির সুন্দর প্রচ্ছদ ও ছবি এঁকেছেন দেবব্রত ঘোষ। অঙ্গসৌষ্ঠব ও প্রকাশনা মান বেশ দৃষ্টিনন্দন। প্রকাশক চন্দ্রাবতী একাডেমি। বইটি প্রকাশের জন্য চন্দ্রাবতী একাডেমি ধন্যবাদার্হ। আমি বইটির বহুল প্রচার কামনা করি। কবি আখতার হুসেনের সাফল্যের মুকুটে আরও নতুন পালক যুক্ত হোক।

 লেখক : শিশুসাহিত্যিক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button