আর্কাইভগল্প

চাকরি : আখতার হুসেন

আবার পড়ি : আখতার হুসেনের কিশোরগল্প

‘আমার এখন একটা চাকরির দরকার’―কোকিলটা মনে মনে বিড়বিড় করতে লাগল। ‘আমি আমার মনের মতো একটা চাকরি চাই।’

এসব ভাবতে ভাবতে সে উড়তে লাগল। উড়তে উড়তে এসে নামল এক চাষির বাড়ির উঠানে। চাষিটা তখন গালে হাত দিয়ে কী যেন ভাবছিল। কোকিলটা তার কাছে এগিয়ে গেল এবং ভয়ে ভয়ে মুখ খুলল, ‘দয়া করে আমার একটা কথা শুনবে ?’ চাষিটা সংবিৎ ফিরে পেল কোকিলটার কথায় এবং গাল থেকে হাত নামিয়ে তার মুখের দিকে চাইল, ‘তোমার যা বলবার, নির্ভয়ে বলতে পারো।’

‘আমি খুব অসুবিধায় আছি,’ কোকিলটা বলতে লাগল। ‘বেকার ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে। তুমি কি আমাকে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে পারো ? আমি ভালো গাইতে পারি। তোমাকে প্রাণভরে গান শোনাব।’

‘চাকরি,’ ঠোঁটের কোণে ম্লান হাসি টেনে চাষিটা নিঃশ্বাস নিল এবং কপালের ঘাম মুছতে লাগল। ‘আমার অবস্থা তোমার চেয়েও খারাপ, ভাই। এবারের বন্যায় আমার সব ফসল ভেসে গেছে। খাজনা পরিশোধ করতে না পারায় আমার এই মাথা গুঁজবার কুঁড়েঘরটাও আগামীকাল নিলাম হয়ে যাবে। আমি নিজেই কোথায় গিয়ে দাঁড়াব, তাই ভাবছি। তুমি বরং গাঁয়ের মোড়লের বাড়ি যাও।’

বেচারা চাষির কথায় কোকিলটার ভীষণ দুঃখ হলো। একবার ইচ্ছে হলো, ওর সুখ-দুখের সাথি হয়ে থেকে যেতে। কিন্তু কী ভেবে আবার বাতাসে পাখা মেলে দিল। উড়তে উড়তে এসে নামল গাঁয়ের মোড়লের বাড়ির উঠানে।

গাঁয়ের মোড়ল তখন লোকজন নিয়ে কীসের যেন বিচার করছিল। কোকিলটা তার মুখোমুখি হতেই সে কিছুটা অবাক হলো এবং এমনভাবে চোখ দুটো গোল গোল করে পাকাল, যেন তাকে এক্ষুনি আস্ত গিলে খাবে―‘কী চাও হে বাপু, মনে হচ্ছে যেন কিছু বলতে এসেছ ?’

‘জি আজ্ঞে’―কোকিলটা থতমত খেয়ে আমতা আমতা করতে লাগল। ‘মানে, আমি বলতে চাই…।’

‘বলে ফেল, বলে ফেল, যা বলবার তাড়াতাড়ি বলে ফেল। আমার সময়ের বড় অভাব’―মোড়ল একরাশ বিরক্তি প্রকাশ করে নাকে এক টিপ নস্যি পুরে দিল। ‘আমাকে আবার এক্ষুনি ভিনগাঁয়ে যেতে হবে। বুঝেছ, গাঁয়ের মামলা-মোকদ্দমা নিয়ে আমি ভারি ব্যস্ত এখন।’

‘আজ্ঞে, আপনি যে ব্যস্ত, সে তো দেখতেই পাচ্ছি,’ কোকিলটা বলতে লাগল। ‘আপনি যদি দয়া করে আমাকে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেন তবে বড় উপকার হয়। আমি ভালো গান গাইতে পারি। আপনি ইচ্ছে করলে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন।’

‘পরীক্ষা করে কী দেখব হে!’ মোড়ল এবার যেন তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল। ‘গান কোনও মানুষ শোনে নাকি ? তুমি এবার যেতে পারো। ওসব গানটান আমার এতটুকু পছন্দ নয়! টাকাপয়সা আর জমিজমার হিসেব ছাড়া আমি কিচ্ছু বুঝিনে। যাও, এখান থেকে এক্ষুনি সরে যাও বলছি!’

মনের দুখে কোকিলটা মোড়লবাড়ির উঠোন ছেড়ে একটা উঁচু বটগাছের নির্জন ডালে এসে বসল। বসে ভাবতে লাগল, ‘আমি একটা চাকরি চাই। আমার মনের মতো একটা চাকরি। এখন, এই মুহূর্তে কেউ যদি এসে আমাকে বলত―চল, তোমাকে একটা কাজ দেব, আর সে কাজ হচ্ছে কেবল গান গাইবার কাজ, গান ছাড়া আর কিছু নয়, তাহলে কী যে ভালো হতো! পৃথিবীতে এর চেয়ে সুখের ব্যাপার আর কিছুই হয় না।’ একটু দম নিল সে। তারপর আবার ভেবে চলল―‘নিশ্চয়ই, কেউ না কেউ, আমি যেমনটি চাই, তেমন চাকরি দেবেই। কিন্তু এভাবে বসে থাকলে তো চলবে না। চাকরি আমাকে খুঁজে বের করতেই হবে!’

ভাবনা শেষে কোকিলটা উড়ে চলল শহরের দিকে। উড়তে উড়তে সে শহরের একটা বিরাট পাঁচতলা দালান-বাড়ির খোলা জানলার কার্নিশে এসে পা রাখল। ‘এত বড় বাড়ির মালিক নিশ্চয়ই একজন হোমরাচোমরা কেউ হবেন,’ কোকিলটা ভাবতে লাগল। ‘বড়লোকেরা সাধারণত গানের কদর করে থাকেন। আমার কেবলি মনে হচ্ছে, এখান থেকে আমাকে আর খালি হাতে ফিরে যেতে হবে না।’

‘কে রে ওখানে ?’

হঠাৎ কোকিলটার ধ্যান ভাঙল। দেখল, একজন স্যুটটাই পরা বিরাট ভুঁড়িঅলা লোক তার দিকে এগিয়ে আসছে। লোকটাকে দেখে সে একটু ভয় পেয়ে গেল। গলাটা শুকিয়ে এল। ঠোঁট জোড়া কাঁপতে লাগল, ‘জি আজ্ঞে আমি, মানে…।’

‘জি আজ্ঞে আমি! আমিটা কে ?’ লোকটা তার চোখ জোড়া গোল গোল করে পাকাল, ‘কী চাও তুমি ?’

‘আজ্ঞে, দেখতেই পাচ্ছেন, আমি একটা কোকিল পাখি। ভালো গান গাইতে পারি। এ ছাড়া আমি আর কিচ্ছু পারি নে। আমাকে একটা কাজ দেবেন। আমি আপনাকে গান শোনাব।’

বিরাট ভুঁড়িঅলা লোকটা এবার কোকিলটার কথায় হো হো করে হেসে উঠল, ‘গান শোনাবে! তুমি কী গান শোনাবে হে! আমার ঘরে চার-চারটে রেডিও-টেলিভিশন সেট আছে, রেকর্ড-প্লেয়ার আছে দু-দুটো। এর পরও তুমি গান শোনাতে চাও ?’

‘জি আজ্ঞে, আপনি আমাকে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন আমি কেমন গান গাই,’ কোকিলটা সাহসে ভর করে বলল। ‘আমি নিশ্চয়ই আপনাকে সন্তুষ্ট করতে পারব ?’

‘ঘ্যানঘ্যানানি বন্ধ করো তো, বাপু’―ভ্রু কোঁচকালো বিরাট ভুঁড়িঅলা লোকটা। ‘তুমি চাকরি চাইছ, চাকরি দেওয়া যেতে পারে।’

‘চাকরি দেবেন আমাকে, চাকরি দেবেন,’ মুহূর্তে খুশিতে ডগমগিয়ে উঠল কোকিল পাখিটা। ‘আপনাকে কী বলে যে ধন্যবাদ জানাব, ভেবে পাচ্ছি নে।’

‘হ্যাঁ, তুমি পেতে পারো, তবে গান গাইবার চাকরি নয়,’ ভুঁড়িঅলা লোকটা পায়চারি করতে লাগল ঘরময়।

‘তাহলে কীসের চাকরি’―কোকিলটা অবাক হয়ে প্রশ্ন করল।

‘আমার বাড়ির সিঁড়িটা দেখেছ ? সেই সিঁড়ি বেয়ে পাঁচতলায় একবার উঠবে আর নামবে। দিনে তোমাকে বারো ঘণ্টা এ কাজ করতে হবে। আর এই হলো তোমার চাকরি। খাওয়া-দাওয়ার জন্যে তুমি চিন্তা কোরো না। এত খাবার পাবে যে খেতে না পেরে বাড়তি খাবার তোমাকে ফেলে দিতে হবে। রাজি আছ ?’ এক দমে কথাগুলো শেষ করল ভুঁড়িঅলা লোকটা।

লোকটার কথা শুনে কোকিলটা ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেল। একবার ইচ্ছে হলো, লোকটার চোখ-মুখ তার ঠোঁটের ঘায়ে ক্ষত-বিক্ষত করে দিতে। কিন্তু পেটে এত খিদে ছিল লোকটার শেষের কথাগুলো তার বেশ ভালো লেগে গেল। তার মনে হলো, সিঁড়ি থেকে ওঠানামার চাকরি ছেড়ে দিলে আর কোত্থাও সে চাকরি খুঁজে পাবে না।

‘কি হে, চাকরি করবে কি না, পষ্ট জবাব দাও আমাকে,’ লোকটা জিগ্যেস করল আবার। ‘আর না হলে এক্ষুনি আমার সামনে থেকে চলে যাও।’

‘জি হ্যাঁ, আমি চাকরি করব’―জবাব দিল কোকিল পাখিটা। ‘আমি চাকরি করব।’

‘তাহলে লেগে যাও’ বলেই পাশের ঘরে চলে গেল বিরাট ভুঁড়িঅলা লোকটা।

এরপর শুরু হলো কোকিল পাখিটার চাকুরে জীবন। ভোর ছটায় দুটো ছোলাদানা পেটে পুরে সেই যে সিঁড়িতে পা রাখতে হয়, একটানা একতলা থেকে পাঁচতলা, পাঁচতলা থেকে আবার একতলায় ওঠানামা করে সন্ধে ছটায় ছুটি। অবশ্য মাঝখানে দুপুরে একবার আধঘণ্টার জন্যে ছুটি পায় কিন্তু তাতে জিরোনো চলে না। খাবার খেতে খেতেই সময় চলে যায়। সন্ধে ঘনাবার সঙ্গে সঙ্গে ওর চোখ দুটো ক্লান্তিতে মুদে আসে। গান গাইবার অবসর কোথায় কোকিল পাখিটার!

এমনি করে অনেক দিন পেরিয়ে গেল।

একদিন ওর ইচ্ছে হলো পাঁচতলার ছাদের ওপর বেড়াতে যাওয়ার। অনেক দিন সে এই ঘরের চত্বর ছেড়ে বাইরে যায়নি। বড় একঘেয়ে লাগছে।

পাঁচতলার ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে কোকিলটা আকাশের দিকে চোখ মেলে দিল। কী নিঃসীম নীল আকাশ! ইচ্ছে হলো একবার বাতাসে ডানা মেলে দিতে! উড়ে যেতে দূরে, অনেক দূরে। অবশেষে সে পাখা মেলে দিল বাতাসে কিন্তু উড়তে পারল না। সারাটা শরীর অবশ আর বড় ক্লান্ত মনে হলো। উড়বার মতো এতটুকু শক্তি তার নেই। এই মুহূর্তে তার ডানা আর অসহায় চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে মনে হলো, যেন সে কোনও দিন উড়তে জানত না। চোখ ছাপিয়ে তার জল এল।

‘আরে, তুমি এখানে ? সেই কত দিন পর দেখা!’ কোকিল পাখিটা সংবিৎ ফিরে পেল তার অনেক দিনের পুরোনো এক সঙ্গী বন্ধুর কণ্ঠস্বরে। ‘এখানে একলা একলা তুমি কী করছ ?’

‘না, মানে আমি এখানেই থাকি,’ কোকিলটা আমতা আমতা করতে লাগল। ‘তুমি এখন কোথায় আছ ?’

‘সেই পুরোনো দেবদারু গাছটাতেই’―সঙ্গী বন্ধুটি বলতে লাগল। ‘তুমি চলে আসার পর থেকে আমি বড় নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছি। কেউ নেই যে আমাকে গান শোনাবে। কত দিন তোমার গান শুনি না। আজ তুমি আমাকে গান শোনাবে ?’

‘শোনাব,’ কোকিলটা বলল। ‘প্রাণভরে তোমাকে গান শোনাব।’

কথা শেষ করেই কোকিল পাখি তার পুরোনো সঙ্গী বন্ধুকে গান শোনানোর জন্যে ঠোঁট জোড়া ফাঁক করল। গান গাইবার চেষ্টা করতে লাগল। চেষ্টা করতে লাগল বারবার। কিন্তু একি! তার কণ্ঠ চিরে সুরেলা গানের বদলে খসখসে বিদ্ঘুটে শব্দ আর রক্ত বেরোচ্ছে কেন ? টাটকা লাল রক্ত!

সঙ্গী বন্ধুটি তখন গায়ক কোকিল পাখিটার রক্তাক্ত ঠোঁটের দিকে বোবাদৃষ্টিতে চেয়ে আছে। চোখে তার জল।

সচিত্রকরণ : ধ্রুব এষ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button