আর্কাইভপ্রচ্ছদ রচনা

সমুদ্র অনেক বড় : কল্পনার মিশ্রণে রচিত একটি অনবদ্য শিশুতোষ গল্পগ্রন্থ : মোজাম্মেল হক নিয়োগী

আখতার হুসেনের সাহিত্যকর্ম : আলোচনা

আখতার হুসেন বিশিষ্ট শিশুসাহিত্যিক হিসেবে বাংলাদেশে অতি সুপরিচিত নাম এবং খ্যাতির শীর্ষে অবস্থান করছেন। শিশুসাহিত্যের ছড়া ও কবিতা তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি থাকলেও শিশুতোষ গল্প নির্মাণেও তিনি সিদ্ধহস্ত। খ্যাতিমান এই শিশুসাহিত্যিক নাটোর জেলার লালপুর উপজেলার নুরুল্লাপুর গ্রামে ১৯৪৫ সালের ১ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। শিশুসাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি অগ্রণী ব্যাংক শিশু একাডেমি এবং ২০১২ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার অর্জন করেন।  

               সমুদ্র অনেক বড় শিশুতোষ গল্পগ্রন্থটি লেখকের একটি অনবদ্য সৃষ্টি। মোট পনেরোটি গল্প এই গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। প্রতিটি গল্পই সুলিখিত, সুসম্পাদিত এবং কল্পনার ব্যঞ্জনায় সৃষ্টি হলেও কয়েকটি গল্পের ক্যানভাসে বাস্তবতারও রং রয়েছে। তবে তাঁর গল্পের ক্যানভাসে কল্পনাই শাসক রং হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। কিন্তু তাতে কী ? শিশুসাহিত্যের একটি প্রধান ও মৌলিক বিষয় হওয়া উচিত শিশুদের কল্পনার জগতটি সুবিস্তৃত করা, জাগিয়ে তোলা। কারণ শিশুরা থাকে কল্পনাপ্রবণ এবং সৃজনশীল চিন্তায় নানারকম সৃষ্টির কথা ভাবতে পারে। শিশুদের কল্পনা শক্তি বিকাশের জন্য কল্পনার ব্যঞ্জনায় গল্প সৃষ্টি করা অত্যন্ত কঠিন কাজ যে কাজটি আখতার হোসেন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে প্রাঞ্জল ও সাবলীল ভাষায় উপস্থাপন করেছেন। শিশুসাহিত্যের মাধ্যমে শিশুদের মধ্যে আবেগের সঞ্চরণ প্রয়োজন এবং আবেগের সঞ্চরণ সৃষ্টি হতে পারে কেবল কাল্পনিক ও রূপকথার সাহিত্যের মাধ্যমে। শিশু বিকাশের জন্য, বিশেষ করে তাদের পঠন দক্ষতা (reading skills) বৃদ্ধির জন্য মননশীল চিন্তার (cognitive) চেয়ে আবেগ বা কল্পনাকে (affective or imaginative) জাগ্রত করা বেশি কার্যকর। এ কারণে বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীর শিশুসাহিত্যে বাস্তবতার চেয়ে কাল্পনিক ও রূপকথার সাহিত্যকে প্রাধান্য দেওয়া হয় এবং অবশ্যই প্রাধান্য দেওয়া উচিত। অন্যথায় শিশুদের মনোজগতে সৃজনশীল চিন্তার কোনও প্রভাব পড়বে না। 

               শিশুসাহিত্য নিয়ে আলোচনায় করতে গেলে প্রশ্ন আসতে পারে কোন সাহিত্যকে শিশুসাহিত্য বলব ? এখানে বিষয়টি পরিষ্কার হওয়া দরকার। আমাদের অনেককেই দেখা যায়, ছড়াকারদেরই শিশুসাহিত্যিক হিসেবে আখ্যায়িত করছেন যদিও ছড়া বড়দের উপযোগীও হয়। ছড়া মানেই শিশুসাহিত্য নয় এবং ছড়াকার মানেই শিশুসাহিত্যিকও নন। তবে ছড়া যদি শিশুদের উপযোগী হয় তাহলে নিঃসন্দেহে শিশুসাহিত্য এবং ওই ধরনের ছড়াকারকে শিশুসাহিত্যিক হিসেবে আখ্যা দিলে তা ভুল হওয়ার কথা নয়। কিন্তু এরপরই প্রশ্ন আসে ‘শিশু’ কে বা কারা ? পূর্বে বাংলাদেশে বিভিন্ন আইন দ্বারা বিভিন্ন বয়সের শিশুকে সংজ্ঞায়িত করা হলেও জাতিসংঘের সনদ অনুযায়ী ‘আঠারো বছরের নিচে সব মানব সন্তানই শিশু’―সংজ্ঞাটিই এখন এ দেশের মানুষ গণ্য করে থাকে। তাহলে শিশু কে বা করা এই প্রশ্ন তোলা অবান্তর। এখন প্রশ্ন আসতে পারে তাহলে আঠারো বছর নিচের সব শিশুর জন্য সাহিত্য কি একই ধরনের হবে ? এটিও অবান্তর প্রশ্ন। কারণ তিন বা চার বছরের শিশুর জন্য যে সাহিত্য উপযোগী বারো বছরের শিশুদের জন্য সে সাহিত্য উপযোগী নয়। ইংরেজি সাহিত্যে শিশুদের তিনটি দলে ভাগ করে সাধারণত শিশুসাহিত্য রচিত হয়; যেমন: Early grade children (toddler group), children and adult children। ভারতের দিল্লিতে অবস্থিত Alka Publications-এর শিশুতোষ বইয়ের বয়সভিত্তিক ছয়টি শ্রেণিতে শিশুদের ভাগ করে শিশুতোষ বই প্রকাশ করছে। তারা ৫-৬ বছর, ৬-৭ বছর, ৭-৮ বছর, ৮-৯ বছর, ৯-১০ বছর এবং ১০-১২ বছর বয়সি শিশুদের ছয়টি শ্রেণিতে বিন্যাস করে গল্পের বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠায় গল্পের বইয়ের ধরন (genre) কেমন হবে তা উল্লেখ করেছে। বর্তমান লেখকের অভিজ্ঞতার আলোকে শিশুদের বয়স বিবেচনা করে সাতটি শ্রেণিতে বিন্যাস করে কালান্তরের কয়েকটি গল্পের বইয়ের পেছনের কভারে গল্পের ধরন উল্লেখ করা হয়েছে। পূর্বে আমাদের দেশে এই ধরনের বয়সের শ্রেণিবিভাজন করে শিশুসাহিত্য রচিত না হলেও হালে বয়স বিবেচনা করে অনেক গল্পের বই রচিত হচ্ছে। আলোচনাটি এখানে প্রাসঙ্গিক এজন্য যে, ‘সমুদ্র অনেক বড়’ প্রকৃতপক্ষে কোন বয়সি শিশুদের জন্য উপযোগী গল্প তা বিশ্লেষণ বা জানার জন্য বয়সভিত্তিক শ্রেণি বিন্যাসের অবতারণা করা হলো। কারণ বইটি তৃতীয় শ্রেণির পূর্বে কোনও শিশুর পক্ষে পড়া সম্ভব নয়। বর্তমান লেখকের দৃষ্টিতে ও অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায় এটি চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শিশুদের জন্য উপযোগী বই যেটি ইংরেজিতে শুধু children বলা হয়ে থাকে। তবে বাংলাদেশের সাহিত্যিকদের ভাষায় কিশোর সাহিত্য ইংরেজিতে যাদের adult children বলা হয় তারাও এই গ্রন্থের উপযুক্ত পাঠক। তবে একটি কথা জোর দিয়ে বলা যায় যে, ‘রিডিং ফর চিলড্রেন’ বা ‘শিশুদের জন্য পড়া’ এই ধারণার ভিত্তিতে ছোট শিশুদেরও তাদের যত্নকারীরা পড়ে শোনাতে পারেন। 

               পূর্বেই বলা হয়েছে যে, এই গ্রন্থের গল্প লেখক এমনই কল্পনার ভুবন তৈরি করেছেন যেখানে জড়বস্তু, মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণী প্রধান চরিত্র হিসেবে চিত্রিত হয়েছে। প্রথম গল্পটি পড়েই পাঠক হয়ত বুঝতে পারবেন লেখকের কল্পনার স্তর কতটা উচ্চমানের এবং তিনি শিশুদের মনোজগত পাঠ করার মতো কতটা সক্ষম! শিশুদের মনোজগত পাঠ করতে সক্ষম বলেই তিনি এই গ্রন্থের গল্পগুলোর মধ্যে দিয়েছেন নানামাত্রিক কল্পনার রূপ। যদিও রূপকার্থে কোনও কোনও গল্পে শিক্ষণীয় বিষয়ও অন্তর্নিহিত রয়েছে তথাপি শিশুদের কল্পনার জগত বিস্তৃত করতে অধিকতর প্রভাবক হিসেবে কাজ করবে। প্রথম গল্পটির শিরোনাম করা হয়েছে ‘সাদা ঘুড়ি, কালো ঘুড়ি’। আকাশে উড়তে উড়তে দুটি ঘুড়ির মধ্যে বন্ধুত্ব হয়। কিন্তু এই বন্ধুত্ব থাকেনি কিশোরদের খেলার জন্য। কিশোররা যখনই ঘুড়ির কাটাকাটি খেলা শুরু করল তখন কালো ঘুড়িটা বোঁকাট্টা হয়ে গেল। দুই বন্ধুর বিচ্ছেদ ঘটলে সাদা ঘুড়ি আর্তনাদ করে ডাকতে থাকে কালো ঘুড়িকে। কিন্তু কালো ঘুড়ি জবাব দিতে পারেনি; কোথায় যেন হারিয়ে যায়। গল্পের শেষে পাঠকের মনে বয়ে যায় বিষাদের স্রোত। মনঘর হয়ে যায় হিমঘর। জড় বস্তুর মধ্যে চমৎকার সংলাপ সৃষ্টি করে বন্ধুত্বের একটি ভালো গল্প নির্মাণ করেছেন তিনি। এই গল্পের মধ্য দিয়ে হয়তো পাঠক বুঝতে পারবে যে, বন্ধুত্ব নষ্ট হয় তৃতীয় কোনও শক্তির প্রভাবে। অথবা কোনও কিছু শিখতে না পারলেই বা কী আসে যায় ? গল্পটি তো পাঠককে চমৎকৃত করবে। সব গল্প থেকে কিছু শিখতে হবে এমন কোনও কথাও নেই। ‘পাখিঘুড়ি ও পাতাঘুড়ি’ নামে এ রকম একটি গল্প আছে বর্তমান লেখকের। অবশ্যই এই গল্পে দুটি ঘুড়ির মধ্যে সহযোগিতার মনোভাব ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

               ‘কাঁথামামা, শীতবুড়ি ও একটি মৃত্যু’ গল্পটিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এ দেশের পথমানুষদের শীতের রাতে কষ্টের করুণ ও বাস্তবানুগ চিত্র। শহরের বিভিন্ন পথের পাশেই আমাদের চোখে পড়ে অনেক মানুষ প্রচণ্ড শীতের রাতেও সামান্য কাঁথা-কম্বল গায়ে জড়িয়ে কোনওক্রমে রাত্রিযাপন করে। অনেকেই শীতে মৃত্যুবরণ করে। এখানেও শীতের তাণ্ডবে একটি শিশুর করুণ মৃত্যুতে পাঠকের হৃদয় ভারী হয়ে যায়। তবে লেখক গল্পটিকে নির্মাণ করেছেন জড়বস্তুর যেমন―কাঁথা ও শীতকে চরিত্র হিসেবে চিত্রিত করে। ছেঁড়া কাঁথা ও শীতবুড়ির মধ্যে বিভিন্ন আকর্ষণীয় সংলাপের মাধ্যমে গল্পটি এগিয়ে যায়। শিশুসাহিত্যের এমন মজার গল্প সৃষ্টি করাই হলো তাঁর কৃতিত্ব। মা ছিল অদূরে কোথাও। গভীর রাতে সন্তানের কাছে এসে দেখে সন্তান মৃত। তখন নিজেও শীতের তাণ্ডব সহ্য করতে না পেরে কাঁথাটিতে আগুন লাগিয়ে দিয়ে নিজের শীত নিবারণের চেষ্টা করে। এই গল্পের মাধ্যমে নিম্ন শ্রেণির মানুষের দুঃখ-কষ্ট যেভাবে চিত্রিত হয়েছে তা সত্যি বিস্ময়কর এবং দেশের উচ্চ শ্রেণির মানুষের বিলাসবহুল জীবনের সঙ্গে নিম্ন শ্রেণির মানুষের যে পার্থক্য তা সচেতন পাঠকের বিবেক এড়িয়ে যেতে পারে না। এখানে উল্লেখ্য যে, শীতকে চরিত্র করে শিশুসাহিত্যিক আহমদ রিয়াজেরও একটি চমৎকার গল্প রয়েছে।   

               ‘আতঙ্ক’ গল্পটিতে একটি ষাঁড় বাছুর কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে চিত্রিত হয়েছে। গল্পটির সারকথা হলো একটি ষাঁড় বাছুর একদিন কোথা থেকে ছুটে এসে মানুষকে আক্রমণ করছে। মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়লে পুলিশ এসে তাকে উদ্ধার করে। পুলিশকেও ষাঁড় বাছুরটি ধমকায়। তার অভিযোগ হলো মাঠে ঘাস নেই কেন ? তারপর তাকে আদর যত্ন করে বশে আনা হয় এবং একটি মাঠে নিয়ে যাওয়া হয় যেখানে অনেক ঘাস আছে। ঘাস দেখে খ্যাপাটে ষাঁড় বাছুর শান্ত হয় এবং মনের আনন্দে গান গাইতে থাকে। বাছুরের গান শুনে এলাকাবাসীর আতঙ্ক দূর হয়। লেখক গল্পটিকে বিশ^স্ত করার জন্য তারিখ, এলাকার এবং চরিত্রগুলোর চমৎকার নাম দিয়েছেন যা পড়ে শিশুরা একদিকে আনন্দ উপভোগ করবে আবার অন্যদিকে তারা মাঠ ও ঘাসশূন্য হওয়া আমাদের দেশের বাস্তব অবস্থাও বুঝতে পারবে।

               এই গল্পগ্রন্থের সবচেয়ে বেশি চমক সৃষ্টি করে ‘চাকরি’ শিরোনামের গল্পটি। গল্পটি একদিকে আনন্দদায়ক ব্যঞ্জনা রয়েছে এবং অন্যদিকে চাকরিদাতাদের আচরণ ও চাকরিজীবীদের জীবনের সত্তা হারিয়ে ফেলার একপ্রকার বিষাদের জন্ম দেয়। একটি কোকিলের একদিন চাকরি করার বাসনা জাগে এবং সে চাকরির খোঁজে বের হয়। তার যোগ্যতা হলো সে ভালো গান করতে পারে। বিভিন্ন জনের কাছে চাকরির আবদার করলে তারা তাকে তাড়িয়ে দেয়। কিন্তু দমে যায়নি কোকিল। সে ঘুরতে ঘুরতে এক ধনী বাড়িঅলার সঙ্গে দেখা করে চাকরির প্রার্থনা করলে ধনী লোকটি তাকে চাকরি দেয়। তবে চাকরিটি গান গাওয়ার নয়। কোকিলের কাজ হলো সকাল থেকে সন্ধ্যা অব্দি ওই বাড়ির সিঁড়িতে ওঠা-নামা করবে। সে চাকরি নিল এবং প্রতিদিনই সিঁড়ি বেয়ে ওঠা-নামা করতে থাকে। একদিন বনের এক পাখির সঙ্গে দেখা হলে পাখিটি তাকে বলল, ‘বন্ধু তুমি তো খুব ভালো গান গাইতে। একটি গান গেয়ে শোনাও।’ কিন্তু কোকিলটি অনেক চেষ্টা করেও গান গাইতে পারেনি। সে গান ভুলে গেছে। এই গল্প থেকে আমরা এই শিক্ষা পাই যে, চাকরি করলে নিজের সত্তা ও প্রতিভাকে বিকিয়ে দিতে হয়। চাকরিজীবনের পর নিজস্বতা বলতে কিছু থাকে না। ‘তিতি’ গল্পটিতেও খাঁচায় বন্দি এক পাখির করুণ চিত্র চিত্রিত হয়েছে এবং এই গল্পেও ময়না পাখির আপন সত্তা হারিয়ে ফেলার বেদনা পাঠককেও সিক্ত করে।

               ‘দুনম্বর ডাউন ট্রেন’ আরেকটি মজার গল্প। এটি মনে হয় শিশুদের দারুণ আনন্দ দেবে। এই গল্পে লেখক ট্রেনের ইঞ্জিনকে প্রধান চরিত্র হিসেবে চিত্রিত করেছেন। একটি স্টেশনে এসে ইঞ্জিন চলতে চায় না। সে অভিমান করে বসে আছে। ট্রেনের ড্রাইভার ও গার্ড পড়েছে মহাবিপদে। যাত্রীরা অস্থির হয়ে পড়লে স্টেশন মাস্টার গিয়ে ইঞ্জিনের অভিমানের কথা জানতে চাইলে ইঞ্জিন বলে, ড্রাইভার আর গার্ড ঘুমায়। তারা রীতিমতো ডিউটি করে না। এজন্য আমি চলব না। যাহোক, পরে ইঞ্জিনের সঙ্গে দেন-দরবার করে তরুণ ড্রাইভার আর গার্ড দেওয়ার পর সে চলতে রাজি হয় এবং চলতে থাকে।

               শিশুকে চাঁদ দেখিয়ে ছড়া কাটার স্মৃতি মনে হয় আমাদের দেশের মানুষের কম বেশি সবারই আছে। চাঁদকে মামা ডাকা হয় কোন সূত্রে তা যদিও অজ্ঞাত কিন্তু চাঁদকে মামা ডাকেনি এমন শিশু বা শিশুর মা-বাবা-ভাই-বোন এ দেশে খুব কমই পাওয়া যাবে। শিশুসাহিত্যিক আখতার হোসেনও চাঁদমামাকে নিয়ে গল্প লিখতে ভোলেনি। তিনি লিখেছেন―‘চাঁদমামার সঙ্গে আলাপ’ নামের একটি গল্প। যদি চাঁদমামার সঙ্গে শিশুদের সাধারণত আনন্দ বা খুশির ছড়া বা গল্পই বেশি ঘটে কিন্তু এই শিশুসাহিত্যিক এই গল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশের দরিদ্র শিশুর অভাব অনটনের ছবি দুর্দান্ত কৌশলে সমাজবাস্তবতা তথা বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার ছবি এঁকেছেন নিপুণ শিল্পীর মতো। এক জরাজীর্ণ ছিন্ন জামা পরিহিত খোকার সঙ্গে চাঁদের সংলাপের মাধ্যমে গল্পটি রচিত হয়। চাঁদ মামা চায় পৃথিবীর সব শিশুকে আনন্দ দিতে, হাসিখুশি রাখতে। কিন্তু ভিখেরি শিশুটি তা অসম্ভব বলে। শিশু ভিখেরির সঙ্গে চাঁদের সংলাপের মধ্য দিয়ে বের হয়ে এসেছে আমাদের নড়বড়ে সমাজ। কিন্তু লেখক এখানে একটি ইতিবাচক নির্দেশনাও দিয়েছেন। যেমন :

‘এখন তুমি ভিক্ষে করো না’―চাঁদমামা প্রশ্ন করল।

‘না, যখন থেকে বুঝতে শিখেছি আমাদের নড়বড়ে সমাজে গুটিকয় বড়লোক অসংখ্য লোককে ভিক্ষে করতে বাধ্য করছে তখন থেকে ও-পথ ছেড়ে দিয়েছি―ছেলেটা এক নিঃশ^াসে কথাগুলো বলল।

               চাঁদমামা প্রশ্ন করল―‘তাহলে তুমি কী করবে ?’

               ‘কী করব ?’

               ‘হ্যাঁ, কী করবে ?’

               ‘এমন করে পৃথিবীটা গড়ব যাতে সবাই এমন সুন্দর ঝকঝকে রাতে আনন্দে হাসতে, গাইতে ও নাচতে পারে’―ছেলেটা তার কথাগুলো শেষ করল আস্থার সঙ্গে।

               আলাপ শেষ হতেই চাঁদমামা ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে ছেলেটার কপালে চুমু দিল।

               গল্পটি পাঠককে চমৎকৃত করবে সন্দেহ নেই। তবে শেষের বাক্যটিতেই শিশুতোষ গল্পের পূর্ণ আমেজটি চলে এসেছে। শিশু পাঠকরা শেষ বাক্যে এসেই চমকে যাবে, আহ্লাদিত হবে এবং চাঁদের সঙ্গে শিশুদের মিতালির মেলবন্ধন রচনা করবে। শিশুরা ভাবনায় পড়বে, চাঁদ কীভাবে এসে কপালে চুমু দিল। যাহোক, শিশুরা ভাবতে থাকুক। লেখকের কাজই তো পাঠককে ভাবানো, চিন্তায় ফেলা যাতে তাদের মননশীলতা সমৃদ্ধ হয়। 

                ছোট শিশুদের গল্পের শব্দ বা বাক্যের পৌনঃপুনিক ব্যবহার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। পৌনঃপুনিক বাক্যের ব্যবহারের ফলে শিশুরা গল্প পড়তে এক প্রকার ছন্দের তাল পায় এবং তারা দ্রুত পড়ার অভ্যাস করতে পারে। একই সঙ্গে শিশুদের নতুন শব্দ শেখানোর জন্য এই পদ্ধতি ইংরেজি সাহিত্যসহ বাংলা সাহিত্যেও পাওয়া যায়। ‘আমার চেয়ে সুখী’ গল্পে লেখক সরাসরি কোনও বাক্যের পৌনঃপুনিক ব্যবহার না করলেও ঘটনার ব্যবহার করেছেন। এর কৌশলের মাধ্যমে শিশুদের গল্পটি দ্রুত পড়ার সুযোগ হয়েছে এবং শিশুরা যেমন আনন্দ পাবে ঠিক তেমনই কল্পনার জগতেও ভেসে যেতে পারবে। এই গল্পে একটি সেতুকে এক দৈত্য ভেঙে ফেলবে বলে সেতুর মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। এবং সেতু দিয়ে যারাই পার হয় তাদের সে ভয়ের কথা জানায়। তারপর সবাই তাকে আশ^স্থ করে যে, দৈত্যকে তারা প্রতিরোধ করবে। সবাই মিলে দৈত্যকে প্রতিহত করে সেতুকে বাঁচায় যার জন্য সেতুটি বলে আমার চেয়ে সুখী আর কে ?

               প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, পৌনঃপুনিক শব্দ বা বাক্যের সফলভাবে ব্যবহার করেছেন শিশুসাহিত্যিক মোহাম্মদ শাহ আলম। তাঁর বেশ কয়েকটি গল্পে বাক্যের পৌনঃপুনিক সার্থক প্রয়োগ দেখিয়েছেন। বর্তমান লেখকেরও দুটি গল্প পৌনঃপুনিক বাক্য প্রয়োগ করে নির্মিত হয়েছে।

               ‘খেলাঘর, তালপাতার সেপাই এবং পাগলাটে ষাঁড়’ গল্পটিও বেশ মজার এবং শিশুদের চিন্তা ও কল্পনা শক্তি বিকাশের জন্য উপযোগী। এই গল্পে মূলত বিভিন্ন দেশের কয়েকটি পুতুল মূল চরিত্র। চরিত্রগুলো নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি করে এবং শেষাবধি পাগলাটে ষাঁড় আসার পর ওরা পালিয়ে যায়। পুতুলকে চরিত্র করে হুমায়ূন আহমেদের ‘নীল হাতি’ নামক একটি গল্প রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। তাছাড়া বর্তমান লেখকেরও পুতুলকে প্রধান চরিত্র করে দুটি গল্প রয়েছে।

               এভাবেই লেখক অত্যন্ত নিপুণতার সঙ্গে ‘মার জন্যে’, ‘কাঠ থেকে পুতুল’, ‘শক্তি’, ‘জাদুর খেলা নাকি সত্যি!’ ‘খেলনা পুতুল’ এবং ‘সমুদ্র অনেক বড়’ নামের গল্পগুলোও নির্মাণ করেন। ‘খেলনা পুতুল’ গল্পটিতে রূপকথার চরম উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে এবং শিক্ষণীয় বিষয়ও রয়েছে। সর্বশেষ, যে গল্পের শিরোনাম বইয়ের শিরোনাম হয়েছে সেটি হলো সমুদ্র অনেক বড়। এই গল্পের মূল চরিত্র একটি মেয়ে ইতু এবং কুয়োর ভেতর ব্যাঙের ছানা সহগামী চরিত্র। কুয়োর ব্যাঙকে একদিন ইতু কুয়ো থেকে বাইরে যখন আনল তখন পৃথিবী ও আকাশের রূপ দেখে সে অভিভূত হয়ে গেল। তারপর সে সূর্যকে চিনল। পুকুর চিনল এবং সবশেষে সাগর দেখে সেখানে থাকতে চাইল। কিন্তু হঠাৎ করে বিশাল বিশাল ঢেউ দেখে সে ভয় পেয়ে যায় এবং সাগরে না থেকে পুকুরেই থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। ব্যাঙের ছানা বলে এখন সে ছোট তাই সাগরে থাকা সম্ভব নয়। বড় হয়ে সে সাগরে থাকবে।

               গল্পটিও শিশুদের কল্পনার জগতকে বিস্তৃত করতে সহায়ক হবে।

               সবশেষে বলা যায়, আখতার হোসেনের পনেরোটি গল্পের মধ্য দিয়ে একজন সত্যিকার অর্থেই দক্ষ ও কৌশলী শিশুসাহিত্যেকের পরিচয় দিয়েছেন। বাক্যের গঠন, নির্ভুল বানান, শব্দের ব্যবহার এবং কোথাও কোথাও উপমার ব্যবহার পাঠককে মুগ্ধ করে। ‘ডালিম-ফাটা’ উপমাটি যেকোনও পাঠকের দীর্ঘকাল মনে থাকবে বলে প্রতীয়মান হয়। নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, এটি একটি সার্থক ও চমৎকার শিশুতোষ গল্পের বই।

 লেখক : কথাশিল্পী

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button