শিশুসাহিত্যের সমৃদ্ধ ধারার অনবদ্য সংযোজন : কাজে হব বড় : ইসমাইল সাদী
আখতার হুসেনের সাহিত্যকর্ম : আলোচনা
শিশুমনকে তুলনা করা হয় উর্বর পলির সঙ্গে। পলিমাটির ধর্ম যেকোনও সুস্থ বীজকে অঙ্কুরোদগমের মধ্য দিয়ে চারা গাছ, চারা গাছ থেকে পরিণত স্ব-স্ব বৃক্ষজীবন দান করা। পরিণত হওয়ার পর বৃক্ষ তার নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী প্রকৃতি থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করে এবং তা সরবরাহ করে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী; প্রবল প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে টিকেও থাকে। এরপর নিজস্ব ফুল-ফল উৎপাদন করে অপরকে বিলাবার জন্য। ওটাই তার ধর্ম। মানবজীবনের সঙ্গে বৃক্ষজীবনের সাদৃশ্য অনেক। মানবসন্তানকে তার শিশুবেলায় যে জীবনাচরণে অভ্যস্ত করে তোলা হয়, যা কিছু শেখানো হয়, যেসব পাঠে অভ্যস্ত করানো হয়, সমাজ-পরিবার-স্বজন সম্পর্কে যে ধরনের ধারণা দেওয়া হয়, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ কিংবা নীতিনৈতিকতা চর্চার মধ্য দিয়ে তার মননকে যেভাবে গড়ে তোলা হয়, বয়ঃপ্রাপ্ত হলে সেসবই তার জীবনচর্চার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। শিশুমনের বিকাশে পারিবারিক পারিপাশির্^কতার ভূমিকা অনবদ্য। একজন শিশু যখন বয়ঃপ্রাপ্ত হতে হতে বিদ্যায়তনিক পাঠপদ্ধতির ভেতরে প্রবেশ করে, তখন সে কেবলই অনুকরণ করতে শেখে। শ্রেণিকক্ষের শিক্ষক এবং গুরুজনদের কাছে এটা ওটা শিখতে শিখতে আয়ত্ত করে নেয় জীবনের পাঠ ও পদ্ধতি। এই আয়ত্তের প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকে বারংবার পাঠ-প্রচেষ্টা। পাঠ-পুনরাবৃত্তির একপর্যায়ে সে বুঝতেও শিখে যায়। একসময় নামতা পড়ার মতো করে শিশুরা আত্মস্থ করে ফেলে :
সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি
সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি।
আদেশ করেন যাহা মোর গুরুজনে
আমি যেন সেই কাজ করি ভালো মনে।
ভাইবোন সকলেরে যেন ভালোবাসি
এক সঙ্গে থাকি যেন সবে মিলেমিশি।
(মদনমোহন তর্কালঙ্কার)
স্মৃতিতে গেঁথে যেতে যেতে এই ধরনের অনাবিল বাণীগুলোর মাহাত্ম্য কখন যে হৃদয়ঙ্গম হয়, তা সুনির্দিষ্ট করে বলা যায় না। একসময় তারা কবিতাটির মর্মার্থও অনুধাবনে সামর্থ্য অর্জন করে। শিশুমন নাড়িয়ে দেওয়া এমন অসংখ্য নীতিনৈতিকতা-সংক্রান্ত কিংবা উপদেশমূলক কবিতা-ছড়া আমাদের মনকেও একসময় আলোড়িত করেছে। বাংলা সাহিত্যে ‘আদর্শ ছেলে’র রচয়িতা কুসুমকুমারী দাশ, ‘স্বর্গ ও নরক’ কবিতার রচয়িতা শেখ ফজলুল করিম, ‘স্বাধীনতার সুখ’এর রচয়িতা রজনীকান্ত সেন, ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’র রচয়িতা কাজী কাদের নেওয়াজ, ‘আমার পণ’-এর মদনমোহন তর্কালঙ্কার, ‘উত্তর ও অধম’-এর সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, ‘মানুষ’ কবিতার রচয়িতা কাজী নজরুল ইসলাম, ‘আমাদের গ্রাম’-এর বন্দে আলী মিয়া প্রমুখের হাত ধরে উপদেশমূলক কবিতার একটি ক্ষীণ কিন্তু জনপ্রিয় ধারা তৈরি হয়েছিল। তাঁদের এসব কবিতা পাঠ্যতালিকাভুক্ত হওয়ার সুবাদে কবিতাপাঠের শুচিস্নিগ্ধ আনন্দে ভরপুর ছিল আমাদের শিশুবেলা।
মাস্টার-মশাইদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে নামতা পড়ার মতো করে যখন ছন্দোবদ্ধ অন্ত্যমিলের সুরেলা পদ্যগুলো কিছু না বুঝেই আওড়াতে হতো, তখন কক্ষময় এক অপার্থিব আনন্দঘন পরিবেশের সৃষ্টি হতো। এর রেশ থেকে যেত মনের গহীনে। স্কুল-ফিরতি বালক-বালিকারা কিছু ত্রুটিবিচ্যুতিসমেত সেগুলো আবার নিজেদের মতো করে আওড়াতে আওড়াতে একসময় তার রসও আস্বাদন করতে সক্ষম হতো। এভাবে অনাবিল আনন্দ-রস থেকে স্থায়ী বার্তা ছড়িয়ে যেত সেই সময়ের শিশুভুবনে। সকল শিশুই এমন আনন্দপাঠের মধ্য দিয়ে জীবন ও পারিপাশির্^কতা সম্পর্কে জেনে যায়, জেনে যায় চারদিকের আপনজনদের পরিসর সম্পর্কে। বিশেষত, যখন পাঠ করে :
আমাদের ছোট গাঁয়ে ছোট ছোট ঘর
থাকি সেথা সবে মিলে নাহি কেহ পর। পাড়ার সকল ছেলে মোরা ভাই ভাই
এক সঙ্গে খেলি আর পাঠশালে যাই।
(বন্দে আলী মিয়া)
তখন না চাইলেও শিশুরা মনে মনে বিদ্যায়তনিক পাঠের বাইরে আপনা-আপনিই একটা জগৎ তৈরি করে ফেলে। কেবল কবিতা নয়, যেন জীবনচলার নির্দেশিকা। শিশুর মননকে গড়ে দিতে এমন কত কিছুই না প্রয়োজন। শিশুরা ভুল করতে পারে, জীবনকে বিপদাপন্ন করে তুলতে পারে। সেসব ভেবেই হয়তো কবি লেখেন এমন কবিতা-চিরন্তন―একটু খানি ভুলের তরে অনেক বিপদ ঘটে ভুল করেছেন যারা সবাই ভুক্তভোগী বটে।
এভাবে শিশুমনকে যারা অনুধাবন করতে পারেন, তাঁরাই কেবল শিশুদের নিয়ে সৃষ্টিপ্রতিভাকে শানিত করতে পারেন। শিশুমনকে বুঝতে তাদের উপযোগী ভাষার ওপর দক্ষতা থাকতে হয়। কারণ ‘সহজ কথা যায় না বলা সহজে।’ শিশুদের হার না মানা মানসিকতায় যেমন গড়ে তুলতে হয়, তেমনি দিতে হয় সাহস। শিশুসাহিত্যিকগণ নিজেদের ভাবনাগুলো তাই ছড়িয়ে দেন বাণী বা উপদেশের মতো করে। কালীপ্রসন্ন ঘোষও ছিলেন তেমনই একজন। এমন কবিতা পড়ে শিশুবেলার কথা মনে পড়ে না, এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া ভার :
পারিব না এ কথাটি বলিও না আর
কেন পারিবে না তাহা ভাবো একবার
পাঁচজনে পারে যাহা
তুমিও পারিবে তাহা
পারো কি না পারো করো যতন আবার
একবারে না পারিলে দেখো শতবার।
এসব কবিতা কণ্ঠস্থ করতে করতেই প্রভাবিত হয় শিশুমন। দীর্ঘস্থায়ী সাহস ও সান্ত্বনাও পেয়ে যায় কিঞ্চিত ভীরু কিংবা ধীর মস্তিষ্কের শিশুরা। শিশুদের মন নিয়ে প্রতিক্ষণ না ভাবলে এমন চিরন্তন চরণ রচনা সম্ভব না। সবারই প্রত্যাশা, নিজেদের শিশুসন্তান যেন এক সত্যিকারের মানুষ হয়। তার জন্য অনুপ্রেরণা দেওয়া যায় এমন কবিতাও রয়েছে আমাদের শিশুসাহিত্যের ভাণ্ডারে। আমরা শিশুদের বলি কাজে বড় হতে। এ বিষয়ে কবি জীবনানন্দ দাশের মা কুসুমকুমারী দাশ লিখেছেন :
আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে
কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে ?
মুখে হাসি বুকে বল, তেজে ভরা মন
‘মানুষ হইতে হবে’―এই যার পণ।
উপর্যুক্ত চরণসমূহ পাঠে কিছুটা মনোনিবেশ করলে উপলব্ধি করা যায়, বাংলা ভাষার শিশুসাহিত্য অত্যন্ত সমৃদ্ধ। শিশুদের মনকে রাঙাতে, কল্পনাপ্রবণ করে তুলতে, তাদের কল্পনাশক্তিকে বিকশিত করতে শিশুসাহিত্যিকগণ যে গভীর অভিনিবেশের সঙ্গে সাধনা করতে হয়, তা বলাই বাহুল্য। তাঁদেরই যোগ্য উত্তরসূরি শিশুসাহিত্যিক আখতার হুসেন (জন্ম ১৯৪৫)। বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যের পুরোধা ব্যক্তিত্ব তিনি। ব্যক্তিজীবনে শিশুর মতো সারল্যে ভরা আখতার হুসেন ছড়া-কবিতা, শিশুতোষ গল্প-উপন্যাসসহ সব শাখাতেই সাধারণত নীতিনৈতিকতা এবং শিশুমনন চমকে দেওয়ার মতো সূক্ষ্ম ও স্বতঃসিদ্ধ ইমেজ তৈরি করে থাকেন; যাতে তাঁর স্বকীয়তা ফুটে ওঠে। তাঁর রচিত সমুদ্র অনেক বড়, রামধনুকের সাঁকো, ফ্রিডম ফাইটার, আমার দুটি ডানা, সোনায় মোড়া ছড়া প্রভৃতি তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি আমাদের শিশুসাহিত্যের সমৃদ্ধ যুগেরই উত্তরাধিকার বহন করছেন। কেননা উপর্যুক্ত ধ্যানলব্ধ ও শিশুমন বিকাশে সহায়ক উপদেশমূলক বাণীবহুল ছড়া-কবিতার ধারা এখন নেই বললেই চলে। আখতার হুসেন সেই ধারাকে অকৃত্রিম সাধনায় আগলে রেখেছেন। সম্প্রতি প্রকাশিত তাঁর ‘উপদেশমূলক কাহিনি কবিতা’ কাজে হব বড় কাব্যসংকলনে তিনি সরাসরি জগতের একসময়ের মহান ব্যক্তিদের জীবনাদর্শ এবং চরিত্রের নানা ইতিবাচক ও অনুসরণীয় দিক নিয়ে কবিতা রচনা করেছেন। গল্প বলার মতো করে তাল-লয়-ছন্দের মোলায়েম আবেশে দীর্ঘ ও নাতিদীর্ঘ মিলিয়ে এ-গ্রন্থে রয়েছে বিশটি কবিতা। কী করে দ্বন্দ্ব-সংঘাত এড়ানো যায়, কী করে বিপর্যস্ত মানসিকতা থেকে পথ খুঁজে পাওয়া যায়, কেমন করে জীবনযাপন করলে মানুষের কল্যাণ হতে পারে, তেমন ভাবনা উপজীব্য করে রচনা করেছেন ছন্দোবদ্ধ অন্ত্যমিলের কবিতাসমূহ।
মানুষের জীবন নানাভাবে সংকটাপন্ন হয়, অনেক সময় দিশাহারা হয়ে পড়ে জীবন চলার পথ, সেই সময়গুলোতে মানুষ মুক্তি খুঁজে ফেরে। মুক্তির জন্য তালাশ করতে থাকেন মনীষীদের জীবন কিংবা তাদের দর্শন। এমন কিছু দৃষ্টান্ত তিনি নিয়েছেন বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধ, ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হজরত মোহাম্মদ (সা.), খলিফা ওসমান, বাগদাদের খলিফা আল মুতাসিম বিল্লাহ, ইরানের কবি শেখ সাদী প্রমুখের জীবন থেকে। কিছু কবিতা তিনি নির্মাণ করেছেন ইশপের গল্প অবলম্বনে। কবিতাগুলো কবিতার চেয়েও বেশি কিছু। কারণ, প্রতিটি কবিতায় তিনি জীবনের গল্প বলেছেন। উপদেশমূলক বাণীর অভ্যন্তরে চমৎকার গল্পের সন্নিবেশ কবিতাগুলো অনন্য করে তুলেছে।
বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধের জীবনীকে নিয়ে রচনা করেছেন একাধিক কবিতা। গ্রন্থের প্রথম কবিতাটিও তাঁকে নিয়ে রচিত। নাম ‘শান্তির মহাব্রতে’। একজন রাজপুত্র কোন্ মন্ত্রবলে রাজাসনের মোহ ছেড়ে ‘পেরোন কেবলি জনপদ আর সীমাহীন প্রান্তর।’ জ্ঞানের অনুসন্ধানে পার্থিব মোহমুক্তি ঘটাতে এবং নির্বাণলাভের জন্য বেরিয়ে যান প্রকৃতির সান্নিধ্যে। কারণ ‘অজ্ঞানতার আঁধার মোচনে অম্লান অন্তর’ তাঁর। সাধনার মধ্য দিয়ে জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে জগতের সমস্ত আকর্ষণ তাঁর কাছে ছিল মূল্যহীন। এগুলো তাঁর কাছে কেবলই মায়া। তাই নিজের গৃহত্যাগের সময় যশোধরার সজল দর্শনে তাঁর উপলব্ধি হয় :
হঠাৎ করেই বুদ্ধ ভাবেন, পড়লেন কোনও ফাঁদে
মায়া-মমতার জালে বাঁধতেই এরা কি এ-ভাবে কাঁদে!
তাই তো বুদ্ধ নিজেকে দ্রুতই সামলে নেবার পর
আসেন বাইরে ছেড়ে দিয়ে সেই প্রাসাদের অন্দর।
একই কারণে পিতার রাজাদেশ উপেক্ষা করেও তিনি অটল থাকেন তাঁর সিদ্ধান্তে। পিতা বলেন এক, তিনি করেন আরেক। বুদ্ধের অনুভূতি আত্মস্থ করে আখতার হুসেন লেখেন :
এদিকে তো রাজা শুদ্ধোধনের খুশির অন্ত নেই
পুত্রকে দেখে মন ভরে যায়, ভাবনা হারায় খেই।
রাজপ্রাসাদের বিশাল কক্ষ খুলে দেন তিনি আর
তাকে অনুরোধ জানান সেখানে মিলেমিশে থাকবার।
তারি তো এসব, তার অধিকারে, থাকো না ভিক্ষুসহ
বুদ্ধ বলেন, চাই না রাজার এতোটুকু অনুগ্রহ।
রাজপ্রাসাদের আরাম-আয়েশ হেলাভরে একদিন
পরিত্যাগ করে সাধনার পথে দ্বিধা-সংকোচহীন―
পথে নেমে আসা; আজও সেইভাবে নামলেন তিনি পথে
নিগ্রোধ নামে উদ্যানে এসে মগ্ন হলেন ব্রতে।
‘অহিংসা পরমধর্মে’র দর্শন প্রচারের জন্য পৃথিবীর মানবতাবাদী মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন গৌতম বুদ্ধ। সংসারের সমস্ত মায়া এবং বস্তুপৃথিবীর সমস্ত লোভ কাটিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়েছিলেন শান্তির বাণী প্রচারের উদ্দেশে। পিতা-মাতা, সহধর্মিণী, সন্তানের প্রতি মায়াকে তিনি পিছুটান জ্ঞান করেছেন। তিনি নিজে রাজার উত্তরাধিকার হেলায় পায়ে ঠেলেছেন বলে সন্তান তো পিতার পথ নাও ধরতে পারেন। কিন্তু পুত্র রাহুলকেও তিনি যে কাছে টানতে পেরেছিলেন। এ কবিতায় সেই গল্পও জানা যায়। ঘটনাটি বেশ চমকপ্রদ :
পথ ধরে তিনি চলতে চলতে ভাবেন নিরন্তর
যাবেন কোথায়, বাঁধবেন তিনি সাময়িক ডেরা, ঘর।
এমন সময় রাজপুত্রের বেশে সম্মুখে তার
দাঁড়াল রাহুল, তার সন্তান, মুখখানা বড় ভার।
বলল পিতার চোখ সোজা চেয়ে, ‘আমি তো তোমার ছেলে
―উত্তরসূরি, লিখে দাও সব, যাও কোথা অবহেলে ?’
এই কথা শুনে বুদ্ধ তিলেক রাহুলের দিকে চেয়ে
বললেন, ‘বড়ো ভালো হলো আজ সত্যি তোমাকে পেয়ে।
তুমি আমাদের সংঘভুক্ত, ভিক্ষু-শিষ্য তাই
এখানে উত্তরাধিকার বলে কোনও কিছু মোটে নাই।
সামনে দৃষ্টি মেলে দিয়ে শুধু পথ চলা অবিরাম
থাকবে দুহাতে শান্তির বাণী-ভরা সুনীলাভ খাম।’
এখনও হাঁটছে বুদ্ধ, রাহুল পৃথিবীর পথে পথে
সঙ্গে অযুত ভিক্ষুর সারি―শান্তির মহাব্রতে।
বুদ্ধ নিয়ে গ্রন্থভুক্ত আরেকটি কবিতার নাম ‘সারা বিশে^র ভার’। তখনও তিনি বোধিস্বত্ব লাভ করেননি। কিন্তু পৃথিবীর নানা অন্যায়-অবিচার তাঁকে ভাবিয়ে তুলেছিল। খেলার সাথির তিরবিদ্ধ আহত এক পাখিকে শুশ্রƒষা দিয়ে সুস্থ করে তোলেন তরুণ বুদ্ধ। শিকারি বন্ধু পাখিকে শরাহত করাকে কৃতিত্ব হিসেবে গণ্য করে পাখিটির মালিকানা দাবি করে। কিন্তু বুদ্ধের দাবি, শুশ্রƒষাকারী হিসেবে এর মালিকানা তারই। একপর্যায়ে বিচারের ভার পড়ে রাজা শুদ্ধোধনের ওপর। বিচারের আগে দুই পক্ষের যুক্তিই শোনেন তিনি। ছেলের যুক্তি শুনে শুদ্ধোধনের গর্ব হয়। তার চোখ যায় খুলে। পাঠ করা যাক বুদ্ধের জীবনীকেন্দ্রিক কবিতাটির কিয়দংশ :
খেলার সঙ্গী দেবদত্তের
সোজা এক কথা, নেই হেরফের
‘পাখিটাকে আমি আহত করেছি আমিই মালিক তার’
একথা শুনেই রাজা তারা ছেলে
বুদ্ধের দিকে দুই চোখ মেলে―
বললেন, ‘বলো তোমারও যদি থাকে কিছু বলবার ?’…
‘পিতা, আপনার কাছে আমি চাই বিচার সত্যিকার
মারতে চেয়েছে পাখিটাকে ও তো
এই যদি হয় জীবনের ব্রত
কারুর জীবন নিরাপদ নয় ওর হাতে মোটে আর।’
‘পেয়েছে তো ফিরে পাখিটি এখন
অমূল্য ধন তার সে জীবন―
সেবাশুশ্রƒষা, আর কারও নয়, পেয়ে সে তো এ আমারই
ভাবুন আপনি আরও একবার
প্রাণীটার ’পরে কার অধিকার―
থাকবে অটুট, বাঁচাল যে তাকে, না যে তার সংহারী ?…
এমন সোনার ছেলেই তো হবে সঠিক কর্ণধার―
রাজ্য চলবে, করবে শাসন।
কিন্তু বুদ্ধ সিংহ-আসন―
দুই পায়ে দলে, কাঁধে তুলে নেন সারা বিশে^র ভার।
কবিতাটির পঙ্ক্তিতে পর্ববিন্যাসও ব্যতিক্রমী ও চমৎকার। প্রতি দুই পর্বের দুই চরণ পরপর একটি করে তিন পর্বসমেত অপূর্ণ পর্বের একটি করে চরণ ব্যবহৃত হয়েছে। পাখির দাবির দুজনের সংলাপ ঠিক রাখতে কবিতায় তিনি এমন বৈচিত্র্য এনেছেন। ছন্দ ও মাত্রজ্ঞানের ওপর অকৃত্রিম দখলের কারণে আখতার হুসেনের পক্ষে কবিতায় এমন চমৎকারিত্ব আনা সম্ভব হয়েছে।
জীবনে বড় হতে গেলে কথা ও কাজের মাঝে মিল থাকতে হয়। সে দর্শন ধরতেই আখতার হুসেন শরণ নিয়েছেন ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক মহানবি (সা.)-এর জীবনের একটি ঘটনাকে। ঘটনাটি বহুল জনশ্রুত। এক সাহাবার ছেলে-সন্তান ‘মাত্রা ছাড়ানো মিষ্টি’ খায়। মিষ্টির আসক্তি ছাড়াতে তাকে নেওয়া হয় নবিজির কাছে, ‘মুক্ত করুন ছেলেটিকে এই অতি আসক্তি থেকে।’ সপ্তাহখানেক পর নবিজি আসতে বলেন। ফের এলে তাকে কেবল বুকে জড়িয়ে ধরেন। সাহাবা-মনের দ্বন্দ্ব কাটে না। এতটুকু করতেই কি তাঁকে সাত দিন পর আসতে বলা হলো ? তাঁর মনে প্রশ্ন সংশয়, হয়তো ‘বিশেষ জরুরি কাজ ছিল’ এ কদিন। পড়ে নেওয়া যাক আখতার হুসেনের কবিতা :
জবাবে বলেন নবিজি মহান, ‘শোনো হে সাহাবা, শোনো
তোমাকে গোপন কথাটা বলতে সংকোচ নেই কোনো।
মিষ্টির প্রতি লোভ-মোহ-টান আমারও মন্দ নয়
না পেলে হাতের, পাতের নাগালে মনখানা ভার হয়।
সত্যি বলতে চলত না এক পলও মিষ্টি বিনে
আমার সে বদ অভ্যাস দূর করেছি এ সাত দিনে।
অন্যে যে দোষে দোষী যদি তাই আমার নিজেরও থাকে―
তুমিই বলো না, তাহলে কীভাবে শোধরানো যাবে তাকে ?
একইভাবে নবিকে নিয়ে আরেকটি ঘটনাও বহুভাবে জনশ্রুত। আখতার হুসেন ঘটনাটিকে ধরেছেন ‘মহৎ কেন তিনি’ নামে। নবির পথে প্রতিদিন কাঁটা বিছিয়ে রাখা হতো। এক বৃদ্ধা নবির চলার পথে প্রতিদিন কাজটি করতেন। জানা সত্ত্বেও তিনি তাকে কখনও শাস্তি দেননি কিংবা অভিযুক্ত করেননি। বরং কণ্টকমুক্ত করে তিনি পথ চলেছেন। একদিন লক্ষ্য করেন, ‘কাঁটা নেই কোনও, বাধাহীন চলা, তাই ভেবে নির্বাক!’ নবির আশঙ্কা হয়, হয়তো বৃদ্ধা অসুস্থ। তিনি ‘গিয়েই দেখেন, সত্যিই তাই, জ¦রে সে কাহিল বড়/ নড়া ও চড়ার শক্তিটা নেই, কাঁপছে সে থরোথরো।’ এরপর নবি তাকে সেবা-শুশ্রƒষা করে সুস্থ করে তোলেন। এমন পরমত-সহিষ্ণুতা অবশ্যই শিশুমন আলোড়িত করে থাকে।
ইসলাম ধর্মে শিয়া ও সুন্নি গোষ্ঠীর মধ্যকার মতাদর্শগত সমস্যা মুসলিম-অধ্যুষিত সকল দেশেই বিরাজমান। বাগদাদে একবার এই দুই গোষ্ঠীর মধ্যে দাঙ্গা সংঘটিত হয়। নিহত মানুষের মধ্যে শিয়া সম্প্রদায়ের সংখ্যা ছিল বেশি। তাতে বাগদাদের খলিফা নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করলেও প্রতিশোধ স্পৃহা জেগে ওঠে উজিরের। তারই প্ররোচনায় হালাকু খান আক্রমণ করে বাগদাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য ধ্বংস করে ফেলে। লোভী ওই উজির সম্পর্কে আখতার হুসেন লিখেছেন :
উজির তো শিয়া গ্রেত্রের নাম তার আহমদ
ওপরে ভালোর ভাব দেখালেও ভেতরে কুটিল, বদ।
মনে ভেতরে ধিকি ধিকি তার তুষের আগুন জ¦লে
প্রতিশোধ চাই, এই কথা তার মনে শুধু বেজে চলে।
খলিফা এসব জানেন না কিছু তার তো সরল মন।
উজির কেবল খুঁজে ফেরে তার মোক্ষম সেই ক্ষণ।…
প্রতিরোধ গড়ে তুলেও খলিফা অবশেষে হেরে যান
উজিরের ষড়যন্ত্রেই হন বিজয়ী হালাকু খান।
উজিরের লোভজনিত বিশ^াসঘাতকতা এবং ষড়যন্ত্রে সাফল্য পায় হালাকু খান। তাকেও প্রাণ দিতে হয় হালাকুর হাতে। বিশ^াসঘাতকের পরিণতি শেষ পর্যন্ত সুখকর হয় না। এক্ষেত্রেও হয়নি। হালাকুর হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে উজির আহমদকে। প্রকৃত ইতিহাসে ঘটনাটি কিছুটা ভিন্ন হলেও আখতার হুসেন মূলত লোভ ও বিশ^াসঘাতকতার পরিণতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে, সেই সাহিত্য-সত্য প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে একটি বার্তা দিতে চেয়েছেন ‘লোভীর শাস্তি’ কবিতার শেষ দিকে :
তুমি বেইমান, আর কিছু নও, জল্লাদ নিয়ে যাও
কোনও কথা নয়, একে এক্ষুনি ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দাও।
বেইমান যারা তাদের শাস্তি এমন করেই হয়
চিরস্মরণীয় কথাটি কখনও ভুলেও ভোলার নয়।
আখতার হুসেন তাঁর গ্রন্থভুক্ত প্রতিটি কবিতাতেই শিশু-কিশোর মনকে আলোড়িত করতে পারে, তেমন বার্তা দিতে চেয়েছেন। তেমনই একটি কবিতা ‘শিক্ষা’। একবার রাজপুতানা রাজ্যে বিদ্রোহ দমাতে রাজা বিরাট নৃশংসতা চালায় রাজ্যজুড়ে। হাজারো মরদেহের মাঝে ছিল তাঁর এক ভাইয়ের মৃতদেহ। অনিচ্ছাকৃত এই মৃত্যু তিনি মেনে নিতে পারেননি। রাজার মনে তখন অনুশোচনার অনুতাপ :
অনুশোচনার ঝড় বয়ে যায়, করে চলে অনুতাপ
নিহত ভাইয়ের চোখজোড়া বলে, তুমি তো করেছ পাপ।
এই পাপাগ্নি নিশিদিন ধরে তোমাকে তো পোড়াবেই
যে কোনও হত্যা ভ্রাতৃহত্যা, জেনো তার ক্ষমা নেই।
অন্য কারও বুকে অস্ত্র চালালে সে অস্ত্র যে নিজ ভ্রাতার বুকেও চলতে পারে, এমন বোধোদয় হলো তাঁর। এই ধরনের কবিতা যে শিশুমনে ভাবনার উদ্রেক ঘটাবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এভাবে প্রকৃত বন্ধু চেনার ওপর গুরুত্ব আরোপ করতে ‘যে নয় পরীক্ষিত’, শরীরের অঙ্গ না থাকার চেয়ে সামান্য পরিধেয় না থাকার ক্লেশ যে বড় হতে পারে না, তা বোঝাতে ‘জুতো না থাকার ক্লেশ’, রসিকতা করে কিংবা খেলার ছলেও মিথ্যা বলতে নেই। মজা করেও কেউ যদি প্রতিনিয়ত মিথ্যা বলে, তার পরিণতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তার দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে ‘মিথ্যেবাদী রাখাল’, নাম যেমনই হোক, কর্ম উত্তম হলে তা যে তেমন কোনও সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় না, সে-বিষয়টি বোঝাতে ‘নামে নয় কাজে পরিচয়’ প্রভৃতি কবিতা আখতার হুসেন রচনা করেছেন গভীর অভিনিবেশের সঙ্গে।
তবে শিল্প-সাহিত্যের ‘উচ্চমার্গীয়’ মানদণ্ডের বিবেচনায় এসব অনবদ্য সাহিত্যকর্মকে ‘পণ্ডিতগণ’ কবিতা না বলে পদ্য বলে থাকেন। মানুষের জীবনের চেয়ে বড় শিল্প, সমৃদ্ধ কবিতা আর কিছুই নেই। মানুষের জীবনের চেয়ে বেশি উপভোগ্য এবং সর্বংসহাও কিছু নেই পৃথিবীতে। তাই শিশুদের জীবনের পথকে মসৃণ করতে, জীবনের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়কে প্রশান্তিময় আলোর পথ দেখাতে অনেক সময় উপর্যুক্ত কবিতারূপী বাণীসমূহ মন্ত্রের মতো কার্যকর হয়। তাই উপদেশমূলক কবিতার ধারায় আখতার হুসেনের এ গ্রন্থ এক অনবদ্য সংযোজন। তাঁর এ গ্রন্থভুক্ত কবিতাগুলো যদি পাঠ্যতালিকাভুক্ত করা হয় তবে শিশুরা তাঁর অভিনব চিন্তার মধ্য দিয়ে নিজেদের কল্পনাশক্তি বিকশিত করার পাশাপাশি মানবহিতৈষী নীতি-আদর্শের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার সুযোগ পাবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক