আবার পড়ি : আখতার হুসেনের কিশোরগল্প
ইতু রোজ মজা কুয়োটার পাশ দিয়ে স্কুলে যায়, আবার ফিরে আসে। কিন্তু কোনও দিন এখানে একটুক্ষণের জন্যেও দাঁড়ায়নি। আজ হঠাৎ ওকে থমকে দাঁড়াতে হলো।
‘কে যাচ্ছ, ভাই, আমাকে ওপরে টেনে তোলো, আমাকে উপরে টেনে তোলো।’
কুয়োর ভেতর থেকেই কথাগুলো ভেসে আসছে! এক পা দুপা করে ইতু এগিয়ে গেল কুয়োটার কাছে। ওটার ভেতরে দৃষ্টি দিতেই ও দেখতে পেল, একটা ছোট্ট ব্যাঙছানা আকাশের দিকে মুখ তুলে চিৎকার করছে, ‘কে যাচ্ছ, ভাই, আমাকে উপরে টেনে তোলো, আমাকে উপরে টেনে তোলো।’
ইতুর ভীষণ মায়া হলো। কুয়োপাড়ে বই রেখে তক্ষুনি দৌড়ে দড়ি বাঁধা বালতি নিয়ে এল। আর অল্পক্ষণের মধ্যেই ব্যাঙের ছা’টাকে উপরে টেনে তুলল।
ব্যাঙের ছা মাটির ওপরে পা রাখতেই বড় একটা হাঁফ ছাড়ল এবং ইতুর দিকে কৃতজ্ঞভরা দৃষ্টিতে চাইল, ‘তোমাকে কী বলে যে ধন্যবাদ জানাব, ভাষা খুঁজে পাচ্ছিনে, ভাই। আর দুটো দিন কুয়োয় থাকলে আমি দম বন্ধ হয়ে মারা যেতাম।’
‘কুয়োর মধ্যে কী করে পড়ে গিয়েছিলে’―ইতু জিজ্ঞেস করল। ‘তোমার মা-বাবা নেই ?’
‘কুয়োর মধ্যে আমি পড়ে যাইনি,’ ব্যাঙছানা বলতে লাগল। ‘ওর মধ্যেই আমার জš§। আমার মা-বাবা ওই কুয়োতেই অসুখে পড়ে মারা গেছে। তার কদিন পর আমার ছোট চারটে ভাইও মারা যায়।’
কথাগুলো বলতে গিয়ে ব্যাঙছানার দুচোখ বেয়ে অঝোরে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। ইতু তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, ‘কেঁদো না! এখন তো তুমি মুক্ত। যেখানে ইচ্ছে সেখানে ঘুরে বেড়াতে পারবে। কেঁদো না!’
ব্যাঙছানা তার চোখ মুছল এবং আকাশের দিকে তাকাল। কত বড় আকাশ, কী নীল আকাশ! চোখ ছাপিয়ে তার আবার জল এল। কিন্তু কান্নাভেজা আবেগে নয়, একটা উজ্জ্বল আনন্দে।
সূর্যটা এতক্ষণ একটা টুকরো মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে ছিল। মেঘের টুকরোটা সরে যেতেই সূর্যটা ব্যাঙছানার দৃষ্টিতে। পড়তেই অবাক হয়ে গেল। এই প্রথম ও সূর্য দেখছে। কুয়োতে থাকতে কখনও সূর্যের মুখ দেখেনি।
‘ওটা কি আকাশের লাল রাগী চোখ ? আমার ভীষণ ভয় আর চোখ জ্বালা করছে!’ চোখ মুছতে মুছতে বলল ব্যাঙছানা।
‘না, ওটা সূর্য। সারা পৃথিবীকে আলো দেয়। ও না থাকলে আমরা বরফে ঢাকা পড়ে মারা যেতাম’―ইতু বলল।
‘ও তাহলে খু-উ-ব ভালো, তাই না’― ইতুর মুখের দিকে তাকালো ব্যাঙছানা।
‘নিশ্চয়ই’―ইতু জবাব দিল।
তারপর কিছুক্ষণ নীরবতা। এ নীরবতার অবসরে ব্যাঙছানা সূর্যের দিকে বার কয়েক তাকাল। তাকাতেই সূর্যের আলোটা ওর চোখে সহনীয় হয়ে উঠল। আর সেই আনন্দে হাততালি দিতে লাগল, ‘সত্যি, কত ভালো লাগছে সূর্যের আলো। চোখ মেলে রাখতে এখন মোটেও কষ্ট হচ্ছে না আমার।’
পথ চলতে চলতে ওরা দুজন একটা ঝোপের ধারে এসে দাঁড়াল। দাঁড়াতেই হঠাৎ দেখতে পেল, একটা সাপ ঝোপের ভেতর থেকে মাথা উঁচিয়ে বেরিয়ে আসছে। সাপটা তাদের দেখে একটু ভয় পেয়ে গেল। মাথা নোয়াল। আর ব্যাঙছানা তার চোখ দুটো বড় বড় করল―‘ওটা কী ?’
‘বিষধর সাপ।’
‘সাপ আবার কী ?’
‘তোমাদের-আমাদের শত্রু।’
‘শত্রু কাকে বলে ?’
‘শত্রু বলে তাকেই, যেসব সময় অন্যের ক্ষতি করে।’
‘তাহলে সাপটা আমার শত্রু। ও অন্যের ক্ষতি করে।’
‘হ্যাঁ, ওর থেকে সবসময়ই সাবধানে থাকবে। যেকোনো সময় তোমাকে আক্রমণ করতে পারে।’
ব্যাঙছানা কুয়োতে যখন ছিল তখন ভেবেছে মাটির উপরের সবকিছু কত সুন্দর। সেখানে কোনও দুঃখ-কষ্ট আর বাধা-বিপত্তি নেই। কিন্তু একি শুনল সে ? ব্যাঙছানা ইতুর কথায় অবাক হলো কিন্তু সাপের কথা ভেবে মনে মনে সাহস সঞ্চয় করল, ওকে অবশ্যই শত্রুর সঙ্গে লড়ে বেঁচে থাকতে হবে।
ওরা দুজন―সাপটা একটা গর্তে ঢুকে যেতেই আবার পাশাপাশি হাঁটতে লাগল। হাঁটতে হাঁটতে একটা পুকুরের ধারে এল। পুকুরটা বর্ষার পানিতে কানায় কানায় ভরা। পানি ভরা পুকুরটা দেখে ব্যাঙছানা আনন্দে লাফিয়ে উঠল, ‘মা বলেছিল সমুদ্রের কথা। এটা কি সেই সমুদ্র ?’
ব্যাঙছানার কথায় ইতুর ভীষণ হাসি পেল কিন্তু হাসল না। হাসল না এই ভেবে, যদি ওর সঙ্গী-বন্ধু ওর হাসিতে মনে মনে দুঃখ পায় ? তাই খুব আপন হয়ে ইতু ওর কাছটি ঘেঁষে দাঁড়াল, ‘না ভাই, ওটা সমুদ্র নয়, পুকুর।’
‘পুকুর। সমুদ্র তাহলে কেমন ? পুকুরের চেয়েও কি ছোট ?’
‘না, সমুদ্র পুকুরের চেয়ে অনেক বড়।’
‘তাহলে আমি সমুদ্রে থাকব’―চিৎকার করে উঠল ব্যাঙছানা। ‘সমুদ্র অনেক বড়। আমি সমুদ্রে থাকব।’
ইতু এবার কঠিন ভাবনায় পড়ল। ঠায় দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগল, এখন সে কী করবে ? আর ব্যাঙছানা তখন তার একটা পা জাপটে ধরে কাঁদতে শুরু করে দিয়েছে, ‘আমাকে সমুদ্রের কাছে নিয়ে চলো। আমি সমুদ্রে থাকব।’
কী আর করবে, বেচারি ইতু শেষে বাধ্য হলো ব্যাঙছানাকে সমুদ্রের ধারে নিয়ে যেতে। কিছুক্ষণ হাঁটার পর ওরা সমুদ্রের পাড়ে এসে দাঁড়াল।
সমুদ্র তখন উত্তাল তরঙ্গে মাতাল। কী বিরাট বিরাট ঢেউ ফণা তুলছে আর ছোবল মারছে ডিঙি নৌকোগুলো। কূলকিনারা কিছুই দেখা যায় না। কেবল পানি আর পানি। পানির শোঁ শোঁ গর্জনে কানের পর্দা ফেটে যাওয়ার দশা। সময় যতই পেরিয়ে যেতে লাগল, ব্যাঙছানা ততই অবাক হয়ে ভাবতে লাগল, সমুদ্রে তার মতো ছোট্ট কারও পক্ষে কি থাকা সম্ভব ? এত বড় বড় ঢেউয়ের সঙ্গে সে কি পেরে উঠবে ? ভাবনা শেষে ব্যাঙছানা ইতুর মুখের দিকে তাকাল এবং অস্ফুট স্বরে বলল, ‘চলো ফিরে যাই।’
‘কোথায় ?’
‘সেই পুকুরে।’
‘কেন, সমুদ্রে থাকবে না ?’
‘হ্যাঁ, থাকব। এখনও তো আমি অনেক ছোট। বড় হলে সমুদ্রে আসব।’
এমনভাবে কথা বলছিল ব্যাঙছানা, মনে হচ্ছিল, যেন এই কিছুক্ষণের মধ্যেই তার বয়স অনেক বেড়ে গেছে।
ইতু এরপর ওর সঙ্গে বলার মতো কোনও কথা খুঁজে পেল না। চুপচাপ ব্যাঙছানার পাশাপাশি হাঁটতে লাগল।
সচিত্রকরণ : ধ্রুব এষ