আখতার হুসেনের আমার দুটো ডানা : নিরীক্ষা ও বৈচিত্র্যময় ভাবনার অপূর্ব সমন্বয় : রাশেদ রউফ
আখতার হুসেনের সাহিত্যকর্ম : আলোচনা
আখতার হুসেন। বাংলাদেশের লব্ধ প্রতিষ্ঠিত শিশুসাহিত্যিক। দেশের কিশোর কবিতার প্রবাদ পুরুষ। মানুষের ভাষা কবিতায় রূপায়ণের ক্ষেত্রে তাঁর কোনও জুড়ি নেই। বাংলাদেশের কিশোর কবিতার চর্চা বেগবান করা, তার গতি প্রকৃতি নির্ণয় এবং স্বতন্ত্র মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে তিনি পালন করেছেন অবিস্মরণীয় ভূমিকা। নিজে কিশোর কবিতা নির্মাণ করে, বই প্রকাশ করে এবং কিশোর কবিতা বিষয়ক গ্রন্থ সম্পাদনা করে তিনি তাঁর সমসাময়িক কালের লেখক ও পরবর্তী প্রজন্মের কাছে অগ্রণী ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন। বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যের নানা শাখায় প্রচুর অবদান থাকা সত্ত্বেও ‘কিশোর কবিতা’ বিষয়ে তাঁর আলাদা আন্তরিকতা ও ভূমিকা অনন্য । ছড়া, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, জীবনী, নাটক ও বিচিত্র ধরনের লেখা লিখে তিনি দেশের শিশুসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে চলেছেন। তাঁর গদ্য রচনাও চমৎকার শিশু-কিশোর মনের স্বপ্ন কল্পনা, আকাক্সক্ষা ও কৌতূহলই তাঁর লেখালেখির উপজীব্য। শিশুসাহিত্যই তাঁর ধ্যান-জ্ঞান তবে কিশোর কবিতায় তিনি অধিক স্বচ্ছন্দ, স্বতঃস্ফূর্ত ও পারদর্শী। সুজন বড়ুয়ার ভাষায়: ‘আহসান হাবীবের পর কিশোর কবিতার সবচেয়ে শুদ্ধবাদী কারুকর্মী তিনি। ষাটের দশকে প্রচুর ছড়া লিখলেও স্বাধীনতার পর কিশোর কবিতাই প্রতিভাচারণার প্রধান মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেন। ছন্দ-মিলের কারুকার্যের সঙ্গে কিশোর মনোসংলগ্ন বক্তব্যের মেলবন্ধনই তাঁর কিশোর কবিতার স্বাতন্ত্র্য। বক্তব্যের চিরন্তনত্ব তাঁর কবিতার স্থায়ী অলংকার। গীতিময় কবিতা ছাড়াও প্রচুর ইতিহাস ও পুরান আশ্রয়ী এবং নীতি ও উপদেশমূলক কবিতা লিখেছেন’। [কিশোর কবিতা : রূপ ও রূপান্তর]
বলা বাহুল্য, স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ে আধুনিক ছড়াসাহিত্য নির্মাণে তিনি পালন করেছিলেন স্থপতির ভূমিকা। বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন এই লেখক যেসব ছড়া সেই সময় রচনা করেছেন, তাতে যেমন পাওয়া যেত সময়ের ছবি, তেমনি দেখা যেত শিশু মনের নানা কৌতূহল। তাঁর জনপ্রিয় ছড়ার কয়েকটি পঙক্তি এখানে তুলে ধরা হলো :
ছি: ছি: ছি:
স্ট্রাইক প্রোসেশন
এইসব কী ?
তার চেয়ে হও বাবা
সিএসপি।
তা’লে পাবে
টাকা মেলা বাড়ি গাড়িটি
শুধু শুধু প্রাণ দিয়ে
লাভ বলো কী ?
ছি: ছি: ছি:।
অথবা
চিমচে পেটে হাত বোলাও
ভাত না পেলে খাও পোলাও
তাও না পেলে বাতাস খেয়ে
আচ্ছা করে পেট ফোলাও।
দায়িত্বশীল ও বৈচিত্র্য পিয়াসী লেখক আখতার হুসেন অনেকগুলো বই রচনা করেছেন। তার মধ্যে ছড়া ও কিশোর কবিতার উল্লেখযোগ্য বই হলো : হালচাল (১৯৭২), হৈ হৈ রৈ রৈ (১৯৭৭), উল্টাপাল্টা (১৯৭৮), রামধনুকের সাঁকো (১৯৮৫), প্রজাপতি প্রজাপতি (১৯৮৭), আমার দুটো ডানা (১৯৯৯), সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি (২০১৪), কাজে হব বড় (২০১৫), আকাশের হাতছানি (২০১৫), আমাদের ইশকুল হোক খেলাঘর (২০১৬) এবং মেলা মানে অবাধ স্বাধীনতা (২০২০)।
এই নিবন্ধে আমি আমার দুটো ডানা নিয়ে দুয়েকটি কথা বলার চেষ্টা করছি। গ্রন্থটির প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৯৯ সালে, এরপর অনিন্দ্য সংস্করণ প্রকাশিত হয় ২০১৩ সালে। এই সংস্করণের বইটির মূল্য রাখা হয়েছে ১০০ টাকা। বইয়ের প্রচ্ছদ ও অলংকরণ করেছেন শিল্পী ধ্রুব এষ। এটি উৎসর্গ করা হয়েছে সাহিত্য-সতীর্থ সুজন বড়ুয়াকে।
শুরুতেই বলে রাখা ভালো বইটি এককথায় অসাধারণ। গ্রন্থভুক্ত কবিতাগুলো কবির সুচিন্তিত আবেগ ও ভাবনার ফসল। এতে ছন্দের যেমন নিরীক্ষা আছে, তেমনি আছে ভাবনার বৈচিত্র্য।
আখতার হুসেন ছোটদের ভালোবাসেন, তাদের কথা ভাবেন অত্যন্ত গভীরভাবে। তাই তিনি তাদের জন্য সৃষ্টি করতে পেরেছেন হৃদয়স্পর্শী বেশ কিছু রচনা। শিশু-কিশোর মনস্তত্ত্ব তাঁর আয়ত্তে থাকার কারণে তিনি দারুণভাবে তুলে ধরতে পারেন তাদের মনের আকাক্সক্ষা, স্বপ্ন ও কল্পনা এবং বিশ্লেষণ করতে পারেন ছোটদের মনোজগতকে। আখতার হুসেন নিজে বাস করেন স্বপ্নের জগতে। স্বপ্নকে তিনি ভালোবাসেন, স্বপ্নেই তিনি ছোটেন, হাসেন, গান গেয়ে ওঠেন। তিনি বলেন :
স্বপ্ন আমার দূর অজানায় হারাবার হাতছানি
স্বপ্ন আমার স্বপ্ন শেষের মা’র প্রিয় মুখখানি।
স্বপ্নেই আমি রঙবেরঙের স্বপ্নের ছবি আঁকি
প্রাণপণে আমি স্বপ্নকে তাই কেবল বাঁচিয়ে রাখি।
স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখি আমি স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখি
স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখি আমি স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখি।
আখতার হুসেন সমাজ সচেতন শিশুসাহিত্যিক। অসম্ভব আজগুবি বিষয়কে কেন্দ্র করে চটুল ছন্দে নিছক মজা সৃষ্টির মাধ্যমে তিনি কিশোরদের বিনোদন দিতে চান না। তিনি অনুভব করেন, আজ যাঁরা ছোট, শিশু-কিশোর, আগামীতে তারাই হবে দেশ ও জাতির কর্ণধার। সমাজ বাস্তবতার নিরিখে তাদের গড়ে তুলতে চান তিনি। সমাজের ভালো-মন্দ সবকিছু সম্পর্কে অবগত করাতে চান। ছোটদের সজাগ ও সচেতন করে তোলাই কবির লক্ষ্য। তিনি বলছেন:
যারা আলসে এবং কুঁড়ে/ যারা যায় না কাছে দূরে/
সদাই ঘরের কোনে থাকে/ এবং ভয়ের ছবি আঁকে/
পথ হারাবার আশঙ্কাতে/ চোখ দুটোকে ঢাকে/
যারা নোংরা হবে বলে/ হাত দেয় না কাদা জলে/
যারা কেবলি হাত ধুয়ে/ সময় কাটায় বসে শুয়ে/
ঘরের পাশে আবর্জনা/ বাড়ায় রেখে থুয়ে
…
যারা নিজেরা স্বার্থ ছাড়া/ মোটে দেয় না কোন সাড়া/
দেখে পরের বিপদ ভারি/ দেয় অন্য পথে পাড়ি/ খোঁজ
নেয় না চাল ডাল নেই/ কার ঘরে কার বাড়ি।
তাদের সঙ্গে আড়ি আমার/ তাদের সঙ্গে আড়ি।
তাদের সঙ্গে আড়ি আমার/ তাদের সঙ্গে আড়ি।
[তাদের সঙ্গে আড়ি]ছোটদের জন্য রচিত আখতার হুসেনের প্রতিটি কবিতার আবেদন স্বতন্ত্র, অর্থবহ ও গভীর হৃদয়স্পর্শী। তাঁর কবিতার কিশোর ইশকুলে যায়, লেখাপড়া করে, ভূগোল পড়ে, ইতিহাস পড়ে, অঙ্ক করে; আবার দূরে মাঠে ছুটে বেড়াবার, আকাশে উড়বার জন্য তার মন ছোটে। আকাশ জুড়ে যখন মেঘের খেলা চলে, বাইরের প্রকৃতি যখন বিছিয়ে রাখে তার সৌন্দর্য, তখন তার মন ক্লাস ছেড়ে দূরে কোথাও ছোটে।
তখন খাঁচার পাখির মতো/ ছটফটে হয় মনটা, ইচ্ছে করে দপ্তরি হই/ দেই পিটিয়ে ঘণ্টা।
আবার হাট ফেরত লোকজন যখন নদীর ঘাটে এসে দেখে আকাশ জুড়ে মেঘ জমেছে, নৌকা আছে শুধু, মাঝি নেই; পরান মাঝি, রজব মাঝি-কেউ নেই। এমন সর্বনেশে ব্যাপার যখন ঘটতে থাকল, তখন কবিতার কিশোর আর বই নিয়ে বসে থাকতে চায় না, সে তখন লোকজনকে নদী পাড় করানোর জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে :
ইচ্ছেটা হয় তখন আমার/ ছুড়েই ফেলি বইটা
না থাক মাঝি, আমিই নায়ের/ ধরব কষে বৈঠা।
জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন, উপমাই কবিত্ব। আসলে কবিতায় উপমা বড় স্থান দখল করে আছে। অনেক সময় একটি উপমাই একটি কবিতাকে উৎরে দেয়। একটি কবিতা স্মরণীয় হয়ে থাকে একটি উপমার জন্যে, একটি চিত্রকল্পের জন্যে। আখতার হুসেন আনন্দ পান চিত্রকল্প, উপমা আর প্রতীক সৃষ্টি করে। আমরা জানি, সৃজনশীল প্রক্রিয়া যেমন জটিল তেমনি রহস্যময়। কবিতা রচনাকে শামসুর রাহমান নিজে রহস্যময় বলে স্বীকার করেছেন। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘রহস্যময় এ অর্থে বলছি যে একজন কবি নানাভাবে কবিতা লিখতে পারেন। কখনও এ রকম হয় যে একটি শব্দ হয়তো মঞ্জুরিত হচ্ছে কবির মনে, তৎপর সেই শব্দই হয়তো তাঁকে দিয়ে একটি কবিতা লিখিয়ে নিল। হয়তো তিনি অফিসে যাবেন কিংবা কোনও বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা দিতে যাবেন, সেই মুহূর্তে একটি লাইন ঝলছে উঠল তাঁর মনে। হয়তো সে মুহূর্তে লেখা হয় না, কিন্তু ওই পঙক্তি তাঁর মনে কাজ করতে থাকে, পরে সেটা কবিতা হিসেবে রূপায়িত হয়।’ [শামসুর রাহমান : নিঃসঙ্গ শেরপা/ সাক্ষাৎকার হুমায়ূন আজাদ]। অর্থাৎ কবিতা রচনায় থাকে একটা দীর্ঘ প্রস্তুতি। শব্দের সঙ্গে মনের, মনের সঙ্গে মস্তিষ্কের, মস্তিষ্কের সঙ্গে দৃশ্যায়নের যে সম্পর্ক―তার জন্য চাই অবিরাম প্রয়াস। আখতার হুসেন তেমন এক কবি, যাঁর কিশোর কবিতায় আমরা পাই গভীর অভিনিবেশ। সনিষ্ঠ আন্তরিকতা, শ্রম ও নিষ্ঠায় তিনি নির্মাণ করেন এক একটি পঙক্তি :
জানালা খুলে রাখি হাওয়ারা আসবে
চুলের উলুবন দুলবে, নাচবে।
রোদের ঝরনায় কেবল নাইব
গলাটি ছেড়ে গান মধুর গাইব।
…
বাইরে কত কিছু, অসীম ডাকবে
দুচোখে ও আকাশ ছবিটি আঁকবে।
স্রোতেরা চলবার নেশায় মাতাবে
পাখিরা সখ্যের মিতালি পাতাবে।
[জান্লা খুলে রাখি]আখতার হুসেন লেখালেখি তাঁর দায়িত্বের অংশ মনে করেন। ফলে তাঁর কবিতাগুলো আমরা তুলনা করতে পারি স্বচ্ছ স্ফটিকের মতো। কবিতার প্রতিটি পঙক্তি সংক্রামক আনন্দে ভরপুর। তাঁর কবিতার প্রতিটি ছত্রে ফুটে ওঠে কবিতার ঔজ্জ্বল্য। আমার কাছে যা সবচেয়ে আশ্চর্যের মনে হয়েছে, সেটি হলো তাঁর কবিতার সহজ-সরল প্রকাশ। স্বচ্ছ নির্মলতাই তাঁর কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
আখতার হুসেন প্রকৃতিপ্রেমী বলে শিশু-কিশোরদেরও প্রকৃতির পাঠ নিতে উদ্বুদ্ধ করেন তাঁর লেখার মাধ্যমে। ‘ওরাই আমার বই’ কবিতায় আমরা দেখি প্রকৃতিকে কীভাবে পাঠ করার প্রেরণা সঞ্চারিত করেছেন তিনি :
যখুনি কেউ জিগ্যেস করে খোকন সোনা কই
‘তোমার পড়ার বই’ ?
তখন আমি দেখাই তাদের দূরের সবুজ বন
ঘাস, ফুল আর শান্ত গৃহকোণ
দেখাই আমরা পালতোলা নাও, নদী
বইছে নিরবধি।
দেখাই আমি মেঠো পথের বাঁক
নীল আকাশে ডানা মেলা ওই যে পাখির ঝাঁক
দেখাই সঙ্গে সাদা এবং/ কালো মেঘের সারি
ওই যে গরুর গাড়ি।
…
দেখাই আমি দিগন্ত আর/ আকাশের ওই তারা
ভোরের শিশির, দখিন হাওয়ার/ মাতাল ডানা নাড়া।
দেখাই রঙিন প্রজাপতি/ ফুলের বাগান আর
হাট ও মেলার রঙবেরঙের / কত না সম্ভার।
‘খোকন সোনা কোথায় তোমার/ বইটি কোথায়, কই’ ?
বলছে যারা, তাদের বলি/ ওরাই আমার বই।
ওরাই আমায় পাঠ দিচ্ছে রোজ
আমি ছাড়া কে জানে তার খোঁজ ?
আমাদের বন, পাহাড়, নদী, আকাশ, পাখি, ফুল, ভোরের শিশির, দখিন হাওয়া তথা আমাদের প্রকৃতি থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। আখতার হুসেনের কবিতার খোকন ঠিকই জবাব দিচ্ছে: ‘ওরাই আমার বই। ওরাই আমায় প্রতিদিন পাঠ দিচ্ছে’। বাংলা শিশুসাহিত্যের অবিস্মরণীয় পুরুষ সুনির্মল বসুর জনপ্রিয় কবিতা ‘সবার আমি ছাত্র’―এর কথা এখানে উল্লেখ করতে চাই :
আকাশ আমায় শিক্ষা দিল উদার হতে ভাইরে
কর্মী হবার মন্ত্র আমি বায়ুর কাছে পাইরে।
পাহাড় শিখায় তাহার সমান
হই যেন ভাই মৌন-মহান
খোলা মাঠের উপদেশে দিল-খোলা হই তাইরে।
কিন্তু ভাবনা-কল্পনায়, চিন্তা-চেতনায়, ছন্দদোলায় ও আঙ্গিক বৈচিত্র্যে দুটো কবিতার ধরন আলাদা। আখতার হুসেন শুধু সেই কবিতায় নয়, অনেকগুলো কবিতায় তিনি প্রকৃতির গান গেয়েছেন। যেমন:
আমাদের ক্লাসঘর হোক না আকাশ
যেখানে আমরা হব মেঘেদের সাথি
যেখানে চলবে খেলা পাখিদের সঙ্গে
যেখানে চলবে খেলা রৌদ্রের সঙ্গে
কিংবা
পড়ার আছে বইয়ের চেয়েও/ বাইরে কত কিছু
কেবল ভাবি, যাই ছুটে যাই/ মেঘের পিছু পিছু।
কিংবা
গাছের পাতায় তুলব নাচন; নদীর নিথর বুকে
ঢেউয়ের দোলা তুলব মনের অসীম অপার সুখে।
সামনে চলার গানের ছন্দে অচল নায়ের পালে
জীবন এবং শক্তি দেবোই মাঝির বৈঠা-হালে।
[বাতাসের বাঁশি]নিসর্গের চিত্র অঙ্কনে আখতার হুসেনের জুড়ি মেলা ভার। তাঁর অসাধারণ একটি কবিতা ‘আহা জাফলং’। শিরোনামের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে মুগ্ধতা। এখানে ‘বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি-পরিবেশের অন্তরঙ্গ রূপ সৌন্দর্য’ অত্যন্ত সহজ-সরল ভাষায় ও ছন্দে বর্ণনা করেছেন তিনি। যা অপূর্ব চিত্রময়তায় অনবদ্য হয়ে উঠেে ছ:
সেখানে গেলেই নদীদের মতো
মনে বয়ে যাবে স্রোত অবিরত
কমলার রঙে রাঙা হবে মন
হবে উন্মুখ আর উন্মন।
পাখিদের সাথি হয়ে যাবে উড়ে
ছাড়িয়ে আকাশ দূরে-বহুদূরে।
মন হবে তরতাজা ফোটা ফুল
জল ভরা নদী, ওপচানো কূল।
ছুটবে মনের জমে থাকা জং
এক্ষুনি চলো সোজা জাফলং।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে ছোটদের মনোজগৎ আখতার হুসেনের কারায়ত্তে। শিশু কিশোর মনস্তত্ব বিশ্লেষণে তিনি সচেতন ও যত্নশীল। তাই তাঁর সৃষ্টিসম্ভারে ছোটদের জন্য যেমন রয়েছে উদার হওয়ার আহ্বান তেমনি রয়েছে ছোটদের সরল কোমল সুকুমার বৃত্তিগুলো বিকাশের উপযুক্ত উপাদান। কখনও মনোহারি ছন্দে মিষ্টি সুরে ভুলিয়ে দিয়েছেন ছোটদের মন। আবার কখনও উপহার দিয়েছেন প্রকৃতির অন্তরঙ্গ ও বিশ্বস্ত ছবি। সহজ সুন্দর শব্দমালায় গাঁথা সেসব ছবি আমাদের আন্দোলিত করে।
মন বসে না যখন কোনওই কাজে
আবোল তাবোল ভাবছি কী সব বাজে
বাইরে যেতেও ভাল্লাগে না মোটে
হাসির ছোঁয়া নেই কো যখন ঠোঁটে
আঁকতে গেলে হয় না ছবি আঁকা
চুপটি করে কেবল বসে থাকা
গাইতে গেলে সুর হারিয়ে ফেলি
কার কাছে যাই, কার সঙ্গে যে খেলি
এসব ভেবে অধীর ও উন্মন
ঠিক তখুনি মনে লাগে
কিছু করার রঙ
বাজলে দূরে দুপুরবেলার
ঘণ্টা ডিডং ডং।
[ঘণ্টা যখন বাজে]এই যে কিশোর মনের চপলতা, দূরের নদী বা আকাশ নিয়ে ভাবনা, পাখির মিষ্টি গান, নিঝুম পাড়া―সবই জীবন্ত হয়ে ধরা দেয় কবিতায়। ভাবনাগুলো একান্তভাবে কিশোর মনোলৌকিক। সরল কোমল সংস্কারমুক্ত উদার কিশোর মন গড়ে তোলার কাজে আজীবন ব্রতী কবি আখতার হুসেন। ছোটদের একাধারে আনন্দ ও শিক্ষাদান করে চলেছেন তিনি। ছোটদের মনকে সহানুভূতিশীল করার প্রয়াস চালিয়েছেন নানা কবিতার মাধ্যমে। নিজে ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানমনস্ক হওয়ার কারণে তিনি প্রতিষ্ঠা করতে চান যুক্তিবাদ, পাশাপাশি বাড়াতে চান একে অপরের প্রতি মমত্ববোধ। তাঁর ‘আমার দুটো ডানা’ কবিতাটি বর্তমান বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে রচিত অসামান্য কবিতা শিল্পকর্ম।
তুচ্ছ ছোটখাটো বিষয় নিয়ে সংসারে মা-বাবার মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়, কথা কাটাকাটি হয়, ঝগড়া হয়। এসব ভালো লাগে না খোকনের :
খেলতে কিংবা পড়তে তখন মোটে
ভাল্লাগে না, কেমন অবশ লাগে
ইচ্ছেটা হয় ঘরের যত কিছু
ভেঙে ফেলি এক নিমিষে রাগে।
তাই তো সেদিন না থাকতে পেরে
ফাটিয়ে গলা ঘর কাঁপিয়ে বলি―
‘বড় হয়ে তোমরা যদি এমন
ঝগড়া করো এবং দলাদলিও
আমরা ছোটর দল তাহলে বল
কেমন করে শান্তি পাব মনে
কেমন করে বলবে আমাদের
ঝগড়াঝাটি করো না কুক্ষণে’ ?
মা ও বাবা হঠাৎ অবাক হয়ে
আমায় বুকে গভীর করে ধরে
বলেন, ‘খোকা এমন কথা তুই
শিখলি কোথা থেকে কেমন করে’ ?
আমি কোনও জবাব দেবার আগে
মা ও বাবা পরস্পরের পানে
হাসিমুখে চেয়ে বলেন, ‘আরও
নয় ঝগড়া, এসো মিলি গানে’।
আঁধার মলিন ঘরের মাঝে ফের
ডাকল যে বান তীব্র আলোকের।
আমি যেন ছোট্ট পাখির ছানা
মা ও বাবা আমার দুটো ডানা।
আখতার হুসেনের কবিতার অন্যতম আকর্ষণ হলো দেশপ্রেম। আমাদের মহান ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ-স্বাধীনতা ও স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর কবিতা উপজীব্য হয়ে এসেছে নানা সময়। ভাষা মানব জাতির শ্রেষ্ঠ সম্পদ। সেই মায়ের ভাষাকে রক্ষার করার জন্য ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আত্মাহুতি দিয়েছিল আমাদের জাতির সেরা সন্তানরা। তাদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল রাজপথ, রক্তাক্ত হয়েছিল এ বাংলা। তাদের বিশাল ত্যাগের বিনিময়ে আমরা আমাদের ভাষা রক্ষা করতে পেরেছি। তাঁদের স্মরণে আখতার হুসেন লিখলেন অমূল্য রচনা। বলেছেন : যারা দিয়ে গেছে ভাষার জন্য/ তাদের সজীব প্রাণ তারা নাই চাক আমাদের কাছে/ এতটুকু প্রতিদান।
অন্যদিকে একুশের সিঁড়ি বেয়ে এসেছে স্বাধীনতা। ১৯৫২ সালে মাতৃভাষার জন্য বিশাল আত্মত্যাগের মাধ্যমে বাঙালির জাতীয় মানসে যে চেতনার বীজ বপন করা হয়েছিল, সেই চেতনারই চূড়ান্ত রূপ পরিলক্ষিত হয় একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে। সেই মুক্তিযুদ্ধে তিরিশ লাখ শহিদের আত্মত্যাগ ও রক্তনদীর জলটুঙি পার করার পর বাংলার আকাশে উঠলো স্বাধীনতার লাল টকটকে সূর্যটি। আখতার হুসেনের কবিতায় এ ত্যাগের চিত্র ফুটে উঠেছে চমৎকারভাবে।
স্বাধীনতা ও সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অস্তিত্বের সঙ্গে যে নামটির সম্পৃক্তি অনিবার্য, তিনি হলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু অভিন্ন সত্তা। সেই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আখতার হুসেন লিখেছেন অনেকগুলো কবিতা। ‘দুই বাংলার কবিতায় বঙ্গবন্ধু’ নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকলন সম্পাদনাও করেছেন। ‘আজ থেকে তুই নিজে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর’ নামে যে কবিতাটি তিনি লিখেছেন, সেটি উভয় বাংলায় ব্যাপক সমাদৃত হয়েছে। এছাড়া নানা কবিতায় বঙ্গবন্ধুকে তুলে ধরে আগামী প্রজন্মকে তাঁর চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার প্রেরণা জোগান। তিনি লিখলেন :
সারাদিন আমি খেলি কত খেলা
খেলতে খেলতে বসে যায় মেলা
কখনও আমার হয় প্রিয় সাথি
হরিণের দল পেতলের হাতি
পাখিদের ঝাঁক বাঁশিঅলা আর
রবীন্দ্রনাথ নজরুল তার
কবিতা ও সুরে মুখরিত করে
সেই সঙ্গে তার মন্ত্রিত স্বরে
ভরে ওঠে এই প্রিয় খেলাঘর
অমর অজয় শেখ মুজিবর।
[তুমি আছ বলে আমি আছি তাই]আবদুল মান্নান সৈয়দ বলেছেন, ‘সমস্ত সাহিত্য-তার যতগুলো মুগ্ধ শাখা: কবিতা, গল্প, নাটক, উপন্যাস সবকিছুই গানের দিকে চলে যেতে চায়, গানের ভিতরে পেরেকের মতো আটকে যেতে চায় শিল্প, তখনই তার সার্থকতা’। [চেতনায় জল পড়ে শিল্পের পাতা নড়ে। পৃ. ২১] আখতার হুসেনের কবিতা গীতিময়। তাঁর প্রায় সব কবিতা গানের দিকে চলে যেতে চায়। তাঁর প্রতিটি পঙক্তি এত সজীব, এত প্রাণবন্ত এবং এত প্রিয় যে বারবার পড়বার ইচ্ছে জাগে। দীর্ঘ অনুশীলনে ও সাধনায় তিনি গড়ে তুলেছেন সম্পূর্ণ নিজস্ব একটা রচনাশৈলী। অন্য গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত একটি কবিতার কথা এখানে উল্লেখ করতে চাই :
বাইরে ছুটে যাব বাড়িয়ে দুটো পা
হাহ্হা হা হা হা হাহ্হা হা হা হা!
…
দুচোখ মেলে দিয়ে দেখব দৃশ্য
কাছের হবে ওই দূরের বিশ্ব।
তাইতো খুলে রাখি জান্লা দোর যে
কখন ডাক দেবে দৃপ্ত ভোর যে!
বাড়িয়ে রাখি আগে তাইতো দুটো পা
হাহ্হা হা হা হা হাহ্হা হা হা হা!
প্রতিটি প্যারার শেষে হাহ্হা হা হা হা যুক্ত করে যে সুর কবিতায় প্রদান করা হয়েছে, তা গানের মতোই মধুর। কাব্যভাব ও রসচেতনায় আখতার হুসেন যেমন একনিষ্ঠ সাহিত্যস্রষ্টা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তেমনি তাঁর ছন্দবোধও অসাধারণ।
রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে প্রদত্ত এক ভাষণে বলেছিলেন: কবিতার বিশেষত্ব হচ্ছে তার গতিশীলতা। সে শেষ হয়েও শেষ হয় না। গদ্যে যখন বলি ‘একদিন শ্রাবণের রাতে বৃষ্টি পড়েছিল’, তখন এই বলার মধ্যে খবরটা ফুরিয়ে যায়। কিন্তু যখন বললেন :
রজনি শাঙন ঘন ঘন দেয়া গরজন
রিমিঝিমি শবদে বরিষে।
তখন কথা থেমে গেলেও বলা থামে না। এ বৃষ্টি যেন নিত্যকালের বৃষ্টি, পঞ্জিকা-আশ্রিত কোনও দিনক্ষণের মধ্যে বদ্ধ হয়ে এ বৃষ্টি স্তব্ধ হয়ে যায়নি। খবরটির ওপর ছন্দ যে দোলা সৃষ্টি করে দেয় সে দোলা খবরটি প্রবহমান করে রাখে।
[শান্তিনিকেতন পত্রিকা, আষাঢ় ১৩৩০/ ছন্দ]আখতার হুসেনের কবিতার বিশেষত্ব তাঁর গতিশীলতা। স্বরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্ত ছন্দের নানারকম প্রয়োগের কারণে তাঁর কবিতায় পাওয়া যায় ছন্দ-বৈচিত্র্য। আহসান হাবীব এবং আল মাহমুদের মতো অন্ত্যমিলহীন কবিতা লিখেছেন স্বরবৃত্ত ছন্দে। আবার অন্ত্যমিলহীন লিখেছেন মাত্রাবৃত্ত ছন্দেও।
মাত্রাবৃত্ত ছন্দে ৪ মাত্রা পর্ব থেকে শুরু করে ৮ মাত্রার পর্বে তিনি কবিতা রচনা করেছেন স্বচ্ছন্দে। সবচেয়ে অবাক করার বিষয়, ‘অ্যারোপ্লেন’ কবিতাটি তিনি পুরোপুরি নতুন আঙ্গিকে আমাদের উপহার দিয়েছেন :
আহা উড়ছি
দেশ ঘুরছি
গানে গানে মন উন্মন
দিন-রাত্রি
কত যাত্রী
বুকে বই, কত আয়োজন।
নেই ভ্রান্তি
পথ-ক্লান্তি
শ্রান্তির কোনও লেশ নেই
কতো দৃশ্য
এই বিশ্ব―
জুড়ে আছে তার শেষ নেই।
৫+ ৫+ ১০ মাত্রার পঙক্তি বাংলা কিশোর কবিতায় সম্পূর্ণ নতুন। মাত্রাবৃত্তে এ ধরনের পর্ববিন্যাস খুব একটা দেখা যায় না। এখানে যে সুর ধ্বনিত হয়েছে তা স্বতন্ত্র; মৌলিক। আসলে ‘সুর পদার্থটাই একটা বেগ। সে আপনার মধ্যে আপনি স্পন্দিত হচ্ছে। কথা যেমন অর্থের মোক্তারি করবার জন্যে, সুর তেমন নয়, সে আপনাকেই আপনি প্রকাশ করে। বিশেষ সুরের সঙ্গে বিশেষ সুরের সংযোগে ধ্বনিবেগের একটা সমবায় উৎপন্ন হয়। তাল সেই সমবেত বেগটাকে গতিদান করে। ধ্বনির এই গতিবেগে আমাদের হৃদয়ের মধ্যে যে গতি সঞ্চার করে সে একটা বিশুদ্ধ আবেগ মাত্র, তার যেন কোনও অবলম্বন নেই’।
[ছন্দের অর্থ/ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]আখতার হুসেনের কবিতার তালটাই মোহনীয়। অ্যারোপ্লেনের মতোই যেন উড়ছে ছন্দটা। তাতে গতি আছে, বেগ আছে, আছে নির্মল আনন্দ।
আখতার হুসেন ছন্দ মিলের কারুকার্যের সঙ্গে কিশোর মনের ভাবনার সমন্বয় ঘটিয়েছেন তাঁর কবিতায়। তাঁর উপস্থাপনভঙ্গি ভীষণ অন্তরঙ্গ। অবান্তর, আজগুবি বা অবাস্তব বিষয়কে সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে উপজীব্য করেন নি কখনও। তাঁর সমগ্র সাহিত্য কর্মে ঘটেছে রুচিশীল চিন্তা চেতনার প্রকাশ। আখতার হুসেন আমাদের দায়িত্বশীল ও আদর্শস্থানীয় লেখক। শিশু-কিশোরদের মনের যথার্থ বিকাশে তাঁর রচনার আবেদন তাৎপর্যবহ।
লেখক : শিশুসাহিত্যিক