আর্কাইভবিশ্বসাহিত্যসাক্ষাৎকার

‘আমি কবিতা লেখা শেষে নিজেকে তার পাঠক হিসেবে বিবেচনা করি’ : নোবেলজয়ী কবি লুইস গ্লুক

বিশ্বসাহিত্য : অনুবাদ সাক্ষাৎকার

২০২০ সালে নোবেলজয়ী কবি লুইস গ্লুক-এর সঙ্গে আলাপচারিতায় হেনরি কোল

বাংলা অনুবাদ : রঞ্জনা ব্যানার্জী

[২০২০-এর মার্চের শুরুতে, দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার ক্লেয়ারমন্ট ম্যাক্কেনা কলেজে লুইস গ্লুক এসেছিলেন, এই কলেজে আমি পড়াই। কোভিডের ভয়ে ছোট প্লেনে চেপে তিনি আমাদের আঞ্চলিক বিমানবন্দরে আসতে রাজি হচ্ছিলেন না। ফলে বার্কলি থেকে আমি গাড়ি চালিয়ে তাঁকে নিয়ে এসেছিলাম। বেশ ক বছর ধরেই শীতকালে তিনি বার্কলিতে একটি ভাড়া বাড়িতে থাকছিলেন। আমাদের ছয় ঘণ্টার সফরের সময় রাস্তায় খাওয়ার জন্য তিনি পাম্পারনিকেল বেগেল, আপেল এবং পনির বেঁধে নিয়েছিলেন। এছাড়া গুইসেপ ভার্দির রিগোলেতো ওপেরা, বারটল্ট ব্রেখটের থ্রি পেনি অপেরা এবং বেলজিয়ামের আধুনিক চেঁসঁ মাস্টার জাক ব্রেলের গানের সিডি  নিয়েছিলেন। অনেক দিন আগে গ্লুক এবং তাঁর প্রাক্তন স্বামী এই ধরনের সফরকালে অপেরা শুনতেন, অবশ্য বহু বছর বাদে সেইবারই প্রথম তিনি এমন রোডট্রিপে বেরিয়েছিলেন। গানগুলো তাঁর আগাগোড়া মুখস্থ, মারিয়া কোলাসের কণ্ঠের তেজ যেমন তিনি চেনাচ্ছিলেন তেমনি ব্রেলের সংগে গলা মেলানোর সময় তালি দিয়ে তাল ঠুকছিলেন। ক্যলিফোর্নিয়ার কেন্দ্রে কাঠবাদামের চমৎকার বাগানগুলোতে সবে কুঁড়ি আসতে শুরু করেছে, গতিশীল হাইওয়ের দুই ধারে তাদের প্রভা যেন গড়িয়ে চলছিল। ক্ল্যারমন্টে খামারিদের হাটে লুইস তাঁর মেয়েবেলা এবং ক্ষুধামান্দ্য রোগ নিয়ে কথা বলতে বলতে নাস্টারটিয়াম এবং দুই ঝুড়ি কমলালেবু  কিনেছিলেন এবং জানিয়েছিলেন  ক্ষুধামান্দ্যকালীন চরম সময়ে কীভাবে তাঁর ওজন কেবল সত্তর পাউন্ডে নেমে গিয়েছিল। আমি বলেছিলাম, ‘কিন্তু লুইস, আপনি তো খাবার ভালোবাসেন, খাদ্যরসিক’, উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘ক্ষুধামান্দ্যের রোগীদের সকলেই খাবার ভালোবাসে’। যে হোটেলে তিনি উঠেছিলেন সেটি ছিল স্যাঁতস্যাঁতে, অপরিচ্ছন্ন, তা নিয়ে তাঁর কোনও অভিযোগ ছিল না। তিনি বিছানার চাদরের ওপরে বালিশ তুলে বসে তাঁর মুঠোফোনে লাগাতার আসা ইমেইলগুলোর উত্তর দিচ্ছিলেন।

কয়েক মাস আগে গ্লুক সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। সুইডিশ একাডেমি খুব ভোরে  তাঁকে ফোনে এই অনন্য সংবাদটি দিয়ে জানিয়েছিল যে, ঠিক পঁচিশ মিনিট পরে বিশ্ববাসীর কাছে এই সংবাদ পৌঁছে যাবে। তিনি প্রথমেই পশ্চিম উপকূলে থাকা তাঁর পুত্র নোয়াকে ফোন দিয়েছিলেন এবং রাত বিরেতে ফোনের আতঙ্ক কাটিয়ে ধাতস্থ হওয়ার পরে  সে আনন্দে ভাসছিল। এরপরেই তিনি তাঁর প্রিয় বন্ধু ক্যাথরিন ডেভিস এবং তার পরে তাঁর প্রিয় সম্পাদক জোনাথন গ্যালাসিকে সুসংবাদটি দিয়েছিলেন। সংবাদকর্মীরা দ্রুত ম্যাসাচুসেটস প্রদেশের ক্যাম্ব্রিজ শহরে তাঁর অপরিসর  কানাগলিটির মুখে হাজির হয়ে গিয়েছিল এবং ‘আপনি প্রায়ই মৃত্যু নিয়ে লেখেন কেন ?’―এ ধরনের প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে তিনি হয়রান হয়ে গিয়েছিলেন।

লকডাউনের কারণে, তাঁর আবাসনের পিছনের উঠানেই পদক প্রদানের আনুষ্ঠানিকতা সারা হয়েছিল। সেই দিন  ধূসর মেঘের আড়ালে সূর্য ঢাকা ছিল। হাল্কা তুষার আর হিমের আস্তরণ ছিল উঠানজুড়ে। জোর হাওয়া বইছিল। ঘাসের ওপর ছোট একটা ফোল্ডিং টেবিল বসানো হয়েছিল। টেবিলে বিছানো ঘিয়ে রঙা টেবিল ক্লথের ওপর সোনার পদকটি ঝলমল করছিল। আমি গ্লুকের দোতলার বারান্দা থেকে অনুষ্ঠানটি দেখছিলাম। তিনি কালো বুট, কালো স্ল্যাক্স, কালো ব্লাউজ, চওড়া ভাঁজের কলারের কালো চামড়ার কোট এবং আঙুলবিহীন দস্তানা পরেছিলেন। একজন ক্যামেরাম্যান তাঁকে বেশ কয়েকবার পদকটি হাতে তুলতে বলছিল এবং তিনিও নির্দেশ মান্য করছিলেন। তার সদ্য কাটা চুল হাওয়ার তোড়ে মুখের উপর লুটাচ্ছিল। সুইডিশ কন্সাল জেনারেল ব্যাখ্যা করছিলেন, নিয়মমতে পদকটি সুইডেনের রাজার হাত থেকে গ্রহণ করবার কথা গ্লুকের, কিন্তু করোনাকাল হওয়ায় তিনি রাজার পক্ষে দায়িত্ব পালন করছেন। কনস্যুলেট সাদা অ্যামেরিলিসের বিশাল তোড়া পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু গ্লুকের মনে হয়েছে, এমন আভরণহীন শীতের পটভূমিতে ওরা বেমানান, তাই ছোট টেবিলটি থেকে ওদের সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। অনুষ্ঠানটি শেষ হতে পাঁচ মিনিটের বেশি সময় লাগেনি এবং পুরোটা সময় তিনি চুপচাপ কাঁপছিলেন এবং অবশেষে তিনি ঘরের ভেতরে যাওয়ার ইচ্ছে জানিয়েছিলেন।

শুরু থেকেই গ্লুক তাঁর কাজে ব্লেইক, কিটস, ইয়েটস এবং এলিয়টের প্রভাবের কথা উল্লেখ করেছেন―সেইসব কবি যাঁদের  কাজ ‘শ্রোতাদের ব্যাকুল করে’। তাঁর কাছে কবিতা হলো শাঁখের ভেতরে লুকিয়ে থাকা বার্তার মতো যা কানের কাছে ধরলেই সর্বজনীন সকল অভিজ্ঞতার বিশ্বস্ত যোগসূত্র তৈরি হয় : বয়ঃসন্ধির টানাপোড়েন, বৈবাহিক প্রেম, বৈধব্য, মধ্যবয়সের নিষ্ক্রিয়তা, বার্ধক্য এবং মৃত্যু। তিনি বলেন  জীবন ও মৃত্যু এবং  দেহ ও আত্মার মাঝখানে একটি সছিদ্র পর্দা আছে। তাঁর স্বকীয় লিখনশৈলী, যা লৌকিক ভাষা এবং বাচনের সম্মোহনী গতিসম্পন্ন তা  নানা প্রজন্মের কবিদের মনোযোগ কেড়েছিল, ঠিক যেমনটি কেড়েছিল  আমার মতো বাইশ বছরের নবীন কবিরও। তাঁর রচনায়  কবিতার ভাষা কখনই কবিতার আবেগকে ছাপিয়ে যায়নি। মহান কবিদের মতো তিনিও মুগ্ধ হয়েছেন, তিনিও ‘সেই ক্ষণ―যা শোক, আকাক্সক্ষা, পৃথিবীর সৌন্দর্যের জন্ম দেয়’, তাতে নিমগ্ন হয়েছেন।

যে কথোপকথনের ভিত্তিতে এই সাক্ষাৎকারটি তৈরি হয়েছে তার বেশির ভাগই দুই বছর আগে গ্লুকের পরে উল্লিখিত সফরের সময়কার, যার মধ্যে সান গ্যাব্রিয়াল পর্বতমালাকে পটভূমি করে খোলা ছাদের আয়োজিত একটি সেমিনার এবং ম্যারিয়ন মাইনর কুক অ্যাথেনিয়ামের স্ট্যান্ডিং-রুম-অনলি-রিডিংয়ের দিনটিও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে―এই বিশেষ দিনটিতে তিনি ছাত্রদের সঙ্গে খাবার খেয়েছিলেন এবং সেই অভিজ্ঞতা তাঁকে অপার আনন্দ দিয়েছিল। জন্ম-থেকে-মৃত্যু―ধরনের বিশদ সাক্ষাৎকারে তাঁর কোনও আগ্রহ ছিল না, তবে তাঁর নতুন বই, শিক্ষকতা, এবং লিখনশৈলী নিয়ে আলাপ করতে তিনি ভালোবাসতেন এবং আমার কাজের অগ্রগতির স্বার্থে তাঁকে পাঠানো এই সাক্ষাৎকারের খসড়াটি তিনি পড়েছিলেন। ১৩ অক্টোবর ২০২৩ তাঁর অপ্রত্যাশিত মৃত্যু হয়। অতঃপর আমাদের কথোপকথনের পাতাগুলো আমি রিভিউর সঙ্গে সহভাগ করি, কারণ তাঁর সঙ্গে কথা বলার সকল দুয়ার রুদ্ধ হয়ে গেছে চিরতরে।

হেনরি কোল

কবি

সাম্প্রতিক বই: গ্র্যাভিটি অ্যান্ড সেন্টার: সিলেক্টেড সনেটস, ১৯৯৪- ২০২২.]

হেনরি কোল : আমি কি ঠিক বলছি যে আপনি দুই ধরনের বই লেখেন―এক.দুর্দমনীয় গীতিকবিতার সংকলন, অন্যটি গদ্যের কিছু বিশেষত্বযুক্ত, আখ্যান অনুসরণে ?

লুইস গ্লুক : হ্যাঁ আমারও মনে হয় আমি এই দুই ধারার ভেতরে ঘোরাফেরা করছি। আমি এমনও মনে করি যে আমার বইগুলো হয় উল্লম্বিক অক্ষে ক্রিয়াশীল থেকে হতাশা অতিক্রম করে অথবা অনুভূমিক তলে সামাজিক কিংবা সাম্প্রদায়িক বিষয়ক হয়, সাধারণত যে সব উপাদান আপনি উপন্যাসের ক্ষেত্রে প্রত্যাশা করেন, কবিতায় নয়। যেমন অ্যাভারনো (২০০৬) বইটির কথা ধরা যাক, এটি সার্বিক অর্থেই উল্লম্বতলে চলেছে। অন্যদিকে আ ভিলেজ লাইফ (২০০৯) একদম উল্টা―বিভিন্ন চরিত্র জীবনের বিভিন্ন সময়ে উদয় হচ্ছে, ভূমধ্যসাগরের কোনও এক অখ্যাত ছোট গ্রামের লোকজন, যদিও ছাঁচটি ভারমন্ট প্রদেশের প্লেইনফিল্ডের, যেখানে আমি দীর্ঘকাল বাস করেছিলাম। নিজেকে আবিষ্কারের জন্যে এইসব প্রতিস্থাপন জরুরি।

হেনরি কোল : আপনার যে বইগুলো হতাশা থেকে উৎকর্ষের পথে নেয়, তাতে পরমের কোনও ভূমিকা আছে কি ?

লুইস গ্লুক : আপনি বলতে পারেন যে, আমার এই ঈশ সাধারণত উল্লম্বিক বইগুলোর ওপরের অংশে থাকে। নিচের নিকষ অংশটিতে মানবজাতি হাহাকার করছে―ঈশ্বর অনুপস্থিত। যেহেতু আমি ধার্মিক মানুষ নই, তাই পরমজনিত কোনও শব্দ ব্যবহার করব না। কিন্তু আমি মনে করি ওপরের দিকে উদ্ধার পাওয়ার এবং নিচের দিকে পরিত্যক্ত হওয়ার মতো একটা অনুভূতি কাজ করে।

হেনরি কোল : বইকে একটি অখণ্ড জিনিস হিসেবে দেখানোর ধারণাটা কোথা থেকে পেলেন ?

লুইস গ্লুক : শুরু থেকেই বইকে আমি এভাবেই দেখেছি। আমি তখন ছোট কবিতা লিখছিলাম, কিন্তু আমি চাইছিলাম একটা আবহ নির্মাণ করতে। কোনও বিশেষ বিষয় কিংবা লক্ষ্যের বিপরীতে আমি একটা আবহ প্রস্তাব করতে চাইছিলাম, একইভাবে কোনও বিশেষ অবস্থানের বিপরীতে ধ্যান কিংবা অনুসন্ধান। অবশ্যই, আমার প্রথম দিককার বইগুলোতে এটি স্পষ্ট হয়নি, যদিও আমি কবিতাগুলির সন্নিবেশের ক্রম এবং তাদের অন্তর্নিহিত অর্থের পরিধি এবং গতিপথ নিয়ে যথেষ্ট ভেবেছি। আমার এই মনোভাব আরারাত (১৯৯০)-এ অনেক বেশি দৃশ্যমান। আমার মনে আছে আমি যখন প্রথম কবিতাটি লিখেছিলাম―তা ছিল সব একঘেয়ে ঘোষণাপত্রের মতো বাক্যে ভরপুর, কোনও রূপক বা দৃশ্যকল্পের বালাই নেই। আমার মনে হয়েছিল এটি কেবল একটি সম্পূর্ণ বই হিসেবেই উৎরে যেতে পারে, অর্থাৎ এর একতলীয় ভাষা পিছনে এবং চারপাশে জড়িয়ে থাকবে, একটা জগতের মতো।

হেনরি কোল : তাহলে ফেইথফুল অ্যান্ড ভারচুয়াস নাইট (২০১৪)-এর বেলায় এর ব্যাখ্যা কী  ?

লুইস গ্লুক : ফেইথফুল অ্যান্ড ভারচুয়াস নাইট-এর অভিযানটি ছিল দুঃসাহসিক এবং দ্বিগুণ কলেবরের, যেটি  অনুভূমিক অক্ষ ধরে এগিয়েছে। প্রথমত অতি দীর্ঘ কবিতা, যা হতে হয়েছে―শিল্প এবং শিল্পসৃষ্টির বিষয়, বিষয় হিসেবে একে ভাবতে আমার সবসময় পরিতাপ হয়, যদিও এখানে বক্তা শুরুতে শিশু থাকেন, এবং আমার মনে হয় সেই কারণেই এটিতে এক ধরনের মৌলিকতা এসেছে। আরেকটা জিনিস আমি আবিষ্কার করেছিলাম, সেটি হলো গদ্য কবিতা। মার্ক স্ট্র্যান্ডের অলমোস্ট ইনভিসিবল পড়ার আগ পর্যন্ত আমি কবিতার এই ধারাটি বুঝতে সক্ষম হইনি, এই বইটি আমার এই বিষয়ের জ্ঞানকে ঝালাই করেছিল। আমার মনে হয়েছিল বহুদিন পরে মুগ্ধ হওয়ার মতো কিছু গদ্যকবিতা পড়লাম আমি, তবে এটি মনে হয়নি যে আমি অমন কবিতা লিখতে পারব। আমার বইটি তখন প্রায় শেষের পথে কিন্তু এটি কেমন যেন অসাড় মনে হচ্ছিল, অন্যরকম কিছু একটার কমতি মনে হচ্ছিল। আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু বললেন, ‘তুমি কাফকার অণুগল্পগুলি পড়ো না কেন, যেগুলি গদ্য কবিতার চালে লেখা ?’ কাফকার অণুগল্পগুলি আমার পড়া ছিল, কিন্তু আমি তাঁদের উপদেশ গ্রহণ করি যাঁদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা অপরিসীম। এবং যখন আমি গল্পগুলো পুনঃপাঠ করলাম আমার কাছে গল্পগুলোকে তেমন ভালো মনে হলো না, কিন্তু মনে হলো ওহ্ আমিও এমন লিখতে পারি। এবং আমি লিখলাম, ভীষণ আনন্দময় ছিল সেই অভিজ্ঞতা। তবে এরপরে কিছু সময়ের জন্য কীভাবে পঙ্ক্তি লিখতে হয় তা আমি ভুলে গিয়েছিলাম―বলা চলে এটি সেই যাত্রার ক্ষুদ্র বিপর্যয়…

হেনরি কোল : আপনি কি আপনার বন্ধুদের সম্পর্কে আরেকটু বলবেন, কীভাবে তাঁরা আপনার কাজকে প্রভাবিত করেন ?

লুইস গ্লুক : আমার বেশির ভাগ বইই আমার বন্ধুদের উৎসর্গ করা। বন্ধুদের ঘিরেই আমার জীবন। তাঁরা আমার জীবনে অনিবার্য। বন্ধুদের দেখব বলে আমি আমার জীবনের বাঁক পাল্টেছি। তাঁরা সকলেই বেশ অন্য রকম। আমি ওদের ছাড়া নিঃস্ব। সম্প্রতি আমি একটি ছোট বাড়ি কিনেছি ভারমন্টে, যেখানে আমার সবচেয়ে পুরানো বন্ধুরা এখনও বাস করছেন। আমার  অন্যতম প্রিয় বন্ধুটি  এখন দু মিনিটের দূরত্বে থাকেন। দীর্ঘদিন আমি ক্যাম্ব্রিজে থেকেছি এবং সেইসময় আমি যা লিখতাম সবই তাঁকে দেখাতাম, যদিও সে অন্যখানে থাকত, কিন্তু এখন অন্য রকমের বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছে এবং মনে হচ্ছে এটি এমন হওয়ার জন্যে অপেক্ষা করছিল। আমার এই বন্ধুতা নানা শহরে থাকা বন্ধুদের বেলায় এমনই। আমাদের মাঝে সময় এবং ভৌগোলিক দূরত্ব থাকতে পারে কিন্তু যখনই আমাদের দেখা হয় মনে হয় যেন সময় স্থির হয়েই ছিল। আমি বলতে চাইছি সময় তো নিশ্চিত পাল্টেছে, চারপাশের অনেক কিছু বদলেও গেছে কিন্তু যখন আমাদের দেখা হয় আমরা আমাদের চারপাশের যা ঘটছে তা নিয়ে আগের মতোই কথায় মেতে উঠি। এবং সেটিই আমার জীবনের অনুপম সত্য।

হেনরি কোল : উইন্টার রেসিপিস ফ্রম দ্য কালেক্টিভ আপনার সাম্প্রতিক কবিতার বই। এই বইয়ের নাম কবিতাটি পড়তে গিয়ে আমি ভাবছি আপনি কি কখনও দলবদ্ধ কিংবা আশ্রম বা কোনও সম্প্রদায়ের সংগে জীবনযাপন করেছেন ? এবং আপনি কি এই দীর্ঘ কবিতার স্তবকগুলো যে ক্রমে সাজানো হয়েছে ঠিক সেইভাবেই লিখেছিলেন ?  

লুইস গ্লুক : দলবদ্ধ কিংবা আশ্রম বা কোনও গোষ্ঠীর ভিতরে আমি থাকিনি। তবে প্লেইনফিল্ডের কাটানো সময়  এই ধরনের যাপনের অভিজ্ঞতার কাছাকাছি হতে পারে―তীব্র আবহাওয়া গ্রামটিকে এমন ধরনের দলবদ্ধ জীবন-যাপনে বাধ্য করত। সেই কঠিন সময়ে সকলের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস সংগ্রহ করা হতো এবং অন্যদের চাহিদার ওপর নজর রাখা হতো আর সেই দীর্ঘ শীতকাল, যা অবশ্যি ভয়াবহভাবে এখন আর তত দীর্ঘ নয়, আমরা পরস্পরের সহযোগিতায় পার করতাম। এই কবিতার সব কিছুই আসলে কল্পনাপ্রসূত―জনগোষ্ঠী, শ্যাওলা-সংগ্রহ এবং তাকে গাঁজানো, বনসাই চাষ কিংবা চৈনিক গুরু―সব কিছু। খণ্ডগুলো দীর্ঘ বিরতি দিয়ে লেখা হয়েছিল, অন্যান্য লেখার ফাঁকে এবং সম্ভবত বেশ কয়েক বছর জুড়ে একটানা তেমন কিছু নয়া লেখার কারণেও এতে ছেদ পড়েছিল। প্রথম অংশটি অবশ্যি প্রথমই ছিল।

হেনরি কোল : আপনি কি প্রতিদিন লেখেন ? আপনার কবিতা কি দীর্ঘযাপনের অভিজ্ঞতার ফসল ?

লুইস গ্লুক : লেখালেখির জন্যে আমার কোনও বাঁধাধরা ছক বা সময়সূচি নেই। এই ধরনের নিয়মবদ্ধতা আমাকে উদ্বিগ্ন করে কারণ এমন অনেক দিন গেছে যখন আমি টাইপরাইটার সামনে নিয়ে এবং তার ওপরের সাদা পৃষ্ঠাটির দিকে চোখ পেতে বসে থেকেছি, একটি অক্ষরও লিখিনি। আমার জন্যে এটি বিধ্বংসী  অভিজ্ঞতা। সেই কারণে যখনই শব্দগুচ্ছ আমার মগজে জড়ো হয়―তখনই আমি ঝটপট কাগজে লিখে ফেলি এবং তারপর কিছু সময় পরে  টাইপরাইটারের সামনে সেই লেখা নিয়ে বসি।

আমার মনে হয় না আমি ক্রান্তিকালীন সময়ে কিছু লিখতে পারি। আমার ক্ষেত্রে যা হয় কিছু একটা থেমে যায়, কিংবা শেষ হয়ে যায় অথবা  রুদ্ধ হয়ে যায়। তখন আমার আর কিছুই বলবার থাকে না―সেটি যা-ই হোক না কেন তার সকল সঞ্চয় যেন আমি ফুরিয়ে ফেলেছি, আধারটি আবার পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত আমাকে অবশ্যই  অপেক্ষা করতে হয়। এই ধরনের স্তোকই দিই সচরাচর আমরা নিজেদের, কিন্তু এই আধার আবার পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত চুপচাপ অপেক্ষার অভিজ্ঞতাটি মোটেও প্রত্যয়ী নয়। বরং ঊষর, ক্ষয় হয়ে যাবার, এমন কি আতঙ্কের অভিজ্ঞতা বলা যেতে পারে―যে কাজটি আপনি করতে চাইছেন তা কিছুতেই পেরে উঠছেন না। এই ধরনের ভয়াবহ সময়ের ভিতর আমি বহুবার গেছি, যা ঘটেছে বলে মনে হচ্ছে, কিংবা যা অতীতে ঘটেছিল তা হলো এক-দুই বছর পরে কিংবা যখনই হোক অন্য একটি ধ্বনি উঠে আসে―এবং এটি সত্যিকার অর্থেই ভিন্ন রকমের স্বর। একদম আনকোরা ধারা কিংবা কবিতাভাবনা, অলক্ষ্য থেকে লৌকিকে নেমে আসা কোনও  স্বরবাণী। হঠাৎ করেই এমন একটি পঙ্ক্তি আমি শুনতে পাই―আমি যখন সেই পঙ্ক্তিটিই পাঠ করছি  আপনি কিন্তু সেই স্বরটি শুনতে পাচ্ছেন না। কেননা আমার নিজস্ব স্বর সবকিছুকে ছাপিয়ে যাচ্ছে―অথচ সেই সব নিথর সময়ে হঠাৎ করেই আমি টের পেয়ে যাই আমাকে কোনও বার্তা পাঠানো হয়েছে, নতুন কোনও ধারা―এবং আমি সেটি নিয়েই কাজ করার চেষ্টা করি। আর এভাবেই আমার কাজে পরিবর্তন আসে―এটি এমন নয় যে আমি পরিবর্তনের জন্য কাজ করি। আমার অনেক বন্ধু, অসাধারণ কবি, তাঁরা প্রতিদিন নিয়ম করে  অসাধারণ  নিষ্ঠার সঙ্গে লেখালিখি করেন, আমার বেলায় এই সূচি কাজ করে না।    

হেনরি কোল : উইন্টার রেসিপি ফ্রম কালেক্টিভ-এর ‘সং’ শিরোনামের শেষ কবিতাটি নিয়ে কি প্রশ্ন করতে পারি ? কবিতার ‘তুমি’ ব্যক্তিটি কি আপনি, লুইস ?

লুইস গ্লুক : না। এই বইটিতে ‘তুমি’ নানাভাবে পাল্টেছে―কখনও তুমি একজন বোন, কখনও একজন বন্ধু, কিংবা একজন সঙ্গী, একজন ব্যক্তি যিনি বক্তার সহযাত্রী।

‘সং’-এর তুমিটি বন্ধু-সঙ্গী-বোনের চরিত্র থেকে খানিক আলাদা―এই তুমি আপনি, পাঠক কিংবা যে কেউ হতে পারে যিনি আমার কথা শুনছেন। তবে যে স্বপ্নের ওপর ভিত্তি করে কবিতাটি লেখা, তার ‘তুমি’ ব্যক্তিটি আমার বিশ্বাস আমার খুব ভালো একজন বন্ধু ছিলেন। যার সঙ্গে আমি মৃৎশিল্প বা সিরামিক নিয়ে কথা বলেছিলাম। সিরামিক আমি ভালোবাসি।  

হেনরি কোল : আপনার স্বপ্নে, সত্যিই কি সেই মৃৎশিল্পীর নাম লিও ক্রুজ ছিল ?

লুইস গ্লুক : হ্যাঁ, যদিও এই নামে আমি কাউকে চিনি না। আমার পরিচিতদের কারও নাম লিও নয় কিংবা ক্রুজ নামে আমার চেনা কেউ নেই। কাজেই এটা আমার নিজস্ব উদ্ভাবন বলা যায়। আর এই কারণটির জন্যই  পঙ্ক্তিটি আমার পছন্দের। আপনি তাকে খুঁজে পাবেন না। পৃথিবীতে নেই সে। মানে, তাদের মধ্যে এই নামে পঁয়তাল্লিশ শ জন থাকতে পারে, কিন্তু সেই সংখ্যার মধ্যে মরুভূমিতে চীনামাটির বাসন তৈরি করে যে জন,  সে নেই। সে একটি স্বপ্নের অংশ। সে মূলত ঊষর মরুভূমিতে জীবনের সত্যের প্রতীক।

হেনরি কোল : আপনার কল্পনা ? 

লুইস গ্লুক : একদম।

হেনরি কোল : সিরামিকে কী এমন আছে যা আপনি ভালোবাসেন ? 

লুইস গ্লুক : সেই সমস্ত সামগ্রী আমার পছন্দ যার উপযোগিতা আছে। দেখতে সুন্দর এবং ব্যবহারযোগ্য এমন জিনিস আমাকে টানে। আমি খুব ঘরমুখো মানুষ। আমি রাঁধতে ভালোবাসি, তাই টেবিল সাজানোও আমার পছন্দ যার সঙ্গে অনিবার্যভাবে কোনও না কোনও সিরামিকের সামগ্রীর অনুষঙ্গ এসে যায়। আমি ফুলদানিও পছন্দ করি, আবার একদম কেজো নয় এমন অনেক জিনিসও ভালো লাগে। তবে সুন্দরের সংগে উপযোগিতার মিশ্রণ  টানে বেশি। এছাড়াও, আমি পুরোনো জাপানি সিরামিক ভালোবাসি। যা কিছু মূল্যবান তা ভঙ্গুর এই ধারণাটিও আমার কাছে আকর্ষণীয়।  

আমি যখন প্রথম ভারমন্টে আসি, আমার বয়স বিশের কোঠার শেষ দিকে, অনেক কাল আগে, গোদার্দ কলেজ তখন খুব নাম করেছে। এক সেমিস্টারের জন্যে আমি সেখানে নিয়োগ পেয়েছিলাম―সেই কারণেই আমি সেখানে গিয়েছিলাম এবং সেটি ছিল আমার প্রথম চাকরি-কবিতা-কর্মশালায় শিক্ষাদান সংক্রান্ত কাজ। গোদার্দের একটি নগ্ন ছাত্রাবাস ছিল এবং আমার ক্লাসটি সেখানেই হতো। এর অর্থ  এই নয় যে আমার ছাত্ররা নগ্ন ছিল কিন্তু যে ছাত্ররা ওখানে থাকত তারা নগ্ন ছিল। আমার ক্লাসে যদিও সকলের শরীরেই পোশাক থাকত কিন্তু এই নগ্ন মানুষগুলোর চলাচল দেখতে খুবই অস্বাভাবিক লাগত। আমি বলতে চাই যে, যদিও তারা সকলেই তরুণ তবে তাদের সকলে দেখতে অপরূপ ছিল না। সেই সময়ে সেখানে অনেক চমৎকার মানুষেরা সিরামিক নিয়ে কাজ করছিলেন। এবং একজন অনন্য শিক্ষক ছিলেন, আমি মৃৎশিল্প স্টুডিওতে প্রায়ই ঘুরতে যেতাম এবং সেইসূত্রে কীভাবে কুমারের চাকিতে কাজ করতে হয় তা শিখেছিলাম―পারদর্শী হইনি যদিও, তবে চাকায় বসে কাদামাটির স্পর্শের অনুভূতি আমার দারুণ লাগত। আপনি যেভাবে হাতকে স্থির রাখবেন মাটি ঠিক সেভাবে নানা আকৃতি নেবে―বিষয়টি আমাকে মুগ্ধ করত। বিশেষ করে রাকু করতে আমি পছন্দ করতাম। আপনি কি জানেন রাকু কী ?

হেনরি কোল : এতে কি চিড় খাওয়া চকচকে ভাব আছে ?

লুইস গ্লুক : এতে উজ্জ্বল করবার প্রক্রিয়াটা সাধারণের চেয়ে বেশি সচ্ছিদ্র। আপনি পাত্রটিকে ভাটা থেকে বার করে এমন কোথাও গড়াতে দেবেন যার ছাপ পরবর্তী পর্যায়ে উজ্জ্বলতা আনার প্রক্রিয়ায় স্পষ্ট হবে। পুরা বিষয়ে একটা অবাধ ব্যাপার আছে। যখন ভাটা থেকে গনগনে জিনিসটা বের করে হেঁটে বাইরে বরফের ওপর গড়িয়ে দিতাম, তখন দারুণ রোমাঞ্চকর লাগত। এর পরে আপনাকে তা খুঁজে বের করতে হ’ত। মাঝে মাঝে ভয়ঙ্কর ছোট গ্যাসীয় স্ফীতিতে ভরে যেত সেটি। তবে পুরা ব্যাপারটা বেশ উপভোগ্য ছিল; মাঝে মাঝে তারা বেশ সুন্দর দেখতে হতো। আসলে অন্যদের কাজগুলো সবসময়ই সুন্দর হতো আমারটা কচিৎ সুন্দর হতো। এই কাজগুলোর একটা নমুনা আমি কোথাও রেখেছি অন্তত আমার কাছে থাকবার কথা। 

হেনরি কোল : আপনি কি আপনার স্বপ্ন এবং অবচেতন থেকে লিখতে বেশি পছন্দ করেন যেমন ‘সং’-এর বেলায় আমরা দেখেছি, না কি নিজের কল্পনা থেকে তৈরি করেন ? আপনি কীভাবে ঠিক করেন ব্যাপারটা ?

লুইস গ্লুক : এটা ঠিক করাকরির বিষয় নয়। এটা নিজেই হাজির হয় এবং আপনি ভেতর থেকেই উত্তর পেয়ে যান কীভাবে একে নিয়ে কাজ করা যাবে, যেভাবে একটি পাখি তার বাসা বোনার সময় জানে, ওহ্ এইখানে আমার একটা লাল ফিতে চাই, অমনি ফিতের খোঁজে সে বেরিয়ে পড়ে কিংবা পাখিটি এইসব না জেনেই লাল ফিতে পেয়ে যায় এবং ভাবে, হুম এতে আমার নাম লেখা আছে। ঠিক সেই রকম আপনি যা পেয়ে যান তা ব্যবহার করেন, এবং আপনি নিয়মিত স্বপ্নের দেখা পান। আমি আমার লেখার টেবিলে বসে কিন্তু এমন ভাবি না যে আমার সাম্প্রতিক দেখা স্বপ্ন থেকে একটা কিছু ব্যবহার করব। বরং আমি যে পঙ্ক্তি পেয়ে জেগে উঠি সেটি লিখে রাখি এবং সেই পঙ্ক্তিটিকে দেখতে থাকি―এটিকে রহস্যময় মনে হয়, কেননা স্বপ্নটিই ছিল রহস্যময়―সেই স্বপ্নের কোনও অর্থ আমি বুঝতে পারিনি। এরপরেই আমি সেই পঙ্ক্তি ঘিরে প্রাসঙ্গিক কিছু ভাবি অথবা কিছু ভাবতে ব্যর্থ হই।

হেনরি কোল : আপনার কবিতায় ভাবের সত্যতা এবং আখ্যানের সত্যতার মধ্যে কোনও সম্পর্ক আছে কি ?  আমি আপনার কল্পকাহিনি এবং স্বপ্নের বিপরীতে আপনার জীবন থেকে নেওয়া উপাদানের সংশ্লেষ নিয়ে ভাবছি।

লুইস গ্লুক : ওহ্, আমার একে সত্য হিসেবে নয় বরং আক্ষরিক সংঘটন বলে মনে হয়। আমার কাছে  অভিজ্ঞতার অন্তর্গত যা কিছু, তার সবই সত্য। মাঝে মাঝে আপনি আপনার জীবনের ঘটনা নিয়েই কাজ শুরু করেন  কিন্তু আপনি  টের পান আপনি নয় বরং অন্য কারও মুখ থেকে এটি  বলাতে পারলেই এর প্রতিক্রিয়া জোরদার হবে। জীবনের অভিজ্ঞতা আক্ষরিক সত্যতায় লিখলে তা সবসময় উৎকৃষ্ট কবিতা হয়ে ওঠে না, এর আংশিক কারণ হলো আপনার যাপনের অভিজ্ঞতার আলোকে যে সিদ্ধান্তে আপনি পৌঁছেছেন সেটি আপনার লেখা শুরুর আগেই ঘটেছিল। আপনি আপনার কবিতায় যা চান তা হলো নতুন কোনও আবিষ্কার। আর তখনই আলোর উদ্ভাস ঘটে, কাজেই আপনি সেই গল্পটি বুনতে চান যা নতুন কিছু উদ্ঘাটন করবে, যার অন্তর্গত সত্য আপনি আগে অনুভব করেননি।  

হেনরি কোল : আপনার অনেক কবিতায় গুরু-শিষ্যের উপস্থিতি আছে, শিক্ষক যিনি জ্ঞানী এবং কবি যিনি জ্ঞানের অনুসন্ধানী। এই বিশেষ আঙ্গিকের কি কোনও উৎস আছে ?

লুইস গ্লুক : গ্রেড স্কুল থেকে শুরু করে যাঁরা আমাকে শিখিয়েছেন তাঁদের সকলের কাছে আমি ঋণী। আমি প্রায়শই আমার সমবয়সীদের সঙ্গে মিশতে পারতাম না  কিন্তু শিক্ষকদের সঙ্গে আমার কখনই অসুবিধে হয়নি। আমি শিখতে চাইতাম তাই শেখানো সহজ ছিল। আমি বাধ্য ছিলাম না, কিন্তু আবার কোনওভাবেই আমাকে তাঁরা বিদ্রোহীও বলতে পারেন না। শিক্ষানবিশ এবং শিক্ষকের সম্পর্কটি আমার কাছে সবসময়ই একটি ক্রিয়াশীল সম্পর্ক, কেননা এর মধ্যে একটা পারস্পরিক বিনিময়ের ব্যাপার আছে। এটা কেবল গুরুর জ্ঞানদান এবং শিষ্যের আনত হওয়া এবং কৃতজ্ঞতার বিষয় নয়। এখানে একটা লেন-দেনের ব্যাপার আছে। অনুজ তার অগ্রজকে, তাঁদের পেশার প্রাথমিক দুর্দমনীয় সময়ের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন। কখনও কখনও অগ্রজ ব্যক্তিটির অনম্য এবং নাছোড় মনোভাব এক ধরনের সৌম্য ক্লান্তির প্রতিনিধি বনে যায়। এই সম্পর্কের লক্ষ কোটি  বিন্যাস রয়েছে, এবং সেগুলোর সব কটিই আমার কাছে কৌতূহলের। এখন আমি দুটি চরিত্রই  যাপন করেছি। এবং আমি যে কত দশক ধরে শিক্ষক হিসেবে আছি তা কেবল বিধাতাই জানেন…

হেনরি কোল : উইন্টার রেসিপিতে যে জিনিসটা আমাকে মুগ্ধ করেছে তা হলো, আপনার মতো একজন প্রসিদ্ধ কবি তাঁর পেশার শীর্ষে থেকেও এখনও কীভাবে অনুসন্ধানী থাকতে পারেন।

লুইস গ্লুক : যিনি লেখেন তিনিই অনুসন্ধানী। আপনি একটি ফাঁকা পৃষ্ঠার দিকে তাকিয়ে আছেন এবং আপনি খুঁজছেন। এই খোঁজার দায়িত্বেই আমাদের নিযুক্ত করা হয়েছে এবং তা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়নি।  আমার কাছে এটি একটি অবিশ্বাস্য  আশীর্বাদ। আমি বোঝাতে চাইছি যে আটাত্তর বছর বয়স হয়েছে এবং এখনও তাকিয়ে আছি, এই যে তাকিয়ে আছি―এটাই আমাকে চমৎকৃত করে।

হেনরি কোল : বিষয়টি আমাকেও অবাক করে।

লুইস গ্লুক : আমি এতে খুবই খুশি, নতুবা আমি হয় হতাশাগ্রস্ত হতাম অথবা আত্মতুষ্টিতে ভুগতাম কিংবা দুটিই ঘটত। আমি এমনই থাকতে চাই কারণ এটিই আমার আয়ুরেখা।

হেনরি কোল : আপনার জীবনে বাগান করার ভূমিকা নিয়ে কিছু বলবেন কি ?

লুইস গ্লুক : এখন আর খুব একটা বেশি বাগান করি না, কিন্তু আমি গাছ ভালোবাসি এবং আমি সারা জীবন তাদের ভালোবেসেছি। আমি উদ্যানপালক পরিবার থেকে আসিনি বরং আমার পরিবার হলো তারিফদার―যারা ফুল ভালোবাসে, এবং ঘটনাচক্রে খাবারও, আমার কৈশোরে তখনও আমি বাড়িতেই থাকি, মায়ের কাছে বাড়ির পেছনের উঠানের একটুকরো জমি চেয়েছিলাম। সেখানেই আমার প্রথম সব্জিবাগান করা এবং আমি বেশ সফল হয়েছিলাম। ওখানকার মাটিটা বেশ উর্বর ছিল। এটা লং আইল্যান্ডে থাকার সময়ের কথা, ওখানে প্রচুর সূর্যের আলো। পরে যখন ভারমন্টে চলে এলাম, তখন ফের চাষবাস শুরু করেছিলাম। কেননা আমি রাঁধতে ভালোবাসি। সেই সময়ে দোকানে সবকিছু পাওয়া যেত না, তাই আমি এবং আমার স্বামী সব্জির চাষ শুরু করি, যদিও সেখানকার গ্রীষ্মকাল খুব কম সময়ের, এবং আমরা চমৎকার সব লেটুস আর ভেষজ এইসব বুনতে চাইতাম। বিশাল জায়গা নিয়ে দারুণ বাড়ি ছিল আমাদের এবং আমরা দুজনে প্রচুর পোকার কামড় খেয়ে প্রথমে সব্জিবাগান এরপরে ফুলের বাগানও করেছি।

আমি এতে বেশ মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম। একটা সময় আমি দুই বছর ধরে কেবল বাগানের ক্যাটালগ ছাড়া অন্য কিছুই পড়িনি। আমি সত্যিই ভেবেছিলাম যে কবি হিসেবে আমার জীবন শেষ হয়ে গেছে। তারপরই আমি দ্য ওয়াইল্ড আইরিস (১৯৯২)―বইটি লিখেছিলাম, যেখানে ফুলেরা কথা বলে। আমি দেখতে পাচ্ছিলাম যে ক্যাটালগের প্রচুর গদ্য আমার কবিতায় চলে এসেছে। একটা জিনিস আমি দৃঢ়ভাবে অনুভব করি―এবং সেই বইটিই আমাকে এটি শিখয়েছে―তা হলো আপনাকে নিজেকে আচ্ছন্ন হতে ছাড় দিতে হবে। আপনি এই সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না যে, এই ধরনের বইয়ের সাহিত্যমান নেই কিংবা তারা যথেষ্ট উৎকৃষ্ট  নয়। আমি বলতে চাইছি, এমন নয় যে আমি নিজেকে ক্যাটালগগুলি পড়ার অনুমতি দিয়েছিলাম, তবে সেই সময়ে এই বইগুলোতেই আমার মন বসেছিল। আমি পরবর্তীকালে বুঝতে পেরেছিলাম আমার বিচারে সেই সময়ের সেরা বই বলে যাকে ভেবেছি তার অনুঘটক ছিল এই বইগুলি―এখন তেমন না হলেও সেই সময়ে কাজ হয়েছিল। ইদানীং, আমি প্রচুর টেলিভিশন দেখছি। এবং আমি নিশ্চিত যে এটাও আমার কাজে আসবে। যদিও সেটা টেলিভিশন থেকে সরাসরি না-ও হতে পারে আবার হতেও পারে। এই মুহূর্তে আমি ঠিক জানি না। কিন্তু মূল বিষয় হলো আমার আর আপাতত অন্য কোনও পছন্দের বিষয় নাই। আপনার নিজের ভেতরের প্রণোদনাকে ভরসা করতে হবে। কেননা আপনার কাজটি, আপনাকে যা আবিষ্ট করে, তার থেকেই উদ্ভব হয়। আপনার কাজ সেখান থেকে তৈরি হবে না, যা আপনি ভাবছেন আপনার আচ্ছন্ন হওয়া উচিত।

হেনরি কোল : টিভিতে কী দেখছেন ?

লুইস গ্লুক : ওজার্ক। আমার কাছে জুলিয়া গার্নারকে দারুণ লাগছে, সব অভিনয়শিল্পীদের ভালো লাগছে, তবে কি এই ধারাবাহিক খানিক একঘেয়ে হয়ে উঠেছে আর চরিত্ররা সারাক্ষণই সেই সব জিনিস করছে যা তারা বাস্তবে করে না, সেই কারণে আমার উৎসাহ ওঠা-নামা করছে। শেষ যে ধারাবাহিক আমার আসলেই ভালো লেগেছিল তা হলো ‘শিটস ক্রিক’, আমি এটা তিন বার পরপর দেখেছি। কোভিড কালে এই টিভি ধারাবাহিক আমার কাছে দারুণ মনে হয়েছিল। কারণ এখানে টিকে থাকার যুদ্ধ ছিল। এটি মজার আবার ভীষণ মন ছোঁয়া―এমন গল্প যা সাহস এবং জীবনের ভয়ঙ্কর ঘটনাগুলো সামাল দেওয়ার  কথা বলে। আমি অন্য কিছু দেখবার চেষ্টা করতাম কিন্তু  শিটস ক্রিক দেখতেই মন টানতো। শেষমেষ এটি দেখা বন্ধ করার কারণ মনে হয় ততদিনে আমার সব দৃশ্য মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল―আমি জানতাম কোন কথার পরে কোন কথা আসবে।

হেনরি কোল : এটার হয়তো আরেকটা পর্ব বানাবে।

লুইস গ্লুক : আমার মনে হয় না। ওরা হয়তো অন্য কিছু তৈরি করবে। এটা কানাডীয় প্রযোজনা।

হেনরি কোল : আপনি কি অন্বেষক হিসেবে আপনার বিশেষ কৌতূহল সম্পর্কে আরেকটু বলবেন ?

লুইস গ্লুক : এই অন্বেষা আসলে সাহিত্যিক ঔৎসুক্য নয় বরং মানবিক ঔৎসুক্য বলা যেতে পারে। আমি যখন কারও সঙ্গে পরিচিত হই তখন আমি তার সম্পর্কে তৎক্ষণাৎ অনেক কিছু জানতে চাই। আমার যা নেই তা হলো স্থানিক-কৌতূহল। আমি ভ্রমণ অপছন্দ করি কারণ আমাকে নিয়মে থাকতে হয়। আমার নিত্যদিনের যাপনে বেশ কিছু পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন হয়, যদি আমার কিছু করণীয় থাকে তবে আমি তা করি। আমার সবসময়ই মনে হয়, যখন আপনি কোনও কাজ সম্পূর্ণ করেন তখনই আপনার ভেতর থেকে সেটি শূন্য হয়ে যায়, এবং তখন যদি আপনার সৃজনশীলতার চুলোয় অন্য কিছু না-চাপানো হয়―আর আমি সবসময় কেবল একটি জিনিস নিয়ে কাজ করি―তখন আপনি রিক্ত হয়ে যান, কিন্তু আপনি সেই সম্পূর্ণ থাকার সময়টি মনে করতে পারেন, সেই কারণে আপনি এই শূন্য অনুভূতির খপ্পড়ে একদমই পড়তে চান না। কেউ কেউ নিজের ভেতরেই সেই পূর্ণতার খোঁজ করে, কিন্তু আমি দেখেছি আমার অন্দরমহলে ভাঁড়ারের মজুদ খানিক সীমিত, তাই আমি বাইরের দুনিয়ার কাছেই আমার ভাবনার-খোরাক সরবরাহে আস্থা স্থাপন করেছি। শিক্ষকতার ব্যাপারেও একই কথা। শ্রেণিকক্ষে ঢোকার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত আমার মনে হয় আমার কিছুই বলার নেই, কিন্তু যখন আমি কক্ষে প্রবেশ করি এবং কেউ কিছু একটা প্রসঙ্গ তোলে এবং আমার ভেতর তখন কানায় কানায় ভরে ওঠে এবং আমি হয় সেই প্রসঙ্গের সমর্থনে অথবা মৃদু মতবিরোধে সংলগ্ন হই। কিন্তু আমার ভাবনার খোরাক আসে প্রতিক্রিয়া কিংবা দ্বান্দ্বিকভাবে। অনুসন্ধান বলতে আমি এটিই বুঝিয়েছি।

হেনরি কোল : এই দ্বান্দ্বিক চিন্তাধারাই আপনার লিখনশৈলীর স্বাক্ষর।

লুইস গ্লুক : হ্যাঁ, বেশ অনেক দিন ধরেই এই প্রক্রিয়াই সত্য।

হেনরি কোল : দ্য ডিনাইয়েল অফ জয়-এ নিশ্চিতভাবে এমনতর কথোপকথন আছে যা এই কবিতাকে আমার কাছে গতি এবং উত্তরণের কবিতা মনে হয়েছে। এটির আখ্যানও কি আপনার কল্পনাপ্রসূত, না কি স্বপ্নের কাছে পাওয়া ? আপনি কি সেই নারী যিনি পাসপোর্ট হারিয়ে কমলা গাছের তলায় ঘুমাচ্ছেন ? আপনি কি সেই দ্বাররক্ষীর চরিত্রে অন্য কাউকে ভেবেছিলেন, যিনি আপনার গুরুস্থানীয় বটেন ? 

লুইস গ্লুক : আমিও এই কবিতাকে গতির কবিতা হিসেবেই দেখি, সময়ের নির্দয় চলন এবং গন্তব্যহীন গতিময়তা―আপনি একটি বৃত্তের মধ্যে ঘুরলেও সময় থামে না। কেননা এই অবিচলতাও সময়ের মধ্যে ঘটে, যে কি না পরিবর্তনশীল এবং ক্ষণস্থায়ী। এই কবিতার ‘আমি’ লুইস নয়। আমি এইখানের চরিত্রদের দুজন পুরুষ হিসেবে দেখেছি। আমার ভাবনায় এটি আগাগোড়াই একটি সমকামী কবিতা―শুরুর প্রেমিকটিও পুরুষ। যদিও আমার কোনও ধারণাই নেই কেউ এটা কীভাবে বুঝবেন, অবশ্য আমার মনে হয় তাতে কিছুই যায় আসে না। যে কোনওভাবেই হোক এই কেন্দ্রের বাইরের সমকামী জীবনটি আমার কাছে এক্ষেত্রে পৃথিবী। আমার জীবনে গুরু গোছের কেউ নাই তবে আমার প্রজ্ঞাবান বন্ধু আছে।

হেনরি কোল : আপনি একবার বলেছিলেন, যখন সং লিখছেন আপনি জানতেন আপনি কাগজের গাদা নয় বরং একটি বই লিখেছেন। কোন্ সেই কবিতা যা বইটিকে নির্মাণ করল ? 

লুইস গ্লুক : সং লেখার আগে আমি একগুচ্ছ গীতিকবিতা লিখেছিলাম। যাদের একটির সংগে আরেকটির কোনও সংযুক্তি না থাকাও সত্ত্বেও মিল ছিল। কীভাবে তারা সংযুক্ত না-থেকেও অনুরূপ হলো ? তারা সকলেই একই জায়গা জুড়ে ছিল, এবং এই বিষয়টি আমার কাছে ভীষণ একঘেয়ে লাগছিল। কবিতাগুলি বেদনা ও বিষাদে পূর্ণ ছিল―কখনও বিদ্রƒপাত্মকও। আমার অতি প্রিয় বোনটির মৃত্যু হয়েছিল, উইন্টার রেসিপি বইটি ছিল প্রধানত শোকগাথা, সময়টির সঙ্গে কোভিডের সমপাতন ঘটল―এবং আমরা আরও বৃহত্তর শোকের অংশী বনে গেলাম―সেই জীবনের জন্য আমরা শোক করছিলাম যা আমরা যাপন করতাম, যা আমাদের ছিল না, যা আমাদের নেই আর। তখনই অনুভব করলাম একটা নতুন ভাবনাসূত্র জন্ম নিচ্ছে, বলা যায় প্রেসিডেন্টস ডে দিয়ে যার শুরু হলো এবং সং এদের ডানা বনে গেল। সেই কারণেই হয়তোবা আমি টের পেলাম আমি একে কিছুতেই আটকে রাখতে পারব না―কেননা এতে এতটাই হাওয়া, ক্রান্তিসীমার অনেক ওপরে সে ভাসছে। আমি তখনই জেনে গেছি এটি এই বইয়ের শেষ কবিতা হতে যাচ্ছে। আপনি নিশ্চয়ই এমন কবিতার পরে কিছু শুরু করতে চাইবেন না এবং এরপরে তাকে পেঁচিয়ে নিচে নামাবেন না। আমি বলতে চাইছি হয়তো পারবেন তবে সেটি একেবারে অন্য রকম কোনও বই হতো। আমি এই বইকে সংলগ্নতার বই হিসেবে পাঠ করি, বেঁচে থাকার সংগ্রাম জেতার বই হিসেবে―সেই বিজয় নয় যেখানে আমরা আমাদের রক্তাক্ত পা নিয়ে পাহাড়ের চূড়ায় উঠি―বরং ভয়ংকর সব ঘটনা সামাল দিয়ে বেঁচে থাকার অভিজ্ঞতা―এই বেঁচে থাকা মানে আমাদের আশা করবার ক্ষমতা এবং এই আশা করতে পারাকেই  হঠাৎ করে আমার কাছে মানবজীবনের সেরা অর্জন বলে মনে হয়েছিল। যদিও আমরা এ নিয়ে কথা বলাকে মূর্খতা ভাবি, কারণ প্রায়শ আশা অনুযায়ী বাস্তবে কিছু ঘটার প্রমাণ মেলে না, কিন্তু অলীক হলেও আমার কাছে সত্যিকার অর্থেই একেই মানবজীবনের টিকে থাকার অবলম্বন বলে মনে হয়। লিও ক্রুজ নামের কেউ যদি না-ও থাকে, কিংবা কোনও বাটি তৈরির সম্ভাবনা নয় অথবা ভাটাতে নাই-বা জ্বলল আগুন, তারপরেও আশাই হলো বিশাল প্রেরণা। 

হেনরি কোল : প্রেসিডেন্টস ডে শেষ হয়েছে দুটি হ্রস্ব পঙ্ক্তি দিয়ে, ‘আনন্দময়―এই সেই শব্দ/ যা বলিনি ক্ষণিক-কাল’ এই ঝটিকা উত্তরণ আমার খুব ভালো লেগেছে। আপনি কি এই পঙ্ক্তি দুটি লেখার সময় আনন্দ অনুভব করেছিলেন ?

লুইস গ্লুক : আসলে ২০২০-এর ফেব্রুয়ারি মাসে বার্ক্লির বাড়ির গাড়িবারান্দায় লিখেছিলাম এটি― লিখবার সময় কেমন বোধ করছিলাম জানি না। আমি ক্বচিৎ বাক্য যা বলছে তার সংলগ্ন হই। আমি বরং শব্দের মোহে আচ্ছন্ন থাকি, এরা হঠাৎ করে উদয় হয়―হয়তো আমি যা অনুভব করছি কিংবা হাওয়াতেই ভাসছিল অথবা কোনও সিনেমা থেকে পাওয়া। 

হেনরি কোল : আমি কি উইন্টার রেসিপির প্রথম কবিতা ‘পোয়েম’― এমন সরল নাম নিয়ে কিছু প্রশ্ন করতে পারি ? আপনি এই শিরোনাম কেন দিলেন ?

লুইস গ্লুক : এর চেয়ে ভালো কিছু মাথায় আসেনি তাই।

হেনরি কোল : ‘পোয়েম’ কবিতার ‘তুমি’ কথক যিনি আপনাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন তিনি কে ? আপনি কি আপনার সহোদরার কথা ভাবছিলেন ? এবং আপনার মা কি ছেলেবেলায় আপনাকে গান গেয়ে শোনাতেন ?

লুইস গ্লুক : হ্যাঁ তিনি আমার বোন―যেমন বলেছিলাম উইন্টার রেসিপি সন্তাপের বই। আমার মায়ের গানের গলা খুব ভালো ছিল এবং তিনি আমার অভিভাবকদের দেওয়া পার্টিগুলোতে আমাকে চূড়ান্ত বিব্রত করে প্রেমের গান গাইতেন―তিনি শিল্পী ছিলেন―কিন্তু তিনি আমাদের গান শোনাতেন না অন্তত তেমন কিছু আমার মনে পড়ে না। অবশ্য আমি এমন হলে পছন্দও করতাম না।

হেনরি কোল : আপনি কি সেই বালক ?

লুইস গ্লুক : আসলে আমি এইখানে মেয়ের চেয়ে ছেলেই বেশি―দায়িত্বশীল নিয়ন্ত্রক চরিত্র। ছেলেটি এবং মেয়েটি দুজনেই এখানে অদম্য অবিনশ্বর দুই চরিত্র। কোকিল-ঘড়ির দিন এবং রাত্রির জানান দেওয়ার মতো।

হেনরি কোল : আপনার যখন ছোট মেয়ে ছিলেন তখন কি কবিতা পড়তেন ?

লুইস গ্লুক : আপনার প্রশ্নের উদ্ভট শব্দবন্ধটি হলো ‘ছোট মেয়ে’। আমার  কখনই ‘ছোট মেয়ে’ ধরনের অনুভূতি হয়নি―হয়তো আমি একে সর্বজনীন অনুভূতি হিসেবেই অনুমান করতাম। যদিও আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমাকে তেমন একজন মনে করা হচ্ছে। আমি যে অতি অবশ্যই ‘ছোট ছেলে’ নই, সেটি জানতাম। কিন্তু আমি নিজেকে একক, অভিনব কিছু মনে করতাম, একটা ভাবনা, খনির শ্রমিকের মাথায় যেমন বাতি থাকে তেমন কিছু। বয়ঃসন্ধি যখন ঘটে গেল, আমি প্রচণ্ড ধাক্কা খেলাম। হঠাৎ করেই যেন আমি লিঙ্গের খোপে গেঁথে গেলাম―আমি শান্ত অথচ তীব্রভাবে একে অস্বীকার করলাম। আমার যখন কম বয়স, আমি শেক্সপিয়ারের নাটকের গান এবং ব্লেইকের ‘সংস অফ ইনোসেন্স অ্যান্ড এক্সপিরিয়েন্স’ পাঠ করেছিলাম। দুটি বই-ই ছোট―মানে আকারের দিক থেকে ক্ষুদ্র―বইগুলো আমার বিশ্বাস আমার নানির বাড়ি থেকে পেয়েছিলাম, যে বাড়িতে আমার বোন এবং আমি, এছাড়া আমাদের চার তুতো ভাইবোন লম্বা সময় কাটাতাম। আমার স্মৃতি ঠিকঠাক না-ও হতে পারে―আমার নানি পড়ুয়া ছিলেন না। কিন্তু সেই মুহূর্তে আমি জেনে গিয়েছিলাম এই স্বর আমার গোত্রের স্বর, এইসব কবিদের মতো মানুষের কথা বলার উচ্চাকাক্সক্ষা আমার সেই থেকেই হয়েছিল।

হেনরি কোল : আপনাকে যাঁরা কবিতা লিখতে শিখিয়েছেন তাঁদের কথা বলুন। 

লুইস গ্লুক : আমি কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রাতের স্কুলের সাধারণ শিক্ষাক্রমের লিখনশৈলী কার্যক্রমে ভর্তি হয়েছিলাম। রাতের স্কুলে আপনি হরেক রকমের মানুষের দেখা পান। কেউ কেউ সৃজনশীলতার আশিসপুষ্ট, কেউ কেউ একেবারেই নয়। সেখানে আমার প্রথম শিক্ষকের নাম ছিল লিওনি অ্যাডামস, বিদ্বজ্জন। তিনি অনেক জানতেন, এবং ঋদ্ধ পাঠক ছিলেন, তবে আমি তাঁর কবিতা পছন্দ করিনি। তিনি তাঁর নিজের কবিতার বাইরে ভিন্ন ধারার কবিতা পড়তেন এবং সেই বিষয়ে তাঁর প্রজ্ঞাও আমাকে সাহায্য করেছে। আমি তাঁর সঙ্গে দুই বছর ছিলাম।  

লিওনি শ্রেণিকক্ষে নবীন কবিদের কবিতাও নিয়ে আসতেন, যে কবিতাগুলি তিনি মনে করতেন আমাদের মনোযোগ দেওয়া উচিত। একদিন তিনি একটি কবিতা নিয়ে এসেছিলেন যা তার মতে চূড়ান্ত অযোগ্য এবং তিনি কবিতাটি আমাদের পাঠ করে শুনিয়েছিলেন। কবিতাটি জেমস রাইটের লেখা এবং আমার মনে হয়েছিল এমন মুগ্ধকর কিছু আমি আগে কখনও শুনিনি। সেই দিনই আমি জেনে গিয়েছিলাম আমার এবং লিওনির পথ ভিন্ন, কাজেই আমি এমন কারও তত্ত্বাবধানে শিখতে চাই না যিনি এমন ভালো কবিতাকে বাজে বলতে পারেন―আমি এমন কবিতাই লিখতে চাই। এর পরে আমি স্ট্যানলি কুনিজের সংগে গ্র্যাজুয়েট শ্রেণিতে পাঠ গ্রহণ করেছিলাম। সেই সময়ে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় সবে তাদের কলাবিভাগের স্নাতকোত্তর কার্যক্রমের  সৃজনশীল-লিখন পাঠক্রম শুরু করেছে এবং স্ট্যানলি আমাকে বললেন আমি বিশেষ শিক্ষার্থী হিসেবে সেখানে যোগ দিতে পারি যদিও আমার কোনও কলেজ ডিগ্রি ছিল না। তিনি আমাদের কবিতার মনোভাবের দিকে নজর দিতে শিখিয়েছিলেন। আপনি যদি অসংখ্য ভালো পঙ্ক্তির মধ্যে দুই একটা বাজে পঙ্ক্তির কোনও কবিতা তাঁকে দেখাতেন তিনি এমন বলতেন না, ‘সুন্দর, যাও এখন আরেকটা লিখে আনো’ বরং তিনি কবিতাটি দেখতেন এবং বলতেন, ‘এটা কাজ করছে না’। এরপরে তিনি দুর্বল জায়গাগুলো চিহ্নিত করতেন যেগুলো আমি নিজেও মনে মনে পার পাওয়ার প্রচেষ্টা বলে জানতাম এবং আমি সবসময় তাঁর সঙ্গে সহমত হতাম। আমি কবিতাটি সংশোধনের পরে নতুন খসড়াটি তাঁকে দেখাতাম এবং সেখানেও কিছু ভুল থাকত এবং আমি আবার সেটি নিয়ে কাজ করতাম। আমি এক ধরনের ধৈর্যশীলতা তার কাছ থেকে শিখেছি―যে, আপনি কোনওভাবে কবিতায় জোর খাটাতে পারবেন না, আপনি এক লহমায় একে সঠিক যেমন বলতে পারেন না, তেমনি প্রথম টানেই ঠিক কবিতাটিও আপনার কাছে আসবে না। আমি তাঁর পরামর্শমতো কাজ করতে ইচ্ছুক ছিলাম এবং বেশ অনেক দিন চলেছিল।

আমি এক সেমিস্টার অ্যাড্রিয়েন রিচের কাছেও শিক্ষা নিয়েছিলাম, তিনি তখন সবে রাজনীতি নিয়ে সোচ্চার হওয়া শুরু করেছিলেন। তখনও তিনি সমকামী হিসেবে স্পষ্ট হননি। তিনি সেই সময়ে তাঁর রেডক্লিফের অধীত বিদ্যাকে প্রয়োগ করছিলেন, তাঁর কর্মশালা পরিচালনার পদ্ধতি ছিল আমরা সকলে টেবিল ঘিরে বসতাম এবং আমাদের কবিতা পড়তাম, তিনি হয় বলতেন জম্পেশ অথবা জমেনি। ব্যস এই পর্যন্ত। আমি ভালো লিখছিলাম না অন্তত খুব ভালো নয়, কিন্তু তারপরেও মনে হচ্ছিল তিনি আমাদের ঠকাচ্ছেন। তার শিক্ষা নিবিড় ছিল এবং মননও পরিশীলিত এবং সঠিক ছিল, যা তিনি সেই সময়ে তুচ্ছ করছিলেন। সেই কারণে তিনি আমাদের জন্য সেই মননের দুয়ার রুদ্ধ করে রেখেছিলেন। কিন্তু ঐ ‘জম্পেশ’ মোটেও কাজে আসছিল না, এবং তাঁর সেই জম্পেশ কবিতাগুলোর অনেকগুলি মোটেও অসাধারণ ছিল না―অর্থাৎ তারা আরও ভালো হতে পারত। তার মানে এই নয় যে তা পুঁথিগত কিছু, কেবল আরেকটু জোরালো যা কবিতাটির লক্ষ্য ছিল। আমি আসলে কিছুই নিতে পারিনি এবং আমার নিজেকে মনে হতো ঐ শ্রেণিকক্ষের বাইরের কেউ। অবশ্য সেখানে একজনের সঙ্গে আমার সখ্য হয়েছিল তার নাম ছিল হিউ সিডম্যান, তাঁর প্রথম বইটি আমার মতে আমাদের প্রজন্মের কোনও কবির লেখা সেরা বই, কালেকটিং অ্যাভিডেন্স―বইটি অনেক বছর আগে তরুণ কবিদের ইয়েল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিল। আমি অনেক কিছু শিখেছি সেই বই থেকে। 

হেনরি কোল : আপনি কীভাবে সিদ্ধান্তে এলেন যে কালেকটিং অ্যাভিডেন্সই সেরা।

লুইস গ্লুক : সংক্ষেপে এই বিষয়ে উত্তর দেওয়া কঠিন―বইটি সামনে নিয়ে বসলে তবেই আমার পক্ষে সহজে বলা সম্ভব হতো যে, এই জায়গাটা দেখুন! কিন্তু কালেকটিং অ্যাভিডেন্স বইটি অসম্ভব উচ্চমানের, এবং এর প্রতিটি পঙ্ক্তি যেমন আবিষ্ট করার মতো অপূর্ব ঠিক তেমনই গভীর প্রজ্ঞাসমৃদ্ধ। সিডম্যানের মন যে পথে হাঁটে সেই পথে আমার মনের চলন নেই। এই বইয়ের প্রতিটি পঙ্ক্তিই আমাকে বিস্মিত করে, এবং যে পূর্ণচিত্রটি তিনি আঁকেন তা অবিশ্বাস্য, অসম্ভব আবেগ এবং তারুণ্যের বিষাদপূর্ণ―মনে হয় এটি বেশ প্রবীণ মননের ফসল, যদিও তিনি যে বয়সে এটি লিখেছেন সেই বয়সকে বালক বয়সই বলা চলে। আমার মতে, সিডম্যান এরপরে আর কোনও বই লিখেননি যা তাঁর প্রথম বইটিকে অতিক্রম করতে পারে। একজন লেখক হিসেবে এই অভিজ্ঞতা বড় মর্মান্তিক যখন আপনার প্রথম বইটি যথেষ্ট মনোযোগ আকর্ষণে ব্যর্থ হওয়ার কারণে স্মারক বনে  যায়। এবং কম কৃতী বইগুলো সমাদর পাওয়ায় বইটি আড়ালেই পড়ে থাকে। 

হেনরি কোল : রিচ সেই সময়ে আপনার কাজের কেমন মূল্যায়ন করেছিলেন ? 

লুইস গ্লুক : তিনি মনে করতেন আমি বুর্জোয়া শ্রেণির―আমি কম বয়েসী ছিলাম কিন্তু আমার প্রথম বইটি বেরিয়ে গিয়েছিল, যেটা বরং নিয়ম মেনে লেখা। আমি একবার তাঁর কক্ষে আমার একটা কবিতা নিয়ে গিয়েছিলাম,  তাঁর কিছু বলার ছিল না। পরবর্তী সময়ে আমি অন্য কাউকে দেখিয়েছিলাম এই কবিতা, ‘যিনি বেশ বিস্তারিত গঠনমূলক মন্তব্য দিয়েছিলেন। এবং আমি কবিতাটি নিয়ে ফের কাজ করি এবং রিচকে আবার দেখাই।’ ‘তুমি এটিকে আরও ভালো করেছো,’ তিনি বলেছিলেন এবং আমি মনে মনে ভেবেছিলাম এইজন্য আপনি কোনও ধন্যবাদ পাচ্ছেন না। জীবনের অনেকটা সময় পেরোনোর পরে  আমরা পরস্পরকে সম্মান এবং পছন্দ করতে শুরু করেছিলাম, তবে শিক্ষক হিসেবে তিনি অতিশয় বাজে ছিলেন। 

হেনরি কোল : আপনার নিজের পাঠদান প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানার কৌতূহল হচ্ছে। 

লুইস গ্লুক : আমরা তিনটি কবিতা নিয়ে দুই ঘণ্ঠা ধরে নিবিড় আলোচনা করি। আমি মূলত স্নাতক শ্রেণির ক্লাস নিই। তারা এক সপ্তাহে একটা করে বই পড়ে, যার মূল তালিকা আমিই সরবরাহ করি। যদি দেখি তারা ভুল কবিকে পড়ছে কেবল নামের কারণে, তখন আমি হয়তো বলি, ‘তুমি এই বইটি বরং পড়বার চেষ্টা করো না কেন ?’―পঠিত বইটির ওপর তাদের বিশ্লেষণমূলক আলোচনা লিখতে হয় এবং আমি তাদের কাজের পরিবর্তনের ধারাবাহিকতা লক্ষ করি আর প্রচুর কর্মশালা করি। যে কবিতাগুলো আলোচনা করা হয় না, সেইগুলো টীকাযুক্ত থাকে, ফলে সকলেই প্রতি সপ্তাতেই তাদের কাজের বিস্তৃত মতামত পায়। আমি প্রাথমিক বিশ্লেষণের আগেই সংলাপে যেতে পছন্দ করি। যখন একটি কর্মশালা হয় সেখানে আপনি কেবল ভুল চিহ্নিত করলে তা ফলপ্রসূ হয় না―আপনাকে বিকল্প কৌশলগুলি নিয়ে ভাবতে হয় যাতে কবি পুনর্বার তাতে প্রবেশ করতে পারে এবং দুর্বল জায়গাগুলির মুখোমুখি হতে পারে। আমাদের মূল লক্ষ্য হলো সেই কারণগুলো চিহ্নিত করা যার জন্যে কবিতাটি বিঘ্নিত হচ্ছে অথবা প্রচলিত মনে হচ্ছে। আমি হয়তো বলতে পারি―‘এমন কিছু আগেও পড়েছি এবং এই জায়গায় কবিতাটি মুখ থুবড়ে পড়েছে।’ এরপরে আপনাকে খুঁজে দেখতে হবে কেন কবিতাটি মুখ থুবড়ে পড়ছে এবং কী করলে এটি ফের দাঁড়াবে। মাঝে মাঝে আপনি শব্দের গড়নের কিছু  সম্ভাব্যতা দেখতে পান, যেমন একটি বাক্যের কাঠামোগত পরিবর্তন করা, বা একটি সংযজনকারী অব্যয় অন্য একটি অব্যয় দিয়ে প্রতিস্থাপন করা, অথবা সেমিকোলন সরিয়ে পূর্ণযতি বসানো এবং এভাবে বাক্যটিকে সচল হতে বাধ্য করা। যদি কোনও কারণে আপনি আটকে যান তবে সবসময় একটি জিনিসই করণীয়, সেটি হলো কবিতাটিকে প্রশ্ন করা। একটি প্রশ্নই কবিতার শৈলী পালটে দিতে পারে।

হেনরি কোল : আপনার নিজের কাজের মূল্যায়ন করা কি কঠিন আপনার কাছে ? আপনি নিজের কাজের পরিমার্জনার সিদ্ধান্তটি কীভাবে নেন ?

লুইস গ্লুক : আমি আমার কাজটির খসড়া অন্যদের দেখাই―অনেক মানুষকে নয়, কয়েকজনকে। মাঝে মাঝে আমি যে জায়গায় আটকে গেছি  সেই জায়গাটি দেখাই তাদের। আমি চেষ্টা করি সম্পূর্ণ কাজটির একটি খসড়া খাড়া করতে, কিন্তু প্রায় সময়ই আমি ওয়াকিবহাল থাকি যে কবিতাটি আমার প্রত্যাশা অনুযায়ী মানসম্পন্ন হয়নি। ইতোমধ্যে সাধারণত যে সময় আমি কবিতাটি কাউকে দেখাই তার আগেই আমি তার শেষ পঙ্ক্তিতে প্রায় পৌঁছে যাই―যত রকমের সমাধান সম্ভব সবই আমার চিন্তা করা হয়ে যায় এবং জিনিসটি তারপরেও ঠিকঠাক দাঁড়ায় না। আমার কোনও বন্ধু হয়তো বলল, ‘এইখানে জট পাকিয়েছে’, যদিও আমি ভেবেছি জটটা অন্য কোনওখানে। অথবা ওরা হয়তো বলতে পারে, এটি অতি দীর্ঘ হয়েছে এবং আমাকে কোন জায়গায় ছাঁটতে হবে সেটি দেখায় অথবা বলে এটি আরও বাড়ানো উচিত। যদি আমি নিজে ওদের সঙ্গে সহমত হই তবে আমি কবিতাটা মাজাঘষা করবার চেষ্টা করি। কেউ যদি বলে এই বাক্যটি  আবার লেখো কিংবা এইখানে আরেকটা স্তবক জুড়ে দেওয়া উচিত, আমি সেটিও করবার চেষ্টা করি।

মাঝেমাঝে, যদি আমার লিখনশৈলী বদলে যায় তবে আমার নিজের কোনও ধারণাই থাকে না আমি অসাধারণ অথবা চমৎকৃত হওয়ার মতো কিছু লিখছি কি না। আর আমার সকল বিশ্লেষণী ক্ষমতা একটি বিশেষ ধারার কবিতা অথবা নানা ধরনের কবিতার দিকে সক্রিয়। যদি আমি কোনও ভিন্ন ধারার কবিতা লিখতে শুরু করি তার জন্য আমার কোনও বিশেষ বিশ্লেষণী যন্ত্র নেই―আমি হয় কারও প্রত্যয়ন নিই অথবা পরের কাজটি শুরু করি। এটা অনেকটা শিশুপালনের মতোই, আপনি শিশুর সঙ্গে তার স্থানটিতে পৌঁছে যাওয়ার অভিযানের মতো―শিশুর যখন দশ মাস বয়স আপনি অবশেষে জানলেন কীভাবে দশ মাস বয়েসী শিশুর মাতা কিংবা পিতা হতে হয়, এবং তারপরেই হঠাৎ করে শিশুটির দুই বছর বয়স হয় এবং আপনার সকল দক্ষতা অচল হয়ে পড়ে। কিন্তু কিছু সময় পরে, আপনি কিছু জিনিস শিখে যান। মাঝে মাঝে আমার কবিতা নিয়ে আমিই অতিশয়োক্তিতে আচ্ছন্ন হই―আপনি সবসময়ই চান সবকিছু দারুণ হোক এবং আপনি কবিতাটি অন্য কাউকে দেখানো পর্যন্ত আপনার হাতে হয়তো চব্বিশ ঘণ্টা থাকে এবং সেই অনুভূতি এই চব্বিশ ঘণ্টার ভেতরেই উবে যায়। কিন্তু আমি সাধারণত সত্যিকার অর্থে ভালো কিছু তৈরি হলে বুঝতে পারি, যদিও তেমন ঘটনা প্রায় বিরলই বলা চলে যখন আমার লেখা-শেষে মনে হয়েছে এটি একটি নিখুঁত কাজ হয়েছে। আমার সাধারণত মনে হয় এই পঙ্ক্তিটি আরেকটু ভালো হতে পারত। অথবা, কিছু একটা ভুল হয়েছে এখানে। 

হেনরি কোল : আপনার কাছে কি সংয়ের মতো অবচেতনে পাওয়া কবিতা পরিমার্জনের প্রক্রিয়াটি কঠিন মনে হয় ?

লুইস গ্লুক : যে স্তবকটি আমাকে পীড়া দিয়েছিল সেটির কথা আমি বলতে পারি। এই কবিতার প্রথম স্তবকটি আমি ঝটপট লিখেছিলাম।

‘লিও ক্রুজ অপরূপ ধবল বাটি বানায়;/ মনে মনে ভাবি তোমাকে কয়েকটা দেওয়া চাই/কিন্তু কীভাবে প্রশ্ন একটাই/এখন এমনই সময়…’ এরপরে দ্বিতীয় স্তবক, ‘সে আমাকে চিনিয়েছে/মরুভূমির যত ঘাসেদের নাম;/ আমার একটা বই আছে/ কেননা ঘাস আর জন্মায় না কোথাও।’  

এটাও অসম্ভব দ্রুততায় লিখেছিলাম। এর পরে আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না কী করণীয়। স্তবকের শুরু ‘আমরা ঠিক করেছিলাম/ বুনো পথে হাঁটব সমান পায়ে’―এটি আমি তখনও পাইনি, আমি জানতাম এই কবিতা ছুটবে দুরন্ত যদি না ওখানে ঠিকঠাক কিছু বসে, এবং কিছু উল্টোপাল্টা পঙ্ক্তি এবং হয়তো আরও কিছু বাজে স্তবক লিখেছিলাম। বেশ সময় নিয়েছিল। আমি মনে করতে পারছি না আমি সেই ‘কখনওই নয়’ জায়গাটা পেয়েছিলাম কি না। ‘আমরা ঠিক করেছিলাম/বুনো পথে হাঁটব সমান পায়ে। জানতে চাইলাম,/কখন ? কখনওই নয়:/যে কথাটা আমরা বলি না কখনওই’―কিন্তু আমি নিশ্চিত, ‘আমরা ঠিক করেছিলাম/ বুনো পথে হাঁটব সমান পায়ে’ এই পঙ্ক্তিগুলো আমি পাইনি। 

হেনরি কোল : এই কবিতায় প্রচুর কমা এবং সেমিকোলন, এবং কবিতার অন্তে কোনও বিরামচিহ্ন নেই। এটা কি প্রত্যাশার ইঙ্গিত ?

লুইস গ্লুক : আমার জানা মতে―মানে, আমি তীব্র অনুভূতিকে যুক্তিযুক্ত করার চেষ্টা করেছি কেবল―যখন আমি লক্ষ করলাম প্রচুর বিরামচিহ্ন এবং মনে হচ্ছিল এর সবই ভুল। এরপরে আমি ভাবলাম, ‘ঠিক আছে তবে কেবল ড্যাশই ব্যবহার করব, যা বিরামচিহ্নের মতো মনে হবে না কিন্তু দেখা গেল বিস্তর ড্যাশ হয়ে গেলো এবং দেখতে অতিরিক্ত প্রগলভ মনে হতে লাগল। তবে এদের বাতিল করা আমার জন্যে খানিক অস্বাভাবিকই, কারণ আমি বিরামচিহ্ন পছন্দ করি।’

হেনরি কোল : নিজের কবিতার  ব্যাখ্যা দিতে আপনি কি চাপ অনুভব করেন ?

লুইস গ্লুক : না, আমি যা করেছি তা আমি করতে জানি। এরপরে লোকজন মতামত দেয়। ওরা যা বলে তা আপনি পছন্দ না-ও করতে পারেন, এমন কি ওরা তার সমর্থনে যুক্তি দিলেও নয়। তবে আপনি ওদের মতামত পড়ে ভাবতে পারেন, যদি ওরা যা বলছে আমি তেমন লিখেছি কি―তখন ছাদ থেকে ঝাঁপ দিতে ইচ্ছে করতে পারে, যদিও তারা আপনার প্রশংসাই করেছে, তার পরেও আপনি আতঙ্কিত হতে পারেন আপনি যা লিখেছেন তার ব্যাখ্যা পড়ে―আপনি ওরা কী বলছে তাতে আতঙ্কিত হচ্ছেন না, আপনার  শঙ্কা হচ্ছে ওরা যা বলছে তা সত্য হতে পারে বলে, কেননা আপনার জানা নেই তা। আপনার হতাশা এবং দুর্ভাবনাকে টোকা দেওয়া সহজ, কিন্তু আমি মনে করি, আপনি একবার যদি বই কিংবা পৃষ্ঠায় কিছু লিখে ফেলেন তার ওপরে আপনার মন্তব্য করবার অধিকার আর থাকে না। কবিতাটি ইতোমধ্যে আপনার মনোভাব ধারণ করে আছে―এটি আপনার প্রত্যয়ন এবং অনুমোদন নিয়েই বইয়ে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এরপরে আপনি আর কিছুই যোগ করতে পারেন না। আমি আমার ছাত্রছাত্রী যারা তাদের সহভাগকৃত কবিতাটির ব্যাখ্যা দেওয়ায় বিশ্বাসী তাদের বলি, ‘তুমি জানো যে তুমি যখন থাকবে না এই পৃথিবীতে তখন তুমি জনে জনে তোমার কবিতা ব্যাখ্যা দিতে পারবে না―একে ঠিকঠাক বইয়ের পাতাতে বসাতে হবে।’ এটা অনেকটা সুর তৈরির মতো ব্যাপার। আপনাকে এটি সঠিকভাবেই উপস্থাপন করতে হবে যাতে করে পরিচালক, যিনি আপনাকে চেনেন না এবং বাদকেরা, যারা এই স্বরলিপি আগে কখনও দেখেননি তারা আপনার স্বরলিপি অনুসরণ করে এই সুরটি বাজাবেন। আপনি চান আপনার কবিতাটি ঠিক একই ভাবে সকলের মনে অনুরণিত হোক ঠিক যেমন আপনার বেলায় হয়েছিল। এবং ঠিক তখনই আপনি বুঝতে পারবেন এটি কখনই সম্ভব নয়। তারপরেও এই লক্ষ্যেই আপনি কাজ করেন। আপনি এর এমন একটি সংস্করণ তৈরি করতে চান যা সহজে হারিয়ে যাবে না।

হেনরি কোল : এই সময়ে লেখালেখি কি ক্রমশ চাপযুক্ত হয়ে উঠেছে আপনার কাছে, যেহেতু নানা ভাষায় আপনার বই অনূদিত হচ্ছে ?

লুইস গ্লুক : না, কারণ আমি সেই সব ভাষা জানি না। তবে আশা করি কিছু অনুবাদ অন্তত ভালো হবে, তবে  ওরা আর আমার বই নয়। উদাহরণ হিসেবে বলি, আপনি কীভাবে ‘ফেইথফুল অ্যান্ড ভারচুয়াস নাইট’ শিরোনামটির ভাষান্তর করবেন ? এটা তো শব্দ শ্লেষালঙ্কার; এবং যে দীর্ঘ কবিতাটি এই বইয়ের ভিত্তি সেটি শ্লেষালঙ্কারে ভরপুর। ‘চিঁহি চিঁহি গেয়েছিল হৃদয়/ না কি চাহি না চাহি না―নিজেই জানি না’ (‘ঘবরময, হবরময ংধরফ সু যবধৎঃ,/ড়ৎ ঢ়বৎযধঢ়ং হধু, হধু―রঃ ধিং যধৎফ ঃড় শহড়’ি) ইংরেজি থেকে ভাষান্তর করা অসম্ভব। কাজেই আমি জানি না জার্মান, ফরাসি কিংবা ইতালীয় ভাষায় আমার কবিতাদের কী দুর্দশা হচ্ছে। 

হেনরি কোল : আপনি কি সেই বিশ্বকে পছন্দ করবেন যেখানে কবিদের কাজের যৌক্তিক ব্যাখ্যা দিতে হবে না ?

লুইস গ্লুক : আমি এমন কী বললাম যাতে আপনার মনে হলো আমাকে সবকিছুর কার্যকারণ বলতে হবে ?

হেনরি কোল : তা নয় তবে আপনার ‘সং’ কবিতার স্তবকগুলোর অন্তে বিরামচিহ্নের ব্যাখ্যা নিয়ে আমি জানতে চেয়েছিলাম।

লুইস গ্লুক : আমার দৃঢ় বিশ্বাস আমার প্রতিটা বইয়ের আবহ সম্পর্কে আমার স্পষ্ট ধারণা আছে, এবং এদের বিষয়বস্তু, উদ্বেগ কিংবা সঙ্কট যা তারা নিজেরা অনুসন্ধান করছে তার সবই আমার জানা। আমি একে যৌক্তিক নয় বরং বিশ্লেষণাত্মক বলেই মানি। আমি জানি আমার এই মনোভাব খানিক একপেশে, আমার দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়ার মতো কিছু থাকতেও পারে এবং সেটির উদ্ঘাটনে আমি শঙ্কিত হবো।

আমি কবিতা লেখা শেষে নিজেকে তার পাঠক হিসাবে বিবেচনা করি। আপনি যখন কবিতা নিয়ে কাজ করেন, আপনি এতে একই সঙ্গে নিমগ্ন এবং বিযুক্ত হয়ে থাকেন―কবিতা থেকে সরে এসে একে ফের দেখলে এর দুর্বল দিকগুলো, এবং না-চাইলেও যে জায়গাগুলো অস্বচ্ছ হয়ে যায় সেই সব নিয়ে চিন্তা করা যায়, কাজেই এখানে সবসময়ই দুইজন মানুষ কাজ করেন, একজন লেখক এবং অন্যজন পাঠক।

হেনরি কোল : তাহলে আপনার কবিতা পড়বার জন্যে আপনার কাছ থেকে কোনও নির্দেশনা চাওয়া উচিত নয় বলছেন ?

লুইস গ্লুক : না। আমি যেমন বলি, যা কিছু আমি প্রত্যাশা করছি তার সবই বইয়ের পাতাতেই থাকা উচিত।

হেনরি কোল : কবি হিসেবে আপনার বিশেষ কোনও দুর্বলতা আছে কি ?

লুইস গ্লুক : হ্যাঁ, আমি মনে করি ছন্দের ব্যাপারে আমার শ্রবণযন্ত্র একগুঁয়ে। আমার জানা মতে এটিই আমার সীমাবদ্ধতা, কারণ আমি এতে প্রচুর মনোযোগ দিই।

হেনরি কোল : একগুঁয়ে ছন্দ সচেতনতা ?

লুইস গ্লুক : আমার মনে হয় ইংরেজি কবিতা যে ছন্দে স্থিত থাকে সেটি খানিকটা ঘুমপাড়ানিয়া গোছের। আমি যখন খুব ছোট তখনই এটি আমার মাথায় বসে গেছে। এবং আমি সেই ছন্দের তালেই শব্দ বসিয়েছি। 

হেনরি কোল : এটি আমাদের হৃৎস্পন্দনের শব্দ।

লুইস গ্লুক : ঠিক তাই, কিন্তু মাঝে মাঝে তাতে খানিক রাসায়নিক ছিটাতে হয় যাতে অন্যদিকে পাশ ফেরে। এটিই আমার জানামতে আমার অন্যতম দুর্বলতা।

হেনরি কোল : আপনি কি কখনও কোনও কবিতা অসমাপ্ত রেখে অন্য একটি নিয়ে কাজ করেন, নাকি আপনি সবসময় একটি কবিতাতেই মনোযোগ দেন যতক্ষণ তা শেষ হয় ?

লুইস গ্লুক : মাঝে মাঝে কোনও কোনও কবিতা দীর্ঘ সময় নিয়ে নেয়, এবং কোনও এক সময় আমি এ নিয়ে হতাশ হয়ে পড়ি, তখন এটি অন্য কিছুর অংশ বনে যায়, তবে আমি সাধারণত একটি কবিতা নিয়েই কাজ করি এবং যা কিছু আমি ভাবি তা এই কবিতারই অংশ হয় শেষে। কবিতাতে এমন উপাদানগত অসমতা আমার পছন্দ কেননা এই ভিন্নতা কবিতাটিকে সরাসরি আমার মাথা থেকে খাতার পাতায় নামতে বাধা দেয়, যদিও মাঝে মাঝে ওরাই আপনার সেরা সৃষ্টি হয়।

হেনরি কোল : যদিও আপনি দীর্ঘ নীরবতার কথা বলেন কিন্তু আপনার বই পোয়েমস ১৯৬২-২০১২ (২০১২) প্রায় সাত শ’ পৃষ্ঠার বই এবং তার পরেও আপনি দুটি বই প্রকাশ করেছেন। আপনি কি কখনও সম্পূর্ণ  সৃজনশীল অবরুদ্ধতার কবলে পড়েননি ? 

লুইস গ্লুক : এই ধরনের শব্দচয়ন আমার অতি অপছন্দের, কেননা এটি আপনাকে নিরবচ্ছিন্ন সৃজনশীলতার আভাস দেয়। অবরুদ্ধতা এই শব্দটি আমি ব্যবহার করব না, কেননা আমি মনে করি মাঝে মাঝে থামতে হয় এবং জীবনকে জীবনের নিয়মে চলতে দিতে হয়। আপনার সঙ্গে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনার কারণে আপনার যাপনের প্রক্রিয়াটিতে পরিবর্তন আসে এবং আপনার জীবনবোধের দর্শন পালটে যায়। তখন সেই নতুন অক্ষটি থেকে নতুন বার্তা আপনার লেখায় উঠে আসে। সাধারণত আমি লিখতে না পারলে বিষণ্ন থাকি, যদি না আমি সদ্য কিছু লিখে শেষ করে থাকি―সেই ক্ষেত্রে আমি আনন্দে উদবেল থাকি। কেননা একটা লেখা শেষ করেই আমি তৎক্ষণাৎ কিছু লেখার চেষ্টা বা লিখতে বসার চাপ নিই না। আবার বিষণ্ন থাকা মানেই আমাকে এতে ইতি টানতে হবে এমন নয়। আমার মতে এটি অগ্নিপরীক্ষার মতো এবং এর ভেতর দিয়েই আমাকে আমার যাত্রা অব্যাহত রাখতে হবে। এ ব্যাপারে আমি বেশ নিষ্ঠ, বলা যায়। আমি যা লিখি তার একটি তালিকা আমার নিজের কাছে রাখি। ব্যাপারটি আমি ষাটের দশক থেকে করা শুরু করেছিলাম―এবং আমি আমার সেই তালিকায় দেখতে পাচ্ছি কোনও বছর আমি কিছুই লিখিনি, প্রতি মাসের ঘরে ঢ চিহ্ন দেওয়া, এবং এর পরে যা লিখেছি তা আগের দুই বছরের লেখাগুলোর মতো নয়―একেবারেই ভিন্ন রকমের। আমার মনে হয় না যদি আমি সেই বিরতির দুই বছর ধরে একনাগাড়ে লিখতাম, এমন কিছু তৈরি হতো। বরং নিজেকে নীরব করা এবং অপেক্ষা করেছি বলেই আমি সেই জায়গায় পৌঁছাতে পেরেছি। আমার ভুলও হতে পারে―হয়তো এটিই সেই কারণ নয় হয়তো আমি আরও দ্রুত সেই অবস্থানে চলে যেতে পারতাম―কিন্তু নিজের অভিজ্ঞতার আলোতেই  বলছি সেইসব গভীর খাদ-বিন্দুগুলিকে পার করার জন্য অপেক্ষাই উত্তম। আপনি কেবল অপেক্ষা করার ধৈর্যটি চালু রাখুন, অবশ্যি আপনি চাইলে লিখতে পারেন এবং যদি আপনি লিখতে অনিচ্ছুক হন তাহলেও ঠিক আছে, কেননা সেই ক্ষুদ্র উপহারটিও আপনার ঝুলিতেই যাবে, এই বিষয়টিও জানা থাকা জরুরি। 

 লেখক : অনুবাদক

কানাডা থেকে


বিশ্বসাহিত্য : লুইস গ্লুক-এর একগুচ্ছ কবিতা

বাংলা অনুবাদ : বদরুজ্জামান আলমগীর

প্রজাপতি

দেখো, দেখো প্রজাপতি।

তুমি কি প্রজাপতির কাছে মানত করেছো ?

একটি প্রজাপতির কাছে বর চেয়ো না।

তোমরা তা করো। তুমি কী তাই করেছো ?

করেছি তো।

মনে রেখো না।

শিক্ষার্থী বাছারা

আমাদের ছোট ছোট সন্তানেরা কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে সামনের দিকে যায়

তাদের মায়েরা লাল আর সোনালি নাইমলা আপেল কুড়াতে ব্যস্ত

যেন তারা ভিনদেশি ভাষা থেকে একটা একটা শব্দ তুলে আনে।

বোধ ও বোধি জারণের দিকে

অধীর অপেক্ষায় অমূল্য উপঢৌকন পাবার আশায়

ওদিকে হাত বাড়িয়ে আছে তারা।

তারা কতটাই না শৃঙ্খলার নিগড়ে

সংহত হয়ে ওঠে―

তারা পরনের কোটগুলো ঠিকঠিক আঙটায় রাখতে জানে।

তাদের শিক্ষকগণ পাঠদান করে নীরবতায়

মায়েরা বেরিয়ে আসার মুখে ফলবাগান গুছিয়ে আসে

পাকা ফলভারে খয়েরি ডালগুলো সাবধানে

তাদের দিকে টেনে নামায়―

যেখানে গোলার বদলে ফলের সম্ভার ফুটে আছে।


লাল পোস্তাদানা

কারও মন আছে

এটিই হতে পারে না

সবচেয়ে বড় কথা। মোক্ষম জিনিস বোধ :

ওটাই আছে আমার।

ওরাই আমাকে পথ দেখায়।

স্বর্গে আমার এক পরমেশ্বর আছেন

যিনি সূর্যের অধীশ্বর,

সূর্যের ভিতরটা উন্মোচন করেন

আমারই প্রাণের আগুনে নিজেকে রাঙান

অগ্নি তারই অবস্থিতির জাগর।

প্রাণের মহিমা ছাড়া এমন সম্ভ্রম

আর কিসেই বা হতে পারত ?

ওহে আমার ভাই ও ভগ্নিগণ―

মানুষ প্রাণি হয়ে ওঠার বহু আগে তোমরা কি

একবারের জন্যও আমাকে মায়া করেছিলে ?

তুমি কি স্বজ্ঞানে খোলসের বাইরে

বেরিয়ে এসেছিলে একবার, কেবল একবার

যারপর আর কখনওই বাইরে আসোনি ?

সত্যের নাভিমূলে দাঁড়িয়ে এখন আমি কথা বলছি

তুমি যেভাবে তা করো।

আমি কথা বলছি―

কেননা আমি এখন খণ্ডিত, টোটাফাটা।

———————————–

সকাল সকাল অন্ধকার

কোন ভরসায় তুমি বলো

দুনিয়া আমাকে উৎফুল্লতা দেবে ?

যা কিছু জন্ম নেয় সবই আমার ওপর

চেপে বসে।

তোমাদের সবার জন্য আমি একচুল এগুতে পারিনি।

তুমি আমাকে চালাতে চাও

তুমি চাও তুমি বলবে আমি শুনব

শোনো, তোমাদের মধ্যে কে বেশি গুরুত্বপূর্ণ―

যাকে দেখতে বেশি আমার মতো লাগে।

আর তুমিই জীবনের মোক্ষমকে অন্তরে রাখো

আলাদা হতে চেয়েও পেরে ওঠো না

তা তুমি বুঝতে দাও।

যদি নিজেদেরই বুঝতে না পারো

তাহলে  বুঝতে চাওয়া সোনার পাথরবাটি।

তোমার স্মৃতি এতটা শক্তিমান নয়

যা এত দূরের কিছু তুলে আনতে পারে―

কখনও ভুলে যেও না তোমরা আমার সন্তান

এ কারণে ভোগান্তি সইছো না যে

তোমরা একজন আরেকজনকে স্পর্শ করেছো

তোমরা এভাবে নাকাল হচ্ছো

কেননা তা জন্মের সঙ্গে এসেছে,

এটি জীবন―যা তোমাকে আমার থেকে

আলাদা করেছে।

——————————

পুকুর

রাত্রি তার পাখার নিচে ঢেকে রাখে পুকুর

আজ চাঁদের চারপাশে একটি আলোর চাকতি

আমি কিন্তু এমন করতেই পারি―

তুমি সাঁতরাচ্ছো ছোট ছোট মিনোও মাছের সাথে

আর ওপরে নক্ষত্র কাঁপছে সংরাগে।

রাত্রির বাতাসের নিচে পুকুরে জলের পিঠ

স্থির, অনড় ধাতব।

প্রাণান্তরে তোমার চোখজোড়া সজাগ।

আমি টের পাই তোমার চোখের পিছুটান

আমাদের স্মৃতি বসত করে ওই চোখে―আমরা

একসঙ্গেই ছোট থেকে ডাঙর হয়েছি।

পাহাড়ের কাঁধে চড়ে বেড়াত আমাদের ঘোড়া

ধূসরতার ওপর সাদা ডোরাকাটা আমাদের অশ্বদল।

তারা এখন ফেরি করে মৃতদের সাথে

যেন তারা ঘোড়া নয়―নেহায়েত শিশুদের দল

যারা উৎকন্ঠায় নিরাপত্তার চাদরের নিচে মুহ্যমান।

আমাদের থেকে পাহাড় অনেক দূরে

ওরা কালো, শৈশবের থেকেও ঝিম কালো।

তোমার কপালে ভাবনার বলিরেখা―

আকাশ-পাতাল কী এমন ভাবছো জলের সিথানে শুয়ে ?

তুমি যেই না জলের অতলে চেয়ে দেখো―

মন বলে, তোমাকে ছুঁই, একবার ছুঁয়ে দেখি

না―নিজেকে সামলে রাখি―

মনে হয়, কোনও এক আর জনমে আমরা

হয়তো বা এক রক্তের জ্ঞাতি ছিলাম।

————————————

বসন্ত বরফ

রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখো

দুটি ঘরানা দুই ক্ষমতা বলয়।

আমি এখানে জানলার পাশে তোমার কাছে

দেখি তুমি কীভাবে তা গ্রহণ করো। গতকাল

চাঁদ উঠেছিল আবছা ছায়ার বশে

আনত বাগানের পদতলে

চাঁদ বুঝি আলোর ধুলায় মৃতদের নিচে আস্তরণ।

চোখ বুজো নমিত করো তারে

আমি শুনি তোমার কান্নার ধ্বনি, কান্নার ছাউনি তলে

অবগুণ্ঠিত হও তুমি

তোমার পরান কী চায়, কী যে তুমি চাহ।

মনে করে দেখো―আমি দেখিয়েছি তোমায়

কী তোমার চাইতে হবে।

না, কোনও বিশ্বাস নয়―কেবল সমর্পণ

অধিরাজ যিনি―তার কাছে, যা বাজাবাজির অধীন।

—————————–

অধিগ্রহণ

তুমি আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলে, তোমার

আমাকে মনে রাখা উচিত।

বাগানে আমি সম্বিত ফিরে পেলে

তুমি এগিয়ে এসেছিলে―একবার নয়, দুইবার

আমি মাটির উপর পড়েছিলাম।

আমি বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম আমি কে

কোন কোন গাছ ছিল চারপাশে তা-ও জানতাম না।

বাগানে এসেছিলে দুই দু বার

তার আগে অন্যত্র এসেছিলে আরও অনেক বেশি

এই কথাটা লুকিয়ে চাপিয়ে রাখতে

আমি এদের কাটা চেরা করিনি, অন্য কোনও কিছুর

বীজও রোপণ করিনি আমি।

আমি কোথায় পড়েছিলাম তা-ও জানতাম না।

কেবল মনে পড়ে―আমার পাশেই আগুন জ্বলছিল

না, পাশে নয়―আগুন জ্বলছিল আমার ওপরে।

দূর থেকে ভেসে আসছিল নদীর ঢেউয়ের স্বনন।

আমি যে সামগ্রিক যোগসূত্রতা থেকে ছিটকে পড়েছিলাম

তার দিকে ন্যূনতম ভ্রুক্ষেপ ছিল না আমার।

আমার মাথার ওপর ছিল একটি ঘূর্ণমান চাকতি

আমার হাতদুটো ময়লায় ঢাকা ছিল

এমন কোনও কাজ করিনি যাতে হাত নোংরা থাকবে।

মিথ্যা বলব কেন―ওই সময়টা তো বাস্তব নয় আর।

যা আমি জীবন থেকে পেয়েছি তা কেন কড়ায়গণ্ডায়

বলে যাব না ?

আমাকে বদলে দিয়েছো তুমি, তোমার বরং

আমাকে মনে রাখা উচিত।

আমার সাকুল্যে মনে পড়ে―বাগানে হাঁটতে বেরিয়েছিলাম

আগে যেমন শহরের রাস্তায় রাস্তায় চক্কর লাগাতাম,

অথবা হাঁটতাম প্রথম এপার্টমেন্টের বেডরুমে।

নির্দ্বিধায় বলছি, আমি একলা ছিলাম, একা

একাকিত্ব ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে কী ?

————————-

চাওয়া

সেই সময়টার কথা মনে করতে পারো―যখন

বর চেয়েছিলে ?

আমি অনেক কিছুই তো চেয়েছিলাম।

আমি প্রজাপতি নিয়ে তোমাকে মিছা বলেছিলাম।

তবে সবসময়ই ভাবি তুমি কিসের বর চেয়েছিলে।

আমি কী চেয়েছিলাম বলে তোমার মনে হয় ?

জানি না আদতে। বোধ করি, ভেবেছি তুমি ফিরে আসতে পারো, আমরা হয়তো শেষমেষ আবার আগের

মতো একসঙ্গে হব।

আমি সবসময় যা চাই, আবারও তা-ই চেয়েছিলাম।

চেয়েছিলাম―যেন আরেকটা কবিতা লিখে উঠতে পারি।

——————————————————

চান্নিপসরে প্রেম

মাঝেমধ্যে এমন হয়, একজন পুরুষ বা একজন নারী নিজের সাকল্য হতাশা

আরেকজনের ওপর আমানত রেখে দেয়, তারপর মন খোলে,

ক্রমান্বয়ে হৃদয়ের অতল সিন্দুকও বুঝি উপুড় করে ধরে,

এভাবেই তারা এই মুহূর্তটির নাগাল পেয়ে প্রাণের সঙ্গে প্রাণের রাখিবন্ধনে মেলে।

বাইরে হয়তো তখন দুনিয়ার উন্মত্ত গ্রীষ্ম গোধূলি চাঁদের ওপর ছলকে পড়ে:

ছায়া ছায়া অপার শুভ্রতা মোহরের নিচে চেনা অচেনা অট্টালিকা, প্রাসাদ

গৃহ ও বৃক্ষের সারি, ওই তো ওখানে নিরিবিলি

উদ্যান এক―বিড়াল যেখানে পলাপলি খেলে,

পিঠের উপর শুয়ে ধুলা মাখে গায়, পাশেই আলগোছে

ফুটে থাকে গোলাপ, তার ধারে তমসার বেড়ে হলুদ গাঁদার ফুল, রাজধানীর কেন্দ্রভবন

সোনালি অর্ধ ডিম্বাকার প্রাসাদ, তাবৎ লোকস্মৃতি, প্রথা ও সৌজন্য―

সবাই এসে জড়ো হয় কাঠামোর বাইরে,

ধারাবাহিকতার ওপারে, সবাই আলগা হয়ে পড়ে :

চাঁদের আলোর জ্বরে, মোহন প্রভায়  সবাই আক্রান্ত :

সে যেই হোক, পাথর কী অন্য কিছু

তাদের সবার ওপরে কেবল চাঁদ―তার আলোকবর্তিকায় সজীব, দিব্যি কার্যকর।

————————-

নরক

তুমি কেন দূরে সরে গেছো ?

আমি আগুনের ভিতর থেকে হেঁটে বেরিয়ে গেছি―জ্যান্ত

কীভাবে এমন হতে পারে ?

কতদূর খুইয়েছো তুমি ?

না, হারাইনি কিছুই; এর সবটাই বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

একটা তীব্র কাজের পরিণতিই বিলয়।

ওখানে কি সত্যিকার আগুন ছিল ?

মনে পড়ে আমি বছর কুড়ি আগে বাড়ির দিকে

ফিরে যাচ্ছি, যা কিছু পারি তা আগলে রাখতে চাই।

চিনামাটির বাসনকোসন, বা এরকম যা―কিছু পারি

সবকিছুর উপর ধোঁয়ার গন্ধ ছিল যদিও।

খোয়াবের ভিতর আমার নিজেকে পোড়ার

এক চিতা বানিয়েছিলাম, আশা করি তুমি বুঝতে পারছো।

মনে হয়েছিল―ভোগান্তির চূড়ান্ত হয়েছে আমার।

ভেবেছিলাম, যাক এবার তার একটা কিনারা হোক :

আগুনকেই মনে হয়েছিল আমার সঠিক দাওয়াই

অগ্নিই ছিল একদম খাপে খাপ।

তারপরও তুমি মরোনি ?

এটি একটি স্বপ্নের বাইরে কিছু ছিল না; আমি বেজান

বাড়ির দিকে যাচ্ছিলাম, তার মধ্যেও মনে পড়ে―

নিজেকে বলছি―আসলে এতেও কাজ হবে না;

আমার আত্মারাম কোনওভাবেই মৃত্যুর কাছে

হার মানবে না।

আমি ভাবতাম আত্মা আর চৈতন্য একই জিনিস―

বোধ করি সবাই এমনই ভাবে।

তুমি কেন দূরে সরে গিয়েছিলে ?

আমি এক মোচড়ে আরেকটি দুনিয়ায় জেগে উঠি

একদম সরল সোজা ব্যাপার।

দূরে কেন সটকে পড়লে ?

দুনিয়া আগের মতো নেই। আমি আগুনের ভিতর দিয়ে

অন্য আরেকটি দেশে গিয়ে দাখিল হই―

হতে পারে এটি মৃতদের দুনিয়া, এর বাইরে আমার

আর কোনও ধারণা নাই।

এমন নয় যে, ওখানে চাহিদা বা আকাক্সক্ষার কিচ্ছা শেষ

বরং তা এক উচ্চতম পরাক্রমের বিন্যাসে সজাগ।

—————

সচিত্রকরণ : নাজিব তারেক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button