আর্কাইভলিটলম্যাগ

লিটল ম্যাগ : শালুক : অধুনাবাদ চিন্তাসঞ্চারী সাহিত্যালোক : মোজাম্মেল হক নিয়োগী

পঁচিশ বছরে সাহিত্যের সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে শালুক লিটলম্যাগ বাংলা সাহিত্যে, বিশেষ করে বাংলাদেশে অধুনাবাদ চিন্তা ও প্রথাবিরোধী পাল তুলে সাহিত্যানুরাগীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছে। বিকল্প চিন্তা, উদ্ভাবন ও সৃজনশীলতার প্রেরণাদাতা ও পরিচর্যাকারী কবি ওবায়েদ আকাশ সম্পাদিত শালুক লিটলম্যাগটি এক দিকে সাহিত্য বিকাশের বিধায়ক, অন্যদিকে প্রথিতযশা ও প্রতিভাবান কবি-লেখকদেরকে অকুণ্ঠ চিত্তে সম্মান জ্ঞাপনের স্মারকগ্রন্থ। কবি ‘জীবনানন্দ দাশ’, ‘সিকদার আমিনুল হক’ ও ‘আবুল হাসান’ প্রয়াত তিন কবির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে শালুক তিনটি সংখ্যা প্রকাশ করে বাংলা ভাষার সাহিত্যপ্রেমীদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। বিশেষ বিশেষ প্রকাণ্ড সংখ্যাগুলো ছাড়াও সাধারণ গতিধারার সংখ্যাগুলো বিশ্লেষণ করলে বলার অপেক্ষা রাখে না যে, লিটলম্যাগ হিসেবে শালুক বাংলাদেশে একটি মর্যাদারও প্রতীক। শঙ্খ ঘোষ সংখ্যাটি ছাব্বিশতম।

               ‘শঙ্খ ঘোষ : মুখোশছেঁড়া উজ্জ্বল প্রতিবাদ’ ৯৪৪ পৃষ্ঠার সুবিশাল কলেবরের সংখ্যাটি ধারণ করেছে নানা বর্ণীয় অসংখ্য লেখা। বিপুল আয়োজনে সমৃদ্ধ সংখ্যাটি প্রকাশের নিমিত্তে উপদেষ্টা পরিষদে ছিলেন আবদুর রাজ্জাক ও মঈনউদ্দীন মুনশী; সহযোগী সম্পাদক হিসেবে শ্রম ও মেধা যুক্ত করেছেন কবি মাহফুল আল-হোসেন, কবি ভাগ্যধন বড়ুয়া ও কবি মনিরুজ্জামান মিন্টু। প্রচ্ছদ করেছেন এই সময়ের জনপ্রিয় চিত্রশিল্পী মাসুক হেলাল এবং ভেতরের রেখাচিত্রের প্রতিকৃতি অঙ্কন করেছেন হিরণ মিত্র। শঙ্খ ঘোষকে নিয়ে লেখা বাংলাদেশের বিভিন্ন বয়সী তেষট্টি জন প্রাবন্ধিকের তেষট্টিটি মূল্যায়ন-প্রবন্ধ ঢাউস সংখ্যাটির প্রধান দখলদার। তাঁদের বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধগুলোতে শঙ্খ ঘোষকে সম্মান জানানোসহ তাঁর প্রতিভা ও কীর্তির আলোচনা-পর্যালোচনা স্থান পেয়েছে। এছাড়া কবি শঙ্খ ঘোষের জন্মভূমি বাংলাদেশ হওয়াতে কোনও কোনও লেখায় উৎকীর্ণ হয়েছে তাঁর কৈশোর-স্মৃতিফলক, দেশপ্রেমের বিভা। মূলত প্রবন্ধকাররা শঙ্খ ঘোষের প্রতিভা, তাঁর আবেগ ও অনুভূতি, মন ও মনন, চিন্তা ও চিন্তন এবং বিশদ কর্মযজ্ঞের অনুপুঙ্খ লেখচিত্র অঙ্কন করেছেন, তাঁকে অনুসন্ধান করেছেন যেখানে সম্পূর্ণ শঙ্খ ঘোষকে অনুধাবন করা যায়। এছাড়া প্রবীণ ও নবীন ১৩০ জন কবির কবিতা এই সংখ্যায় স্থান পেয়েছে। উনিশ জন গল্পকারের গল্প এই সংখ্যাকে দিয়ে আরও সমৃদ্ধি। এছাড়া একটি সাক্ষাৎকারের অংশবিশেষ, কবির আত্মজার স্মৃতিচারণমূলক একটি সংক্ষিপ্ত গদ্য, কয়েকটি অনূদিত কবিতা, গ্যাব্রিয়েলা মার্কেসকে নিয়ে একটি প্রবন্ধ, কবিতাবিষয়ক প্রবন্ধ, তিনটি বইয়ের আলোচনা, কবির সর্বশেষ গ্রন্থের ও নির্বাচিত কয়েকটি কবিতা এবং সর্বশেষে ‘শালুক আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মিলন’-এর একটি ছোট্ট প্রতিবেদন সন্নিবেশিত হওয়ায় সংখ্যাটিতে ভিন্ন মাত্রার ব্যঞ্জনার সৃষ্টি হয়েছে। এর কলেবর যেমন দীর্ঘ, ঠিক তেমনই বিষয় নির্বাচন ও বিন্যাসে সম্পাদকমণ্ডলীর প্রজ্ঞা ও মেধার পরিচয় পাওয়া যায়। লিটলম্যাগ প্রথাবিরোধী, নিয়ম ভেঙে বিধান তৈরি করে; এ-কারণেই দু-একজন লেখকের একাধিক বিষয়ে লেখা এই সংখ্যায় স্থান পেয়েছে।

               তেরো পৃষ্ঠার দীর্ঘ সম্পাদকীয়তে কবি ও শালুক সম্পাদক ওবায়েদ আকাশের ‘প্রিয় কবিদের রন্ধনশালায়’ কাব্যগ্রন্থের কবি শঙ্খ ঘোষের কবিতাটি দিয়ে শালুকের যাত্রা শুরু। এই কবিতায় কবির কাব্যপ্রতিভা, মন ও মনন, আবেগ-উচ্ছ্বাস, রাগ-বিরাগ, কবিতা ও ছন্দের সুরের একটি স্ন্যাপশট পাওয়া যায়। কবির স্বপ্ন হলো সমাজ ও রাষ্ট্র হোক মুখোশহীন। কিন্তু আমরা যে সমাজে বড়ো হচ্ছি সেই সমাজের মানুষেরা তো মুখোশেই মুখ ঢেকে রাখে। ‘মুখোশছেঁড়া উজ্জ্বল প্রতিবাদ’ সাবটাইটেলেও কবির সত্তার পরিচয় উন্মোচিত হয়েছে। শালুকের অধিকাংশ মূল্যায়ন প্রবন্ধেও শঙ্খ ঘোষ যে একজন নীরব প্রতিবাদের নিভন্ত আগুন, ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি তার প্রকাশ ঘটেছে। পুঁজিবাদ ও মুখোশের বিরুদ্ধে শঙ্খ ঘোষের প্রতিবাদী কবিতাটি জনপ্রিয়তার দিক থেকে শীর্ষে এবং এটি শালুকের অনেক প্রবন্ধেও স্থান পেয়েছে। মানুষ বুকের ভেতরে অনেক স্বপ্ন লালন করে, করতে চায় প্রতিবাদ, গাইত চায় সাম্যের গান কিন্তু তার সঠিক ভাষা অনেকের জানা নেই বলে তা প্রকাশ করতে পারে না। শঙ্খ ঘোষের এই কবিতার ভাষায় যেন প্রতিফলিত হয়েছে কোটি মনের ভাষা। এ-কারণে মানুষ এই কবিতার মধ্য নিজেকে একাত্ম করে তোলে। সামিল হয় প্রতিবাদের শব্দের মিছিলে।

               কবি শঙ্খ ঘোষ তারুণ্য ভালোবাসতেন এবং তিনি ছিলেন তারুণ্য-বান্ধব। অর্থাৎ বয়সের বিচারে নয়, মনের বিচারে, ভেতরের বিচারে তিনি তারুণ্যকে আপন করে নিতেন, ভালোবাসতেন, যে বিষয়টি সম্পাদকীয়তে প্রকাশ পায়। তরুণ কবি-সাহিত্যিকগণ শঙ্খ ঘোষের গদ্য পড়ে সাহিত্যের অলিগলিতে মুখরতা নির্মাণ করতে পেরেছেন বলেও সম্পাদকীয়তে উল্লেখ পাওয়া যায়। সম্পাদকীয়তে কবি ওয়াবেদ আকাশ উল্লেখ করেন :

শঙ্খ ঘোষের কবিতা তাঁর জীবনযাপনের মতোই অনেকটা নির্ভার, স্থিতধী, নিটোল এবং মহাসমারোহে আহ্বানের দিকে ধাবিত। এই নন্দন বসুন্ধরা, এই পৃথিবীর রূপময়তার মাঝে তিনি নিজেকে অক্ষম বলে আত্মসমালোচনা করে লিখেছেন― ‘আমার জন্য একটুখানি কবর খোঁড়ো সর্বহারা/ লজ্জা লুকাই কাঁচা মাটির তলে―/… নিবেই যখন গেলাম আমি, নিবতে দিয়ো হে পৃথিবী/আমার হাড়ে পাহাড় করো জমা―/ মানুষ হবার জন্য যখন যজ্ঞ হবে, আমার হাড়ে/ অস্ত্র গড়ো, আমায় করো ক্ষমা।’  [পৃ. ১৯]

ওবায়েদ আকাশ আরও উল্লেখ করেন :

বাংলাদেশের লেখকগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে কবি শঙ্খ ঘোষকে আবিষ্কার করেছেন তাঁদের লেখনীর মাধ্যমে, চিন্তার মাধ্যমে। মহান এই কবির জন্য এদেশের লেখকদের যে এত ভালোবাসা, এত অনুরাগ তা কেবল লেখাগুলো পাঠেই ধারণা করা সম্ভব। অসামান্য সব লেখা, সমৃদ্ধ সব বিশ্লেষণের ভিতর দিয়ে শঙ্খ ঘোষকে যথার্থ মূল্যায়ন করা হয়েছে মনে করি। [পৃ. ২৫]

               সম্পাদকীয়তে ওবায়েদ আকাশ আক্ষেপ করে বলেছেন, সব লেখকের লেখার আলোচনা বা উদ্ধৃতি দিতে পারলে ভালো হতো কিন্তু এত লেখার উদ্ধৃতি দিতে গেলে তা ভারী হয়ে যাবে। এটি সত্য কথা, তাহলে পাঠকগণ সম্পাদকীয় পড়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারতেন। অনুরূপভাবে আমারও আক্ষেপ যে, সব লেখকের লেখার অন্তত নির্যাস হিসেবে দু-একটি বাক্য দিতে পারলে ভালো হতো, পরিতৃপ্ত হতে পারতাম। কিন্তু প্রায় হাজার পৃষ্ঠা পড়া যেমন সময়সাপেক্ষ ব্যাপার, ঠিক তেমনই শ্রম ও ধৈর্যসাপেক্ষও। অল্প সময়ের মধ্যে এই বিপুল আয়োজনের পত্রিকাকে কব্জা করা সহজ কাজ নয়। শালুক শঙ্খ ঘোষ সংখ্যাটির মূল স্রোত তৈরি করেছে কবির মূল্যায়ন-প্রবন্ধগুলো। এছাড়া সমকালীন কবিতা ও গল্প এই স্রোতের সঙ্গে মিশেছে যেন শাপলা-শালুকের সঙ্গে পদ্ম, কলমিসহ আরও সৌন্দর্যবর্ধক জলজ নাম না-জানা পুষ্পপুঞ্জলতা।

               মূল্যায়ন-প্রবন্ধগুলো সম্পর্কে মোটা দাগে বললে দুটি বিষয় বেশি স্থান পেয়েছে বলে মনে হলো। প্রথমেই কবির প্রতিভা ও কর্মযজ্ঞের ওপর প্রবন্ধকারদের মূল্যায়ন ও মতামত। দ্বিতীয়ত তাঁর ব্যক্তিগত আবেগ-অনুভূতি ও যাপিত জীবন। কবির জন্মস্থান যেহেতু বাংলাদেশ তাই বাংলাদেশের প্রতি তাঁর অমোঘ ভালোবাসা ঘুরেফিরে অনেক লেখাতেই স্থান পেয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানের কথা তাঁর লেখাতে উল্লেখ পাওয়া যায়। দেশভাগের আক্ষেপও সেই সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে বিষাদের ঝড় তোলে।

               কবির পারিবারিক জীবনের একটি চিত্র পাওয়া যায় তাঁর আত্মজার লেখা থেকে। এই লেখা থেকে অনুধাবন করা যায় যে, তাঁর পারিবারিক বন্ধন ছিল নিটোল ভালোবাসায় পরিপূর্ণ। শুধু পারিবারিক বললে ভুল হবে, তিনি যে অতিথিবৎসল ছিলেন তাও এই লেখায় প্রতিফলিত হয়েছে। কয়েকজন প্রবন্ধকারের প্রবন্ধ বেশ সমৃদ্ধ এবং কেউ কেউ একাডেমিক বিধি অনুযায়ী প্রবন্ধ লিখেছেন; তাঁরা হলেন : মিহির মুসাকী, ইমতিয়ার শামীম, কুমার দীপ, নাসির আহমেদ, দিলারা হাফিজ, মহীবুল আজিজ, সাদ কামালী, এজাজ ইউসুফী, পৃথ্বিলা নাজনীন, বিপ্লব রায়, মোঃ আব্দুর রশীদ প্রমুখ। শঙ্খ ঘোষকে নিয়ে গল্প লিখেছেন মামুন হুসাইন। অন্যান্য গল্পকারের মধ্যে রয়েছেন সাদ কামালী, মোহিত কামাল, হাসান অরিন্দম, ইকরাম কবীর, কাজী রাফিসহ অনেকে। মোহাম্মদ রফিক, আসাদ চৌধুরী, মুহম্মদ নূরুল হুদা, কালীকৃষ্ণ গুহ, জাহিদ হায়দার প্রমুখ কবিদের সঙ্গে রয়েছেন একশত ত্রিশজন কবি।  

               পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, কবির জন্মস্থান বাংলাদেশ। তাই মাতৃভূমির প্রতি আবেগ ও ভালোবাসা তাঁর ছিল। একটি কথা বলা হয়তো অতিরঞ্জিত নয় যে, সাতচল্লিশের পর বাংলাদেশ থেকে আরও অনেক বিখ্যাত মনীষী পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক হয়েছেন। কিন্তু সবার মধ্যে মাতৃভূমির জন্য একই রকম আবেগ, ভালোবাসা ও মায়া প্রকাশ পায়নি, যতটা আমরা দেখতে পাই কবি শঙ্খ ঘোষের মধ্যে। কোনও কথায় তাঁর মধ্যে শিশুসুলভ আচরণও প্রকাশ পেয়েছে। হয়তো কবিমন বলেই এই মহান কবিসত্তার মধ্যে একটি শিশুমনও বাস করত। সফেদ ফরাজীর একটি সাক্ষাৎকারের সংক্ষিপ্ত অংশ ছাপা হয়েছে শালুকের এই সংখ্যায় যেখানে বাংলাদেশের প্রতি কবির গভীর ভালোবাসার বেশ কয়েকটি ঘটনা লক্ষ করা যায়। শঙ্খ ঘোষের কৈশোর কাটে পাবনার পাকশিতে। তাঁর কাছে এটি একটি শ্রেষ্ঠ স্থান। সাক্ষাৎকারের শিরোনামও হয়েছে কবির কথার, ‘আমার কাছে পৃথিবীর সেরা জায়গা হলো পাকশি’। এই সাক্ষাৎকারের কিছু অংশ এখানে প্রণিধানযেগ্য :     

[…] ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পরিবার-পরিজনের সঙ্গে বরিশালের বানারীপাড়ার নিজেদের বাড়ি ছেড়ে কলকাতায় চলে যেতে হয় আমাকে। এরপর দীর্ঘ ৫০ বছর পর ১৯৯৭ সালে একবার শুধু বানারীপাড়া গিয়েছিলাম, নিজের গ্রাম দেখতে, বাড়িটি দেখতে। এছাড়া ’৪৭-এর পর বাংলাদেশে বেড়াতে আসা হয়েছে ’৭৫, ’৮৪, ’৯৫, ’৯৭ ও ২০০১ সালে। প্রতিবারই একটু ঘোরাফেরা করে, পরিচিত কয়েকজন কবি-সাহিত্যিকের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে চলে গেছি। সভা-সেমিনার বিষয়টিতে আমার ভয় লাগে। তাই সভা-সমিতিতে আমি খুব একটা যাই না। এবারও এক পারিবারিক নিমন্ত্রণে বেড়াতেই এসেছি। বাংলাদেশের প্রতি আমার যে অনুভূতি তা তো ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। [পৃ. ৮৮]

               পঞ্চাশ বছরে অনেক জনপদেরই পরিবর্তন হয়েছে, হওয়াটা স্বাভাবিক। জনপদের পরিবর্তন মানে ওই জনপদের জলবায়ু, রূপ-বৈচিত্র্য, অবকাঠামো, সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয়ের পরিবর্তন হওয়াটা খুব সাধারণ ঘটনা। কবির কাকা দেশভাগের পর বানারীপাড়ায় এসে অনেক কিছুর পরিবর্তন দেখতে পেয়ে খুব দুঃখ পেয়েছিলেন। তাঁর আক্ষেপের শেষ ছিল না। তাই কবি যখন বললেন, সবকিছু আগের মতোই আছে বলেন তখন তিনি বলেছিলেন, কবির কথা বিশ^াস না করার জন্য; কবি মিথ্যা বলছেন। কবি এই কথার প্রেক্ষাপটে বলেন দুজনের দৃষ্টিভঙ্গি দুই রকম বলেই দুজনের দেখা দুই রকম। তিনি বলেন :

বানারীপাড়ার সঙ্গে আমার নাড়ীর যোগ অবিচ্ছেদ্য। ৫০ বছর পর ১৯৯৭ সালে যখন বানারীপাড়ায় গিয়েছিলাম তখনও নিজেদের বাড়িটি চিনতে একটুও ভুল হয়নি। ঠিক ঠিকই চিনতে পেরেছি। আমার স্মৃতির সেই গ্রাম, সেই বাড়ি, সেই বাগানবাড়ি, সেই গাছপালা ঘেরা প্রকৃতি, সেই পথঘাট, সেই নদী ৫০ বছর পরও সেই একই রকম রয়ে গেছে। […] উনার (কাকার) চোখে যে পরিবর্তনগুলো বেশি পড়েছিল সেগুলো হচ্ছে পুজোর ঘরটিতে প্রতিমা নেই, ঘরবাড়িতে কেমন যেন পরিবর্তন আনা হয়েছে, এইসব। কিন্তু আমি দেখলাম সেই গ্রাম, সেই পথ, সেই নদীনালা, সেই বাগানবাড়ি, সেই গাছপালা, সেই মানুষজন সবই প্রায় আগের মতোই। দু’জনে আসলে দুই রকম অনুভূতি দিয়ে দেখা হয়েছে তো। [পৃ. ৮৯]

               আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ওপর ‘রাইফেল রোটি আওরাত’ নামে প্রথম উপন্যাসের লেখক আনোয়ার পাশা ছিলেন ভারতের নাগরিক। তাঁর সঙ্গে কবি শঙ্খ ঘোষের ঘনিষ্ঠতার পরিচয় পাওয়া যায় এই সাক্ষাৎকারেই। এমনকি পাশা শব্দটি তাঁরই দেওয়া। এই বিশেষ ঘটনাটি এই সাক্ষাৎকারটি না পড়লে জানার সুযোগ কোথায় ? আনোয়ারুল ইসলাম কীভাবে আনোয়ার পাশা হলেন তারই সংক্ষিপ্ত ইতিহাস শালুক জানার সুযোগ করে দিল :  

[…] আনোয়ারের সঙ্গেও আমার যে কত স্মৃতি! কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ পড়ার সময় বিশ^বিদ্যালয় থেকে একটি ম্যাগাজিন বের হয়েছিল। এবং এটি সম্পাদনার দায়িত্ব পড়েছিল আমার উপর। তখন আনোয়ারের একটি কবিতা ওতে ছাপা হয়েছিল। আনোয়ার তখন ‘মুহম্মদ আনোয়ার’ নামে লিখত, কিন্তু আমি ওটিকে ‘আনোয়ার পাশা’ বানিয়ে ছেপে দিয়েছিলাম। (মৃদু হাসি)। এরপর ও আনোয়ার পাশা নামেই লিখত। […] আনোয়ার পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে চাকরি পেয়ে বাংলাদেশে চলে আসার আগে আমার সঙ্গে দেখা করে একটি ডায়লগ দিয়ে এসেছিল, এখনও স্পষ্ট মনে আছে। একদিন হুট করে আমাকে বলল, আমি চললাম। আমি বললাম, চললাম মানে? ও বলল, পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে শিক্ষকতার চাকরি পেয়েছি, তাই পাবনায় চলে যাচ্ছি, এখন তুমি থাক আমার দেশে, আমি গেলাম তোমার দেশে। আনোয়ারের এই কথাটি আমার মনে গেঁথে আছে! [পৃ. ৯০]      

               শঙ্খ ঘোষের তনয়া শ্রাবন্তী ভৌমিকের (ঘোষ) সংক্ষিপ্ত একটি বেদনাবিদুর স্মৃতিকথা, যেটি ছাপা হয়েছিল ‘এই সময়’-এ, [কলকাতা, ৯ অক্টোবর, ২০২১] পাঠকের মনেও বিষাদের ছায়া ফেলে। ‘বাবা নেই, এবার শরতের আলো আমার জন্য নয়’ শিরোনামে তাঁর লেখার শেষাংশ :   

হঠাৎ করে বদলে গেল আমার পৃথিবী। একরাশ শূন্যতা এসে ভর করল আমার চেতনাকে। তবু ভাবি, এও তো জীবনকে একরকমের চেনার সময়। সবাই যখন শারদীয় আনন্দে মাতোয়ারা, আমি তখন নির্জনে বসে ভাবব মা আর বাবার সঙ্গে পুজো কাটানোর ভালো সময়গুলির কথা। ‘নীরব জপের মালার ধ্বনি অন্ধকারের শিরে শিরে।’ আজ একা বসে শোনার সময় হলো। [পৃ. ৭৪]

শালুকের প্রতিটি সংখ্যায় থাকে সম্পাদকীয় পরিষদের গভীর ভালোবাসা, অকৃত্রিম আন্তরিকতা, শ্রম ও নিষ্ঠা এবং সর্বোপরি তাঁদের সৃজনশীল ও মননশীল প্রতিভার স্বাক্ষর। এই সংখ্যাটি কলেবরের দিক থেকে অন্যান্য যে-কোনও সংখ্যার চেয়ে বড়ো এবং প্রায় দুইশ লেখকের লেখার মাধ্যমে অভিষিক্ত। কবি শঙ্খ ঘোষের প্রতি বাংলাদেশের কবি-লেখকদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা কতটা গভীর তার দলিল শালুকের এই সংখ্যা। 

               লিটলম্যাগের ইতিহাসে শালুক তথা শালুকের সম্পাদক কবি ওবায়েদ আকাশের বিভিন্ন উদ্ভাবনমূলক ঘটনা বা কাজের ইতিহাস আছে যেগুলো এখনও আমাদের অলক্ষ্যেই থেকে যাচ্ছে। এমনই একটি ঘটনা, বইমেলায় লিটলম্যাগের জন্য স্টল বরাদ্দের বিষয়টি শালুকের শঙ্খ ঘোষ সংখ্যাটির উদ্বোধনীর দিন জানা গেল। বাংলা একাডেমি কর্তৃক আয়োজিত অমর একুশে বইমেলায় লিটলম্যাগের জন্য স্টল বানানো ও বরাদ্দের নেপথ্যের প্রথম কুশলীব যে ওয়াবেদ আকাশ তা অনেকেরই অজানা। তিনিই প্রথম এর উদ্যোগ নেন এবং বর্তমানে বইমেলায় লিটলম্যাগ একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান জুড়ে থাকে।

               শালুক আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মিলন ২০২৩ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শালুক  লিটলম্যাগ জগতের একটি স্মরণীয় ঘটনা বা ইতিহাস সৃষ্টি করল। ইতোপূর্বে দুই দিনব্যাপী এ-ধরনের আন্তর্জাতিক বা জাতীয় সম্মেলন লিটলম্যাগের পক্ষে কোথাও অনুষ্ঠিত হয়েছে কি না আমাদের জানা নেই। এই দুই দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন শালুকের এই সংখ্যার শেষ ছয় পৃষ্ঠায় স্থান পেয়েছে। প্রতিবেদনটি লিখেছেন কবি ও প্রাবন্ধিক পারভেজ আহসান।

               শালুক আরও গতিশীল হবে এবং বাংলা ভাষার লেখক সৃষ্টি ও পৃষ্ঠপোষকতায় অগ্রণী ভূমিকা রাখবে বলে আমাদের বিশ্বাস। শালুকের জন্য অশেষ শুভকামনা। 

 লেখক : কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button