লেখক হওয়ার জন্য জন্ম যার : মঞ্জু সরকার
মঞ্জু সরকারের নিবন্ধ
খোকা, বড় হয়ে তুমি কী হবে ? বাল্যকালে বড়দের এমন বেকুব প্রশ্ন শুনলে অনেক সময় জবাব দিতাম না। তার কারণ অপরিণত বয়সে এত কিছু হতে ইচ্ছে করে যে, স্রেফ একটা কিছুতে স্থির থাকা বড় কঠিন। তাছাড়া বড় হয়ে ইচ্ছেমতো একটা কিছু হতে বড়রাই পারে না, আর ছোটরা তো যাকে বলে তরলমতি নাবালক। অল্প বয়সে হাজারো স্বপ্ন-সম্ভাবনা মনে উঁকি দেয়। কিন্তু কিছু একটা হওয়া কি কেবল ছোটদের ইচ্ছাশক্তির ওপর নির্ভর করে ? ছোটবেলাতেও এ সংশয় ছিল বোধহয়। ইচ্ছেটা তাই ঘন ঘন বদল হতো। ট্রেনের ড্রাইভার, পুলিশ, গুণ্ডা, বিখ্যাত গায়ক, নায়ক, বুজর্গ দরবেশ, মুজিব-ভাসানীর মতো বড় নেতা, এরকম কত কিছু হওয়ার কথা ভেবেছি!
স্বজন-শুভার্থী, যারা মানুষ হওয়ার জন্য হরদম দোয়া করে, লেখাপড়ার খোঁজ নেয়, তারাও শিক্ষাজীবন শেষের কর্মজীবন তথা পেশা দিয়েই চেনার চেষ্টা করে, কীরকম মানুষ হব আসলে।
মানুষ হওয়ার প্রক্রিয়ায় পেশা নির্বাচন যে জরুরি সেটাও হাইস্কুলের শেষ দিকে বুঝতে শুরু করি। এক জীবনে সব কিছু তো হওয়া যাবে না। নির্দিষ্ট একটা পেশার স্বপ্ন সামনে রেখে লেখাপড়া চালাতে হবে। হাইস্কুলেই ঠিক করতে হবে আর্টস, বিজ্ঞান, নাকি কমার্স নিয়ে পড়ব। আমাদের কৈশোরে জজ-ব্যারিস্টার নয়, অধিকাংশ ভালো ছাত্রের অ্যাম্বিশন ছিল ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়া। এ দুই পেশায় গেলে সামাজিক মর্যাদা ও আর্থিক সাফল্য অর্জন-উপার্জন অবধারিত। সুবিধা ও ক্ষমতার ক্রিম মাখানো নানা ধরনের সরকারি চাকরির পদ ও পদবিও কিশোর-মনকেও প্রলুব্ধ করে সহজে। নিজেও যেমন ভালো ছাত্র হিসেবে পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে জেলার ডিসির বাংলোয় সিএসপি ডিসির সঙ্গে হ্যান্ডশেক এবং কথা বলার সুযোগ পেয়ে ভেবেছিলাম, সিএসপি ডিসি হওয়াই সই। মোট কথা মানুষ হওয়ার শেষ গন্তব্যই ছিল একটা চাকরি। আর শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যই যে একটা চাকরি―সেটা তো ঔপনিবেশিক আমলের কেরানি বানানো শিক্ষাব্যবস্থায় পোক্ত হয়েই ছিল। আমার ক্ষেত্রে গোল বাধে, এই ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে নানারকম অ-পাঠ্য ও দুষ্পাঠ্য বই পড়ার সুযোগ পেয়ে।
শৈশব-কৈশোরে জীবন ও জগৎ নিয়ে কৌতূহলের অন্ত থাকে না। আমার মধ্যে জিনিসটা বোধহয় একটু বেশি পরিমাণেই ছিল। এমন সব অভিজ্ঞতাও হয়, কখনও-বা এমন আবেগজাত বেসামাল চাপ সৃষ্টি হয় মনে, যা নিজের মধ্যে চেপে রাখা দায়, আবার অন্যকে মুখে বলাও যায় না। এমন অবস্থায় প্রকাশের জন্য কাগজ-কলমই অকৃপণ সাহায্য করতে পারে। শব্দকে নিঃশব্দে কাগজের মধ্যে বসাতে বসাতে, নবীন যৌবনে পদার্পণ করতে না করতেই আত্মআবিষ্কারের অন্তহীন অভিযানের মধ্যে একদিন নিজের মধ্যে সম্ভাবনাময় এক কবি-লেখককেও আবিষ্কার করি।
অনেকেই বলেছেন, বাঙালি ছেলেমেয়েরা কবিতা দিয়ে যৌবন শুরু করে। আবেগ-উচ্ছ্বাসে ভরপুর তারুণ্যে ইচ্ছেপূরণের কল্পনায় মুক্তি খোঁজা অস্বাভাবিক নয়। পাঠ্যবইয়ের বাইরে সস্তা ডিটেকটিভ সিরিজসহ নানারকম সাহিত্যের বই পড়ার সুযোগ পেয়ে, পড়তে পড়তেই এক সময় বুঝতে পারি, অন্ত্যমিল দিয়ে পদ্য লেখা কঠিন কাজ নয় মোটেও। আর ইচ্ছে পূরণের জন্য কল্পনার ডানা মেলে নানা গপ্পো-কাহিনি বানানোটা বেশ মজার। হাতে-কলমে প্রমাণ দেওয়ার আগে, মুখে মুখেও গুল-গল্পকে বিশ্বাসযোগ্য করে বন্ধুদের কাছে বলে সক্ষমতা দেখাতে থাকি। সৃজনের এই খেলায় মজা পেতে শুরু করলে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎচন্দ্রের মতো বিখ্যাত কবি-লেখকের সঙ্গে আত্মীয়তাবোধ জাগ্রত হতে থাকে। ঠিক করি, নিজেও এদের মতো একজন হব। দেশ-বিদেশের কত লোক আমার লেখা পড়বে, আমাকে চিনবে―ভাবতেও খুব রোমাঞ্চিত হই।
কিন্তু সমস্যা হলো, লেখক হওয়ার উৎসাহটা আসে কেবল নিজের ভিতর থেকে। মরেও অমর কবি-লেখক যারা, নিজেদের সাহিত্যকর্ম দিয়ে তারা দলে টানার জন্য প্রেরণা দেন বটে, জীবিতরা কেউ উৎসাহ দেয় না। লেখক হতে চাই শুনলে স্বজন-শুভার্থীরা বরং নিরুৎসাহিত করার জন্য বৈরী বাস্তবতা চেনায়।’ কবি কবি ভাব বজায় রাখলে ভাত-কাপড়ের অভাব হবে অবশ্যই। লিখতে চাও ভালো কথা, কিন্তু তার আগে সামাজিক প্রতিষ্ঠার জন্য একটা পেশা লাগবে। বাংলা উপন্যাসের গুরু, সাহিত্য সম্রাট যাকে বলা হয়, সেই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও ব্রিটিশ সরকারের ডেপুটি ছিলেন। অনন্য প্রতিভাশালী রবীন্দ্রনাথ তো জমিদারপুত্র। সব দিক থেকেই অসাধারণ। গরিব ঘরের বাড়ি-পালানো নজরুল, কবিতা ছাড়াও হাজার হাজার গানের স্রষ্টা, তারপরও কি আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য এসেছিল জীবনে ? বর্তমান কালেও শুধু লিখে সচ্ছল সুখী জীবনযাপন করছে কয়জন ?
কবিতা লিখি জেনে বাবা কৈশোরেই জেলা শহরের এক কবির কাছে নিয়ে যান। যতদূর মনে পড়ে, নুরুল ইসলাম কাব্যবিনোদ ছিল নাম। নামের শেষে কাব্যবিনোদ উপাধিসহ তার এক চটি কাব্যগ্রন্থও দেখেছি। লুঙ্গি পরে তিনি এক লাইব্রেরিতে চাকরি করতেন। কবি হওয়ার আগে ভালোমতো লেখাপড়া করে মানুষ হও―এ জাতীয় উপদেশ দিয়েছিলেন তিনিও।
কলেজে ভর্তি হওয়ার পর ভেবেছিলাম, পেশা যদি এতই অপরিহার্য. তবে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বা ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক হব। কিন্তু মাস্টারি নয়, লেখকই হবে মূল পরিচয়। অধ্যাপনা পেশায় থেকেও যেমন জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখের সাহিত্যকীর্তি প্রধান। কিন্তু ছাত্রজীবনে সরকারি কলেজের বাংলা সাহিত্যের কিছু অধ্যাপককে দেখে হতাশ হই। একজন তো আমার সৃজনকর্মের নমুনা পড়ে দেখার সময় নেই বলে বেশ তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছিলেন। রাগ হয় খুব, মনে হয়েছিল, লেখক হওয়ার জন্য এরকম অধ্যাপক হওয়া মোটেও জরুরি নয়।
অন্যদিকে গণ্ডীবদ্ধ একাডেমিক লেখাপড়াও তৃপ্ত করতে পারছিল না নিজের সীমাহীন পঠনতৃষ্ণা। জেলা শহরের ঐতিহ্যবাহী পাবলিক লাইব্রেরি ও রঙ্গপুর সাহিত্য পরিষদের বইপত্র পড়েই সময় কাটাতাম বেশি। কালজয়ী বিশ্বখ্যাত লেখকদের নামগুলি তো প্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছিল। এ ছাড়াও একাডেমিক ডিগ্রি কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক পেশা-পদবি অর্জনকে পাত্তা না দেওয়া লেখকদের সাহিত্যকর্মের পাশাপাশি তাদের সাহিত্যজীবন দেখেও প্রেরণা খুঁজতাম। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বীরভূমের লোকজীবনের অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে লেখার জন্য কলকাতায় গিয়ে ঘর ভাড়া নিলেন। তারপর আজীবন কাগজ-কলম-মনের একনিষ্ঠ সাধনায় কত কীর্তি কত নাম! মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ও সারা জীবন নিজেকে কলমপেশা মজুর ভেবেই দারিদ্র্যের পীড়ন সয়েও লিখে গেছেন। বিভূতিভূষণও চাকরি করতে বিহারের জঙ্গলে গিয়েছিলেন বটে, অভিজ্ঞতার সৎ ও সরল রূপায়ণও হয়ে উঠেছিল প্রধান কাজ। নিজের লেখকজীবনের শুরুতে জীবিতদের মাঝে জনপ্রিয় সমরেশ বসুর সার্বক্ষণিক লেখক-জীবনও প্রেরণা জোগায়।
বড় লেখক হতে হলে ভালো পাঠক হতে হবে আগে। সব লেখকই বলেছেন কথাটা। কাজেই বড় লেখক হওয়ার স্বপ্ন-সাধনা উজ্জীবিত রাখতে, অনুবাদে ও ইংরেজিতে হাতের নাগালে বিশ্বসাহিত্য যা পাই, পড়তে শুরু করি। মস্কোর প্রগতি প্রকাশনের বাংলা-ইংরেজি অনুবাদের মাধ্যমে রুশ সাহিত্যের টলস্টয়, দস্তয়েভস্কি, আন্তন চেখভ। ইংরেজি সাহিত্যের মধ্যে হেমিংওয়ের কয়েকটি উপন্যাস সহজবোধ্য ও বেশ উপভোগ্য মনে হয়। তবে নবীন যৌবনে যার উপন্যাস পড়ার আগে একটি সাক্ষাৎকার পড়ে খুব প্রভাবিত হয়েছিলাম, তিনি নোবেল বিজয়ী মার্কিন লেখক উইলিয়াম ফকনার। প্যারিস রিভিউতে প্রকাশিত ফকনারের সাক্ষাৎকারটি কোনও এক সাহিত্য পত্রিকায় বাংলা অনুবাদেই পড়ি প্রথম।
ভালো ঔপন্যাসিক হওয়ার জন্য কী দরকার ? এমন প্রশ্নের জবাবে ফকনার মনে করেন, শতকরা ৯৯ ভাগ প্রতিভা, ৯৯ ভাগ শৃঙ্খলা ও ৯৯ ভাগ পরিশ্রম। ফকনারের মতে, একজন লেখকের তিনটি জিনিস দরকার হয়। অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ ও কল্পনা। প্রকৃত লেখক শিল্পের কাছে দায়বদ্ধ, এ জন্য তিনি যা খুশি তাই করবেন। লেখক হওয়ার জন্য তার আর্থিক স্বাধীনতার প্রয়োজন নেই। পূর্বসূরি বা কোনও ফর্মুলা অনুসরণের প্রয়োজন নেই। নিজের কাজে কখনই তিনি সন্তুষ্ট হতে পারেন না এবং নিজের ভুল থেকেই শিক্ষা নেন।
তরুণ বয়সে ফকনারের এসব চিন্তাকে শতভাগ সহি হাদিস ভেবে লেখক-পেশা বেছে নিতে উৎসাহিত হই। দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছেড়ে অ্যাম্বিশন চূড়ান্ত করে ফেলি, লেখকই হব। বড় চাকরি বাগানো মানুষ হওয়ার জন্য প্রচলিত পথে হাঁটব না আর। বৃক্ষ তোর নাম কী ? ফলে পরিচয়। এটাই আসলে বেশ কাজের কথা। আমার কাজ হবে ভালো লেখা। তা হলে আর উপযুক্ত অন্য পেশার দরকার কি ? আর অন্য পেশা অবলম্বন করতে না চাইলে উচ্চতম একাডেমিক ডিগ্রি ধুয়ে কি পানি খাব ? গৎ বাঁধা লেখাপড়ার বদলে বিচিত্র বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের জন্য লাইব্রেরি ভরা বই তো আছেই। তাছাড়া প্রকৃত লেখক আসলে জীবন থেকেই শিক্ষা নেবে। চোখের সামনে শহর-বন্দর-গ্রামে কত বিচিত্র জীবনপ্রবাহ। নিজেকে ভাসিয়ে দিলেই হলো। দুঃখ-কষ্ট হবে, বেদনায় নীল হয়ে যাব কখনও-বা, কিন্তু দুর্ভোগ-যাতনাও লেখার বড় পাথেয় হয়ে উঠবে। নবীন যৌবনের এরকম রোমান্টিক চিন্তাচেতনা সম্বল করে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তথা কলেজের সঙ্গে সম্পর্ক ঘুচিয়ে দিলাম একদিন। ফলে পরিবার ও স্বজন-শুভার্থীদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হতে বিলম্ব হয় না।
শুধু লেখক হওয়ার জন্যই যৌবনে মহাবিদ্রোহী হয়ে উঠি, এমন বললে ভুল হবে। কারণ একজন ব্যক্তি যখন প্রচলিত রীতিপ্রথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে, তার মনস্তাত্ত্বিক কারণগুলো যাই হোক, দৃশ্যমান কারণগুলো সেই সমাজ-পরিবেশ ও সময়ের মধ্যে খুঁজে পাওয়া সম্ভব। আমার নিজের ক্ষেত্রে যেমন ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি ও পরিণতি এক আবেগময় কিশোর-তরুণের চেতনায় তীব্র প্রভাব ফেলে। সত্তরে ছিলাম কারমাইকেল কলেজের ছাত্র। দেশপ্রেম, প্রকৃতিপ্রেম, সৌন্দর্য কী নারীপ্রেম সব প্রেম একাকার হয়ে ওঠার সময় ছিল সেটা। আত্মোৎসর্গ করার আবেগ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হতে একাত্তরে বাড়ি থেকে পালিয়ে ইন্ডিয়া গিয়েছিলাম। অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করার সুযোগ পাইনি। সঙ্গে দেশপ্রেমমূলক কবিতার খাতাটি ছিল। সেই অস্ত্র প্রয়োগের জন্য স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রও খুঁজে পাইনি। ডিসেম্বরে ইন্ডিয়া থেকে স্বাধীন দেশে ফিরে দেশপ্রেমের আবেগটা মিথ্যে হয়ে যায়নি। বরং অর্জিত স্বাধীনতার অসম্পূর্ণতা দেখেশুনে, সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা হতে না পারার আক্ষেপ মেটাতেও বটে, বিপ্লবী কলমযোদ্ধা হয়ে ওঠার সংকল্পটাই বেপরোয়া হয়ে উঠল। ততদিনে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এমন সব আবেগময় অভিজ্ঞতা হয়েছে, এগুলো নিয়ে আমি মহৎ সাহিত্য রচনা করতে না পারলে আর কে পারবে ? ম্যাক্সিম গোর্কির উপন্যাস মা ছাড়াও তার স্মৃতি ও অভিজ্ঞতানির্ভর বই পৃথিবীর পথে ও জীবনের পাঠশালায় বেশ উৎসাহিত করেছিল। আর গোর্কির মতো বাস্তববাদাী বিপ্লবী লেখক হতে চায় যে, মানুষ হওয়ার প্রচলিত ধ্যানধারণায় নষ্ট করার মতো সময় তার থাকে ? প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া ও কলেজের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের কথা ঘোষণা করলাম নতুন করে।
অন্যদিকে পিতা আমাকে শহরে রেখে পড়াচ্ছিলেন ভালো রেজাল্ট ও উপযুক্ত মানুষ করার আশায়। বখে গিয়ে ততদিনে উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করিনি শুধু, বিস্তর পয়সার অপচয় করে বিরাগভাজন হয়েছিলাম তার। স্বাধীনতার পর নিজেদের দল ক্ষমতায় এসেছে বলে দাপটও বেড়েছিল পিতার। আমাকে শুধু টাকার জোগান দেওয়াই বন্ধ করলেন না, অঘোষিতভাবে ত্যাজ্যপুত্র করার কষ্ট ও আবেগে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানালেন, সাহিত্য করি আর বিপ্লব করি, তার টাকায় বা তার খেয়ে বাড়িতে থেকে নয়। নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছেতাই করো। চোখের সামনে দেখতে চাই না আর।
নিঃশব্দে পরিবার, স্বজন, শুভার্থী, বন্ধু সকলকে শেষবারের মতো চূড়ান্ত গুডবাই না জানিয়ে উপায় ছিল না আমার। পরিচিত ও পুরানো সবার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে বেরিয়ে পড়লাম পৃথিবীর পথে। প্রথমে নিজের জেলাশহর রংপুরে। তারপর চূড়ান্ত গন্তব্য সদ্য স্বাধীন দেশের রাজধানী ঢাকা।
সময়টা ছিল ১৯৭২ সালের আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহ। আমার কাঁধে একটি ব্যাগ। ব্যাগের ভারী সম্পদ বলতে চাইনিজ ইয়ুথ কলম আর কয়েকটি বাঁধানো খাতা। কবিতা, গল্প ছাড়াও একটিতে ছোট এক উপন্যাসও আছে। যখন-তখন মুড বা আইডিয়া এলে টুকে রাখার জন্য ছয় ইঞ্চি লম্বা একটি নোটবুক। এসব যুদ্ধাস্ত্র ছাড়া নিজের কিছু জামাকাপড়, পড়ার জন্য দুই একটি বই-পত্রিকা। ব্যাগের সাইডপকেটে নোটবুক ছাড়াও আয়না-চিরুনি, দাড়ি কাটার রেজর, সাবান ও জরুরি ওষুধও আছে। এসব সম্পদের বিবরণ দিলাম, কারণ অর্থসম্পদ খুব বেশি ছিল না। ওই সময়ে ঢাকায় একজনও আত্মীয়-স্বজন ছিল না। ব্যাগে কোনও ইন্টারভিউ কার্ড দূরে থাক, সম্ভব্য চাকরির বিজ্ঞাপনও নেই। নামজানা অচেনা কবি-লেখকদের ঠিকানা নেই। ট্রেন থেকে রাতে কমলাপুর স্টেশনে নেমে তবু বিন্দুমাত্র উদ্বেগ-ভয় কাছে ঘেষতে পারল না।
পকেটের ও ব্যাগের অবশিষ্ট অর্থ হিসাব করে বুঝলাম, মাঝারি কোনও হোটেলে রাত্রিবাস ও ভদ্রলোকের মতো খাওয়া-দাওয়া করলে দু-চারদিনের মধ্যে ফতুর হব। অন্যদিকে কমলাপুর স্টেশনের প্লাটফরমকে বিছানা বানিয়ে রাত কাটাই যদি, স্টেশনের টয়লেট ব্যবহার করে ফুটপাতের হোটেলে শস্তায় খাওয়া-দাওয়া করে মাসখানেক কারও সাহায্য ছাড়াই টিকতে পারব। ততদিনে পথ একটা পেয়ে যাব নিশ্চয়ই। প্লাটফরমে অপেক্ষমাণ যাত্রীরা বেঞ্চিতে বসে থাকে। বেঞ্চে শোয়ার মতো জায়গা না পেয়ে মসৃণ মোজাইক মেঝের এক কোণে বিছানা পাতলাম। ব্যাগের দৈনিক বাংলা পেপারটাকে তোষক-চাদর ও আস্ত ব্যাগকে বালিশ বানিয়ে লম্বা হয়ে দেখি, একা আমি নই। বিছানা বানিয়ে শুয়েছে আরও অনেকে। একান্ত পাশের সমবয়সী যুবকটিকে দেখলাম, কাঁথা ছাড়াও সত্যি এক বালিশের মালিক সে। বুঝলাম, আপ-ডাউন কোনও ট্রেনেরই যাত্রী নয়, রাজধানীর স্থায়ী বাসিন্দা সে। আমিও স্থায়ী হব বলে যেচে আলাপ করে তার সঙ্গে খাতির জমানার চেষ্টা করি। রিকশা চালায় সে, দেশ কুমিল্লায়। রাতে এখানেই থাকে, বিছানাপত্র রাখে কাছাকাছি হোটেলের চেনা এক কর্মচারী-বন্ধুর জিম্মায়। আমার সঙ্গে পরিচিত হয়ে সিগারেটের ধোঁয়ার সঙ্গে উপদেশ দিল, ‘এই যে, টাকা-পয়সা ব্যাগে পকেটে রাইখেন না কিন্তু। আমার মতো জাঙ্গিয়ার চুরা-পকেটে রাইখা ঘুম যাইবেন।’
আমার জাঙ্গিয়াতে চোরা পকেট নেই। ছেলেটির মতো অভিজ্ঞ হলে বাড়ি থেকে জিনিসটা অনায়াসে বানিয়ে আনতে পারতাম। জীবনে অনেক ত্যাগ কিংবা বড় বড় ভুল করবে যে, তার এইটুকু ভুলের জন্য আফশোস করা মানায় না। সতর্কতা ও স্বপ্ন নিয়ে একসময় ঘুমিয়ে পড়ি।
পরদিন সকাল থেকেই রাজধানীর পথে নেমে শুরু হয় পথ খোঁজা। চালচুলা ও ঠিকানাবিহীন ভাসমান জীবনে ভেসেও নিজেকে সান্ত্বনা দিই, এই ভালো। দেখেশুনে মেলা অভিজ্ঞতা হবে। আর যে কোনও অবস্থায় লেখাটাও চালিয়ে যেতে হবে। এখন কেউ চিনছে না, ভাবছে সহায়-সম্বলহীন রাস্তার ছেলে, কিন্তু একদিন বিখ্যাত লেখক হিসেবে এই শহরে অনেক কিছুই হবে আমার। নিজের স্বপ্ন ও সংগ্রাম থেকেও প্রেরণা পাই। পেটের খিদে নিবৃত্ত হলে লেখার জন্য রাত জেগে কখনও স্টেশনের বিছানায় বসে, আর দিনে রমনা পার্কের গাছতলায় কিংবা রেসকোর্সের নির্জন মাঠে বসে খাতা-কলম বের করি। অনিশ্চিত দুরবস্থার মধ্যেও ধোঁয়া উড়িয়ে ট্রেন আসার মতো সিগারেটের ধোঁয়ায় সঙ্গে লেখা আসত, লিখতামও। মনে আছে ‘নরকে গোলাপ গন্ধ’ নামে ছোট্ট একটা গল্প লিখেছিলাম রেসকোর্স ময়দানে বসেই।
কিন্তু লিখে খাতা ভরালেই তো হবে না। লেখক হওয়ার জন্য পত্রপত্রিকার সম্পাদক, প্রতিষ্ঠিত লেখক ও প্রকাশকদের সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়া এবং তাদের স্বীকৃতি আদায় করাটা অপরিহার্য। প্রকাশিত হলেই না বাংলাভাষী পাঠকদের কাছে পৌঁছতে পারব। সমস্যা বাধে, ঢাকার সাহিত্যজগতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিখ্যাত কি নবীন কারও সঙ্গেই চেনাজানা নেই। নামে চিনি অনেককে, লেখা পড়ে নিকটজন মনে হয়েছে কাউকে-বা। যেমন শওকত ওসমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, শওকত আলী। শুনেছি এরা সবাই অধ্যাপনা করেন। আমি লেখাপড়া বিসর্জন দিয়েছি, উপরন্তু বাংলার এক অধ্যাপক একুশে সংকলনের জন্য আমার কবিতা অমনোনীত করেছিলেন। তাচ্ছিল্য করে আমার লেখা পড়তে চাননি আর একজন। ফলে অধ্যাপকমণ্ডলী ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাছাকাছি ঘেঁষার উৎসাহ ছিল না আর। ঢাকার দিন কয়েকের ভাসমান জীবনে তিন-চারটি সংবাদপত্র অফিস চেনা হয়ে গেছে। পত্রিকা অফিসগুলির সঙ্গে এক ধরনের সম্পর্ক দাঁড়িয়েছে, প্রতিদিনের পেপারগুলি অফিসের বাউন্ডারি দেয়ালে টাঙানো থাকে। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি। প্রধান আকর্ষণ চাকরির বিজ্ঞাপন ।
একদিন দৈনিক বাংলা ভবনের দেয়ালে সাঁটানো কাগজের সাহিত্যপাতাটি দেখে চমকে উঠি। এই সাহিত্য পাতার সঙ্গে আমি পাকিস্তান আমল থেকে পরিচিতি, পত্রিকার নাম ছিল যখন দৈনিক পাকিস্তান। আর সাহিত্য সম্পাদক আহসান হাবীবের সঙ্গে পরিচিত প্রাইমারি স্কুলে পড়ার সময় থেকে। বাংলা বইয়ে পড়া তার কবিতাটি হুবহু আবৃত্তি করতে পারব এখনও। অতএব আজই যাই না, বিখ্যাত একজনের সঙ্গে পরিচিত হব, সুযোগ বুঝে লেখার খাতাও এগিয়ে দিতে পারব।
এর আগে কোনও পত্রিকা অফিসে ঢুকিনি। নিচে দারোয়ান গোছের একজনকে জিজ্ঞেস করতেই লিফট দেখিয়ে দিয়ে বলল, চারতলায় গেলে পাবেন। গ্রামের ছেলে, লিফটে উঠিনি কখনও। চড়লে পয়সা লাগে কিনা জানি না। তাছাড়া চালাতে গিয়ে কী থেকে যে কোনটা টিপি! ভয়ে ভয়ে একজনের সঙ্গে উঠলাম। লোকটাকে আহসান হাবীবের নাম বললাম। চারতলায় নেমে সে রুমও দেখিয়ে দিল।
ভিতরে ঢুকতেই দেখতে পেলাম তাঁকে। সৌমকান্তি চেহারার ছোটখাটো মানুষটি, হাতে জ্বলন্ত সিগারেট নিয়ে কী যেন ভাবছিলেন। টেবিলে কয়েকটা বক্সফাইলের পাশে ক্যাপেস্টেন সিগারেটের প্যাকেট। পাশের টেবিলে বসা এক ভদ্রমহিলা (পরে জেনেছি, তিনি মহিলা পাতার সম্পাদক মাফরুহা চৌধুরী)। আমি সালাম দিয়ে নিজের দীনহীন পরিচয় যেটকু দিলাম, প্রিয় কবি ও সম্পাদককে চেনার এবং ভক্তির আবেগ দেখালাম আরও বেশি। তিনি বসতে বলে কী করি জানতে চাইলে লেখক হওয়ার জন্য ঢাকায় আসার কথা বললাম। কাঁধের ব্যাগটিসহ বসে গল্প নাকি পুরোনো কবিতার খাতা বের করব, সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তিনি সহানুভূতিমাখা শান্ত কণ্ঠে বললেন, ঠিক আছে তোমার লেখা পরে দেখব। ছাপার মতো হলে ছাপবও। যখন নিজে বুঝবে লেখা ছাপার মতো হয়েছে, কাগজের এক পৃষ্ঠায় সুন্দর করে লিখে নিয়ে আসবে।
আমি লেখার খাতা বের করার বদলে ছোট নোটবুকটি এগিয়ে দিয়ে বললাম, আপনার একটা অটোগ্রাফ নেব।
তিনি কলমটা হাতে নিয়ে একটু ভাবলেন। লিখলেন, আজকের সামান্য এই লেখক কালে অসামান্য হবে। নিচে সুন্দর করে নিজের নাম-স্বাক্ষর ও তারিখ।
আমার লেখা দেখানোর আগে প্রিয় কবি-সম্পাদকের এই লেখা দেখে আমার ভিতরে এত আবেগ চলকে ওঠে যে, আর বসে থাকতে পারি না। রুমে অচেনা দুই তরুণ লেখক-কবির আগমন ঘটে। আমি পরে আসব বলে বিদায় নিয়ে আবার রাস্তায় দাঁড়াই। এতদিন শুধু নিজেকে নিজে বলতাম, আজ সেই স্বপ্নের স্বীকৃতি বিখ্যাত কবি-সম্পাদকের কাছে পেয়ে এত খুশি হলাম যে, বলার মতো নয়। ভাবলাম, লেখা না দেখলেও, আমার চেহারা দেখেই প্রতিভা আঁচ করতে পেরেছেন নিশ্চয়ই! প্রতিষ্ঠিত প্রিয় লেখকদের প্রশংসা নবীন লেখককে যে এতটা অনুপ্রাণিত করে, জানা ছিল না। এর আগে আর কারও অটোগ্রাফ নিইনি আমি, পরেও আর কারও নেব না। ঢাকায় এসে বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে প্রথম আহসান হাবীবের সঙ্গে এই সাক্ষাৎকার এবং পরবর্তী দিনগুলিতে সাহিত্য-সম্পাদক হিসেবে তাঁর সঙ্গে তিক্ত-মধুর সম্পর্কের স্মৃতি নিয়ে একটা লেখা আহসান হাবীব স্মারকগ্রন্থে লিখেছিলাম। বছর দু-তিনেকের মধ্যে তিনি ওই টেবিলে বসে একের পর এক আমার পাঁচটি গল্প অমনোনীত করেছিলেন। সম্পাদকের নিষ্ঠুর আচরণে এত কষ্ট পাব জানলে প্রথম সাক্ষাতের অটোগ্রাফটি পেয়ে আনন্দে আটখানা হতাম না নিশ্চয়ই। মোল্লা-মুরব্বিরা যেমন আল্লাহ তোমার ভালো করুক বলে সবার জন্য দোয়া করে, কবি-সম্পাদকও হয়তো নবীন সাহিত্যযশোপ্রার্থীদের সবার জন্য ওরকম ভবিষ্যদ্বাণী করেন। অটোগ্রাফ নেওয়ার মাসখানেকের মধ্যে আমার ব্যাগের সাইড পকেট থেকে অবশিষ্ট টাকাসহ নোটখাতাটিও উধাও হয়েছিল। টাকা হারিয়ে নয়, অমূল্য বাণীটি হারিয়ে ফেলে কষ্ট পেয়েছিলাম। কিন্তু পরবর্তীকালে পাঁচটি লেখা অমনোনীত হওয়ার বেদনা এত বেশি ছিল, প্রথম সাক্ষাতের আনন্দ-স্মৃতি মনে করে নোটখাতাটা চুরি করার জন্য চোরকেও ধন্যবাদ দিয়েছিলাম। নবীন লেখক হিসেবে ওই সময়ে ঢাকার সাহিত্য সম্পাদকদের সঙ্গে সম্পর্কের অভিজ্ঞতা নিয়ে পৃথক লেখায় হাবীব ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্কের স্মৃতি বিশদে বলা যাবে। তবে প্রথম সাক্ষাতের প্রাপ্তিটি দুঃসময়ে হতাশা দূর করে আত্মবিশ^াস বাড়ায়নি শুধু, ভাসমান জীবনে পায়ের তলায় মাটি খুঁজে পাওয়ার সংগ্রামেও প্রেরণার একটা বড় উৎস হয়ে উঠেছিল।
সচিত্রকরণ : ধ্রুব এষ