আর্কাইভগল্পপ্রচ্ছদ রচনা

মঞ্জু সরকারের গল্প : কুড়ানি বুড়ি ভাদুর মা : মঞ্জু সরকার

রাতে আকাশের দিকে তাকালে, চাঁদের উছলানো আলো কি মেঘের ঘন আঁধার, কিংবা অনন্ত এক নীল থালায় সাদা ভাতের মতো বেশুমার নক্ষত্র দেখে স্রষ্টার কথা স্মরণ করে মন উদাস হয়, মন উদাস হলে সঘন দীর্ঘশ্বাস পড়ে এবং ভাদুর মায়ের দীর্ঘশ্বাসেও আওয়াজ ফোটে―হে আল্লাহ মাবুদ। গভীরভাবে বিশ্বাস করে সে, এই আসমান ও জমিনের ওপর যা কিছু দৃশ্যমান, সবই আল্লার সৃষ্টি। আল্লার হুকুম ছাড়া যেমন গাছের একটি পাতাও পড়ে না, আল্লাহ  রেজেক রাখলে কোনও প্রাণি না খেয়ে মরবে  না। নিজের রেজেক খুঁজতে ভাদুর মা তাই রোজই আল্লার দুনিয়ায় ঘোরে। দুনিয়াদারি করেই পেটের  আহার জোটায়, মনের ক্ষুধাও মেটায়।

ভাদুর মায়ের আল্লার দুনিয়া অবশ্য গাঁয়ের চেনাজানা চৌহদ্দির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। গ্রামের বাইরে যেতে সে কখনও ট্রেনে-বাসে চড়েনি, শহর-সভ্যতাও দেখেনি। তিন ছেলেমেয়ে-জামাই রাজধানী শহর ঢাকায় থাকে, তাদের কাছে গল্প শুনে এবং দু-একদিন পরের বাড়ির টিভি দেখে বিদেশ-বিভূঁই সম্পর্কে আবছা-ঝাপসা ধারণা হয়েছে। গ্রামের অল্পবয়সীরা রঙিন দুনিয়া দেখতে টিভি ছাড়াও হাতের ফোনের দিকে তাকিয়ে সারা দিন কী যে দেখে, ভাদুর মা জানে না, রঙিন দুনিয়া দেখার ইচ্ছাও হয় না কখনও। আল্লার চেনা দুনিয়ায় রূপ-বৈচিত্র্য ও তার নিত্যনতুন মহিমা গাঁয়ের পথে-প্রান্তরে খালে-জঙ্গলে এবং পাড়া-পড়শির বাড়িতে গেলেও সে দেখতে পায়। ফজরের নামাজটা পড়েই ভোরবেলা গাঁয়ের বড় বড় গেরস্থদের সুপারি কি ফলবাগানে ঢুকে শুরু হয় তার দিনযাপনের দুনিয়াদরি।

না বলে কারও গাছের ফলে হাত দেয় না ভাদুর মা। গাঁয়ের গেরস্থ দূরে থাক, কাঁধের ফেরেশতারাও চোর বলতে পারবে না তাকে। তবে আল্লাহ তার ফুয়ের বাতাস দিয়ে কিংবা বাদুড়-বগদুল পাখির দ্বারা ঠোকর মেরে ভাদুর মায়ের জন্য গাছের দুচারটা ফল মাটিতে ফেলে দেয়, তাই  খুঁজে পেতে পরের বাগানে ঘুরণা দেয় সে রোজ। ভোরের আবছা আলোয়  যেদিন বাগানে একটা সুপুরিও খুঁজে পায় না, সেদিন হঠাৎ একটা ঢিল পড়েছে ঠিক তার কাঁধের ওপরে। চমকে ঘাড়ে হাত দিয়েই ঘোমটায় আটকানো একটা পাকা সুপুরি পায় সে। শুধু সুপুরি কিংবা আমের মৌসুমে কাঁচা-পাকা আম নয়, একদিন ভূঁইয়ার পুকুরপাড়ের নারকেল গাছের তলায় যেতেই একটা ঝুনা নারকেল আল্লা তাকে ঢিল মেরে খেতে দিয়েছিল। ইচ্ছে করলে নারকেলটা তার মাথার ওপরেও ছুড়ে মারতে পারত, কিন্তু ধুপ করে তার পায়ের কাছে পড়েছিল ফলটা। এটাকে আল্লার দান ছাড়া কী বলবে সে ? সুপারি-নারকেল-আম-লিচু যা-ই পাক, কোচরে নিয়ে প্রাপ্তিসুখে আল্লাহকে শোকর জানায় সে।

শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা বারোমাসই ঘর থেকে বেরুলে আল্লার দুনিয়ায় কুড়িয়ে পাওয়ার মতো কিছু না কিছু খুঁজে পায় ভাদুর মা। সবচেয়ে বেশি পাওয়ার মজা হয় গরমকালে, যখন আম-কাঁঠাল-লিচু পাকে। নিজের বাড়ি-ভিটায় গর্ভের সন্তানরা সপরিবার গাদাগাদি করে থাকায় গাছ লাগানোর জায়গা নেই। যেটুকু খালি জায়গায় তরিতরকারি চাষ করত ভাদুর বাপ, তাতেও ছেলেমেয়েরা ঘর তুলেছে। নিজের না থাকলেও, গাঁয়ের ছোট-বড় সব গেরস্থের বাড়িভিটায় নিদেন পক্ষে দু-চারটা আম-কাঁঠাল-পেঁপে কিংবা কলাগাছের ঝোপ আছেই। বড় গেরস্থ অনেকেই এখন  ক্ষেতে ধান-পাট চাষের মতো আম-লিচুর বাগানও করেছে। কাক-বাদুড় এবং লুটেরা পোলাপানের ভয়ে কেউবা জাল কি পলিথিন দিয়ে গাছের ফল বেঁধে রাখে। তারপরও গাঁয়ের কুড়ানি ও লুটেরা পোলাপানের জন্য আল্লা ঝড়ঝাপটা দিয়ে গাছে এমন ঝাঁকি দেয়, দুপদাপ করে গাছের কাঁচাপাকা ফল মাটিতে পড়তে থাকে। কার পাপে কে জানে, কালবোশেখি দিয়ে কারও বা আস্ত গাছটাই উবড়ে দেয়। ঝড়ের দিনে ভাদুর মা তাই সবার আগে আম কুড়াতে ছোটে। কোথায় কোন গাছে কেমন ফল ধরেছে, ভাদুর মা সবচেয়ে ভালো জানে। জিভে কাঁচা-পাকা  আমের স্মৃতিস্বাদ নিয়ে ছুটতে ছুটতে নিজের শৈশবকেও ফিরে পায় যেন। ঝড়ে কুড়ানোর প্রতিযোগিতায় নামে গাঁয়ের ছোট-বড় সবাই। কিন্তু ভাদুর মা আগে আগে যায় বলে বেশি বেশি পায়। কোচর ভরে নানা গাছের আম বাড়িতে নিয়ে গেলে একা খায় না, নাতি-নাতনিদের বিলিয়েও সুখ পায়।

একবার পড়শি কছিমুদ্দির বাড়ির বগল দিয়ে হাঁটার সময় কাঁঠালের গন্ধ পেয়ে থমকে দাঁড়ায় ভাদুর মা। কছিমুদ্দির কাঁঠাল গাছটার দিকে তাকিয়ে অবাক হয় সে। গাছের গোড়া থেকে আগা পর্যন্ত অগুনতি কাঁঠাল ধরেছে। কিন্তু আশ্চর্য যে একটার সঙ্গে আরেকটার হুবহু মিল নেই। হাতের পাঁচ আঙুল যেমন সমান না, আল্লার দুনিয়ার কোটি কোটি মানুষের মুখ যেমন হুবহু একই রকম হয় না, এ গাছের কাঁঠালগুলিও যেন সেরকম। ভিতরের স্বাদ অভিন্ন হলেও আকারে কিছু না কিছু ভিন্নতা আছে। আল্লার সৃষ্টি মুগ্ধ হয়ে দেখার জন্য আল্লাহ যেন নগদ পুরস্কারও দেয়। পাকা কাঁঠালের ঘ্রাণের উৎস খুঁজতে গিয়ে গোড়ার দিকেই কাক-ঠোঁকড়ানো একটা ছোট কাঁঠাল চোখে পড়ে। হাতের চাপড় দিয়ে আরও কিছু কাঠালের কাঁচা-পাকা দশা পরীক্ষা করে কাক-ঠোকড়ানো কাঁঠালটা ছিঁড়ে মালিক কছিমুদ্দির বাড়িতে নিয়ে যায় সে। খুশি হয়ে কাঁঠালের কিছুটা ভাগ ভাদুর মাকেও দেয় কছিমুদ্দির বউ। ভাতের বদলে চালের গুড়া ও কাঁচামরিচ দিয়ে পাকা কাঁঠাল খেয়েই সেদিন রাত কাটিয়েছে ভাদুর মা। ফলের কথা বাদ দিলেও, গাঁয়ের জায়-জঙ্গল বিলে-ঝিলে ঘুরে নানা পদের বারমাসি শাক ও কচুঘেঁচু ভাদুর মায়ের মতো  চেনে না কেউ, আল্লার দুনিয়ার ফলমূল বেশি বেশি কুড়াতে পারে বলে তাকে এখন কুড়ানি বুড়িও বলে অনেকে।

শুধু আল্লার দুনিয়ার গাছ-গাছালির ফল-মূল-লতা-পাতা খেয়ে তো দিন চলে না। তিনবেলা পেটপুরে ভাত না পেলেও এক-আধবেলা ভাত ছাড়া বাঁচে কোনও মানুষ ?  গ্রামে ক্ষেত-প্রান্তরজুড়ে এত যে ধান হয়, ইঁদুর-পাখি  সেই ধানে যতই নিজেদের হক আদায় করুক, ভাদুর মা পারে না। গরিবগুর্বো মানুষ টাকা দিয়েই ধান-চাল কিনে খায়। কিন্তু ভাদুর মা টাকা পাবে কোথা ? মায়ের বাড়িভিটা দখল করে আছে ছেলেমেয়ে এমনকি এক নাতিও। এরা ছাড়াও ঢাকায় গার্মেন্টস-এর চাকরি করা ছেলে ও মেয়ে-জামাইও নিজেদের হিস্যা আদায়ের লড়াই শুরু করেছে, কিন্তু এ যাবৎ বুড়িকে কে কয়টি শাড়ি কিংবা নগদ টাকা দিয়েছে, আঙুলে না গুনেও বলে দিতে পারবে ভাদুর মা। সন্তানদের ওপরে নির্ভর করে বাড়িতে বসে থাকলে এতদিন ওরাই মাকে ধাক্কা দিয়ে কবরে নামিয়ে দিত। ভাদুর মা তাই আল্লাহ ছাড়া কারও ওপরেই পুরোপুরি নির্ভরশীল থাকে না। শৈশবে দেখা পির হুজুরের মুখখানা স্মরণ করে, তার কথা ও দোয়ার বরকতে বুড়া শরীরে আজও বল পায়। হুজুর বলেছিল, আল্লার দুনিয়ায় তোমগোরে সবার সমান হক আছে, আদায় করিয়া খাইবা। আদায় করে খাওয়ার জন্য তাই ভাদুর মা লাঠিতে ভর করে হলেও রোজই আল্লার  চেনা দুনিয়ায় নিজের উপস্থিতি জানান দেয়।

গাঁয়ে বেশ কয়েকটা বাড়ি আছে, যাদের পূর্বপুরুষরাও ছিল ভাদুর মায়ের বাপ-দাদার ঘনিষ্ঠ পিরের মুরিদান। ছোটবেলায় টাইফয়েড জ্বরে ভুগে মরার দশা হয়েছিল ভাদুর মায়ের। বাঁচার আশা ছিল না, বাকশক্তি হারিয়ে এক বছর কথা বলতে পারেনি। পির হুজুরের পানিপড়া খেয়ে তার বেঁচে ওঠা ও জবান ফিরে পাওয়ার সত্য ঘটনা যারা জানে, বাপ-মায়ের কাছে শোনা সেই পিরহুজুরের অলৌকিক ক্ষমতার নানা গল্পগাথা তারা অবিশ্বাস করে না কেউ।  বরং পিরহুজুরের কথা উঠলে তার বিশেষ দোয়াপ্রাপ্ত ও নাতনিতুল্য ভাদুর মাকে নগদ পানসুপুরি খাওয়ায়, কিছু ধান-চাল দিয়েও সাহায্য করে। এভাবেই পিরের অছিলায় পেটের অন্নটা জুটে যায় ভাদুর মায়ের, কারও কাছে আপনজনদের চেয়েও বেশি বেশি খাতিরযত্ন পেলে, বৃদ্ধবয়সে বাঁচার সুখেও আল্লাহকে শোকর জানায়।

বানবর্ষার সময়ে ভাদুর মা অনেক দিন বৃষ্টিতে ভিজেও আল্লার ভেজা দুনিয়া দেখতে বেরোয়। বৃষ্টির পানি গাঁয়ের খালেবিলে নৃত্য করা দেখলে নিজের শৈশবটাও খলবল করে ভিতরে জেগে ওঠে। ছোটবেলায় বান ডাকলে নদীতে, বর্ষার পানি জমলে খালেবিলে ও ধানখেতেও কত যে মাছ ধরেছে। মাছ ধরার জন্য বাবার ছিল কয়েক কিসিমের জাল। এখন খালেবিলে যেমন আগের সেই মাছ নেই, ভাদুর মায়ের বাড়িতেও কারও জাল কি পলো নেই। ভাদুর দুটি ছিপ-বড়শি আছে অবশ্য, তা দিয়ে কোথায় কী মাছ ধরে সে, খাওয়া দূরের কথা চোখেও দেখেনি কখনও। ভাদুর মা বর্ষায় ছোটবেলার মাছ ধরার স্মৃতির আনন্দে একদিন বৃষ্টিতে খালের পাড়ে একটা কই ও চেংটি মাছকে লাফাতে দেখে, সেই জ্যাতা মাছ দুটি  ধরতে গিয়ে শরীরে যে কাদাপানির দাগ লাগে, তারচেয়ে মাছ দুটি মুঠোয় ধরা দিয়ে খলবলিয়ে আনন্দ দেয় বেশি। সরকারি খালটাও এখন লোকেরা বাঁধাঘেরা করে মাছ চাষ করে। সেখানে নেমে মাছ ধরার উপায় নেই। তবে বৃষ্টিজমা ক্ষেতের অল্প পানিতে যখন গেরস্থরা কলের লাঙ্গল নামায়, সেই চষা ভুঁইয়ের ছোট পুঁটি-খলসে ধরার জন্য গাঁয়ের ছেলেমেয়েরা কাদাপানিতে দাপিয়ে মাছ ধরে। ভাদুর মাও এমন দৃশ্য দেখে বৃদ্ধ বয়সেও লোভ সামলাতে পারে না। গোটা শাড়িতে কাদা মেখে একদিন কাদাপানি ঘেটে এক সন্ধ্যা খাওয়ার মতো পুটি খলসে পেয়েছিল। বাড়িতে নিয়ে কেটেবেছে বেশি পেঁয়াজ-মরিচ দিয়ে চচ্চড়ি করে গরম ভাতে মেখে বড় তৃপ্তি পেয়েছিল। রোজ গ্রামে ঘুরে ভাদুর মা বিচিত্র জিনিস দেখার ও খাওয়ার এরকম আনন্দ পায় বলেই  শেষ বয়সের নানা জ¦ালা সয়েও আল্লার কাছে আশু মরণ কামনা করে না কখনও। যখন তার সময় হবে তুলে নিয়ে যাবে―এ নিয়ে ভাদুর মায়ের চিন্তা নেই, বলারও কিছু নেই।

বাড়িতে ভাদু ছাড়াও  যাদু, রহমত ও এক বিধবা মেয়ের ভিন্ন ভিন্ন ঘরসংসার। ঈদে ও ছুটিছাটায় বিদেশ-খাটা ছেলেমেয়েরাও সপরিবার মায়ের কাছে এসে ভিড় জমায়। প্রত্যেকের সংসারে গড়ে দুই নাতি-নাতনি এবং বড় নাতির সংসারে নাতবউ ছাড়াও দুই বাচ্চা। চারপাশে এত আপনা মানুষজন থাকতেও ভাদুর মাকে মনে হয় জগৎ-সংসারে বড় একা। স্বামীর মৃত্যুর পর সংসারে নিজেকে একা ভাবতেই অভ্যস্ত সে। কোনও ছেলেমেয়ের সংসারে খায় না। নিজের হাঁড়িতে নিজের চুলায় নিজেই রেঁধেবেড়ে খায়। নিজের খাবারের ভাগ কিছুটা নাতি-নাতনিদেরও বিলায়। মায়ের ভিটেমাটিতে আছে বলে ওরা মাকে টুকটাক যেটুকু দেয়, তার চেয়ে প্রতিদিন গ্রামে ঘুরেই বেশি বাঁচার রসদ জোগাড় করে সে। গ্রামে ঘোরা এবং খোঁজনা ও কুড়ানো স্বভাবের মধ্যেও ভাদুর মায়ের অসহায় একাকিত্ব গ্রামবাসীর চোখেও ধরা পড়ে।

সকালে বাড়ি থেকে বেরুনোর মুখে ভাদু একদিন মায়ের ঘরে আসে। ছোটবেলার মতো খাতির জমানো চাপা গলায় আবদার জানায়, ও মা গো, বুড়া বয়সে ফকিরনির মতো গ্রামে ঘুরনা দিস, আমার কষ্ট লাগে। এই বাড়িভিটার পনেরো শতক সম্পত্তির মালিক তুই। নানায় এই জমি তোর নামেই হেবা কইরা দিয়া গেছে। তুই মইরা গেলে এই সম্পত্তির ভাগ কোনও পোলা-মাইয়া ছাড়ব ? যে বইন মইরা গেছে, তার পোলাও ছাড়ব না। অহনই কামড়াকামড়ি শুরু হইছে, তুই মইরা গেলে মাথা ফাটাফাটি হইব। তার চাইতে  বাঁইচা থাকতে জমিটা আমার নামে লেইখা দে মা। বাকি জীবন আমার সংসারে তিনবেলা খাবি, আলাদা খাইতে চাস তো তোরে রোজ এক শ টাকা খোড়াকি দিমু, না হইলে নগদে হাজার টাকা দিয়া রাখমু আমি।

ভাদুর মা চড়া গলায় আজ আধবুড়ো ছেলেকে শাসন করে, চোপ হারামজাদা। আমাগোরে পির হুজুর কইত, জায়গাজমির আসল মালিক আল্লাহ। আমি মইরা গেলে এই বাড়িভিটায় যার যার  হক আছে, সবাই আদায় করব। টাকার লোভ দেহাস না আমারে। কুনো পোলার বউয়ের দাসীবাঁদী হইয়া খামু না আমি, আল্লায় দিলে তোগো সাহায্য ছাড়াই চলব আমার।

ভাদুও মাকে শাসন করে, অত পির হুজুরের দেমাক করস, পিরে কি তোরে বেপর্দা গ্রামে ঘুরতে কইছে ? বাড়িতে থাইকা যত খুশি নামাজ-রোজা কর, কে মানা করছে ?

বেপর্দা ঘুরি আমি! এই দেখ, মুন্সি-মওলানার মতো মাথার এই টুপি দিনেরাতেই মাথাতেই থাকে আমার। পির হুজুর আমার বাপ-দাদারে কইত, লড়াই কইরা দুনিয়ার হক আদায় কইরা বাঁচতে হইব। আমার পা দুইটা যতদিন চলব, পোলামাইয়ার সংসারে বোঝা হওনের চাইতে লড়াই কইরাই দুনিয়ার হক আদায় করুম আমি।

ছেলেরা মায়ের সঙ্গে ঝগড়ায় পারে না। মায়ের গলাবাজির ভয়ে বাড়িতে সে না থাকলেই বরং স্বস্তি বোধ করে। আর সন্তানদের সংসারের হাউকাউ এড়াতে সাতসকালেই মাথার ঘোমটা টেনে ভাদুর মাও বাড়ি থেকে বেরিয়ে, আল্লার দুনিয়ায় বাঁচার সুখ খোঁজে।

ভাদুর মা গ্রামের বিরল গৃহবধূর একজন, যার নারীদেহ বাঙালি নারীর আদ্যিকালের পোশাক শাড়িতেই ঢাকা থাকে দিনেরাতে এবং মাথায় ঘোমটাও থাকে যথারীতি। শাড়ির নিচে আর কোনও অন্তর্বাস থাকে না। বয়সকালেই প্রয়োজন হয়নি, আর এখন তো বুড়ো হাড়ের চিমাসানো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিজেও তাকাতে ইচ্ছে করে না। পাড়াপড়শিরাও রোজ দেখে বলে ভাদুর মায়ের দিকে ফিরে তাকায় না, গন্তব্যও জানতে চায় না কেউ।

গাঁয়ের পাকা রাস্তায় শাড়ি-পরা মহিলা চোখে পড়ে কদাচিৎ। যে দু-চারজন বয়োজ্যেষ্ঠা পুরানো বেশটা ধরে রেখেছে, তারা সাধারণত বাড়ির অন্দরমহলেই অন্তরীণ। গাঁয়ের পাকা রাস্তায় সাইকেলে কি ভ্যানে চড়ে কিংবা পায়ে হেঁটেও যেসব কিশোরী-যুবতী স্কুল-কলেজে যায়, তারা হয়তো স্বপ্নের শাড়ি তুলে রেখেছে বিয়ের দিনের জন্য। সালোয়ার-কামিজ পরলেও বোরখা, কিংবা মাথা-মুখ ঢাকা হিজাব পরে অনেকেই। কেউ-বা করোনাকালে প্রচলিত মুখোশটি পরে মুখরক্ষা করে। তাদের একজনকে একদিন জিজ্ঞেস করে ভাদুর মা, করোনা মড়ক হুনছি দেশছাড়া হইছে। তয় অহনতরি গরুর মুখবাঁধা টোপরের মতো এইটা মুখে বান্দস ক্যা গো ?

নাতনি সম্পর্কের পড়শি মেয়েটা জবাব দিয়েছে, এইটা আামার হিজাব। বোরখার কাম দেয়। তোর মতো বেপর্দা তো মানুষকে মুখ কি বুক দেখাতেই পারি নাা দাদি।

ছেমড়ির মুখের পর্দা ভেদ করে সব কথা কানে না এলেও গালিটা ঠিক শুনতে পায় এবং ঠাট্টার গলায় জবাব দেয় ভাদুর মা, শাড়ি কেনারই পয়সা জোটে না, তোগো মতো শখের বোরখা-পর্দা কই পামু আমি ? খালি মাথা আর বুক না, এই দেখ জাউরা পেট, তাও কেমন শাড়ির আঁচলে বাঁইধা থুই আমি।

গর্ভবতী মেয়েদের যেমন উঁচু পেট, তেমনি কোচরে একটি গর্ভ বানিয়ে ঘরে ফেরে ভাদুর মা। তবে গর্ভে যে তার জারজ সন্তান নয়, বরং ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য খোঁজনা কি কুড়িয়ে পাওয়া এটাসেটা খাদ্যসামগ্রী, ঘনিষ্ঠ জনরা জানে বলে দেখার কৌতূহল বোধ করে না। কিন্তু রাস্তায় পুলের ওপর বসে মোবাইল ফোন হাতে বিশ্রামরত অচেনা  এক পথিক ভাদুর মায়ের পেটের ঝোলা ও মলিন বেশবাস দেখে ভিখিরিনী ভেবে কাছে ডাকে। দান করার মানত পূরণে তার হাতে দুটি টাকার নোট তুলে দিয়ে বলে, খুব বিপদে আছি ফকিননি মা, দোয়া করেন।

টাকাটা হাতে নেয় ঠিকই, অচেনা পথিককেও সগর্বে আত্মপরিচয় দিতে শুরু করে ভাদুর মা, তোমার বিপদের কথা হুইনা আমার পির হুজুরের কথা মনে হইল বাবা। সেই পিরের দোয়ায় আমার ভিক্ষা করন লাগে না বাবা, আল্লাহর দুনিয়ার হক আদায় কইরা খাই। গেরস্থ ঘরের মাইয়া আমি। আসামে বাপ-দাদার  আছিল দুই হাল আর এক বিশ মাটির গেরস্থি। তিস্তার চরুয়া গ্রামেও এক হালের সম্পত্তি করছিল আমার বাপ চান্দু ফকির। সেই সম্পত্তির ভাগ পাইয়া এ গ্রামে বাড়ি করছি। বাপের গেরস্থিতে এত উন্নতি হইছিল কেমনে শুনবা ? আমাগো বংশের সেই পিরের দোয়ায়। বাজানরে আপনা পোলার মতো দেখত পিরহুজুর। ছোটকালে টাইফয়েড জ¦রে বিছানায় ছিলাম এক বছর। জবান বন্ধ হইছিল। সেই পিরের পানিপড়া খাইয়া আমি জবান ফিইরা পাইছি, বাঁইচা আছি অহনতরি। পিরের দোয়া আর পানিপড়া নিতে হাজার হাজার মানুষ ভিড় জমাইত। পিরহুজুর যদি কোনও কুয়ার পানিতে ফুঁ দিত, সেই কুদরতি পানি লইতে কাড়াকাড়ি কইরা কুয়া-ইঁদারা শুকায় ফেলত মানুষ। তুমি বিপদে পইড়া আমারে দুই টাকা দিলা, তেমনি হাজারে হাজারে মানুষ বালামুসিবতে হুজুরের দোয়া আর পানিপড়া লইয়া সেলামি দিত। কিন্তু পকেটভরা সেলামির টাকা হুজুরে কুনোদিন গুইনা দেহে নাই, পকেট থন বাইর কইরা আবার গরিব-দুঃখীরে বিলায় দিত।

অচেনা পথিক কৌতূহল দেখায়, কোন জায়গার পির, কোন পিরের কথা কও ?

আজকালকার ছেলেরা তো ভাদুর মায়ের পুরোনা কালের গল্প শুনতে চায় না। অচেনা যুবকের আগ্রহ দেখে পিরহুজুরের গল্প শোনাতে ভাদুর মা টাকাটা হাতে নিয়ে পুলের ওপরে বসে পড়ে।

পিরহুজুরের কুদরতি ক্ষমতা নিজের চক্ষেও দেখছি আমি। এই গ্রামেও যাগো বাপ-দাদারা হুজুরের মুরিদান আছিল, তারাও জানে। সব মুরিদগো চাইতে আমার বাপ-দাদাগো লগে হুজুরের বেশি পেয়ারের সম্পর্ক কেমনে হইছিল জানো ? হুজুর এ দেশ ছাইড়া আসাম দেশের জঙ্গলে গিয়া ডেরা বাঁধছিল। হুজুরের কথায় আমার গরিব দাদা-দাদিও জোয়ান পোলারে  লইয়া গেছিল সেই দেশে বসত করতে। জঙ্গল কাইটা মেলা আবাদি জমি করছিল তারা। আসামের জঙ্গলের হাতি-ঘোড়া বাঘ-সিংহ পিরহুজুরের কথামতো চলত। সেই দেশের রাজাবাদশারাও হুজুরকে ভয় পাইত। পিরহুজুর ডাক দিলে তার ওয়াজ শুনতে লাখো হাজার মানুষ জড়ো হইত। শত শত গরু কোরবানি হইত, হুজুরের জলসায় তিন/চারদিন লক্ষ মানুষ ভরপেট খিচুড়ি খাইত। এত মানুষরে খাওয়ানোর চাইল-ডাইল হুজুর পাইত কই জানো ? হুজুরের ছিল দশটা পোষা জিন, তারাই সব আঞ্জাম কইরা দিত। আসাম মুল্লুকে আমার বাপ-দাদার বাড়ি ছিল হুজুরের দরগার কাছেই। দাদা ছিল হুজুরের বড় খাদেম। হুজুর যে দুলদুল ঘোড়ায় চইড়া আসামের জলজঙ্গল ভাইঙা তিরের নাহান ছুইটা যাইত, দাদা সেই ঘোড়াটারে দানাপানি খাওয়াইত। আমাগো বাড়িতেই থাকত ঘোড়াটা।

যুবক শ্রোতা ভাদুর মায়ের রূপকথা শোনার ধৈর্য রাখে না আর। বুড়ির মাথায় দোষ আছে সন্দেহ জাগে। কাম আছে বলে সাইকেল দাবড়ে চলে যায়। কিন্তু বাবা-মায়ের কাছে শুনে শুনে শৈশব থেকেই যে রূপকথার জগৎ ভাদুর মায়ের নিঃসঙ্গ স্মৃতিসত্তা ও কল্পনায় জীবন্ত হয়ে আছে এখনও, লোকজনকে তার ভাগ দিতে না পারলেও, নিজেকেই হারানো দিনের গল্প শুনিয়ে যেন বাঁচার সুখ ও সাহস খুঁজে পায়।

পিরহুজুর যদি আমৃত্যু আসাম দেশেই বাস করত, ভাদুর মায়ের জন্ম ও বিয়েশাদি সে দেশেই হইত। ইংরেজ রাজারা দেশে কী যে গণ্ডগোল লাগায় দিল, হুজুর মুসলমানের দেশ পাকিস্তানে আইসা পাকাপাকি আস্তানা গাড়ল। ওদিকে আসামে তার লাখ লাখ মুরিদের মাথার ওপর হইতে বটগাছের ছায়া সইরা গেল। সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়ল ভাদুর মায়ের বাপ চান্দু ফকির। আসামের রাজা-জমিদার আর হিন্দুরা একদিন তার ঘরবাড়ি হাতি দিয়া ভাইঙা দিল, পাকা ক্ষেতেও আগুন দিছে। হুজুর নাই, বিপদে কে তার মুরিদ-চাষিগো রক্ষা করব ? টিকতে না পাইরা চান্দু ফকিরও একদিন বেবাক সম্পত্তি আর বাপের কবর ছাইড়া পরিবার লইয়া নৌকায় ভাইসা পাকিস্তানে আইছে। এই দেশে আইসাও হুজুরের দরগায় গেছিল তার বাপ। হুজুরের দোয়া ও বুদ্ধি লইয়া তিস্তার চরে সস্তায় কিছু জমি কিইনা বাড়ি করছে। ভাদুর মায়র তিন ভাই ও এক বইনের জন্ম হইছিল আসামে, কিন্তু ভাদুর মায়ের জন্ম এ দেশেরই চরুয়া গ্রামে। জন্মের পর তার মুমূর্ষু দশা ও হুজুরের দোয়ায় জবান ফিরে পাওয়ার স্মৃতি তার মনে নেই। কিন্তু পির হুজুরকে একবার নিজের চক্ষে দেখার স্মৃতি শেষ বয়সে এসে প্রতিদিনই প্রায় স্মরণ করে সে। আল্লাহ-রসুলের নাম নিলেও হুজুরের মুখখানা মনে ভাসে।

ভাদুর মায়ের যখন নয়-দশ বছর, হুজুর একবার ভোটের সময় ওয়াজ করতে পাঁচ মাইল দূরের বন্দরে আইছিল। খবর শুইনা চান্দু ফকিরও কয়জন মুরিদ ভাইরে লইয়া ছুইটা গেছিল হুজুরের কাছে। পরদনি চান্দু ফকিরের দাওয়াত কবুল করতে ঘোড়ায় চড়ে চরুয়া গ্রামেও এসেছিল হুজুর। মুরিদান ছাড়াও গ্রামবাসী সবাই জড়ো হইছিল চান্দু ফকিরের বাড়িতে। হুজুর সবাইরে পানিপড়া দিছে। নদীর চরে গিয়া খুঁটি পুইতা কইছে, এই খুঁটি ভাইঙা নদী আর এদিকে আসব না। তোমরা খুঁটির এপারে বাড়িঘর কইরা থাকবা।

হুজুরকে নানা পদের মাছ-গোশত দিয়ে খাওয়ানোর পর পানের বাটা লইয়া গেছিল চান্দু ফকিরের ছোট মাইয়া, এই আজকের ভাদুর মা। হুজুরের দোয়ায় তার জবান ফিরে পাওয়ার গল্প শুনে কাছে ডেকে তার মাথায় হাত দিয়ে বলেছিল, অহন কথা কইবার পারস, কও চাই কলেমা তৈয়ব কি ?

মক্তবে আমসিপারা পড়া শিখেছিল বলে ভাদুর মা বড় করেই কলেমাটা বলেছিল।

খুশি হয়ে হুজুর বলেছিল, এইবার কও দেহি আমি তোর কী হই ?

হুজুর।

খালি হুজুর না, দাদা হুজুর। তোর দাদা আমারে খুব ভক্তি করত, একসঙ্গে কতো লড়াই করছি আমরা! তোর দাদারে আসামে কবর দিয়া আইছি, কিন্তু আমি পাকিস্তানে বাঁইচা আছি তোমাগোরে সেবা কইরবার জন্য। আর দুই-এক বছর বাদে তোর বিয়া হইব, দোয়া করি বিয়ার পরও তুইও আল্লার দুনিয়ার হক আদায় করতে লড়াই কইরাই অনেক দিন বাঁইচা থাকবি।

দাদা-হুজুরের কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্য হইছে। চান্দু ফকির দু’ বছর বাদেই নদীভাঙা এক গেরস্থের পোলার সঙ্গে বিয়ে দিছিল ছোট মেয়ের। আশা ছিল নদীর জায়গা-জমি ভাইসা উঠলে মেয়েরও সুখের ঘরসংসার হবে। কিন্তু বাবার আশা পোরেনি। বাবার দেওয়া জমিতে ঘর তুইলা সারা জীবন কামলা খাইটা মরেছে ভাদুর বাপ। তারপরও হুজুরের দোয়ায় ভাদুর মায়ের সংসারে সুখ-শান্তির অভাব হয়নি। স্বামীর সঙ্গে নিজেও দিনেরাইতে আল্লার দুনিয়ার হক আদায় করেই আট সন্তানকে মানুষ করেছে। ছেলেমেয়েরা সবাই এখন নিজ নিজ সংসার চালাতে দেশ-বিদেশে খাটে। কমবেশি রোজগার করে সবাই। কিন্তু তারপরও মায়ের বাড়িভিটার ভাগ আদায় করতে নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি লেগেই আছে। বাড়িভরা স্বজনদের কথায় না শুধু, নিঃশ^াসেও যেন হিংসার বিষ। বাড়ির দূষিত পরিবেশে টিকতে না পেরে, রক্ত সম্পর্কিত আপনজনদের ভুলে নিজের মুক্তির পথ খুঁজতেও আল্লার চেনা দুনিয়ায় একলা ঘুরে বেড়ায় ভাদুর মা।

একদিন গাঁয়ের বড় মোড়ল, সবচেয়ে ধনী গেরস্থ সদর ভুঁইয়ার পাকা বাড়িতে গেলে স্বয়ং ভুঁইয়া তাকে জরুরি কথা বলার জন্য ঘরে ডেকে নেয়। নিজের চেয়ারের সামনে টুলের উপর বসতে বলে। ভুঁইয়ার বাপ-দাদারা ভাদুর মায়ের পিরহুজুরের মুরিদ ছিল না, খাতির পাওয়ার জন্য এ বাড়িতে সে আসেও না তেমন। তার উপর ভাদুর মায়ের  বাড়িভিটার সঙ্গেই ভুঁইয়ার মেলা জায়গা-জমি। এক জমিতে সুপুরি ও আমের বাগান করেছে। সেই বাগানের ফল কুড়ায় বলে ভাদুর মা ও তার নাতি-নাতনিদের শুধু চোর ভাবে না, চুরির দায়ে শাস্তি দিতেও কয়েকবার হুমকি দিয়েছে। ভাদুর মাও আজ শাস্তি পাবার ভয় এবং পিরহুজুরের মুখখানা স্মরণ করে প্রতিরোধের সাহস খুঁজতে খুঁজতে ভুঁইয়ার সামনে বসে।

তোমার নামে কয়েক লাখ টাকার সম্পত্তি, তা রেখে শেষ বয়সে গ্রামে ঘুরে ফকিরালি কর ক্যা ?

সাহায্য চাইতে তোমাগো বাড়িতে কয়দিন আইছি ? তোমার বাড়ির মানুষরে জিগায় দেহো বাবা।

আহা আসবা না কেন ? আমাগোরে দল আমাগোরে সরকার পনের বৎসর ধইরা দেশ চালাইতেছে। এই দেশে না-খাওয়া ফকির-মিসকিন আর আছে আগের মতো ? আমার সুপারিশে এ জায়গার কতজনে বয়স্ক ভাতা-বিধবা ভাতা পাইল, বানের টাইমে কত মানুষরে রিলিফ আইনা দিলাম। কিন্তু তুমি আমার গ্রামের মানুষ, পোলারা তেমন সাহায্য করে না বইলা কত কষ্ট কইরা চলো, সব খবরই রাখি আমি।

সুপারি ও ফল চুরির বিচারের ভয়টা কেটে যাওয়ার পরও মানী লোকটার মতলব বুঝতে ভাদুর মা তাকিয়ে থাকে। সদর ভুঁইয়া সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে বলে, আমি তোমারে শুধু বিধবা ভাতা না, সরকারি একটা পাকা বাড়িও বরাদ্দ নিয়া দিমু। সরকার ভূমিহীন গরিব মানুষের জন্য পাকাবাড়ি কইরা তাদের নামে রেজিস্ট্রি কইরা দিতেছে। তোমারেও সেই রকম একটা বাড়ি লইয়া দিমু। কিন্তু বাপে যে তোমার নামে পনের শতক জমি লেইখা দিয়া গেছে, সেইটা তোমার নামে থাকলে তো কোনও সাহায্য পাইবা না। তোমারেও ভূমিহীন হইতে হইব।

আমার ভিটামাটির ভাগ-দখল লইয়া পোলা-মাইয়া-নাতিগোরে মাঝে হিংসাহিংসি লড়াই লাইগা আছে। এর লাইগা বাড়িতেও মন টেকে না আমার। গ্রামে ঘুইরা বেড়াই।

সব জানি আমি। ভাদু আর যাদুও আইছিল আমার কাছে, তারা যে ভাগ পাইবো সেইটা আমার কাছে আগাম বেইচা কিছু টাকাও লইছে। তুমি এক কাম করো গো চাচি, একদিন তোমারে অটোতে কইরা রেজিস্ট্রি অফিসে নিয়া যামু, তুমি জমিটা আমার নামে লেইখা দাও, তারপর তোমার দায়িত্ব আর তোমার পোলাপানগো সামলানোর দায়িত্ব আমারে দিয়া শেষ বয়সটা নিজের টাকায় আচুদা কইরা খাও, আল্লাবিল্লা কইরা দিন কাটাও।

আমি লেইখা দিমু কেমনে, ওই জমির মালিক আমি না বাবা। জমির আসল মালিক আল্লাহ। তোমাগোরে গ্রামে যে এত জায়গাজমি, সেগুলির আসল মালিক কে ? আমাগোরে পিরহুজুর কইত, দুনিয়ার সব জায়গাজমির মালিক আসলে আল্লাহই। আল্লাহর এ দুনিয়ার ওপর সব বান্দারই সমান হক আছে। আমি মইরা গেলে আমার বাড়িভিটাতেও সব পোলামাইয়া হক আদায় করব। আল্লার জমি বেচাকেনা কইরা টাকা লাগব না আমার।  পিরহুজুরের দোয়ায় জবান ফিইরা পাইছি, বাকি জীবনডাও কাটব আল্লার রহমে।

কোন পিরের কথা কও তুমি ?

ওই পিরহুজুর তো খালি আমাগোরে পির আছিল না, সারা দেশের মানুষ চিনত তারে। বাংলাদেশ স্বাধীন কইরা দিয়াও চার বছর বাঁইচা ছিল। তোমাগো বড় নেতা শেখ মজিবর ও আর কত বড় বড় মন্ত্রী-নেতাও তারে পায়ে হাত দিয়া হুজুর হুজুর করত। সেই আমলে হুজুরে হুমকি দিয়া শাও দিছিল বইলা আইয়ুব খান গদি ছাইড়া পলায় গেছিল। তোমার জন্মের আগে সেই হুজুর একবার আমাগোরে বাড়িতেও আইসা আমারে অনেক দোয়া দিয়া গেছে।

ও বুঝছি, তুমি মওলানা ভাসানীর কথা কইতাছো! আরে ওই বুড়ার পলিটিক্স তো কবেই কবর হইছে, তার কোনও দল নেতা-কর্মী আছে দেশে ? তোমার মতো মুরিদরা দেশে তার জন্য উরস করে কোথাও ? পলিটিক্স আর পিরগিরি কইরা দেশের জন্য কী করছে সে ? আমাগো নেতা শেখ মুজিব বাংলাদেশ স্বাধীন কইরা শুধু জাতির পিতা হয় নাই, তার মেয়েও তার দল দিয়া দেশটারে কতো উন্নত করছে, রাখো সেই খবর ? আমরা সাহায্য না করলে এই শেষ বয়সে একলা চলবা কেমনে চাচি ?

গাঁয়ের কোনও গেরস্থবাড়ির টিভির খবর দেখার ইচ্ছে জাগে না কখনও, তেমনি সদর ভুঁইয়ার ভাষণ শুনতেও বিন্দুমাত্র আগ্রহ জাগে না। ভাদুর মা উঠে দাঁড়িয়ে বলে, আল্লার দুনিয়ায় ভাদুর মা একলা না। তোমাগোরে সাহায্য না পাইলে আর তোমাগো বাড়িতে না আইলেও পিরহুজুরের দোয়ায় বাকি দিনগুলি চলব আমার।

চলার আত্মবিশ্বাসে ভাদুর মা আজ হাতের লাঠির সাহায্য ছাড়াই জোর কদমে ভুঁইয়াবাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।

সচিত্রকরণ : ধ্রুব এষ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button