আর্কাইভপ্রচ্ছদ রচনা

মঞ্জু সরকারের উজানযাত্রা : কালের রেখাচিত্র : মোজাম্মেল হক নিয়োগী

মঞ্জু সরকারের সাহিত্যকর্ম : আলোচনা

উত্তরবঙ্গের মাটির সোঁদা গন্ধ এবং অন্ত্যজ জনগোষ্ঠীর জীবনাচার ও অন্তর্গ্রথিত কথকতা আধুনিক ও বিজ্ঞানমস্ক প্রজ্ঞায় ও শিল্পগুণে বাংলা সাহিত্যে উচ্চ মর্যাদার আসন অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। অর্ধশতাধিক গ্রন্থের মধ্যে উপন্যাস ও ছোটগল্পের প্রধান ক্যানভাস হলেও শিশুসাহিত্যেও তাঁর লক্ষণীয় অবদান স্বীকৃত। সরকারি চাকুরে ও সাংবাদিক কীর্তিমান কথাসাহিত্যিক মঞ্জু সরকার ১৯৫৩ সালে রংপুরে ভূমিস্পর্শ করেন এবং ৪৫ বছর বয়সে বাংলা একাডেমির সাহিত্য-পুরস্কারের সম্মান লাভ করেন। বর্তমানে জীবিকার সকল পেশা থেকে অবসর নিয়ে পূর্ণ সময় লেখালেখিতে মগ্ন। বলা বাহুল্য, তিনি সাহিত্যাঙ্গনে পরিচিত, মূলধারার সাহিত্যিক হিসেবে বাংলাদেশের যে কয়জন কথাসাহিত্যিক বাংলা সাহিত্যে পরিচিত, বিবেচিত ও সম্মানিত তিনি তাঁদের অন্যতম। এছাড়া, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ ও হাসান আজিজুল হক প্রমুখ কথাসাহিত্যিক রাঢ়বঙ্গের গণমানুষের জীবনগাথাকে উপজীব্য করে যেসব সার্থক কথাসাহিত্য রচনা করেছেন, ঠিক তেমনই উত্তরবঙ্গের, বিশেষ করে, বৃহত্তর রংপুরের ভূমিসন্তানদের জীবন ও কথাকে সেভাবে সার্থক চিত্রায়ণের কারিগরের মধ্যে সৈয়দ শামসুল হক, শওকত আলী ও মঞ্জু সরকারের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সৈয়দ শামসুল হকের কথাসাহিত্যে কিংবা কাব্যে আমরা তাঁর কল্পভূমি জলেশ^রীর দর্পণে দেখতে পাই বৃহত্তর রংপুরের মঙ্গাপীড়িত ও অকাট্য সারল্যের মুখচ্ছবি, নিখাদ প্রেম ও ভালোবাসা এবং কখনও বিদ্রোহের অগ্নিমূর্তি। নূরল দিনের সারা জীবন কাব্যনাট্যে তিনি বিপ্লব ও বিদ্রোহের যে ছবি চিত্রিত করেছেন তা বাংলা সাহিত্যের একটি অনন্য সৃষ্টি হিসেবে সমাদৃত। এই কাব্যনাট্যের ‘কোনঠে বাহে’ ধ্বনিতে যেন রয়েছে এক জাদুকরী মন্ত্র, যে ধ্বনি উচ্চারিত হলে অর্ধমৃত মানুষও জেগে ওঠার প্রেরণা পায়। শওকত আলীর কথাসাহিত্যেও উত্তরবঙ্গের জনমানুষের জীবনাচার ও কথকতার চিত্র যেন আলোক বিকিরণ করে। মঞ্জু সরকারও একই ক্যানভাসে উত্তরবঙ্গকে চিত্রিত করেছেন আপন নৈপুণ্যে ও বৈদগ্ধ্যে। তার মানে এই নয় যে, তাঁদের সমস্ত সাহিত্যকর্মই রংপুরের মাটি ও মানুষের জীবনীভিত্তিক তথা উত্তরবঙ্গকেন্দ্রিক। নাগরিক জীবনের কথাও তাঁদের সাহিত্যে সমানভাবে দীপ্যমান। অনস্বীকার্য যে, মঞ্জু সরকার ও শওকত আলী বাম ঘরানার রাজনীতিতে বিশ^াসী হলেও তিনজনের সাহিত্যেই, অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষের সুখ-দুঃখ, অকপট সারল্য ও বিদ্রোহ, দেশপ্রেম, সমকালীন রাজনীতি ও মুক্তিযুদ্ধ উল্লেখযোগ্যভাবে চিত্রিত হয়েছে। বলতে দ্বিধা নেই যে, মঞ্জু সরকার একজন অনলস পরিশ্রমী অনুসন্ধানী ও অনুধ্যানী লেখক, যিনি বাস্তবতার পটভূমিতে জীবনকে বিভিন্ন আঙ্গিকে চিত্রিত করেছেন, তাঁর শাণিত অন্তর্দৃষ্টিতে সমাজ ও জীবনকে ব্যবচ্ছেদ করে তুলে ধরেছেন গভীর সত্য ও বাস্তবতাকে। সেই আলোকে তিনি রচনা করেছেন অচল ঘাটের আখ্যান, অন্তর্দাহ, বরপুত্র, আবাসভূমি, অবগুণ্ঠন ও প্রতিমা উপাখ্যানের মতো উল্লেখযোগ্য উপন্যাস এবং ছোটগল্প গ্রন্থগুলোর মধ্যে অবিনাশী আয়োজন, মৃত্যুবাণ, উচ্ছেদ উচ্ছেদ খেলা, অপারেশন জয় বাংলা।

               উজানযাত্রা মঞ্জু সরকার রচিত অধিক পঠিত ও আলোচিত উপন্যাসগুলোর একটি। এটি ২০২১ সালে ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার লাভ করে। এই উপন্যাসের ক্যানভাসে চিত্রিত হয়েছে স্বাধীনতা-উত্তর পঞ্চাশ বছরের বাংলাদেশের সমাজের বাস্তবতা, মনোসামাজিক মিথস্ক্রিয়া, সমান্তরালভাবে পাশ্চাত্যের আধুনিকতা ও আবহমান বাংলাদেশের সংস্কৃতি, মুক্তিযুদ্ধের খণ্ডচিত্র, রাজনৈতিক গতিধারা, দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনের ধারা এবং প্রেম ও কামের নিগূঢ় ছবি। লোকচক্ষুর অন্তরালে ঘটে যাওয়া মানুষের জীবনের অজানা সুখ-দুঃখ, অনুতাপ-পরিতাপ, আশা-আকাক্সক্ষা, লোভ-ক্রোধ, ভালোবাসা ও কামের বর্ণনা বিধৃত হয়েছে উপন্যাসের পৃষ্ঠাজুড়ে। উপন্যাসের ভরকেন্দ্রে রয়েছে আমেরিকা প্রবাসী বাহাত্তর বছর বয়সী আধুনিক ও বিজ্ঞান মনস্ক প্রফেসর ড. মাসুদ, যাকে কেন্দ্র করেই উপন্যাসে কাহিনি আবর্তিত হয়েছে। উত্তরবঙ্গের কোনও এক অঞ্চলের ধর্মপুর গ্রামের অনেক চরিত্রের উজানযাত্রা প্রধান যাত্রী মাসুদের সঙ্গে অনেক চরিত্রের মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নির্মিত উপন্যাসের প্রথম বাক্যেই পাঠকের কাছে কাহিনিকে বিশ^স্ত করে তোলার জন্য এবং পাঠককে চমক দেওয়ার জন্য কফিন ম্যাটাফর ব্যবহার করে কল্পনার রং চড়াতে লেখক কৌশলী হন। অমূলক নয় যে, প্রথম প্যারাতেই পাঠক প্রধান চরিত্রের প্রতি আকৃষ্ট হতে পারেন।

বিয়াল্লিশ বছর দুই মাস চার দিন পর দেশে ফিরে ঢাকা এয়ারপোর্টের এক্সিট লাউঞ্জে লটবহরসহ গাড়ির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে মাসুদ কফিনে শায়িত নিজের হিমশীতল লাশটি দেখে এবং কবরবাসী স্বজনদের স্মরণ করে। মরহুম বাবা-মায়ের একান্ত ইচ্ছে ছিল, মৃত্যুর আগেও মা কথাটি বলে গেছে, বড় ছেলে মাসুদ বিদেশি বউ-বাচ্চা নিয়ে দেশে যদি আর না ফেরে, অন্তত মরার পর তার লাশটি যেন আসে এবং বাবা-মায়ের পাশে কবর পায়। মায়ের শেষ ইচ্ছাটি স্মরণ করে জর্জ ওয়াশিংটন ইউনির্ভাসিটির রিটায়ার্ড প্রফেসর বড় ভাইকে দেশে আনার সব আয়োজন করে ছোট ভাই মুকুল। ভেবেছে হয়তো, আমেরিকা থেকে লাশ আনার হাঙ্গামার চেয়ে জীবিত অবস্থায় দেশে এনে মরতে দিলে কবরে শোয়ানোর কাজটা সহজ হবে। (পৃষ্ঠা ৭)

যেহেতু দীর্ঘকাল আমেরিকায় থেকে যে মানুষটি নিজের দেশের কথা মনে করেনি, দেশে যাওয়া-আসা করেনি, তাই নিজেকে এই দেশের জন্য একটি কফিনে লাশ হিসেবে কল্পনা করতেই পারে। আবার এই প্যারার এই অংশেই লেখক এ দেশের মানুষের মনোজগতের লুকিয়ে থাকা আপনজনদের প্রতি সুগভীর ভালোবাসার টান প্রকাশ করেছেন যা সাধারণত প্রবাসী বাবা-মায়ের মধ্যে আকুতি হিসেবেই প্রকাশ পায় অর্থাৎ দেশের ভূমিসন্তান যেন দেশের মাটিতেই চিরনিদ্রায় শায়িত হয়। এই আকাক্সক্ষা শুধু মাসুদের বাবা-মায়ের নয়, সকল প্রবাসী সন্তানের বাবা-মায়েরই থাকে, যদিও পরিণামে এই সত্য অনেকাংশে বাস্তবে প্রতিফলিত হয় না। এই পর্যন্ত পাঠ করার পর পাঠক কি সত্যি সত্যিই এমন প্রত্যাশা করেন যে, মাসুদের জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটবে এই দেশেই? না, লেখক এই প্যারাতেই পরের বাক্যগুলোতে এই ধোঁয়াশার পর্দা উন্মোচন করে দেন এবং মাসুদের দেশে আসার প্রকৃত কারণ জানিয়ে দিয়ে পাঠককে উজানযাত্রীদের কাফেলায় মিশে যাওয়ার পথ তৈরি করে দেন। অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ধনাঢ্য মাসুদ প্রকৃতপক্ষে দেশে এসেছে নিরিবিলি পরিবেশে থেকে তাঁর জীবনীগ্রন্থ লেখার জন্য। মাসুদের জীবনীগ্রন্থই উজানযাত্রা উপন্যাস। এই উজানযাত্রায় মাসুদের পারিবারিক, সামাজিক, প্রাতিষ্ঠানিক বিষয়াদি থাকলেও কৈশোর ও যৌবনের সূচনালগ্নের অবিকশিত প্রেম ও দুই প্রেমিকার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কের গল্পই প্রাধান্য পেয়েছে। লেখকের ভাষায় :

কিন্তু বাহাত্তুরে প্রবীণ মাসুদ, বাংলাদেশি-আমেরিকান একাডেমিক বিজ্ঞানী প্রফেসর মাসুদুল হক পাটোয়ারি ওরফে ড. প্যাটারি যে স্বজনদের শেষ ইচ্ছে পূরণ করতে নয়, বরং ফিরে এলো শেষ বয়সেও নিজের মতো বাঁচার ও প্রেমের আনন্দ উপভোগ করতে এই সত্যটা প্রকাশে সে লাগেজে চাটি মেরে কফিন ও কবরের কল্পনা তাড়ায় এবং চারপাশে কৌতূহলী দৃষ্টি ঘুরিয়ে চেনামুখ খোঁজে। (পৃষ্ঠা ৭)

কাহিনি নির্মাণের জন্য নির্ভরযোগ্যতা ও বিশ^স্ততার জন্য লেখককে নানারূপ কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়, যাতে পাঠকের কাছে অবশ্যম্ভাবী ঘটনা বলে বিবেচিত হয় এবং যখনই ঘটনা বা কাহিনি বিশ^স্ত হয়ে ওঠে তখন চরিত্রগুলোও আলোর মতো বিভা ছড়াতে থাকে। পাঠকের মনোযোগও বৃদ্ধি পায়। ঔপন্যাসিক এ-কারণেই হয়তো ড. মাসুদের দেশে ফেরার সময়টি বিয়াল্লিশ বছর দুই মাস চার দিন পর উল্লেখ ছাড়াও আরও কিছুদিন তারিখের উল্লেখ করেছেন; যেমন―একাত্তর সালের আটাশ এপ্রিল মাসুদ মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করতে ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। এ-রকম বছর মাস ও দিনের উল্লেখ পাওয়া যায় গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা উপন্যাসে—ডা. জুভেনাল উরবিনো মৃত্যুর পর একান্ন বছর নয় মাস চার দিন পর তার বিধবা স্ত্রী ফারমিদা ডাজার সঙ্গে সাবেক প্রেমিক ফ্লোরেন্টিনো আরিজা দেখা করার সুযোগ পেল। মার্কেজ অবশ্যই আরও কিছু ঘটনার ক্ষেত্রে দিন তারিখ এমনভাবে উল্লেখ করেছেন। তাতে এই কল্পকাহিনিটি পাঠকের মনে হতে পারে একটি বাস্তবধর্মী অর্থাৎ ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ও ফারমিদা ডাজার প্রেম-কাহিনি সত্য ঘটনা।     

               উজানযাত্রা উপন্যাসটি যেন মাসুদের আত্মজীবনীর দর্পণ, যে দর্পণে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মাসুদের তরুণ বয়স পর্যন্ত এবং দেশে ফেরার পরবর্তীকালের পুঞ্জিভূত ঘটনা প্রতিফলিত হয়েছে। ধর্মপুর গ্রামের একটি শিক্ষিত কালচার্ড অভিজাত পরিবারের হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকের বড়ো সন্তান মাসুদ। একান্ন বছর পর গ্রামে ফিরে আসার পর তাঁর স্মৃতিপ্রবাহে শৈশব, কৈশোর ও তরুণ বয়সের ঘটনাবলি উপন্যাসের পর্দায় প্রক্ষেপিত হতে থাকে লেখকের ন্যারেশনে। এয়ারপোর্টের এক্সিট লাউঞ্জে দাঁড়িয়ে থেকে তাঁর স্মৃতিমন্থনে দেশত্যাগের কারণ এবং বাংলাদেশে তার আগমনের প্রভাবের আঁচ পাওয়া যায়। উপন্যাসের ন্যারেশনে কোথাও চেতনাপ্রবাহের রীতিরও সন্ধান পাওয়া যায়। ছিচল্লিশটি অধ্যায়ে বিভাজিত ২৭২ পৃষ্ঠার মলাটবন্দি উপন্যাসে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি ও জাতির রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মরণ করে মুক্তিযুদ্ধে তার অংশগ্রহণ করার কারণও প্রথম ও দ্বিতীয় অধ্যায়ে সূচিত হয়। দেশভাগ ও বাংলাদেশের  স্বাধীনতার প্রতি তার অনুভূতির বিষয়টি বিধৃত হয়।   

               বোর্ডে স্ট্যান্ড করা তুখোড় মেধাবী মাসুদ মাধ্যমিক স্কুলজীবনেই নারীঘটিত চারিত্রিক স্খলনের ঘটনাটি নিজ গ্রামের প্রতিষ্ঠাতা আদর্শের প্রতীক কড়া মেজাজের প্রধান শিক্ষক পিতার হাতে ধরা পড়ার পর থেকে অসহনীয় বাষ্পরুদ্ধ পরিবেশে ক্রমান্বয়ে পিতা-পুত্রের মনোসংকট বৃদ্ধি এবং পিতার ক্ষমাহীন ক্রোধের কারণে পিতার মুখ দর্শনে ত্যক্ত-বিরক্ত ও নিস্পৃহ মাসুদ দেশত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করতে ভারতে চলে যায়। মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার পেছনে দেশপ্রেমের চেয়ে পিতার প্রতি বিতৃষ্ণা এবং পারিবারিক গণ্ডিতে থেকে বাবার মুখদর্শনের তীব্র মনস্তাত্ত্বিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে যুদ্ধ গিয়ে মরে যাওয়াই ভালো মনে করে সে দেশত্যাগ করে। মাসুদ তখন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র। নানা প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে দেশত্যাগ করলেও প্রকৃতপক্ষে সে ভারতে গিয়ে যুদ্ধে যুক্ত না হয়ে ওদেশ থেকে প্রাপ্ত শরণার্থীদের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে সারা ভারতে ঘুরে বেড়িয়ে আনন্দ-ফুর্তিতেই কাটিয়েছে। কিন্তু তার সততার উদাহরণ মহত্ত্বের পরিচয় বহন করে। যেহেতু মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কোনও ভূমিকাই রাখেনি, তাই প্রবাসজীবনে উমরের মতো ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হয়ে কোনওরূপ সুবিধা কোথাও থেকে আদায় করার চেষ্টা করেনি এবং উমরের পীড়াপীড়িতেও নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দাবি করেনি। উমরকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয় যে, আমি ভারতে গেলেও যুদ্ধে অংশ নিইনি, তাই মুক্তিযুদ্ধের কোনও সংগঠনে যুক্ত হব না।

               এয়ারপোর্ট থেকে ঢাকার উত্তরায় অনুজ মুকুলের অত্যাধুনিক বাসায় পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কয়েক দিন থাকে মাসুদ। পারিবারিক সদস্য বলতে মুকুলের নাতি-নাতনিসহ অনেকেই ছিল তাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য, সঙ্গ দেওয়ার জন্য। প্রবাস জীবনের সঙ্গে উত্তরার বাসায় জীবনযাপনের মধ্যে বেশ সাজুয্য থাকাতে মাসুদ আপ্যায়ন উপভোগই করছিল। 

               মাসুদ ফিরে আসে জন্মভূমি ধর্মপুর গ্রামে। ছোট ভাই মুকুল ইঞ্জিনিয়ার। অর্থবিত্ত, ব্যবসাপাতি, রাজনীতি ও সামাজিক মর্যাদায় দেশের উচ্চবিত্তের সম্পদশালী ব্যক্তি হিসেবে বড়ো ভাইকে বাড়িতে থাকার জন্য আমেরিকা প্রবাসীর জন্য যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা প্রয়োজন ঠিক সে-রকম আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত একটি বাংলো নির্মাণ করে দেয় ধর্মপুর গ্রামে। আমেরিকায় জীবনযাপনে যেভাবে অভ্যস্ত সেভাবে থাকা-খাওয়ার জন্য তার যাতে কোনও অসুবিধা না হয় সেজন্য যাবতীয় ব্যবস্থা করতে মুকুল কার্পণ্য করেনি। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে পারিবারিক পরিবেশে মদ্যপান কেবল উচ্চবিত্ত পরিবারে দেখা যায়, যে চিত্র এই উপন্যাসেও পরিস্ফুটিত হয়েছে। দুই ভাইয়ের একসঙ্গে মদ্যপানের মধ্য দিয়ে সংস্কারমুক্ত আধুনিক জীবনের চালচিত্র উপন্যাসে স্থান পেয়েছে। আমেরিকা প্রবাসী একজন অধ্যাপকের খাদ্যাভ্যাসকে লেখক বাস্তবভিত্তিক করে তুলেছেন। উত্তরার বাসায় মাসুদের আগমন উপলক্ষ্যে ঢাকার কয়েকজন খ্যাতিমান অধ্যাপক ও ব্যক্তিত্বের সঙ্গে একটি নৈশভোজ হয়। এই নৈশভোজের সময় তাঁদের বাতচিতে পঁচাত্তর পরবর্তীকাল থেকে শুরু করে হালের রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো স্থান পায়। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সেভেন মার্ডার, বামপন্থি রাজনীতির ধারা ও পরিণতি, ক্ষমতাসীন সরকারের কার্যকলাপ, বাকস্বাধীনতাসহ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের অনেক বিষয়ই উপন্যাস ধারণ করেছে প্রাসঙ্গিকভাবে। এইসব আনুষঙ্গিক ও প্রাসঙ্গিক ঐতিহাসিক উপাদান উপন্যাসে স্থান পাওয়াতে উপন্যাস যেমন হয়েছে সমৃদ্ধ, অন্যদিকে পাঠকও রাজনীতি সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাবেন। একটি আদর্শ ও মহান উপন্যাস কেবল কোনও জীবনের গল্প নয়, বরং উপন্যাসের ঘটনাপ্রবাহে মিশে যায় মানুষের জীবনযাত্রাসহ দেশ-সমাজ-কালের প্রাসঙ্গিক বিষয়াদি। উন্নত উপন্যাস মহাকালের সাক্ষী হয়ে থাকে। মানুষ যেহেতু রাজনীতির বাইরে নয়, তাই রাজনীতির অনুবন্ধন এই উপন্যাসের বাড়তি রসদ। পাঠক পাবেন একদিকে কল্পকাহিনির আনন্দ এবং অন্যদিকে রাজনীতি ও দেশের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি।

               পাঠকের মনে প্রশ্ন দেখা দেওয়াটা স্বাভাবিক যে, গ্রামে ফিরে মাসুদ কি আত্মজীবনী লেখার কাজে ব্যাপৃত হয় ? নাকি অন্য কোনও কাজে যুক্ত হয়ে নিজের অভিজ্ঞতা, অর্থবিত্ত মানুষের কল্যাণে নিয়োগ করে ? পাঠকের কৌতূহল মেটানোর জন্য ঔপন্যাসিক দুটি বিষয়কেই অবলম্বন করে উপন্যাস নির্মাণ করেছেন।

               মাসুদের দেখভাল ও বিভিন্ন কাজে সাহায্য করার জন্য বহ্নি নামের এক সুন্দরী কিশোরীকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ছোট ভাই মুকুলই এই নিয়োগের ব্যবস্থা করেছে। বিয়াল্লিশ বছর পর এসে নিজের গ্রামে কিছুটা পরিবর্তন দেখতে পায় মাসুদ। চেনা মানুষগুলো যেন অচেনা হয়ে গেছে। অনেকেই হারিয়ে গেছে। সহপাঠীদের মধ্যে পাওয়া গেল সাইফুল ও কুদ্দুসকে। মাসুদের পরিবারের পূর্বের আভিজাত্যের চেয়ে বর্তমানের আভিজাত্য আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। গ্রামে বলতে গেলে তাদের একক আধিপত্যই পূর্বের মতো রয়েছে। এখানকার জীবন অর্থবিত্ত, প্রাচুর্যে ও আভিজাত্যের মোড়কে বন্দি হলেও মাসুদ খুঁজে বেড়ায় তার কিশোর বয়সের প্রেমিকাদের যাদের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। অতীতকে অনুসন্ধান করার মধ্য দিয়ে এবং বর্তমানের ধর্মপুর গ্রামের মানুষের মধ্যকার মিথস্ক্রিয়ার যুগপৎ ধারায় উপন্যাসের স্থাপত্য নির্মিত হয়েছে। ধর্মপুরে বসেই ড. মাসুদ জীবনী লেখার মধ্য দিয়ে সামাজিক, পারিবারিক, রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত বিষয়গুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে উদঘাটন করেন। পঞ্চাশ বছরে মানুষের জীবনে ও একটি সমাজে কত কিছু ঘটে যায় লেখক চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন। তবে সবকিছু ছাপিয়ে বাল্যপ্রেমিকা মাছুয়া ধোঁধার বড়ো মেয়ে হতদরিদ্র অঞ্জনি এবং পাশের গ্রামের মোমেনার প্রেম ও শারীরিক সম্পর্ক মুখ্য হয়ে ওঠে এবং শেষ বয়সে তাদের দুজনের কষ্টকর জীবনের ব্যঞ্জনা পাঠকের মনকে নাড়িয়ে দেয়। গ্রামের ছবিগুলো যেন দৃশ্যমান হয়, দৃশ্যমান হয় জীবনের নানা রকম উত্থান-পতন ও বাঁকবদলের সুখ-দুঃখের ঘটনা। অনবদ্য চিত্রকল্প সৃষ্টিতে লেখক কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন।  

               বলা বাহুল্য, এই উপন্যাসের প্রধান উপাদান হলো গ্রামীণ সংস্কৃতি ও কুসংস্কার যা আবহমান বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে। মাসুদের চাচা ইব্রাহিম মনে করে মসজিদের জিন মাসুদকে গ্রামে এনেছে। তাছাড়া, উল্লেখযোগ্য হিসেবে ‘মাশানকুড়া’র মিথটি মনে করিয়ে দেয় আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের খোয়াবনামা উপন্যাসের কাৎলাহার বিলের মুনসির মিথকে। এ-রকম মিথ বা বিশ^াস পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন রকম দেখা যায়। ধর্মপুরের মানুষেরা মাশানকুড়ার পিশাচকে বিশ^াস করে এবং ওই পিশাচ মানুষের ক্ষতি করে। খোয়াবনামায় মুনসি যেমন কাৎলাহার বিল শাসন করে তেমনই পিশাচেরা কুড়াকে শাসন করে। লেখকের ভাষায় :

কুড়ার গভীর পানিতে অতিকায় গজার কিংবা বোয়াল মাছের ছদ্মবেশে অনেক পিশাচ-মাশান থাকার কারণে বিলটার নাম হয়েছিলা মাশানকুড়া। কুড়ার মাশানভূত নিয়ে নানা কিংবদন্তি গাঁয়ের ছোটরাও জানে। সেসব জানা গল্প ছাড়াও কুড়ার মাশান-পিশাচের কাণ্ডকীর্তির খবর মৎস্যকন্যা তো বেশি জানেই, উপরন্তু পানির নিচে মাছের গতিবিধিও সে ওপর থেকে দেখতে পায়। (পৃষ্ঠা ১২০)

মাছুয়ার বেটি অঞ্জনি, মাছ ধরার জন্যও খুব পটু বলে নসু দাদা নাম দিয়েছে মৎস্যকন্যা ও ধানকন্যা, ড. মাসুদও তাকে কখনও মৎস্যকন্যা আবার কখনও ধানকন্যা বলে ডাকে। দুধমায়ের মেয়ে অঞ্জনির সঙ্গে তার প্রথম প্রেম অর্থাৎ কৈশোরেই প্রথম যৌনতার ভাগাভাগি। অঞ্জনিই যৌনতার প্রথম পাঠ দেয় মাসুদকে যা স্বভাবসিদ্ধভাবে প্রকৃতি থেকে মানুষ শিখে থাকে। অঞ্জনির মধ্যে দেখতে পাওয়া যায় মাহমুদুল হকের অনুর পাঠশালা উপন্যাসের সরুদাসীকে। অঞ্জনির মতে গ্রামের মানুষ খারাপ কাজ শেখে পশুপাখিদের প্রজননকর্ম দেখে। হাঁস-মুরগি-গরু- ছাগল-কুকুর-বিড়ালের প্রজনন ক্রিয়া দেখে মানুষও শেখে (পৃষ্ঠা ৮৬)। সে মাশানকুড়ায় মাসুদকে মাছ ধরতে শেখায়, মাছ ধরার সময় অঞ্জনি অশ্লীল ইঙ্গিত করে যৌনতার প্রতি প্ররোচিত করে। দুজনের মধ্যে কিছুটা ঘনিষ্ঠতা হলে মাশানকুড়ায় পানির নিচে প্রথমে আঙুল স্পর্শ করে এবং তারপর শিশ্ন ধরে মাসুদকে আনন্দ দেয় (পৃষ্ঠা ১০১)। মাসুদও অঞ্জনির ডাকে সাড়া দিলে দুজন জলো সম্পর্কে গড়ালে সেই খবর জানাজানি হলে মাসুদের ওপর শাসন নেমে আসে। তবে মাঝে মাঝেই বিভিন্ন শারীরিক কসরতের কারণে ওদের বাড়িতে কাজ করার সময় অঞ্জনির প্রতি সে আসক্ত হয়ে পড়ত। এক সময় অঞ্জনির বিয়ে হয়। কিন্তু বিয়েটা বেশি দিন টিকেনি। যৌতুক ও তার মানসিক অসুস্থতার কারণে জিন-ভূতে ধরেছে বলে তাকে শ^শুরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। জিনের গল্প গ্রামে, বিশেষ করে দরিদ্র পরিবারে, যে পরিবারে কিশোর বয়সী বধূরা শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতিত হয় তাদের মধ্যে প্রায়ই দেখা যায় এবং চিকিৎসার পরিবর্তে মেয়েদের ওপর নেমে আসে নিষ্ঠুর নির্যাতন। এই নির্যাতনের চূড়ান্ত ফয়সালা ঘটে তালাক দিয়ে বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে। অঞ্জনির জীবনের মতো অন্য চরিত্রগুলোও ঔপন্যাসিক মঞ্জু সরকার দক্ষতার সঙ্গে চিত্রিত করেছেন। বিতাড়িত অঞ্জনিকে ঢাকায় মাসুদের এক আত্মীয়ের বাসায় কাজ দেওয়ার ব্যবস্থা হলে মাসুদকে ঢাকায় নেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়। হেঁটে যেতে যেতে ওদের দুজনের মধ্যে ঐকমত্য হয় যে, মাঝে মাঝে সুযোগ বুঝে তারা শারীরিকভাবে মিলিত হবে। জনশূন্য পথে মাসুদ অঞ্জনির বুকে হাত বুলিয়ে ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়ে এবং কোনও এক সময় কথার ভুল বোঝাবুঝির কারণে ক্রুদ্ধ অঞ্জনি ঢাকা না গিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা দেয়। বয়স হওয়ার পর অঞ্জনি বিশ^াস করে মাসুদ বিদেশে গিয়ে খ্রিস্টান মেয়েকে বিয়ে করে, তারপর মরে ভূত হয়ে গেছে। কিন্তু ধর্মপুরে আসার দীর্ঘ দিন পরে মাসুদ খুঁজে পায় বুড়ি অঞ্জনিকে। অঞ্জনি তখন সাদা চুল, জরাজীর্ণ শাড়ি পরিহিতা, জীর্ণশীর্ণ ভিখারিনী। দুদিন পরেই সে মাসুদদের বাড়িতে এসে সাহায্যের জন্য হাত পেতেছে মাসুদের কাছে। তার দাবিও বেশ জোরালো। কেননা, মাসুদ তার মায়ের স্তন্যপান করেছে, তাই তাকে বেশি টাকা দিতে হবে। ‘নাতিকে কয় টাকা দিলু ? ও মাসুদ, মোকে কী দিলু তুই ? তুই যে মোর দুধভাই, মোর মায়ের দুধ চুষিয়া মানুষ হইছিস, সে কথা ভুলি গেছিস!’ (পৃষ্ঠা ২১২)     

               তারপর দ্বিতীয় জলো প্রেম ও শারীরিক সম্পর্ক সৃষ্টি হয় মাসুদের চেয়ে বয়সে বড়ো পাশের গ্রামের তাদেরই বর্গাচাষির মেয়ে মোমেনার সঙ্গে। মোমেনা মাধ্যমিক পাস করে ফ্যামিলি প্ল্যানিংয়ে চাকরি করে মাসুদের বাবা প্রধান শিক্ষক এয়াকুব আলীর পরামর্শে। মোমেনার সঙ্গে মাসুদের রাত্রিযাপনের সময় বাবার কাছে হাতেনাতে ধরা পড়ে। মাসুদের জীবনের ক্লাইমেক্সের সঙ্গে সঙ্গে উপন্যাসের ক্লাইমেক্স শুরু হয় এই বিন্দু থেকে। লেখকের ভাষায় :

ড. মাসুদ জীবনে যত নারীকে দেখে মুগ্ধ হয়েছে, ভালোলাগার বোধে বিহ্বল হয়েছে, অতঃপর ক্ষণস্থায়ী ও দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্কে জড়িয়েছে যাদের সঙ্গে, তাদের মধ্যে প্রথম প্রেম মোমেনাকে দেখার এবং বিছানায় তাকে পাওয়ার স্মৃতিটি সেরা, যা জীবনে কত সহস্রবার যে মনে পড়েছে, তার হিসাব নেই। প্রায় পঞ্চাশ বছর পর দেশে ফিরে দুর্ঘটনার স্মৃতিটা আবারো স্মরণ করার জন্য ঘাঘটের ওই ব্রিজের কাছে গিয়ে জায়গাকে আর চিনতে পারবে না মাসুদ। পাকা রাস্তার ওপর ব্রিজটাও নতুন হয়েছে। কিন্তু নিচের ছোট নদীটা থাকলেও রাস্তার ধারে দোকানপাট- বিল্ডিংবাড়ি গিলে খেয়েছে সেই নির্জন গোধূলির আলো। (পৃষ্ঠা ১৫০)

মোমেনার ঘটনার মাধ্যমে অভিজাত পাটোয়ারির পরিবারের তুখোড় মেধাবী ছাত্রের এমন কলঙ্ক যদি প্রকাশ পায় তাহলে গ্রামে এই পরিবারের কে মুখ দেখাতে পারবে ? এই কলঙ্কজনক ঘটনা কড়া মেজাজের তুখোড় ব্যক্তিত্বের অধিকারী স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক এয়াকুব পাটেয়ারি কীভাবে মেনে নেবেন ? বিকল্প চিন্তা, পরিবারকে শহরে স্থানান্তর করা।

               নারী চরিত্রগুলোর মধ্যে অঞ্জনি ও মোমেনা উপন্যাসের প্রধান চরিত্র এবং এই দুটি চরিত্র লেখক অত্যন্ত দক্ষতা ও সতর্কতার সঙ্গে সৃষ্টি করেছেন। মোমেনা সুন্দরী ও শিক্ষিতা। চাকরি পাওয়ার আগে তার বিয়ে হয়েছিল, একটি কন্যাসন্তান হওয়ার পর স্বামী হঠাৎ মারা যায়। তারপর বাপের বাড়িতে আশ্রয় নেয়।  সুন্দরী মেয়ে হিসেবে সুনাম আছে, তেমনই ফ্যামিলি প্ল্যানিং বিভাগে চাকরির করার জন্য তার বদনাম ছড়িয়ে পড়ে এই মর্মে যে, মোমেনার চরিত্র খারাপ। সে মানুষকে কনডম পরতে শেখায়, এমনকি আখ খেতে পুরুষকে কনডম পরানো শেখায়। চাকরি করে অসচ্ছল একটি পরিবারে সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনার যে স্বপ্ন দেখছিল তা সফল হয়নি। পাড়ার মসজিদের ইমাম মওলানা গফুর প্রথমে চরিত্রহীন গুজব ছড়িয়ে নানা রকম ষড়যন্ত্রের কলে ফেলে তাকে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে বিয়ে করে। তারপর মওলানা গফুর মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকারের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়াতে স্বাধীনতার পর সে নিরুদ্দেশ থাকে এবং কয়েক বছর পর মারা যায়। ওই ঘরে তার তিনটি সন্তান হয়েছিল। চাকরি ছেড়ে সম্পত্তির লোভে মওলানাকে বিয়ে করার অপবাদে মাসুদ মোমেনাকে তখন ভালো চোখে দেখত না বলে তার সঙ্গে আর দেখা করেনি, বলা যায় চিরস্থায়ী বিচ্ছেদ ঘটে সেই বিয়ের পর থেকে। বহ্নির কাছে যখন জানতে পারে যে তার নানি মোমেনা তিন বছর আগে মারা গেছে তখন মাসুদ আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে। সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না সংক্রামক বিধায় মোমেনার মৃত্যুর খবরে পাঠকও ভারাক্রান্ত হতে পারে; হতে পারে বিষাদক্লিষ্ট।

               উপন্যাসের পাতায় পাতায় রয়েছে বৈচিত্র্যের ছড়াছড়ি। যদিও প্রেম ও যৌনকাতরতা এই উপন্যাসের মূল উপাদান কিন্তু এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের অনুষঙ্গ, রাজনীতি, অতীত ও সমকালীন সামাজিক অবস্থা, ধর্মীয় আচারাদি, আবেগ, হতাশা, মিথ, বিশ^াস-অবিশ^াসের দোলাচল, সংস্কার-কুসংস্কার ইত্যাদি মনোসামাজিক বিষয়গুলোর ব্যঞ্জনায় উপন্যাসটি ঋদ্ধ হয়েছে। মাসুদের চরিত্রেও আনা হয়েছে বৈচিত্র্য। ড. মাসুদ এলাকায় কল্যাণমূলক কাজ করার জন্য স্থানীয় পর্যায়ের জাদুঘর ও কৃষি খামারের জন্যও কাজ শুরু করেন। কখনও আশাবাদী, আবার কখনও হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। মোমেনার নাতনি বহ্নিকে পটিয়েপাটিয়ে তার বাংলোতে থাকার জন্য রাজি করানো হয়েছে। সমাজের মানুষের নানা রকম মন্তব্যকে উপেক্ষা করে বহ্নিও বাংলোয় থাকা শুরু করেছে। তার প্রেমিক ফিরোজ মাসুদের ঘনিষ্ঠতা লাভ করতে সমর্থ হলেও শেষ পর্যন্ত তা টিকে না। 

               আমেরিকা থেকে ড. মাসুদের তৃতীয় স্ত্রী ন্যান্সি তাকে তালাক দেওয়ায় ডিপ্রেশনে ভুগতে থাকে। এই কারণে, শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য  মেডিটেশন করে। মাঝে মাঝে সামাজিকতা রক্ষার্থে লোক দেখানো ইবাদত করতে, আধুনিক ও বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ যার পরকালে বিশ^াস নেই, কিন্তু মসজিদে যায়। তবে সত্তরোর্ধ্ব মাসুদের যৌনপ্রবৃত্তি দমে যায়নি। অত্যন্ত কৌশলে প্রথম জীবনের প্রেমিকা মোমেনার নাতনি কলেজপড়ুয়া ব্যক্তিগত সহকারী বহ্নিকে প্রেমের জালে আটকাতে চতুর শিকারির মতো উঠেপড়ে লাগে। সফলও হয়। 

               চাচা ইব্রাহিম পাটোয়ারি, চেয়ারম্যান, এলাকায় প্রভাবশালী ক্ষমতাধর ব্যক্তিও মাসুদকে বিশ^াস করে। তার মৃত্যুর পূর্বে সম্পত্তি ভাগাভাগির সময় মাসুদকে কাছে ডাকে। ছেলে তোফাকে ও তৃতীয় স্ত্রীর সন্তানকে সম্পত্তি কম দিতে চায় চাচা। কারণ হিসেবে চাচা উল্লেখ করে যে, তৃতীয় ছেলেটি তার নিজের নয়, তোফার। তোফার সঙ্গে যুবতী সৎ মায়ের শারীরিক সম্পর্ক হওয়া খুব অস্বাভাবিক মনে হয় না। শরীরের ব্যাকরণ ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হয়। নদীর গতিধারাকে যেমন নিয়ন্ত্রণ করা যায় না ঠিক তেমনই শুধু প্রভাব-প্রতিপত্তি, অর্থ-সম্পদ-যশ দিয়ে শরীরকে প্রথাসিদ্ধ করা যায় না, যায় না নিয়ন্ত্রণ করা। যুগে যুগেই বিভিন্ন সমাজে যুবতী সৎমায়ের সঙ্গে যুবক ছেলেদের শারীরিক সম্পর্কের প্রমাণ পাওয়া যায়। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের খোয়াবনামা উপন্যাসে কুলসুমের সঙ্গে তমিজের শারীরিক সম্পর্কের উল্লেখ রয়েছে। কথাসাহিত্যিক আবুল বাশারের ফুলবউ উপন্যাসে মওলানার চতুর্থ স্ত্রী রাজিয়ার সঙ্গে ছেলে মিল্লাতের গভীর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং বিয়ের দিন রহস্যজনক কারণে রাজিয়া নিরুদ্দেশ হয়ে যায়।

               কথাসাহিত্যিক মঞ্জু সরকার সমাজকে ব্যবচ্ছেদ করেছেন, ব্যবচ্ছেদ করেছেন বর্ণিত চরিত্রগুলোর। হয়তো অলক্ষ্যে নয়, সচেতনভাবেই তাঁর অন্তর্দৃষ্টিতে ধরা পড়েছে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাগুলো। অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া সেই পঞ্চাশ বছরের আগের মানুষগুলো পঞ্চাশ বছর পরও পিছিয়েই রইল। সম্পদশালীরা আরও সম্পদশালী হলো। ইঞ্জিনিয়ার মুকুলের মনে রাজনৈতিক অভিলাষ থাকার কারণে এলাকায় কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান করেছে এবং নিজেও অঢেল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছে। শেষে বড়ো ভাই মাসুদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রের ফাঁদ পেতেছে। অঞ্জনির ছেলে মনির ভ্যানচালক হয়েছে, মোমেনার সংসারের তেমন কোনও উন্নতি নেই, তারা এখনও বর্গাচাষিই রয়ে গেছে। তবে দেশের অবকাঠামো উন্নয়নের এবং মঙ্গা দূর হওয়ার ইঙ্গিত উপন্যাসে পাওয়া গেলেও বুর্জোয়া শ্রেণির উর্ধ্বমুখী উত্থানের সঙ্গে পুঁজিবাদের বিস্তারের প্রমাণ পাওয়া যায় মাসুদদের পরিবারের সদস্যদের বিলাসিতাপূর্ণ যাপিত জীবন থেকে।

               ড. মাসুদ পাটোয়ারি পাশ্চাত্যের আধুনিক সংস্কৃতি ধারণ করে জীবনযাপন করেছে এবং আমেরিকায় তার বিদেশিনী স্ত্রীদের সন্তানরাও পাশ্চাত্য সংস্কৃতিকেই ধারণ করবে যা অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা। এই স্বাভাবিকতা কি এ দেশের মানুষ গ্রহণ করতে পারে ? তার কন্যা গর্ভে সন্তান ধারণ করেছে এবং মানুষ যখন জানল যে, বিয়ে হয়নি অথচ সন্তান ধারণ করল তখন অনেকের মনে নানা রকম প্রতিক্রিয়া দেখা গেলেও মাসুদরা প্রভাবশালী বলে সেই সব কথা আড়ালেই থেকে যায়। মোমেনার দ্বিতীয় বিয়ের এক বছরের মধ্যে পুত্রসন্তানের জন্ম হলে অনেকেই সেই সন্তানের বৈধতার প্রশ্ন তুলে কুৎসা রটিয়েছিল। কিন্তু ড. মাসুদের কন্যার বিয়ের পূর্বে সন্তান ধারণের জন্য কুৎসা রটনার সুযোগ থাকল কোথায় ? বিত্তবানরাই সমাজের নিয়ন্তা, তাই কে কথা বলবে ?

               সময়, সমাজব্যবস্থা, ব্যক্তির প্রভাবে সংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটে। মানুষ নিজেকে বদলায়। বহ্নিও বদলে গেল। নিম্নবিত্ত পরিবারের বহ্নি কলেজেপড়ুয়া তরুণীও মাসুদের প্ররোচনায় রেডওয়াইন পান করতে শুরু করে। হয়তো মাসুদ না এলে সে মদ্যপান কল্পনাও করতে পারত না। ফিরোজের সঙ্গে বহ্নির সম্পর্কের কথা মাসুদ জানে এবং তার সঙ্গে ভিড়িয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিলে বহ্নি প্রত্যাখ্যান করে এই মর্মে যে, ফিরোজ অর্থলোভী। সে চাকরির আশায় বহ্নির সঙ্গে জড়িয়েছিল। ফিরোজের চাকরির ব্যবস্থা করে মুকুল ঢাকায় নিয়ে যায়।

               উপন্যাসের রয়েছে নানা রকম বাঁকবদল। অতীত ও বর্তমানের গল্প। শৈশব থেকে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত ড. মাসুদের যৌনকাতরতা ছাড়াও পশ্চিমা সংস্কৃতিতে মানিয়ে চলা একজন আধুনিক ও বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ হিসেবে চিত্রিত হয়েছে। তবে এক কালের শয্যাসঙ্গিনী মোমেনার বয়সী বহ্নির সঙ্গে প্রেমে জড়িয়ে পড়ার ঘটনাটি পশ্চিমা সংস্কৃতি কতটুকু অনুমোদন করে তা আমাদের জানা নেই। মাসুদের লাম্পট্যকে সাধুবাদ জানানো কতটুকু উচিত হবে তাও বলা কষ্টসাধ্য। একই বাংলোয় একটি তরুণীর সঙ্গে থাকা, তাকে লোভনীয় ভবিষ্যতের অফার দেওয়া এবং নিজেকে প্রেমিক পুরুষ হিসেবে উপস্থাপন করা ছিল বহ্নিকে ঘায়েল করার কূটকৌশল। লেখকের ভাষায় :

দেখো, পুরোনো ভালোবাসার টানে এত যুগ পরে আমি ফিরে এসেছি। আসার পর থেকে সেই হারানো প্রেম খুঁজে ফিরছি আমি। এখন তোমাকে দেখে কী মনে হচ্ছে জানো ? তোমার মাঝেই যেন আমার হারানো প্রেম হারানো দেশ সব কিছুই ভর করে আছে। মোমেনাকে পাওয়ার রাতে বুকের মধ্যে যে রকম আবেগ-উত্তেজনা জেগেছিল, তোমাকে দেখেও আজ সে রকম আবেগ জাগছে। সত্যি বলছি। (পৃষ্ঠা ২৭১)

মাসুদের আবেগীয় কথায় যেন আগুনের আঁচে মোম হয়ে গলে পড়ে বহ্নি এবং প্রথম দিকে যদিও সে মাসুদের লালসার শিকার না হওয়ার জন্য এড়িয়ে চলত কিন্তু ভবিষ্যতে আমেরিকা ছেড়ে দেশে চলে এসে একটি বৃদ্ধাশ্রম করার পরিকল্পনার কথা জানায়, যে বহ্নিকে ওই পরিকল্পিত বৃদ্ধাশ্রমের দায়িত্ব দেওয়া হবে। বহ্নি তখন নিজেকে সমর্পণ করে মাসুদের বাহুবন্ধনে। উপন্যাসটি শেষ হয় :

বহ্নিকে আবেগময় আলিঙ্গনে বেঁধে বলে মাসুদ, ‘এভাবে পাশে থাকো যদি, আসব বহ্নি, বারবার হাজারবার দেশে ফিরে আসব আমি।’ (পৃষ্ঠা ২৭২)

মঞ্জু সরকারের উজানযাত্রা সরল ও সাবলীল ভাষায় রচিত। কিছু রংপুর আঞ্চলিক ভাষার সংলাপ চরিত্রগুলোকে উজ্জ্বল করেছে। ভাষা ও শব্দের বাহুল্য চোখে পড়েনি। মাসুদের সঙ্গে অঞ্জনি ও মোমেনার যৌন-প্রবৃত্তির বর্ণনায় কিছুটা নগ্নতা থাকলেও বর্তমান সময়ে এই বর্ণনা অশ্লীলতাকে নির্দেশ করে না। রবীন্দ্রযুগে হলে হয়তো এই ধরনের নগ্নতাকে খারিজ করে দেওয়া হতো, কিন্তু বর্তমান সময়ে সাহিত্যে অপ্রাসঙ্গিক নয়, বরং বলা যায় সময়ের দাবি। বাংলাদেশের পাঠক হারুকি মুরাকামি ও মার্কেজ পড়ে অভ্যস্ত, যাঁদের সাহিত্যে এমন শারীরিক মিলনের বর্ণনা সাবলীল। তবে ঔপন্যাসিক সতর্কতার সঙ্গে শৈল্পিকভাবে স্পর্শকাতর বিষয়গুলো উপস্থাপন করেছেন। চরিত্র চিত্রণেও তিনি পারঙ্গমতার স্বাক্ষর রেখেছেন। মানবজীবন বড়ো রহস্যময়। মানবজীবনের অনেক কথাই অপ্রকাশিত ও অনোন্মোচিত থেকে যায়। ড. মাসুদের জীবনের ঘটনাবলির মতো অনেক মানুষের জীবনে যে ঘটে না তা হলফ করে কে বলতে পারবে ?

লেখক : কথাশিল্পী ও সাহিত্য বিশ্লেষক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button