আর্কাইভপ্রচ্ছদ রচনা

এক মুক্তিযোদ্ধার পরাজয় কিংবা একটি প্রেমের অপমৃত্যু : রণজিৎ অধিকারী

মঞ্জু সরকারের সাহিত্যকর্ম : আলোচনা

উপন্যাস এমন একটা শিল্প যার ভেতরে ঠেসে পুরে দেওয়া যায় দেশকালের যাবতীয় সংকটকে। এমনকি উপন্যাস সেই শক্তি ধারণ করে, যে-শক্তি একটা প্রেক্ষাপটকে আবার নতুন করে আবিষ্কার করতে দেয় পাঠককে। কোনও ইশারা বা ইঙ্গিতমাত্র দিয়েই কোনও উপন্যাস লেখা সম্ভব হয় না, তাই এসে পড়ে লেখকের বিস্তৃত অভিজ্ঞতা, তাঁর নিজস্ব বয়ান এবং সেই সব প্রশ্নও―যার উত্তর হয়তো লেখকের কাছেও নেই। যেন জীবনের শেষ অংশের মতো উপন্যাসের শেষও লেখকের অনায়ত্ত, আর সেই অসহায়তা বহন করতে বাধ্য হন লেখক। আমরা এই সমস্ত প্রসঙ্গ তুলব না, সেই সব আখ্যান বা উপন্যাস সম্পর্কে, যাদের আকাক্সক্ষা কেবল পাঠকের মনজয়েই চরিতার্থ হয়। আমরা সেই উপন্যাসের দিকে ইঙ্গিত করছি, যে-তার শরীরের ভেতরে চরিত্রের গভীর মনোজগৎ থেকে তার চারপাশের বিচিত্র ঘটনাসমূহকে আত্তীকরণ করতে চায়।

যে কোনও দেশের যে কোনও মানুষের কাছে তো সবচেয়ে বড় সংকট তার দেশের স্বাধীনতা, স্বাধীনতাকে কেন্দ্র করে তার স্বপ্ন আকাক্সক্ষার বুনন এবং স্বাধীনতার পর মানুষের হতাশা। কেননা দেশ স্বাধীন হলে চালের দাম কমে যাবে কিনা এমন ‘তুচ্ছ’ প্রশ্ন ব্যক্তিগত হতে পারে না। তখন এই আশা-আকাক্সক্ষা একটা দেশের জাতির কোটি কোটি সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক চাওয়া হয়ে প্রতীকী রূপ লাভ করে। গত শতকে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন, দেশভাগ, স্বাধীনতা, দাঙ্গা বা মুক্তিযুদ্ধের মতো ঘটনা এভাবেই বারবার লেখকদের কাছে সেই দাবি জানিয়েছে। মানুষের সঙ্গে এই সমস্ত ঘটনার সম্পর্ক, সেই পটভূমিতে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের টানাপোড়েন ইত্যাদিকে পুনরাবিষ্কার করার এবং সেই দায় নিতে হয়েছে বিশেষ করে ঔপন্যাসিকদেরই। কেননা ততদিনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে যে, উপন্যাস এমন এক শিল্প ও শক্তি যা সাহিত্যের অন্যান্য ধারাগুলির চেয়ে ভিন্নভাবে কাজ করে। এখানে লেখককে অভিজ্ঞতা ও কল্পনার চূড়ান্ত ক্ষমতার প্রয়োগ করে সেই সেই সংকটগুলির ভেতরে প্রবেশ করতে হয় এবং কাহিনির পুনর্র্নিমাণ করতে হয় এমনভাবে যেন তা সত্য শিল্পবস্তু হয়ে ওঠে।

স্বাধীন বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এমন একটি সংকটকাল হলো তার মুক্তিযুদ্ধ। ফলে মুক্তিযুদ্ধ লেখকদের কলমে বারবার ফিরে আসতেই পারে কিন্তু সেই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লেখককে দেশকাল খুঁড়ে অনুসন্ধান করতে হবে, বহু আকাক্সিক্ষত স্বাধীনতা তার মুক্তিযুদ্ধ কতদূর উত্তরণের পথে নিয়ে যেতে পেরেছে দেশকে। এই প্রশ্নের সম্মুখীন হবেন কিংবা হবেন না―এই দুই শিবিরে ভাগ হয়ে পড়তে পারেন লেখকেরা। এত সব কথা উঠে পড়ল মঞ্জু সরকারের উপন্যাস প্রতিমা উপাখ্যান বিচার প্রসঙ্গে। একটি ছোট উপন্যাস তার শরীরের মধ্যে কতখানি অঙ্গীকার বহন করতে সক্ষম, তার উজ্জ্বল উদাহরণ এই উপন্যাসটি। তাই একটি প্রেমোপাখ্যানের ইঙ্গিত দিয়ে শুরু করেও ক্রমেই তার পরিধি বেড়ে যেতে দেন লেখক। এবং ক্রমেই প্রেমের অনুষঙ্গটি ছাড়িয়ে তিনি যেন নিজেই সমাজের জোরালো সব জট খুলতে প্রয়াসী হয়ে পড়েন। এমনকি নিজের ভেতরকার দ্বিধা পাঠকের মধ্যেও চারিয়ে দেন ‘তার পলায়ন বা পরাজয় দেখিয়ে গল্পটা শেষ করা যায় না।’ এখানে উপন্যাসের সমাপ্তির তাই একাধিক সম্ভাবনা তৈরি হয়ে যায়। যদি কেবল গ্রাম্যজীবনের কাহিনি হয়ে উঠতে চাইত এই উপাখ্যান, তবে তো প্রতিমা যখন তাকে নিয়ে তৈরি হওয়া সংকটটাকে সহ্য করতে না পেরে দাদার কাছে ভেঙে পড়ে ‘দাদা, আমার আর এসব ভালো লাগে না। তুই আমাকে ইন্ডিয়ায় বড়দার ওখানে পাঠায়ে দে। তা না হয় একটা ভালো চাকরি নে, আমরা টাউনে গিয়ে থাকব।’ তখনও শেষ হয়ে যেতে পারত। এখানে একই সঙ্গে দুটো বিন্দুর দেখা পাই আমরা : এক গ্রাম্যজীবনের চক্রান্ত আর রাজনীতি থেকে দূরে সরে যাওয়ার চেষ্টা; দুই সাম্প্রদায়িক চাপে বর্ণহিন্দুদের ইন্ডিয়ায় চলে যাওয়া। কিন্তু এ-দুটোর কোনওটাই লেখকের মনঃপূত হয় না। লেখক জানেন সমস্যা কেবল গ্রাম-শহর বা হিন্দু-মুসলিম নয়, ব্যাধি আরও গভীরে। ফলে লেখক আমাদের অপেক্ষা করিয়ে রাখেন। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার দিকে কাহিনিকে ঠেলে দিয়ে সরলরৈখিক দায় সারেন না লেখক। তিনি অনুসন্ধান করতে থাকেন, কেন স্বাধীন হওয়ার পরপরই দেশের মানুষ আস্থাশূন্য রাজনীতি, লুটপাট, ধর্ষণ, ছিনতাই, সন্ত্রাসের জাঁতাকলে পড়ে ছটফট করতে থাকে ? সমস্যা কি আরও গভীরে নয় ? সেই গভীর অনুসন্ধানই প্রতিমা উপাখ্যানকে অসাধারণ একটি উপন্যাসে পরিণত করে। আমরা এবার এখানে উপন্যাসটিকে একটু ভেঙেচুরে দেখবার চেষ্টা চালাব।

বড় সাদামাটা বৈচিত্র্যহীন আমাদের গ্রামখানি―

প্রতিমা উপাখ্যান-এর কাহিনিটিকে এখানেই রাখতে চান লেখক। সুন্দরী প্রতিমাকে নায়িকা করে গল্প লেখার কথা বহুদিন ধরে ভেবেছেন কিন্তু সাহস পাননি। কেন ? না তিনি আরেকটি ইচ্ছে-পূরণের গল্প বা তাৎপর্যহীন গল্প লিখতে চাননি। পাহাড় নেই, বন নেই, নেই নির্জন নদীতট। আছে ছেঁড়াখোঁড়া জমির ফসল, কাদামাটি, পোকামাকড়, ঝিলের মাছ, শাপলা, প্রকৃতির সোঁদা-পচা গন্ধ―এই পটভূমিতে কীভাবে একটা গভীর জটিল প্রেমের গল্প লেখা যায় ভেবে লেখক আশা ছেড়ে দিয়েছেন, আর যেন সেই ফাঁকে একটা জটিল গল্পরচনার দায়িত্ব হাতে তুলে নেয় পুরো একটা গ্রাম-সমাজ। প্রশ্ন হলো কীভাবে তথাকথিত সাদামাটা গ্রামের সাদাসিধা মানুষগুলি এমন একটা জোরালো দায়িত্ব নিতে পারে ? আসলে লেখকের প্রথম সিদ্ধান্ত ছিল এতদিন ধরে চলে আসা একটা ওপর-ওপর ধারণা, যে-অগভীর চলতি দৃষ্টিতে আমরা গ্রামসমাজকে দেখি, সেই ধারণাকে ভেঙে দেওয়া। যেন এ এক নতুন করে গ্রামকে দেখার সুযোগ তৈরি হওয়া লেখকের সামনে। হয়তো যে-গল্প তৈরি হওয়ার কথাই নয়, সেই গল্প হয়ে উঠছে অর্থাৎ নির্মিত হচ্ছে, দূর থেকে মনে হওয়া মূর্খ সাদাসিধা মানুষগুলির সাহায্যেই। একজন নারী, যার সৌন্দর্য এই গ্রামদেশে বিরল, সেই সৌন্দর্য সহ্য করতে না-পারার চাপা টেনশন যেন একটা স্ফুলিঙ্গের অপেক্ষায় ছিল―আর সেই ঘটনাটি হলো, প্রতিমার বাড়ির ঘনিষ্ঠ, প্রতিমার দাদা রণজিতের বন্ধু শিক্ষক আহমদের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়া।

ঠিক এই সময় থেকেই ‘কানকথা’টি ধোঁয়া ছড়িয়ে চারপাশ আচ্ছন্ন করে তোলে। গ্রাম-জীবনের অবদমিত বাসনাগুলি এই সুযোগ হাতছাড়া করে না, যেন এইভাবে একটা কৃত্রিম ঢেউ উঠে তাদের জীবনকে গতি এনে দেয়! কাদের জীবনে ? স্কুল-মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক, বাজারের ব্যাপারি-দোকানদার, চাষি, এমনকি দরিদ্র ক্ষেতমজুর, যারা গল্পটিকে নির্মাণের দায়িত্ব নিয়ে ফেলেছে হয়তো তাদের অজান্তেই। কেননা সচেতন দায়িত্ব গ্রহণের ক্ষমতা তাদের নেই। কিন্তু সাদাসিধা একটা সমাজ কীভাবেই-বা একটা সাধারণ প্রেমকথাকে এত জটিল রূপ দেবে ? তাহলে কি গ্রামসমাজ সম্পর্কে এতদিন ধরে চলে আসা আমাদের ধারণায় ফাঁক আছে বিস্তর ?

এখানেই লেখকের কৃতিত্ব! লেখক যেন ধীরে ধীরে আমাদের সঙ্গে নিয়ে গ্রামের আলপথ দিয়ে ঘটনাস্থলে প্রবেশ করছেন এবং ক্রমেই আমাদের নিয়ে যাচ্ছেন গ্রামের প্রকৃত রূপটির কাছে আর অতি জটিল নানা টানাপোড়েনের নানা সম্পর্কের ভেতর দিয়ে নিয়ে গিয়ে প্রতিমা নয়, খুলেমেলে দেখিয়ে দেন গ্রাম-প্রতিমাকেই।

বদরু যদি তার প্রেমপত্র দিতে পারত কিংবা একা পেয়ে প্রতিমাকে পাটখেতে টেনে নিয়ে যেতে পারত তাহলে আর এতদূর ক্ষত দেখানোর সুযোগই পেতেন না লেখক। আশ্চর্যের বিষয় হলো, মুসলিম যুবক আহমদ ও বামুনের মেয়ে প্রতিমাকে নিয়ে প্রেমের উপাখ্যান লেখারও সুযোগ গ্রহণ করেননি লেখক। তিনি শুরু করেছেন আহমদ গ্রাম ত্যাগ করে যাওয়ার পর থেকে এবং উপন্যাস শেষে আহমদ ফিরে এসেছেন তখনই যখন প্রতিমারা বাস্তুভিটা ছেড়ে ইন্ডিয়ায় চলে গেছে। এমনকি খুবই ইঙ্গিতপূর্ণ যে, আহমদকে লিখে যাওয়া প্রতিমার চিঠিখানাও শেষে পাওয়া গেল না। প্রেমের উপাখ্যানের যাবতীয় সুযোগ পরিত্যাগ করে লেখক কী লিখলেন তবে ? একটি নারীকে কেন্দ্রে রেখে একটা আপাত সরল সাদাসিধা গ্রামকে! তার সম্পর্কের রূপরীতি, তার রাজনীতি, তার অবদমিত বাসনা ঈর্ষা লোভ, গুপ্ত থাকা সাম্প্রদায়িক চেতনা সব মিলিয়ে একটা আবিষ্কার, যা বদলে দেয় গ্রাম সম্পর্কে আমাদের ওপর ওপর ধারণাকে।

প্রতিমার রূপ আমি দেখিয়াছি :

কলেজের নোংরা পায়খানার দেওয়ালে লেখা এই বাক্যটির ‘রূপ’ শব্দ কেটে কেউ ‘দুধ’ বসিয়ে দিয়েছে। কিন্তু কলেজের ছেলেদের এটুকুতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে, এর বেশি এগোবার সুযোগ হয়নি। আড়াল থেকে তার রূপ দেখে চক্ষু সার্থক করা ও ভেতরে ভেতরে তাকে সম্ভোগের প্রবল ইচ্ছা ভোলারহাটের শিক্ষিত অশিক্ষিত যুবকদের ক্ষমতা ছিল এতটাই। এখান থেকে লেখক মুসলিম শিক্ষিত যুবক আহমদ ও প্রতিমার প্রেম নিয়ে একটি একরৈখিক উপন্যাস লিখতে পারতেন। কিন্তু লেখক সে-সহজ পথ মাড়াননি। লেখকের কৃতিত্ব এখানেই যে, তিনি এই কাহিনিতে প্রতিমা-আহমদের সম্পর্ক বোনার জন্য তাদের চোখের আড়ালে বা অন্ধকারে নিয়ে যাননি, এমন একটা মুহূর্তও তৈরি করেননি বা একটি সংলাপও, যা সহজ পাঠককে একটি লঘু প্রেমোপাখ্যান পড়ার আহবান জানাবে। এই উপন্যাসে দুটি আবেগঘন মুহূর্ত তৈরি হয়েছে প্রতিমা যখন তার দাদার কাছে কেঁদে ফেলে গ্রাম ত্যাগ করতে চায় এবং গ্রামে ফিরে এসে প্রতিমাদের ভিটার দিকে তাকিয়ে আহমদ যখন চোখে জল নিয়ে বলে, ‘আমি তো ওদের অমঙ্গল চাইনি। তবু ওরা দেশ ছেড়ে চলে গেল কেন বোচা’ ?

প্রতিমা গর্ভবতী হওয়ার পর―

আহমদ একটা বেদনা ও লজ্জা থেকে মুক্তি পেয়েছে, মুক্ত হয়েছে নির্দোষ চিলটাও। প্রতিমার অবৈধ গর্ভ ও আহমদের গোপন প্রেম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে গ্রাম্য কানাকানিতে, সেখানে মিশেছে ‘সাদাসিধা’ গ্রামের মানুষের ঈর্ষা, অবদমিত বাসনা ও ক্ষোভ। ক্ষোভ কীসের ? নানাবিধ। এই তরঙ্গহীন গ্রাম্যজীবনে অপ্রয়োজনীয় প্রতিমার রূপ, মুসলিম সমাজের মাঝখানে বিচ্ছিন্ন এক কুলীন পরিবার―যারা এখনও ইন্ডিয়ায় চলে যায়নি, প্রতিমার দাদা রণজিতের পলিটিক্স। সব মিলিয়ে তুলনায় সচ্ছল অবিনাশ চক্রবর্তীর পরিবার ও তার সম্পত্তি প্রতিবেশীদের চক্ষুশূল হয়ে উঠতে পারে। এবং লোভ―একটা কুৎসাই হয়তো তাদের দেশত্যাগে বাধ্য করতে পারে, যা সাম্প্রদায়িক ভীতিও পারেনি। ফলে প্রতিমাকে গর্ভবতী হতেই হতো! লেখক নিজেই যখন প্রমাণ পেলেন, প্রতিমা গর্ভবতী নয়, তখনই একটা রহস্যের উন্মোচন হয় যে, রহস্যটা প্রতিমাকে নিয়ে নয়, বরং গ্রাম্যসমাজের গুপ্ত থাকা সেই পলিটিক্স, যা ওপর থেকে চোখ এড়িয়ে যায়। লেখক তাই অনেক বেশি আলো ফেলেছেন সবুজ জমির ফসল ও কাদামাটি, নোংরা দুর্গন্ধযুক্ত নদীতীরের পাশে বসবাস করা ভোলারহাটের মানুষগুলির ওপর।

আর বাস্তবতা না বুঝলে আপনারা লিখবেন কী ?

রণজিৎ বানোয়াট গল্প-উপন্যাস পড়ে না, হয়তো সে কোনও গল্প-উপন্যাসই পড়ে না। চা দোকানের আড্ডায় সাহিত্য সম্পর্কে এর চেয়ে বেশি গভীর সাহিত্যবিষয়ক মন্তব্য অবিশ্বাস্য মনে হতো। কিন্তু বক্তব্যটি ইঙ্গিতবহ। রণজিৎ বাস্তবতার যে নিদান দেয়, তা গুরুত্বপূর্ণ। দেশের বাস্তব চেহারা দেখতে চাইলে কামলা-কিষানের দারিদ্র্য, তাদের সমস্যা এবং তার কারণকে অনুসন্ধান করতে হবে। কৃষক ক্ষেতমজুরদের সঙ্গে আলাপ করতে হবে। একজন রাজনৈতিক নেতার কাছে এটাই বাস্তব এবং সাধারণ পাঠকের একটা ধারণা হলো, সাহিত্য এ-সবের ধার মাড়ায় না। চলতি গল্প কাহিনি গ্রাম বলতে যে-সুন্দর রোমান্টিক গ্রাম্যদৃশ্যের অবতারণা করে, জনপ্রিয় সিনেমায় যে হলুদ সরষেক্ষেতের দৃশ্য, নদীতে জলকেলির দৃশ্য এবং গ্রাম্য নারীর যে শরমে রাঙা মুখের ছবি তুলে ধরে―প্রকৃত গ্রামবাংলা কি তা-ই ?

ফলে রণজিতের হালকা চালে করা অভিযোগটি খুবই গুরুতর তাত্ত্বিক প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায় উপন্যাস-বিচারের ক্ষেত্রে। নিশ্চয়ই নাগরিক দৃষ্টিভঙ্গিতে অর্থাৎ শহুরে সাহিত্যিকের চোখে যে আবছা অবাস্তব গ্রামের ছবি ফুটে ওঠে অধিকাংশ সময়, সেটাকে ঘুরপথে আক্রমণ করে এই লেখক একটা বাস্তব গ্রামজীবনকে তার আঁতিপাঁতি সমেত তুলে ধরতে চেয়েছেন! উপন্যাসটি পড়তে পড়তে পাঠক তা টের পান।

এ দ্যাশের কপালে ঝাঁটা মারি ইন্ডিয়া চলি যাব হামরা :

উপন্যাসটি ধীরে ধীরে এভাবে জটিল হতে থাকে, পরতের পর পরত খুলতে থাকে। দেশভাগের পর অনেকগুলো বছর অবিনাশ চক্রবর্তীরা এ দেশে কাটিয়ে ফেলেছেন। যারা পেরেছে, যাদের সঙ্গতি ছিল, সামান্য সুযোগ ছিল, একটা কোনও ছিদ্র… তারাই দলে দলে দেশত্যাগ করে চলে গেছে ইন্ডিয়ায়। যারা পারেনি, যারা কোনও সুযোগ তৈরি করতে পারেনি, কিংবা উচিত মূল্যে সম্পত্তি বিক্রির একটা ব্যবস্থা করতে পারেনি, তারা থেকে গেছে। কিন্তু এ দেশকে কি তারা ভালোবাসতে পেরেছে ? অবিনাশ বাবু, তাঁর স্ত্রীর মতো ঘোর সংসারী মানুষেরা কোনওমতে দিনযাপন করে আর মনে করে এটা মুসলমানদের দেশ, যেখানে জাতধর্ম নিয়ে থাকা যায় না। এই উপন্যাসটি পড়ার আগেই চিন্তাবিদ বদরুদ্দীন উমরের সাক্ষাৎকার নেওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার। তিনি বলছিলেন, মুসলমানদের আক্রমণের শিকার হয়ে হিন্দুরা যত না দেশত্যাগ করেছে তার চেয়ে বেশি করেছে, মুসলমানদের দেশে হিন্দুরা থাকতে পারে না এই মনোভাব নিয়ে। কথাটি অনেকখানি সত্যতা নিয়ে হাজির হয় মঞ্জু সরকারের এই উপন্যাসে। একটা গ্রামে হিন্দু-মুসলমান মিলেমিশে থাকার ভান করে কিন্তু ভিতরে ধিকিধিকি জেগে থাকে একটা বিদ্বেষ। বিদ্বেষের চেয়ে বড় হলো, উচ্চবর্ণ হিন্দুর সেই চিরাচরিত অবজ্ঞা, যে-অবজ্ঞা উনিশ শতক থেকে বাস্তব হয়ে উঠেছে।

অথচ অন্যরকম কি ঘটতে পারত না ? অশিক্ষা কুশিক্ষায় ভরা গ্রামের মধ্যে তুলনায় শিক্ষিত সচ্ছল পরিবার তো রণজিৎরাই। তার ওপর রণজিৎ কমিউনিস্ট, ক্ষেতমজুরদের নিয়ে সে আন্দোলন করে, দেশের অপশাসনের বিরুদ্ধে সে আন্দোলন করতে চায়, ভূমিহীনদের দুরবস্থা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে, এই দেশ স্বাধীন করার জন্য সে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে, সেই রণজিতের পরিবার যদি সাম্প্রদায়িক চেতনার বাইরে না বেরোতে পারে, তাহলে সারা বাংলাদেশের অশিক্ষিত হিন্দুদের কাছে অ-ধর্মীয় চেতনা প্রত্যাশা করা কি সোনার পাথরবাটি ? নিরুপায় হয়ে এ দেশে থাকতে হলে যে চুপচাপ সবকিছু মেনে নিয়ে কোনওরকমে দিনযাপন করতে হবে, পালোয়ানি করা যাবে না―এই মনোভাব আসলে একটা সংকটকাল ও ভালোবাসাহীন সম্পর্কের নিদারুণ ছবি তুলে ধরে।

বোচা এক সাব-অলটার্ন দৃষ্টিকোণ―

সাম্প্রদায়িকতার কথা উঠলেই আমাদের চোখে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িকতা বা দাঙ্গার ছবি ভেসে ওঠে কিন্তু নিম্নবর্ণ হিন্দু বোচা যখন আইল ধরে হাঁটতে হাঁটতে প্রার্থনা করে, বৃষ্টি না হোক, খরায় জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাক ফসলের মাঠ, গেলবারের মতো মস্ত বন্যা এসে ভাসিয়ে দিক পৃথিবী, তাহলে ক্ষুধার কষ্ট নিয়ে নিজেকে তার এত অসহায় মনে হবে না―তার এই চাওয়ার মধ্যে কোন সাম্প্রদায়িকতা কাজ করে ? কেন অবিনাশ চক্রবর্তীর দেশত্যাগে মুসলমান হয়েও দরিদ্র জমসেদের খুশি হওয়ার কিছু থাকে না ? তবে বোচা জমসেদ মিলে কি আরেকটা সম্প্রদায় নয় ? আইল ধরে হাঁটতে হাঁটতে বোচার মনে যে ভাবনা আসে, তা এই উপন্যাসকে আরেকটা নতুন খাতে এনে ফেলে। সে তখন আর কেবল অবিনাশ চক্রবর্তীর পারিবারিক চাকর হয়ে থাকে না, একটা শ্রেণির প্রতিনিধি হিসেবে হাজির হয় এবং প্রতিমা উপাখ্যান এক গুরুতর প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে পড়ে।

রণজিৎ যাদের নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলে সেও কি পেরেছে তাদের মনকে বুঝতে ? যে-দোষ সে লেখকদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চায়, রাজনীতি-সচেতন রণজিৎও কি সেই দোষে দুষ্ট হয়ে পড়ে না ? ভোলারহাটের জনসভায় শহর থেকে আসা তার দলের নেতাদের চেয়েও রণজিতের ভাষণ বেশি হাততালি পেতে পারে অথচ তার পরিবারেরই প্রায় অংশ হয়ে যাওয়া বোচাকে বুঝতে সে ব্যর্থ হয়েছে তা প্রমাণ হয়ে যায় যখন দেখি বোচা উচ্চবর্ণ হিন্দু অবিনাশের অমঙ্গল কামনা করে। মুসলিম শাসিত দেশের মুসলিম অধ্যুষিত গ্রামে বাস করেও সে কখনও হিন্দুর সঙ্গে একাত্ম হতে পারে না। তার কারণ নয় কি তার মধ্যে জেগে থাকা নিম্নবর্গীয় চেতনা, যা তাকে যুগ যুগ ধরে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের দ্বারা শোষিত মানুষের প্রতিনিধি করে তোলে ?

বোচা কেন অসহায় মনে করে নিজেকে ? কেন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এই সমাজ থেকে ? তার ক্ষুধা তাকে দিয়ে এমনই ভাবিয়ে নেয় যে, পুরো জগৎ সংসার যেন তাকে অনাহারে মারবার জন্য চক্রান্ত করেছে!

ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাকে দায়ী করা হতে পারে―

মুসলিমপ্রধান গ্রামে বামুনবাড়ির মেয়ে প্রতিমাকে নিয়ে যে সংকট ঘনিয়ে আসে কিংবা স্বাধীন বাংলাদেশে অবিনাশ চক্রবর্তীদের যে অশুভ পরিণতির সম্ভাবনা তৈরি হয় তার জন্য ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাকে দোষ দেওয়াই স্বাভাবিক। এমনকি ইন্ডিয়ায় তাদের যে আত্মীয় পরিজনেরা আছে, যারা চায়ও না অবিনাশরা সেখানে চলে যাক, তারাই কিন্তু দূর থেকে যে কোনও দুর্ঘটনার জন্য মুসলমান সমাজকেই দোষ দেবে। কিন্তু তলিয়ে দেখার দায়িত্ব তো লেখকেরই। লেখককেই সমস্যার গভীরে গিয়ে দেখতে হবে প্রতিমাকে নিয়ে ঘনিয়ে ওঠা সমস্যার কতখানি সাম্প্রদায়িক! সাম্প্রতিক ইতিহাসচর্চা থেকে জানা যাচ্ছে যে, একাধিক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনায় ধর্মীয় বিদ্বেষের চেয়ে বেশি দায়ী ছিল অর্থনৈতিক বাস্তবতা। কোনও ব্যক্তির অর্থনৈতিক উন্নতি যে ঈর্ষার জন্ম দেয়, তাকে চরিতার্থ করার জন্যই অনেক ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক রূপ দেওয়া হয় সুচতুর ভাবে। এখানেও রণজিৎদের পরিবারের ওপর যে-মানসিক চাপ নামিয়ে আনা হলো, তার প্রকৃত কারণ ধর্মের মধ্যে পাওয়া যাবে না, যতখানি সম্পত্তি লুটপাটের মানসিকতার মধ্যে পাওয়া সম্ভব। উপন্যাসের শেষে আমরা এরকমই একটা জায়গায় এসে পৌঁছাই, হয়তো প্রতিমাকে নিয়ে তৈরি হওয়া কানকথারও পরিসমাপ্তি ঘটবে এখানেই―কেননা হাজি ও সামাদের শর্ত মেনে নিয়ে তাদের কাছে সম্পত্তি বেচে দিয়ে রণজিৎরা ইন্ডিয়ায় চলে যায়। কেন হাজির কাছে পরাজয় স্বীকার করে রণজিৎ ? পারিবারিক শত্রু, সাম্প্রদায়িক শত্রু, দেশের শত্রু, স্বাধীনতার শত্রু, শ্রেণিশত্রু হাজি! তবে কি কিশোর বেলার সেই শুদ্ধ দেশপ্রেমের অবশিষ্ট নেই এই রণজিতের মধ্যে ? তবে এতটাই কি ভঙ্গুর ছিল তার সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস ?

সমাজতন্ত্রের দিকে এগোতে চায় কোন রণজিৎ ?

প্রতিমাকে ক্রমেই আবছা করে দিতে দিতে এই উপন্যাসে প্রকট হয়ে ওঠে রণজিৎ চরিত্রটি। এবং উপন্যাসের প্রকৃতিকে আরো ঘোরালো ও ঘোলাটে করে তুলতে থাকে। কেননা তার চরিত্রের দুর্বলতার সূত্রেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকে বোচার বউ ললিতা। ললিতা বৌদির সঙ্গে তার দৈহিক সম্পর্ক উপন্যাসটিকে অন্য দিশা দেয়। মুক্তিযোদ্ধা রণজিৎ, কমিউনিস্ট রণজিৎ, ক্ষেতমজুরদের নিয়ে আন্দোলন করা রণজিৎ―যে আহমদের প্রেমকে উড়িয়ে দিয়েছে, আহমদ-প্রতিমার একটা স্বাভাবিক প্রেমকে মেনে নিতে পারে না, তার চারিত্রিক স্খলন কি আহমদের প্রেমকেই বড় করে তোলে না ? ললিতার সঙ্গে গোপন সম্পর্ক আসলে রণজিতের বানিয়ে তোলা আভিজাত্য উন্নাসিকতা এমনকি রাজনৈতিক যে কোনও অঙ্গীকারকে ফিকে করে দেয়। প্রমাণ হয়ে যায়, এই ন্যূনতম দায়ভার নেওয়ার যোগ্য নয় সে। ফলে যখন সে ললিতাকে ইন্ডিয়া থেকে ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দেয়, তাকে একজন আত্মবিশ্বাসহীন মানুষ বলে চিনে নিতে আমাদের অসুবিধা হয় না। এই মানুষ সমাজতন্ত্রের দিকে এগোবে ? কেমন ঠাট্টার মতো শোনায়―‘৭১ সালে যেমন বাবা-মাকে ইন্ডিয়ায় রেখে যুদ্ধ করার জন্য দেশে ফিরেছিলাম, এবারও তেমনি ফিরে আসব। মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তিকে ’৭১-এর পর আমরা ক্ষমা করেছিলাম, কিন্তু এবারে ওদের নির্মূল না করলে সমাজতন্ত্রের দিকে আমরা আগাইতে পারব না।’ সত্যিটা হলো, এই রণজিতের পক্ষে আর এগোনো সম্ভব নয়। কিছু বুলি কপচিয়ে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে জিতিয়ে ওয়ারেছকে চেয়ারম্যান হয়তো করা যায় কিন্তু দেশকে বিপদ থেকে উদ্ধার করার লড়াই করা যায় না, মৌলবাদকে উচ্ছেদ করার লড়াই করা যায় না, সর্বহারা বোচাদের হয়েও লড়াই করা যায় না। তাই তার ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি কেমন ঠাট্টার মতো শোনায়। সে যদি প্রকৃতই এই দেশকে ভালোবাসত, তবে কি তার গড়ে তোলা জনসমর্থনকে কাজে লাগিয়ে, সাহসের সঙ্গে সক্রিয় শত্রুদের মোকাবিলা করতে পারত না ? তার এই পরাজয়, এই পলায়নপরতাই তার এতদিনের লড়াইয়ের ইতিহাসকে ধুলোয় মিশিয়ে দেয় আর উপাখ্যানটিকে বিষাদাচ্ছন্ন করে তোলে। পাঠক সিদ্ধান্তে আসে, একটা সুন্দর প্রেমকে ধ্বংস করার মূলে এই রণজিৎই, যার কাছে প্রেমের মূল্য নেই, আছে কেবল দৈহিক ক্ষুধা। ললিতার সঙ্গে গোপন সম্পর্কই তার প্রমাণ। ফলে প্রতিমার প্রতি আহমদের ভালোবাসাকে তার পাগলামি মনে হওয়াই স্বাভাবিক।

সমাজসত্তার অনুসন্ধান ও একটি উপন্যাস

একজন লেখককে তাঁর সমকালকে স্বীকার করতেই হয়। তিনি যে সমাজবাস্তবতায় শ্বাস-প্রশ্বাস নেন, তার সত্তাকে, সত্তার ভেতরে থাকা ব্যাধিকে আবিষ্কার করতেই হয়। আধুনিক ঔপন্যাসিক সে দায় বহন করেন বলেই আধুনিক সাহিত্যের যতগুলি ধারা তার মধ্যে উপন্যাসই হয়ে পড়ে সবচেয়ে জটিল। একটা উপন্যাসই প্রকৃত প্রস্তাবে সমাজ-রাজনীতি সাংস্কৃতিক গতিপ্রকৃতিকে তার শিকড়সমেত হাজির করতে পারে। বাজারি বা জনপ্রিয় উপন্যাসগুলি নিশ্চয়ই সে-পথ মাড়ায় না, কেননা পাঠক তৈরি নয়। এখনও বাংলা ভাষার পাঠক একরৈখিক কোনও কাহিনিকেই উপন্যাস হিসেবে গ্রহণ করতে প্রস্তুত।

কিন্তু আশার কথা হলো ওয়ালীউল্লাহ বা আখতারুজ্জামান ইলিয়াস প্রভৃতি সাহিত্যিকের মতো মঞ্জু সরকারও সেই সহজ পথ মাড়াননি। মাড়াননি যে, তা তিনি সচেতনও। তাই রণজিৎকে দিয়ে বলিয়ে নেন, প্রেমের প্যানপ্যানানির চেয়ে স্বাধীনতার পর ভূমিহীনদের অবস্থার কী পরিবর্তন হয়েছে, কৃষক-শ্রমিকেরা কী হারে শহরে চলে যাচ্ছে তা জানা কত বেশি জরুরি। আসলে এই সব কথার মধ্যে দিয়ে লেখক সমাজবাস্তবতার একটা ভূমি প্রস্তুত করে নেন, যে-ভূমিতে একটি সুন্দর প্রেমের সম্পর্ক আবছা হতে হতে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।

প্রতিমা-আহমদের সম্পর্কের কানাকানি পেরিয়ে তাই বাস্তব হয়ে ওঠে রাজাকার- মুক্তিযোদ্ধার সম্পর্ক, হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক, আওয়ামী লীগ-কমিউনিস্ট সম্পর্ক, ব্রাহ্মণ-নিম্নবর্ণ সম্পর্ক। এর সঙ্গে হিন্দুদের দেশত্যাগ এবং তার সম্পত্তি কিনে নেওয়ার লোভ উপন্যাসটিকে আরও ঘোরালো করে তোলে।

এই উপন্যাসের আলোচনায় অত্যন্ত গুরুত্ব পাওয়া উচিত এর প্লটনির্মাণ। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে একের পর এক সমস্যাগুলিকে পাঠকের সামনে এনেছেন লেখক। যেন খেলা শুরুর আগে তাসগুলোকে শাফল করে নিয়েছেন, তারপর একেকটা করে পাঠকের সামনে হাজির করছেন। তবে সহজ বর্ণনাভঙ্গিই বেছে নিয়েছেন লেখক। ভাষা স্বাভাবিক গতি রক্ষা করেছে এবং গ্রাম্যজীবনকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছে। চরিত্রগুলি ততটাই নাটকীয়, যতখানি ধীরস্থির তরঙ্গহীন জীবনকে বাস্তব করে তুলতে লাগে। সংলাপে তাদের আঞ্চলিক চিহ্ন বর্তমান। মরা মানাস নদীর মতো প্রতিমা-আহমদ সম্পর্কও শেষে মরে গেল বোচার বেঁচে থাকার ঝাঁঝালো তেজে, হাজির ধূর্ত পলিটিক্স আর রণজিতের অবিমৃষ্যকারিতায়। তবু পাঠ শেষে একটা আক্ষেপ থেকে যায় পাঠকের মনে, প্রতিমা চরিত্রটিকে যদি আরেকটু স্থান দিতেন লেখক। একবার তার দাদার কাছে ভেঙে পড়ার মুহূর্তটি ছাড়া তাকে পাঠক খুঁজে পান না। তার মনের প্রকৃতিকে যদি আরেকটু আলোয় আনা যেত!

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button