আর্কাইভপ্রচ্ছদ রচনা

শামসুর রাহমানের পঙ্ক্তিমালায় স্বদেশের মুখ : বিশ্বজিৎ ঘোষ

প্রচ্ছদ রচনা : সৃজন-আলোয় কীর্তিমান পাঁচ সাহিত্যিক

ধুনিক বাংলা কবিতার তিন প্রধান নক্ষত্রের নাম, বোধকরি সব বাঙালি কবিতাবোদ্ধার কাছেই, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কাজী নজরুল ইসলাম। এই তিন নামের পর কোন্ নাম উচ্চারণ করব ? লেখাই বাহুল্য যে, পরবর্তী নাম হবে জীবনানন্দ দাশ। তারপর ? এবারেও অত সব চিন্তা না করে বলব জসীমউদ্দীনের নাম। কিন্তু তারপর ? অনেক নামের ভিড়েও, আমাদের চোখে ভেসে ওঠে উজ্জ্বল এক নাম―শামসুর রাহমান। এ কথা নিঃসন্দিগ্ধভাবে বলা যায়, বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের সবচেয়ে দীপ্র কবির নাম শামসুর রাহমান। আমাদের কালকে যাঁরা শব্দে ধারণ করেছেন, যাঁদের ছন্দোবদ্ধ শব্দগুচ্ছে বন্দি হয়ে আছে বাঙালির উত্থানের ইতিকথা―শামসুর রাহমান তাঁদের অন্যতম। তিরিশি বাংলা কবিতা পঞ্চাশে এসে যে নতুন চারিত্র্য অর্জন করল, তার শ্রেষ্ঠতম শিল্পী শামসুর রাহমান। অর্ধ-শতাব্দীরও অধিককাল ধরে তিনি হেঁটেছেন কবিতা-কক্ষপথে, নির্মাণ করেছেন নিজস্ব এক কবিতাভুবন।

চল্লিশের পাকিস্তান আন্দোলন পূর্ববাংলাকেন্দ্রিক বহু কবিকে উদ্বুদ্ধ করেছে―পাকিস্তান আন্দোলনের আন্তঃপ্রেরণায় তাঁরা রচনা করেছেন একের পর এক কবিতা। স্বপ্নভঙ্গের বেদনায়ও তাঁরা পীড়িত হননি―তাঁদের কবিতায় শিল্পিত হতে থাকল দ্বিজাতিতত্ত্বের ভ্রান্ত সমাজদর্শন। ফলে তাঁদের কবিতায় স্বদেশের রূপটা দেখা দিয়েছে বিকৃত ও সংকীর্ণ সত্তায়। আটচল্লিশে আরম্ভ হওয়া রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, যা উত্তুঙ্গ রূপ পরিগ্রহ করে বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতে, আমাদের সমাজ-সংস্কৃতির জগতে তোলে প্রবল অভিঘাত। পূর্ববাংলার সৃষ্টিশীল কবিচৈতন্য অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে শিল্প নির্মাণে আত্মনিমগ্ন হলেন―পূর্ববাংলার কবিতায় দেখা দিল নতুন রূপ, স্বদেশের মুখটা শিল্পিত হতে থাকল নতুন চেতনায়। এভাবে বিভাগ-পরবর্তীকালে পাকপদ্যের জঞ্জাল থেকে পূর্ববাংলার কবিতাকে যাঁরা উদ্ধার করেছিলেন, শামসুর রাহমান তাঁদের অগ্রগণ্য। কালকে তিনি ধারণ করলেন, তাঁর হাতে শিল্পরূপ পেল কালের গতিধারা―তিনি হয়ে উঠলেন কালের কবিতা-কথক। বস্তুত, শামসুর রাহমানের কবিতায় সংহত হয়ে আছে বাংলাদেশের সমাজ-ইতিহাসের অন্তর্গত ধারা, তাঁর কবিতায় শব্দবন্দি হয়ে আছে পঞ্চাশ-পরবর্তী অর্ধ-শতাব্দীরও অধিকালের বাংলাদেশের রূপ, বাঙালির অগ্রযাত্রা।

আমাদের সংস্কৃতির অন্তর্ভুবনে একুশের মতো প্রভাবসঞ্চারী কোনও অনুষঙ্গ নেই। একুশে বাঙালি কবিকে নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করেছে, কবিতার পঙ্ক্তিস্রোতে শিল্পিতা পেয়েছে একুশে-উত্তর ভিন্ন এক বাংলাদেশ। এ প্রসঙ্গে শামসুর রাহমানের কথা বিশেষভাবে আমাদের স্মরণে আসে। একুশেকে কেন্দ্র করে বাঙালির সাংস্কৃতিক জাগরণ শব্দরূপ পেল রাহমানের পঙ্ক্তিমালায়। স্মৃতিকথায় তিনি লিখেছেন : ‘অসুস্থতা আমাকে একুশে ফেব্রুয়ারির মিটিং ও মিছিলের সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত করেছে সত্য, কিন্তু কেড়ে নিতে পারেনি বাংলা ভাষার প্রতি আমার প্রবল ভালবাসাকে, কবিতার প্রতি অকুণ্ঠ নিবেদনকে। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস আমার কবিতা রচনায় একটি নতুন বাঁকের জন্ম দেয়’। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে কবি শামসুর রাহমান কবিতার মাধ্যমে গেঁথে দিয়েছেন বাঙালির গভীরতম প্রদেশে। বাংলা ভাষা আর বর্ণমালা কবির পঙ্ক্তিস্রোতে বাঙালির সত্তার সঙ্গী হয়ে শিল্পিতা পেয়েছে :

আজন্ম আমার সাথী তুমি,

আমাকে স্বপ্নের সেতু দিয়েছিলে গড়ে পলে পলে,

তাই তো ত্রিলোক আজ সুনন্দ জাহাজ হয়ে ভেড়ে

আমারই বন্দরে।

                     (‘বর্ণমালা আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’)

―বায়ান্ন-উত্তর কালে বাঙালির সব দ্রোহ আর সংগ্রামের মাঝেও কবি খুঁজে পান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অবিনাশী চেতনা। কবি তাই নিসর্গলোকের কৃষ্ণচূড়ায় দেখেন একুশের রক্ত, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের দীপ্ত রাজপথে কবি দেখেন বরকত-সালামের স্মৃতি-জ্বলজ্বল মুখ :

ক. আবার ফুটেছে দ্যাখো কৃষ্ণচূড়া থরেথরে শহরের পথে

কেমন নিবিড় হয়ে। কখনো মিছিলে কখনো-বা

একা হেঁটে যেতে যেতে মনে হয়―ফুল নয়,

ওরা শহীদের ঝলসিত রক্তের বুদ্বুদ, স্মৃতিগন্ধে ভরপুর।

একুশের কৃষ্ণচূড়া আমাদের চেতনারই রঙ।

                                                       (‘ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯’)

খ. বুঝি তাই উনিশশো ঊনসত্তরেও

আবার সালাম নামে রাজপথে, শূন্যে তোলে ফ্ল্যাগ,

বরকত বুক পাতে ঘাতকের থাবার সম্মুখে।

সালামের বুক আজ উন্মথিত মেঘনা,

সালামের মুখ আজ তরুণ শ্যামল পূর্ব বাংলা।

                                               (ফেব্রুয়ারি, ‘১৯৬৯’)

বাংলার মুখকে আঁকতে গিয়ে শামসুর রাহমান পৌনঃপুনিক বিচরণ করেছেন বাংলাদেশের দ্রোহী আর রক্তমুখী জাতীয় সত্তায়। বাংলার এই মুখটা সমবেত বাঙলির সমুত্থিত অস্তিত্বের স্মারক। তাই বায়ান্নর উন্মথিত জাগরণ ঊনসত্তরে আমাদের প্রাণের পতাকা করে তোলে আসাদের শার্টকে―শহিদ আসাদের শোণিতাক্ত শার্ট স্বাধিকারের পতাকা হয়ে ওড়ে বাঙালির চেতনায়। ইতিহাসের রক্তাক্ত বাঁককে অঙ্গীকার করে এবার কবি আঁকবেন বাঙালির চির-উজ্জ্বল যুদ্ধদিনের মুখ―রক্তে-বারুদে-পৌরুষে-পুরুষকারে যে মুখ হাজার বছরের বাঙালি কখনও দেখেনি। স্বদেশের রক্তমুখী মুখটা কবিকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রেরণা দেয়, নির্জনতাপ্রিয় রোমান্টিক কবিকেও করে তোলে স্বপ্নমুখী যুদ্ধমুখী :

যাকে ভালোবাসি সে যেন পুকুরের ঘাটে ঘড়া রোজ

নিঃশঙ্ক ভাসাতে পারে, যেন এই দুরন্ত ফিরোজ,

আমার সোদর, যেতে পারে হাটে হাওয়ায় হাওয়ায়,

বাজান টানতে পারে হুঁকো খুব নিশ্চিন্তে দাওয়ায়,

তাই মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও এঁদো গণ্ডগ্রামে

ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম কী-দুর্বার সশস্ত্র সংগ্রামে।

                                                  (‘গ্রামীণ’)

―এভাবে বিদ্রোহী বাংলা নির্জনতাবিলাসী এক কবিকে নিয়ে গেছে জনারণ্যে, তাঁর চেতনার আকাশে ‘বারবার ফিরে আসে রক্তাপ্লুত শার্ট’। কিন্তু স্বাধীনতার পর স্বদেশের সামূহিক বিপন্নতায় পুনশ্চ পীড়িত হতে থাকেন কবি―এবার স্বদেশের মুখটা মলিন হয়ে শিল্পিতা পায় তাঁর কবিতায়, বিলাপে মুখর হয় তাঁর দ্রোহী শব্দরাজি :

এ দেশের প্রতিটি গোলাপ আজ ভীষণ মলিন,

প্রতিটি সবুজ গাছ যেন অর্ধ-নমিত পতাকা,

আমাদের বর্ণমালা হয়ে গেছে শোকের অক্ষর,

আমাদের প্রতিটি শব্দ কবরের ঘাসের ভেতরে

হাওয়ার শীতল দীর্ঘশ্বাস;

আমার প্রতিটি চিত্রকল্প নিষ্প্রদীপ ঘর আর

আমার উপমাগুলি মৃতের মুঠোর শূন্যতায় ভরপুর,

আমার কবিতা আজ তুমুল বৃষ্টিতে অন্ধ পার্খির বিলাপ।

(‘অবিরল জলভ্রমি’)

স্বদেেেশর মৃত্তিকায় সংলগ্ন হয়ে হতাশাকে অতিক্রম করে কবি পৌঁছতে চেয়েছেন সদর্থক জীবনতটে। কিন্তু জাতিক-আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের শিকার বাংলাদেশ কবিকে কিছুতেই সুস্থির থাকতে দেয় না, তাঁর লেখায় ফুটে ওঠে স্বদেশের বিপন্ন মুখটাই : ‘শহরের আনাচে-কানাচে ফেরেশতার ভাঙা/ ডানা পড়ে থাকে; কত বিষণ্ন করোটি ফুটপাতে, ঝোপঝাড়ে/ কালোবাজারির বন্ধ গুদামের আশেপাশে লুটায় কেবলি’ (‘এই নবান্নে’)। তবু বুকের গভীরে আছে স্বদেশের জন্য কবির গভীরতম ভালোবাসা, আছে অন্তহীন মুগ্ধতা আর অতুল অনুরাগ, তাই শত ষড়যন্ত্র আর সহস্র মারি-মড়কের পরও স্বদেশের মুখটা তাঁর চোখে ধরা দেয় এমন প্রফুল্ল সত্তায় :

তোমার রূপের খ্যাতি পরাক্রান্ত প্রবাদের মতো

এখনও ছড়িয়ে আছে হাটে মাঠে ঘাটে; এখনও তোমার মুখ,

সর্ষে ক্ষেতের মতো মুখ,

সোনালী আঁশের মতো চুল

জেলের ডিঙ্গির মতো ভুরু,

মেঘনার মতো কালো টলটলে চোখ…

                                           (‘বহু কিছু থেকে ছুটি’)

শামসুর রাহমান বিশ্বাস করেন ‘সংকটে কবির সত্তা আরও বেশি চিন্তাশ্রয়ী হয়’ (‘সংকটে কবির সত্তা’)। তাই স্বদেশের নানামাত্রিক সংকট, ষড়যন্ত্রের ঘূর্ণিচক্র কবিকে আচ্ছন্ন করলেও করতে পারে না বিপন্ন―তিনি বরং আরও গভীরভাবে স্বদেশকে আঁকড়ে ধরে হতে চান সংকটবিজয়ী। নির্জনতাপ্রিয় কবি এবার জনতার স্রোতে একাত্ম হয়ে মুছে দিতে চান স্বদেশের সংকট, যারা বস্ত্রহরণ করে স্বদেশের মুখটা কালিমালিপ্ত করতে চায় তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান কবি : ‘যেদিন তোমার বস্ত্রহরণের পালা/শুরু হলো, তোমার চুলের মুঠি ধরে পৈশাচিক/ উল্লাসে উঠলো মেতে মদমত্ত বর্বরেরা, সেদিন যাদের/চোখ ক্রোধে রক্তজবা হয়ে উঠেছিল লহমায়,/তোমার গ্লানির কালি মুছে দিতে যারা/হলো শস্ত্রপাণি, আমি তাদের করেছি সমর্থন/ সমস্ত অস্তিত্ব দিয়ে’ (‘দেশদ্রোহী হতে ইচ্ছে করে’)। পৌরাণিক বস্ত্রহরণ পালার বিবরণ শেষে কবি যেন এখানে স্বদেশের মুক্তি হয়েই আত্মপ্রকাশ করেন।

স্বদেশের মুখ আঁকতে গিয়ে কবি শামসুর রাহমান পৌনঃপুনিক শিল্পিত করেছেন স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। পিতার বন্দিত্বে বিপন্ন বিধ্বস্ত স্বদেশটা টেলেমেকাস পুরাণ কাহিনিতে কবি শিল্পিত করেন এভাবে : ‘নয়কো নগণ্য দ্বীপ সুজলা সুফলা শস্যশ্যাম/ইথাকার আমার ধনধান্যে পুষ্পেভরা। পিতা, তুমি/যেদিন স্বদেশ ছেড়ে হলে পরবাসী, ভ্রাম্যমাণ,/ সেদিন থেকেই জানি ইথাকা নিষ্পত্র, যেন এক বিবর্ণ গোলাপ’ (‘টেলেমেকাস’)। পিতার মৃত্যুও অডিসিয়ুস পুরাণ স্মরণে কবি তুলে ধরেন অসামান্য ব্যঞ্জনায়, তুলে ধরেন পিতার মৃত্যু-অতিক্রমী অবিনাশী সত্তা; কবির শব্দগুচ্ছে ধরা পড়ে আলোক-উৎস হয়ে পিতার নিরন্তর জেগে থাকা :

এই তো তুমি

ওডিসিউসের মতো বেরিয়ে পড়েছো নব অভিযানে।

কসাইখানাকে ফুলের বাগান বানানো যার সাধনা,

তুমি সেই সাধনার অকম্পিত শিখা।

                                           (‘তোমারই পদধ্বনি’)

পিতার মৃত্যু আর কন্যার প্রতিশোধ বাসনা গ্রিক পুরাণের এক বহুশ্রুত গাথা। কবি সেই পুরাণগাথাকে পঁচাত্তর-পরবর্তী স্বদেশের স্বরূপ আঁকতে ব্যবহার করেন শিল্পিত স্বরগ্রামে। ‘ইলেক্ট্রার গান’ কবিতায় পুরাণ-ভাষ্যের আড়ালে স্বদেশের বিপন্ন মুখটা চিত্রিত করেন শামসুর রাহমান―এই ছবিতে অ্যাগামেমননের সঙ্গে সমীকৃত হয়ে যান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আর প্রতিশোধ বাসনায় আগ্নেয়-উৎসে রূপান্তরিত ইলেক্ট্রা হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু-আত্মজা শেখ হাসিনা। পুরাণ আর বাস্তবকে, গ্রিস আর বাংলাদেশেকে একসূত্রে গেঁথে তোলেন কবি, ফলে ইলেক্ট্রার আর্ত-হাহাকারে সমকালীন বাংলাদেশের কান্না শিল্পিতা পায় অসামান্য ব্যঞ্জনায় :

আড়ালে বিলাপ করি একা একা, ক্ষতার্ত পিতা

তোমার জন্যে প্রকাশ্যে শোক করাটাও অপরাধ।

এমন কি, হায়, আমার সকল স্বপ্নেও তুমি

নিষিদ্ধ আজ; তোমার দুহিতা একি গুরুভার বয়।

নিহত জনক, অ্যাগামেমনন, কবরে শায়িত আজ।

                                                            (‘ইলেক্ট্রার গান’)

মুক্তিযুদ্ধ আর স্বাধীনতার চেতনায় উদ্দীপ্ত কবি শামসুর রাহমানের অন্তর্গত প্রতিভা। ফলে কালিক বিপন্নতা তাঁকে স্পর্শ করে না; বরং ইতিহাসের বিশাল ডানায় ভর করে তিনি পাড়ি দেন সমকালের ধস-অর্ণব। ম্যাক্রো-সময়টাকে অঙ্গীকার করার ফলে তিরিশের কবিদের মতো তাঁকে খণ্ডতার আরাধনা করতে হয়নি। শামসুর রাহমানের এই ম্যাক্রো-সময়চেতনার কারণে তাঁর সৃষ্ট মানুষেরা হয়ে ওঠে সাহসী সৈনিক―মওলানা ভাসানী কিংবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের মতো শাণিত তরবারি :

আমি এমন এক তরুণের কথা জানতাম,

যে তার কবিতায় আলালের ঘরের দুলাল, মেনিমুখো শব্দাবলি ঝেড়ে ফেলে

অপেক্ষা করত সেদিনের জন্যে,

যেদিন তার কবিতা হবে মৌলানা ভাসানী

এবং শেখ মুজিবের সূর্যমুখী ভাষণের মতো।

(‘বাইবেলের কালো অক্ষরগুলো’)

―কেবল কোনও এক তরুণ কবিই নন, কবি নিজেও বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি থেকে আহরণ করেন অফুরন্ত শক্তি, অবিরল খুঁজে নেন দুরন্ত সাহস ‘শেখ মুজিবের উদ্যত তর্জনী থেকে’। মধ্য-আগস্টের ট্রাজেডি কবিকে নিয়ত যন্ত্রণা দেয়, ওই ট্রাজেডির বিষাদমলিন স্মৃতি পেরিয়ে তিনি পাড়ি দিতে চান যন্ত্রণার সাগর, বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি আর শরণে উচ্চারণ করেন কীভাবে ওই স্মৃতি কবিতা হয়ে ফোটে বিপন্ন বাংলায় :

এই লেখা উঠে এসেছে সেই সিঁড়ি থেকে,

যেখানে পড়েছিল ঘাতকের গুলিবিদ্ধ তোমার লাশ,

এই লেখা উঠে এসেছে তোমার বুক জোড়া রক্তাক্ত গোলাপ থেকে

বুলেটের ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া নব পরিণীতার

মেহেদি-রাঙা হাত এবং

শিশুর নেকড়ে খোবলানো শরীর থেকে।

                                         (‘তোমারই পদধ্বনি’)

শামসুর রাহমান স্বদেশের যে মুখ তাঁর কবিতায় পৌনঃপুনিক অঙ্কন করেছেন, তা মূলত বিদ্রোহী-বাংলার মুখ। বাঙালির দ্রোহ-চেতনাটাই তাঁকে দিয়ে নিরন্তর কবিতা লিখিয়ে নেয়―এমনই ভাবনা কবির নিজের। তাই যেখানেই আছে দ্রোহ-প্রতিবাদ ক্ষোভ আর যুদ্ধ―সেখানেই মুখর রাহমানের পঙ্ক্তিমালা। এমনি এক দ্রোহী মুখ দেখা দিয়েছিল বাংলার পটে নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে―নূর হোসেনের অবয়বে সেদিন বাংলার মুখটা দ্রোহে হয়ে উঠেছিল স্বদেশের হৃদয় :

উদোম শরীরে নেমে আসে রাজপথে, বুকে-পিঠে

রৌদ্রের অক্ষরে লেখা অনন্য শ্লোগান,

বীরের মুদ্রায় হাঁটে মিছিলের পুরোভাগে এবং হঠাৎ

শহরে টহলদার ঝাঁক ঝাঁক বন্দুকের সীসা

নূর হোসেনের বুক নয় বাংলাদেশের হৃদয়

ফুটো করে দেয়; বাংলাদেশ

বনপোড়া হরিণীর মতো আর্তনাদ করে, তার

বুক থেকে অবিরল রক্ত ঝরতে থাকে, ঝরতে থাকে।

(‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’)

―এভাবে বাংলাদেশ যখন রক্তাক্ত হতে থাকে স্বৈরাচারের ছোবলে, তখন সংক্ষোভে বাক্সময় হয়ে ওঠে রাহমানের কবিতা। তাই নূর হোসেনের রক্তাক্ত বুক হয়ে ওঠে রক্তাক্ত বাংলাদেশ―‘নিকট-সমকাল নিয়ে কবিতা লিখলেও সাংবাদিক-দিনলিপিতেই তাকে অস্ত যেতে দেন না শামসুর রাহমান। তাই তার কবিতায় আমরা আজকের নূর হোসেনের চালচিত্রে কোন গ্রিক বীরের দীপ্ত পদধ্বনি শুনতে পাই।’ একসময় তাঁর কবিতায় রক্তচক্ষু কোকিল এবং স্বয়ং কবি রূপান্তরিত হন অভিন্ন দ্রোহী সত্তায়―কোকিল আর কবি তখন অভিন্ন সুরে ঐকাত্ম্য গলায় গায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার গান : ‘রক্তচক্ষু কোকিল বলবে নির্দ্বিধায়,/ লোকটা আমারই মতো গলায় রক্ত তুলে গান গায়’ (‘আত্মা ছুঁয়ে দিই’)। এভাবে কোকিলের সঙ্গে গণতন্ত্রকামী কবি যে গানের সুর তোলেন, সেই সুরে সমবেত ঐকতান সৃষ্টি করতে গিয়ে জেনে-বুঝেই কবিকে দাঁড়াতে হয় ‘কবিতার নন্দনতত্ত্বের গলায় পা রেখে’।

স্বদেশের একটা ইতিবাচক সদর্থক মুখ অঙ্কন কবি শামসুর রাহমানের কবি-প্রতিভার অন্তর্গত বৈশিষ্ট্য। তিনি বিশ্বাস করেন তাঁর প্রিয় দেশ-মাতৃকার মুখটা থাকবে বাসন্তী গোলাপের মতো সদা প্রফুল্ল। তাই দেশকে নতুন করে সাজাবার বাসনায় মুখর হয়ে ওঠে তাঁর কবিতা :

কোটি কোটি চোখ

নতুনের স্বপ্নে খুব ডাগর উৎসব। আগামীর

নামে রঙ বেরঙের প্রজাপতি উড়ুক বাগানে,

কোকিল করুক আজ বসন্তের বিশদ আবাদ।

ফের সাজাবো বাগান অপরূপ,…

                                         (‘বাগানের গান’)

২.

শামসুর রাহমানের কবিতায় স্বদেশের নৈসর্গিক বিমুগ্ধ মুখটাও পৌনঃপুনিক শিল্পিতা পেয়েছে। তাঁর আয়ত প্রসারিত চোখে দেশটা কেবলি অপরূপ হয়ে ধরা দিয়েছে। নিসর্গকে তিনি অঙ্গীকার করেছেন নিবিড় অন্তরঙ্গতায়, শৈশব থেকেই প্রকৃতির লাবণ্যে মুগ্ধ কবি―তাই তিনি লেখেন এই নিসর্গ-বন্দনা : ‘মন আমার দিনরাত্রি, বলা যেতে পারে, প্রকৃতির অন্তরঙ্গতায় ছিল ভরপুর। বাড়ির চৌহদ্দিতেই ঘুরে বেড়ানোর মতো যথেষ্ট জায়গা। কত সময় কাটিয়ে দিয়েছি লিচু গাছের ডালে বসে, নেবুতলায় শুয়ে রসালো নেবু পেড়ে এক গাছ থেকে আরেক গাছের দিকে আস্তে-সুস্থে হেঁটে যেতে যেতে, কখনও কখনও প্রজাপতিদের উড়াউড়ি দেখে মুগ্ধ হয়েছি।’ নিসর্গসান্নিধ্যে কবির এই মুগ্ধতাই তাঁর পঙ্ক্তিস্রোতে রূপ নেয় এভাবে :

বনতুলসীর গন্ধ, হঠাৎ হাঁসের চই চই শব্দ আর

ধানের সবুজ ক্ষেতে ধ্যানী সাদা বক, দোয়েলের শিস, ফিঙে

পাখিটির নাচ, কুটিরের ধোঁয়া, আর মফস্বলী স্টেশনের রাত,

চিলেকোঠা আমাকে ফিরিয়ে দেয় আমার শৈশব।

(‘যৌবনোত্তর বিলাপ’)

শামসুর রাহমান নাগরিক কবি হিসেবেই সমধিক পরিচিত। তাঁর কবিতায় শহর, বিশেষত ঢাকা শহর, নানা রূপে বহুমাত্রিক পরিচয়ে শিল্পিত হয়েছে। এই নাগরিক কবিও কিন্তু মর্মে-মর্মে বাংলার গ্রামীণ উত্তরাধিকারের সঙ্গে বিজড়িত―শহর আর গ্রামীণ বাস্তবতাতেই কবি শনাক্ত করেন নিজেকে। শাহরিক বাস্তবতায় বাস করলেও তিনি বিস্মৃত নন গ্রামীণ উত্তরাধিকার। তাই ‘আমার অন্তর জুড়ে শহুরে-গ্রামীণ সুরধারা’ কবিতায় তিনি উচ্চারণ করেন সত্তার দ্বৈত-উৎস : ‘শেষরাতে ঘুম ভেঙে গেলে দেখি চাঁদ/ হাসছে কৌতুকে এই শহুরে লোককে দেখে, যার/ সমস্ত শরীর ফুঁড়ে কি সহজে বেরুচ্ছে গ্রামীণ রূপ/ আমার অন্তর জুড়ে শহুরে গ্রামীণ সুরধারা।’ নিসর্গের এই অপরূপ উৎস চাঁদও একসময় রাহমানের কবিতায় স্বদেশের বিপন্নতায় হিংসুটে দানব দ্বারা গ্রাসিত হয়, স্বদেশে নেমে আসে গভীর অন্ধকার :

প্রবীণ আঁধারে

হঠাৎ উদিত হ’ল চাঁদ

ঠোকরে ঠোকরে তাকে কাচের পাত্রের মতো গুঁড়ো

করে ফেলে হিংসুটে দানব এক, মানবগন্ধী অন্ধকার নেমে

আসে ত্রিভুবনে…।

                        (‘এ কেমন কৃষ্ণপক্ষ’)

স্বদেশজুড়ে অন্ধকারের এই উল্লাস দূর করতে চান কবি―আর সেজন্য কোনও ধাতব অস্ত্রের প্রয়োজনীয়তা তিনি উপলব্ধি করেননি। কেননা তাঁর কাছে আছে নিসর্গ-উৎস থেকে প্রস্তুত অবারিত আয়ুধ। শামসুর রাহমান অস্ত্রের হুংকার শুনতে চান না―তিনি বরং নির্বিরোধী চেতনায় ঘোষণা করেন তাঁর এই রণকৌশল, যেখানে প্রকৃতিই হয়ে ওঠে তাঁর শ্রেষ্ঠ অস্ত্র : ‘আমার লড়াইয়ের রীতি/ নদীর ফেরীর মতো; ফুল আর সুরের মতো/ পবিত্র’ (‘অস্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই’)। ফুলের পবিত্রতা দিয়ে তিনি যেমন যুদ্ধ করতে চেয়েছেন, তেমনি স্বদেশকেও তিনি কল্পনা করেছেন ফুল্ল প্রতিমায় :

তোমার সৌন্দর্যে, হে স্বদেশ, আকৈশোর মুগ্ধ আমি

অনিন্দ্য ফুলের মতো তোমার এ মুখ

উন্মীলিত, যেখানেই যাই

তোমার মুখশ্রী সঙ্গী আমার এবং

দেশ দেশান্তরে ভ্রমণের ঘোর কেটে গেলে

তোমার রূপের টানে ফিরে আসি তোমার কাছেই।

(‘কারো একলার নয়’)

স্বদেশকে কবি মায়ের মতোই ভালোবাসেন―স্বদেশের মুখেই তিনি দেখেন মায়ের মুখ, কিংবা মায়ের মুখশ্রীতে স্বদেশ। একটি থেকে অন্যটিকে শামসুর রাহমান কখনও বিচ্ছিন্ন ভাবতে পারেননি। তাই বিপন্ন দুঃখী স্বদেশকে ছেড়ে তিনি কোথাও যেতে চান না। তাঁর মাতৃ-রূপ দর্শনও প্রাতিস্বিকতায় ভাস্বর। তিনি সেই মায়ের মুখে স্বদেশকে কল্পনা করেন, যে মায়ের দ্রোহী সন্তান নিজের বুকের রক্ত ঢেলে দেশকে করতে চায় মুক্ত ও মানবিক। তাই নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী যুদ্ধে শহিদ নূর হোসেনের মায়ের মুখেই কবি দেখেন প্রিয় স্বদেশের মুখ :

ফুটেছে গোলাপ এক বুকের ভেতর

মা, তোমার মমতার মতো।

তোমার মুখেই দেখি

প্রতিদিন স্বদেশের মুখ

                           (‘এক শহীদের মা বলছেন’)

শামসুর রাহমান নিসর্গের উপাদান ব্যবহার করেই ফুটিয়ে তোলেন স্বদেশের রূপ, বিচিত্র মানবস্রোতের অবয়ব। প্রাকৃতিক উপাদানের নিপুণ ব্যবহারে তা আর যেন প্রাকৃতিক থাকে না, বরং হয়ে ওঠে তাঁর অন্তর্গত প্রতিরূপক : ‘আমার টেবিলের গোলাপটি/ যখন পাপড়ি ঝরাতে থাকে, তখন আমি/ চৌচির মাঠে উবু-হয়ে-বসে-থাকা কৃষক,/ বেতফলের স্বাদে ভরপুর কিশোরী,/ নতুন চরে পড়ে-থাকা লাঠিয়ালের ভেজা শরীর,/ পালকির পর্দা সরিয়ে-তাকানো নতুন বউ,/ অন্ধকারে জেলে ডিঙ্গির ছিপছিপে গতি দেখতে পাই/ এবং দেখি/ চুয়ান্ন হাজার বর্গমাইল জুড়ে ফুটে থাকে কোটি কোটি রক্তগোলাপ’ (‘একটি গোলাপ যখন’)। তবে স্বদেশের নানামাত্রিক ধস আর বিপন্নতায় কবি-চিত্তও কখনও কখনও সন্দিগ্ধ হয়ে ওঠে, তখন প্রকৃতির বিশল্যকরণী সত্তা হারিয়ে যায়, উচ্চারিত হয় এই বিরূপ ভাষ্য :

প্রিয় প্রকৃতিও

পারে না বুলোতে কোনও অব্যর্থ মলম

অন্তরের গভীর জখমে আর সুদূর একাত্তরের রক্তমাখা মুখ

আবার নতুন করে জেগে উঠে বিভীষিকা রূপে

পথে পথে, ঘরে ঘরে হানা দেবে ভেবে

এখন তোমার বুকে জমছে তুষার।

                                 (‘নিভৃত কঙ্কাল’)

―কিন্তু কবির চিত্তে আছে ফিনিক্স পাখির জেগে ওঠার বীজমন্ত্র, তাই কোনও বিরূপতাই তাঁকে বিপন্ন করতে পারে না; বরং প্রাকৃতিক উপাদানে তিনি প্রকাশ করেন জেগে ওঠার এই অবিনাশী আয়োজন :

কোটি কোটি চোখ

নতুনের স্বপ্নে খুব ডাগর উৎসব। আগামীর

নামে রঙ বেরঙের প্রজাপতি উড়ুক বাগানে,

কোকিল করুক আজ বসন্তের বিশদ আবাদ।

ফের সাজাবো বাগান অপরূপ।

                              (‘বাগানের গান’)

৩.

শামসুর রাহমানের কবিতায় স্বদেশের নানামত্রিক রূপ শিল্পরূপ লাভ করেছে। এই রূপের মধ্যে যেমন আছে সামাজিক- রাজনৈতিক অনুষঙ্গ, তেমনি আছে নৈসর্গিক প্রসঙ্গ। রাহমানের কবিতায় একটা সময়ের বাংলাদেশ যেন শব্দে-বর্ণে-রেখায় চিত্রিত হয়ে আছে। তাঁর কবিতা গভীরভাবে অনুধাবন করলে পাঠকচিত্তে অলক্ষে ভেসে উঠবে স্বদেশের আয়ত অবয়ব―কথা বলবে বিদ্রোহী বাংলা।

 লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button