আর্কাইভপ্রচ্ছদ রচনা

কবি-সব্যসাচী সৈয়দ শামসুল হক : মৃত্তিকা লাবণি

প্রচ্ছদ রচনা : সৃজন-আলোয় কীর্তিমান পাঁচ সাহিত্যিক

শব্দকথার ইন্দ্রজালে পাঠক এবং দর্শককে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখার এক হিরণ¥য় ক্ষমতার অধিকারী সৈয়দ শামসুল হক―বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যশিল্পী। একাধারে কবিতা, নাটক, উপন্যাস, ছোটগল্প, চিত্রনাট্য, অনুবাদ, শিশুসাহিত্য, সংগীত প্রভৃতি অঙ্গন তাঁর প্রতিভার স্পর্শে হয়েছে সমৃদ্ধ।

ছোটবেলা থেকে সৈয়দ শামসুল হকের লেখালেখির সূচনা। চিকিৎসক-বাবার অনুপ্রেরণাতে তাঁর লেখার প্রতি আগ্রহ জন্মায়। তবে বাবা এটাও চেয়েছিলেন, পুত্র ডাক্তার হোক। এছাড়া স্কুলজীবনে বিদ্যাসাগর, বিভূতিভূষণ, শরৎচন্দ্র পড়েও লেখার প্রতি অনুপ্রাণিত হন সৈয়দ হক। পরবর্তী জীবনে সব্যসাচী লেখক হয়ে বাংলা সাহিত্যকে বৈচিত্র্যময় ধারায় সমৃদ্ধ করে গেছেন তিনি।

সৈয়দ শামসুল হকের জন্ম ১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর কুড়িগ্রামে। জগন্নাথ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে ভর্তি হন। কিন্তু পড়ালেখা সমাপ্ত না করে পুরোদমে লেখালেখি শুরু করেন। পঞ্চাশের দশক থেকে তিনি নিরন্তর লিখে গেছেন। তৈরি করে গেছেন তাঁর নিজস্ব ঘরানা। সিনেমার কাজ আর লেখক হওয়ার বাসনায় প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা ছেড়ে দেওয়ায় ক্ষতি কিছু হয়নি। বরং আমরা পেয়েছি একজন সব্যসাচী লেখককে।

সাহিত্যের আঙ্গিক, কৌশলগত দিক আর বিষয়-ভাবনায় তিনি বরাবরই সৃজনশীল ও শিল্পসচেতন। তাঁর রচনায় রয়েছে আধুনিকতার রূপকল্প। চারদিকের বাস্তবতা শিল্পী হৃদয়ে যে অনুরণন ঘটায় তারই প্রতিভাস ফুটে ওঠে তাতে। ১৯৫১ সালে সৈয়দ শামসুল হকের প্রথম একটি ছোটগল্প ছাপা হয় ফজলে লোহানী সম্পাদিত অগত্যা নামের মাসিক পত্রিকায়। আর তাঁর রচিত প্রথম উপন্যাস হলো দেয়ালের দেশ।

বাংলাদেশে কাব্যনাটকের সফল রূপকার সৈয়দ শামসুল হক। এই অঙ্গনে তিনি অনুপ্রাণিত হয়েছেন বিশ্ববিখ্যাত কবি টি. এস. এলিয়টের দ্বারা। তবে তাঁর ভাবনার মূলে সদা-সর্বদাই প্রাধান্য পেয়েছে দেশজ পটভূমি। কর্মজীবনের সাত বছর কাটিয়েছেন বিবিসি বাংলা বিভাগের সঙ্গে। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিবিসি বাংলা বিভাগে প্রচারিত বাংলাদেশের বিজয়ের সংবাদটি পাঠ করেছিলেন  সৈয়দ শামসুল হক।

বিবিসি বাংলা বিভাগে কাজ করার সময় শিল্প-সাহিত্য অনুষ্ঠান, সংবাদ পাঠ ইত্যাদির সূত্রে নাটক দেখার সুযোগ হতো। তাছাড়া বিশ্বনাট্যের রাজধানী লন্ডনে থাকার সুবাদেও অনেক নাটক দেখার সুযোগ হয় তাঁর। তাঁর মনোজগতে জাগে সৃজনশীলতা। লন্ডনেই তিনি লেখেন তাঁর প্রথম নাটক পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় (১৯৭৫)। লন্ডনে নাটক দেখতে গিয়ে সৈয়দ হকের মনে হয়েছে আমাদের দেশে যেখানে সাক্ষরতার হার কম, বই পড়ার অভ্যেস কম, সেখানে নাটকের মাধ্যমেই মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়া সহজ। নাটক দেখে মানুষ তাৎক্ষণিকভাবে তার ভাববস্তু উপলব্ধি করে।

সৈয়দ শামসুল হকের কাব্যনাট্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য : পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় (১৯৭৫), নূরলদীনের সারাজীবন (১৯৮২), এখানে এখন (১৯৮৮), গণনায়ক (১৯৭৫-৭৬), ঈর্ষা প্রভৃতি।

পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রচিত একটি কাব্যনাট্য। গ্রামের মাতব্বর, গ্রামবাসী, পির সাহেব, মাতব্বরের মেয়ে, পাইক আর মুক্তিযোদ্ধা―এই স্বল্পকিছু চরিত্র নিয়ে নাটকটি রচিত। মাতব্বর পাকিস্তানের সমর্থক। সে গ্রামবাসীকে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে ভুল বোঝায়। একটা পর্যায়ে গ্রামবাসী বুঝতে পারে মাতব্বর তাদের মিথ্যা বলেছে। সহজ সরল গ্রামবাসী মাতব্বরের ওপর আর আস্থা রাখতে পারে না। মাতব্বরের পাকিস্তানপ্রীতি, নিজ কন্যাকে পাকসেনাদের হাতে তুলে দেওয়া, কন্যার আত্মহত্যা, এবং এরপর পিতার অন্তর্দহন। তবে শেষ রক্ষা হয় না রাজাকার মাতব্বরের। নিজের পাইকের হাতেই তার মৃত্যু হয়। পাইক বলে, ‘আপনার কোনো ঈমান ছিল না’। সংলাপের কুশলী ব্যবহারে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার পরিস্থিতি উদ্ভাসিত হয়েছে এ নাটকে। বাঙালির দেশপ্রেম, দেশদ্রোহীর প্রতি চরম ঘৃণা ও আক্রোশের চিত্র নাটকে ফুটে উঠেছে চমৎকারভাবে।

নূরলদীনের সারাজীবন নাটকটি ব্রিটিশ শাসনামলে শাসকগোষ্ঠী ও তাদের সহযোগী স্থানীয় জমিদার মহাজন-শ্রেণির হাতে নিষ্পেষিত অসহায় সাধারণ কৃষক প্রজাদের জীবনের মর্মন্তুদ কাহিনি নিয়ে রচিত। এর পটভূমিতে রয়েছে বাস্তব ঐতিহাসিক ঘটনা। জমিদার-জোতদার আর কোম্পানির কুঠিয়ালদের অত্যাচার, শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে ১৭৮৩ সালে রংপুরের উত্তরাঞ্চলে প্রকাশ্য বিদ্রোহ শুরু হয়। নাটকটি এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট নিয়ে রচিত। শোষণের হাত থেকে রক্ষা পেতে কৃষকরা বিদ্রোহ করে। নূরলদীন তাদের নেতা। নীলকরদের অত্যাচারে সর্বস্বান্ত তাঁর কৃষক বাবা নিজের কাঁধে লাঙল টানত। লাঙলের মুঠি চেপে ধরত কিশোর নূরলদীন। সময় বয়ে যায়, কিন্তু শোষিতের অবস্থার পরিবর্তন হয় না।  যুবক নূরলদীনের ডাকে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রস্তুত সমস্ত কৃষকরা। নূরলদীনের সারাজীবন নাটকে একজন সাধারণ মানুষ কী করে একজন নেতায় পরিণত হন তা দেখানো হয়েছে। এই যে মানুষের মধ্য থেকে অন্য এক মানুষকে আবিষ্কার করা―এটি সৈয়দ শামসুল হকের অনন্য বৈশিষ্ট্য।

সৈয়দ শামসুল হকের বাড়িতে কাজের একজন সহযোগী বহু বছর লেখকের সঙ্গে ছিলেন। তাঁকে সৈয়দ হক নূরলদীনের সারা জীবন নাটকটি দেখাতে নিয়ে যান। নাটক দেখা শেষ হলে হল থেকে বেরিয়ে তিনি বলেন, আমার সাহেব লেখেন তা জানতাম কিন্তু কুড়ি বছর ধরে জানতে পারিনি তিনি কী লেখেন। আজ জানলাম।

এখানে এখন নাটকের বিষয়বস্তু স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা, মানুষের মূল্যবোধের অবক্ষয়, স্বার্থান্বেষী মহলের হঠকারিতা এবং এর ফলে সৃষ্ট জীবন-যন্ত্রণা। পুঁজিবাদী ব্যবসায়ী শ্রেণির উচ্চাভিলাষী মানসিকতা এ নাটকের মূল উপজীব্য। মূলত স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের সামগ্রিক অবস্থাকে খণ্ডিতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে এ কাব্যনাট্যে।

গণনায়ক কাব্যনাট্যের প্রেক্ষাপট রাজনৈতিক। এ নাটকে লেখক নিজের রাজনৈতিক কিছু অভিজ্ঞতাকে তুলে ধরায় প্রয়াসী হয়েছেন। নাটকটি রচনায় শেক্সপিয়রের জুলিয়াস সিজার নাটকের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন তিনি। তবে বিষয় নির্বাচন ও কাহিনি বিনির্মাণে সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটভূমি তুলে ধরেছেন। স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক আবহ, পট পরিবর্তন, নেতাদের মানসিকতা প্রভৃতি বিষয়ের অবতারণা করতে গিয়ে স্বাভাবিকভাবেই এসেছে দ্বন্দ্ব, সংঘাত ও উৎকণ্ঠা। 

নাটকে সমকাল এবং সমষ্টিকে স্পর্শ করে এমন নৈর্ব্যক্তিক বিষয় তিনি বেছে নেন। তিনি বলেন, আমি প্রেমের গল্প যদি লিখি সেটা হবে ব্যক্তির অনুভূতি নিয়ে একটি ব্যক্তিক অভিজ্ঞতা, কিন্তু যখন আমি একটা আন্দোলনের কথা লিখছি, যখন আমি একটা বড় মাপের ভেতরে মানুষগুলোকে দেখতে পাচ্ছি তখন সেই ব্যাপারটাকে আনবার জন্যে শিল্পে আমি নাটকটাকে বেছে নিই। ঈর্ষা প্রেমের নাটক হলেও এতে সমষ্টি চেতনা কাজ করেছে। ত্রিভুজ প্রেমের আঙ্গিকে সম্পূর্ণ মানবিক বিষয় নিয়ে রচিত হলেও নাট্যকার অপূর্ব কুশলতায় স্বদেশের স্বাধীনতা বিষয়টি এখানে যুক্ত করেছেন। রূপক আর উপমার ব্যবহারে নাটকটি অনবদ্য।

বাংলার মাটি বাংলার জল সৈয়দ শামসুল হকের আরেকটি উল্লেখযোগ্য নাটক। নাটকটি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখা। এই নাটকে লেখক দেখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের ভেতর থেকে কীভাবে রবীন্দ্রনাথের উত্থান হয়েছে। তাঁর মতে, যে রবীন্দ্রনাথকে আমরা জানি অর্থাৎ বাংলাদেশের পটভূমিতে তাঁকে ফেলে আমি দেখেছি যে-সময়টা সাজাদপুর, পতিসর, শিলাইদহে ছিলেন, আমাদের সকলেরই জানা যে রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথই হতেন না, যদি না বাংলাদেশে, এখন যে বাংলাদেশ, সেই বাংলাদেশে এসে এখানকার মাটি, জল, মানুষের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটত। তা নইলে তিনি কিন্তু, জোড়াসাঁকোর সৌখিন কবি হয়েই থাকতেন।

ভাষা ব্যবহারে সৈয়দ শামসুল হকের কুশলতা অনবদ্য। আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে নাটকে তিনি ভিন্নমাত্রা সংযোজন করেছেন। কাব্যনাট্যে সাধারণ গ্রামীণ মানুষের সংলাপ হিসেবে প্রচুর আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার করলেও তিনি সচেষ্ট ছিলেন সাধারণের বোধগম্য করে তা উপস্থাপন করতে। এক্ষেত্রে অনেক সময় তিনি নিকটতম প্রতিশব্দ ব্যবহার করেছেন। ছন্দ ও সংগীতের মূর্র্ছনা সংলাপকে করেছে আকর্ষণীয়। সর্বোপরি নাটক হয়ে উঠেছে গতিময় ও প্রাণবন্ত। ভাষার বর্ণিল উজ্জ্বলতা আর ছন্দের অনিরুদ্ধ প্রবাহ বরাবরই তাঁর সৃষ্টিকে দিয়েছে অনন্যতা।

একাধারে কবিতা, নাটক, উপন্যাস, ছোটগল্প, চিত্রনাট্য ও অনুবাদ সাহিত্যসহ শিল্প ও সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখার জন্যে তাঁকে ‘সব্যসাচী’ লেখক বলা হয়। স্বতন্ত্র রচনাশৈলীর মাধ্যমে সাহিত্যের প্রায় সব শাখাকে তিনি সমৃদ্ধ করেছেন। তিনি লিখতেন যত, পড়তেন তারও বেশি। নিজেই এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘লেখককে সময়টা এভাবে মেপে দিতে হয় যে, দু ঘণ্টা যদি তিনি লেখেন, অন্তত তাঁকে দু ঘণ্টা পড়তে হবে।’

সৈয়দ হক ইংরেজিতে লিখেছেন নাটক দ্য ডেড পিকক। তাঁর অনূদিত মহাকবি শেক্সপিয়রের ম্যাকবেথ পড়ে খ্যাতিমান অভিনেতা, নাট্যকার ও নাট্য নির্দেশক উৎপল দত্ত অভিভূত হয়ে বলেন, আমি বিস্মিত হয়েছি এই ভেবে যে, সৈয়দ হক কী বিরল ক্ষমতাবলে বাংলা ও ইংরেজি ভাষার শব্দঝঙ্কার ও অনুপ্রাসকে এক করতে পেরেছিলেন।

শিশুদের জন্যও প্রচুর লিখেছেন সৈয়দ হক। তাঁর শিশুতোষ গ্রন্থগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য : আনু বড় হয়, সীমান্তের সিংহাসন (১৯৮৮) ও হডসনের বন্দুক।

সীমান্তের সিংহাসন উৎসর্গ করেছেন তাঁর পুত্র দ্বিতীয় সৈয়দ হককে। উৎসর্গ পত্রে লেখা আছে, ‘…সাহসী হও, মানুষকে ভালোবাস, মানুষকে বাদ দিয়ে দেশ নয়, মানুষকে ভালোবাসাই দেশকে ভালোবাসা, দেশকে ভালোবাসতেও সাহসের দরকার হয়। বাবা দ্বিতীয়, সাহস ও ভালোবাসা নিয়ে তোমরা সবাই বড় হও।’ উৎসর্গপত্রের এই লেখাটুকুতে রয়েছে গভীর জীবনবোধ। মানুষকে দেশপ্রেম, দেশের মানুষের প্রতি অগাধ ভালোবাসা আর প্রগতিমুখী চেতনায় ফেরাতে ও জাগাতে দায়বদ্ধ থেকেছেন সব্যসাচী এই লেখক।

স্বাধীনতাপূর্ব এবং স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা সাহিত্যজগতে সৈয়দ শামসুল হক স্বতন্ত্র ধারায় পরিচয় দিয়েছেন। কৌতূহলী মন, সামাজিক ও রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা ও অঙ্গীকারের চেতনায় তাঁর শিল্পীসত্তা চালিত হয়েছে। মেধা তাঁকে প্রদীপ্ত রয়েছে, জ্ঞান তাঁকে করেছে উজ্জ্বল। তাঁর সাহিত্যকর্ম মূল্যায়নে কোনও কোনও শিল্প ও সাহিত্যবোদ্ধা তাঁকে এ যুগের রবীন্দ্রনাথ হিসেবে মূল্যায়িত করেছেন। কবিতা, নাটক, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, শিশুসাহিত্য, অনুবাদ―সবকিছুতেই তাঁর শৈল্পিক হাতের স্পর্শ রয়েছে।

সৈয়দ শামসুল হকের কবিতায় নাগরিক আবহ ও নৈঃসঙ্গের আভাস পাওয়া যায়। তাঁর কাব্যগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য : একদা এক রাজ্যে (১৯৬১), বিরতিহীন উৎসব (১৯৬৯), বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালা (১৯৭০), প্রতিধ্বনিগণ (১৯৭৩), অপর পুরুষ, (১৯৭৮) পরানের গহীন ভিতর (১৯৮১), নিজস্ব বিষয় (১৯৮২), রজ্জুপথে চলেছে (১৯৮৮), অগ্নি ও জলের কবিতা (১৯৮৯) প্রভৃতি। বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালা (১৯৭০) কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি আদমজি পুরস্কার লাভ করেন।

সৈয়দ শামসুল হক বাংলাদেশের বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক। গল্প ও উপন্যাস রচনায় তাঁর সৃজনশীলতা বর্ণনাকৌশলে মুন্সিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর ছোটগল্পের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য শীত বিকেল (১৯৫৯), রক্তগোলাপ (১৯৬৪), আনন্দের মৃত্যু (১৯৬৭)। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে : এক মহিলার ছবি (১৯৫৯), সীমানা ছাড়িয়ে (১৯৬৪), নীল দংশন (১৯৬৮), স্মৃতিমেধ (১৯৮৬), স্তব্ধতার অনুবাদ (১৯৮৭), বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ (প্রথম ১৯৮৯, দ্বিতীয় ১৯৯০), নিষিদ্ধ লোবান (১৯৯০) ইত্যাদি।

বিষয়-বৈচিত্র্য ও প্রমিত কাব্যভাষায় তাঁর রচনা বরাবরই আধুনিক। বিশ্বসাহিত্য অঙ্গনের বিশিষ্ট কবিদের কবিতা তাঁকে প্রভাবিত করে। অভিনব চিত্রকল্প, অলংকারের প্রয়োগ, কল্পনার অবারিত দুয়ার খুলে সেখানে বিচরণ, যাপিত জীবনের কামনা-বাসনার প্রকাশ মনস্তাত্ত্বিক আবহের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে সচেষ্ট তিনি।

তাঁর রচনায় প্রাধান্য পেয়েছে সমসাময়িক বাংলাদেশ, মধ্যবিত্তের জীবনালেখ্য। তাঁর লেখার জৈবিক প্রবণতাকে দেখানো হয়েছে জীবনের একটি স্বাভাবিক মানবিক ক্রিয়া হিসেবে। শ্লীল কিংবা অশ্লীল―এইসব বিবেচনা তিনি করতে চাননি। পাশাপাশি তাঁর রচনা অপশক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামের কথা বলে। শুভ-অশুভের লড়াই, শোষক আর শোষিতের মধ্যে বিভেদের বার্তা দেয়।

সৈয়দ শামসুল হক রচিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাসের মধ্যে উল্লেখযোগ্য : নিষিদ্ধ লোবান, নীল দংশন, এক যুবকের ছায়াপথ, ত্রাহি, বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ, এক মুঠো জন্মভূমি, বালিকার চন্দ্রযান, জনক ও কালোকফি ইত্যাদি।

বেশ কিছু চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লিখেছেন তিনি। রচনা করেছেন গান। পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। তাঁর রচিত ‘হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস’ গানটি ভীষণ জনপ্রিয়।

কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন আদমজি সাহিত্য পুরস্কার, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, নাসিরউদ্দিন স্বর্ণপদক, জেবুন্নেসা-মাহবুবউল্লাহ স্বর্ণপদক, আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার, কবিতালাপ পুরস্কার, পদাবলী পুরস্কার, রাষ্ট্রীয় একুশে পদক এবং স্বাধীনতা পুরস্কার।

নিবিষ্ট মনে লেখার জন্যে একদা তিনি বাংলাবাজারের বিউটি বোর্ডিংয়ে আসতেন নিয়মিত। একটি নির্দিষ্ট কামরা, নির্দিষ্ট আসনে বসে লিখতেন। ঢাকার বিখ্যাত বিউটি বোর্ডিং ছিল সাহিত্যিকদের আড্ডার জায়গা, সাহিত্যের অন্যতম প্রধান সূতিকাগার।

ব্যক্তিজীবনে ছিলেন বন্ধুবৎসল এবং মানবিক। দেশ ছিল তাঁর ধ্যান, জ্ঞান। আর ছিল লেখালেখি। লন্ডনের রয়েল মার্সডেন ক্যান্সার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি অনুবাদ করেছেন শেক্সপিয়রের হ্যামলেট। ডিকটেশন নিয়ে সাহায্য করেছেন তাঁর স্ত্রী আনোয়ারা সৈয়দ হক।

২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর প্রাকৃতজনের কবি সৈয়দ শামসুল হক মৃত্যুবরণ করেন। চলে যাওয়ার কয়েক বছর আগে তিন পয়সার জোছনা নামে একটি আত্মকথা লেখেন। এই আত্মকথাটি এক অনবদ্য জীবনগল্প। নূরলদীনের সারাজীবন কাব্যনাট্যের নূরলদীনের মতোই বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে সৈয়দ শামসুল হক বলিষ্ঠ ও বিকশিত এক নাম। এই নাটকের বিখ্যাত পঙ্ক্তি ‘জাগো বাহে, কোন্ঠে সবায়?’ যেন লেখকেরই কণ্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি।

 লেখক : প্রাবন্ধিক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button