আর্কাইভক্রোড়পত্র

খোকা হলো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে নতুন করে পাওয়া : সুহৃদ সাদিক

ক্রোড়পত্র : বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তিনটি বই

স্বাধীনতার রঙিন সূর্য দেখার জন্য আমাদের দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হয়েছে, দিতে হয়েছে চরম মূল্য। পলিমাটি ঘেরা সবুজ-শ্যামল এই দেশের মাটিতে দূর্বাঘাসের ওপর নিশ্চিন্তে শুয়ে শিশিরকণার পরশ পাবার জন্য কিংবা আষাঢ়ের রিমঝিম বর্ষণে ভিজতে ভিজতে হারিয়ে যাবার স্বাদ পেতে বলিদান দিতে হয়েছে অজস্র তাজা প্রাণ, সম্ভ্রম হারাতে হয়েছে অসংখ্য নারীকে! রোদ-ঝলমল বাংলার প্রত্যুষ-লগ্নের অন্ধকার দূর করতে ফাল্গুনের কড়া নাড়ার শব্দে হোমশিখার মতো দাউদাউ করে জ্বলে উঠতে হয়েছে। বাংলার জনমানুষ আবহমান কাল ধরে অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে, স্বাধীনতার জন্য করেছে মরণপণ লড়াই। তবে যাঁর ঐকান্তিক প্রেরণা-উৎসারিত আলোকের উজ্জ্বল-দীপ্ত-রাগে আমরা বিজয়ের উৎসব করেছি, কণ্ঠে ধারণ করেছি স্বাধীনতার মাল্য, তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। হাজার বছর ধরে লালিত বাঙালির স্বপ্নকে তিনি বাস্তবতার অবয়ব দিয়েছিলেন। পরাধীনতা, বঞ্চনা, স্বৈরাচার-অবিচার যুগ যুগ ধরে এ দেশের মানুষ সহ্য করে এসেছিল। ভাগ্য, নিয়তি এরকম শব্দের গর্ভে বসবাস করতে হয়েছিল শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। পাল, সেন, পাঠান, মোগল, নবাবী যুগ পেরিয়ে কোম্পানি-ইংরেজ শোষণ-শাসন দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনীর অভিজ্ঞতা। ইংরেজ রাজত্বের অন্তিম নিঃশ্বাসের সময় তাঁর আবির্ভাব। তখন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলন জোরেশোরে চলছে। উপমহাদেশে ততদিনে ইংরেজদের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুলে’র বিষবৃক্ষ ফলতে শুরু করেছে। এ সময়ের তিতুমীর আর ক্ষুদিরামরা শ্বেতাঙ্গ প্রভুদের নয়, পরস্পর নিধনের উন্মাদনায় মত্ত। ছাত্রাবস্থায় জেলহাজতের অভিজ্ঞতা আর সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিমের রাজনৈতিক শিক্ষা তাঁকে পাকিস্তান আন্দোলনের লড়াকু নেতায় পরিণত করেছিল। ‘টুঙ্গিপাড়ার মিয়াভাই’ খ্যাত খোকা কীভাবে একটি জাতির জন্মদাতা হয়ে উঠল, তারই বস্তুনিষ্ঠ ইতিবৃত্ত আহমেদ ফরিদের খোকা হলো জাতির পিতা।

আমাদের প্রথাগত ইতিহাসের দলিলে যেসব কণ্ঠস্বর শ্রুত হয়, সেগুলোর অধিকাংশই অন্যের নির্মাণ করা। ফলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অনেক ভাঙাগড়া ও টানাপোড়েন আছে। তবে সামগ্রিকভাবে একটি দেশকে জানতে গেলে দেশটির আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থার সঙ্গে জড়িত ইতিহাসকে বস্তুনিষ্ঠভাবে জানতে হয়। বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে জ্ঞানলাভের কাজটি বুদ্ধিজীবীরাই করে থাকেন। আবার এই চর্চার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য না থাকলে সেটি শুধু চর্চার জন্য চর্চা হয়ে যায়। যার ফলে সেটি ব্যক্তিকেন্দ্রিক এমনকি ব্যক্তি-স্বার্থকেন্দ্রিকও হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাজনীতিতে সক্রিয় থাকায় তাঁর পক্ষে সমাজ ও রাজনীতির গতিপ্রকৃতি বুঝতে সুবিধা হয়েছে এবং নিজের ভাবনা-চিন্তাকে সেই অভিজ্ঞতার আলোকে শান দিয়ে তিনি অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা ও আমার দেখা নয়াচীনের মতো প্রামাণ্য ও বিশ্বাসযোগ্য গ্রন্থ লিখতে পেরেছেন। এগুলো চিন্তার স্বচ্ছতায়, বিশ্লেষণের অকাট্যতায় এবং অন্তর্দৃষ্টির আলোকে অনন্য এবং এ-কারণে আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের যে কোনও প্রকারের আলোচনায় তিনি বারবার প্রাসঙ্গিকভাবেই উদ্ধৃত হবেন এ-কথা নিশ্চিত করেই বলা যায়। আমাদের লেখকদের উচিত এই সুযোগটা নেওয়া। আহমেদ ফরিদ নিয়েছেন। অকুণ্ঠচিত্তে স্বীকারও করেছেন সে-কথা। নির্ভরযোগ্য উৎস হিসেবে বঙ্গবন্ধুর নিজের লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লেখা শেখ মুজিব আমার পিতা গ্রন্থ থেকে বিভিন্ন ঘটনা চয়ন করে নিজের মতো করে সাজিয়েছেন। এতে গ্রন্থটির গ্রহণযোগ্যতা আরও বেড়েছে বৈ কমেনি।

খোকা হলো জাতির পিতা পড়া এক মজার অভিজ্ঞতা। সেটা এই কারণে নয় যে, বইটি গল্পের ঢঙে লেখা। কিন্তু বইটির লিখনশৈলীর মধ্যে এমন একটা ব্যাপার আছে যে, বইটিকে ‘আপন স্বরূপে আপনি ধন্য’ বলে মনে হয়। এর কেন্দ্র ধরতে পারা যায় সহজেই। লেখকের যে কেন্দ্র, পাঠক পড়তে পড়তে তার কাছে পৌঁছুতে পারবেন যুক্ত থেকে। পাঠক অনায়াসেই বঙ্গবন্ধুর সময়কালে ফিরে এক ধরনের মানস-পরিভ্রমণ করতে পারবেন। বইটির বিকেন্দ্রীকৃত পাঠও সম্ভব। এটিকে একবার মনে হবে বঙ্গবন্ধুর জীবনী, আবার মনে হবে তাঁকে ঘিরে লেখা একটি বই। বইটি আদি-মধ্য-অন্ত্য মেনে লেখা হয়েছে। আহমেদ ফরিদের বইতে বঙ্গবন্ধুর আদি-মধ্য-অন্ত্য সবই আছে। সম্ভবত আরও কিছু বেশি পরিমাণেই আছে। আদি-মধ্য-অন্ত্য এই গ্রন্থে নতুন করে বিন্যস্ত, ফলে জানা ঘটনাগুলোকে নতুন কার্য-কারণ সম্পর্কে বাঁধা সম্ভব হয়েছে। গ্রন্থটির পরিণতি তাই এত বেশি শৈল্পিক, এত বেশি নান্দনিক! ২৫ টি পরিচ্ছেদে বিন্যস্ত উপন্যাসটিতে চরিত্র রয়েছে মোটে চারটি। মূলত নূরনগর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক জনাব এবিএম মাহমুদ হোসেন, বিএ. বিএড…, বিটি কাহিনিকে এগিয়ে নিয়েছেন। তিনি একজন  ‘বীর বিক্রম’ খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর নাতি-নাতনি অর্থাৎ মুগ্ধ, রবীন ও নিনিতার নানা প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে তিনি ইতিহাসের প্রসঙ্গগুলো নিয়ে আসেন। বঙ্গবন্ধুকে নতুন করে বোঝাপড়া করা হয়। আহমেদ ফরিদ পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দেন বাঙালির গর্বিত ইতিহাসের রাজপথ ও অলিগলির সঙ্গে।

ঐতিহাসিক মানবাধিকার রক্ষার প্রথম ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছিল : ‘অষষ যঁসধহ নবরহমং ধৎব নড়ৎহ ভৎবব ধহফ বয়ঁধষ রহ ফরমহরঃু ধহফ ৎরমযঃং. ঞযবু ধৎব বহফড়বিফ রিঃয ৎবধংড়হ ধহফ পড়হংপরবহপব ধহফ ংযড়ঁষফ ধপঃ ঃড়ধিৎফং ড়হব ধহড়ঃযবৎ রহ ধ ংঢ়রৎরঃ ড়ভ নৎড়ঃযবৎযড়ড়ফ.’ পরিতাপের বিষয় এটাই যে, মানবসমাজ এই ওয়াদা কার্যক্ষেত্রে খুব কমই রক্ষা করতে পেরেছে। জাতীয় সম্পদের বৃদ্ধি, ব্যক্তিগত উপার্জন বৃদ্ধি, শিল্পায়ন, প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অগ্রগতি দেখিয়ে উন্নয়নের জোয়ার বইছে সারাবিশ্ব জুড়ে; কিন্তু সুবিধাবঞ্চিত, পিছিয়ে পড়া, বঞ্চিত, শোষিত মানুষের ভাগ্যের খুব বেশি পরিবর্তন ঘটেছে কি ? তবে এসব নিয়ে যিনি ভেবেছেন, পিছিয়ে পড়া মানুষদের মনুষ্যত্বের অধিকার আদায় যাঁর অভীষ্ট লক্ষ্য ছিল, মানুষ-দেশ-ইতিহাস-সংগ্রাম- অধিকার যাঁর চেতনায় একাকার হয়েছে, যিনি মানবতার মূর্ত প্রতীক, তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর জীবনব্যাপী সংগ্রামের চূড়ান্ত ফসল বাংলার স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘আমার জীবনের একমাত্র কামনা বাংলাদেশের মানুষ যেন খাদ্য পায়, বস্ত্র পায়, বাসস্থান পায়, শিক্ষার সুযোগ পায় এবং উন্নত জীবনের অধিকারী হয়।’ তিনি স্বাধীনতা চেয়েছিলেন স্বাধীনতাহীনতার প্রধান উৎসগুলোকে নির্মূল করার জন্য। দারিদ্র্য ও অত্যাচার, অর্থনৈতিক সুযোগের অভাব, সামাজিক বঞ্চনা, জনসাধারণের কল্যাণের উপেক্ষা চিরতরে রুদ্ধ করাই তাঁর মূল লড়াই ছিল। কোনও সুবিধাবঞ্চিত মানুষ যাতে ক্ষুধা মিটাতে অক্ষম না হয়, চিকিৎসার অভাবে মারা না যায়, স্বাস্থ্যরক্ষা ও শিক্ষালাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত না থাকে, সেজন্যই তিনি তাদের নিয়ে ‘সোনার বাংলা’ গড়ার স্বপ্ন দেখেন। ১৯৭২-এর সংবিধান সেই সাক্ষ্যই দেয়। বঙ্গবন্ধুর শৈশবের শিক্ষক হামিদ সাহেব এ ব্যাপারে তাঁর কিশোর মনকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। আলোচ্য গ্রন্থে টুনির প্রশ্নের উত্তরে মাহমুদ দাদু জানান, ‘হামিদ স্যার মারা গেলেন কিন্তু তাঁর এ মহৎ কাজটা তো আর থেমে থাকতে পারে না। মুসলিম সেবা সমিতির হাল ধরলেন স্বয়ং খোকা। খোকা সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দীর্ঘদিন হাল ধরে রাখেন। এ সময় দল বেঁধে তাঁরা মুষ্টির চাল উঠাতেন। অনেকেই দিতে চাইত না। যারা দিতে চাইত না রাতে তাদের বাড়িতে ইট মারা হতো। ভুতুড়ে ইট কোত্থেকে আসত কেউ দেখত না কিন্তু সবাই জানত কারা ইট মারত। এ নিয়ে খোকার বাবার কাছে নালিশ যেত। মাঝে মাঝে এর জন্য বাবার কাছে শাস্তি পেত খোকা কিন্তু দমতো না।’ পরের জন্য যাঁর প্রাণ কাঁদে, পরের দুঃখে যিনি কাতর হন, তিনি এত সহজে দমেন না! কারণ তিনি খোকা; এক সময় তিনিই হবেন সবার প্রিয় মুজিব ভাই, তারপর বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং একটি জাতিরাষ্ট্র জন্ম দিয়ে ‘জাতির পিতা’।

মানবতাবোধ ছিল বঙ্গবন্ধুর চরিত্রের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। তিনি কৈশোরকাল থেকেই স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে, প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে আমরণ যে আপসহীন সংগ্রাম করেছিলেন তার পিছনে ছিল মানুষের প্রতি তাঁর অগাধ বিশ্বাস ও ভালোবাসা। বাংলার জনগণের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য তিনি করেছিলেন নিঃস্বার্থ সংগ্রাম। অত্যাচারীর বিরুদ্ধে এ সংগ্রাম তখনই সম্ভব হয় যখন থাকে মানুষের প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ও গভীর মমত্ববোধ। এগুলো ছিল তাঁর সংগ্রামের তথা কর্মের প্রেরণার উৎস। টুঙ্গিপাড়ায় নদীর পানিতে ঝাঁপ দিয়ে, মেঠো পথের ধুলোবালি মেখে কিংবা বর্ষার কাদাপানিতে ভিজে শৈশব কাটালেও, মানবিক গুণাবলির বিকাশ তাঁর মধ্যে সেই সময় থেকেই দেখা যায়। মানুষ তো অনেক দূরের কথা, পশুপাখির সামান্য অযত্নও তিনি সহ্য করতে পারতেন না। ছুটির পর একদিন তাঁর মা দেখেন মুজিব নিজের পায়জামা-পাঞ্জাবি বিলিয়ে দিয়ে গায়ের চাদর জড়িয়ে বাড়ি ফিরছে। তাঁর হৃদয়ের গভীরতা ছিল অতল সমুদ্রের মতো। এ ব্যাপারে তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা লিখেছেন : ‘তিনি ছোটবেলা থেকে অত্যন্ত হৃদয়বান ছিলেন। তখনকার দিনে ছেলেদের পড়াশোনার তেমন সুযোগ ছিল না। অনেকে বিভিন্ন বাড়িতে জায়গির থেকে পড়াশোনা করত। চার পাঁচ মাইল পথ হেঁটে স্কুলে আসতে হতো। সকালে ভাত খেয়ে তারা স্কুলে আসত। আর সারাদিন অভুক্ত অবস্থায় অনেকদূর হেঁটে তাদের ফিরতে হতো। যেহেতু আমাদের বাড়িটা ছিল ব্যাংকপাড়ায় আব্বা তাদেরকে বাড়িতে নিয়ে আসতেন। স্কুল থেকে ফিরে দুধভাত খাবার অভ্যাস ছিল এবং সকলকে নিয়েই তিনি খাবার খেতেন। দাদীর কাছে শুনেছি আব্বার জন্য মাসে কয়েকটা ছাতা কিনতে হতো―কারণ আর কিছুই নয়। কোন ছেলে গরিব, ছাতা কিনতে পারে না, দূরের পথ রোদ বা বৃষ্টিতে কষ্ট হবে দেখে তাদের ছাতা দিয়ে দিতেন। এমনকি পড়ার বইও মাঝে মাঝে দিয়ে আসতেন।’ আলোচ্য গ্রন্থেও এরকম অসংখ্য ঘটনা রয়েছে।

১৯৩৮ সালের ১৬ জানুয়ারি বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক গোপালগঞ্জ মিশন স্কুল পরিদর্শনে এলে শেখ মুজিবের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। সে সময় বাণিজ্য ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীও সঙ্গে ছিলেন। কংগ্রেসের বাধা সত্ত্বেও কৃষক-প্রজা পার্টি ও মুসলিম লীগ তাদের সংবর্ধনার আয়োজন করে। শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্রদের নিয়ে তাঁদের সংবর্ধনার পক্ষে কাজ করেন। এ সময় স্কুলের ছাদ সংস্কারের দাবির ওপর ভিত্তি করে একটি দল নিয়ে এই নেতাদের কাছে তিনি যান, যার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি নিজেই। ১৯৩৮ সালে সরকারি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে স্কুল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে প্রতিবাদসভা করার দুঃসাহসের কারণে তিনি প্রথম কারাবরণ করেন। ১৯৪৩ সালে তিনি বেঙ্গল মুসলিম লীগে যোগ দেন এবং অগ্রণী বাঙালি নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্যে আসেন। এখানে তাঁর ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য বিষয় ছিল একটি পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন। ১৯৪৩ সালে খাজা নাজিমউদ্দিন প্রধানমন্ত্রী (মুখ্যমন্ত্রী) হলে, শহীদ সোহরাওয়ার্দী সিভিল সাপ্লাই মন্ত্রী হন। তখনকার পরিস্থিতি ছিল ভয়াবহ। দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছে। গ্রাম থেকে লাখ লাখ লোক শহরের দিকে ছুটেছে স্ত্রী-পুত্রের হাত ধরে। খাবার নাই, কাপড় নাই। এরকম পরিস্থিতিতে শেখ মুজিব ঘরে বসে থাকেননি। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান কিছুটা হলেও বাড়ানোর জন্য তিনি দিনরাত পরিশ্রম করেছেন। দাদুর কাছে মুগ্ধ জানতে চায়, ‘দুর্ভিক্ষ কী ?’ উত্তরে দাদু একদিকে দুর্ভিক্ষের স্বরূপ উন্মোচন করেছেন, অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর অবদান নিয়ে বলেছেন : ‘সে দুর্ভিক্ষে লক্ষ লক্ষ লোক মারা যায়। খোকা তখন কলেজের ছাত্র। খোকা আর খোকা নেই, পুরোদস্তুর শেখ মুজিবুর রহমান বনে গিয়েছেন। মানুষের দুঃখ-কষ্ট দেখে তিনি আর স্থির থাকতে পারলেন না। তিনি অন্যান্য ছাত্রকে সঙ্গে নিয়ে অনেকগুলো লঙ্গরখানা খুললেন। তিনি যে হোস্টেলে থাকেন সেখান থেকে বেঁচে যাওয়া খাবার এনে বুভুক্ষু মানুষকে খাওয়ান। নেতাদের কাছে ধরনা দেন সাহায্যের জন্য। রাতদিন ছুটাছুটি করতে থাকেন ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে এক মুঠো খাবার তুলে দেওয়ার জন্য। এ সময় মানুষকে সাহায্য করার জন্য তিনি এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েন যে পার্টি অফিসের বেঞ্চই হয় তাঁর ঘুমানোর জায়গা।’ উল্লেখ্য, তেতাল্লিশের সেই দুর্ভিক্ষে প্রায় তিরিশ লাখ লোক না খেয়ে মারা গিয়েছিল।

সে সময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা পৈশাচিক বিভীষিকার রূপ নিয়েছিল। উগ্র সাম্প্রদায়িক অপশক্তির ক্রীড়নকে পরিণত হয়েছিল সাধারণ মানুষ। ১৯৪৬ সালে কলকাতায় দাঙ্গার সময় শেখ মুজিবুর রহমান দাঙ্গা প্রতিরোধে এগিয়ে আসেন। তিনি নিজে লাঠি হাতে নিয়ে দাঙ্গাকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। ইসলামিয়া কলেজের সামনে একজন বিহারি মুসলমান একজন বাঙালি হিন্দুকে হত্যা করে। তিনি এ হত্যার প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, একজন বিহারি একজন বাঙালিকে হত্যা করেছে, এটা মেনে নেয়া যায় না। ১৯৪৬ সালেই তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, অবাঙালি মুসলমান বাঙালি মুসলমানদের বন্ধু নয়। এভাবে ইসলামিয়া কলেজ থেকে দাঙ্গা প্রতিরোধে নেতৃত্ব দিয়ে প্রগতিশীল ছাত্রগোষ্ঠীর অন্যতম প্রধান হয়ে উঠলেন তিনি। এই সময় সরকারের গোপন নথিতে লেখা হয় : ‘ংঁনলবপঃ (ঝযবরশয গঁলরনঁৎ জধযসধহ) ধিং ধহ রসঢ়ড়ৎঃধহঃ ংঃঁফবহঃ ড়িৎশবৎ ড়ভ ঃযব ঢ়ৎবঢ়ধৎধঃরড়হ ফধুং ধহফ ধ ঢ়ৎড়সরহবহঃ ষবধফবৎ ড়ভ ঃযব অষষ ইবহমধষ গঁংষরস ঝঃঁফবহঃং খবধমঁব.’  শেখ মুজিব তখন দলবল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন দাঙ্গা প্রতিরোধে। কে কোন সম্প্রদায়ের তার বাছবিচার করেননি। এই অকরুণ অমানবিক কাণ্ডের অভিশাপ চেতনায় বহন করে তিনি তখন আপন হৃদয়ের ধরাবাঁধা সীমা অতিক্রমের সাহস ও শিক্ষা দুই-ই অর্জন করেন।

বঙ্গবন্ধু ১৯৫৬ সালে মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খানের মন্ত্রিসভায় বাণিজ্য, শিল্প, শ্রম ও দুর্নীতিদমন বিভাগের মন্ত্রী হন। তিনি পাকিস্তানের আমলাতন্ত্র সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। উল্লেখ্য ১৯৫৪ সালে আমলাদের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণে এনে জনগণের কল্যাণের চেষ্টা করেছিলেন তিনি। ফল হয়েছিল উলটো। আমলাদের ষড়যন্ত্রে নারায়ণগঞ্জের আদমজী জুটমিলে বাঙালি-অবাঙালি বিরোধ লাগে এবং সেটা নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হওয়ার অভিযোগ এনে এরাই যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বরখাস্ত করার ব্যবস্থা করে। এরূপ অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু আমলাদের অযথা ফাইল আটকানো বন্ধের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন এবং একবার এক সিনিয়র অফিসারকে ডেকে বলেন, ‘শুনতে পাই আপনার কুড়ি বছরের অভিজ্ঞতা, কিন্তু আপনার যা চালচলন দেখতে পাচ্ছি, তাতে তো আমার মনে হয় যে, আসলে আপনার অভিজ্ঞতা এক বছরের, সেটাকে আপনি কুড়ি বছর ধরে টেনে চলেছেন।’ প্রখর ন্যায়নিষ্ঠা না থাকলে বঙ্গবন্ধু এমন মন্তব্য করতে পারতেন না।

১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন কায়েম করে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার আদলে শুরু করে শোষণ। ফলে বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালে প্রতিটি বাঙালির মুক্তির অঙ্গীকার ‘ছয় দফা’ ঘোষণা করেন। এতে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বার্থকে উত্থাপন করা হয়। এর ফলে আইয়ুব খান বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্নতাবাদী উল্লেখ করে তাঁর নামে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ আনেন। তিনি প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন, ‘মুজিব যদি যুক্তির ভাষা না বোঝেন, তাহলে তাঁকে অস্ত্রের ভাষায় শিক্ষা দেওয়া হবে।’ এর পরপরই বঙ্গবন্ধুর নামে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ দায়ের করা হয়। কিন্তু সামরিক জান্তার হুমকিতে টলার মতো ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু নন। ১৯৬৬-১৯৬৯ সালে কারাগারে রাজবন্দি থাকার সময়ও তিনি লিখেছেন : ‘গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে গণতান্ত্রিক পথেই মোকাবিলা করা উচিত। যে পথ তারা অবলম্বন করেছে তাতে ফলাফল খুব শুভ হবে বলে মনে হয় না।… এটা ক্ষমতা দখলের সংগ্রাম নয়, জনগণকে শোষণের হাত থেকে বাঁচাবার সংগ্রাম।’ বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য মানুষ রাজপথে নামে। সরকার বাধ্য হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে। আহমেদ ফরিদ মর্মস্পর্শী ভাষায় দাদুর মুখ দিয়ে বললেন : “২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ বঙ্গবন্ধুকে গণসংবর্ধনা দেয় রেসকোর্স ময়দানে। সেখানে সমবেত হয় লাখ দশেকের বেশি লোক। সেই সমাবেশে শেখ মুজিবুর রহমানকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেওয়া হয়। সেদিন থেকে তিনি হয়ে গেলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান―খোকা থেকে শেখ মুজিব―শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু।”

বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের সংগ্রামের মূল লক্ষ্য ছিল জনগণের ক্ষমতায়ন। তাঁর আপসহীন মনোভাবের জন্যই সামরিক শাসকরা শূন্যের ওপর ক্ষমতার প্রাসাদ নির্মাণ করতে ব্যর্থ হয়। দাবি না মানলে কোনও আলোচনা নয় জানিয়ে ৭ মার্চের ভাষণে তিনি বলেন, ‘ওই শহীদদের রক্তের উপর পাড়া দিয়ে আর.টি.সি.তে মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারে না।’ ‘সেদিন রেসকোর্সের মাঠ এবং শহরের সব জায়গায় হেলিকপ্টার গানশিপ ও সশস্ত্র আক্রমণের প্রস্তুতি নিয়েছিল পাকিস্তানিরা। কিন্তু তবু তাঁর কণ্ঠে ঘোষিত হয় ইতিহাসের অমোঘ নির্দেশ।’ তিনি বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ নীতির প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু আজীবন ছিলেন অবিচল এবং কখনই কোনও উদ্যত খড়গের সঙ্গেও তিনি আপস করেননি।

স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক চক্রান্তের লীলাক্ষেত্রে পরিণত হয়। দুর্নীতিবাজদের ব্যাপক দুর্নীতির জন্য বিদেশ থেকে আসা সাহায্য জনগণের কাছে পৌঁছুতে পারেনি। এসব থেকে দেশের মানুষকে বাঁচানোর জন্য, শোষণহীন সমাজ গড়ার জন্য পরীক্ষামূলকভাবে তিনি বাকশাল কর্মসূচি গ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’ কর্মসূচির কথা ঘোষণা করেন। ওই কর্মসূচির মধ্যে ছিল :

১. উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা;

২. জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা;

৩. দুর্নীতি, ঘুষ, কালোবাজারি, চোরাচালান প্রভৃতি সমাজবিরোধী কার্যকলাপ দমন করা;

৪. ঐক্যবদ্ধভাবে দায়িত্ব পালন করা।

বাকশাল কর্মসূচি গ্রহণের পর দেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার ধীরে ধীরে উন্নতি ঘটতে থাকে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামও কমতে থাকে। এতে করে জনমনে বইতে থাকে স্বস্তির সুবাতাস। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবার নিহত হলে এই কর্মসূচির বিলুপ্তি ঘটে। ঘাতকরা সেদিন ছোট্ট শিশু রাসেলকেও রেহাই দেয়নি। মহিতুল ইসলামকে জড়িয়ে ধরে রাসেল বলেছিল : ‘ভাই, আমাকেও কি ওরা মেরে ফেলবে ? আমাকে আমার মায়ের কাছে নিয়ে যান না একটু।’ ছোট্ট রাসেলের এরকম আকুতিতেও মন গলেনি খুনিদের।

বঙ্গবন্ধুর চিন্তাচেতনা, সমাজবোধ, অর্থনৈতিক ভাবনা―এই সবকিছুর পটভূমি হিসেবে উদ্ভাসিত ছিল নিঃস্বার্থ ভালোবাসা এবং অসীম সাহস। তিনি চেয়েছিলেন মানবাধিকার, সম্পদের সুষম বণ্টন। সেজন্য ‘শোষণহীন সমাজ’, ‘বৈষম্য দূরীকরণ’, ‘ভাগ্যহীনদের ভাগ্য উন্নয়ন’, ‘দরিদ্রদের অবস্থা পরিবর্তন’ এই কথাগুলো প্রায়ই বলতেন তিনি। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও তার পন্থাপদ্ধতি অনুসরণ করে বঙ্গবন্ধু এ দেশের বঞ্চিত ও পিছিয়ে পড়া মানুষের মনে স্বাধীনতা ও মুক্তির ছাপ এঁকে দেন গভীরভাবে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশবিরোধী শক্তির হাতে নৃশংসভাবে শহিদ হলেও তিনি সদা জীবন্ত; কারণ বাংলাদেশ ও শেখ মুজিব সমার্থক শব্দ। সুবিধাবঞ্চিত, শোষিত, নিষ্পেষিত, পিছিয়ে পড়া মানুষের পাশে দাঁড়ানোর অন্তহীন প্রেরণার উৎস হয়ে তাঁর স্মৃতি জ্যোতির্ময় শিখার মতো বেঁচে রয়েছে। আহমেদ ফরিদ তাঁর খোকা হলো জাতির পিতা গ্রন্থে গল্পই বলতে চেয়েছেন। কিন্তু লেখার মুন্সিয়ানা ও প্রতিভার বাঞ্ছিত সম্মিলনে গ্রন্থটি একাধারে হয়ে উঠেছে উপন্যাস ও ইতিহাসের আকর-উপাদান। আহমেদ ফরিদ যে-কৌশলে বঙ্গবন্ধুর বর্ণাঢ্য জীবন আর মর্মন্তুদ পরিণতিকে উপস্থাপন করেছেন, তা একজন কুশলী লেখকের কথাই বলে। সর্বযুগে সর্বকালেই সাহিত্য তার সামাজিক দায়বদ্ধতা পালনে স্বীকৃত। বর্তমান গ্রন্থটি এর নিজস্ব মাধুর্য নিয়ে সংবেদনশীলতা ও মানবিকতার ব্যঞ্জনা নিয়ে পাঠককে আলোড়িত করবে, এই আমাদের প্রত্যাশা।

 লেখক : প্রাবন্ধিক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button