আর্কাইভগল্পপ্রচ্ছদ রচনা

স্বকৃত নোমান : আত্মহত্যার আগে

আত্মহত্যাবিরোধী বিশেষ গল্প

শ্রাবণের প্রবল বৃষ্টির রাতে কোলবালিশে হেলান দিয়ে নাইপলের ইন আ ফ্রি স্টেট পড়ছিলাম। রাত তখন প্রায় দেড়টা। পড়তে বসলে মোবাইল সাধারণত সাইলেন্ট করে রাখি। সবার তো কাণ্ডজ্ঞান থাকে না। রাত তিনটায়ও কেউ ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করতে পারে, ‘আচ্ছা এটা কোথায় ?’ তখন কি মেজাজ ঠিক থাকে ?

সে ফোন দিয়েছিল ঠিক একটা একত্রিশ মিনিটে, ফাঁসির দড়ি গলায় পরে। মোবাইল বালিশের নিচে ছিল বলে খেয়াল করিনি। সময় দেখতে মোবাইলটি হাতে নিতেই দেখি তার এসএমএস। রাত তখন একটা সাঁইত্রিশ মিনিট। সে লিখেছে, ‘ভাইয়া, আপনি আমার কৃষ্ণকে ফিরিয়ে দিন, নইলে আমি বাঁচব না। আমার গলায় এখন ফাঁসির দড়ি। বলুন ফিরিয়ে দেবেন কিনা ? তাকে ছাড়া আমি এক মুহূর্তও বাঁচতে চাই না।’

আজব তো! কার কৃষ্ণ কে কাকে ফিরিয়ে দেবে! এসএমএসের মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে না পেরে দ্রুত ফোন ব্যাক করলাম। রিং হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রিসিভ এবং হাউমাউ কান্না। যতই কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করি ততই তার কান্নার গতি বাড়ে। যাকে বলে রাও ধরে কান্না। অগত্যা হাল ছেড়ে দিই। কাঁদুক। বর্ষণ প্রবল হলে ঝড় দুর্বল হয়ে পড়ে।

প্রায় দশ মিনিট সে কাঁদল। মোবাইলটি কানে ধরে রেখে শুনে গেলাম, একটি শব্দও উচ্চারণ না করে। যখন বুঝলাম কান্নার গতি কিছুটা কমে এসেছে তখন কারণ জানতে চাইলাম। বলতে গিয়ে সে আরও কয়েক মিনিট চালিয়ে গেল। তারপর বলতে শুরু করল, ‘আমার কৃষ্ণ…আমার কৃষ্ণকে…।’ শেষ করতে পারল না, আবার শুরু করল কান্না। কিছুটা বিরক্ত হলাম এবার। সে আমার কে লাগে যে এত রাতে টাকা খরচ করে তার কান্না শুনতে হবে ? মৃদু ধমক দিয়ে বললাম, আপনি এখন কোথায় ?

ফাঁসির টেবিলে।

আপনার গলায় ফাঁসির দড়ি ?

জি, ফাঁসির দড়ি। আমার কৃষ্ণকে ফিরিয়ে দেবেন কিনা বলুন, নইলে আমি এখুনি সুইসাইড করব।

ভারী তো বিপদ! সত্যি সত্যি যদি ঝুলে পড়ে রাজ্যের হ্যাপা সামলাতে হবে আমাকে। লাশ উদ্ধারের পর পুলিশ নিশ্চয়ই তার মোবাইলটি জব্দ করবে, কললিস্ট চেক করে প্রথমেই পাবে আমার নম্বরটি। তখন মুখোমুখি হতে হবে জেরার―মেয়েটি আপনার কী হয় ? আপনি তাকে কীভাবে চেনেন ? কতদিনের পরিচিত ? আত্মহত্যার আগে আপনাকে কেন ফোন দিয়েছিল ? আপনি কেন থানায় ইনফর্ম করলেন না ? এমনও হতে পারে পুলিশ আমাকেই হাতকড়া পরিয়ে আদালতে হাজির করে তিন দিনের রিমান্ড চাইছে। অথচ আমি তাকে ভালো করে চিনিই না। মাস তিনেক আমাদের অফিসে কাজ করেছিল। তাও পাঁচ মাস আগের কথা। হুট করে একদিন চাকরিটা ছেড়ে দেয়। অফিসে খুব একটা কথাবার্তা হতো না। আমি হেড অব মার্কেটিং অ্যান্ড ব্রান্ডিং আর সে জুনিয়র সেলস এক্সিকিউটিভ―বলার মতো কথা কিছু থাকত না।

দেখুন, ঘটনা কী তা আগে আমাকে জানতে হবে।

আমার কৃষ্ণ…আমার কৃষ্ণ।

কী হয়েছে তার ? একসিডেন্ট করেছে ?

আবারও সে কাঁদতে লাগল। কান্নার তোড়ে মুখের কথা হারিয়ে গেল।

তার সঙ্গে আপনার কতদিনের সম্পর্ক ?

প্রায় দুই বছরের। জানেন ভাইয়া, সে আমাকে বলেছিল পূর্ণিমার রাতে আলুটিলার চূড়ায় উঠে জোছনা উপভোগ করবে। আমি তার কোলে শুয়ে থাকব, সে আমার চুল টেনে দেবে, ভ্রƒ টিপে দেবে, চুমোয়া চুমোয় দুই গাল ভরিয়ে দেবে। কিন্তু সে…কিন্তু সে…আমার কৃষ্ণ…আমার কৃষ্ণ…। বলতে বলতে আবার কাঁদতে লাগল।

সে কি টিলার চূড়া থেকে পড়ে গেছে ? বেঁচে আছে, না মরে গেছে ?

না ভাইয়া, সে এখন আরেকটা মেয়েকে বিয়ে করে তার সঙ্গে বাসর করছে।

ও, এই তাহলে ঘটনা! এ তো নতুন কিছু নয়, যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। এ কারণেই আপনি সুইসাইড করছেন ?

তাকে ছাড়া এক দিন এক মুহূর্তও আমি বাঁচতে পারব না ভাইয়া। সে ছাড়া এই পৃথিবী শূন্য, সে ছাড়া কিসের মায়ায় আমি বেঁচে থাকব ? বলুন তাকে ফিরিয়ে দেবেন কিনা ? হ্যাঁ বা না বলুন। বলুন প্লিজ, নইলে এই আমি ঝুলে পড়লাম।

দাঁড়ান দাঁড়ান।

আমার কৃষ্ণকে ফিরিয়ে দেবেন ?

দেব, তবে একটি শর্তে।

কী শর্ত বলুন ভাইয়া, তার জন্য সব শর্ত মানতে রাজি।

আপনাকে একটি গল্প শুনতে হবে।

গল্প শুনতে হবে!

জি।

ওকে, আমি রাজি। শুরু করুন প্লিজ।

গল্পটা আমার এক কলিগের, মোমেনা, যার ত্বক ছিল ফর্সা, কিন্তু ফিগার খুব বাজে। বয়স প্রায় আটত্রিশের কাছাকাছি। অসম্ভব বদমেজাজি এবং গলাটা পুরুষালি। মাঝেমধ্যে অফিসে গান শোনাত আমাদের। নিজের কণ্ঠ নিয়ে অহংকারের অন্ত ছিল না। তার কণ্ঠে লালনের গান শুনে গোপনে আমরা হাসাহাসি করতাম। গান নয়, যেন রাজহাঁসের ডাক। চোখ বন্ধ করে যখন গাইত চ্যাপ্টা নাকটা আরও চ্যাপ্টা হয়ে যেত। তখন তাকে এতটাই কুৎসিত দেখাত, আমাদের অনেকে মুখ ফিরিয়ে নিত। যদিও তার ধারণা ছিল সে খুব সুন্দরী। শাড়ি পরলে কিছুটা সুন্দরী দেখাত বটে, কিন্তু যেদিন জিন্সের প্যান্ট, টপস আর হাইহিল জুতা পরত সেদিন তার দিকে আর তাকানোর ইচ্ছে হতো না। যেন একটা কাক লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটছে। সুইস পায়জামা আর কামিজে কিছুটা মানাতো, কিন্তু প্রায়ই অফিসে আসত পালাজ্জো আর কামিজ পরে। এই পোশাক তার বয়স বাড়িয়ে দিত, তবু এটাই তার প্রিয়। নারীদের বয়স আর পোশাক নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করা শোভন নয়, তবু একদিন আমাদের এক কলিগ হাসতে হাসতে বলে বসল, আপনাকে শাড়িতেই সুন্দর মানায় আপা।

মোমেনা হাসতে হাসতে বলল, শাড়ি পরে কি জিম করা যায় ? ডেইলি অফিস শেষ করে আমাকে জিমনেশিয়ামে যেতে হয়। শরীরটা যা বেড়েছে না! বুঝলেন, একশ বত্রিশটা ব্লাউজ অকেজো হয়ে পড়েছে।

বিয়ে করেছে প্রায় তেরো বছর আগে। সন্তানাদি কিছু হয়নি। এ নিয়ে অবশ্য তার মনস্তাপ ছিল না, তার স্বামীও তাকে কিছু বলত না, মাঝেমধ্যে শাশুড়ির বাঁকা-ত্যাড়া কথা শুনতে হতো, এই যা। স্বামীর চাকরি একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের পারচেইজ অফিসার পদে। সকাল সাড়ে সাতটায় বাসা থেকে বেরোত, ফিরত রাত আটটায়। তার ধারণা স্বামী তাকে অন্ধের মতো ভালোবাসে এবং তার বদমেজাজকে খুব ভয় পায়। আমাদের কাছে প্রায়ই তার গোবেচারা স্বামীর গল্প করত। জিমনেশিয়াম থেকে সে বাসায় ফিরত রাত নটায়। অফিস থেকে ফিরেই তার স্বামী রান্না-বাড়ায় লেগে পড়ত। সে শুয়ে শুয়ে টিভি দেখত অথবা বন্ধুদের সঙ্গে ফেসবুকে চ্যাটিং করত। সে নিজ থেকে না করলে স্বামী কখনই তাকে রান্নার কথা বলত না।

হ্যালো, শুনতে পাচ্ছেন ?

জি, পাচ্ছি।

আপনার গলায় কি এখনও ফাঁসির দড়িটা আছে ?

কেন থাকবে না ? আমার কৃষ্ণকে ফিরিয়ে দেবেন কিনা বলুন, নইলে এই আমি ঝুলে পড়লাম।

বলে সে আবার ফুঁপিয়ে উঠল।

আপনি কিন্তু শর্তের কথা ভুলে যাচ্ছেন।

ভুলছি না। আমাকে রেখে সে অন্য একটা মেয়ের সঙ্গে বাসর করবে কোনওদিন কল্পনাও করতে পারিনি। কত ভালোবাসত আমাকে। একদিন দশ বার কল দেওয়ার পরও আমি রিসিভ না করায় সে কী করেছিল জানেন ? একটা জিলেট ব্লেড কিনে বাঁ হাতের চামড়া কেটে বাংলা অক্ষরে আমার নাম লিখেছিল। দেখে আমার বুকটা ফেটে যেতে চাইল। গুলশানের ফুটপাথে প্রকাশ্যে তাকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কেঁদেছিলাম। যাই হোক, আপনি গল্পটা দ্রুত শেষ করুন প্লিজ, আমি আর বেঁচে থাকতে চাই না।

তা করছি। বেশিক্ষণ লাগবে না, একটু ধৈর্য ধরুন।

আমি আর সইতে পারছি না।

তা প্রায় এক বছর আগের কথা, আপনি তখনও জয়েন করেননি, একদিন মোমেনা অফিসে এল বারোটায়। এমনিতেই সে কখনও দশটার আগে অফিসে আসত না। সেদিন এত দেরি দেখে আমার মেজাজ চড়ে গিয়েছিল। ভেবেছিলাম দু-চারটা কড়া কথা শুনিয়ে দেব, কিন্তু তার সাজগোজ দেখে মেজাজ গলে গেল।

কেমন আছেন জাকির ভাই ?

আজ খুব খুশিতে আছেন দেখছি। ঘটনা কী ? ম্যারেজ ডে নাকি ?

আরে না, জন্মদিন।

তাই নাকি! হ্যাপি বার্থডে টু ইউ।

থ্যাংকু জাকির ভাই।

আগে জানলে তো আসার সময় ফুল আর কেক নিয়ে আসতাম।

আরে রাখেন তো ভাই। জানেন, সকালে আমি জীবনের সবচেয়ে বড় সারপ্রাইজটা পেয়েছি।

বাহ! কে দিয়েছে সারপ্রাইজটা ?

মোমেনা তার সারপ্রাইজের গল্পটি শোনাতে লাগল। জন্মদিন তো শুরু হয় রাত ঠিক বারোটায়। জন্মদিনের প্রথম প্রহরে শুভেচ্ছা জানাবে সবচেয়ে কাছের মানুষটি, সবাই এমনটাই আশা করে। অথচ সেদিন তার স্বামী খেয়েদেয়ে দশটার মধ্যেই শুয়ে পড়ল। রাতে তারা একই খাটে ঘুমায়, কিন্তু মোমেনার মন এতই খারাপ হয়ে পড়ল, এক খাটে দূরে থাক, এক রুমেই থাকতে ইচ্ছে করল না। কিন্তু ভাড়া বাসা, রুম মাত্র তিনটা। বাকি দুটোতে তার দেবর আর শাশুড়ি থাকে। অগত্যা সে খাটের নিচে বিছানা পেতে ঘুমাল। সকালে ঘুম থেকে উঠে নাশতা করে অফিসে চলে গেল তার স্বামী, তাকে জাগিয়ে একটিবার বলার প্রয়োজনবোধ করল না, হ্যাপি বার্থ ডে মোমেনা।

মোমেনার ঘুম ভাঙল ন’টার দিকে। স্বামীকে না দেখে তার বুকটা ভারী হয়ে গেল। ভারী স্বামীর জন্য নয়, জন্মদিনে তাকে শুভেচ্ছা জানায়নি বলে। মন এতটাই খারাপ হলো যে নাশতা না করেই অফিসে আসার প্রস্তুতি নিতে শুরু করল। মিরপুর বেনারসি পল্লী থেকে কেনা নীল শাড়িটা পরল। ঠোঁটে লিপস্টিক, চোখে আইলেনার, মাশকারা, আইশেড, কপালে টিপ লাগাল এবং কানে সোনার দুল, নাকে ডায়মন্ডের ফুল পরল। ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু জন্মদিন বলে কথা। বছরে মাত্র একটা দিন, মনে যত কষ্টই থাকুক, একটু সাজগোজ না করলে কি হয় ?

 সাজগোজ শেষ করে আবার যখন ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়াল হঠাৎ চোখে পড়ল ভাঁজ করা একটি কাগজ। ভাঁজ খুলে দেখল জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে তার স্বামীর লেখা চিঠি। একটানে পড়ে ফেলল এবং পড়ে তার কান্না পেল। বহু কষ্টে অশ্রু সংবরণ করল। জল গড়ালেই এত সময় নিয়ে এত সাজগোজ সব নষ্ট হয়ে যাবে। চিঠিটা পার্সে ঢুকিয়ে নতুন কেনা পেন্সিলহিল জুতাটা পরে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল।

ভাইয়া, আপনি কিন্তু গল্পটা দীর্ঘ করে ফেলছেন, আমি কিন্তু ঝুলে পড়ব।

গলায় এখনও দড়িটা আছে ?

দেখতে চান ? এই ঝুলে পড়লাম। বাই।

প্লিজ প্লিজ, আর সামান্য একটু বাকি, পাঁচ মিনিটের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে।

সেই পৌনে দুটা থেকে আমাকে এভাবে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন, এখন কটা বাজে জানেন ? একটু পর আপনার মোবাইলের ব্যালেন্স শেষ হয়ে যাবে।

হবে না, পোস্টপেইড।

গল্পটা শেষ করুন তাড়াতাড়ি, আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না।

নেমে পড়ুন না।

না, আমি বাঁচতে চাই না। আমার কৃষ্ণকে ছাড়া কী লাভ বেঁচে থেকে ? সে ছাড়া এ পৃথিবী আমার জন্য নরক।

আচ্ছা, তার বাড়ি কোথায় ?

নোয়াখালী।

আই সি।

মানে ?

মজিদের দেশের মানুষ, এমনটা করা খুবই স্বাভাবিক।

আপনার গল্পটা শেষ করবেন, নাকি ঝুলে পড়ব ?

ওহ স্যরি। চেয়ারে বসল মোমেনা, পার্স থেকে চিঠিখানা বের করে আমাকে দেখাল। বলল, শোনেন কী লিখেছে। বলেই পড়তে শুরু করল, ‘প্রিয় মোমেনা, জন্মদিনের অনেক অনেক শুভেচ্ছা। রাতে তুমি ঘুমিয়ে পড়ার পর আমি উঠে ডায়নিং রুমে বসে চিঠিটা লিখি। আজ তুমি আটত্রিশে পা দিলে। আমাদের বিয়ের বয়স আট বছর। তাই আমার কাছে আজ একটি বিশেষ দিন। তোমাকে আজ একটি সত্যি কথা বলি, আমার জীবনের চেয়েও তোমাকে বেশি ভালোবাসি। জীবনে আমি একবারই প্রেমে পড়েছি, তোমার। আমার জীবনে আর কখনও প্রেম আসবে না। তুমি ছাড়া আর কাউকে আমি কল্পনাও করতে পারি না। তুমি শুধু আমার, চিরদিন আমার বুকে থাকবে তুমি। মৃত্যু ছাড়া আমাদের প্রেম কেউ ভাঙতে পারবে না। তোমার জন্য নিরন্তর শুভকামনা, ভালোবাসা। আবারও জন্মদিনের শুভেচ্ছা।

পুনশ্চ : ‘রাতে আমি ইয়াম্মি থেকে কেক নিয়ে বাসায় ফিরব। নীল শাড়িটা পরে তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করো। আমি তোমাকে মন ভরে দেখব। ইতি, তোমার জীবন।’

হ্যালো, শুনতে পাচ্ছেন ?

জি, পাচ্ছি। গল্প শেষ হলো ? আমার কৃষ্ণকে ফিরে পাব কিনা বলুন।

নিশ্চয়ই পাবেন। গল্পের আরেকটু বাকি আছে। কিন্তু আমার মোবাইলের ব্যালেন্স শেষ, বোধহয় গল্পটা শেষ করতে পারব না।

 এ কি! আপনি না বললেন পোস্টপেইড ?

পোস্টপেইড, বাট লিমিট পাঁচ শ টাকা। একটু পর ক্রস করবে।

বুঝেছি, আপনি কোনও সমাধান দিতে পারবেন না। ওকে, আমি ঝুলে পড়লাম।

গল্পের শেষটুকু শুনবেন না ?

শুনতে তো চাই, কিন্তু কিভাবে ? আমার মোবাইলেও তো জিরো ব্যালেন্স।

ভোর হয়ে আসছে, ওয়াশরুমে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে নিন। আমি ঠিক সাড়ে পাঁচটায় চন্দ্রিমার মোড়ে আপনার অপেক্ষায় থাকব।

আপনিও আমার সঙ্গে প্রতারণা করছেন ?

মোটেই না। গল্পের শেষটুকু শুনিয়ে আপনাকে ছেড়ে দেব। রুমে ফিরে গিয়ে আপনি রশিটা গলায় পরে ঝুলে পড়বেন, কেউ বাধা দেবে না।

ওকে, আমি আসছি।

প্লিজ।

ঠিক পাঁচটা কুড়ি মিনিটে আমি চন্দ্রিমার মোড়ে গিয়ে দাঁড়ালাম। বৃষ্টিধোয়া সড়ক। ঠান্ডা বাতাস বইছে। ট্রাফিক পুলিশেরা তখনও এসে পৌঁছেনি। যাত্রীছাউনিটায় বন্দুক হাতে তিন পুলিশ বসে। রাতের ডিউটি ছিল হয়তো। রাস্তায় যানবাহনের সংখ্যা কম। শাঁই করে চলে গেল গুলিস্তান টু মিরপুরের একটা বাস। আমি খামারবাড়ি মোড়ের দিকে তাকিয়ে। সে আসবে রাজাবাজার থেকে।

ঠিক আট মিনিট পর একটা রিকশা এসে থামল। ভাড়া আমিই দিলাম। বিধস্ত তার চেহারা, দুই চোখ ফোলা, নিচে কালো দাগ। দেখে মনে হচ্ছে এখুনি আবার কেঁদে ফেলবে।

চলুন, উদ্যানের দিকে যাই।

এটা কিন্তু কথা ছিল না।

আরে চলুন তো, পনেরো মিনিটের মধ্যে ছেড়ে দেব।

ঠিক আছে, চলুন।

লেকের ধার ঘেঁষে আমরা হাঁটতে থাকি। পুলিশেরা আমাদের দিকে কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে। প্রায় তিন মিনিট হাঁটার পর দাঁড়াল সে। আমিও। বলল, গল্পের শেষটুকু বলুন এবার।

বিশেষ কিছু না, মোমেনা যখন আমাকে চিঠিখানা পড়ে শোনাচ্ছিল তার স্বামী তখন কী করছিল জানেন ? আমার এক বন্ধু সুন্দরবন হোটেলের ম্যানেজার। মোমেনার স্বামীকে চিনত সে। ঠিক তখনই সে ফোন করে আমাকে জানাল, মোমেনার স্বামী তখন তার এক গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে সুন্দরবনের কক্ষে শুয়ে।

কী ?

জি।

ছি!

কেন ?

মানুষ এতটা জঘন্য হতে পারে ?

মানুষ স্বভাবতই বহুগামী।

সে অ্যানথ্রোপলজির ছাত্রী, আমার কথা বুঝতে তার এক মুহূর্ত দেরি হলো না। হাত দুটো বুকের ওপর ভাঁজ করে ধীর পায়ে সে হাঁটতে লাগল। পাশাপাশি আমিও। হাঁটতে হাঁটতে আমরা বেইলি ব্রিজে উঠে দাঁড়ালাম। লেকের স্বচ্ছ জলে সূর্যের সোনালি কিরণ চকচক করছে, এক ঝাঁক পাখি উড়াল দিল আকাশে। লেকের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল সে। কী যেন ভাবছে। আমার চোখের দিকে তাকাতে বললাম তাকে। তাকাল সে। বললাম, সারা রাত বৃষ্টি হয়েছে, অথচ আকাশটা এখন কী নির্মল দেখুন, কোথাও এক ফোঁটা মেঘ নেই। কী পবিত্র ভোর। সবে মাত্র দিনের শুরু। আপনার সময়টাও তাই, মাত্র জীবনের শুরু। জীবন কিন্তু খুবই সুন্দর, তাই না ?

তার মুখটা ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, ঠোঁটে জাগে হাসির আভা। লেকের দিকে তাকিয়ে থাকল খানিকক্ষণ। তারপর দুহাত দুদিকে প্রসারিত করে হাসতে লাগল। সূর্যকিরণে চিকিয়ে উঠতে লাগল তার সাদা দাঁতগুলো।

সচিত্রকরণ : ধ্রুব এষ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button