আর্কাইভগল্পপ্রচ্ছদ রচনা

আশরাফ জুয়েল : নাওয়াল

আত্মহত্যাবিরোধী বিশেষ গল্প

হাউ টু প্রিপেয়ার ফর দ্যাট জব ? নিজের মুখোমুখি হওয়া, না মোটেও সহজ কাজ নয়। কাজটা এখন পর্যন্ত করে দেখা হয়নি। অনেক ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্তটা নিয়েছে সে। ভেতরে ভেতরে এক ধরনের বোঝাপড়া চলেছে। এই উদ্দেশ্যেই সে স্থিরচিত্তে দাঁড়াল বিশালাকৃতি আয়নার সামনে। শরীরের ভেতরেও থাকে আরেকটা শরীর, মনের শরীর, সেই শরীর অনুভূতির, অনুভবের―সে দেখে নিতে চায় তার মনের ভেতরের সেই শরীরটাকে, দেখে নিতে চায় সেই শরীরের আকাক্সক্ষা, অপ্রাপ্তি, দ্বেষ, কলুষতা। কিন্তু সে যা দেখতে চায় তা দেখতে পায় না, বরং তার দৃষ্টিজুড়ে শীতের একরোখা কুয়াশা ব্যতীত অন্য কিছুই দেখা যায় না, রক্তমাংসের শরীরটা মাঝেমাঝে স্পষ্ট হয়ে ভেসে উঠছে আয়নায়, তবে কি শরীরের ভেতরের শরীরটাকে দেখার জন্য কোনও বিশেষ দৃষ্টিশক্তি থাকা প্রয়োজন ? সেই দৃষ্টিশক্তি কি সে হারিয়ে ফেলেছে ? শরীরের ভেতরের শরীরে প্রবেশের অনুমতি সে পায় না, বাধ্য হয়েই দেখতে থাকে তার উনিশ বছর বয়সের রক্তমাংসের শরীরটাকে। চিকন চালের মতো ঠোঁট জুড়ে ভেসে আছে মদাক্ত আকাক্সক্ষা। অবহেলায় বয়ে চলা চিবুক যেন মিহি বালির ধারালো শাঁস। দীর্ঘদেহী গ্রীবা নেমে গেছে সদ্য গজিয়ে ওঠা পাহাড় অভিমুখে, পাহাড়ের গা জুড়ে রঙ-বেরঙের ফুল। বাহু দুটো খুঁজে নিচ্ছে প্রান্তিক সীমানা। না, কোথাও অতিরিক্ত কোনও ফ্যাট নেই। আগুনরঙা মসৃণ পেট যেন পুরাতন পেঁয়াজের খোসা। নাভিমূলে মুখ গুঁজে খেলা করছে সৌন্দর্য-লীলা। নিজেকে দেখে খুবই হতবাক হলো সে। সে নিজেই আন্দাজ করছে নিজ শরীরের উত্তাপ। ইটস ইম্পসিবল, এভাবে হয় না। ইটস বিং আ ভেরি টাফ জব টু টক উইথ উওন। একটা সিগারেট ধরানো প্রয়োজন। সিগারেটের প্যাকেটটা হাতে নিয়ে ধীর পায়ে বিছানার দিকে এগিয়ে যায় সে, টান হয়ে শুয়ে পড়ে বিছানায়। টারব্লক ব্র্যান্ডের সিগারেট ফিল্টারে সিগারেটটা গুঁজে দিয়ে সেটাকে দুই ঠোঁটের ফাঁকে ঠেসে ধরে, লাইটারটা জ্বালাতে গিয়েও কি ভেবে জ্বালায় না। ঠিক কী বিষয়ে গল্প করবে সে ? রি-উইন্ড করে দেখবে তার অতীত ? কিন্তু রি-উইন্ড করবে কোন অংশ থেকে ? তার জন্ম থেকে করতে পারে। চাইলে করতে পারে তার শিশুবেলা থেকেও। টিন এজের আরম্ভ থেকেও করা যায়। আর যৌবনকাল থেকে তো করাই যায়। প্রত্যেকটা অংশই আলাদা আলাদা, আনকমপ্লিট স্টোরি। বাট সি উ’ডোন্ট এক্সপ্রেস অল দ্য থিংস। যেটুকু না বললেই না সেটুকুই বলবে। মা মারা গেছিলেন তার জন্মের সময়। ড্যাড আর বিয়ে করেননি, বিয়ে না করে তার লাভই হয়েছে। হি ইজ আ ব্লাডি বুলশিট, খুব খারাপ একজন মানুষ। নিজের বাবা সম্পর্কে বাজে বলা হচ্ছে ? বাট দ্যাট ক্রুয়েল ম্যান ডিসার্ভ ইট। দ্যাট ম্যান জাস্ট কিলড হিজ ওয়াইফ। ওনলি হি নোজ এবাউট হিজ ওয়েলথ, দ্য সোর্স অব হিজ ইললিগ্যাল প্রোপার্টিজ। নাওয়াল নিজেও জানে না তারা কী পরিমাণ রিচ। একচুয়ালি সি ডিড ডোন্ট ওয়ান্ট টু নো। বাবা তার জীবনের জন্য অভিশাপ, কতবার যে সে বাবাকে মেরে ফেলতে চেয়েছে, মরতে চেয়েছে নিজেও। কিন্তু মৃত্যুও তাকে নেয়নি।

নাওয়ালের বেডরুমটা সাদা ওয়ালম্যাট দিয়ে মোড়ানো। বেডরুমটা বলতে ঘরের ওয়াল-ফ্লোর সব। এ রুমের বাসিন্দা সাকুল্যে তিন জন―নাওয়াল নিজে, একটা কিং সাইজের বেড সঙ্গে ড্রেসিং আয়না। অনিয়মিত বাসিন্দা হিসেবে খুব দুর্নাম তার। ধুর কিছুই ভালো লাগছে না―নিজের সঙ্গে কম্যুনিকেট করার সুযোগ কি তার কোনওদিনই হবে না ? 

ব্লাকবেরি ডিটিইকে-৫০ মডেলের মোবাইলটা হঠাৎ ম্যালেরিয়া জ্বরের রোগীর মতো কেঁপে উঠল। কে আবার কল দিল এই অসময়ে, এত রাতে ?’

‘হ্যালো, ইয়েহ, ওহ ডুড! এই সময়ে ?’ নিরাভরণ শরীরে সাদা রঙের গাউনটা গায়ে জড়াতে জড়াতে বলল নাওয়াল।

‘ইয়েহ বেবি, কাম অন, হারি আপ, হারি।’

‘ক্যান ইউ সে হোয়াট হ্যাপেন্ড ? ডিয়ার।’

‘এখুনি বেরিয়ে আয়, আই অ্যাম ওয়েটিং। ’

‘হ্যাভ উ এনি আইডিয়া ? হোয়াট টাইম ইট ইজ ? বাজে ছেলে!’ নাওয়ালের কৌতূহলোদ্দীপক কণ্ঠ।

‘নো প্রব বেব্বি, কাম অন, প্লিজ।’ বিপরীত দিকে উত্তেজিত সাইমন।

কী এমন হলো এই মধ্যরাতে! নিশ্চয়ই কোনও নিউ ওয়াইল্ড এডভেঞ্চারের খোঁজ পেয়েছে। একটা ইয়োলো কালারের টি-শার্ট পরল নাওয়াল। সঙ্গে ব্ল্যাক কালারের ব্রুক শিল্ড’স জিনস। মানিব্যাগ, মানিব্যাগে সবসময়ই টাকা থাকে তার। টাকা না থাকলে কার্ড তো আছেই। নাওয়ালের বাবা এসব ব্যাপারে খুবই লিবারেল। লিবারেল হবেনই না বা কেন ?

‘কি রে কই তুই ? আয় জলদি।’ সাইমনের যেন তর সইছে না আজ। হোয়াট হ্যাপেন্ড উইথ দিজ ক্রেজি গাই। কে জানে কী হয়েছে আজ ওর।

‘ফুফুম্মা, আই অ্যাম গোয়িং উইথ সাইমন।’ সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে কথাগুলো বলল সে। ডুপ্লেক্স বাড়ির দোতলায় নাওয়ালের শোবার ঘর। ঠিক পাশের ঘরেই থাকেন তার ফুফুম্মা।

‘কখন ফিরবি, বলে যা মা’ বিব্বি―কঁকিয়ে উঠল ফুপি-মা, তার ঘর থেকেই।

‘আই ডোন্ট নো, প্লিজ ডোন্ট ওয়েট ফর মি, বেবি ঘুমিয়ে যেও তুমি।’ ওদিকে অনবরত ফোনে কথা বলছে সাইমন। সাইমনের কথাতে অবশ্য এখন মনোযোগ নেই। সে এখন কথা বলছে ফুফিম্মার সঙ্গেই।

‘তোমার বাবা কিন্তু আজ তাড়াতাড়ি ফিরবে। চলে এসো বিব্বি’, এত রাতে বাইরে ? বাসাতে সবাই তাকে বিব্বি বলেই ডাকে। বন্ধুরাও সবাই এই নামেই ডাকে তাকে।

 হু কেয়ারস ফুফুম্মা। তুমি তো জানোই। ঝড়ের বেগে দৌড়ে বেরিয়ে যায় নাওয়াল।

হোয়াট অ্যা প্লিজ্যান্ট সারপ্রাইজ ইট ইজ ? সাইমন ছাড়াও আরও তো অনেকেই এসেছে। নাওয়ালকে দেখেই সবাই একসঙ্গে চিৎকার করল। হোন্ডা সিআরভি-র পেছনের ডোর খোলা। ড্রাইভিং সিটে সাইমন নিজে, ভেতরে গাদাগাদি করে বসে আছে রহিয়া, সিনথিয়া, ইমরোজ, আনিফ। সামনের সিটে গাড্ডু নিখিল। ও একটা আস্ত শয়তান, ভীষণ ফাজিল।

‘হাই বিব্বি, ইউ আর লুকিং ইরোটিক’―পেছনে তাকিয়ে বলল নিখিল।

‘ইউ বিচ, তোর ধান্দা তো এদিকেই’, বলল সিনথিয়া, তার মুখে কপট হাসি।

‘ইনফ্যাক্ট ইউ অল গার্লজ লুকিং সেক্সি।’ নিখিল মানেই এমন, অলওয়েজ ধান্দাবাজ, দুষ্টু।

‘হোয়ার উই আর গোয়িং, প্লিজ মেক মি ক্লিয়ার।’ সাইমনের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলল নাওয়াল।

‘গোয়িং টু টেস্ট আ নিউ এক্সপিরিয়েন্স’ ড্রাইভিং সিটে বসে আছে সাইমন, হাসছে।

‘মিনস হোয়াট’, কী হতে যাচ্ছে বলত ? ব্লাডি ফাকার। সিনথিয়া বলে উঠল পেছনের সিট থেকে।

‘মানে তুইও জানিস না’, কিরে রহিয়া ? শালা তোকে দেখে তো সেইরকম লাগছে।

১২৯ নাম্বার রোড থেকে বেরিয়েছে গাড়িটা। গুলশান এক নম্বর থেকে ইউটার্ন নিয়ে ছুটে যাচ্ছে দুই এর দিকে। এই মধ্যরাতের রাস্তাটা চুপচাপ উদাসীন, বড়লোকের বাড়িগুলোর আশপাশে থাকতে থাকতে ওরাও বড়লোকদের মতোই হয়ে গেছে, ব্যতিক্রম শুধু ফাস্টফুডের দোকান, রেস্টুরেন্টগুলো, ফাস্টফুডের দোকানগুলোর সামনে সারি সারি প্রাইভেট। কোথায় যে যাচ্ছে এরা, কে জানে ? মিনিট সাতেকের ভেতর গাড়ি থামাল সাইমন।

‘এই নাম, নাম, হারিআপ, প্লিজ।’ গাড়িটা পার্ক করানোর সময় পর্যন্ত নাই।

‘হোয়াট ইজ গোয়িং টু বি হ্যাপেন ?’

‘হবে হবে, আগে নাম তো, আ বিগ সারপ্রাইজ!’

গাড়ি থেকে সবাই হুড়মুড় করে নামল। তাড়াহুড়া করে ঢুকে পড়ল বনানীর এগারো নাম্বার রোডের হোটেল বারিন্দে।

দুই

লাইফ ইজ এক্সট্রিমলি বোরিং। যখন যেখানে যেতে ইচ্ছা করছে যাচ্ছে, যখন যা করতে ইচ্ছা তাই করেছে। এই তো গত মাসেই স্টেটস থেকে ফিরে এসেছে নাওয়াল। ড্যাড নামের মানুষটি এসবে কখনও বাধা দেননি। ইনফ্যাক্ট এই লোকের সেই সাহস নেই। মা বেঁচে থাকলে কি এমন হতো ? মাঝে মাঝে আত্মহত্যার কথা ভাবে নাওয়াল কিন্তু ফুফুম্মাকে ফেলে কোথায় যাবে সে ? 

‘বিব্বি, কী ভাবছিস মা, ঘুমাবি না ?’ এত রাতে ফুপুম্মা জেগে আছে কেন ? এলোমেলো ভাবনাগুলোকে নিজের ভেতরে গিলে নেয় নাওয়াল।

‘তুমি এত রাতেও ঘুমাওনি, ফুপুুম্মা!’ বিস্ময়ের ঢেউয়ে নিজেকে ঠেলে দেয় নাওয়াল।

‘নারে ইদানীং ঘুম পায় না কিছুতেই।’

‘তুমি তো আমার কথা নকল করছো।’

‘তোর কথাই তো আমার কথা রে।’

‘ও মাই বেবি, কি পেলে জীবনে ?’

‘জীবন! তুই জানিস জীবন মানে কি ?’ শ্লেষ মেশানো কণ্ঠে কথাগুলো বলেন হালিমা।

‘বেবি, এই আমার জীবনের কথাই ভাবো। মা মারা গেল আমার জন্মের সময়েই। ড্যাড থেকেও নেই।’

‘বিব্বি, মা আমার। সোনা মা, জীবন অনেক সুন্দর।’ নাওয়ালের মাথায় বিলি কেটে দিতে দিতে কথাগুলো বলে হালিমা।

‘আচ্ছা তুমি আর বিয়ে না করে এ বাড়িতে থেকে গেলে ক্যানো ? হোয়াই ?’

‘মারে, তোর মা মারা যাবার সময় তোর বয়স মাত্র সাড়ে সাত মাস। তোর নানা-নানিও বেঁচে ছিলেন না। কার কাছে ফেলে যেতাম তোকে ? আমার সোনা বিব্বিটা, ঘুমাও। আমি তোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। ঘুমা সোনা। মা আমার।’

নাওয়াল ঘুমানোর ভান করে, কারণ সে ভালো করেই জানে সে না ঘুমানো পর্যন্ত এই মহিলা সারারাত তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই থাকবে। খামোখা তাকে কষ্ট দিয়ে লাভ কী ? তার চেয়ে ঘুমানোর ভান করলে কিছু সময় পর এমনিতে ফুফুম্মা তার নিজের ঘরে চলে যাবে। ফুফুম্মার কথা ভেবে অবাক হয়ে যায় নাওয়াল। শুধু নাওয়ালের কথা ভেবেই ফুফুম্মা এই সংসারে থেকে গেছেন, নিজের কথা এতটুকুও ভাবেননি। কিছু কিছু মানুষ ক্যানো এমন হয়, অন্যের জন্য সবকিছু বিলিয়ে দেয়! বাবা-মায়ের বিয়ের প্রায় এগারো বছর পর নাওয়ালের জন্ম। ফুফুম্মার কাছে শোনা, নাওয়ালের বাবা চাকুরি করত। সরকারি চাকুরি। আর্কিটেক্ট। হঠাৎ তার মাথায় ব্যবসার ভূত চাপে। গভর্নমেন্ট জব ছেড়ে উনিশ শ ঊননব্বই সালের দিকে তিনি ব্যবসা আরম্ভ করেন। ডেভেলপারের ব্যবসা। বুয়েট থেকে পাস করা মেধাবী জালাল উদ্দিন পাটোয়ারী খুব অল্প দিনেই ব্যবসায় ভালো করতে থাকেন। ধীরে ধীরে তিনি ব্যবসার পরিধি বাড়াতে থাকেন, অর্থের নেশা পেয়ে বসে তাকে। বৈধ-অবৈধ উপায়ে তিনি বছর বিশেকের মধ্যেই দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান। বর্তমানে প্রায় পনেরোটি ছোট-বড় প্রতিষ্ঠানের মালিক তিনি। টিভি চ্যানেল, পত্রিকার মালিকানা, সিমেন্ট ফ্যাক্টরি, গার্মেন্টস ব্যবসা, শেয়ার বাজার, ম্যান পাওয়ার রিক্রুটিং এজেন্সি বহুবিধ ব্যবসায় নিজেকে জড়িয়েছেন তিনি। সন্তান জন্ম দেওয়া খুব সহজ কাজ, যদিও জালাল আর মাধবী দম্পত্তিকে সন্তান পাবার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে প্রায় এগারো বছর। কত আদরের সন্তান, কত আরাধনার সন্তান। নাওয়ালের জন্মের মাত্র সাড়ে সাত মাসের মাথায় মারা যান মা। সম্ভবত পোস্টপারটাম কার্ডিওমায়োপ্যাথি নামের অসুখ হয়েছিল মায়ের। নাওয়ালের জন্মের পরপর একটু নড়াচড়া করলে বা একটু পরিশ্রম করলেই খুব শ্বাসকষ্ট হতো মায়ের। বাবা মায়ের কষ্টকে গুরুত্ব দেয়নি, টাকার পেছনে ছুটতে ছুটতে সে ততদিনে অন্ধ হয়ে গেছিল। প্রচণ্ড শ্বাসকষ্টে মারা যান মা, হাসপাতালে পর্যন্ত নেওয়ার সময় পাওয়া যায়নি। বড় হতে হতে এ কথাগুলো সে শুনেছে ফুফুম্মার কাছে। মা মারা যাবার পর বাবা আরও ব্যবসামুখী হয়ে পড়ে, জড়িয়ে পড়ে অবৈধ সম্পদ আহরণের দিকে, নারীসঙ্গ আর নেশায় ডুবে যায় সে। টাকা দেওয়া ছাড়া নাওয়ালের প্রতি কোনও দায়িত্বও পালন করেনি বাবা! সন্তান জন্ম দিলেই তো কেউ বাবা হয়ে যায় না, বাবা হওয়া খুব কঠিন কাজ। বাবা যেমন বাবা হয়ে উঠতে পারেনি, তেমনি নাওয়াল নিজেও সুসন্তান হয়ে উঠতে পারেনি। ইচ্ছামতো টাকা উড়িয়েছে, নেশা, পার্টি, সম্পর্কে জড়িয়েছে, ভেঙেছে, কয়েকবার আত্মহত্যা করার চেষ্টাও করেছে, সেই চেষ্টা সফলতার মুখ দ্যাখেনি, হাসপাতালে ভর্তি হতেও হয়েছিল একবার।

তিন

পার্টিটা অসাম। পুরো পার্টি স্পন্সর করেছে সিনথিয়া। সিসার সঙ্গে আফিমের নেশাটাও জমেছে খুব। বাকার্ডি, কোরিয়ান রাম, স্ম্রিনফ ভদকা, সানরাইজ টাকিলা আরও কী কী যেন আছে মেন্যুতে, সবাই যার যার পছন্দমতো ড্রিঙ্ক করছে। রহিয়ার পকেট থেকে বেরিয়েছে একগাদা ইয়াবা। রহিয়া, সিনথিয়া, ইমরোজ, আনিফসহ বন্ধুদের প্রায় সবাই সারারাত হোটেলেই, ডি-জে পার্টিটাও সেইরকম, কুল! নাওয়ালও মেতে উঠেছে। বন্ধুরা যে যার সঙ্গে ইচ্ছামতো ড্যান্স করছে, এসব পার্টিতে কোনও বাইন্ডিংস থাকে না, এমনকি কেউ বিছানায় যেতে চাইলে তার ব্যবস্থাও থাকে। যার যা ইচ্ছা তাই করা যায়, কেউ কাউকে নিষেধ করতে পারবে না, এটাই শর্ত। নাওয়ালও এনজয় করছে খুব, ফুফুম্মা ফোন করছে বারবার, কিন্তু সবাইকে ছেড়ে বাসায় যেতেও ইচ্ছা করছে না নাওয়ালের। পার্টিতে সিনথিয়ার সঙ্গে একটি ছেলে এসেছে, সম্ভবত সিনথিয়ার কাজিন। এমন কোনও পার্টি নেই যেখানে নাওয়ালকে নিয়ে এক্সট্রা ইন্টারেস্ট শো করে না ছেলেগুলো। আর এখনও পরিচয় করিয়ে দেয়নি সিনথিয়া, মাদার ফাকার মনে হয় নিজের কব্জায় রাখতে চায়। মেজাজ ঠিক রাখতে পারছে না নাওয়াল, মাঝে আনিফ ড্যান্স করার জন্য টানাটানি করছিল। নাওয়াল একটু দূরে বসেছিল, এক প্রচুর ড্রিঙ্কস করছে সে, সিনথিয়ার কাজিন একে ওকে জড়িয়ে ড্যান্স করছে, আর রহিয়া! ‘আ হোর’, ছেলেটির সঙ্গে লেপ্টে আছে পুরোটা সময়। ছেলেটিকে দেখেই নাওয়াল বুঝেছে এ ছেলে কোনও একজন মেয়ের সঙ্গে আটকে থাকার ছেলে নয়। তাই বলে একবারও নাওয়ালের দিকে তাকাবে না! অ্যাবস্যার্ড, হতেই পারে না। একবার ইচ্ছা হচ্ছিল রহিয়াকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে ছেলেটির সঙ্গে ড্যান্স করতে, কিন্তু খুব ইগোইস্টিক নাওয়াল। সে আরও মদ খাবে, মদে ডুবে যাবে কিন্তু কিছুতেই নিজে থেকে গিয়ে পরিচিত হবে না, না কিছুতেই না। ‘অল ব্লাডি আর মাদার ফাকার।’ মদের নেশায় জড়িয়ে যাওয়া শব্দগুলো হারিয়ে  গেলো ডিজে মিউজিকের ভিড়ে। 

‘ডু ইউ ওয়ান্না সেক্স উইথ মি ? বেবি, হেই, ইয়েস ইউ! বাট নট টু ডে, এনাদার ডে, প্লিজ গো টু ইয়োর হোম, ন্যাও, ইউ হ্যাভ ড্রিঙ্ক আ লট, ইউ হ্যাভ ভমিটেড।’ রহিয়ার লিপসের সঙ্গে সেঁটে থাকা ছেলেটি, হ্যাঁ, সিনথিয়ার কাজিনই তো। কথাগুলো বলেই সে আবার জমে গেলো রহিয়ার ঠোঁটে।

‘মানে কী ? নিজেকে কী ভেবেছে সে! সান অফ আ বিচ, ব্লাডি, বুলশিট, তোকে দেখে নেবে আমি। আর ও কীভাবে জানল যে আমি বমি করেছি ? আমি তো একা একা ফ্রেশ রুমে গিয়ে ভমিট করলাম ? তাহলে ? কথাগুলো শব্দ হয়ে উচ্চারিত হবার আগেই আরেক পেগ মদ গলায় ঢেলে দিল নাওয়াল। মেজাজ ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না, ইচ্ছা করছে উঠে গিয়ে ওর শার্টের কলার ধরে ইচ্ছামতো থাপড়াতে, কিন্তু পারছে না, ওর পা দুটো সায় দিচ্ছে না।

নাওয়ালের যখন ঘুম ভাঙল তখন ঘড়িতে দুপুর আড়াইটা। পাশে বসা ফুফুম্মা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, ঠিকমতো চোখ তুলে তাকাতেও পারছে না সে। চারপাশ কেমন যেন ধোঁয়া ধোঁয়া, আবছা, তার জীবনের মতোই, ফুফুম্মার জীবনের মতো, কেমন যেন ঘোলাটে।

‘ফুফুম্মা আমি কোথায় ? কটার দিকে বাসায় ফিরেছিলাম ? ঘুম ঘুম কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল নাওয়াল।’

‘রাত তিনটার দিকে, তোর মোবাইল থেকে একটা ফোন এল, তোর বন্ধু সম্ভবত, কী যেন নাম ? হ্যাঁ, মনে পড়েছে, মিনহাজ, হ্যাঁ মিনহাজই, বলল আন্টি ড্রাইভার পাঠিয়ে দিন, নাওয়াল আজ একটু বেশিই ড্রিঙ্কস করেছে, কয়েকবার বমিও করেছে, ওর বাসায় যাওয়া প্রয়োজন। ছেলেটি ভেবেছে আমি তোর মা!’

‘তুমি তো মা-ই, আর মিনহাজ ? এ নামে তো আমার কোনও ফ্রেন্ড নেই, হু দ্য হেল ওয়াজ দিস ?’

‘কী বলিস ? পরে আবার ফোন করে জিজ্ঞেস করল, আন্টি, নাওয়াল ঠিকমতো বাসায় ফিরেছে ? ওকে গাড়িতে তুলে দিয়েছিলাম তো! আমি হ্যাঁ বলতেই কেটে দিল।’ ফুফুম্মার মুখে বিস্ময়।

‘মানে ? শালা কি ঐ মালটা ? মানে সিনথিয়ার কাজিন ? না, হতেই পারে না।’ মনে মনে কথাগুলো আওড়াল নাওয়াল। নাম্বারটা তো আছে, ফ্রেশ হয়ে নিয়েই কল দিতে হবে, তার আগে সিনথিয়ার সঙ্গে কথা বলা প্রয়োজন।

‘বিব্বি, মা আমার নেশাটেশা ছেড়ে দে মা। জীবন অনেক সুন্দর। একে হেলায় হারাস না। কিছুতেই হারাস না মা। তোর মা সব দেখছে। সে কষ্ট পাবে।’

‘বেবি, আমার ডারলিং, আমি আরও নেশা করব, আমার কেউ নেই, কেউ আমাকে ভালোবাসে না, মা ক্যানো আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। আমার কী দোষ ছিল, আমি কি জন্মেই পাপ করেছি ? আর ঐ যে লোকটা! আমি হারিয়ে যাব,’ কথাগুলো বলতে বলতে হালিমার কোলে মাথা গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে নাওয়াল।

ফুফুম্মা আজ নাওয়ালের পছন্দের খাবার রান্না করেছে। তার টানাটানিতেই বিছানা থেকে উঠে শাওয়ার নিতে যায় নাওয়াল। শাওয়ার নেবার পর থেকে শরীরটা খুব ঝরঝরে লাগছে, খিদেটাও চনমন করে উঠেছে। সবসময়ই ফুফুম্মাই তাকে তুলে খাইয়ে দেয়। এই মহিলাকে দেখেই নাওয়াল বুঝতে পারে মায়েরা মনে হয় এমনই হয়। কত যত্ন আরা ভালাবাসায় নাওয়ালকে আগলে রেখেছে ফুফুম্মা, কোনও স্বার্থ ছাড়া। জীবনে কোনও কিছু পাবার আশা করে না এরা, শুধু অন্যকে দেবার জন্যই যেন জন্ম হয়েছে এইসব মানুষের। মাঝে মাঝে ফুফুম্মার মতো ভালো মানুষ হয়ে যেতে খুব ইচ্ছা হয় নাওয়ালের।

চার

‘হেই বিচ, সিনথিয়া ? ওয়াজ দ্যাট ইয়োর স্টুপিড কাজিন ?’ ‘এসওবি’ ও তো একটা হারামি, কাল পার্টিতে কী বলেছিল জানিস ? প্রায় চিৎকার করেই কথাগুলো বলল নাওয়াল।

‘হ্যাঁ জানি তো, তোর সঙ্গে বেড শেয়ারের প্রপোজাল দিয়েছে, হি ইজ জিনিয়াস ইন দ্যাট বিজনেস’ ওপার থেকে সিনথিয়ার ঠান্ডা মাথার জবাব।

‘আই উইল কিল দ্যাট ব্লাডি, জারজ একটা। সে আমাকে এ কথা বলার সাহস পায় কোথা থেকে ?’ সিনথিয়ার চিৎকার এবার রাগে টার্ন নেয়। রাগে কাঁপতে থাকে নাওয়াল।

‘ওহ, ইজ ইট ?’ তুই আবার কবে থেকে তুলসি পাতা ধোঁয়া পানি হয়ে গেলি ? মনে হচ্ছে তুমি কারও সঙ্গে বিছানায় যাও না ? ওপাশ থেকে ভেসে আসে সিনথিয়ার ঠাট্টামিশ্রিত কণ্ঠ।

চুপসে যায় নাওয়াল, সত্যি তো সে নিজেও তো শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়েছে। ফিজিক্যাল রিলেশন তাদের ফ্রেন্ড সার্কেলের কাছে গাঁজা, হেরোইন, ড্রিঙ্কস, ইয়াবাসহ এন্টারটেনমেন্টের আর পাঁচটা উপাদানের মতোই, যে কেউ যখন খুশি যেভাবে খুশি নিজেকে ইউজ করছে, ইউজড হচ্ছে।

‘ইউ আ্যশ হোল, দ্যাট মিনস তুইও তোর কাজিনকে সাপোর্ট করছিস, বাই দ্য ওয়ে হারামিটার নাম কি ? মিনহাজ ?’

‘হি ইজ আ জেনুইন ম্যান, লেগে যা, ইউ উইল বি আম্যাইজড!’

‘মানে তুইও ? দাঁড়া হারামিটাকে আমি দেখে নেব, বলত নেক্সটে কে পার্টি থ্রো করছে ? প্রতিশোধের তীব্র আগুনে জ্বলছে নাওয়াল, মন মনে ভাবছে একে ছাড়া যাবে না, এমন প্যাঁচে ফেলবে যে হাঁসফাঁস করতে করতে মরবে।’

‘ওর নিজের একটা ফ্ল্যাট আছে গুলশান একাত্তর নাম্বার রোডে, একা থাকে, চাচ্চুর সঙ্গে বনিবনা হয় না বলে চাচ্চু ওকে এই ফ্ল্যাট দিয়েছে, ওটা ওর পারসোনাল ওয়ার্ল্ড, কাউকে নেয় না ওখানে, কাউকেই না।’

‘তো আমি কী করব ? ওকে আমি দেখে নেব।’

‘নেক্সট পার্টি থ্রো করছে আনিফ, মিনহাজ থাকছে ওখানে।’

মনে মনে প্লান আঁকে নাওয়াল। কীভাবে ঘায়েল করা যায় মিনহাজকে, নিজেকে খুব স্মার্ট ভাবছে সে, নাওয়ালও কম যায় না, মিনহাজকে সবার সামনে অপমান না করলেই নয়, এ তার প্রতিজ্ঞা। আরেকটা প্রশ্ন মনের ভেতর ঘোরপাক খাচ্ছে নাওয়ালের, কী ভেবে ছেলেটি গাড়িতে উঠিয়ে বাসায় পাঠিয়েছিল তাকে ? কিছু কিছু প্রশ্নের উত্তর হয়তো কোনও দিনই মিলবে না, মেলে না।

আজকে আনিফের পার্টি, জমবে খুব। আজ নাকি সেই মিনহাজ না ফিনহাজ ছেলেটাও আসবে, আজকেই কোপটা মারতে হবে। নাওয়াল আজ ইচ্ছা করেই পোশাকের ব্যাপারেও খুব উদার, তার রূপ দিয়ে আজ মিনহাজকে ঘায়েল করবে, যেভাবেই হোক। প্লান মোতাবেক সে পৌঁছে যায় পার্টি ভেন্যু হোটেল ওয়েস্টিনে, পুলসাইডে পার্টি। ততক্ষণে অনেকেই এসে পৌঁছে গেছে, নাওয়াল পৌঁছানো মাত্রই বন্ধুদের মাঝে একটা হুল্লোড় পড়ে গেল।

‘হাই ড্যুড, ইউ আর লুকিং সো ইরোটিক। আজ থাকবি ? স্যুট বুক করা আছে। জমবে কিন্তু। সেইরকম!’ ইমরোজ অনেকটা দৌড়ে এসে হাগ করল নাওয়ালকে, কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল কথাগুলো।

একটু হাসল নাওয়াল, এই হাসির অর্থ হ্যাঁ হতেও পারে, না হতেও পারে। নাওয়াল মুহূর্তের মধ্যে চোখ বুলিয়ে নেয় পুরো হল রুমটায়। তার চোখ খুঁজছে অন্য কিছু, অন্য কাউকে। আজ তাকে একটা শিক্ষা দিতে হবে।

‘এই যে সোনামণি, খুব তো সেজেগুজে এসেছো, ঐ দ্যাখো।’ পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কথাগুলো বলে সিনথিয়া।

‘দ্যাখ কী হাল করি আজ, আই উইল ব্লাস্ট দ্যাট ডার্টি ব্লাডি।’ রাগটাকে চেপে মুখের হাসিটা ধরে রাখার চেষ্টা করে নাওয়াল।

যা ভেবে এসেছিল তার কিছুই হলো না আজ। কোনও সুযোগই পেল না সে। মিনহাজ আজ চুপচাপ বসে থাকল, নাওয়াল খেয়াল করল পুরোটা সময়, না, একবারও ড্রিংক্স করেনি, কাউকে জড়িয়েও ধরেনি, কিস করেনি। নেতিয়ে পড়েছে মনে হয়, হয়তো বুঝতে পেরেছে নাওয়াল তাকে নাজেহাল করবে আজ। নাওয়ালও কোনও জোশ পেল না, পরাজয় স্বীকার করে নেওয়া প্রতিপক্ষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার কোনও ইচ্ছাই নেই নাওয়ালের, এতে মজা নষ্ট হয়ে যায়, আরেক দিন ধরতে হবে এই সান অফ আ বিচটাকে। কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে হলেও সত্য যে পরের পার্টিগুলোর কোনওটাতেই মিনহাজকে আর ধরা হয় না, মানে ধরতে পারে না নাওয়াল, পরের সব পার্টিতে এসেছে মিনহাজ, সব পার্টিতেই সে চুপচাপ, মদ খায় না, কারও সঙ্গে ড্যান্স করে না, কাউকে জড়িয়ে ধরে না। তাহলে কি নাওয়ালের প্রতিশোধ নেওয়া হবে না ? শালা কি কোনও রিলিজিয়াস এক্সট্রিমিস্টদের পাল্লায় পড়েছে ? হঠাৎ ভালো মানুষ সাজার চেষ্টা করছে এখন।

পাঁচ

‘হ্যালো, নাওয়াল, আমি মিনহাজ বলছি, হাউ আর ইউ ? উইল ইউ কাম টু মাই ফ্লাট ? অ্যাড্রেস এসএমএস করে দিচ্ছি, ইচ্ছা হলে এসো, আই অ্যাম হেয়ার অল ডে লং।’

নির্লিপ্তভাবে কথাগুলো বলে লাইনটা কেটে দেয় মিনহাজ। ধন্ধে পড়ে যায় নাওয়াল। খুব অবাক হয়। প্রায় মাস তিনেকের পরিচয় মিনহাজের সঙ্গে, কিন্তু দুই জনের সম্পর্কটা তো জঘন্য। কিছুটা যে সহজ হয়নি তা বলা যাবে না, পরিচয়ের আগেই এ ছেলে সরাসরি নাওয়ালকে তার সঙ্গে বিছানায় যাবার প্রস্তাব দিয়েছিল, নাওয়ালও নিজের সঙ্গে নিজেই প্রতিজ্ঞা করেছিল মিনহাজকে দেখে নেবার। আজ আবার সরাসরি ফোন করে নিজের ফ্ল্যাটে ডাকছে ? সিনথিয়া তো বলেছিল, মিনহাজ তার ফ্ল্যাটে কাউকে কোনও দিন ডাকে না। যদি মিনহাজ তার প্রথম দিনের সেই প্রস্তাব করে বসে ? এই জন্যই কি সে নাওয়ালকে ডেকেছে নিজের ফ্ল্যাটে। সিনথিয়াকে একটা কল দিয়ে দেখবে ? না এটা করা যাবে না। সিনথিয়া মুহূর্তেই রাষ্ট্র করে দেবে এই খবর। নাওয়াল ডাকাবুকো মেয়ে, সে ভয় পায় না, সে কি যাবে মিনহাজের ফ্ল্যাটে ?

প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে বাথটাবে ডুবে আছে নাওয়াল, সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না, যাবে কী যাবে না। শাওয়ার নেওয়া শেষ করে নাওয়াল দাঁড়াল আয়নার সামনে, একটা সাদা টি-শার্ট সঙ্গে একটা ব্ল্যাক জিনস পরে নিল নাওয়াল, বাবরি কাটের সদ্য স্নান সেরে নেওয়া চুলগুলো এখনও ভেজা। ছোট ছোট চুল চুঁইয়ে এক ফোঁটা দুই ফোঁটা করে পানি ঝরছে, মাথাটা এদিক ওদিক ঝাঁকাল বার কয়েক। ভাবনাটা পিছু ছাড়ছে না, সে কি যাবে নাকি যাবে না ? এলোমেলো ভাবনারা একসময় স্থির হয়, নাওয়াল সিদ্ধান্ত নেয় সে যাবে মিনহাজের ফ্ল্যাটে। লেটস সি! মিনহাজ সেয়ানা হলে কী হবে, নাওয়াল নিজেও কী কম, নাকি এই শুয়োরটার অন্য কোনও ফন্দি, বেশ কিছুদিন থেকে খুব চুপসে গেছে, প্রায় সব পার্টিতেই এসেছে কিন্তু ভালো মানুষ সেজে থেকেছে। নাওয়ালের সন্দেহ হয়, হারামিটা কি সত্যিই কোনও উল্টাপাল্টা পথে পা বাড়াচ্ছে ? ওর লাস্ট কিছুদিনের মুভমেন্ট সন্দেহজনক! মিনহাজের ফ্লাটে যাবার সিদ্ধান্ত নেয় নাওয়াল, শেষটা দেখতে চায় সে। ড্রাইভার না নিয়ে গাড়ি নিয়ে একাই বেরিয়ে পড়ে।

 কলিং বেল চাপ দেবার আগেই ফ্ল্যাটের দরজা খুলে যায়, দরজায় কে আসছে না আসছে সব ভেতর থেকে ক্যামেরার সাহায্যে দেখছে সে! মিনহাজের মুখে মিচকা শয়তানি হাসির ছটা ঘুরপাক খাচ্ছে।―জানতাম তুমি আসবে, এসো, এসো। কাম, কাম, সিট হেয়ার, আমি আসছি একটু।

মেজাজ খারাপ করার মতো কথা না―‘আ-মি জা-ন-তা-ম তু-মি আ-স-বে!’ আজ নিজেকে শান্ত রাখবে এই সিদ্ধান্তে অনড় নাওয়াল। ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে পড়ে, প্রায় মিনিট তিনেক ধরে একা বসে আছে সে, এটা কোন ধরনের ইতরামি। ‘এসওবি’, ব্লাডি ফাকার, আজ তোকে দেখে নেব, দাঁড়া।

‘তুমি এটা পরতে পারো’ ভেতর থেকে একটা প্যাকেট আনে মিনহাজ।

‘এটা পরব ক্যানো ? ক্যানো পরব এটা!’

‘পরবে, বিকজ আই সেইড ইট।’

‘হোয়াট ?’

‘মানে কিছুই না, তুমি এটা পরবে।

‘আই ক্যান নট, আই নেভার টাচ ইট’, কিছুটা কুঁকড়ে গিয়ে শব্দ কয়টা উচ্চারণ করল নাওয়াল। এই ছেলে এমনভাবে সব কথা বলে যেন সে যা বলে সেটাই নিয়ম, সেটা না মানলে কারও রক্ষা নাই। ফোন দেবে কাউকে, সিনথিয়াকে, না কিছুতেই না, তাহলে ফুফুম্মাকে, ফুফুম্মাই বা কী করবে। ফোন দেবেই বা কীভাবে, মিনহাজের ফ্ল্যাটে ঢোকার কিছু সময় পরেই মিনহাজ নাওয়ালের কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে বন্ধ করে রেখে দ্যায়, রিং টোন নাকি তার অসহ্য লাগে। কিছু উত্তেজনা, কিছু দুর্ভাবনা নাওয়ালের মনে।

‘ওকে, দ্যাটস লাইক আ গুড গার্ল। আমি পরিয়ে দেব। জাস্ট দাঁড়াও, সোজা হয়ে দাঁড়াও, ডোন্ট মুভ।’

জলপাই রঙা শাড়িটার ভাঁজ খোলে মিনহাজ, শুধু কী শাড়ি ? শায়া, ব্লাউজও তো আছে।

‘তুমি কি ফোর্স করছ আমাকে ?’ আর আমি শাড়ি পরব ক্যানো, ক্যানো ডেকেছিলে ? তোমার আটিটিউড ভালো ঠেকছে না। নিজের ভেতর কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে কথাগুলো বলে নাওয়াল, কিন্তু সে খেয়াল করছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার ভেতরের সাহস শূন্যের দিকে দৌড়াচ্ছে।

‘হ্যাঁ, জাস্ট ক্লোজ ইয়োর আইজ, আই সে ক্লোজ!’

এখন নাওয়াল একজন হাল ছেড়ে দেওয়া মাঝি। চোখ বন্ধ করে সে, কিছু করার উপায় নাই, হয়তো আরও খারাপ কিছু অপেক্ষা করছে তার জন্য, আ ডার্টি বয়, এত রুড!

‘ওকে নাউ ইউ ক্যান ওপেন ইয়োর আইজ’ হঠাৎ কণ্ঠ পাল্টে ফেলে মিনহাজ, যেন প্লে-গ্রুপ বা নার্সারি ক্লাসের কোনও বাচ্চার ক্লাস নিচ্ছে সে, একেবারে সফট টোন কোথা থেকে এসে হাজির হলো ? নিজেকে চিনতে পারে না নাওয়াল, এক অন্য ধরনের ভালো লাগা কাজ করে শাড়ি পরা নিজেকে দেখে, কিন্তু এক গাদা ভয়, শঙ্কা তাকে আবার বাস্তবে ফিরিয়ে নিয়ে আসে, চুপ করে থাকে সে। 

‘এদিকে আসো, এই ঘরে’ বলে নাওয়ালের হাত ধরে তাকে কোনার দিকের একটা ঘরের দিকে নিয়ে যেতে চায় মিনহাজ।

‘আবার চোখ বন্ধ করো’ কোনও কথাই বলার সুযোগ দিচ্ছে না নাওয়ালকে, যেন এটা তার টেরিটোরি, এখানে সেই রাজা। আর নাওয়ালও, যেন তার সব কথারা শুকিয়ে গেছে আজ।

রুমের ভেতরে নিয়ে কী করবে মিনহাজ ?

‘না, রুমে ক্যানো যাব, আই ওয়ান্ট টু গো টু হোম, আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না, হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট ফ্রম মি ?’

‘ভয় পেয়েছো, বেবস ? আমাকে না পানিশ করবে বলেছিলে ? এই বলেই নাওয়ালের হাত ধরে টানতে থাকে তাকে, নিয়ে আসে একটা রুমের সামনে। রুমের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে মিনহাজ, এসো’, নাওয়াল বুঝে গেছে তার কিছুই করার নেই আর, মিনহাজ যা বলবে তাই করে যেতে হবে এখন। ঘরে ঢোকে সে। ঢুকেই হতবাক হয়ে যায়। এই জীবনে এতটা বিস্ময়াভিভূত  কোনওদিনই হয়নি সে।’

ঘরের ওয়ালজুড়ে ছোট-বড় বিভিন্ন সাইজের অনেক পেইন্টিংস, কোনওটায় ব্যবহার করা হয়েছে পেনসিল, কোনওটায় ওয়াটার কালার, কোনওটা আবার অয়েল কালারে, কিছু কিছু প্যাস্টেল কালার, কোনওটাতে ব্যবহার করা হয়েছে এক্রিলিক কালার, এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক পেইন্টিংসই নাওয়ালের, অসাধারণ সব পেইন্টিংস। নিজের পেইন্টিংসগুলো দেখে নিজেকে চিনতে অসুবিধা হয় নাওয়ালের।

সামনে এসে দাঁড়ায় মিনহাজ, বলতে থাকে, শাড়িটা মায়ের। মাকে তো আমি দেখিনি! আমাকে জন্ম দিতে গিয়ে মা আকাশ হয়ে গেছে। আকাশ থেকেই আমার সঙ্গে কথা বলে মা। বাকি পেইন্টিংসগুলো দেখছো না! ওগুলো মায়ের। আমিই এঁকেছি। আকাশ থেকে মা-ই বলেছেন, তোর জন্য একটা ‘উপহার’ আছে।

মিনহাজ ঘুরে দাঁড়াল, তার দু চোখের ভেতর শান্ত কোনও এক সমুদ্রের সমস্ত জলকে টলটলায়মান করে। মোচড়হীন ঢেউ তুলে নাওয়ালের চোখে চোখ রাখে সে। বলে, ‘নাওয়াল’ শব্দের অর্থ তুমি জানো ? 

সচিত্রকরণ : রজত 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button