অনুবাদ গল্পআর্কাইভবিশ্বসাহিত্য

চার্লি পার্কার বোসা নোভা গাইছে : হারুকি মুরাকামি

বিশ্বসাহিত্যের অনুবাদ গল্প

বাংলা অনুবাদ : মিলটন রহমান

[হারুকি মুরাকামি, জন্ম ১২ জানুয়ারি ১৯৪৯, একজন জনপ্রিয় জাপানি লেখক। তিনি একবিংশ শতাব্দীর প্রথম কোয়ার্টারের পৃথিবীতে জনপ্রিয়তম কথাসাহিত্যিক। তাঁর প্রায় সব বই দীর্ঘকাল যাবৎ আন্তর্জাতিকভাবে বেস্টসেলার হয়ে আসছে। নানা বই বাংলাসহ সারা বিশ্বে  ৫০টিরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তাঁর বই তাঁর নিজের দেশ জাপানের বাইরেও কয়েক লাখ কপিরও বেশি বিক্রি হয়েছে। দি গার্ডিয়ান-এর স্টিভেন পুলের মতে, মুরাকামি কর্ম ও অর্জনে পৃথিবীর সেরা জীবিত ঔপন্যাসিকদের একজন। সাহিত্যে অবদানের জন্য বিভিন্ন সময় মুরাকামি বিভিন্ন পুরস্কার অর্জন করেছেন, যার মধ্যে রয়েছে বিশ্ব ফ্যান্টাসি পুরস্কার, ফ্র্যাঙ্ক ও’কনর আন্তর্জাতিক ছোটগল্প পুরস্কার, ও ফ্রানৎস কাফকা পুরস্কার।

মুরাকামির উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে আ ওয়াইল্ড শিপ চেজ (১৯৮২), নরওয়েজিয়ান উড (১৯৮৭), দি ওয়াইন্ড-আপ বার্ড ক্রোনিকেল (১৯৯৪-৯৫), কাফকা অন দি শোর (২০০২) এবং ওয়ানকিউএইটিফোর (২০০৯-১০)।]

পাখিটি ফিরে এসেছে।

শুনতেই ভালো লাগছে! ঠিক তাই, যে পাখিকে তুমি চেনো এবং ভালোবাসো সে ফিরে এসেছে। তার গতিশীল ডানা বাতাসে আঘাত করছে। নভোসিবির্স্ক থেকে টিম্বুকটু পর্যন্ত গ্রহের প্রতিটি প্রান্তে, মানুষ আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে, চমৎকার এই পাখিটির ছায়া সর্বত্র গুপ্তচরবৃত্তি এবং উল্লাস করছে। পৃথিবী আরও একবার উজ্জ্বল সূর্যালোকে পূর্ণ হবে।

সময় ১৯৬৩ সাল। সে বছর থেকে মানুষ নাম শুনেছে চার্লি ‘পাখি’ পার্কারের। কোথায় পাখি এবং সে কী করছে ? পুরো বিশ্বের জাজ প্রেমিকরা এই প্রশ্নই ফিসফিস করছে। সে মরতে পারে না, পারে কি ? কারণ আমরা তার মৃত্যুর কোনও খবর শুনিনি। কিন্তু জানেন, কেউ হয়তো বলতে পারে, আমি তার বেঁচে থাকা সম্পর্কে কিছুই জানি না।   

সর্বশেষ খবরে সবাই জেনেছে, পাখিটিকে মালিক ভ্যারনেস নিকার বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, যেখানে নিকা নানা অসুস্থতার সঙ্গে যুদ্ধ করছিলেন। জ্যাজ ভক্তমাত্রই জানে যে পাখি এক ধরনের নেশাখোর। হেরোইন খাঁটি সাদা প্রাণঘাতী পাউডার। গুজব আছে নেশাসক্তির বাইরেও তিনি মারাত্মক নিউমোনিয়ার সঙ্গে লড়াই করছিলেন, শরীরের অভ্যন্তরে বিভিন্ন ধরনের রোগ, ডায়াবেটিসের উপসর্গ, এমনকি মানসিক রোগও। এসব রোগ থেকে তিনি ভাগ্যজোরে সেরে উঠলেও, শারীরিক দুর্বলতার কারণে তিনি কখনও গানের যন্ত্রপাতি হাতে তুলে নিতে পারবেন না। এভাবেই ১৯৫৫ সালের দিকে পাখিটি তার পাশ থেকে হারিয়ে যায়, রূপান্তর হয় একটি খ্যাতিমান জ্যাজ শিল্পীতে। 

১৯৬৩ সালের উত্তপ্ত সামারে, চার্লি পার্কার আবার হাতে তুলে নেন আলটো স্যাক্সোফোন, এবং নিউ ইয়র্কের বাইরে একটি অ্যালবাম রেকর্ড করলেন। আর সেই অ্যালবামের নাম ছিল ‘চার্লি পার্কার বোসা নোভা গাইছে!’

তুমি বিশ্বাস করতে পারো!

বিশ্বাস করাই ভালো, কারণ তা-ই হয়েছিল।

সত্যিই সে রেকর্ড হয়েছিল।

এটি একটি লেখার সুচনা, যা আমি কলেজে পড়ার সময় লিখেছিলাম। এটাই ছিল আমার প্রথম কোনও প্রকাশিত লেখা। আর এটাই ছিল আমার কোনও একটি লেখা যেটার জন্য আমি পারিশ্রমিক পেয়েছিলাম, যদিও তা ছিল অত্যন্ত অল্প। প্রকৃতপক্ষে, তখন ‘চার্লি পার্কার বোসা নোভা গাইছে’ নামের কোনও অ্যালবাম ছিল না। চার্লি পার্কার মারা গিয়েছিলেন ১৯৫৫ সালের ১২ মার্চ। ১৯৬২ সাল পর্যন্ত বোসা নোভা শেষ হয়ে যায়নি, স্টেন গেটজ এবং অন্যদের পরিবেশনের মধ্য দিয়ে জিইয়ে ছিল। তবে পাখি যদি ১৯৬০ সাল পর্যন্ত বেঁচে থাকত, এবং বোসা নোভাতে আগ্রহী হয়ে যদি তিনি পরিবেশন করতেন… এই কাল্পনিক রেকর্ড সম্পর্কে সেটাই ছিল আমার পর্যালোচনা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক যিনি ছিলেন, তিনি আমার লেখাটি ছেপেছিলেন এবং বুঝতেই পারেননি যে এমন কোনও অ্যালবাম সত্যিকার অর্থে ছিল না। লেখাটিকে তিনি সাধারণ সঙ্গীত সমালোচনা হিসেবেই ছেপেছিলেন। সম্পাদকের ছোট ভাই আমার বন্ধু, তাকে বলেছিলাম, আমি এ বিষয়ে কিছু ভালো রচনা তৈরি করছি, যেগুলো তাদের ছাপা উচিত (চার সংখ্যা প্রকাশিত হওয়ার পর পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়, আমার পর্যালোচনামূলক লেখাটি ছাপা হয়েছিল তৃতীয় সংখ্যায়।)

চার্লি পার্কারের রেখে যাওয়া একটি অ্যালবাম দুর্ঘটনাক্রমে একটি রেকর্ডিং কোম্পানির সিন্দুক থেকে উদ্ধার করা হয়, যা সম্প্রতি আলোর মুখ দেখেছে, সেটাই ছিল আমার নিবন্ধের মূল ভিত্তি। হয়তো, আমার বিচার করা উচিত নয়, কিন্তু আমি এখনও মনে করি, এ গল্পটির সমস্ত বিবরণ বিশ্বাসযোগ্য, এবং এ লেখাটির শক্তিমত্তা আছে। এতটাই যে, শেষ পর্যন্ত আমি প্রায় বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম যে, সত্যিকার অর্থেই রেকর্ডটি আছে।

ম্যাগাজিনে আমার লেখাটি প্রকাশিত হওয়ার পর বেশ প্রশংসা পেলাম। এটা ছিল ছোট মাপের একটি ম্যাগাজিন, সাধারণত এর গ্রহণযোগ্যতা তেমন নেই। তবে মনে হচ্ছে এখনও কিছু সিরিয়াস পাঠক আছে, যারা চার্লি পার্কারকে নিজের রোল মডেল মানেন, আমার বিদ্বেষপূর্ণ রসিকতা এবং চিন্তাহীন অবজ্ঞার বিষয়ে বেশ কিছু চিঠি পেয়েছেন সম্পাদক। অন্যদের কি হাস্যরসের অভাব রয়েছে ? বা, আমার রসিকতা কি বানানো ? বলা কঠিন। কিছু লোক নিবন্ধটিকে সিরিয়াসলি নিয়েছেন, এমনকি অ্যালবামটি খোঁজ করতে দোকানেও গিয়েছেন।

আমি ঠকিয়েছি বা প্রতারণা করেছি এমন মনোভাব নিয়ে সম্পাদক কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। আমি তার সঙ্গে মিথ্যে বলিনি, তবে বিস্তারিত ব্যাখ্যাও দিইনি। তিনি নিশ্চই গোপনে খুশি হয়েছেন আমার প্রবন্ধটি এত বেশি পাঠকের মনোযোগ পাওয়ায়, যদিও এর অধিকাংশ ছিল নেতিবাচক। তার প্রমাণ পাওয়া গেল যখন সম্পাদক বললেন, সমালোচনা কিংবা মৌলিক লেখা যা-ই লিখি না কেন তিনি তা দেখতে চান। (আমি তাকে অন্য লেখা দেখানোর আগেই ম্যাগাজিনটি বন্ধ হয়ে যায়)। 

আমার রচনাটি ছিল এরকম―

…চার্লি পার্কার এবং আন্তোনিয়ো কার্লোস জোবিমের বাহিনীতে যোগদানের মতো অস্বাভাবিক কল্পনা কি কেউ করতে পারে ? জেমি রেনি গিটারে, জোবিম পিয়ানোতে, জিমি গ্যারিসন বেইস গিটারে, রয় হেইন্স আছে ড্রামে―যেনও স্বপ্নের মতো সাজানো লাইনআপ, প্রতিটি নাম শুনেই হৃদয় নেচে ওঠে। আর আল্টো সাক্সোফোনে, চার্লি ‘পাখি’ পার্কার ছাড়া আর কে হতে পারে ?

এখানে রাখলাম, গানগুলোর নাম :

সাইড-এ

১. কর্কো ভাডো

২. ওয়ান্স আই লাভড

৩. জাস্ট ফ্রেন্ডস

৪. বাই বাই ব্লুস

সাইড-বি

১. আউট অব নো হোয়ার

২. হাউ ইনসেনটিভ

৩. ওয়ান্স এগেইন

৪. ডিন্ডি

‘জাস্ট ফ্রেন্ড’ এবং ‘নো হায়ার’ জবিমের সুর করা দু‘টি জনপ্রিয় গান। জবিমের সুর করা নয় এমন দুটি গান শিল্পী জীবনের শুরুর দিকে পার্কারের দুর্দান্ত পরিবেশনের কারণে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সেগুলোও বোসা নোভা ছন্দে করা হয়, সম্পূর্ণ নতুন ঘরানার। (আর এ দুটি গানে কেবল জবিম পিয়ানো বাজাতেন না, তাঁর সঙ্গে ছিলেন বহুমুখী, অভিজ্ঞ হেঙ্ক জোন্সও।

তাহলে, জাজের ভক্ত হিসেবে চার্লি পার্কার বাজাচ্ছেন বোসা নোভা, এমন শোনার পর আপনার কী প্রতিক্রিয়া হবে ? অত্যন্ত বিস্মিত হব, কল্পনা এবং প্রত্যাশার অনুভূতি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করব। তবে দ্রুতই সত্যি সম্মুখে এসে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে―যেমন সুন্দর রৌদ্রোজ্জ্বল পাহাড় ঢেকে যায় অশুভ কালো মেঘে।

একটু থামো। আমাকে তুমি বলছো যে, পাখি-চার্লি-পার্কার সত্যিই বোসা নোভা গাইছে ? সত্যি ? তিনি কি সত্যি এমন মিউজিক বাজাতে চান ? তিনি কি বাণিজ্যের কাছে নতি স্বীকার করেছেন ? এ বিষয়ে রেকর্ড কোম্পানির সঙ্গে কথা বলুন, জানার চেষ্টা করুন সে সময় এর আবেদন কেমন ছিল, জনপ্রিয় ? এমনকি যদি সত্যিকার অর্থেই বলি তিনি এমন গান গাইতে চেয়েছিলেন, শতভাগ বেঢপ আল্টো সাক্সোফোন কি শীতল ব্যঞ্জনার ল্যাটিন আমেরিকান বোসা নোভার সঙ্গে এক হতে পারে ?

বাদ দাও সবকিছু―আট বছর বিরতির পর সে কি এখনও তার বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারে ? সে কি আবার তার সেই শক্তিশালী পরিবেশন ক্ষমতা এবং সৃষ্টিশীলতা ফিরে পেয়েছে ?

সত্যি বলতে―আমি কোনও সহায়তা করতে পারিনি, কিন্তু নিজেও সে সব বিষয়ে অস্বস্তি বোধ করেছি। আমি গান শোনার জন্য মরে যাচ্ছিলাম, কিন্তু একই সময়ে আমি ভীতসন্ত্রস্ত ছিলাম―যা শুনব তাতে হতাশ হব কিনা ? কিন্তু এখন, ডিস্কের গান বারবার শোনার পর―আমি একটা বিষয় নিশ্চিত করে বলতে পারি : একটি উঁচু ভবনে উঠে চিৎকার করে পুরো নগরবাসীকে এই গান শোনার আহ্বান জানাতে ইচ্ছে করছে। যদি তুমি জাজ ভালোবাসো, এমনকি তুমি গান ভালোবাসো, তাহলে তোমাকে অবশ্যই হৃদয়হরণী এই গান শুনতেই হবে―যা একটি উৎসাহী হৃদয় এবং শীতল মনের উপজীব্য…

কী বিস্ময়, প্রথমত, জবিমের বর্ণনাতীত অসাধারণ বাদন, পিয়ানো বাজানোর শৈলী, বাকপটু পাখির বাধাহীন বাক্যাংশ। আপনি হয়তো জবিমের কণ্ঠ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন যে (এখানে জবিম গান গাইছেন না, তাই শুধু তার বাদ্যযন্ত্রের ভাষা সম্পর্কে বলতে চাই) জবিমের কন্ঠ আর পাখির কণ্ঠ সম্পূর্ণ ভিন্ন মেজাজের, বিপরীত, এমন কি উদ্দেশ্যেও রয়েছে ভিন্নতা। আমরা এখানে সম্পূর্ণ ভিন্ন দু’টো কণ্ঠ নিয়ে কথা বলছি, তাই তাদের মধ্যে শেয়ার করা কোনও দিক বা বিষয় খুঁজে পাওয়াও কঠিন হতে পারে। সর্বোপরি কেউ তার সঙ্গীতকে অন্য কারও সঙ্গে মিলানোর চেষ্টা করছে বলেও মনে হচ্ছে না। তবে এই দুই পুরুষ কণ্ঠে যে ভিন্নতা রয়েছে তাই এই অনন্য মনোরম সঙ্গীতের মূল রসদ। 

আমি বলব তুমি প্রথম রেকর্ডের ‘করকোভাডো’র এ সাইডটা শোনো প্রথমে। পাখি শুরুতে সূচনা সঙ্গীত গায় না। কোনও একটি বাক্যাংশ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আসলে তিনি বিষয় ঠিক করেন না। জবিম পিয়ানোর সঙ্গে পরিচিত এমন থিম বাজাতে শুরু করেন। ছন্দের অংশটি পুরোপুরি বন্ধ। সুর জানালার পাশে বসে থাকা এক তরুণীর কথা মনে করিয়ে দেয়, যে অনিন্দ্যসুন্দর রাতের দৃশ্য দেখছে। এর বেশির ভাগই একক নোট দিয়ে করা হয়, মাঝে মাঝে নো-ফ্রিলস কর্ড যোগ করেছে। মনে হয় যেনও আলতো করে মেয়েটির কাঁধের নিচে কুশন টেনে দেওয়া হচ্ছে।

একসময় যখন পিয়ানো বাজানো শেষ হয়, পাখি আল্টো স্যাক্স নিঃশব্দে প্রবেশ করে, একটা আবছা গোধূলির ছায়া পর্দার ফাঁক গলে গড়িয়ে পড়ছে। আপনি টের পাওয়ার আগেই তিনি সেখানে উপস্থিত হন। এই করুণ, বিচ্ছিন্ন বাক্যাংশগুলো সুন্দর স্মৃতির মতো, তাদের নামগুলো অদৃশ্য, ঘুমিয়ে থাকে আপনার স্বপ্নের মধ্যে। যেমন সূক্ষ্ম বাতাসের মতো আপনি কখনওই অদৃশ্য হতে চান না, মনের বালুচরে মৃদু চিহ্ন রেখে…

আমি বাকি সব রচনা মুছে দেব, ওসব কেবলই পুনরাবৃত্তি, রয়েছে জুতসই অলংকরণ। আমি যে সঙ্গীতের কথা বলেছিলাম, সে সম্পর্কেই ধারণা দেয়। অবশ্যই তা সঙ্গীত যা কোনওভাবেই খুঁজে পাওয়া যাবে না, অথবা বলা চলে, সে সঙ্গীত আর খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়।

আমি গল্পের পাট সেখানে গুটিয়ে ফেলব এবং এ বছর পরে যা ঘটবে সে সম্পর্কে কথা বলব।

বহু দিন মনেই ছিল না যে, সে রচনাটি আমি কলেজে পড়ার সময় লিখেছিলাম।

স্কুল শেষ হওয়ার পরে আমি অত্যন্ত বিশ্রী রকম ব্যস্ত হয়ে পড়ি, যা কল্পনা করতে পারিনি, তার চেয়েও বেশি বিরক্তিকর। সে পর্যালোচনা এ বিশ্বাসই দিয়েছিল যে, ওই গানের অ্যালবামে হালকা মনের অনুভূতি ছাড়া কিছুই ছিল না। কৈশোরে আমি দায়িত্বজ্ঞানহীন রসিকতা করতাম। তবে পনেরো বছর পরে, রচনাটি অপ্রত্যাশিতভাবে আমার জীবনে বুমেরাং হয়ে আবির্ভূত হয়েছিল। অনেকটা ঘূর্ণির মতো এর ভেতর নিক্ষেপ করল।  

আমি ব্যবসার কাজে নিউ ইয়র্ক ছিলাম। কিছুটা সময় নিয়ে, হাঁটতে হাঁটতে হোটেলের কাছে, ইস্ট ফর্টিন নাম্বার রোডে পৌঁছাই পুরনো একটি ক্যাসেটের দোকানে। সেখালে চার্লি পার্কার সেকশনে পেলাম, চার্লি পার্কার গাইছে বোসা নোভার পুরো রেকর্ড। হাতে নিয়ে মনে হলো এটা ব্যক্তিগতভাবে কেউ রেকর্ড করেছিল। কভারে একটি সাদা জ্যাকেট পড়া ছবি। বিষণ্ন কালো অক্ষরে লেখা শিরোনাম। আর অপর পিঠে ছিল গানের তালিকা এবং শিল্পীদের নাম। আশ্চর্যজনকভাবে গান এবং শিল্পীদের নাম আমি কলেজজীবনে যেভাবে আবিষ্কার করেছিলাম সেভাবেই আছে। আর একইভাবে হ্যাঙ্ক জোন্স দুটো ট্রেকেই বসে আছেন। রেকর্ড হাতে আমি সেখানে নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকি। মনে হচ্ছিলো আমার ভেতরের ছোট ছোট কলকব্জাগুলো অসাড় হয়ে পড়েছে। আমি চতুর্দিকে তাকাই। সেটা কি আসলে নিউ ইয়র্ক ছিল ? এটা নিউ ইয়র্ক ডাউনটাউন ছিল―এতে কোনও সন্দেহ নেই। আমি সেখানে পুরানো একটি রেকর্ডের দোকানে ছিলাম। আমি কোনও কল্পনার জগতে ছিলাম না, কিংবা অতিমাত্রায় বাস্তবসম্মত কোনও স্বপ্নের মধ্যেও ছিলাম না।

আমি রেকর্ডটিকে বক্স থেকে বের করলাম। গায়ে রয়েছে গান ও শিল্পীদের তালিকাসম্বলিত একটি সাদা আস্তরণ। তাতে রেকর্ড কোম্পানির কোনও লোগো ছিল না। আমি পরীক্ষা করে বুঝতে পারলাম, প্রত্যেক পাশে চারটি করে গান রয়েছে। আমি দোকানের লম্বা চুলওয়ালা তরুণটিকে জিজ্ঞেস করলাম রেকর্ডটি বাজিয়ে শুনতে পারব কিনা। উত্তরে ছেলেটি বলল―না। দোকানের রেকর্ড শোনার যন্ত্রটি ভেঙে গেছে, দুঃখিত।

রেকর্ডটির দাম ছিল ৩৫ ডলার। সেটি কিনব কি কিনব না এ নিয়ে দীর্ঘ সময় দোদুল্যমান ছিলাম। কিন্তু এক সময় আমি অনুভব করলাম পুরো দোকান শূন্য। আবিষ্কার করলাম, কারও নির্বোধ কৌতুককর ধারণা থেকে হয়েছে। আমার অনেক আগের একটি কাল্পনিক রেকর্ডের ওপর ভিত্তি করে কেউ একজন একটি জাল রেকর্ড তৈরি করেছে। চারটি ট্রেক রয়েছে এমন একটি রেকর্ড নিয়ে, জলে ভিজিয়েছে, তুলে নিয়েছে লেভেল, এবং আঠা দিয়ে সেঁটে দিয়েছে হাতে তৈরি লেভেল। সে যাই হোক, এমন একটি জাল রেকর্ডের জন্য ৩৫ ডলার ব্যয় করা হাস্যকর।

হোটেলের কাছে একটি স্পেনিশ রেস্টুরেন্টে গেলাম এবং অল্প বিয়ার পান সহযোগে হালকা রাতের খাবার খেয়ে নিলাম। পরে আমি যখন উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম, তখন আমার মনে কিছুটা অনুশোচনা জাগল। আমার অবশ্যই এই রেকর্ডটি কেনা উচিত। যদিও সেটি জাল এবং দামও চড়া। তারপরও আমার অবশ্যই কেনা উচিত, অন্তত আমার জীবনের প্রতিটি বাঁক পরিবর্তনের স্মৃতি চিহ্ন হিসেবে। আমি আবার ফেরত গেলাম চৌদ্দতম সড়কে। তাড়াতাড়িই গিয়েছিলাম, কিন্তু ততক্ষণে রেকর্ডের দোকানটি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। শাটারের ওপরে লেখা আছে দোকান খোলার সময় সকাল ১১.৩০ এবং বন্ধ সন্ধ্যা ৭.৩০টা।

পরেরদিন সকালে, দুপুরের একটু আগে আমি আবার যাই সেই দোকানে। মাথায় ছাঁটা চুল, কিছুটা বিক্ষিপ্ত, গোল গলার একটি স্যুয়েটার গায়ে, মাঝবয়েসী এক লোক কফি পান করছেন আর স্পোর্টস সেকশনের পত্রিকা পাঠ করছেন। কফিটি মনে হয় মাত্র তৈরি করা হয়েছে, একটি সুগন্ধ ভেসে আসছে নাকে। দোকানটি মাত্র খুলেছে এবং আমিই ছিলাম একমাত্র ক্রেতা। ফারোহ স্যান্ডার্সের একটি পুরনো গান সিলিং-এর সঙ্গে লাগানো একটি ছোট স্পিকারে বাজছে। আমি ভেবেছিলাম ওই লোকটি দোকানের মালিক। আমি সোজা গেলাম চার্লি পার্কার সেকশনে, কিন্তু সেই রেকর্ডটি সেখানে খুঁজে পাওয়া যায়নি। আমি নিশ্চিত, গতকাল এ সেকশনেই রেকর্ডটি ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। ভাবলাম এটি অন্য কোথাও রাখা হয়েছে কিংবা কেউ নিয়ে গিয়েছে। আমি জাজ সেকশনে তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম। কিন্তু ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলো না। তাহলে কি গতকাল আমি চলে যাওয়ার পর অন্য কেউ রেকর্ডটি কিনেছিল ? আমি রেজিস্ট্রার বিভাগে গেলাম এবং মধ্যবয়েসী সেই লোকটিকে বললাম, আমি একটি জাজ রেকর্ড খুঁজছি, যেটি গতকাল আমি এখানে দেখেছিলাম।

‘কোন রেকর্ড ?’ লোকটি জানতে চাইল। দি নিউ ইয়র্ক টাইমস থেকে চোখ না তুলেই জানতে চাইলেন।

‘চার্লি পার্কার বোসা নোভা গাইছে’ আমি বললাম।

লোকটি হাত থেকে পত্রিকাটি নামিয়ে রাখলেন, ধীরে ধীরে আমার দিকে তাকালেন। ‘দুঃখিত, বুঝতে পারিনি, আবার বলবেন ?’

আমি বললাম। লোকটি কিছুই বললেন না। আরও একবার কফিতে চুমুক দিলেন। মৃদু মাথা ঝাঁকালেন। ‘এখানে এমন কোনও রেকর্ড নেই।’

‘অবশ্যই ছিল’ আমি বললাম।

‘আপনি যদি প্যারি কমো কিংবা জিমি হেনড্রিক্সের গান পছন্দ করেন’, তাহলে আমাদের স্টকে আছে। 

‘প্যারি কমো সিংস’ অনেকটা উপহাসের মতো শোনাল তার কণ্ঠে। আমার সঙ্গে ঠাট্টাচ্ছলে কথা বলছেন।

‘আপনি যতই ঠাট্টা করেন না কেনো, আমি এখানেই রেকর্ডটি দেখেছিলাম।’ আমি জোর দিয়ে বললাম। মনে হলো আমার বলাটা কৌতুকে পরিণত হলো।

‘আপনি রেকর্ডটি এখানে দেখেছিলেন ?’

‘গতকাল বিকেলে, ঠিক এখানে।’ আমি রেকর্ডটির বর্ণনা দিতে শুরু করি। রেকর্ডটির প্যাকেট কেমন ছিল, কোন ছবি ছিল তার গায়ে। কীভাবে রেকর্ডটির দাম পঁয়ত্রিশ ডলার লেখা ছিল, ইত্যাদি।

‘কোথাও ভুল হচ্ছে। আমাদের কাছে কখনও ওই ধরনের রেকর্ড ছিল না। দোকানের জন্য সব ধরনের কেনাকাটা আমি করি। জাজ রেকর্ডের গায়ে মূল্য আমি বসাই। আমার দোকানে এমন কোনও রেকর্ড যদি থাকত, তাহলে আমার অবশ্যই মনে পড়ত।’

লোকটি মাথা ঝাঁকিয়ে চোখে রিডিং গ্লাসটা পরলেন। পড়ার জন্য আবার চলে গেলেন স্পোর্টস বিভাগে। তবে কিছুক্ষণ পরে চোখের চশমা নামিয়ে আমার দিকে স্থির তাকালেন। হেসে বললেন, ‘আপনি এ যাবৎ যদি ওই রেকর্ডটি সংগ্রহ করে থাকেন তাহলে আমাকে একটু দেবেন। আমি শুনতে চাই, ঠিক আছে ?’   

সেখানে আরেকটি বিষয় পরে দেখা গেল।

এই ঘটনার অনেক পরে এই ঘটনাটি ঘটে। এক রাতে আমি চার্লি পার্কারকে স্বপ্নে দেখলাম। স্বপ্নে দেখলাম, সে কেবল আমার জন্য ‘কর্কোভাডো’ বাজাচ্ছে। একক সাক্সোফোন, কোনও ছন্দের শ্রেণিবিন্যাস নেই।

কোথাও কোথাও সূর্যের আলো ঝলমল করে উঠছিল। প্রলম্বিত আলোকরশ্মি দ্বারা আলোকিত একটি স্থানে দাঁড়িয়েছিল পার্কার। সম্ভবত তা ছিল ভোরের আলো। ফুরফুরে, সতেজ আলো, যেন কলুষমুক্ত। আমার মুখোমুখি, পাখির মুখ, গভীর ছায়ায় লুকিয়ে ছিল। আমি যে কোনওভাবে দুই পাটিযুক্ত কালো স্যুট তৈরি করতে পারি, সঙ্গে সাদা শার্ট এবং উজ্জ্বল রঙের টাই। তার সাক্সোফোনটি ছিল ময়লাযুক্ত, ধুলো-বালিতে ঢাকা। সেখানে একটি বাঁকা চাবি ছিল, হাতলের ওপর টেপ দিয়ে একটি চামচ আটকে  রাখত। যখন আমি এটি দেখি, বোকা বনে যাই। এমনকি পাখিও যন্ত্রটি থেকে উপযুক্ত শব্দ শুনতে পাবে না।

হঠাৎ, ঠিক তখনই, আশ্চর্যজনকভাবে আমার নাকে ভেসে এল কফির সুগন্ধ। চমৎকার মাদকীয় গন্ধ। গরম, কড়া, কালো কফির সুবাস। আমার নাসারন্ধ্র আনন্দে নেচে উঠল। সেই সুগন্ধের প্রলোভনে, কখনও আমি পাখির ওপর থেকে চোখ ফিরিয়ে নেইনি। এক পলকের জন্যও যদি আমি তার ওপর থেকে চোখ সরাই, তাহলে সে আমার পাশ থেকে মিলিয়ে যেতে পারে।

আমি নিশ্চিত নই, কিন্তু আমি জানি, এটা আমার স্বপ্ন ছিল। আমি স্বপ্নে দেখেছিলাম পাখিকে। কোনও কোনও সময় এমন ঘটে। যখন আমি স্বপ্নে দেখি তখন নিশ্চিত বলতে পারি―এটা একটা স্বপ্ন। অদ্ভুতভাবে যে স্বপ্নে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। আমি স্পষ্টভাবে লোভনীয় কফির গন্ধ অনুভব করতে পারি।

অবশেষে পাখি মাউথপিসে ঠোঁট রেখে, দমে থাকা শব্দ উড়িয়ে দিল, বাদ্যযন্ত্রের রিড পরীক্ষা করার মতো। শব্দটি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে গেল, সে নিঃশব্দে আরও কিছু কিছু নোট তৈরি করে রাখল। সেখানে নোটগুলো কিছু সময়ের জন্য বাতাসে ভেসে থাকল, তারপর আলতো করে মাটিতে পড়ে গেল। নোটগুলো মাটিতে পড়ে গেল, এবং তারা নীরবতায় হজম হয়ে যায়। পাখি দুর্দান্ত একটি সিরিজ পাঠায়, বাতাসে দীর্ঘস্থায়ী নোট। এভাবেই ‘কর্কোভাডু’ শুরু হয়েছিল।

কীভাবে এ সঙ্গীত সম্পর্কে বর্ণনা করা যায় ? একটু পেছনে ফিরে তাকানো যাক, পাখি এ গান পরিবেশন করত কেবল আমার জন্য, সম্পূর্ণ বিকিরণ, আমি ক্ষণিকের স্রোতের চেয়েও কম অনুভব করেছি। আমি সেখানে গাওয়া গান স্পষ্ট মনে করতে পারি। কিন্তু আমি সে গান পুনরায় নির্মাণ করতে পারি না। সময়ের সঙ্গে সবকিছু মøান হতে হতে দূরে সরে গেছে, অনেকটা বৃত্তের নকশা বর্ণনায় পারঙ্গমহীনতার মতো। বলতে পারি সেই গানটি আমার আত্মার একেবারে গভীরে জায়গা করে নিয়েছিল। আমি নিশ্চিত ছিলাম এমন গান পৃথিবীতে বিদ্যমান ছিল, সঙ্গীত এমনি যা তোমার শরীরের কাঠামোর মধ্যে পুনরায় পুলক জাগায়, অত্যন্ত ধীরে ধীরে। যাতে তুমি অভ্যস্ত হয়ে ওঠো।

‘মৃত্যুর সময় আমার বয়স ছিল মাত্র চৌত্রিশ বছর’―পাখি আমাকে বলল।

‘চৌত্রিশ!’ সে আমাকে এমন কিছু বলেছিল বলে আমি মনে করি। তখন একটা রুমে কেবল আমরা দুজন ছিলাম।

কীভাবে উত্তর দেওয়া উচিত আমি জানি না। স্বপ্নে সঠিক কাজ করা কঠিন। অতএব আমি চুপ থাকি, তার কথা শোনার অপেক্ষায় রইলাম।

‘চিন্তা করে দেখো চৌত্রিশ বছর বয়সে মারা যাওয়া কেমন’ পাখি বলতে শুরু করে।

আমি ভাবতে চেষ্টা করি, এবং অনুভব করি, চৌত্রিশ বছর বয়সে আমি মারা গেলে কেমন হয়। এখন আমার জীবনে কত কিছুই না ঘটছে। এমন সময়ে আমার মৃত্যু হলে কেমন হবে!

‘ঠিক, আমি নিজেই কাজগুলো শুরু করব’―বলল পাখি।

‘সবে আমার জীবনের শুরু। কিন্তু আমি তারপর নিজের চারপাশে তাকাতে তাকাতেই সব শেষ হয়ে গেলো।’ তিনি নীরবে নিজের মাথা ঝাঁকালেন। তাঁর পুরো মুখ তখনও ছায়ায় ঢাকা ছিল। ফলে আমি তার চেহারার অভিব্যক্তি কেমন ছিল বুঝতে পারিনি। তার গলায় ঝোলানো ছিল নোংরা এবং বিকৃত সাক্সোফোন।

‘মৃত্যু হঠাৎ করেই আসে’ পাখি বললেন। তবে মৃত্যু তার নিজের সময় নেয়। অনেকটা আপনার চিন্তায় আসা চমৎকার বাক্যাংশের মতো। যা কিছুক্ষণ মাত্র স্থায়ী হয়। তার মধ্যেও সেই বাক্যাংশ চিরস্থায়ী দাগ কাটে। এমনকি পূর্ব উপকূল থেকে পশ্চিম উপকূল পর্যন্ত চিরদিনের জন্য তা স্থায়ী হতে পারে। সময়ের ধারণাই সেখানে হারিয়ে গেছে। সেই মতে, আমি জীবিত এবং জীবনযাপন করেও মরে যেতে পারি। তবে সত্যিকারের মৃত্যু নিষ্পেষণের মতো। আশ্চর্যজনক হলো এতক্ষণ যা দৃশ্যমান ছিল তা হঠাৎ করেই অদৃশ্য হয়ে যায়। কিছ্ ুফেরত আসে না। আমার ক্ষেত্রে একই ঘটেছে।

কিছুক্ষণের জন্য তিনি মাথা নিচু করে থাকেন, তারপর বাদ্যযন্ত্রের দিকে তাকিয়ে, কথা বলতে শুরু করেন।

তুমি কি জানো মারা যাওয়ার সময় আমি কী ভেবেছিলাম ? তিনি জানতে চান। ‘আমার মনে কেবল একটাই ভাবনা ছিল―একটি একক সুর। আমি মগজের কোষে বার বার সেই সুর গুঞ্জন করতে থাকলাম। আমি এর রেশ শেষ হতে দিতে চাই না। এমনই ঘটেছে, বুঝতে পেরেছো ? তোমার মাথায় একটি সুর আটকে গেছে। সেই সুরটি ছিল বিথোভেনের প্রথম পিয়ানো কনসার্টের তৃতীয় সৃজনের একটি অংশ।’

পাখি মৃদু সুরে গুনগুন করে। আমি তা বুঝতে পারি। তা ছিল একক পিয়ানোর একটি অংশ।

‘বেথোভেনের এই সুরটি সত্যি সত্যি দুলে উঠছে।’

পাখি বলেন, ‘আমি সব সময় তার এক নম্বর গানটি পছন্দ করি। কতবার যে এই গানটি শুনেছি তার কোনও হিসাব নেই। একটি আদর্শ গানের রেকর্ড, ওপরে একটি পাখির ঠোঁটের ছবি আঁকা। কিন্তু এটা আশ্চর্যজনক, তুমি কি তাই মনে করো না ? ওটা আমি―চার্লি পার্কার―আমি মারা যাওয়ার সময়―গুন গুন করে গান গাইছিলাম, আমার মগজে বেথোভেনের সুর বাজছিল একের পর এক। তারপর নেমে আসে অন্ধকার। অনেকটা জানালার পর্দা নেমে যাওয়ার মতো।’ পাখি কর্কশ কণ্ঠে একটু হাসলেন।

আমার কাছে তেমন কোনও তথ্য নেই যে বলব চার্লি পার্কারের মৃত্যু কেমন ছিল ?

সে যাই হোক, তোমাকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত, পাখি বলে, ‘তুমি আমাকে নতুন জীবন দিলে। আমাকে বোসা নোভা গাইবার সুযোগ দিয়েছো। অন্য কোনও কিছুই আমাকে এতো খুশি করতে পারবে না। অবশ্যই, বেঁচে থাকা এবং গান গাইতে পারা জীবনের সবচেয়ে আশ্চর্যজনক এবং আনন্দময় ঘটনা। এমন কি মৃত্যুর পরেও, এটা আমার জন্য বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা। তখন থেকে আমি নতুন গান ভালোবাসি।’

তো তুমি এখানে এসেছো আমাকে ধন্যবাদ জানাতে ?

আমরা কী চিন্তা করছি তা বুঝতে পেরে পাখি বললেন, ‘হুম তাই’। আমি তাঁকে ধন্যবাদ জানাতে থাকলাম। ধন্যবাদ। আশা করি আমার গান তোমার ভালো লেগেছে।

আমি মাথা নাড়লাম। আমার কিছু বলা উচিত ছিল, কিন্তু বলতে পারিনি। জীবনেও আমি সঠিক উত্তর দিতে পারিনি।

‘জিমি হ্যানড্রিক্স প্যারি কমো গান গাইছে।’ পাখি যেনও বিড় বিড় করে কিছু স্মরণ করছে। আবার কর্কশ কণ্ঠে হাসল।

এরপর তিনি মিলিয়ে যান। প্রথমে মিলিয়ে যায় সাক্সোফোন, পাশেই কোথাও আলো জ্বলে ওঠে, এবং সর্বশেষ পাখিও মিলিয়ে যান।

আমি যখন স্বপ্ন ভেঙ্গে জেগেছি, তখন আমার বেডের পাশের ঘড়িতে সকাল সাড়ে তিনটা বাজে। তখনও বাইরে অন্ধকার, আলো ফোটেনি। ঘর ভর্তি কফির যে সুগন্ধ বিরাজ করছিল, তাও মিলিয়ে গেছে। পুরো ঘরে সুগন্ধের কোনও রেশ নেই। রান্নাঘরে গেলাম, একসঙ্গে কয়েক গ্লাস পানি পান করলাম। ডাইনিং টেবিলে বসলাম। আবার স্বপ্নে দেখা বিষয় স্মরণ করার চেষ্টা করি। হোক তা অল্প। পাখি কেবল আমার জন্যই সেই অসামান্য গানটি গেয়েছিলেন। অথচ আমি স্বপ্নের বিষয়ে কিছুই মনে করতে পারলাম না। তবে আমি স্মরণ করতে পারছি, পাখি আমাকে কী বলেছিলেন। স্বপ্ন আমার স্মৃতি থেকে মুছে যাওয়ার আগে, তার বলা কথাগুলো লিপিবদ্ধ করতে চাই। একটি বলপেন দিয়ে নোটবুকে তা লিখে রাখলাম, যতটুকু সম্ভব নিখুঁত করার চেষ্টা করেছি। সেটাই ছিল আমার নেওয়া একমাত্র ব্যবস্থা। পাখি আমার স্বপ্নে পরিভ্রমণ করেছেন এবং আমাকে যথাযথ সম্মান জানিয়েছেন, খুব মনে করতে পারি। অনেক বছর আগে বোসা নোভা গাইবার জন্য তাকে সুযোগ দেওয়ায় আমাকে ধন্যবাদ জানাতে এসেছেন। পাশে থাকা একটি বাদ্যযন্ত্র তুলে নিয়ে শুধু আমার জন্য ‘কর্কোভাডো’ গাইলেন।

বিশ্বাস হয় ?

তুমি খুশি হবে। কারণ এমনটি ঘটেছিল।

সে সত্যিই গান বাজিয়েছে। 

[সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে কথাসাহিত্যিক হারুকি মুরাকামির (১৯৪৯) আটটি গল্পের সংকলন ‘ফার্স্ট পারসন সিঙ্গুলার’ (মূল জাপানি ভাষায় গ্রন্থের শিরোনাম-ইছিবানসু তানসু)। মূল জাপানি ভাষা থেকে সব ক‘টি গল্পের ইংরেজি অনুবাদ করেছেন ফিলিপ গ্যাব্রিয়েল। সাম্প্রতিক বিশ্বসাহিত্যে মুরাকামির গল্পগ্রন্থটি বিস্তর আলোচনায় স্থান করে নিয়েছে। বিশ্বের প্রথম সারির প্রায় সব সাহিত্য পত্রিকা গল্পগুলো নিয়ে আলোচনা করেছে।  দি নিউ ইয়র্কার, গার্ডিয়ান, দি টাইমস থেকে শুরু করে বিভিন্ন পত্রিকায় এ গ্রন্থ নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। সঙ্গীত, স্মৃতি এবং স্ফীত জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছানোর মানসিক দর্শন গল্পগুলোর অবকাঠামো তৈরি করেছে। এ গ্রন্থের তৃতীয় গল্প ‘চালি পার্কার প্লেইস বোসা নোভা’। আমি ইংরেজি থেকে গল্পটি বাংলায় অনুবাদ করেছি। যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি মূলের ভাব এবং চিন্তার রেখা ঠিক রাখতে।] 

সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button