অনুবাদ গল্পআর্কাইভবিশ্বসাহিত্য

চলেছো কোথায়, ছিলেই বা কোথায় তুমি ? : জয়েস ক্যারল ওটস

বিশ্বসাহিত্যের অনুবাদ গল্প

বাংলা অনুবাদ : ফারহানা আনন্দময়ী

[জয়েস ক্যারল ওটস আমেরিকান লেখক, জন্ম ১৬ জুন, ১৯৩৮। তাঁর প্রথম গ্রন্থ ১৯৬৩তে প্রকাশিত হবার পরে এ পর্যন্ত ৫৮টি উপন্যাস, ছোটগল্প সংকলন, কবিতা আর প্রবন্ধের বই প্রকাশ পেয়েছে। ক্যারলের পাওয়া বহু পুরস্কারের মধ্যে ১৯৬৯-এ ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ড, ও হেনরি অ্যাওয়ার্ড আর ২০১৯ সালে জেরুজালেম পুরস্কার অন্যতম।

‘Where Are You Going, Where Have You Been’ গল্পটি তিনি লিখেছেন ১৯৬৬ সালে এবং এটা উৎসর্গ করেছিলেন বব ডিলানকে। এই গল্পটি মূলত কল্পনা আর বাস্তব জগতের জটিলতার সংঘর্ষের ফলে একটা কিশোরীর মনস্তত্ত্বে কী প্রভাব ফেলে, তাই বর্ণিত হয়েছে। পুরুষতন্ত্রের জোরের কাছে একজন কিশোরীর প্রেমময় কল্পনার জগৎ কতটা অসহায়, তার পরিণতি কতটা করুণ হতে পারে, সেই বর্ণনা আছে এ গল্পে।]

মেয়েটার নাম কনি। পনেরো বছর বয়সী একটা মেয়ে ও। কী এক অদ্ভুত অভ্যাস ছিল ওর, একটু পরপরই গলা বাড়িয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি হাসত আর প্রতিবারই নিজের মুখটা দেখে নিত। আবার অন্যদের দিকে তাকিয়েও সচেতনভাবে বুঝে নিতে চাইত, ওকে ঠিকঠাক দেখাচ্ছে কি না! কনির মা অবশ্য এই বিষয়টা খুব খেয়াল করত। আর বিরক্ত হতো ভীষণ, মেয়ের এই এত তীব্র নার্সিসিস্টিক আচরণে। কিছুতেই তিনি বুঝতে পারতেন না, কী এমন আছে ওর মুখে যে বারবার করে নিজের মুখটা দেখতে হবে! ধমক দিয়ে বলতেন, ‘থামাও তোমার এই পাগলামি! এতবার করে নিজের মুখটায় কী দেখছো ? ভাবছো, তুমি দেখতে খুব সুন্দর ?’

মায়ের এই অভিযোগের পুনরাবৃত্তি গায়েই মাখত না কনি। ভুরুটা একটু উঁচু করে এমন এক রহস্যময় দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকাত, যেন চোখ দিয়েই বলল, তুমি যা বলো তাই বলো, আমি জানি আমি সুন্দর। কনির মা-ও একটা সময়ে সুন্দরী ছিলেন, পুরনো ছবির অ্যালবাম ঘাটলে তার প্রমাণ পাওয়া যাবে। তবে সেই সৌন্দর্যের এখন আর তেমন কিছু বাকি নেই। আর এই আক্ষেপেই হয়তো তিনি কনির পেছনে এটা নিয়ে লেগে থাকে সারাক্ষণ।

‘আচ্ছা, তুমি কি তোমার ঘরটা একটু গুছিয়ে রাখতে পারো না ঠিক করে, তোমার বোনের মতো ? এই, তোমার চুলগুলো এমন শক্ত হয়ে আছে কেমন করে ? আর কেমন একটা বিশ্রী গন্ধও আসছে চুল থেকে! হেয়ার স্প্রে ব্যবহার করেছো ? ইসস! কই, তোমার বোন তো এসব ছাইপাঁশ চুলে দেয় না!’ কনিকে থেকে থেকে এসব বলতেই থাকে মা।

জুন ওর বোন, বয়স চব্বিশ, একই বাড়িতে থাকত। দেখতে শুনতে গাট্টাগোট্টা, স্বভাবে ধীরস্থির। কনি যে স্কুলে পড়ত, সেই স্কুলে সে সেক্রেটারির কাজ করত। একই বাড়িতে থেকে সারাক্ষণ যদি সেই বোনের প্রশংসা শুনতে হয়, মা আর মায়ের বোনের মুখে―সেটা কনির একটুও ভালো লাগত না। লাগার কথাও নয়! জুন এটা করেছে, জুন ওটা করেছে, জুন টাকা জমিয়েছে, ভালো রান্না করত, ঘর গুছাত! বোনের এত সব পারার মধ্যে কনি কিছুই করত না, শুধু দিবাস্বপ্ন দেখা ছাড়া! ওর বাবা কাজে সারা দিন প্রায় বাইরেই থাকতেন। আর কাজ সেরে ঘরে ফিরেই খবরের কাগজ হাতে নিয়ে সান্ধ্য খাবারটা খেতেন। এরপর সোজা বিছানায় গিয়ে ঘুমানোর আয়োজন। কনির বাবা খুব একটা কথাই বলতেন না, তবে তার মাথার কাছে বসে ওর মা কনির বিষয়ে বলতেই থাকতেন। ও বিরক্ত হয়ে ভাবত, মা টা মরে না কেন! আর এরপর সে-ও মরে গেলে ভালো হতো। মুক্তি মিলত এত সব কথার ঝামেলা থেকে। সে তার বন্ধুদের মাঝেমধ্যে বলত, ‘সে আমাকে বাধ্য করে আমি যেন তাকে ছেড়ে চলে যাই।’ আর এই কথাটা সে এমন বিষাদী স্বরে বলত যে, আদতেই এটা সত্য না কি মিথ্যা, বোঝা কঠিন হতো।

বাড়িতে এত সব অসহ্য লাগা বিষয়ের মধ্যে একটা জিনিস কনির ভালো লাগত। জুনের মেয়ে বন্ধুরাও জুনের মতো সোজা আর শান্ত হওয়ায়, ওর বন্ধুদের সঙ্গে বাইরে ঘোরাঘুরি করতে যাওয়াতে কোনও বারণ ছিল না। সেই সুযোগে কনিরও বন্ধুদের সঙ্গে বাইরে ঘুরতে যাবার বিষয়টি সহজ ছিল। কনির সবচেয়ে কাছের বন্ধুর বাবা ওদের সব মেয়েবন্ধুকে গাড়িতে করে তিন মাইল দূরে শহরের একটা শপিং মলে নামিয়ে দিয়ে আসতেন, প্রায় প্রায় সপ্তাহান্তে। ওরা সদলে ওখানে দোকানে ঘোরাঘুরি করত, সিনেমা দেখত, খাওয়া-দাওয়া করত, হইহল্লা করত। তারপর রাত এগারোটার দিকে এসে মেয়েটির বাবা আবার নামিয়ে দিতেন যার যার বাড়িতে। সারাপথ একবারও জিজ্ঞেস করতেন না, ওরা সারা বিকেল-সন্ধে ওখানে কী করল!

ওখানে ওরা পরিচিত জায়গার মধ্যেই ঘোরাঘুরি করত, মলের আশেপাশেই থাকত। সকলেরই পরনে থাকত ছোট প্যান্ট, পায়ে ব্যালেরিনা স্লিপারস, হাতে চিকন চুড়ি―ওদের চুড়ির আওয়াজ আর খিলখিল হাসির আওয়াজে বাকিরা ফিরে ফিরে তাকাত ওদের দিকে। এদের মধ্যে কনির ছিল দীর্ঘ গাঢ় সোনালি রঙা চুল, চুলগুলো সে সামনের দিকে ফুলিয়ে ওপরে তুলে বেঁধে রাখত। কিছুটা চুল ছেড়ে রাখত যা ওর ঘাড় বেয়ে নিচে নামত। এটা যে কারওরই নজর কাড়ত। ওর গায়ে থাকত একটা গলাঢাকা ব্লাউজ―ঘরে সে এটা পরত একভাবে আর যখন বন্ধুদের সঙ্গে বাইরে আসত, তখন পরবার ঢঙটা বদলে নিত। তার চলন-বলনের সবকিছুই ঘর আর বাইরে―দুই রকম ছিল। ঘরে সে একদম অন্য এক মানুষ। আর বাইরে বেরোলেই যেন সে হয়ে উঠত অন্য এক কনি। চপল-চঞ্চল হাঁটবার ছন্দ, হাঁটবার সময়ে কানে হেডফোন লাগানো থাকত ওর। সারাক্ষণই হাঁটত, চলত গানের সুরে দুলে দুলে। তবে ঘরে যখন থাকত, কেমন মলিনতা মাখানো থাকত ওর চোখটায়। আর সেই চোখই ঘরের বাইরে বেরোলে হয়ে উঠত উজ্জ্বল। চোখের তারাটা নাচত তখন। ঘরের অকরুণ জলভরা চোখ দুটো যেন পুলকিত হয়ে ওঠে, হাতের চুড়ির মতো রিনরিনিয়ে গেয়ে উঠত, উচ্চকিত স্বরে।

সবসময়েই যে তারা শপিং মলে বা সিনেমায় যেত, তা নয়। মাঝে মাঝে হাইওয়ে ধরে দ্রুতগতিতে চলে যেত আরও দূরের কোনও রেস্তরাঁতেও। ওখানে ওদের চেয়ে আরেকটু বেশি বয়সী ছেলেমেয়েরা আনন্দ-ফুর্তি করত। রেস্তরাঁটা দেখতে ছিল একটা বোতলের মতো, তবে বোতলের চেয়ে একটু খাটো অবয়ব। মুখটার কাছে একটা ছেলের মূর্তি―হাসি হাসি মুখে বসে আছে আর একটা হ্যামবার্গার শূন্যে ছুড়ে দিচ্ছে, এমনটা। একরাতে হলো কী, ওরা এক দমে রাস্তাটা পার হয়ে দেখল, একটা গাড়ির জানালায় দিয়ে একটা ছেলে ওদেরকে ইশারা দিয়ে ডাকছে। হাইস্কুলে পড়া ছেলে মনে হলো। ওরা ওকে পাত্তাই দিল না। সারি সারি গাড়ি রাখা পার্কিং পাশ কাটিয়ে সেই আলোয় ঝলমল রেস্তরাঁটার দিকেই এগুলো তারা। ভেতরে ঢুকে মনে হলো, ঠিক এরকম একটা স্বর্গীয় আনন্দের জায়গাই তো ওরা খুঁজছিল। কাউন্টারের পাশে একটা জায়গায় বসল গোড়ালিতে ভর দিয়ে। চারপাশ দেখেশুনে ওদের ছোট্ট কাঁধটা শক্ত হয়ে উঠল উত্তেজনায়। ভেতরে তখন গান বাজছিল। ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজছিল, চার্চে যেমন বাজে। কী মধুর সেই সঙ্গীত! যেন এর ভেতরে ডুব দিয়ে থাকা যায়!

এডি নামের একটা ছেলে পাশের একটা টুলে এসে বসল। আর একটু পরপর পিঠটা ঝুঁকে ঝুঁকে যেন ভাব জমাতে চাইল ওদের সঙ্গে। কনিকে সে জিজ্ঞেস করল কিছু খাবে কি না! কনি সম্মতি দিল। ও তার বন্ধুর হাতটায় একটু টোকা দিতেই সে সকৌতুকে কনির মুখ তুলে কনির দিকে তাকাল। কনি বলল, ‘আমি আসছি, এগারোটার মধ্যেই দেখা হবে আবার, আমাদের ফেরবার সময়ের আগেই আসব আমি।’

‘ওকে এভাবে একা রেখে যেতে আমার খারাপ লাগছে।’ যেতে যেতে ছেলেটিকে বলল ও।

‘না, না। বেশিক্ষণ তোমার বন্ধুকে এখানে একা থাকতে হবে না’। বলেই কনিকে নিয়ে বেরিয়ে এসে গাড়ির কাছে এল। গাড়ির কাচে নিজের মুখটা দেখতে পেল কনি। আনন্দে চকচক করছে ওর চোখ-মুখ। এডির সঙ্গে ওর অন্তরঙ্গ কিছু হলো, এরকম কিছু নয়। ওর উচ্ছ্বাস, আনন্দটা বোধহয় ভেতরে বাজতে থাকা সঙ্গীতের ওই মূর্ছনার জন্য। সে কাঁধটাকে একটু ঝাঁকা দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল, ভেতরের উচ্ছ্বাস সে চেপে রাখতে পারছিল না। হঠাৎই কনির চোখ পড়ল কয়েক ফুট দূরে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ছেলের দিকে। সোনালি রঙের জেলোপির পাশে দাঁড়ানো ঝাঁকড়া চুলওয়ালা একটা ছেলে। ওর দিকে তাকিয়ে আছে আর ঠোঁটটা প্রসারিত করে হাসছে। কনি একবার দেখেই চোখ ফিরিয়ে নিল। কিন্তু কয়েক মুহূর্ত পরে আবার ফিরে তাকাল। দেখল ছেলেটি তখনও তাকিয়ে আছে। আর আঙুল দুলিয়ে ওকে বলছে, ‘তোমার সঙ্গ চাই, বেইবি।’ কনি আবার এদিকে ফিরল, এডি কিছু বুঝে উঠবার আগেই।

প্রায় তিন ঘণ্টা এডির সঙ্গে কাটাল কনি। ওরা হ্যামবার্গার খেল, কোক পান করল, যদিও জায়গাটা খুব একটা আরামের নয়, ওরা গরমে ঘামছিল। এরপর প্রায় মাইলখানেক ঢালু রাস্তা পেরিয়ে এগারোটা বাজবার ঠিক পাঁচ মিনিট আগে কনিকে ওর সেই মেয়ে বন্ধুটার কাছে পৌঁছে দিল এডি। মলের সব দোকানপাট তখন বন্ধ হয়ে গেছে, সিনেমা হলটা ছাড়া। মেয়েটা একা ছিল না, একটা ছেলের সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। কনির সঙ্গে চোখাচোখি হতেই, দুজনেই হেসে উঠল। কনি বলল, ‘সিনেমা কেমন দেখলে ?’ মেয়েটা হেসে বলল, ‘সে তো তুমিই ভালো জানো আমার চেয়ে!’ ওরা বেরিয়ে মেয়েটার বাবার সঙ্গে ফিরতি পথ ধরল। কনির কেমন ঘুম ঘুম পাচ্ছিল, তৃপ্তিতে। ও পেছন ফিরে ফাঁকা হয়ে যাওয়া, প্রায় অন্ধকার সিনেমা প্লাজাটা দেখল। ওপারে রেস্তরাঁটা তখনও খোলা, পার্কিংয়ে অনেক গাড়ি তখনও চলাচল করছিল। কনি দেখতে পাচ্ছিল, কিন্তু ওখানে বাজতে থাকা গানের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিল না আর।

পরদিন সকালে জুন ওকে জিজ্ঞেস করল সিনেমা কেমন লেগেছে। ‘ভালোই।’ কনির উত্তর।

সই বন্ধুটা আর আরও একটা মেয়ের সঙ্গে কনি সপ্তাহে কয়েকবার বেরত। ওটা ছিল গরমের ছুটির সময়। বাড়িতেই বেশিটা সময় কাটত কনির―মায়ের ওই সব কথা শুনে আর নিজের ভাবনায় ডুবে থেকে। ও সেই ছেলেগুলোর কথা ভাবত বসে, যাদের সঙ্গে ও বাইরে গেলে দেখা করেছিল। তবে আলাদা করে কারও মুখ মনে করতে পারত না। প্রতিটা ছেলের মুখই গুলিয়ে মিলিয়ে একটা কোনও ছেলের মুখে―না মুখ নয়, একটা কোনও ধারণা বা ভাবনায় গিয়ে মিশে যেত। আর সেই ভাবনা গিয়ে ডুবে যেত কানে বাজতে থাকা গানের সুরের মধ্যে, মধ্য জুলাইয়ের রাতের আর্দ্র হাওয়ার সঙ্গে। দিনের আলো ফুটলেই মা আবার তাকে খোঁচাখুঁচি শুরু করে দিত, বিভিন্ন কাজের তাগাদা দিতে থাকত। হয়তো হঠাৎ করে বলে উঠত, ‘কই, সেই আহ্লাদী মেয়েটার কী খবর, কী যেন নাম, পেটিনজার ?’

‘ওহ! ওই মেয়েটা ? বোকা মেয়েটার কথা বলছো ?’ কনি উত্তরে বলল। ও সবসময়ই একটা মোটাদাগের আড়াল রেখে চলত এই মেয়েদের কাছ থেকে। আর ওদেরকে নিয়ে মাকে যা-ই বলত, ওর মা সবই বিশ্বাস করত। একটু সহজ আর বোকা টাইপ মানুষ ছিল কনির মা। মাঝেমধ্যে কনিরও মনে হতো, মাকে এভাবে বোকা বানানোটা কি ঠিক হচ্ছে ? ওর মা সারাদিন স্লিপার একটা পায়ে গলিয়ে সারা ঘর এলোমেলো ঘুরে বেড়াত। আর অবসর পেলেই ফোনে বোনেদের সঙ্গে কথা চালাচালি করত। এর কথা শুনে ওকে বলত আবার ওই বোনের কথা শুনে একে বলত। আর নিজের মেয়েদের প্রসঙ্গ এলে জুনের কথা যতটা সন্তোষের সঙ্গে বলত, কনির কথা ততটা নয়। তবে আবার এ-ও নয় যে, কনিকে খুব একটা অপছন্দ করত। তবে কনি মনে করত, তার সুন্দর চেহারার জন্যই হয়তো জুনের চেয়ে সামান্য বেশি পছন্দ করত। ওদের দু বোনের মধ্যে আলগা একটা উত্তেজনার ভাব সবসময়ই দেখা যেত। মনে হতো যেন বিশেষ কিছু একটা নিয়ে ওদের মধ্যে শীতল লড়াই চলছে। দড়ি টানাটানি লেগেই আছে যেন। কখনও কখনও কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে তাদের বন্ধুত্ব একটু দানা বাঁধে। কিন্তু মাছির ভনভনানির মতো সেই অজানা বিরক্তিটা আবার ফিরেফিরে ঘুরে আসে ওদের মগজের কাছে, মুখের ছাপে। ওদের শক্ত হয়ে-ওঠা মুখটায় তখন ঘৃণার ছায়ায় ঢেকে যেত।

এক রবিবারের সকালে বেশ দেরিতেই ঘুম থেকে উঠল কনি। ওদের কারও তাড়া থাকে না চার্চে যাবার। কনির হাতে আজ অনেক সময়―চুল ভিজিয়ে স্নান করে রোদে বসল ও। রোদে দীর্ঘ চুলটা শুকাবে বলে। এক আত্মীয়ের বাড়িতে সারা দিনের বারবিকিউয়ের নেমন্তন্নে যাবার কথা জুন আর ওর মা-বাবার। কনি খুব একটা উৎসাহ দেখাল না যেতে। বলল,  ‘তোমরা যাও। আমার ইচ্ছে করছে না।’ মা কনির মুখটায় চোখ বুলিয়ে কী বুঝল কে জানে! কর্কশ স্বরে বলে উঠল, ‘থাকো তুমি একলা বাড়িতে।’ সামনের উঠোনটায় বসে কনি দেখল, ওরা সকলে বেরিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাবা বরাবরের মতোই চুপচাপ, পেছনে তাকিয়ে গাড়িটা ঘোরানোর চেষ্টা করছিল। আর মায়ের রাগ তখনও পড়েনি। কাচের ওপাশ থেকেই রাগ-রাগ চোখে কনির দিকে তাকিয়ে থাকল। আর বেচারা জুন! পেছনের সিটে সেজেগুজে মনমরা হয়ে বসেছিল; বাচ্চাদের চেঁচামেচি ছাড়া বারবিকিউয়ের আর কোনও আনন্দ সম্পর্কে যেন ও কিছু জানেই না।

একলা বাড়িটায় কনি বসেই রইল চোখটা বুজে, আপন মনে। ভাবনার জগতে ভেসে যেতে থাকল সে। আগের রাতে যে ছেলেটির সঙ্গে ও ডেইটে গিয়েছিল, তার মুখটা মনে পড়তে থাকল। আবেগে, ভালো লাগার আবেশে সে হারিয়ে যেতে থাকল নিজের ভাবনায়। ছেলেটি কীভাবে কথা বলেছে, কীভাবে তারা আদর করেছিল, সে সব মনে হতেই ওর অন্যরকম এক ভালোবাসার অনুভূতি হচ্ছিল। সিনেমার চরিত্রের মানুষেরা যেমন, গানের লিরিকে যেমন ভালোবাসার মানুষের ছবি আঁকা থাকে, ছেলেটিকে ওরকম মনে হচ্ছিল। কনি যখন চোখ খুলল, ও কোথায় বসে আছে বাস্তবে, ঠিক ঠাহর করতে পারছিল না। ওর মনে হতে থাকল, উঠানটা ঘাস-লতাপাতায় ভরে গেছে, বেড়াগুলো সব গাছের সারিতে সেজে দাঁড়িয়ে আছে। আর তার ওপারে ওপরের আকাশটা বড্ড বেশি নীল। আর তিন বছরের পুরনো ওদের আসবেস্টসের বাড়িটাও চোখে যেন চমক লাগাচ্ছিল―যেন এইমাত্র ওর ঘুম ভাঙল।

সেদিন খুব গরম ছিল। বাইরে আর না বসে ঘরের ভেতরে গিয়ে রেডিয়োটা ছেড়ে দিল সে। ঘরের নৈঃশব্দ্য গানের সুরে সুরে ভরে উঠল। খালি পায়ে বিছানার ধারটায় বসে কনি গানই শুনে যেতে লাগল। একের পর এক, অবিরাম শুনে যেতে লাগল। ঘণ্টা পেরিয়ে গেল, কনির কোনও খেয়াল নেই। ও গান শুনছিল, আর সঙ্গে সঙ্গে গাইছিল―রেডিয়োতে তখন ঢণত-এর সানডে জাম্বুরি বাজছিল। ‘ইড়ননু করহম’-এর ‘অহ ষড়ড়শ যবৎব, ুড়ঁ মরৎষং ধঃ ঘধঢ়ড়ষবড়হ’ংÍঝড়হ ধহফ ঈযধৎষবু ধিহঃ ুড়ঁ ঃড় ঢ়ধু ৎবধষ পষড়ংব ধঃঃবহঃরড়হ ঃড় ঃযরং ংড়হম পড়সরহম ঁঢ়!’

গান শুনতে শুনতে সে সঙ্গীতের সুরধারায় স্নান সেরে নিচ্ছিল যেন। তার ভেতরের মুগ্ধতা গানের লয়ে ঢেউয়ের মতো দুলতে থাকল। অলসভাবে নিজেকে এলিয়ে দিল গানের স্রোতে… ছোট ছোট শ্বাস-প্রশ্বাসে তাল মিলিয়ে তার বুকটাও ধীর লয়ে দুলছিল যেন।

কয়েক মুহূর্ত পরে কনি শুনতে পেল, বাইরে একটা গাড়ি এসে থামল। একটু চমকে উঠল ও―না, তার বাবার তো এত তাড়াতাড়ি ফেরবার কথা নয়। অনেক দূর থেকে রাস্তার নুড়িগুলোর মচমচানি আওয়াজ ভেসে আসছিল, গাড়ির চাকার নিচে পড়ছিল তো ওগুলো। দৌড়ে গেল সে জানালায়। একটা গাড়ি এগিয়ে আসছে, দেখতে পেল, কিন্তু চেনা নয়। একটা সোনালি রঙের জেলোপি! সূর্যের আলো পড়ে তা আরও জ্বলজ্বল করছিল। উত্তেজনায় ওর হৃদকম্পন বেড়ে গেল গাড়িটা দেখতে পেয়ে! দু’হাতের আঙুল দিয়ে চুলের মধ্যে বিলি কাটতে শুরু করল―ওহ! ঈশ্বর! ওহ! ঈশ্বর বলে বিড়বিড় করতে থাকল। আর ঠিক তখুনি গাড়িটা এসে থামল ওদের বাড়ির সামনে। যেন আগে থেকে জানা কোনও সংকেত―ঠিক এভাবেই চারটে হর্ন বাজাল ভেতর থেকে কেউ।

কনি দৌড়ে গেল রান্নাঘরের দরজার ওদিকে! তারপর পর্দাঢাকা কাচের দরজাটা সরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতেই গাড়ির ভেতরের দুজন ছেলেকে দেখতে পেল। আরে! এদের একজন তো সেই ছেলেটা! সেদিন ওই রেস্তরাঁর সামনে দাঁড়িয়ে কয়েক মুহূর্ত চোখাচোখি হয়েছিল। ঝাঁকড়া কালো চুলভর্তি মাথায়, মনে হচ্ছিল নকল চুল! আর ওর দিকে তাকিয়ে হাসছিল! 

‘আমি নিশ্চয়ই দেরি করে ফেলিনি ? নাকি দেরি হলো আসতে ?’ ছেলেটি বলল।

‘তুমি কে ? তোমার পরিচয় কী ?’

‘সে কি ? আমি কি তোমাকে বলিনি আগে ?’

‘আমি তোমাকে চিনিই না।’ কনি খুব বিষণ্ন গলায় বলে উঠল। খুব একটা আগ্রহ প্রকাশ করল না তার কথায়। দেখতে চাইল গাড়ির ভেতরের অন্য ছেলেটাকে। এক গোছা সোনালি চুলে তার কপাল ঢাকা, পাশ দিয়ে মুখের যেটুকু দেখা যাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছিল, সে একটু বিব্রত। দুজনেই রোদচশমা পরা চোখে। যে ছেলেটা গাড়ি চালাচ্ছিল, তারটা মেটালিক। বাইরের সবকিছুই প্রতিফলিত হচ্ছিল সেই কাচে।

‘তুমি কি ঘুরতে যেতে চাও ?’

কনি একটু হাসল এবার। হাত দিয়ে চুল সরাল ওর কাঁধের এক পাশ থেকে।

‘আমার গাড়িটা তোমার পছন্দ হলো না ? রঙ করিয়েছি নতুন। এই, শুনতে পাচ্ছ তুমি ?’ ছেলেটা বলল।

‘কী ?’

‘তোমাকে দেখতে না খুব মিষ্টি।’

শুনে কনি যেন একটু অস্বস্তিতে পড়ল। দৌড়ে ঘরে যাবার ভান করল।

‘তোমার কি বিশ্বাস হচ্ছে না আমার কথা ?’

‘দ্যাখো, সত্যিই আমি তোমাকে চিনি না।’ এবার একটু বিরক্ত হয়েই বলল কনি।

‘এই শোনো, এলির রেডিয়ো আছে সঙ্গে। আমারটা ভেঙে গেছে।’ বলেই ছেলেটি হাতটা উঁচু করে ছোট্ট রেডিয়োটা দেখাল। ওখানে তখন গান বাজছিল। কনি শুনতে পেল, সেই গানের অনুষ্ঠানটাই রেডিয়োতে বাজছে, যা ও শুনছিল এতক্ষণ।

‘ববি কিং ?’ কনি জানতে চাইল।

‘আমি একেই সারাক্ষণ শুনি। ওর মতো কেউ গায় না আর।’

‘হ্যাঁ। ও আসলেই দারুণ শিল্পী।’ একটু উদাস সুরে বলল কনি।

‘জানো তো, সে সত্যিই খুব ভালো শিল্পী। সে জানে গানে কোথায় কোণ কাজটা করতে হয়।’

এবার কনি একটু উচ্ছ্বসিত হলো। তবে সে এখনও ঠিক বুঝতে পারছে না, ছেলেটাকে কি পছন্দ করা যায়, না কি ফালতু। রোদচশমায় ছেলেটার চোখটা ঢাকা থাকায় সে ঠিক বুঝতে পারছিল না, ছেলেটা কী দেখছে। সে দৌড়ে সিড়ির গোড়ায় গিয়ে দাঁড়াল এবার, তবে নিচেও নামলো না। আবার ঘরেও ঢুকলো না।

‘তোমার গাড়ির গায়ে এত সব কী আঁকা ?’

‘তুমি পড়তে পারছো না ?’ বলে ছেলেটি আস্তে করে গাড়ির দরজাটা খুলল। এত কোমলভাবে খুলল, যেন জোরে খুললেই সব লেখা গা থেকে ঝরে পড়বে। গাড়ি থেকে নেমে, মাটিতে শক্ত করে পা-টা রেখে এবার রোদচশমাটা নামাল চোখ থেকে। এবং তাকাল কনির গায়ের সবুজ ব্লাউজটা বরাবর।

‘এটা আমার নাম লেখা।’ সে বলল। ‘আরনল্ড ফ্রেন্ড’। কালো কালিতে লেখা―পাশে কুমড়োর মতো দেখতে একটা মুখ, হাসছে, তার চোখে কোনও রোদচশমা নেই।

ছেলেটি বলতে শুরু করল, ‘এবার তাহলে আমার পরিচয়টা দিই। আরনল্ড ফ্রেন্ড। এটাই আমার সত্যিকারের নাম। আর গাড়ির ভেতরে যে বসে আছে, ও এলি অস্কার। ও স্বভাবে একটি লাজুক ধরনের।’

এলি তার ছোট্ট রেডিয়োটা ঘাড়ের উপর রেখে একটু ঠিকঠাক জায়গায় বসাতে চাইল।

‘এই যে গাড়ির গায়ে নাম্বারগুলো দেখছো, এটা একটা গোপন সংকেত।’ আরনল্ড ফ্রেন্ড ওকে সংখ্যাগুলো পড়ে শোনালো। ৩৩, ১৯, ১৭… ভুরুটা উঁচিয়ে বুঝতে চাইল, কনি এই সংখ্যার মানে বুঝেছে কি না। কনি অবশ্য নাম্বারের দিকে অত মনোযোগ দিল না। বাঁদিকের পেছনের বাম্পারটা ঘষা-লাগা আর ওখানে সোনালি রঙের ওপর কালো রঙে লেখা, ‘উঙঘঊ ইণ অ ঈজঅতণ ডঅগঅঘ উজওঠঊজ’! এটা দেখে কনি সশব্দে হেসে উঠল। ওর হাসি দেখে এবার আরনল্ড একটু সহজ হয়ে বলল, ‘এসো, দেখে যাও। গাড়ির এদিকটায় অনেক কিছু আঁকা আছে। তুমি দেখতে চাও ?’

‘না।’

‘কেন নয় ?’

‘কেন দেখব আমি ?’

‘তুমি দেখতে চাও না গাড়িতে আর কী আছে ? তুমি ঘুরতে যেতে চাও না ?’

‘না, আমি জানি না।’

‘কেন জানো না ?’

‘ঘরে অনেক কাজ আছে আমার।’

‘কী রকম কাজ ?’

‘আছে। কাজ আছে।’

কনির কথা শুনে সে এমনভাবে হেসে উঠল যেন ও খুব একটা মজার কথা বলেছে। ও ঊরু চাপড়ে হাসতে লাগল। সে একটু অদ্ভুতভাবে দাঁড়িয়ে ছিল, যেন পড়ে না যায়―এরকম একটা ভঙ্গিতে গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। অত লম্বা নয় নয় ছেলেটা দেখতে। কনি যদি পাশে এসে দাঁড়ায় তো ওর চেয়ে ইঞ্চিখানেক লম্বা হতে পারে। ছেলেটি যে বসনে সেজেছিল, কনির পছন্দ হলো। টাইট রঙ জ্বলে-যাওয়া জিন্স প্যান্ট, বুট, একটা মেটালের বেল্ট পরা―এমনভাবে পড়েছে যে, ওর কোমরটা চিকন সেটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। সাদা একটা শার্ট, গায়ে চেপে বসে আছে এমন, আর তাতেই হাতের আর কাঁধের মাসলের আভাস বাইরে থেকে ফুটে উঠেছিল। ওকে দেখে মনে হতে পারে, সে খুব পরিশ্রমের কাজ করে, শক্ত-ভারী জিনিস ওঠানো-নামানোর কাজ। এমন কি তার গলাটাও শক্ত ভাঁজের। মুখটাও খানিকটা ওরকম গোছের। চোয়ালের দিকটা একটা কালো লাইনের মতো ফুটে উঠেছে, হয়তো গত দু একদিন দাড়ি কামায়নি। তার নাকটাও কেমন দাঁড়কাকের মতো বাঁকানো। আর এমনভাবে নিঃশ্বাস নিচ্ছে, যেন গন্ধ শুঁকছে―চারপেয়ে প্রাণিরা খাবার সামনে পেলে যেমনটা করে!

‘কনি, তুমি কিন্তু সত্যি কথা বলছো না। আজকের দিনটায় তুমি আমার সঙ্গে বাইরে যাবে এমন প্রস্তুতিই নিয়েছিলে।’ ছেলেটি হাসতে হাসতে বলল।

‘আমার নাম তুমি কী করে জানলে ?’ সন্দেহভরা চোখে ও জানতে চাইল।

‘আমি জানি। কনি।’

‘হতেও পারে। নাও হতে পারে।’

‘আমি আমার কনিকে চিনি।’ আঙুল দোলাতে দোলাতে সে বলল। কনির এবার ছেলেটাকে স্পষ্ট করে মনে পড়ল। ওই সেদিন রেস্তরাঁর পেছনে―কয়েক মুহূর্তমাত্র―তবু, ও যখন ছেলেটাকে পাশ কাটিয়ে এগোলো, ওর চিবুকটা তপ্ত নিঃশ্বাসে কেমন ওম পেয়েছিল, ছেলেটার কথাই তো সেই মুহূর্তে ও ভাবছিল। আর ছেলেটিও এত গভীর দৃষ্টিতে ওকে দেখছিল! কনিকে তো তার মনে থাকারই কথা!

‘এলি আর আমি শুধু তোমার জন্যই এখানে এসেছি। এলি পেছনে বসবে। তুমি আমার পাশে বসে যাবে। কেমন হবে ?’ 

‘কোথায় ?’

‘কোথায় মানে ?’

‘কোথায় মানে, আমরা কোথায় যাব ?’

সে কনির দিকে তাকাল। রোদচশমাটা নামাল। কনি এবার পরিষ্কার দেখতে পেল, ছেলেটার চোখের চারপাশটা কেমন ক্লান্ত, মলিন। ছায়ায় এতক্ষণ এতটা বোঝা যাচ্ছিল না। আলো পড়াতে সব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তার চোখটা ছোট্ট ছোট্ট কাচের টুকরোর মতো, আলোটা খুব ঘন ঘন প্রতিফলিত হয় চোখে। সে হাসল। যেন কোথায় যাবে কিছুই জানে না, এখুনি নতুন করে ভাবতে হবে।

‘আরে, বিশেষ কোনও জায়গায় নয়। শুধুই ঘুরব আমরা, কনিসোনা।’

‘আমার নাম যে কনি, একবারো কিন্তু তোমাকে বলিনি আমি।’

‘কিন্তু আমি তো জানি তোমার নাম। শুধু নাম নয়। আমি অনেক কিছু জানি। তোমার সবটা জানি আমি।’ সে কিন্তু একটুও নড়েনি। গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েই কথাগুলো বলছিল আরনল্ড।

‘তোমার জন্য আমি আলাদা করে সময় ব্যয় করেছি। এত সুন্দর দেখতে তুমি! তোমার সব খবর আমি নিয়েছি। আমি জানি তোমার বোন আর মা-বাবা আজ কোথায় গেছে, কতক্ষণ হলো গেছে। এ-ও জানি, কাল সন্ধ্যাতে কার সঙ্গে কাটিয়েছো তুমি। আর তোমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুর নামও জানি আমি। বেটি। ঠিক বলেছি না ?’

এমন ছন্দোময় সুরে সে কথা বলছিল যেন কোনও গানের লাইন পড়ছে। মন্দ ভাবার মতো কিছুই চোখে পড়ছিল না কনির। আর ওদিকে গাড়ির মধ্যে বসে জোরে রেডিয়ো ছেড়ে গান শুনতেই থাকল এলি। বাইরে তারা কী কথা বলছে, কোনও মনযোগই ছিল না ওর তাতে।

‘এলি পেছনেই বসতে পারবে।’ আরনল্ড ওর বন্ধুর দিকে তাকিয়ে বিষয়টি নিশ্চিত করাতে চাইল কনিকে।

‘তুমি এত কিছু জেনেছো কেমন করে ?’

‘শোনো, বেটি শুজ আর টনি ফিজ, তারপর জনি পেটিনজার আর ন্যান্সি পেটিনজার, এদিকে রেমন্ড স্ট্যানলি, বব হান্টার…’ এক নিঃশ্বাসে সে বলে গেল।

‘তুমি এদের সক্কলকে চেনো ? আশ্চর্য!’

‘সব্বাইকে চিনি আমি।’

‘এটা কী করে সম্ভব ? তুমি তো এখানের মানুষ নও। তুমি নিশ্চয়ই মজা করছো ?’

‘নিশ্চয় আমি এখানের।’

‘তাহলে এতদিনে একবারও কেন দেখিনি তোমাকে আগে ?’

‘অবশ্যই তুমি আমাকে দেখেছো। মনে করতে পারছো না শুধু।’ নিজের বুটের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলল সে।

‘আমার মনে হচ্ছে, মনে করতে পারব।’

‘ঠিক।’ তার মুখটা চকচক করে উঠল। এবার সে যেন খুশি হয়ে উঠল। এলির রেডিয়োতে বাজতে থাকা গানটা শুনতে শুনতে নিজের মুঠিতে টোকা দিতে থাকল। আর কনির চোখ তার দিক সরে গাড়ির দিকে পড়ল। এত উজ্জ্বল রঙে আঁকা সব! ওর চোখ ঝলসে যাবার মতো। নামটা আবার দেখল, আরনল্ড ফ্রেন্ড। আর সামনের বাম্পারে লেখা ‘Íগঅঘ ঞঐঊ ঋখণওঘএ ঝঅটঈঊজঝ.’ এই কথাগুলো ছেলেমেয়েরা আগে বেশ ব্যবহার করত। এখনকার দিনে ওভাবে আর করে না। সে এমনভাবে লেখাগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকল যেন এর অর্থ সে আগে কোনও দিন জানতোই না।

‘এই, তুমি কী এত ভাবছ ?’ আরনল্ড ফ্রেন্ড একটু জোরের সঙ্গেই জিজ্ঞেস করল। ‘হাওয়ায় তোমার চুল সব ওড়াউড়ি করবে, সেসব নিয়ে ভাবছ না কি ?’

‘না।’

‘তাহলে কী ? ভাবছো, আমি ভালো গাড়ি চালাতে পারি না ?’

‘সেটা আমি জানব কী করে ? আমার তো জানবার কথা নয়।’

‘তোমাকে বোঝা বড় মুশকিল মনে হচ্ছে। তুমি কি দ্যাখোনি আমি যে একটা চিহ্ন উড়িয়েছিলাম হাওয়ায়, তুমি যখন যাচ্ছিলে পাশ দিয়ে।’

‘চিহ্ন! কিসের চিহ্ন ?’

‘আমার চিহ্ন।’ বলেই সে বাতাসে একটা ঢ আঁকলো, কনির দিকে ফিরে। যদিও তারা প্রায় দশ ফুট দূরত্বে দাঁড়িয়ে, তবু হাতটা নামিয়ে ফেলবার পরেও বাতাসে কনি সেই ঢ চিহ্নর ছায়া দেখতে পেল। সে পর্দাটা টেনে দিয়ে দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে রইল। তার ঘরে যে গান বাজছে আর এলির রেডিয়োতে―দুটো গানের সুর সে মেলাতে পারছিল। কনি আরনল্ড ফ্রেন্ডের দিকে তাকিয়ে কিছু বুঝতে চাইল। ছেলেটি এমন ভাব দেখাচ্ছে, সে খুব আরামে দাঁড়িয়ে কথা বলছে, আদতে ওর ভেতরে একটা জড়তা কাজ করছিল। অনাবশ্যকভাবে সে গাড়ির হাতলটা ধরে ছিল, যেন ওখান থেকে সে আর নড়বেই না। কনি ওর দিকে তাকিয়ে ওর সমস্ত কিছু মেলাবার চেষ্টা করছিল। ওর টাইট জিন্স, যেটার উপর দিয়ে ওর ঊরু, নিতম্বের আকার সবই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, পায়ের চকচকে বুট, সাদা গায়ে লেগে-থাকা শার্টটা। সব, সব―কনি এক সুতোয় গাঁথতে চাইল। ওর মোলায়েম স্বরে কবিতার সুরে কথা বলা, রগড় করা আবার গম্ভীর হয়ে যাওয়া। গান শুনবার সময়ে হাতের কব্জিকে টোকা দিয়ে তাল মেলানো―সবই সে মেলাতে চাইল একত্রে, মানুষটার সঙ্গে। কিন্তু কোথায় গিয়ে মিলছিল না যেন আর।

‘আচ্ছা, বলো তো, তোমার বয়স কত ?’ হঠাৎ জিজ্ঞেস করে উঠল কনি।

এবার তার হাসিটা মিলিয়ে গেল পলকে। একটু অপ্রস্তুত হলো সে ওর এই আকস্মিক প্রশ্নে। কনি ওর দিকে তাকিয়ে আন্দাজ করল, ওর বয়স তিরিশ হবে। হতে পারে তারও বেশি। এটা বুঝবার পর ওর বুকের স্পন্দন দ্রুত হয়ে উঠল।

‘একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করে বসলে তুমি! এটা একটা প্রশ্ন হলো ? দেখছো না, আমি তোমারই বয়সী।’

‘তুমি মোটেও তা নও।’

‘তাহলে হয়তো আরও কটা বছর বড় হবো। আমি আঠেরো।’

‘আঠারো!’ কনি বিস্ময়ভরা কন্ঠে বলল।

ওকে আশ্বস্ত করতে আরনল্ড হাসল, মুখ প্রসারিত করে হাসি যাকে বলে। ওর ঠোঁটের পাশে চিকন চিকন দাগ দেখতে পেল কনি। বেশি হাসাতে ওর চোখটাও ছোট হয়ে এল, কনি দেখল ওর চোখের পাতাগুলো বেশ দীর্ঘ, কালো। আর মুখ হা করাতে দেখতে পেল বড় বড় সাদা দাঁত। এর মধ্যেই হঠাৎ আরনল্ড ওর কাঁধের পাশ দিয়ে তাকিয়ে দেখল এলি উদ্ভ্রান্তের মতো গান শুনেই চলেছে! বলল, ‘ওকে কি তোমার পাগল কিসিমের মনে হচ্ছে না ? ও এরকম একটা আলাভোলা।’ রোদচশমা পরে থাকায় ও কি ভাবছে আরনল্ড কিংবা কনি কারওরই বুঝবার পথ নেই। কোনওদিকেই তার কোনও খেয়াল নেই। কটকটে কমলা রঙের একটা বুকখোলা শার্ট পরেছিল সে। বোতাম অনেকটা খোলা থাকায় অনাকর্ষণীয় বুকটা দেখা যাচ্ছিল। একেবারেই কোনও মাসলম্যানদের মতো নয়। আর কলারটা বেখাপ্পারকম ওপরের দিকে তুলে রাখা, একেবারে চিবুক ঢেকে যাচ্ছে, এরকম। তার রেডিয়োটা কানের কাছে চেপে ধরে সে কিন্তু গান ছেড়েই রেখেছিল।

‘ও আসলেই একটু অদ্ভুত রকমের মানুষ মনে হচ্ছে।’ কনি বলল।

‘হেই! শুনতে পাচ্ছ, কনি বলেছে তুমি সত্যিই একটা পাগল কিসিমের মানুষ!’ বলতে বলতে সে গাড়ির ভেতরে মুখ বাড়িয়ে দিল। এই প্রথমবারের মতো এলি মুখ বের করে চাইল কনির দিকে। কনি তো ওকে দেখেই একটা ধাক্কা খেল, মনে হলো। সে তো মোটেও কোনও অল্পবয়সী ছেলে নয়। তার সাদা, ফ্যাকাশে মুখটা দেখে বোঝাই যাচ্ছে, কমের পক্ষে চল্লিশ বছর বয়স হবে ওর। আর মুখের চামড়াটা এত পাতলা যে, শিরা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল। কনির মাথাটায় যেন একটা চক্কর দিয়ে উঠল ওকে দেখে। সে নিজেকে ধাতস্থ করবার জন্য আরও কিছুক্ষণ এলির মুখে তাকিয়ে রইল। ও ভাবছিল, এটা যেন ওর চোখের ভুল হয়। আবার যেন তাকালে ওর বদলে যাওয়া মুখটা দেখতে পায়। এলি কিছু বলবার জন্য মুখ খুলল। কিন্তু কিছুই বলতে পারল না। তোতলাতে থাকল শুধু।

‘তোমরা দুজনে বরং ঘুরে এসো।’ কনি খানিকটা অবসন্ন গলায় বলল।

‘কি ? কী বললে ? এও হয় নাকি ? তুমি জানো আজ রবিবার। আর আমরা এখানে এসেছিই শুধু তোমার জন্য।’ তার গলার স্বরটা এখন শোনাচ্ছে একদম রেডিয়োতে কথা বলা লোকটার গলার মতো! ‘তুমি তো জানো আজ ছুটির দিন, রোববার। আর সোনা, তুমি কেন ভুলে যাচ্ছো, তুমি কার সঙ্গে আছো এই মুহূর্তে! কাল রাতে কার সঙ্গে ছিলে তুমি, সেটা কোনও বিষয়ই নয়। চলো, চলো, আমরা ঘুরে আসি।’ তার গলাটায় একটা আলগা আকুতি যোগ হলো, সঙ্গে খানিকটা উত্তাপ।

‘না। বললাম তো, কাজ আছে আমার।’

‘এই শোনো।’

‘উঁহু। তোমরা দুজনে বরং যাও ঘুরতে।’

‘তুমি সঙ্গে না গেলে আমরা এখান থেকে নড়ছি না।’

‘কিন্তু আমি তো মোটেও যাব না।’

‘কনি শোনো, লক্ষ্মীটি আমার, বোকামি কোরো না।’ মাথা নেড়ে নেড়ে বলল আরনল্ড ফ্রেন্ড। খুব হাসতে শুরু করল সে। এরপর ওর রোদচশমাটা মাথার ওপর তুললো ধীরে ধীরে, মনে হচ্ছিল যে ও একটা নকল চুল লাগিয়েছে আর কানের গোড়া দিয়ে গাছের ঝুরির মতো ঝাকড়া চুল বেয়ে নামছে। কনি তার দিকে তাকিয়েই রইল। মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করে উঠল, বিবশ লাগতে শুরু করল ওর। লোকটা গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঠিকই, তবে কনি তাকে দেখতে পাচ্ছিল ঝাপসা। সে কোথা থেকে এল, কোথায়ই বা আছে, এতক্ষণ কানে বাজতে থাকা গানের সুর… সবই কেমন তালগোল পাকিয়ে যেতে থাকল!

‘দ্যাখো, এখুনি যদি আমার বাবা চলে আসে তো তোমাদেরকে দেখবে।’

‘তিনি এখন আসবেন না, বারবিকিউ পার্টিতে আছে।’

‘তুমি এটাও জানো ? কীভাবে ?’

‘তারা এই মুহূর্তে টিল আন্টির ওখানে আনন্দ করছে। উঠানে বসে খাচ্ছে-দাচ্ছে পান করছে, নাচছে।’ ভাসা ভাসা স্বরে সে বলতে থাকল। ‘ওরা সকলেই এখন ওখানে বসে আছে। তোমার বোনটা! নীল একটা জামা পরে গেছে, পায়ে উঁচু হিল―কিন্তু কী বলব ? সে তোমার ধারেকাছেও না। তুমি এত সুন্দর! আর তোমার মা তো আরও ব্যস্ত। কতগুলো মোটা মহিলার সঙ্গে মিলে ভুট্টা ছিলছে।’ এমনভাবে সে কথাগুলো বলছিল যে, এতটা পথ পেরিয়েও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ওখানের সব!

‘মোটা মহিলা কাকে বলছো ?’ প্রায় চিৎকার দিয়ে বলে উঠল কনি।

‘আশ্চর্য তো! মোটা মহিলাগুলো কে, তা আমি বলব কী করে ? আমি পৃথিবীর সমস্ত মোটা মহিলাকে চিনে রেখেছি না কি ?’ হাসতে হাসতে বলল সে।

‘ওহ! বুঝেছি। ওটা মিসেস হর্ন্সবি। ওকে ওখানে নেমন্তন্ন করল কে ?’ কনির মাথাটা আবার ফাঁকা ফাঁকা লাগতে লাগল। বুক ধড়ফড় করতে শুরু করল।

‘ইশ, জানো তো, মোটা মহিলা আমার একেবারে পছন্দ নয়। কনি সোনা, আমার পছন্দ তোমার মতো দেখতে মেয়েকে।’ ঘুমজড়ানো চোখে বলে উঠল সে। দরজার কাছটাতে দাঁড়িয়েই কনি লোকটার দিকে তাকিয়ে রইল আরও বেশ কিছুক্ষণ। পরস্পর দৃষ্টি বিনিময় হচ্ছিল, এর মধ্যেই আরনল্ড ফ্রেন্ড বলে উঠল, ‘তো, তুমি কী করবে এখন ? এসো। দরজার ওখান থেকে নেমে এসো। তুমি যাবে আমার সঙ্গে ঘুরতে। গাড়ির সামনের সিটটায় তুমি বসবে আমার পাশে। এলির কথা মাথায় রেখো না। ও পেছনে বসে থাকবে। ও কোনও সমস্যা নয়। তুমি যাবে আমার সঙ্গে। আমি তোমার প্রেমিক।’

‘কী ? তুমি কি পাগল হয়ে গেলে ?’

‘না। তোমার প্রেমিক আমি। তুমি যদি এখনও সেটা না জানো, তো জানবে একটু পরেই। আমিও জানবো। যদিও তোমার অনেক কিছুই আমি জানি। শোনো কনি, আমার চেয়ে ভালো প্রেমিক তুমি আর পাবে না। এত আদর করে কেউ তোমাকে কথা বলবে না। আমি যা বলি তা করি―প্রতিজ্ঞা রাখি। দ্যাখো, আমি তোমার সঙ্গে প্রথম দেখায় যেমন সুন্দর ছিলাম, এখন এই মুহূর্তে ঠিক তেমনই আছি। ভরসা রাখো। খুব ভালোবাসব আমি তোমাকে। এত প্রেমময় আলিঙ্গনে তোমাকে জড়াব যে তুমি তা থেকে বেরিয়ে আসতে চাইবার ভান করবে, কিন্তু আদতে বেরোতে চাইবে না। তোমার এত গভীরে প্রবেশ করব, তোমার সবটা গোপন আমি আবিষ্কার করব―তুমিও তা খুব উপভোগ করবে, আমি বলছি। আমি জানি, তুমি তখন ভালোবাসতে শুরু করবে আমাকে।’

‘চুপ করো। পাগলের মতো বোকো না। তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।’ বলতে বলতে সে দরজা থেকে দূরে সরে এল। দু হাত দিয়ে নিজের কান চেপে রেখে সে বিড়বিড় করতে থাকল। ‘তুমি এসব কী বলছো পাগলের মতো। এভাবে কেউ বলে না।’ কনির হৃদস্পন্দন এত দ্রুত আর জোরে হতে থাকল যেন ওত হৃদযন্ত্রটা ওর বুকের বাইরে বেরিয়ে আসবে এখুনি। ঘামে ওর শরীর ভিজতে লাগল। ও এলোমেলো পা ফেলে বারান্দার দিকে এগিয়ে গেল। কোনও রকমে চোখটা খুলে দেখতে চাইল আরনল্ড ফ্রেন্ড তখন কী করছিল। কনি দেখল, তখন নিজেকে সামলে নিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল লোকটা। বুট দিয়ে মাটিটাকে চাপ দিয়ে নিজের শরীরের ভারসাম্য ঠিক রাখছিল।

‘কনি, তুমি কি এখনও শুনতে পাচ্ছ আমাকে ?’

‘তুমি এখুনি বেরিয়ে যাও এখান থেকে।’

‘এভাবে রেগে যেও না। প্লিজ, কনি, আমার কথা শোনো।’

‘এবার কিন্তু আমি পুলিশ ডাকব।’

আরনল্ড ফ্রেন্ড আবার উত্তেজনায় কাঁপতে শুরু করল। ওর মুখ দিয়ে থুতুর সঙ্গে বেরিয়ে এল একটা অভিশাপ―যদিও কনির উদ্দেশ্যে সে তা বলেনি। তবু ‘হা ঈশ্বর’ শব্দটা সে একটু জোরেই বলল। এবং হাসতে শুরু করল। লোকটাকে কনির তখন একেবারেই অচেনা মনে হচ্ছিল। ওর হাসিটাও যেন মুখ থেকে নয়, লোকটার মুখোশ থেকে বেরিয়ে আসছিল, মনে হলো। তার সম্পূর্ণটাই কি মুখোশে মোড়া ? না তাও নয়। সে মুখটা মুখোশে ঢাকলেও গলার কাছটায় ঢাকতে ভুলে গেছে মনে হচ্ছে।

‘লক্ষ্মীটি, শোনো আমার কথা। আমি একটুও মিথ্যে বলছি না। আমি কথা দিচ্ছি তোমাকে, এরপরে আর কখনওই আসব না এখানে।’

‘সেটাই তোমার জন্য সবচেয়ে ভালো হবে। আমি পুলিশ ডাকব এখুনি, তুমি যদি…’

‘সোনা, শোনো আমার কথা। ঠিক আছে, আমি ভেতরে আসব না। কিন্তু তোমাকে তো বাইরে আসতে হবে। আর কেন হবে, তা তুমি জানো।’

কনি তখনও হাঁপাচ্ছিল। দৌড়ে রান্নাঘরে ঢুকলেও জায়গাটা ওর অচেনা মনে হচ্ছিল। যেখানেই ও দৌড়ে যাচ্ছে, কোনওটাই যথেষ্ট মনে হচ্ছে না, যা ওকে সেই মুহূর্তে আশ্রয় দিতে পারে। ওদের রান্নাঘরের জানালায় কখনই পর্দা ছিল না, সিংকটার ওপরে কতগুলো থালাবাসন, ধোবার জন্য জমানো। মনে হচ্ছে, ওগুলো যেন তিন বছর ধরে জমিয়ে রেখেছে কেউ ওর জন্য―আঙুল দিয়ে একটা দাগ কাটলে আঠা-আঠা এঁটো লেগে যাবে ডগায়।

‘এই তুমি শুনছো ? শুনতে পাচ্ছ, কনি ? পুলিশকে ফোন করছো নাকি তুমি ? শোনো, তুমি যেইমাত্র পুলিশ ডাকবে, আমি কিন্তু আমার প্রতিজ্ঞা ভুলে যাব। ভেতরে চলে আসব আমি। তুমি নিশ্চয়ই তা চাইবে না।’

কনি তড়িঘড়ি করে দরজাটা লক করতে চাইল। হাত কাঁপছিল ওর। ঠিক ওর মুখের বিপরীত দিকে দাঁড়িয়ে শান্ত স্বরে আরনল্ড ফ্রেন্ড বলে উঠল, ‘দরজা কেন লক করছো ? কী লাভ ? এ তো শুধু একটা পর্দা দেওয়া কাচের দরজা। কেউ যদি চায় এক নিমেষেই এটা ভেঙে ফেলতে পারবে। একটা পর্দা, কাচ, কাঠ কিংবা লোহার পাত―ভেঙে ফেলতে চাইলে এগুলো ভাঙা কোনও বড় সমস্যা নয়। বিশেষ করে আরনল্ড ফ্রেন্ড যদি চায়।’ সে যখন কথাগুলো বলছিল, ওর পায়ের বুটটা এমনভাবে রেখেছিল, যেন ওর মধ্যে ওর পা-টাই নেই। গোড়ালির ওপর ভর করে জুতার মুখটা একটু বামদিকে হেলিয়ে দরজামুখী হয়ে ছিল বুটটা। সে বলতেই থাকল, ‘ধরো, এখন যদি এই বাড়িটায় আগুন লেগে যায়, তুমি তো দৌড়ে এসে আমার বাহুতেই আশ্রয় নেবে। এর চেয়ে নিশ্চিন্ত আশ্রয় তুমি আর পাবে না কোথাও। ভেবে দ্যাখো, কী করবে ? বোকামি কোরো না, কনি। তোমার মতোই একটু লাজুকমতো মেয়ে আমি বরং পছন্দ করি, বোকাবোকা মেয়ের চাইতে।’

তার কথাগুলো কনির কানে শোনাচ্ছিল ছন্দোবদ্ধ কবিতার মতো, গানের লিরিকের মতো। সে কথা বলছিলই সেভাবে। কনির খুব চেনা একটা গানের কলি যেন প্রতিধ্বনিত হলো আরনল্ডের কথায়―গত বছর শোনা গান―একটা মেয়ে তার প্রেমিকের আলিঙ্গনে ফেরবার জন্য আকুতি নিয়ে দৌড়ে আসছে, ঘরে ফিরছে…।

খালি পায়ে ঘরের মেঝেতে দাঁড়িয়ে সে অস্ফুট স্বরে তাকে বলল, ‘তুমি আসলে কী চাও ?’

‘তোমাকে চাই আমি।’

‘কী বললে ?’

‘প্রথম দিন দেখেই আমি ভেবেছি, একেই আমি চাই, আর কোনওদিকে তাকাবার দরকার নেই।’

‘কিন্তু বাবা ফিরবে এখুনি। ফিরেই আমাকে খুঁজবে। আর আমার চুলগুলো ধুতে হবে আগে।’ সামান্য গলা উঁচিয়ে বলল কনি, যাতে আরনল্ডের কানে পৌঁছায়।

‘না। তোমার বাবার ফিরতে দেরি হবে। তবে হ্যাঁ, চুলগুলো তোমাকে ধুতে হবে। আর তা ধোবে তুমি আমার জন্য। এগুলো ধুলে আরও উজ্জ্বল, সুন্দর দেখাবে। আর সেটাও তুমি করবে আমার জন্য।’ নতজানু হবার ভঙ্গিমায় বলতে গিয়ে সে আবার ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছিল শরীরের। তার বুটটার ভেতরে এমন কোনও জিনিস পুরে দেওয়া যার জন্য ওর পায়ের পুরোটা ঠিকঠাক বসছিল না। তবে বোধহয় এটা করা হয়েছিল, ওকে আরেকটু লম্বা দেখাবার জন্য।

কনি তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ গেল ওর পেছনে গাড়িতে বসা এলির দিকে। সে এতক্ষণ পর্যন্ত ওদের দিকে খেয়াল না করলেও এই মুহূর্তে যেন মনে হলো, কিছু একটা বলতে চাইছে গাড়ির ভেতর থেকে।

‘তুমি কি চাও ফোনের লাইনটা ছিঁড়ে ফেলি ?’

‘একদম মুখটা বন্ধ রাখো। এটা তোমার ভাববার বিষয় নয়।’ খুব রাগত স্বরে এলিকে বলল। আর এমনিতেই আরনল্ড ফ্রেন্ডের মুখটা লাল হয়ে উঠছিল একটা বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়ে। তার মনে হচ্ছিল, কনি বোধহয় বুটের দিকে তাকিয়ে আছে―যেটা তাকে অস্বস্তিতে ফেলেছে।

‘তুমি কী করতে চাইছো ? কী করবে ? আমি এখন যদি পুলিশকে ফোন দিই, তারা এসে এখুনি তোমাকে ধরে নিয়ে যাবে। তুমি জানো না তা ?’

‘শোনো, কনি সোনা, ভেতরে না ঢুকবার প্রতিজ্ঞাটা আমি রাখব, যতক্ষণ না তুমি ফোনে হাত দেবে। আমি প্রতিজ্ঞা রাখি।’ একটু শক্ত-সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে, কাঁধ নেড়ে সে কথাটা বলল। তার বলার ভঙ্গিমায় ছিল নায়কোচিত একটা ভাব। খুব জোরে কথা বলছিল, যেন শুধু কনি নয়, ওর পেছনের কেউ একজনকেও সে শোনাচ্ছে।

‘এই বাড়িতে ঢুকবার কোনও পরিকল্পনা করে এখানে আসিনি আমি। দরকারও নেই আমার। আমি এসেছি শুধু তোমার জন্য। আমি চাই, তুমি বেরিয়ে এসো আমার কাছে। তুমি তো জানো, কে আমি!’

‘তুমি একটা পাগল।’ সে বিড়বিড়িয়ে বলল। দরজা থেকে পেছনে সরে এল বটে, তবে অন্য ঘরের দিকেও সে যাচ্ছিল না। কনির মনে হলো, অন্য ঘরে সরে যাওয়া মানে তাকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়াটা সহজ করে দেওয়া হবে হয়তো।

‘কী সব বলছো তুমি, সোনা ?’

ওর চোখ রান্নাঘরের সবদিকে বুলিয়ে দেখছে। কিন্তু কোনও কিছুই চেনা লাগছিল না ওই মুহূর্তে।

‘সবচেয়ে ভালো হয় কী, তুমি জানো ? বেরিয়ে এসো। আমরা গাড়িতে করে ঘুরতে বেরোই। আর তুমি যদি না বের হও, আমরা এখানেই দাঁড়িয়ে থাকব, তোমার মা-বাবা না ফেরা পর্যন্ত। আসুক, তারা ফিরে আমাদেরকে এভাবে দেখুক।’ 

কী বুঝল এলি, কে জানে! কানের কাছ থেকে রেডিয়োটা সরিয়ে, মুখ ভেঙচে সে তখন বলে উঠল, ‘কী বলো, ফোনটা টেনে বের করে আনব না কি ?’

‘এই! তোমাকে চুপ থাকতে বলেছি, কানে যায়নি কথা তোমার ? তুমি কি কালা ? যাও কানে হেয়ারিং এইড পরে আসো, যাও। কনি তো সমস্যাই করছে না, করবেও না আমার সঙ্গে। ও লক্ষ্মী মেয়ে।’ জোরে জোরে উদ্দেশ্যহীনভাবে বাতাসে গলা ছেড়ে বলল আরনল্ড। ‘ও আমার প্রেমিকা। তোমার নয়। তোমাকে এটা নিয়ে ভাবতে হবে না। এলি, তুমি আমাকে খোঁচাতে এসো না। শুয়োরের মতো কোরো না যেন। মুখ বন্ধ রাখো একদম।’ এবার ঘরের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘তুমি কিছু মনে কোরো না সোনা। ও একটা ফাজিল। ওর কথায় কান দিয়ো না। তুমি শুধু আমাতে মন দাও। বেরিয়ে এসে আমার হাতে হাত রাখো। কেউ তোমাকে কোনও কষ্ট দিতে পারবে না দেখো। শুনছো ? এসো। খামোখা আমাদের মধ্যে তোমার টাক মাথা বাবা, ঘ্যানঘ্যানানি মা, হাইহিল পরা বোনটা কাউকে টেনো না।’

‘একা ছেড়ে দাও আমাকে।’ কনি আলতো স্বরে বলল।

‘এই শোনো, তুমি কি রাস্তার শেষ মাথার ওই মহিলাটিকে চেনো ? মুরগি-টুরগি নিয়ে থাকে ?’

‘ও তো মারা গেছে।’

‘সে কি ? মারা গেছে ? চেনো ওকে ?’

‘বললাম তো, সে মারা গেছে।’

‘তুমি কি তাকে পছন্দ করতে না ?’

‘সে আর নেই। মারা গেছে।’

‘কিন্তু ওর সঙ্গে কি তোমার কোনও রাগ ছিল ?’ রোদচশমাটায় হাত বুলাতে বুলাতে শীতল স্বরে সে বলল।

‘আচ্ছা বাদ দাও। এবার তুমি ভালো মেয়েটি হয়ে যাও তো দেখি।’

‘কেন ? তুমি কী করতে চাইছো ?’

‘সেরকম কিছু নয়। মাত্র দুটো বা তিনটে জিনিস করব। তুমি শুধু বেরিয়ে এসো। আমি কথা দিচ্ছি, তোমার ভালো লাগবে। আমাকেও তোমার ভালো লাগবে যেমন অন্য কাছের মানুষদের লাগে। বেশিক্ষণ সময় নেব না। বেরিয়ে এসো, সোনা। তুমি নিশ্চয়ই চাও না, তোমার পরিবারের কেউ ঝামেলায় জড়িয়ে যাক।’

দৌড়ে পেছনের রুমটায় চলে গেল কনি। যেতেই একটা টেবিল বা কিসের সঙ্গে যেন জোরে ধাক্কা লাগল। ফোনটা উঠাতেই কিসের একটা গর্জনের আওয়াজ শুনতে পেল কানের কাছে। আস্তে, আবার জোরে। কেমন অসুস্থ লাগতে লাগল ওর। ফোনটা উঠাল ঠিকই কিন্তু এত ভারী লাগল, ডায়াল ঘুরিয়ে ফোন করবার মতো শক্তিও যেন ওর মধ্যে বাকি নেই আর। সে চিৎকার দিতে লাগল। কান্না শুরু করল। মাকে ডাকতে লাগল ও। বুকের মধ্যে এমন চাপ লাগতে লাগল, হঠাৎ মনে হলো আরনল্ড ফ্রেন্ড ওকে ছুরি দিয়ে আঘাত করতে চাইছে। বারবার, নির্মমভাবে। একটা চাপা কান্নার আওয়াজ ওর পুরোটা জুড়ে, ভেতরটা জুড়ে। ও যেন নিজের ভেতর বন্দি হয়ে রইল, যেমনটা আটকে আছে এই ঘরটার মধ্যে।

কিছুক্ষণ পরে ঘোর কাটল ওর। ও অন্য বাইরের আওয়াজ শুনতে পেল। দেয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে বসা ও তখন―ঘাম বেয়ে পড়ছিল ওর পুরো পিঠটা জুড়ে।

দরজার ওপাশ থেকে শোনা গেল আরনল্ড ফ্রেন্ডের গলা, ‘এই তো লক্ষ্মী মেয়ে। ফোনটা ঠিক করে রেখে দাও তো দেখি।’

কনি লাথি দিয়ে ফোনটা দূরে সরিয়ে দিল।

‘ঊঁহু, না না। এভাবে নয়। ফোনটা তুলে ঠিক জায়গায় রাখো।’

সে আবার ফোনটা তুলে ক্রাডলে ঠিকঠাক রেখে দিল। এবার বন্ধ হলো ডায়াল টোনটা।

‘খুব ভালো মেয়ে তুমি। আসো। এবার বেরিয়ে এসো তো।’

এতক্ষণ ধরে যা ওর ভয় হয়ে কাজ করছিল সব যেন একটা বিশাল শূন্য গহ্বরের মধ্যে তলিয়ে যেতে থাকল। কেমন সব শূন্য লাগতে লাগল। কান্না হয়ে, চিৎকার হয়ে ঠেলে বেরিয়ে আসল। সে বসে রইল নির্বাক। একটা পা ভাঁজ করে, তার ওপর ভর দিয়ে মেঝেতেই বসে রইল। ওর মাথার মধ্যে একটা ছোট্ট আলোর বিন্দু ওকে তাড়া করছে―কিছুতেই স্থির হতে দিচ্ছিল না। কেবলই ওর মনে হতে থাকল, ওর মাকে ও কখনও আর দেখবে না। ওর বিছানাটায় ও আর কখনও ঘুমাতে পারবে না। অজানা আশংকায় ওর উজ্জ্বল সবুজ ব্লাউজটা ভিজে যেতে থাকল ঘামে।

ঠিক তখুনি আবার শোনা গেল আরনল্ড ফ্রেন্ডের গলা। নাটকীয় স্বরে সে বলল, ‘যেখান থেকে তুমি এসেছিলে, সে জায়গাটা আর ফিরে পাবে না তুমি। সামনে যেখানে যাবে বলে ভাবছো, সেই ভাবনাটাও বাতিল করতে হবে তোমাকে। আর তুমি যেখানে রয়েছো এই মুহূর্তে―তোমার মা-বাবার বাড়িটায়, এটাও নিতান্তই একটা বোর্ডের বাক্সের মতো। আমি চাইলেই মুহূর্তে ভেঙেচুরে ফেলতে পারি। তুমি এটা জানো এবং আগেও জানতে। কি ? শুনতে পাচ্ছ আমাকে ?’

কনি ভাবতে থাকল, কী করা যায়! কী করা দরকার এখন ?

‘চলো, দূরে একটা সুন্দর মাঠে আমরা যাই, যেখানে প্রচুর রোদের আলো, সুন্দর গন্ধ ভেসে আসে। তোমাকে আমি দু হাত দিয়ে আলিঙ্গনে বেঁধে রাখব। সেখান থেকে বেরিয়ে যাবার কোনও প্রয়োজনই হবে না তোমার। তুমি অনুভব করবে, ভালোবাসা দেখতে কেমন সুন্দর। এই ইট-কাঠের বাড়িটা একটা যাচ্ছেতাই। ছাড়ো একে।’ বলতে বলতে আরনল্ড ফ্রেন্ড দরজার কাচে আঙুল দিয়ে দাগ টানল। সেই আওয়াজে কনি এখন আর ভয়ে কেঁপে উঠল না, একটু আগে যেমন উঠেছিল।

‘হাতটা তোমার বুকের ওপর রাখো। কী বুঝছো ? সত্যটা অনুভব করো। আমার প্রতি তুমি সদয় হও, সোনা। লক্ষ্মী মেয়ের মতো আমার সঙ্গে চলো। তোমার মতো সুন্দর, উজ্জ্বল একটা মেয়ের জন্য তো এটাই সবচেয়ে ভালো। চলো। বাড়ির লোকজন ফিরে আসবার আগেই চলো।’

ওর বুকের ভেতর জোরে জোরে ধাক্কা দিচ্ছে কী যেন। হৃৎপিণ্ডটার ওপরে হাতটা জড়ো করে রাখল ও। এই প্রথমবার ও অনুভব করল জীবনে, এই শরীরের কিছুই যেন ওর নয়। কিছুর ওপরেই ওর কোনও অধিকার নেই। হৃদস্পন্দন আরও দ্রুত থেকে দ্রুততর হলো। এমন কি এই স্পন্দনটাও যেন ওর নিজের নয়।

‘তুমি নিশ্চয়ই নিজেকে কষ্ট দিতে চাও না। প্লিজ সোনা, ওঠো। উঠে দাঁড়াও।’

ও উঠে দাঁড়াল।

‘এবার ঘুরে দাঁড়াও। দরজার কাছে আসো। এই তো। এবার আমার কাছে আসো।’

ওর কথাগুলো রাগের নয়, কেমন পাগলাটে শোনাচ্ছে। ‘আসো। রান্নাঘরের দরজা দিয়ে বেরিয়ে আমার কাছে চলে এসো। তোমার হাসিটা আমাকে দেখতে দাও। তুমি তো মিষ্টি একটা সাহসী মেয়ে। এত ভাবছো কেন ? ওরা এখন উঠোনটায় বসে হ্যামবার্গার আর ভুট্টাভাজি খাচ্ছে। তারা তোমাকে কোনও দিন জানেইনি, তুমি কত ভালো ওদের সকলের চেয়ে। আর জানো তো, তোমার জন্য এতটা আর কেউ কোনও দিন করবে না।’

কনি নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইল। ঘরের মেঝের পিচ্ছিলতা ও অনুভব করল পায়ের তলায়―কী শীতলতা সেখানে। কপালের ওপর থেকে চুলটা সরিয়ে চিরুনি বোলাল চুলে। আর এদিকে আরনল্ড ফ্রেন্ড বারান্দার খাম্বাটাকে আড়াল করে যতটা সম্ভব নিজেকে সহজ করে দাঁড়াল। দু হাত এমনভাবে বাড়াল, কব্জিটা নরম করে, যেন কনির কাছে মনে হয় ওর আলিঙ্গনটা সামান্য অপ্রতিভ―কনিও যেন নিজ সচেতনতা নিয়ে অতটা ভাবিত না হয়। 

সে দরজাটার সামনে এসে দাঁড়াল। কাচে নিজেকে দেখতে পেল। এরপর ধীরে ধীরে হাত দিয়ে ঠেলে সামনে এগোলো। বাইরের রোদের আলোর আভা এসে তার শরীর, চুলে ছড়িয়ে পড়ছিল। ওখানেই অপেক্ষা করছিল আরনল্ড ফ্রেন্ড। 

‘আমার নীল-নয়না মিষ্টি মেয়েটি!’ গানের কলির সঙ্গে মিলিয়ে, ছোট ছোট শ্বাসের সঙ্গে মিশিয়ে, বেরিয়ে এল তার মুখ থেকে কথাটি―যদিও ওর খয়েরি রঙা চোখের সঙ্গে তা যায় না। কিন্তু ও সেভাবেই নিল কথাটা। সামনে তাকিয়ে রাস্তাঘাট, আশপাশে কিছুই আর দেখতে পেল না―সে শুধু দেখল মানুষটার পেছনে, চারপাশে শুধু বিস্তীর্ণ মাঠ, প্রান্তর―রোদের আলোয় যা উদ্ভাসিত। এরকমটা ও আগে দেখেনি কখনও। ওর কাছে এই রোদেলা প্রান্তর চেনা না হলেও, ও বুঝে নিল, এর মধ্যে দিয়ে ওকে এখন যেতে হবে।

 সচিত্রকরণ : ধ্রুব এষ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button