আর্কাইভপ্রচ্ছদ রচনা

শাহনাজ মুন্নীর আলোছায়ার মায়াময় গল্পভুবন : নিঝুম শাহ্

প্রচ্ছদ রচনা : শব্দঘর নির্বাচিত সেরা বই ২০২৩―কথাসাহিত্য

বনফুলকে লেখা চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন : ‘জগতের আনাচে-কানাচে আড়ালে-আবডালে ধূলিধূসর হয়ে আছে যা, তা তুচ্ছতার মূল্যেই মূল্যবান করে দেখাবার কাজে কোমর বেঁধে বেরিয়েছে তোমাদের মতো বিজ্ঞানীর মেজাজের সাহিত্যিক’। জীবনের অন্তরালবর্তী রহস্যরূপের প্রচ্ছন্ন দিকগুলি প্রকট করে তোলার প্রবণতাকেই রবীন্দ্রনাথ চিহ্নিত করেছিলেন ‘বিজ্ঞানী মেজাজের’ বিশিষ্টতা বলে। সে অর্থে বাংলা ছোটগল্পের যে আচ্ছন্নতা, ভাষার কারুকার্যে জীবনের বর্ণিল ক্ষুদ্র আভাকে তুলে আনবার প্রয়াস, তা প্রণোচ্ছলতার সঙ্গেই পাওয়া যাবে শাহ্নাজ মুন্নীর গল্পে। রচনা-পরিকল্পনার স্বাতন্ত্র্য ছাড়াও গল্প বিষয়ে জীবনের বিচিত্র পরিচয় অন্বেষণ তাঁর গল্প চরিত্রে নতুন তাৎপর্য সঞ্চার করেছে। উপরন্তু একই সঙ্গে গল্পকারের সর্বব্যাপী কৌতূহল গল্পবাণীতে করেছে অনন্য বিস্তার সাধন। আসলে জীবনের বিশাল পরিধি থেকে এক একটি বিশেষ অনুভব, ঘটনা অথবা মুহূর্তকে সীমায়িত পরিসরে অখণ্ড সমগ্রের ব্যঞ্জনাময় করে তোলার যে কৌশল, যা কিছু ছোটগল্পের স্বভাবধর্মও; তাকে শাহ্নাজ মুন্নী আয়ত্ত করেছেন সম্পূর্ণ নিজের মতো করে। কখনও গল্পের প্রয়োজনে নিছক গল্প বা গল্পহীনতার গল্প অথবা গল্পের ওপরেই তার গতিবিধি ছেড়ে দেওয়ার মতো স্বাধীনতা গ্রহণ করেছেন গল্পকার। ছড়ানোভাবে নয়, জীবনের অন্তর্গূঢ় প্রতীতিটুকু মুন্নীর গল্পে উন্মোচিত হয়েছে মননশীল তীক্ষè প্রতীকধর্মিতায়। চলমান জীবনধারার সহজ সরল সহচর শিল্পীমনের অনুসন্ধিৎসা যেন গল্প রূপায়ণে নিত্য নব পরীক্ষায় নিয়োজিত। উদ্ভাবনী কল্পনার অফুরান শক্তিতে যেন জীবনের ব্যাখ্যা বহু বিচিত্ররূপে গল্পশরীরে উপস্থিত হয়েছে। যা দেখেছেন, যা শুনেছেন, সেটাকেই একটা চিত্রধর্মিতায় গল্পে বেঁধে ফেলেছেন। ফটোগ্রাফিক মেমোরিকে কাজে লাগিয়ে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে না বলে সরল সহজ ছবি আঁকাতেই গল্পকারের পারদর্শিতা। ফলে অনেক গল্পই পাওয়া যাবে, যাকে প্রচলিত গল্পের কাঠামোতে ফেলা যাবে না, সে গল্পগুলো ফটোগ্রাফিক প্লেটের মতোই নৈর্ব্যক্তিক কিন্তু যান্ত্রিক নয় একেবারে। বরং এ ধরনের গল্পগুলোতে তড়িৎপ্রভাদীপ্ত জীবন নিটোল রূপ পেয়েছে এবং সেই সঙ্গে ব্যক্তিচিত্তের দোলাচলতার স্পর্শমুক্ত নিরাবেগ অটলতাও এসব গল্পের সর্বাঙ্গে ভরাট। বাস্তবতা সেখানে রাখঢাক রেখে রূপক-প্রতীকের আশ্রয়ে বৃদ্ধি না পেয়ে সরাসরি গল্প হয়েই এসেছে―যে গল্পের শুরু-শেষ লেখকের হাতে নেই বা লেখক আসলে এর শেষ নিয়ে ভাবেনওনি। গল্পটা যেভাবে আছে তাকে তার পথেই ছেড়ে দেওয়া।

শাহ্নাজ মুন্নী কবিও বটে, মূলত কবিতা দিয়েই শুরু করেছিলেন তাঁর সাহিত্য অন্বেষণ। কবিতার সহজ উপলব্ধি দিয়ে যে জীবনের শুরু নাগরিক পরিবেশে নতুন উপলব্ধিরা এসে তাকে প্রতিস্থাপন করেছিল। চমক জাগিয়েছিল তাঁর শিল্পীসত্তায়। মানুষের বিচিত্র জীবন আর রূপ-রসে তাঁর প্রত্যয়লালিত প্রগাঢ় মূল্যবোধের কাব্যিক পরিমণ্ডলটি বাস্তবসর্বস্ব আত্মকেন্দ্রিকতার মুখোমুখি হয়ে হঠাৎই যেন কাব্যিক গদ্যরূপে জমাট বেঁধেছে।

শাহ্নাজ মুন্নীর গল্পে গ্রামীণ পটভূমির যা বিস্তার সেখানে স্মৃতি রোমন্থন ও স্মৃতিকে কাজে লাগিয়ে গল্প ফাঁদার ভ্রমণটা বেশ পোক্ত। শাহ্নাজ মুন্নীর আসল অস্ত্র প্রতীকায়ন। গল্পে প্রতীকের এত বহুল ব্যবহার বাংলাদেশের গল্পধারায় কম। অধিকাংশ ক্ষেত্রে রূপক ও প্রতীককে তিনি একীভূত করেছেন। প্রমথ চৌধুরী, রাজশেখর বসু, আবুল মনসুর আহমদ ব্যাপকভাবে আয়রনি, উইটের ব্যঞ্জনায় সমাজ-রাজনীতি-ধর্ম নিয়ে ভণ্ডামির মুখোশ উন্মোচন করেছেন। শাহ্নাজ মুন্নীও সমাজের এসব অসঙ্গতিকে পাশ কাটাতে পারেননি বলে মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন প্রতীক বা রূপককে। ব্যাপকতম অর্থে একটি জিনিস দিয়ে ভিন্ন আরেকটি জিনিস  বোঝানো হলে তাকে প্রতীক বলে। ব্যবহৃত শব্দ যখন তার সহজ সাধারণ আক্ষরিক অর্থকে অতিক্রম করে ভিন্নতর অর্থের ইঙ্গিত দেয় তখনই সাহিত্যের পরিভাষায় বলা হয় শব্দটি প্রতীকী। সাধারণত কবিতায় প্রতীকায়নের ব্যাপারটি উল্লেখযোগ্য হলেও গদ্যেও এর ব্যবহার একেবারে সীমিত নয়। বনফুলের ‘নিমগাছ’ বা বিভূতিভূষণের ‘মেঘ-মল্লার’ বা শওকত ওসমানের ‘ক্রীতদাসের হাসি’র মতো আরও অজস্র উজ্জ্বল গল্প বা উপন্যাসের নামের তালিকা তৈরি করতে হবে। কিন্তু এ লেখকদের কারও প্রধান অস্ত্র প্রতীক নয়। লেখক অনেক সময় গতানুগতিক সুপরিচিত প্রতীক ব্যবহার করেন, আবার নিজেদের বিশিষ্ট অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে অনেকেই ব্যক্তিগত প্রতীক গড়ে তোলেন। কোনও কোনও বস্তু বা কর্মের চরিত্রের সঙ্গে দীর্ঘদিনের এবং বহুল পরিচিত অনুষঙ্গের ওপর নির্ভর করে কিছু কিছু প্রতীক সহজবোধ্যভাবে গড়ে উঠেছে। এই প্রসঙ্গে ময়ূরের সঙ্গে অহঙ্কারের, সিংহের সঙ্গে বীরত্বের, অগ্নির সঙ্গে ক্রোধের, ভোরের সূর্যের সঙ্গে জীবনের প্রারম্ভ অথবা একই সূর্যের অস্তাচলের সঙ্গে জীবনের সমাপ্তির অনুষঙ্গ অনেক প্রতীকের জন্ম দিয়েছে। কিন্তু লেখকের অসামান্য কল্পনা ও ক্ষমতার ওপর নিজস্ব প্রতীকায়নও প্রতিষ্ঠা পায়। যেমন―জীবনানন্দ দাশের কবিতায় হেমন্ত শুধু ঋতু নয় বরং জীবনের ক্রমাগত ক্ষরণে শুষে নেওয়া বিস্ময় থেকে উৎপন্ন বিষণ্নতা।

প্রতীকের কারবার মায়ানির্ভর। মায়াময় জগৎ সৃষ্টি করতে না পারলে শুধু কতগুলো চিহ্ন ব্যবহার করলেই তা প্রতীক হয়ে ওঠে না। প্রতীক একেবারে ভিন্ন একটা গল্প বলবার পরেও নতুন আরও একটা গল্পের ইঙ্গিত দেয়। সচেতন পাঠক মাত্রই তা বুঝবেন কিন্তু কোথাও তা সরাসরি বলা থাকবে না। হয়তো ইঙ্গিতে তা উঁকি দেবে মাত্র।  যেমন―‘রূপময়ীর ছয়টি হাত’ গল্পটিতে শাহ্নাজ মুন্নী স্পষ্টতই বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে ইঙ্গিত করেছেন। হেমনগর যথার্থই বাংলাদেশের প্রতীকায়ন। রূপময়ীর শরীরের অতিরিক্ত পুরুষালি হাত দুটি কার ? পিতারূপী, স্বামীরূপী পুরুষতন্ত্রের নয় কী ? রূপময়ী যখন নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে চাইল এই পুরুষ সমাজই তাকে চাইল না। বাংলাদেশের রাজনীতির সঙ্গে প্রতীকের আড়ালে এই যে সমাজকে একই সূত্রে গ্রন্থিত করে দেওয়ার অসামান্য দক্ষতা তা গল্পকারকে নতুন প্রতিষ্ঠার দিকে নিয়ে যায়।

গল্পকারের এই প্রতীক কখনও কখনও আবার পাঠককে ধাঁধিয়ে দেয়। তার ভাবনারাজ্যকে নিয়ে যায় দূর থেকে বহুদূরে, যেখান থেকে পাঠক তার বোধিশক্তি দিয়ে বিষয়ের ভিতরে প্রবেশ করে রহস্য উদ্ঘাটন করেন। প্রতীকের ব্যবহার সম্পর্কে বলতে গিয়ে বদিউর রহমান বলছেন―‘প্রতীকবাদী শিল্পীর সৃষ্টিতে থাকবে একটা ধোঁয়াটে ভাব, আর সেই ধোঁয়াটে ভাব প্রকাশের ভাষাও হবে কিছুটা অস্পষ্ট।’ প্রতীকের কোনও সাধারণ ব্যাখ্যা সম্ভব নয়, তাকে অবচেতন মনের দ্বারা উপলব্ধি করে নিতে হয়, বিশ্বাস করে নিতে হয়। শাহ্নাজ মুন্নীর ক্ষেত্রে অন্তরের গভীর তলদেশে সংগুপ্ত বিষয়ের প্রকাশ ঘটানোর জন্য প্রতীকের সঙ্গে তিনি একীভূত করে নিয়েছেন লোককথার সব কয়টি উপাদানকে। ব্রতকথা, উপকথা ও মাঝে মাঝে রূপকথার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য নিয়েও প্রতীক হয়ে বর্তমানকে খোদাই করে নিয়েছেন গল্পে। লোককথার গড়নে কখনও পশুরাও এখানে মানুষের মতোই কথা বলে উঠে এমনকি মানুষের সঙ্গে উঠবসও করে, স্বাভাবিক জীবনযাপনও করে। ‘কাঁঠাল’ গল্পটির কথাই ধরা যাক। গল্পটি শুরু হচ্ছে এভাবে :

পোয়াতি নারীর জিভ যেন চঞ্চলা বানের পানি; সময় অসময়ে কত কিছু যে খাইতে মন চায়! পোড়ামাটি, কয়লা, তেঁতুল, গম ভাজা আরও কত হাবিজাবি, সোয়ামি যার উজান দেশে কামলা খাটতে গেছে, সে একলা ঘরে মাটিতে বিছানো হোগলা চাটাইয়ে গড়াগড়ি যায় আর লকলকে জিভের জল টেনে ভাবে―

‘আহারে কেউ যদি এখন আমারে একটা কাঁঠাল খাওয়াইত, তাইলে…’

 সে তার ঈষৎ ফুলে উঠা পেটে হাত রেখে অনাগত শিশুর অস্তিত্ব খুঁজতে থাকে―

‘তাইলে আমার পেটের বাচ্চার সাথে তার বিয়া দিতাম, আর বাচ্চাটা যদি পোলা হয় তাইলে তার সাথে দোস্তি পাতায়া দিতাম।’

পোয়াতি নারীর এই কাঁঠাল খাবার সাধ পূরণ করে এক শিয়াল। ফুটফুটে মেয়ে ময়নার পছন্দের পুরুষ পরানের ছেলে হারান হলেও মাতৃঋণ ও প্রতিজ্ঞা শোধ করবার জন্য বারো বছর পর সেই শিয়ালের সঙ্গেই বনে সংসার পাতে ময়না। সেখানে শিয়ালের ঔরসে মানবসন্তান জন্ম না হয়ে জন্ম নেয় দুই শেয়ালশিশু: ‘সেই পশু অস্তিত্ব, কাঁঠালের সুমিষ্ট আস্বাদ, সেই প্রলয় প্রহর এবং পতনের প্রাকৃতিক চক্রান্ত তার হৃদয়কে দীর্ণ করে।’ পরান বনে ময়নাকে খুঁজে পেলে ময়নার মধ্যে পুরোনো আকুতি ফিরে আসে। একদিন ময়না সত্যিই বন ছেড়ে লোকালয়ে চলে আসে তার শিয়াল স্বামী, সন্তানকে পেছনে ফেলে। কিন্তু যে মানুষ-জীবনের আকাক্সক্ষা নিয়ে ময়না লোকালয়ে ফিরে আসে সে মানুষ-ময়নার বদলে তার মধ্যে ক্রমশ জেগে ওঠে শিয়ালিনীর পশু অবয়ব : ‘পরান দেখে ময়নার অনাবৃত হাতে মসৃণ বাদামি লোম। আঙ্গুলে ময়লা লম্বা ধারালো নখ, মুখে সাদা তীক্ষè সূচালো মাংসাশি দাঁত, জিভ বেরিয়ে নেমে এসেছে বুক পর্যন্ত। ময়না বসে আছে ঠিক পশুদের মতো, চার হাত-পায়ে ভর দিয়ে।’ মানুষ ও পশুর এই স্বাভাবিক পাশাপাশি জীবন স্পষ্টতই তার মনুষ্যবোধ ও পশুত্ববোধের প্রতীক―পাশাপাশি স্বাভাবিক নিয়মেই তারা একসঙ্গে বসবাস করে। মানুষের মনের কাঁঠালরূপী বাসনা, মোহ, আকাক্সক্ষা তাকে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য করে দেয় সে পশুত্বের দ্বারস্থ হয়। গল্পের মাঝে লেখক মনে করিয়ে দিচ্ছেন ‘সেই পশু অস্তিত্ব, কাঁঠালের সুমিষ্ট আস্বাদ, সেই প্রলয় প্রহর এবং পতনের প্রাকৃতিক চক্রান্ত তার হৃদপিণ্ড দীর্ণ করে।’ এই বাসনাকে আলিঙ্গন করে মানুষ যে সিদ্ধান্ত নেয় তা থেকে তার ভবিষ্যৎ প্রজন্মও নিস্তার পায় না। বাসনারূপী কাঁঠালের ফলাফল বারো বছর পরেও তার পিছু ছাড়ে না।

গ্রামীণ পটভূমিতে পারিবারিক খুঁটিনাটির নিখুঁত গল্প ‘জ্বিনের কন্যা’। বৌ-শাশুড়ি-ননদের মনস্তাত্ত্বিক সম্পর্ক গল্পটিতে ফটোজেনিকভাবে তুলে এনেছেন গল্পকার। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মনের সঙ্গে দাম্পত্য জীবনের শরীরী আকাক্সক্ষা। স্বামীর কাছ থেকে অতৃপ্ত একজন সাদামাটা গ্রামীণ বধূ সোহরাবের বউ নুরজাহান কীভাবে জ্বিনের কন্যার মতো অতিলৌকিক পর্যায়ে উত্তীর্ণ হলেন তারই গল্প ‘জ্বিনের কন্যা’। সোহরাবের পানীয়র প্রতি আসক্তি, পতিতাগমন এবং জাগতিক কামনা, বাসনা, মোহের হাতে বন্দি হবার প্রতীককল্পিত কলসভর্তি রত্নরাজিই তার মৃত্যু ডেকে আনে।

সমকালের জীবনযাত্রার নানা বিকৃতি নানা বিভ্রান্তি লেখকের অন্তর্নিহিত শুদ্ধতার বোধটিকে প্রতিনিয়ত বিচলিত করেছে। ভঙ্গুর সমাজজীবনের বিরুদ্ধে গভীর ক্ষোভ সঞ্চারিত হয়েছিল লেখকের মনে, কিন্তু দলা পেকে ওঠা অভিযোগ অনেক সময়ই সরাসরি ঝাঁঝালো ভঙ্গিতে ব্যক্ত করতে পারেননি―গল্পের আধারে প্রতীকাশ্রয়িতাই তখন হয়ে উঠেছে তার মোক্ষম হাতিয়ার। ধর্মকেন্দ্রিক প্লটের গল্পগুলোও অবশ্যম্ভাবীভাবেই তাই প্রতীকায়িত গল্পের অনন্যসাধারণ উদাহরণ হয়ে উঠেছে। ‘স্বর্গ-ছেঁড়া’ আশ্চর্য সুন্দর ধর্মীয় ভণ্ডামির গল্প। স্বর্গ আকাক্সিক্ষত অনেক মানুষের একই বাসে স্বর্গ পর্যন্ত যাত্রার এক অভাবনীয় সুন্দর রূপকাশ্রয়ী গল্প। গল্পের প্রথম বাক্যেই গল্পকার বলছেন―‘সেটা ছিল রোদে পেঁচানো উত্তপ্ত এক গ্রীষ্মদিন। গ্রীষ্মকালের জ্বলন্ত রাস্তায় একটা হাড় জিরজিরে বুড়ো বাস চলছিল ধুঁকে ধুঁকে।’ ‘জ্বলন্ত রাস্তা’ বা ‘হাড় জিরজিরে বুড়ো’ যদিওবা সুন্দর উপমা তবু স্বাভাবিক কিন্তু প্রথম বাক্যের ‘রোদে পেঁচানো উত্তপ্ত দিন’ উপমা অর্থে একেবারেই নতুন। ‘রোদে ঝলমলে’, ‘প্রখর রৌদ্র’, ‘নরম রোদ’ বা রোদের আরও বিশেষণ পাওয়া গেলেও মুন্নীই সম্ভবত প্রথম ‘পেঁচানো রোদ’ ব্যবহার করলেন। এ অনুচ্ছেদেই স্বর্গপ্রার্থী যাত্রী নারীদের কথা বলছেন তিনি : ‘তারা কথা বলছিল না, কেবল শ্যাওলা পড়া পাথরের ম্লান স্থাপত্যের মতো সামনে তাকিয়েছিল চুপচাপ। বাসের উইন্ডস্ক্রিন দিয়ে হয়তো তারা কালো রাস্তায় গা চিরে বয়ে যাওয়া হলুদ, সাদা দাগগুলো দেখছিল অথবা দেখছিল না কিছুই, কেবল অলস চোখের পাতা খুলে কিছু একটা দেখার ভান করছিল।’ অথবা বাস ড্রাইভারের বর্ণনায় : ‘বাসটির মতো বাসের ড্রাইভারও ছিল বৃদ্ধ। তার তোবড়ানো গাল জুড়ে চিত্রলতার মতো লতিয়ে ছিল নিষ্প্রভ সাদা দাড়ি, ঝানু গোয়েন্দার মতো তীক্ষè দৃষ্টি নিয়ে চারপাশ দেখে অ্যাকসিডেন্ট এড়িয়ে ধীরে সুস্থে সীমিত গতিতে গাড়ি চালাচ্ছিল সে।’ মূলত ধর্ম নিয়ে স্বর্গে যাবার পন্থারূপী এই বাসটির এবং বাস ড্রাইভারের বৃদ্ধ ভাঙাচোরা দশা আসলে পূর্ব থেকেই চলে আসা ধর্ম নিয়ে ভণ্ডামির কথাই মনে করিয়ে দেয়। যুগের পর যুগের পরিবর্তন আসে কিন্তু ঐ ভাঙাচোরা জংধরা পন্থাতেই কিছু মানুষ স্বর্গে যাবার প্রত্যাশা রাখে। যখন তারা বুঝতে পারে তারা পথ হারিয়েছে―‘প্রতারক, ঠগ, বাটপার, জোচ্চোর’ বলে ক্ষেপে যায় এবং সেই বৃদ্ধ কাণ্ডারীকে ত্যাগ করে, তখনও তাদের জন্য আসলে অপেক্ষা করে সেই পথহীনতার অসীম বেদনা। আর তারা নিমজ্জিত হয় ‘এই দেশ তো চিরসন্ধ্যার দেশ, এখানে রাতও নামে না, সকালও হয় না, শুধু সন্ধ্যা ঝুলে থাকে তার ধূসর নৈরাশ্য নিয়ে।’ অথচ বাজাররূপী দেশের মানুষগুলো তখনও সেই বৃদ্ধ ড্রাইভারের ওপর ভর করে পুরোনো পন্থায় এমন একটা ইউটোপিয়া স্বর্গের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে, করতেই থাকে। ‘চিল্লা’ গল্পটাও এমন একটা প্রতীকী গল্প। আমি কথনে একজন শীর্ষ সন্ত্রাসী তার গল্পটা বলে যায়। আইনের হাত থেকে বাঁচবার জন্য আত্মগোপনে থাকার চেষ্টা করতেই এক গ্রামের একজন মুসল্লি আবদুর রবের সঙ্গে পরিস্থিতির প্যাঁচে পড়েই চিল্লায় যায় এই সন্ত্রাসী। সেখানে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের সঙ্গে সৌহার্দ্য চর্চার মধ্য দিয়েই দিনগুলো কাটছিল তার। এভাবে বেশ কয়েক মাস কাটানোর পরে তার মধ্যে কোনও ভাবাবেগের পরিবর্তন না এলেও সে উপলব্ধি করতে পারে এই পোশাকে, বেশে এবং বাহ্যিক ব্যক্তিত্বে তাকে কেউ আর সন্দেহ করছে না। একসময় সে এটাকেই তার আত্মগোপনের একটা পন্থা হিসেবে ব্যবহার করতে থাকল। আসলে মানুষের ভেতরে যে পশুত্বকে, কালোকে সে লালন করে তার চর্চা যদি সে করতে চায়, ভালো সঙ্গ, ভালো পরিবেশেও তা সে করে এবং ধর্ম এমন একটা ফেনোমেনা এই উপমহাদেশের মানুষের কাছে, যে মন্দশক্তি খুব সহজেই তা ব্যবহার করে নিজ স্বার্থ হাসিল করে ফেলতে পারে।

নির্বাচিত গল্প-এ কতগুলো গল্পকে এমন কাতারে ফেলা যায় যেগুলোকে ঠিক গল্পের প্রচলিত ধারায় ফেলা যায় না, অনেকটা গল্পহীনতার গল্পের মতো। কিছু চরণ প্রকাশের জন্যই যেন পুরো গল্পটা তৈরি করা। ধরা যাক―‘সোনালি ডানার চিল’ গল্পটার কথা। আগেই বলেছি, শাহ্নাজ মুন্নী কবি। কবি বলেই অসম্ভব গীতল আর কাব্যিক এক স্বকীয় ভাষা আছে তাঁর। এ গল্পটিতে রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, নজরুলের উদ্ধৃতি যেমন আছে, তেমন গল্পকারের নিজস্ব কিছু বলবার আছে। সোনালি চরিত্রটি বলছেন : ‘নাহ। মন ছাড়াই বেশ আছি। মন থাকলেই ভালোবাসতে ইচ্ছে করে, ভালোবাসা পেতে ইচ্ছে করে। দুঃখ হয়, কষ্ট লাগে।’ যেন পুরো গল্পে এই বাক্য বলবার জন্যই এই গল্পহীন অশরীরী কাব্যিক একটা পরিবেশ তৈরি করা। ‘প্রেম প্রার্থনার ভিতর যৌনতা’ গল্পটির ক্ষেত্রেও মনে হয়েছে ‘খুব কাছের অন্ধকার বড় বেশি যৌন হয়, খুব কাছের মানুষ বড় বেশি মৌন হয়, প্রেম তো বাচালের ভেতর মৌনতা, প্রেম প্রার্থনার ভিতর যৌনতা…’ যেন এই বাক্য কয়েক প্রকাশের জন্যই পুরো পরিস্থিতি, চন্দনা বা তার স্বামীর প্রেক্ষাপট পরিকল্পিতভাবে লেখক ভেবেছেন। শাহ্নাজ মুন্নীর অনেক শব্দই বেশ জোরালো, শক্তিমান―ভিত নাড়িয়ে দেওয়ার মতো, যেগুলো সচেতন পাঠক মাত্রই চোখে পড়বে। এই গল্পটির প্রধান চরিত্র চন্দনা, যার স্বামী জহির কর্মসূত্রে আরেক জায়গায় থাকেন। চন্দনা তার মেয়েসহ যে বাড়িটিতে বাস করেন গল্পকারের বয়ানে তা এমন : ‘শেষ পর্যন্ত চন্দনা রয়ে গেছে এখানেই ঢাকায়, শাশুড়ির নিজের বাড়িতেই, কোনার দিকের একটি আলাদা ছোট্ট কক্ষে, ননদ, ভাসুর, দেবরের যৌথ পরিবারের সীমিত স্বাধীনতা, সীমিত স্বপ্নের মধ্যে অসীম ধৈর্য ধারণ করে।’ বাংলাদেশের পাঠকমাত্রই ‘শাশুড়ির নিজের বাড়িতেই’ শব্দ দেখে খটকা অনুভব করবেন। কারণ, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে শ্বশুরবাড়ি শব্দটির ঢালাও ব্যবহার (যে ক্ষেত্রে শাশুড়ির অর্থায়নে নির্মিত সেক্ষেত্রেও) শিরোধার্য। শাহ্নাজ মুন্নী এভাবে ছোট্ট, সূক্ষè কিছু ব্যবহার করে, শব্দের ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে কাক্সিক্ষত জীবনের ইঙ্গিত দিয়ে এভাবেই লড়ে যান মানবিক পৃথিবীর লক্ষ্যে। যদিওবা ব্যাপারটিকে অন্য প্রতীকেও ভাবার সুযোগ আছে। বাড়িটিতে শাশুড়ির একমাত্র কর্তৃত্ব বা অনুশাসন বোঝাতেও ‘শাশুড়ির নিজের বাড়ি’ শব্দবন্ধ ব্যবহৃত হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু শুধু চন্দনার অসহায়ত্ব বোঝাতে লেখক এই শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছেন বলে আমার মনে হয় না। অন্তত আরও কিছু গল্প বিবেচনায় রাখলে তো নয়ই। নারীদের প্রতি হয়ে আসা অন্যায় স্রোত, বঞ্চনার প্রতিবাদে শাহ্নাজ মুন্নী প্রতিবাদী মিছিলে নামেন না; তিনি গভীরভাবে আলোড়িত হন এবং তাঁর নিজস্ব প্রতিবাদের স্টাইলেই প্রতিবাদ করেন। রাজনৈতিক অস্থিরতা, সমাজের নানা স্তরের বঞ্চিত মানুষের জন্য যেমন তিনি প্রতীক প্রতিবাদের পথের শরণ নিয়েছেন, নারীবিষয়ক গল্পগুলোও তার ব্যতিক্রম নয়। ‘ফেয়ার এন্ড ফাইন লুক’ শুধু প্রতীকী নয় অনেকটা ব্ল্যাক হিউমারের গল্পও বটে। পাড়ার একটা লেডিস বিউটি পার্লারকে কেন্দ্র করে গল্পটা ফেঁদেছেন লেখক :

‘ফেয়ার এন্ড ফাইন লুক’-এ তরুণী, প্রৌঢ়া, বৃদ্ধাসহ সব বয়সের নারীদের ভিড় বাড়তেই থাকে। ত্বক, ঠোঁট আর চুলের যত্নের পাশাপাশি পার্লার কর্তৃপক্ষ মনের যত্নের একটি স্পেশাল প্যাকেজ অফার দেয়। দুঃখিত, বিমর্ষ, অপমানিত, বেদনার্ত, যন্ত্রণাক্লিষ্ট দুমড়ানো, মুচড়ানো মনকে সতেজ আর স্বাভাবিক করে তুলতে সেই প্যাকেজে ছিল অভূতপূর্ব সব ব্যবস্থা। ফলে নারীমহলে এর সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। নারীদের কাছে পৃথিবী যখন বিবর্ণ হয়ে ওঠে, যখন তারা আহত বোধ করে, তখন তারা ফেয়ার এন্ড ফাইন লুকে যায়, ক্ষতস্থানে কিছু উজ্জ্বল ঝলমলে রং মেখে নেয়। পুরুষদের মুগ্ধ চোখে তখন তাদের সেই রংচংই শুধু ধরা পড়ে। নারীদের মনের উপর যখন স্তরে স্তরে ময়লা, দুঃখ, ক্ষোভ, হতাশা আর অসহায় রাগ জমতে থাকে তখন তারা মনের যত্নের স্পেশাল প্যাকেজ সেবা নিতে আসে।’

পুরুষতান্ত্রিক সমাজে প্রতি মুহূর্তে নারীর যে আন্তঃসৌন্দর্য হরণ হয়, আত্মবিশ্বাস বিসর্জিত হয়―তারই বেদনার্ত প্রতীকায়ন এই গল্পটি। চেখফ, জেমস অতৃপ্তি দিয়ে গল্প শেষ করাকে ‘পাঠকের প্রতি অবিচার’ বলে অভিহিত করলেও রবীন্দ্রনাথ কিন্তু ‘শেষ হয়েও হইল না শেষ’ এই পন্থায় বিশ্বাসী ছিলেন। অর্থাৎ, পাঠককে রবীন্দ্রনাথ একটা স্পেস দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন। শাহ্নাজ মুন্নী রবীন্দ্রনাথের মতো পাঠকের ওপর বিশ্বাস রাখতে চেয়েছেন বলেই প্রতীকের এত সাবলীল ব্যবহার করেছেন কিন্তু সম্ভবত গল্পকে চমক লাগানো সমাপ্তিতে শেষ করার পক্ষপাতী তিনি। এডগার অ্যালান পো বা মোঁপাসার ‘চাবুক হাঁকানো’ সমাপ্তিকে তিনি হয়তো সমর্থন করতে বেশি আগ্রহী। বনফুলের গল্পেও সমাপ্তিতে একটা চাবুক হাঁকানোর ব্যাপার আছে। মুন্নীর গল্পের সমাপ্তি প্রায়শই এমন। এই গল্পের শেষে পুরুষেরা অতি ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে যখন পার্লারটিতে আক্রমণ করে, তারা খুঁজে ফিরছিল পরিবারের কোনও সদস্যকে কিন্তু ব্যর্থ হয়েছিল। ‘ফেয়ার এন্ড ফাইন লুক’ গল্পের সমাপ্তিটা তাই শ্লেষাত্মক এবং তীক্ষè :

ভাইরা খোঁজে বোনদের, প্রেমিকরা খোঁজে প্রেমিকাদের, স্বামীরা খোঁজে স্ত্রীদের… খোঁজ, খোঁজ, খোঁজ… কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা সেখানে কোনো পূর্ণাঙ্গ নারী খুঁজে পায় না। বিস্ফোরিত চোখে পুরুষেরা দেখে, সৌন্দর্যকেন্দ্রের মেঝে জুড়ে নারীদের রঙহীন চোখের জল, বেগুনি দীর্ঘশ্বাস, অসহায় হাত, স্থবির পা, দীর্ঘ চুল, নির্মম দাঁত, কোমল ঠোঁট, মেহেদি রাঙানো নখ, বিচ্ছিন্ন হাড়, নেতিয়ে পড়া স্তন, কুঁকড়ে যাওয়া যোনি, ফ্যাকাশে ত্বক, লালচে মাংস সবই আলাদা আলাদা হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। আদিবাসী মেয়েরা মাথা নিচু করে নীরবে সেইসব বিচ্ছিন্ন অঙ্গের সুচারু পরিচর্চা করছে। আহা, এইসব অঙ্গকে যে নিখুঁত হয়ে আবার তাদের চাররঙা সংসারে ফিরে যেতে হবে!’

পুরুষতান্ত্রিক সমাজ প্রতি মুহূর্তে নারীকে ভেঙেচুরে, অবয়বকে ডিসট্রাকশন করে যে রূপ তৈরি করে, তার নগ্নরূপ লেখক দেখিয়েছেন এই শেষ কয়টি বাক্যে। শাহ্নাজ মুন্নী প্রতীকের মাধ্যমে সমাজটাকে একটা মায়াময় জগতে রূপান্তরিত করে স্বাদু এক গল্পজগৎ তৈরি করেছেন। ‘মেয়ে মানুষের গোশত’ গল্পে লোককথাকে ব্রতকথার আঙ্গিকের সঙ্গে ব্লেন্ড করে তিনি সমকালীন জীবনের পাত্রে উপস্থাপন করেছেন অবলীলায়। নারীখাদকের গল্পে বাবুর্চির বুদ্ধিমত্তায় নারীখাদকদের হাত থেকে নারীদের বাঁচানো গেলেও বাস্তবে যে তা সম্ভব হয়নি বরং পুরুষ মস্তিষ্কে এখনও যে নারী মাংসের স্বাদ পশুরূপে জাগ্রত―তারই প্রমাণস্বরূপ লেখক কার্যকারণসূত্রে যুক্ত করেছেন গল্পের শেষ বাক্যে পাওয়া রায়নার হত্যারহস্যের সংবাদ দিয়ে। ফলে ময়নার স্মৃতিতে রায়নার বলা কথাগুলো পাঠকের মনেও ধ্বনিত হয় : ‘মেয়েমানুষের গোশত খাওয়ার লোভ এখনো পুরুষ মানুষের শেষ হয় নাই রে!’ শাহ্নাজ মুন্নীর গল্পজুড়েই আমরা পাবো লতা, বৃক্ষ, নদী, মাছ, পাখির―শেকড়ের এক গভীর টান। নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের পথে ফেরার একটা আকুলতা লেখকের একটা মূল প্রবণতা। সংস্কারে বিশ্বাস স্থাপন করলেও সংস্কার যেখানে কুসংস্কারে পরিণত হয়েছে সেখানে প্রশ্ন তুলতে তিনি দ্বিধাবোধ করেন না। ‘পানসুন্দরী’ গল্পে গ্রামীণ জীবনের সরলতা থাকলেও সমাপ্তিটা কিন্তু বরাবরের মতোই চাবুক হাঁকানো :

রৌশন এবার ম্লান হাসে, ‘পান খাওয়া ছাইড়া দিছি বেপারি, এই বাড়ির কেউ পান খাওয়া পছন্দ করে না।’

‘এতক্ষণে তার সাদা ফ্যাকাশে ঠোঁটের দিকে চোখ পড়ে মোতালিবের, সে দেখে সাদা ঠোঁটে পান খাওয়ার কোনো স্মৃতি নাই।’

পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বিয়ের পর নারীর চিরকালীন অভ্যেস, জীবনাচরণ, পরিবর্তিত, বিবর্তিত, বিসর্জিত অবস্থান এবং গ্রামীণ কুসংস্কার, তন্ত্র-মন্ত্র, ঝাড়-ফুঁক, তুক-তাকে বিশ্বাসকে একসঙ্গে মুন্সিয়ানায় প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন গল্পকার।

এই গল্পগ্রন্থের কিছু গল্প আবার নিছক মনস্তাত্ত্বিক গল্প। পরিবার, তাদের আন্তঃসম্পর্ক, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সহমর্মিতা, সহধর্মিতার গল্প। ‘হেমন্তের অবিরল পাতার মতো’, ‘মনের মতোন সতিন’, ‘প্রজন্মের পালক’, ‘আমি আর আমিন যখন আজিমপুর থাকতাম’, ‘বাঘা আইড়’, ‘সোনালি ডানার চিল’, ‘সুর’ ‘ইস্ত্রি’, ‘প্রেম প্রার্থনার  ভেতর যৌনতা’, ‘পা’, ‘পানসুন্দরী’ ইত্যাদিতে গল্প প্রবণতার চেয়েও মনস্তাত্ত্বিক বিকিরণ স্ব আভায় বিকিরিত হয়। যেমন ‘মনের মতোন সতিন’ দাম্পত্য মনস্তত্ত্বের অসামান্য আলেখ্য। আপাত সরল, মহানুভব নারী সাবিয়া বেগমও যে কতটা চাতুর্য দেখাতে পারেন নিজ সংসারের স্বার্থের প্রয়োজনে তার এক অপূর্ব বয়ান এই গল্প। নিজের শারীরিক অসুস্থতার জন্য নিজেই স্বামীকে বিয়ে দিতে চাইলেও তার মধ্যে মহানুভবতার যে ছায়া আমরা পাই তাই আবার আহত হয় পাত্রী আঙ্গুরাকে তার অজান্তেই লাইগেশন বা বাজাকরণ করার মধ্য দিয়ে। আঙ্গুরাকে নিয়ে এমন ফাঁদ পেতে পরিকল্পিতভাবে নিজ স্বার্থে সাবিয়া বেগমের এই বৈপ্লবিক চারিত্রিক পরিবর্তন পাঠককে নির্বাক হতে বাধ্য করবে।

সভ্যতার লগ্ন থেকেই নগরে বাস মানুষের। উন্নত জীবনের হাতছানি, ভালো চাকুরি, শিক্ষা সুবিধা নানা কারণেই মানুষ এই ব্যস্ত নগরের জীবনকে গ্রহণ করে। আবার সভ্যতা-ভব্যতা, মার্জিত রুচিবোধ, পরিশীলিত জীবনবোধ ও সুসংস্কৃত হবার বাসনা থেকেও এক শ্রেণির মানুষ নগরকে বেছে নেয় সৌন্দর্যময় জীবনযাপনের জন্য। নিছক জীবিকা অন্বেষণের জন্যেও অনেক মানুষ নগরবাসী হয়। পৃথিবীর অর্থনৈতিক পরিবর্তন, জীবন সম্পর্কে সচেতনতাবোধ ও মানুষের বিবিধ সম্ভাবনার দ্বারও যেন উন্মুক্ত হয় নগরে এসে। সময়-ক্রমিক ধারণায় পৃথিবীতে নগর সভ্যতা অনেক প্রাচীন, সে হিসেবে আমাদের রাজধানী ঢাকার মতো নগরগুলো নবজাতকই বটে। ঔপনিবেশিক কালপর্বে এগুলোর গোড়াপত্তন হয়েছে। ক্রমান্বয়ে এসব নগর বিকশিত হয়েছে। আজকের যুগের প্রাযুক্তিক উন্নতি নগরাঞ্চলকে ভিন্নমাত্রায় উপস্থাপন করেছে। তবু নগর মানেই নিরবচ্ছিন্ন সুখ, নিñিদ্র নিরাপত্তা ও আনন্দবহুল কোনও ব্যবস্থা নয়―বিশেষ করে সিস্টেমে এখানে ফাটলের শেষ নেই, তাই সেখানে আগাছা জন্মেছে আর বেড়েই চলেছে সমানুপাতিক হারে দিনকে দিন। পৃথিবীর সকল সুযোগ-সুবিধা যেমন আগে নগরবাসীদের হাতে এসে পৌঁছায়, তেমনি পৃথিবীর যাবতীয় যন্ত্রণা ও নৈরাশ্যের ভারও নগরবাসীদের পোহাতে হয় রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক নানা টানাপোড়েনে। সমাজের এই রন্ধ্র, অন্যায়-অবিচার, রাতারাতি মাফিয়া বনে যাওয়া বা সমাজের ছিন্নমূল মানুষের কথা তাই গল্পকারের গল্পে নানাভাবে উঠে আসে। ‘রঙের হাটের বেচাকেনা’, ‘মৃতেরা শব্দ করে না’, ‘দুলাভাই’, ‘পুকুর’, ‘উনার নাম আলাউদ্দিন’, ‘ইস্ত্রি’, ‘কালো লাকি, ফর্সা লাকি’, ‘জাজিম’, ‘কনডম’ গল্পগুলো শুধু শিল্পগত আকাক্সক্ষার জন্য নয়, গল্প হিসেবেও তাই অনবদ্য। ‘রঙের হাটের বেচাকেনা’য় মনস্তাত্ত্বিক ক্ষরণ ছাপিয়ে মাদক, পরিস্থিতির শিকারে একজন সাধারণ নারীর মাফিয়া বনে যাবার গল্পটাই প্রধান। ‘মৃতেরা শব্দ করে না’, ‘দুলাভাই’, ‘পুকুর’, ‘উনার নাম আলাউদ্দিন’, ‘ইস্ত্রি’, ‘কালো লাকি, ফর্সা লাকি’, গল্পগুলো ধর্ষণ, রাজনৈতিক কারণে গুম, হত্যা, বেওয়ারিশ লাশ, নারী সহিংসতা, শ্রমিক হত্যা, কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের নিরাপত্তাহীনতার মতো চলমান অন্যায়, অবিচারের প্রতিবেদনমূলক দলিল। এসব গল্পে ফুটে উঠেছে সমকালীন জীবনের প্রত্যক্ষ অভিঘাত। ‘পুকুর’ গল্পটা তো বাংলাদেশের দুর্নীতিতে শীর্ষতালিকায় থাকা দেশেরই চিত্র। একটা গল্প আলোচনা না করলেই নয়―‘কনডম’। গল্পনাম যেমন সাহসী গল্পের বাঁধুনিটাও তেমন জোরালো। কনডম নিয়ে ট্যাবুর ব্যাপারটাকে এমন একটা নাম নিয়ে সমাজকে প্রথমেই একটা ঝাঁকুনি দেওয়া হয়তো গল্পকারের উদ্দেশ্য হয়ে থাকবে। বুয়া থেকে শুরু করে ভাসমান যৌনকর্মী, বন্ধুবৎসল কনডম উপহারদাতা আরিফ, স্ত্রী ইয়াসমিন সকলেরই মনস্তত্ত্বের উদ্ঘাটন করেছেন একটি মাত্র কনডম শব্দ ব্যবহার করে। চরিত্রানুযায়ী ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রেও লেখকের কৃতিত্বের প্রশংসা করতে হয়―ময়মনসিংহ, উত্তরবঙ্গ এবং চরিত্র অনুযায়ী বিভিন্ন এলাকার আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করেছেন সাবলীল সরলতায়। যেমন এই গল্পে পার্কের বেঞ্চিতে ভাসমান যৌনকর্মী কিশোরীর মুখে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি শ্লেষ আছড়ে পড়েছে যথার্থ ভাষায় প্রাসঙ্গিকভাবে : ‘কনডম তোর চেটের মধ্যে লাগায়া রাখ। খানকি মাগির পোলা, কনডম চুদাইতে আইছে। পেটে নাই ভাত, আমি চাবায়া চাবায়া কনডম খাই… হারামির বাচ্চা…’। চরিত্রানুযায়ী এমন খিস্তি অশ্লীলতাকে ছাপিয়ে  শিল্পসম্মতই হয়েছে। গল্পটিতে কনডমদাতা আরিফ তারেককে যে কনডম উপহার দিয়েছিল তা আসলে যৌনকর্মীদের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণের কথা ছিল। কিন্তু তা হাতবদল হয়ে আসে তারেকের কাছে। আপাত সরল দৃষ্টিতে এটা একটা স্বাভাবিক ঘটনা মনে হলেও এভাবেই ছিন্নমূল মানুষ বঞ্চিত হয়ে আসছে তাদের প্রাপ্য থেকে। যে জিনিসটি বিনামূল্যে ছিন্নমূল মানুষের কাছে পৌঁছানোর কথা ছিল, তা পৌঁছায় তারেকের মতো সামর্থ্যবান মানুষের হাতে, যিনি সেটি ক্রয় করার ক্ষমতা রাখেন। এসব ছোট ছোট  দুর্নীতিই একসময় বৃহৎ দুর্নীতিতে পরিণত হয়। বিবেকবান মানুষ মাত্রই সামান্য সচেতন থাকলে এসব অবলীলায় দমন করা যায় কিন্তু ঐ কনডমের মতো সামান্য নিয়ন্ত্রণবোধ আমাদের মধ্যে অনুপস্থিত। অনৈতিকতাই যখন সমাজে স্বীকৃত ও উপহারে পরিণত হয় তখন তারেক সাহেবের মতো বিবেকবান মানুষই অন্যের কাছে হাস্যরসের খোরাক হয় বা তারেক সাহেবের যৌনদণ্ডের মতোই সমাজে সে ক্রমশ শিথিল, অকেজো, অসমর্থ ও অক্ষম হয়ে ওঠে। শিথিল যৌনদণ্ডের মতো এমন সূক্ষè অথচ সামান্য কিন্তু নতুনভাবে শব্দ নিয়ে খেলা করার প্রচুর উদাহরণ টানা যাবে। ‘পা’ গল্পে ‘এই জখমি পা নিয়েই সব চলেছে, বাজার করা, ক্ষেত খোলা দেখা, গরু বাছুরের তদারকি করা, স-ও-ব’; উচ্চারণ আনুযায়ী বাংলা বানান লেখাকে গল্পকার সমর্থন করেন সম্ভবত। নইলে ‘সব’ কে ‘স-ও-ব’ লিখতেন না! অবশ্য ‘স-ও-ব’ লিখলে আলাদা করে শব্দটার উপর যে জোর দেওয়া হয়, সোজাসাপ্টা ‘সব’-এ তো সে জোর নেই।

‘ঘধঃঁৎব যরষষং’-এর তত্ত্বে লেখক দারুণভাবে প্রভাবিত। চিকিৎসাশাস্ত্রে ভারতভূমির যে সমৃদ্ধ ইতিহাস অনেক গল্পেই তার বিচ্ছুরণ খুঁজে পাওয়া যায়। গাছপালার প্রাকৃতিক ভেষজ গুণের কথাও উঠে এসেঝে অনেক জায়গায়।  বিশেষ করে ‘আরোগ্য লতা’, ‘পা’, ‘পানসুন্দরী’ গল্পগুলোতে দারুণভাবে তা বর্ণিত হয়েছে। লতা-গুল্মের ভেষজ গুণের কথা থাকলেও লেখক কুসংস্কারগুলোকে পাত্তা দেননি বরং সেসব অবৈজ্ঞানিক পন্থাগুলোর ব্যাপক সমালোচনা করেছেন, প্রতীকে-ইঙ্গিতে বাণ ছুড়েছেন। মফস্সল জীবনের গ্রামীণ আন্তরিকতা ছাপানো অভিজ্ঞতার কেন্দ্রে ঢাকার স্বতবিচ্ছিন্ন নিরন্তর ছুটে চলা জীবনের বিস্ময়-বিমূঢ়তার ছাপও পড়েছে তাঁর গল্পে। মানবসত্তার নিভৃততম রাহস্যিক অনুভবের নৈর্ব্যক্তিক রূপায়ণও শাহ্নাজ মুন্নীর সৃজনশক্তির সহজ অভিব্যক্তি। শুধু দৃষ্টিভঙ্গির উদাসীন নিস্পৃহতাই নয়―গল্পকারের শিল্পীমানসে যে সহৃদয়তা ছিল আপাত গোচর, তাও উৎসারিত হয়েছে তাঁর গাল্পিক ভাবনায়। আসলে ব্যক্তিগতভাবে শাহ্নাজ মুন্নী সম্ভবত প্রত্যয়বাদী শিল্পী, জীবনের অভিজ্ঞতায় পাওয়া বৈনাশিক চেতনার অভিঘাতেও তাঁর এই প্রত্যয়নিষ্ঠা বিচলিত হয়নি। তাই মানবজীবনের বৈচিত্র্য যেমন তাঁর অন্বিষ্ট ছিল, তেমনই মানবমনের অন্তর্নিহিত বিশুদ্ধতার বোধটিকে প্রতিষ্ঠাতেও তিনি বিশ্বাসী হয়েছেন। ‘আমার জুতা-জীবন’-এ একজন নিম্নবিত্ত আয়ের চাকরিজীবীর জুতারূপী বিবেক তাই তাঁর সমগ্র জীবনটাকেই হয়তো নাড়িয়ে দিয়েছে।

শিল্প বিবেচনার একটা প্রাথমিক মানদণ্ড হচ্ছে কাল বা সময়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় পাঠকের হৃদয়। কাল পরিক্রমায় শাহ্নাজ মুন্নী গল্পকার হিসেবে কতটুকু সফল হয়েছেন তা হয়তো জানা যাবে দীর্ঘকাল অতীত হবার পরে। কিন্তু পাঠকমাত্রই তাঁর গল্পে আকর্ষিত হবেন তাঁর সরল স্বাদু গীতল কাব্যিক ভাষার গুণে। গভীরভাবে পঠনে নিমজ্জিত হলেই পাঠক খুঁজে পাবেন আমাদের ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র স্বাদু গল্পগুলোর ছোঁয়া। লোককথা, উপকথাকে প্রতীকবাদের সঙ্গে এভাবে মিশিয়ে দিয়ে মানুষের লোভ, কামনা, বাসনা, জাগতিক আকাক্সক্ষা কীভাবে তাকে পশুত্বের দিকে টেনে-হিঁচড়ে তার অন্তর্লীন আত্মাকে ক্রমশ ক্ষরণ করছে তার এক নতুন আলেখ্য খুঁজে পাওয়া যাবে গল্পগুলোতে। আপাতত পাঠক হিসেবে সংস্কার, প্রতীক ও ইঙ্গিতকে ব্যবহার করে যে ধোঁয়াশা, আলো-ছায়ার নরম মায়াময় নিজস্ব গল্পভুবন শাহ্নাজ মুন্নী গড়ে তুলেছেন তার জন্য তাঁকে সাধুবাদ না জানালেই নয়!

লেখক : প্রাবন্ধিক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button