আর্কাইভপ্রচ্ছদ রচনা

বাংলাদেশে ফোকলোর চর্চার ইতিবৃত্ত : মাহবুব বোরহান

প্রচ্ছদ রচনা : শব্দঘর নির্বাচিত সেরা বই ২০২৩―প্রবন্ধগ্রন্থ

মাহবুবুল হক (জন্ম : ১৯৪৮) বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের নিবেদিতপ্রাণ অধ্যাপক। প্রথিতযশা ব্যাকরণবিদ। বাংলা বানানের নিবিষ্টচিত্ত গবেষক। নজরুল-গবেষণায় অমূল্য অবদান নজরুল তারিখ অভিধান গ্রন্থের জন্য পেয়েছেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘নজরুল সম্মাননা’। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে রচনা করেছেন মূল্যবান গবেষণাগ্রন্থ রবীন্দ্র সাহিত্য রবীন্দ্রভাবনা। লেখালেখিতে সামগ্রিক অবদানের জন্য পেয়েছেন একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার। তিনজন আধুনিক কবি তার পি-এইচ.ডি থিসিসের গ্রন্থরূপ। প্রথাগত একাডেমিক গবেষণাও যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে মাহবুবুল হকের তিনজন আধুনিক কবি তার প্রামাণ্য দলিল। জন্মস্থান ফরিদপুর হলেও বাবার কর্মস্থল হওয়ার সুবাদে এবং পরবর্তীকালে স্থায়ীভাবে বসবাস স্থাপনের ফলে শৈশবকাল থেকেই জীবন কেটেছে চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক মাহবুবুল হক এখনও বাস করেন তাঁর প্রিয় শহর চট্টগ্রামেই। রাজনৈতিক ভাবনায় সাম্যবাদে আস্থাশীল এই লেখক প্রায়োগিক বাংলা ও ফোকলোর চর্চায় বিশেষ অবদান রেখেছেন। গবেষণা, সম্পাদনা, পাঠ্যবই রচনা এবং অনুবাদে তিনি দেশে বিদেশে সুনাম কুড়িয়েছেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা চল্লিশের অধিক। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত এবং অধুনাবিলুপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে তাঁর গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ফোকলোর বিষয়ে দেশ- বিদেশের প্রখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ করেছেন গবেষণা প্রবন্ধ। সাম্যবাদী মাহবুবুল হকের ফোকলোর চর্চা সামষ্টিক ভাবনায় উজ্জীবিত তার মানবকল্যাণকামী মার্কসিস্ট চেতনারই বহিঃপ্রকাশ। জীবনের দিকে তিনি চোখ ফিরিয়েছেন অবহেলিত মানুষের মুক্তির মহান সংগীতকে কণ্ঠে ধারণ করে। মাহবুবুল হকের ফোকলোর চর্চা তাঁর জীবন চর্চারই অনিবার্য পরিণতি। ফোকলোর বিষয়ে তাঁর রচিত গ্রন্থসমূহ সংস্কৃতি ও লোকসংস্কৃতি (২০০৮), বাংলার লোকসাহিত্য : সমাজ ও সংস্কৃতি (২০১০) ও লোকসংস্কৃতি ও লোকসাহিত্য (২০১৬)। মাহবুবুল হকের দীর্ঘদিনের ফোকলোর গবেষণার পরিণত রূপ লোকসংস্কৃতি চর্চা (২০২২)। গ্রন্থটিতে বাংলাদেশের ফোকলোর চর্চার একটি সামগ্রিক ও সম্পূর্ণ পরিচয় প্রকাশিত হয়েছে। বলা যায় লোকসংস্কৃতি চর্চা বাংলাদেশের ফোকলোর চর্চার ইতিবৃত্ত।

২.

লোকসংস্কৃতি চর্চা গ্রন্থটি মাহবুবুল হকের দীর্ঘ সময়ের অকুন্ঠ পরিশ্রমের ফল ফোকলোরবিষয়ক ২২টি গবেষণা প্রবন্ধের সংকলিত রূপ। প্রবন্ধগুলো হলো : ১. ছড়ায় বাঙালির সমাজ ও সংস্কৃতি, ২. প্রবাদে বাঙালির সমাজ ও সংস্কৃতি, ৩. ধাঁধায় বাঙালির সমাজ ও সংস্কৃতি, ৪. লোককথায় বাঙালির সমাজ ও সংস্কৃতি, ৫. গীতিকায় বাঙালির সমাজ ও সংস্কৃতি, ৬. লোকসংগীতে বাঙালির সমাজ ও সংস্কৃতি, ৭. সম্ভাবনার বাংলাদেশ : ফোকলোর, ৮. বাংলাদেশে ফোকলোর চর্চা, ৯. শিক্ষা ও ফোকলোর, ১০. ফোকলোর আর্কাইভিং ও সম্পাদনা, ১১. পরিবর্তনশীল বিশ^ ও বাঙালির লোকসংস্কৃতি, ১২. বাংলার লোকসাহিত্য : সংক্ষিপ্ত রূপরেখা, ১৩. বাংলার লোককাহিনির দিগ্দিগন্ত, ১৪. বাংলা প্রবাদ ও প্রবচন, ১৫. বাংলার লোকজ খেলাধুলা, ১৬. খনা ও তাঁর বচন, ১৭. চট্টগ্রামের লোকসাহিত্য, ১৮. চট্টগ্রাম অঞ্চলের লোকখাদ্য, ১৯. ‘ঘন্টার ছরা’ : সুতায় গাঁথা লোকবিশ^াসের মালা, ২০. সাপ্তাহিক দিন ও লোকসংস্কার : চট্টগ্রামের পুথিসাহিত্যের আলোকে [প্রবন্ধটির নাম বইয়ের ভেতরে (পৃষ্ঠা : ৩৬৫), সূচিপত্রে এবং ভূমিকায় তিনভাবে দেওয়া আছে। সূচিপত্রে আছে : ‘সাপ্তাহিক দিন ও লোকসংস্কার : পুথিসাহিত্যের আলোকে’ এবং ভূমিকায় আছে, ‘সাপ্তাহিক দিন ও লোকসংস্কার : পুথিসাহিত্য আলোয়’। আমাদের আলোচনায় বইয়ের ভেতরের নামটিকেই গ্রহণ করা হয়েছে।], ২১. লোকসাহিত্য চর্চায় দীনেশচন্দ্র সেন ও ২২. বাংলা একাডেমি লোকজ সংস্কৃতি বিকাশ গ্রন্থমালা (এই প্রবন্ধটির নাম ভূমিকায় আছে ‘বাংলা একাডেমি লোকজ বিকাশ গ্রন্থমালা’)। প্রবন্ধগুলো তিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উপলক্ষ্যে রচনা করেছেন। গ্রন্থটির ভূমিকা থেকে জানা যায়, ‘এই বইয়ের প্রথম ছয়টি প্রবন্ধ ২০০৭ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সমীক্ষা গ্রন্থমালায় ষষ্ঠ খণ্ডে (ভাষা ও সাহিত্য) প্রথম প্রকাশিত হয়। পরে তা পরিবর্ধিতরূপে বর্তমান লেখকের বাংলার লোকসংস্কৃতি : সমাজ ও সাহিত্য গ্রন্থে সংকলিত হয়।’ সপ্তম প্রবন্ধ ‘সম্ভাবনার বাংলাদেশ : ফোকলোর’ প্রবন্ধটি ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে একুশের গ্রন্থমেলা উপলক্ষ্যে ঢাকায় বাংলা একাডেমি আয়োজিত সেমিনারে প্রথম পাঠ করা হয়। অষ্টম প্রবন্ধ ‘বাংলাদেশে ফোকলোর চর্চা’ বাংলা একাডেমি পত্রিকার এপ্রিল-জুন ২০০৮ সংখ্যায় (ফোকলোরবিষয়ক বিশেষ সংখ্যা) প্রথম প্রকাশিত হয়। নবম প্রবন্ধ ‘শিক্ষা ও ফোকলোর’ ২০১৩ সালে (তারিখ উল্লেখ করা হয়নি) দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় সাহিত্য সাময়িকীতে প্রথম প্রকাশিত হয়। দশম প্রবন্ধ ‘ফোকলোর আর্কাইভিং ও সম্পাদনা’ ২০০৭ সালের ২৭-২৮ জুলাই রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত জাতীয় ফোকলোর সম্মেলনে পাঠ করা হয়। প্রবন্ধটি ‘শিক্ষাবার্তা’ সাময়িকীর জানুয়ারি ২০০৮ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়। একাদশ প্রবন্ধ ‘পরিবর্তনশীল বিশ্বও বাঙালির লোকসংস্কৃতি’ ২৮-৩০ জানুয়ারি ২০০০ সালে পাঞ্জাবের পাঞ্জাবি বিশ^বিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত ‘ফোকলোর অ্যান্ড কালচার স্টাডিজ ইন দ্য টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সেমিনারে পঠিত প্রবন্ধের অনুসরণে রচিত। শব্দঘর সাময়িকীর জুলাই ২০১৫ সংখ্যায় ষোড়শ প্রবন্ধ ‘খনা ও তাঁর বচন’,  জুন-জুলাই ২০১৬ সংখ্যায় চতুর্দশ প্রবন্ধ ‘বাংলা প্রবাদ ও প্রবচন’ এবং এপ্রিল ২০১৭ সংখ্যায় পঞ্চদশ প্রবন্ধ ‘বাংলার লোকজ খেলাধুলা’ প্রথম প্রকাশিত হয়। অষ্টাদশ প্রবন্ধ ‘চট্টগ্রাম অঞ্চলের লোকখাদ্য’ ২০১৩ সালের ৩০ আগস্ট চট্টগ্রাম সমিতির উদ্যোগে ঢাকায় আয়োজিত সাহিত্য সম্মেলনে প্রথম পাঠ করা হয়। ঊনবিংশতম প্রবন্ধ ‘ঘন্টার ছরা : সুতায় গাঁথা লোকবিশ^াসের মালা’ ৫-৬ এপ্রিল ১৯৯৯ সালে পশ্চিমবঙ্গের কল্যাণী বিশ^বিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশে লোকসংস্কৃতি চর্চার গতিপ্রকৃতি শীর্ষক আলোচনাচক্রে পঠিত হয়। বিংশতম প্রবন্ধ ‘সাপ্তাহিক দিন ও লোকসংস্কার : চট্টগ্রামের পুথিসাহিত্যের আলোকে’ ১০-১২ জানুয়ারি ২০০০ সালে পশ্চিমবঙ্গের যাদবপুর বিশ^বিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ফোকলোর সেমিনারে পঠিত। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে এই প্রবন্ধটির নাম সূচিপত্র, গ্রন্থের মধ্যে শিরোনামে এবং ভূমিকা অংশে তিনভাবে আছে। ভূমিকা অংশে উল্লেখিত নাম, ‘সাপ্তাহিক দিন ও লোকসংস্কার : পুথি সাহিত্য আলোয়’। এই নামটিতে অসংগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। হতে পারে ‘পুথি সাহিত্য আলোয়’ স্থলে ‘পুথি সাহিত্যের আলোয়’ হবে। শেষোক্ত দুটি প্রবন্ধই কল্যাণী বিশ^বিদ্যালয়ের লোকসংস্কৃতি বিভাগ থেকে প্রকাশিত  বাংলাদেশে লোকসংস্কৃতি চর্চা সংকলনে (২০০১) প্রকাশিত হয়। গ্রন্থের সর্বশেষ প্রবন্ধ ‘বাংলা একাডেমি লোকজ সংস্কৃতি বিকাশ গ্রন্থমালা’ ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে একুশের গ্রন্থমেলা উপলক্ষ্যে ঢাকায় বাংলা একাডেমি আয়োজিত সেমিনারে প্রথম পঠিত হয়। গ্রন্থটিতে অন্তর্ভুক্ত চারটি প্রবন্ধ (‘বাংলার লোকসাহিত্য : সংক্ষিপ্ত রূপরেখা’, ‘বাংলার লোককাহিনির দিগ্দিগন্ত’, ‘চট্টগ্রামের লোকসাহিত্য’ এবং ‘লোকসাহিত্য চর্চায় দীনেশচন্দ্র সেন’) রচনার সময় ও প্রথম প্রকাশের তথ্য গ্রন্থটিতে নেই। হতে পারে এই গ্রন্থেই প্রবন্ধগুলো প্রথম সংকলিত হয়েছে।

৩.

‘ছড়ায় বাঙালির সমাজ ও সংস্কৃতি’ দীর্ঘ প্রবন্ধে লেখক ‘বাংলা ছড়ায় জাতিতাত্ত্বিক ইতিহাসের বিভিন্ন উপাদানসহ বাঙালির সামাজিক, অর্থনৈতিক, পারিবারিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের বিভিন্ন দিকের পরিচয়’ অনুসন্ধান করেছেন। প্রবন্ধটিকে লেখক প্রথম কয়েকটি প্রধান ভাগে ভাগ করেছেন। তার পর প্রতিটি প্রধান ভাগকে কয়েকটি উপবিভাগে ভাগ করে অত্যন্ত সুবিন্যস্তভাবে তার বক্তব্য তুলে ধরেছেন। প্রতিটি প্রধান ভাগ ও উপবিভাগের তিনি একটি করে বিষয়ানুগ শিরোনাম যুক্ত করেছেন। ভূমিকায় ছড়া সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করে লেখক মূল আলোচনায় প্রবেশ করেছেন ‘জাতিতাত্ত্বিক প্রেক্ষাপট’ শিরোনামের প্রধান অংশে। এই অংশটিকে তিনি আবার ‘ছড়ায় প্রাক-আর্য উপাদান’, ও ‘ছড়ায় আর্য উপাদান’ নামে প্রধান দুটি ভাগে ভাগ করেছেন। [ও ‘ছড়ায় দাসী ক্রয়ের প্রসঙ্গও পাওয়া যায়’ এই তিনটি উপবিভাগে ভাগ করে তার বক্তব্য বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেছেন।]

‘প্রাক-আর্য উপাদান’ অংশের মূল কথা হলো প্রাক-আর্য বাঙালি সমাজ ছিল মাতৃপ্রধান। ছড়াগুলোয় তাই মাতৃবন্দনার প্রাচুর্য দেখা যায়। সমাজের দেব-দেবী কল্পনায়ও দেখা যায় দেবতার চেয়ে দেবীর সংখ্যাই বেশি। লেখক জানিয়েছেন ব্রতের ছড়ায় ‘উল্লিখিত দেব-দেবীর মধ্যে দেবতাদের তুলনায় দেবীর সংখ্যা তিন গুণ।’ (পৃষ্ঠা : ১১-১২) প্রাক-আর্য সমাজে কৃষিতে ব্যবহৃত মূল পদ্ধতি ছিল নিড়ানি দিয়ে খনন পদ্ধতির চাষাবাদ। এই চাষাবাদে নারীর একচেটিয়া প্রধান্য ছিল। চাষাবাদের আর্য উপকরণ হলো লাঙল, বলদ, কাস্তে ও মই। আর্য সমাজেই চাষাবাদে নারীর তুলনায় পুরুষের প্রাধান্য পায়। কৃষিজীবী সমাজের মধ্যেই সেকালে বাঙালি সমাজ মাতৃতন্ত্র থেকে পিতৃতন্ত্রে রূপান্তরিত হয়েছিল বলে লেখক অভিমত প্রকাশ করেন। বাংলা ছড়ায় ব্যবহৃত অষ্ট্রিক ভাষা উদ্ভূত ধান, কলা, পান, নারিকেল, ডালিম, পাট, কার্পাস, মেড়া, দা প্রভৃতি কৃষিসম্পর্কিত শব্দের ব্যবহার প্রাক-আর্য সমাজের স্মৃতিকেই স্মরণ করিয়ে দেয়।

‘ছড়ায় আর্য উপাদান’ অংশকে লেখক ‘কৃষি ও দাসপ্রথা’ ও ‘পুরুষ প্রাধান্য ও নারী নিগ্রহ’ নামক দুটি উপ অংশে ভাগ করে তার বক্তব্য উল্লেখ করেছেন। এই অংশের মূল বক্তব্য হলো ‘খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকের মধ্যে আর্য জনপ্রবাহ ও আর্য সংস্কৃতি বঙ্গদেশে বিস্তার লাভ করে।’ আর্যদের প্রভাবেই এ দেশে পিতৃতান্ত্রিক সমাজের সৃষ্টি হয়। বাঙালি সমাজে পুরুষ প্রাধান্য ও নারী নিগ্রহ আর্য আগমনেরই ফল। একই সঙ্গে তখন থেকেই সমাজে নারীর মর্যাদা ক্ষুণ্ন হতে থাকে। চালু হয় যৌতুক বা পণপ্রথা। নারী পরিণত হয় ভোগ্যবস্তু বা পণ্যে। ‘ছড়ায় দাসী ক্রয়ের প্রসঙ্গও পাওয়া যায়’ অংশে লেখক ‘বর্ণভেদ ও কৌলীন্য প্রথা’, ‘বহুবিবাহ’, ‘সপত্নী সমস্যা’ ও ‘বাল্যবিবাহ, অসম-বিবাহ ও যৌতুক’বিষয়ক বিভিন্ন উপাদান বাংলা ছড়া থেকে শনাক্ত করেছেন। ‘বর্ণভেদ ও কৌলীন্য প্রথা’ সম্পর্কে লেখকের পর্যবেক্ষণ হলো সেন রাজত্বকালে (আ ১০৯৭-১২২৫), বিশেষভাবে বল্লাল সেনের আমলে বাংলায় বর্ণভেদ ও কৌলীন্য প্রথা চালু হলেও ব্রাহ্মণ্যবাদ বাংলার সাধারণ মানুষের কাছে উপেক্ষিত হয়েছে। সেনরা বহু চেষ্টা করেও বাংলায় বৈদিক ধারার সংহত জাতপ্রথার সৃষ্টি করতে পারেনি। ‘এর প্রধান কারণ বাংলা মূলগতভাবেই অনার্য দেশ।’ বর্ণভেদ ও কৌলীন্য প্রথার ফলেই হিন্দু সমাজে বহুবিবাহ, সপত্নী সমস্যা, বাল্যবিবাহ, অসমবিবাহ ও যৌতুক প্রথার উদ্ভব ঘটে। কৌলীন্য প্রথা ও বর্ণপ্রথার নির্মম ফল বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ধ্বনিত হওয়ার নজিরও পাওয়া যায় মেয়েলিছড়ায়। (উদাহরণ : পৃষ্ঠা ১৭) বিষয় শিরোনামে ‘ছড়ায় দাসী ক্রয়ের প্রসঙ্গও পাওয়া যায়’ উল্লেখ করলেও দাসী ক্রয়সংক্রান্ত কোনও তথ্য বা ছড়ার উদাহরণ লেখক প্রবন্ধটিতে দেননি।

‘গৃহস্থালি ও জীবনযাত্রা’ অংশে লেখক ছড়া থেকে ‘আবাসন ও গৃহ-পরিবেশ’, ‘আসবাবপত্র ও তৈজসপত্র’, ‘আহার্য ও পানীয়’, ‘পোশাক-পরিচ্ছদ’ ও ‘অলংকার ও প্রসাধন’ ইত্যাদি সম্পর্কিত বিস্তারিত উপকরণ শনাক্ত করে প্রবন্ধটিতে সন্নিবেশিত করেছেন। লেখক দেখিয়েছেন গৃহ হিসেবে দোচালা, চার চালা, আট চালা, দশ চালা ও বারো চালা বাড়ির ব্যবহারও প্রচলিত ছিল। বসার আসন হিসেবে পিঁড়ি, মাদুর, জলপিঁড়ি, শীতলপাটি, তক্তপোশ, শতরঞ্চি এবং শোয়ার আসন হিসেবে খাট, পালং, চৌকি ইত্যাদি ব্যবহারের উল্লেখ লোকছড়ায় পাওয়া যায়। আহার্য  হিসেবে গরম ভাত, ঘি-ভাত, পান্তা ভাত ও দুধ-ভাতের উল্লেখ আছে। এছাড়া মাছ, মাংস, সবজি, ফলমূল ও বিভিন্ন রকম পিঠা-পায়েস বাঙালির খাদ্য হিসেবে প্রচলিত ছিল। মাছ বাঙালির বিশেষ প্রিয় ছিল। লেখক ছড়া থেকে প্রাপ্ত ২৪ প্রকার মাছের নাম তাঁর প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন। (পৃষ্ঠা : ২০) পানীয় হিসেবে ডাবের পানি, ইক্ষুরস, তালরস, খেজুর রস ও মধুর ব্যবহার ছিল। শরবত হিসেবে গুড়ের পানা, চিনির পানা, বেলের পানা ইত্যাদির চল ছিল। ভাত, গম, মধু, আখ ও তালরস থেকে তৈরি দেশি মদ মাদক-পানীয় হিসেবে ব্যবহৃত হতো। নেশাদ্রব্য হিসেবে ছড়ায় তামাক, আফিম, মোদক, ভাঙ ও গাঁজার উল্লেখ আছে বলে লেখক জানিয়েছেন। (পৃষ্ঠা : ২২) মধ্যযুগ পর্যন্ত বাঙালির পরিধেয় পোশাক ছিল এক প্রস্থ কাপড়। পুরুষেরা ধুতি ও নারীরা শাড়ি পরত। পুরুষেরা গায়ে উত্তরীয় ও মেয়েরা ওড়না ব্যবহার করত। দরিদ্র লোকেরা সাধারণত ন্যাকড়া ও নেংটি পরত। সেলাইহীন বস্ত্র পরিধানের এই রীতির মধ্যে প্রাক-আর্য প্রভাব লক্ষণীয়। পরবর্তীকালে উত্তর ভারতীয় প্রভাবে সেলাই করা পোশাকের প্রচলন হয় বলে লেখক জানিয়েছেন। সুপ্রাচীন কাল থেকেই বাঙালি নারী ও পুরুষ অলংকার ও প্রসাধনী ব্যবহার করত। একসময় বাঙালি নারী ও পুরুষ উভয়েই বালা পরিধান করত।

ছড়া থেকে গবেষক বাঙালির যাতায়াত ও যানবাহন, লোকচিকিৎসা, পারিবারিক সম্পর্ক ও আত্মীয়তা, অর্থনৈতিক জীবন (কৃষি, কুটিরশিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্য), সামাজিক বর্গ ও বৃত্তিবিন্যাস, গ্রামীণ নগর ও মধ্যবিত্ত, ধর্মবিশ^াস ও লোকাচার লৌকিক দেব-দেবী ও দেবতা কল্পনা, ইসলাম ধর্ম ও লৌকিক পিরবাদ, লোকাচার ও সংস্কার, উৎসব-অনুষ্ঠান ও বিনোদন (উৎসব-অনুষ্ঠান, নৃত্য, বাদ্যযন্ত্র, খেলাধুলা, শিকার) সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য প্রবন্ধটিতে হাজির করেছেন।

প্রবন্ধটির শিরোনাম সম্পর্কে একটি বিষয় বিবেচনার দাবি রাখে। ছড়া বাংলা সাহিত্যের একটি শক্তিশালী মাধ্যম। অতীতে আধুনিক লেখকদের মধ্যে অনেকেই ছড়া লিখে খ্যাতি অর্জন করেছেন। এখনও অনেকেই ছড়া লিখে সুনাম কুড়াচ্ছেন। ফোকলোরের বিষয় হিসেবে যে ছড়ার আলোচনা করা হয়েছে তা কোনও নির্দিষ্ট লেখকের লেখা ছড়া নয়। প্রাবন্ধিকের ভাষায়, ‘ছড়া সৃষ্টি হয়েছে লোকপরম্পরায়। কালে কালান্তরে এবং স্থানে স্থানান্তরে ছড়ায় নানা সংযোজন, বিয়োজন বা পরিবর্তন ঘটে বলে এগুলোকে সুনির্দিষ্ট কালিক বা স্থানিক পরিসরের গণ্ডিতে অবলোকন করা কঠিন।’ (পৃষ্ঠা : ১১)  ফোকলোরের বিষয় হিসেবে লেখকের আলোচিত ছড়াকে তাই শুধু ছড়া না বলে ‘লোকছড়া’ বলাই সংগত। যেমন অন্যত্র তিনি যথার্থই ব্যবহার করেছেন ‘লোককথা’, ‘লোকসংগীত’, ‘লোকসাহিত্য’ ও ‘লোককাহিনি’। তাই আমাদের বিবেচনায় প্রবন্ধটির শিরোনাম ‘লোকছড়ায় বাঙালির সমাজ ও সংস্কৃতি’ হওয়াই যৌক্তিক।

‘প্রবাদে বাঙালির সমাজ ও সংস্কৃতি’ প্রবন্ধে লেখক বাঙালির পারিবারিক সম্পর্ক ও আত্মীয়তা, গৃহস্থালি ও জীবনযাত্রা (আবাসন ও গৃহ পরিবেশ, আসবাব ও তৈজসপত্র, আহার্য ও পানীয়, পোশাক-পরিচ্ছদ, যাতায়াত ও যানবাহন, অলংকার ও প্রসাধন), অর্থনৈতিক জীবন (কৃষি ও কৃষক, কুটিরশিল্প, মুদ্রা ও বিনিময়), সামাজিক বর্গ, ধর্মবিশ^াস ও লোকাচার, উৎসব-অনুষ্ঠান ও বিনোদন (বাদন ও বাদ্যযন্ত্র, লোকসংগীত) সম্পর্কিত অনুপুঙ্খ উপকরণ প্রবাদ থেকে শনাক্ত করেছেন। লেখকের এই অনুসন্ধান গভীর মনোযোগ ও অপরিমেয় পরিশ্রমের স্মারক। প্রবন্ধটিতে তিনি দেখিয়েছেন প্রবাদে বাঙালির সমাজ ও সংস্কৃতির যে পরিচয় মেলে তাতে সর্বত্রই মাতৃবন্দনার ছড়াছড়ি, পিতৃবন্দনা অনুপস্থিত। অর্থনৈতিকভাবে দেখা যায় আরণ্যক ও পশুপালক জীবনপ্রকৃতির পর বাঙালির সমাজ জীবনের ভিত্তি ছিল কৃষি। প্রবাদে কৃষককে সমাজের স্থূলবুদ্ধি অংশ হিসেবে কটাক্ষ করার পরিচয় আছে। (উদাহরণ: পৃষ্ঠা ৬৫) প্রবাদে ধান ও পানকে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। চাষার হতদরিদ্র জীবনে যে বিলাসিতার সুযোগ ছিল না, ‘চাষা কি জানে মদের স্বাদ।’ (পৃষ্ঠা : ৬৫) প্রবাদটিতে তার পরিচয় স্পষ্টভাবেই আছে। কৃষি ছাড়াও সমাজে কুটিরশিল্পভিত্তিক পেশা ছিল। প্রবাদে কলু, কামার, কারিগর, কুমার, ছুতার, তাঁতি, তেলি, দরজি, বেনে, মজুর, ময়রা, সেকরা ইত্যাদির উল্লেখ আছে বলে প্রাবন্ধিক জানিয়েছেন। সম্পদ ও সচ্ছলতার দিক থেকে এদের বেশির ভাগই ছিল নিম্নবর্গের। মুদ্রা হিসেবে কড়ির প্রচলনের তথ্য প্রবাদ থেকে পাওয়া যায়। শ্রেণিবিভক্ত সমাজে নিম্নবর্গের পাশাপাশি উচ্চ ও মধ্যবর্গের বৃত্তিধারী হিসেবে সমাজে আমির, উকিল, উজির, হাকিম, কাজি, দারোগা, দেওয়ান প্রমুখের উপস্থিতি ছিল। সামন্ত সমাজে রাজা, বাদশাহ, জমিদাররাই ছিল সমাজের শাসক, শোষক ও প্রতিভূ। এছাড়াও সমাজে গণক, গায়েন, গোঁসাই, ঘটক, ঠক, দরবেশ, দালাল, পণ্ডিত, পুরোহিত, বাটপাড়, বৈরাগী, মোল্লা ইত্যাদিরও অস্তিত্ব ছিল। প্রবাদে প্রাক-আর্য ধর্মবিশ^াসের পরিচয় পাওয়া যায়। ষষ্ঠীর পূজা, মনসা পূজা প্রাক-আর্য ধর্মবিশ^াস প্রভাবিত। মনসা প্রাক-আর্য দেবী। পাল আমলে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের আনুকূল্যে মনসা উচ্চবর্গীয় সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। প্রবাদে পুত্র ও কন্যা সন্তান জন্মলাভ সম্পর্কে নানা রকম সংস্কার প্রচলিত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন : ‘স্ত্রী ভাগ্যে ধন, পুরুষ ভাগ্যে পুত্র।’ বা ‘শেষ ঘরে হয় পুত, সংসারে লাগে ভূত।/ শেষ ঘরে হয় মেয়ে, ঘি পড়ে শিক বেয়ে।’ প্রবাদে উৎসব হিসেবে ‘নবান্ন’ বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। বাদ্যযন্ত্র হিসেবে একতারা, দোতারা, গাবগুবাগুব, কাঁসি, কাড়া, খঞ্জনি, খোল, ঘণ্টা, ডঙ্কা, ডুগডুগি, ঢাক, ঢোল, ধামসা, বাঁশি, মৃদঙ্গ, শাঁখ, শিঙা, সানাই ইত্যাদির উল্লেখ প্রবাদে আছে বলে গবেষক জানিয়েছেন। এদের মধ্যে ঢোল প্রাক-আর্য বাদ্যযন্ত্র। প্রবাদে বিনোদনের উপকরণ হিসেবে কবিগান, ধুয়াগান, পাঁচালি, বাউল, সারি গান ইত্যাদির উল্লেখ পাওয়া যায়। এছাড়া নৃত্য, শিকার, মাছ ধরা, তাস বা পাশা খেলার উল্লেখ আছে বলে লেখক জানিয়েছেন। প্রবাদ বাঙালির এক অমূল্য সম্পদ। গণমানুষের যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতার সারাৎসারই প্রবাদ। লেখকের অভিমত, ‘প্রবাদগুলো গ্রামের সাধারণ লোকসমাজের হাতেই তৈরি হয়েছে।’ (পৃষ্ঠা : ৫৬)

ধাঁধা লোকসাহিত্যের প্রাচীন শাখা। কিন্তু এতে মনন ও বিন্যাসের যে বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায় তাতে এগুলোকে তুলনামূলকভাবে পরবর্তীকালের সৃষ্টি হিসেবেই মনে করা হয়। ধাঁধা উপমা-রূপক-প্রতীকের আশ্রয়ে হেঁয়ালিপূর্ণ ভাষায় রচিত। এগুলো মূলত প্রশ্নোত্তরমূলক। ধাঁধা সাধারণত বিয়ের আসরে প্রচলিত এক ধরনের প্রমোদমূলক প্রতিযোগিতা। এছাড়া সাধারণের বুদ্ধির খেলা হিসেবে অবসর যাপন ও বিনোদনেও ধাঁধা ব্যবহৃত হয়। মনসা পূজার আচার হিসেবে এবং রথযাত্রা অনুষ্ঠানে ধাঁধার ব্যবহার ছিল। বাংলাদেশের মুসলিম সমাজে লিঙ্গচ্ছেদ অনুষ্ঠানে প্রশ্নোত্তরমূলক ধাঁধা একটি বিশেষ আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান হিসেবে প্রচলিত ছিল। দীর্ঘকাল ধরে ধাঁধা মৌখিক ঐতিহ্য হিসেবে সমাজে লৌকিক শিক্ষার মাধ্যমরূপে প্রচলিত। পূর্ববর্তী দুটি প্রবন্ধের মতো ‘ধাঁধায় বাঙালির সমাজ ও সংস্কৃতি’ প্রবন্ধেও লেখক একইভাবে একই শিরোনাম উপশিরোনামে বিন্যস্ত করে বাঙালির জীবন ও সমাজের বিভিন্ন উপকরণ ও রীতিপদ্ধতির পরিচয় শনাক্ত করেছেন। অবস্থাপন্ন পরিবারে খাদ্য হিসেবে গরু, ছাগল, শূকর, বক, হাঁস, কবুতর, হরিণ ইত্যাদি পশুপাখির মাংস ব্যবহৃত হলেও ধাঁধায় কেবল মুরগির মাংসের উল্লেখ পাওয়া যায়। ধাঁধা থেকে জানা যায় দরিদ্র ও অসচ্ছল পরিবারে নিত্যদিনের খাদ্যের উপকরণ ছিল শাকভাত। ধাঁধায় কচু শাক, কলমি শাক, কুমড়ো শাক, ঢেঁকি শাক, নালিতা শাক, পাট শাক, পালং শাক,পুঁই শাক, মুলা শাক, লাউ শাক, শুশনি শাকের উল্লেখ আছে বলে গবেষক জানিয়েছেন। বাঙালির সমাজ ও সংস্কৃতির যে পরিচয় লেখক পূর্ববর্তী প্রবন্ধ দুটিতে উপস্থাপন করেছেন তার সঙ্গে বর্তমান প্রবন্ধে উপস্থাপিত নান বিষয়ের মিল আছে। বিশেষভাবে সমাজে মায়ের প্রাধান্য ও মাতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করা যায়।

‘লোককথায় বাঙালির সমাজ ও সংস্কৃতি’ প্রবন্ধে লেখক রূপকথা, ব্রতকথা, পুরাকথা, পশুকথা, জাতিতাত্ত্বিক পেক্ষাপট (প্রাক-আর্য উপাদান, আর্য উপাদান), গৃহস্থালি ও জীবনযাত্রা (আবাসন ও গৃহ পরিবেশ, আসবাব ও তৈজসপত্র, আহার্য ও পানীয়, পোশাক-পরিচ্ছদ, অলংকার ও প্রসাধন, লোকচিকিৎসা), পারিবারিক সম্পর্ক, অর্থনৈতিক জীবন (কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য, মুদ্রাব্যবস্থা, কুটিরশিল্প), সামাজিক বর্গ : পেশা ও বৃত্তিবিন্যাস, সামাজিক রীতিনীতি (বিবাহ, নারী), আইন ও বিচারব্যবস্থা, লোকবিশ^াস ও লোকাচার (জাদুবিশ^াস, জন্মান্তরবাদ, টোটেমবাদ, আত্মা ও সর্বপ্রাণবাদ, দেব-দেবী, নিষেধ বা ট্যাবু, নিষেধ-বিধি ভঙ্গ করার শাস্তি), উৎসব ও বিনোদন (লোকক্রীড়া) সম্পর্কিত বিস্তারিত উপকরণ বাংলা লোককথা থেকে উদ্ধার করেছেন। একই সঙ্গে প্রাবন্ধিক প্রবন্ধটিতে লোককথা সংগ্রাহকদের সম্পর্কেও প্রয়োজনীয় তথ্য উল্লেখ করেছেন। গবেষক দেখিয়েছেন ‘কাঞ্চনমালা’, ‘মধুমালা’, ‘পুষ্পমালা’, ‘মালঞ্চমালা’, ‘শে^তবসন্ত’, ‘ডালিমকুমার’, ‘নীলকমল-লালকমল’, ‘সাত ভাই চম্পা’, ‘সুখু ও দুখু’, ‘ফকিরচাঁদ’, ‘রাজকন্যা কলাবতী’ ইত্যাদি রূপকথায় শুভ-অশুভর দ্বন্দ্বের পরিণতিতে শেষ পর্যন্ত শুভর বিজয় হয়। ব্রতকথা বাঙালির এক বিশেষ সম্পদ। লেখক জানিয়েছেন বাংলা ব্রতকথার মতো আনুষঙ্গিক কাহিনি পৃথিবীর অন্য কোনও লোকসমাজে বিরলদৃষ্ট। (পৃষ্ঠা :১০২) ‘বাংলার লোককথার সবচেয়ে প্রাচীন রূপ হচ্ছে পুরাকথা।’ ‘পুরাকথার মাধ্যমেই মানববুদ্ধির প্রথম বিকাশ ঘটেছে।’ (পৃষ্ঠা : ১০৩) পশুকথা লোকসাহিত্যের একটি প্রাচীন শাখা। পশুকথাগুলোতে আদিম যুগের অসহায় অবস্থায় মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার অভিজ্ঞতা নানা রূপকে প্রকাশিত হয়েছে। ক্ষেত্রলক্ষ্মীর ব্রতকথায় পশুচারণজীবী সমাজ থেকে কৃষিজীবী সমাজে উত্তরণের পরিচয় পাওয়া যায়। মন্থন বা চাপড়া ষষ্ঠীর ব্রতকথার বরাত দিয়ে লেখক জানিয়েছেন সেকালে বাংলাদেশে নরবলি প্রচলিত ছিল। সামন্তবাদী সমাজজীবনের পটভূমিতে সৃষ্ট বলে অধিকাংশ লোককথায় রাজরাজড়ারাই কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে স্থান পেয়েছে। লোককথায় কাঠ কুড়ুনি, ঘুঁটে কুড়ুনি, ফকির, চাকর, ক্রীতদাস-ক্রীতদাসী চরিত্রের দেখা পাওয়া যায় বলে লেখক উল্লেখ করেছেন। সমাজে কোনও কোনও নারী স্বেচ্ছায় দেহব্যবসা করে দিনাতিপাত করত বলেও লোককথাগুলো থেকে জানা যায়। বংশপরম্পরায় চুরিবিদ্যা শিক্ষা দেওয়ার প্রসঙ্গও লোককথায় আছে। লোককথায় বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহের উল্লেখ পাওয়া যায়। সেকালে স্বাধীন ও অবাধ প্রেমের ব্যাপারে সমাজ রক্ষণশীল ছিল বলে জানা যায়। রূপকথাগুলোতে নরমাংসভোজী রাক্ষস সম্প্রদায়ের বর্ণনা মাতৃতান্ত্রিক সমাজের ইঙ্গিতবাহী। লোককথায় নারীর পাখিতে রূপান্তরিত হওয়ার কাহিনি দূষিত মনুষ্য সমাজের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে নারীর সে-সমাজ পরিত্যাগের অবচেতন ইচ্ছার নামান্তর বলে লেখক উল্লেখ করেছেন। লোককথায় আদিম সমাজে অনুসৃত আইন ও বিচারব্যবস্থার ইঙ্গিতের পাশাপাশি সামন্ত সমাজে আইন প্রয়োগ ও শাস্তি বিধানে রাজার ভূমিকাই প্রধান ছিল বলে জানা যায়। সে সময়ে বাঙালি সমাজ নানা লোকবিশ^াস ও লোকাচারে অভ্যস্ত ছিল বলে লোককথা থেকে জানা যায়। সমাজবদ্ধ মানুষের অবচেতন আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলনই লোককথা। লেখক যথার্থই  বলেছেন, ‘বাংলা লোককথার গভীর তলে সমাজমানসের অবচেতন আকাক্সক্ষা ও অভিপ্রায়ের সঙ্গে ব্যক্তিমনের সূক্ষ্ম ও জটিল অনুভূতি ও উপলব্ধির প্রকাশ ঘটেছে।’ (পৃষ্ঠা : ১১৪)

গ্রন্থটির সবচেয়ে দীর্ঘ প্রবন্ধ ‘গীতিকায় বাঙালির সমাজ ও সংস্কৃতি’। এই প্রবন্ধটিতেও আগের চারটি প্রবন্ধের মতোই বিষয়ভিত্তিক বিভিন্ন শিরোনাম ও উপশিরোনাম ব্যবহার করে গীতিকাসমূহ থেকে বাঙালির সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে লেখক তাঁর পর্যবেক্ষণ ও অনুসন্ধান তুলে ধরেছেন। এই প্রবন্ধটিতে লেখক পূর্ববর্তী প্রবন্ধসমূহে আলোচিত বিষয়গুলোসহ নতুন কিছু বিষয় সম্পর্কে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করেছেন। যেগুলো পূর্ববর্তী প্রবন্ধসমূহে আলোচিত হয়নি, কিছু বিষয় সামগ্রিক আলোচনায় কখনও কখনও উল্লেখ করলেও পৃথক শিরোনাম দিয়ে আলোচনায় আসেনি। বিষয়গুলো হলো : শিক্ষা, প্রেম, নৌশিল্প, গৃহনির্মাণ শিল্প, বয়নশিল্প, মৃৎশিল্প, ধাতুশিল্প, দারুশিল্প, স্বর্ণের ব্যবহার, গুপ্তধন, শাসকশ্রেণি, যুদ্ধ-বিগ্রহ, মহাজন, কৃষক সম্প্রদায়, ব্রাহ্মণ, বেনে, গণক, ঘটক, চণ্ডাল, ডোম, জল্লাদ, পালকিবাহক, রাখাল, দাস-দাসী, কুটনি, পির-ফকির-দরবেশ, সন্ন্যাসী, শিলারি, ভিক্ষুক, [‘আইন, অপরাধ, বিচার ও শাস্তি’  শিরোনামের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে :] ‘চোর, ডাকাত ও জলদস্যু’, সন্তান অপহরণ, শাস্তি, আত্মহনন, [‘সামাজিক বিধিবিধান’ শিরোনামের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে :] শ্রেণিবৈষম্য, মানুষ ক্রয়-বিক্রয়, বিয়ে, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, সপত্নী সমস্যা, [‘হিন্দুর বিবাহ বৈশিষ্ট্য’ শিরোনামের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে :] অনুলোম ও প্রতিলোম বিবাহ, রাক্ষস বিবাহ, বরপণ ও কন্যাপণ, ঘটক প্রথা, কৌলীন্য প্রথা, [‘ধর্মবোধ ও ধর্মবিশ^াস’ শিরোনামের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে :] লৌকিক দেব-দেবী, শিব, সত্যপির, শালগ্রাম শিলা, শীতলা, দুর্গা, লক্ষ্মী, মনসা, বনদুর্গা, চণ্ডী, ষষ্ঠী, কার্তিক, রক্ষাকালী, ডরাই, তুলসী গাছ, আউলিয়া দরবেশ, ভক্তিবাদ, জাতিত্বসংস্কার, ধর্মান্তরণ, ধর্মীয় সম্প্রীতি, বিভিন্ন জাতি-সম্প্রদায়, বলিদান, নরবলি, [‘লোকবিশ^াস ও সংস্কার’ শিরোনামের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে :] জাদুবিশ^াস ও সংস্কার, সর্বপ্রাণবাদ, কর্মবাদ, দেবতা ও পিরের উদ্দেশে মানত, অমঙ্গল বিশ^াস, [‘আচার-অনুষ্ঠান’ শিরোনামের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে :] বিয়ের আচার-অনুষ্ঠান, সোহাগ মাগা, ফুলশয্যা, বধূবরণ, মৃতদেহ সৎকার, নৌযাত্রা সম্পর্কিত আচার, নামকরণ, আলপনা, [‘উৎসব-অনুষ্ঠান ও বিনোদন’ শিরোনামের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে :] মেলা, নৌকাবাইচ, নবান্ন উৎসব, ইন্দ্রজাল ও শারীরিক ক্রীড়া, নৃত্য, শিকার, খেলা, গান-বাজনা এবং বাদন ও বাদ্যযন্ত্র। গবেষক অত্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করে বাংলা গীতিকা থেকে উল্লিখিত বিষয়সমূহ সম্পর্কিত নানা উপকরণ তার প্রবন্ধে তুলে ধরেছেন।

‘লোকসংগীতে বাঙালির সমাজ ও সংস্কৃতি’ প্রবন্ধে লেখক পূর্বালোচিত বিষয় ছাড়াও যে বিষয়গুলো সম্পর্কে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে তথ্য উপস্থাপন করেছেন সেগুলো হলো : নারীর স্বাধীন প্রণয়াধিকার, পরকীয়া প্রেম, পালিত ছেলের সঙ্গে বিয়ে, প্রোষিথভর্ত্তৃকার আর্তনাদ, সতীত্ব, শালিকাবরণ, দেবর-ভাসুরবরণ, ধর্মান্তরিত বিয়ে, আত্মা, বরণডালা, গায়ে হলুদ, পানখিলি, থুবড়া কোটা, জলভরণ, স্নানের অনুষ্ঠান, দুধের ধার শোধ, খই ছিটানো বা সরিষা উদরানো, বর সাজানো, বর বিদায়, কনে সাজানো, কনে সম্প্রদান, বাসর যাপন, বাসি গোসল, সাধভক্ষণ, অন্নপ্রাশন, নামকরণ বা আকিকা, খতনা বা মুসলমানি, পাখি পোষা ইত্যাদি। বাঙালির সাধারণ সাংস্কৃতিক বিষয়াবলির পাশাপাশি একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য লেখক প্রবন্ধটিতে উপস্থাপন করেছেন, তা হলো নারীর স্বাধীন প্রণয়াধিকার। ‘পদ্মপুরাণের পালাগান’-এর বরাত দিয়ে লেখক জানিয়েছেন, ‘তৎকালীন সমাজে বিয়ে পুরোপুরি শাস্ত্রীয় রীতিনীতিনির্ভর ছিল না। যে কোনো পুরুষ যে কোনো নারীকে বিয়ে করতে পারত।’ (পৃষ্ঠা : ২১২)

গ্রন্থটির প্রথম ছয়টি প্রবন্ধে লেখক বাঙালির সমাজ ও সংস্কৃতির যে পরিচয় তুলে ধরেছেন কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া তা প্রায় অভিন্ন।

‘সম্ভাবনার বাংলাদেশ : ফোকলোর’ প্রবন্ধে লেখক ফোকলোর-এর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক, সামাজিক, বিদ্যায়তনিক গবেষণা, পুনঃসৃষ্টি ও সাংস্কৃতিক সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেছেন। লোকসংস্কৃতি বাংলাদেশের উদার অসাম্প্রদায়িক কল্যাণমুখী পথযাত্রায় অগ্রগতির রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করবে বলে লেখক মনে করেন। ‘বাংলাদেশে ফোকলোর চর্চা’ প্রবন্ধে বাংলাদেশে ফোকলোর চর্চায় ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক অবদানের ইতিবৃত্তকে তুলে ধরা হয়েছে। ব্যক্তি হিসেবে ধর্মযাজক রেভারেন্ড লালবিহারী দে (১৮২৪-১৮৪৯), লীলা মজুমদার, দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার (১৮৭৭-১৯৬৭), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১), দীনেশচন্দ্র সেন (১৮৬৬-১৯৩৯), চন্দ্রকুমার দে (১৮৮১-১৯৪৬), আশুতোষ চৌধুরী (১৮৮-১৯৪৪), জসীমউদ্দীন (১৯০৩-১৯৭৬), মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন (১৯০৪-১৯৮৭), আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ (১৮৬৯-১৯৫৩), ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (১৮৮৫-১৯৬৯) থেকে শুরু করে মোহাম্মদ মোর্তজা আলী, সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদসহ ফোকলোর চর্চায় অবদান রেখেছেন এমন গুরুত্বপূর্ণ প্রায় প্রত্যেকের অবদানের কথা লেখক উল্লেখ করেছেন। প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ, বাংলা একাডেমি, রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগ-এর অবদানের কথা গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। একই সঙ্গে ফোকলোর সম্পর্কিত প্রকাশিত বহুগ্রন্থের নামসহ এ সম্পর্কিত প্রাতিষ্ঠানিক একাডেমিক গবেষণার বিস্তারিত তথ্য লেখক প্রবন্ধটিতে দিয়েছেন। কিন্তু সতর্কতার অভাবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে সৈয়দ আজিজুল হকের ময়মনসিংহ গীতিকা নিয়ে এমফিল ডিগ্রি অর্জন এবং এম. ফিল-অভিসন্দর্ভের গ্রন্থরূপ ময়মনসিংহের গীতিকা : জীবনধর্ম ও কাব্যমূল্য (১৯৯০: দ্বি.সং ২০০৩) গ্রন্থ প্রকাশের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি বাদ পড়ে গেছে। ফোকলোর চর্চায় ‘ফোকলোর আর্কাইভিং’ ও ‘সম্পাদনা’ অত্যন্ত দরকারি দুটি বিষয়। বাংলাদেশে বিষয় দুটির সীমাবদ্ধতাসহ আনুষঙ্গিক সকল ক্ষেত্র সম্পর্কে বিস্তারিত আলোকপাত করা হয়েছে ‘ফোকলোর আর্কাইভিং ও সম্পাদনা’ প্রবন্ধে। প্রযুক্তি ও গণমাধ্যমের প্রচণ্ড প্রতাপে অনেক ক্ষেত্রেই দেশজ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। সকলের সুবিবেচনাবোধ কাজে লাগিয়ে পরিবর্তনের সঙ্গে ঐতিহ্যের সহ-অবস্থান নিশ্চিত করে কীভাবে পরিবর্তন ও ঐতিহ্যের সমন্বয় ঘটানো যায় সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা আছে ‘পরিবর্তনশীল বিশ^ ও বাঙালির লোকসংস্কৃতি’ প্রবন্ধে। প্রবন্ধটিতে বাউল গানসহ বাঙালি সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রের নানা মেকিপনার সমালোচনা করা হয়েছে। ‘বাংলার লোকসাহিত্য : সংক্ষিপ্ত রূপরেখা’ প্রবন্ধে লোকসাহিত্যের সংজ্ঞাসহ শ্রেণিবিভাগ নিয়ে অতিসংক্ষিপ্ত আলোকপাত করা হয়েছে। ‘বাংলার লোককহিনির দিগ্দিগন্ত’ প্রবন্ধে গবেষক লোককাহিনির শাখা-উপশাখাসহ বিভিন্ন দিকের বিশদ ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন। ছয়টি লোককাহিনি পাঠকের সামনে উপস্থাপন করে তিনি এগুলোর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্য বিশ্লেষণ করেছেন। লেখক যথার্থই বলেছেন, ‘এসব লোককাহিনিতে ধ্বনিত হয়েছে জীবনের জয়গান। বাংলার এসব লোককাহিনিতে সেকালের সমাজজীবনের ছবি যেমন পাওয়া যায়, তেমনি তাতে পাওয়া যায় মানবিকতা, নৈতিকতা ইহজাগতিকতা ইত্যাদির পরিচয়। এসব লোককাহিনিতে জাতি-ধর্ম-শ্রেণি-গোত্র ছাপিয়ে উঠেছে মানবমহিমা।’ (পৃষ্ঠা : ৩০৩) প্রবাদ ও প্রবচন বাঙালি সংস্কৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। ব্যক্তির যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতাই প্রবাদ-প্রবচনের উৎস। এগুলো মুখে মুখে রচিত হলেও বিখ্যাত বাঙালি কবি-লেখকের অনেক পঙ্ক্তিই প্রবচনের রূপ নিয়েছে। ‘বাংলা প্রবাদ ও প্রবচন’ প্রবন্ধে লেখক প্রবাদ-প্রবচনের জনপ্রিয়তার কারণ বিশ্লেষণসহ প্রবাদের উদাহরণ দিয়ে এগুলো সৃষ্টি হবার পেছনে যে লোককাহিনি প্রচলিত তা তুলে ধরেছেন। একই সঙ্গে তিনি বাংলা প্রবাদ সংগ্রহের ইতিহাস ও সংগ্রাহকদের সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। প্রবাদ সম্পর্কে লেখকের অভিমত, ‘… প্রবাদে সমাজের বিভিন্ন সম্প্রদায়, শ্রেণি ও পেশার মানুষের স্বভাব-বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তোলার পাশাপাশি মানবচরিত্রের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়েছে। সমালোচনা করা হয়েছে ত্রুটি-বিচ্যুতির। এর উদ্দেশ্য কোনো ব্যক্তি বা পেশাকে হেয় প্রতিপন্ন করা নয়; বরং সমাজজীবনে মহৎ আদর্শময় পরিবেশ সৃষ্টি।’ (পৃষ্ঠা : ৩১৭) ‘বাংলার লোকজ খেলাধুলা’ প্রবন্ধে লেখক বাংলার লোকায়ত খেলাধুলার সুপ্রাচীন ঐতিহ্যসহ বিভিন্ন প্রকার অঙ্গচালনার খেলা, জলের খেলা ও শিশুতোষ খেলার বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেছেন। ‘বাংলার লোকজীবনে খনা এক কিংবদন্তির নায়িকা।’ ‘খনা ও তাঁর বচন’ প্রবন্ধে লেখক খনার জীবন সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য উপস্থাপনসহ তার গুরুত্বপূর্ণ কিছু বচনের অর্থ ও তাৎপর্য বিশ্লেষণ করেছেন। খনার বচনগুলো বাঙালির মনোজগৎ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। শিকড়সন্ধানী মমতায় আধুনিক প্রজন্মকে এগুলো সম্পর্কে নতুন করে উজ্জীবিত করতে হবে বলে লেখক অভিমত প্রকাশ করেছেন। ‘চট্টগ্রামের লোকসাহিত্য’ প্রবন্ধে লেখক চট্টগ্রাম থেকে সংগৃহীত লোকসাহিত্যের প্রায় অনুপুঙ্খ পরিচয় তুলে ধরে তার প্রধান শ্রেণিগুলো (ছড়া, প্রবাদ-প্রবচন, ধাঁধা, লোকসংগীত, লোককথা ও লোকগীতিকা) সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। লোকসাহিত্যে সমৃদ্ধির পেছনে কাজ করেছে চট্টগ্রামের ভৌগোলিক তাৎপর্য। লেখকের ভাষায়, ‘বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অঞ্চলের রয়েছে সমৃদ্ধ ঐতিহাসিক পটভূমি। এটি বিশে^র প্রাচীন সমুদ্রবন্দর হওয়ায় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।’ (পৃষ্ঠা : ৩৩৭) ‘চট্টগ্রাম অঞ্চলের লোকখাদ্য’ একটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ প্রবন্ধ। প্রবন্ধটিতে লেখক প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে মানুষের খাদ্যসংস্থান প্রক্রিয়ার বর্ণনা দিয়ে চট্টগ্রাম অঞ্চলের লোকখাদ্যের বলা যায় একটি পরিপূর্ণ পরিচয় পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। এ বিষয়ে ইতোপূর্বে কোনও গবেষণা বা জরিপ হয়েছে বলে জানা যায় না। লেখক অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে এই অঞ্চলের ফলমূল, শাক-সবজি, বন থেকে শিকার করা বিভিন্ন পশুপাখি, জলাশয় থেকে শিকার করা বিভিন্ন মাছ, উৎপাদিত খাদ্যশস্য ইত্যাদির পরিচয় দিয়েছেন। এছাড়াও  বিভিন্ন স্তরের পরিবারের দৈনন্দিন সাধারণ খাবার, নাশতাজাতীয় খাবার, পিঠা ও উৎসব-অনুষ্ঠানে পরিবেশিত লোকখাদ্য সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। শিশুকে অমঙ্গল ও অসুস্থতা থেকে রক্ষা করার জন্য শিশুর সার্বিক শুভকামনায় লোকবিশ^াসের বশবর্তী হয়ে অভিভাবকেরা বিভিন্ন রকমের ঘুঙুর, ঘণ্টা, কবচ, তাবিজ, কড়ি, মুদ্রা ইত্যাদি গাঁথা যে কালো সুতা শিশুর গলা বা কোমরে পরিয়ে দেয় সাধারণভাবে মালার মতো দেখা যায় বলে তাকে বলা হয় ‘ঘুনসির মালা’। চট্টগ্রামের ভাষায় একেই বলা হয় ‘ঘন্টার ছরা’। শিশুকে এই ‘ঘন্টার ছরা’ পরানোর কার্যকারণ সম্পর্কিত বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে ‘ঘন্টার ছরা’ : সুতায় গাঁথা লোকবিশ^াসের মালা’ প্রবন্ধে। বিশেষভাবে চট্টগ্রাম অঞ্চলকে নিয়েই গবেষক তাঁর আলোচনা করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলেই এগুলোর কমবেশি প্রয়োগ লক্ষ করা যায়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মানদীর মাঝি উপন্যসে এই ‘ঘুনসি’র উল্লেখ আছে। ‘সাপ্তাহিক দিন ও লোকসংস্কার : চট্টগ্রামের পুথিসাহিত্যের আলোকে’ প্রবন্ধে চট্টগ্রামের পুথিসাহিত্য থেকে প্রাপ্ত তথ্যের আলোকে দিন সম্পর্কে এই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে প্রচলিত বিভিন্ন সংস্কার তথা মঙ্গল-অমঙ্গলবোধকে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এই সংস্কারগুলোর মূলে রয়েছে বৈরী প্রকৃতি ও অমঙ্গলকারী বিভিন্ন শক্তির হাত থেকে অসহায় মানুষের আত্মরক্ষার আকুতি। ঝড় জলোচ্ছ্বাস কবলিত বৈরী প্রকৃতির জন্যেই চট্টগ্রাম অঞ্চলে এগুলোর প্রচলন অধিক ছিল।

‘লোকসাহিত্য চর্চায় দীনেশচন্দ্র সেন’ প্রবন্ধে লেখক ফোকলোর চর্চায় দীনেশচন্দ্র সেনের অপরিসীম অবদানের পরিচয় তুলে ধরেছেন। লেখক যথার্থই লিখেছেন, ‘দীনেশচন্দ্র কর্মজীবনে নানাভাবে তাঁর অপরিসীম লোকসাহিত্য প্রীতির পরিচয় রেখে গেছেন। তাঁর অপরিসীম নিষ্ঠা, সাধনা ও গবেষণায় বাঙালির লোকসাহিত্য ও লোক-ঐতিহ্যের এক বিরাট দিক কেবল আবিষ্কৃত হয়নি, সেগুলো অবলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। বাঙালির ভাব ও মনোজগতে পরবর্তীকালে যে জাতীয়তাবাদী স্বদেশচেতনার বিকাশ ঘটেছিল, তার পেছনে দীনেশচন্দ্রের লোকসাহিত্য চর্চার অবদান যে কম নয়, তা-ও অকুণ্ঠভাবে বলা চলে।’ (পৃষ্ঠা : ৩৮৬) ‘বাংলা একাডেমি লোকজ সংস্কৃতি বিকাশ গ্রন্থমালা’ প্রবন্ধে লেখক বাংলা একাডেমির উদ্যোগে ২০১০-২০১১ অর্থ বছর থেকে ‘লোকজ সংস্কৃতির বিকাশ কর্মসূচি’র আওতায় বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার সামাজিক-সাংস্কৃতিক রূপান্তরের ধারায় লোকজ সংস্কৃতির পরিচয় তুলে ধরার যে কার্যক্রম গ্রহণ করা হয় তার অংশ হিসেবে প্রকাশিত ১৩টি গ্রন্থের মধ্যে ১০টি গ্রন্থ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আলোচিত গ্রন্থগুলো হলো : ময়মনসিংহ (ফেব্রুয়ারি ২০১৩), গাইবান্ধা (জুন ২০১৩), নড়াইল (জুন ২০১৩), নেত্রকোনা (জুন ২০১৩), মেহেরপুর (জুন ২০১৩), শেরপুর (জুন ২০১৩), শরীয়তপুর (ডিসেম্বর ২০১৩), মুন্সিগঞ্জ (জানুয়ারি ২০১৪), কুমিল্লা (মার্চ ২০১৪) ও রাঙামাটি (এপ্রিল ২০১৪)। মাহবুবুল হক তাঁর আলোচনায় গ্রন্থগুলোর যেমন ত্রুটি শনাক্ত করেছেন তেমনি প্রশংসাও করেছেন। ত্রুটি সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ‘গ্রন্থগুলোতে প্রদত্ত বিবরণ থেকে কিছু বিভ্রান্তি জাগতে পারে। যেমন, প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যাচ্ছে : ওপেনটি বায়োস্কোপ কেবল কুমিল্লায়, কড়ি খেলা কেবল মেহেরপুরে, ছক্কা খেলা কেবল নেত্রকোনায়, দড়িলাফ কেবল ময়মনসিংহ ও মুন্সিগঞ্জে, রস-কস ও লুডু খেলা কেবল ময়মনসিংহে, রুমাল চুরি কেবল মুন্সিগঞ্জে, লাটিম খেলা কেবল কুমিল্লা, মুন্সিগঞ্জ ও শরীয়তপুরে এবং লুকোচুরি খেলা কেবল মেহেরপুরে প্রচলিত। বাস্তবে এসব খেলা বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলেই প্রচলিত। (পৃষ্ঠা : ৪০৩) বাংলা একাডেমির এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি সম্পর্কে লেখকের প্রশংসনীয় মূল্যায়ন : ‘…বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতি চর্চার ইতিহাসে এই গ্রন্থমালা একটি বিশাল কাজ। এই কাজ আধুনিক কালের ফোকলোর চর্চার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান আকর গ্রন্থ হয়ে থাকবে। একই সঙ্গে তা লোকসংস্কৃতি ছাড়াও সামাজিক, সাংস্কৃতিক, নৃতাত্ত্বিক গবেষণাসহ নানা বিদ্যাশাখায়ও আকর গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হবে।’ (পৃষ্ঠা : ৪০৮)

৪.

গ্রন্থটির প্রচ্ছদ ও অঙ্গসজ্জা সুন্দর। বইটিতে মুদ্রণ প্রমাদ অপেক্ষাকৃত কম। তবু কিছু ত্রুটিবিচ্যুতি আমাদের নজরে পড়েছে। ৪২ নম্বর পৃষ্ঠায় প্রবাদের প্রথম উদাহরণ ‘অনেক দুর্ভাগ্য যার ঘরে নাই মা।’-এর বামে কোনও সংখ্যা চিহ্ন না দিয়েই পরের তিনটিতে যথাক্রমে ১, ২ ও ৩ সংখ্যা দেওয়া হয়েছে। উদাহরণ চারটির পাশে যথাক্রমে সংখ্যাগুলো হবে ১, ২, ৩ ও ৪। ৪৪ নম্বর পৃষ্ঠার ৩ নম্বর প্রবাদটিতে আছে, ‘মামা ভাগনে যেখানে, আপন নেই সেখানে।’ সম্ভবত হবে ‘মামা ভাগনে যেখানে, আপদ নেই সেখানে।’ প্রবাদটি ফরিদপুর অঞ্চলে এভাবেই প্রচলিত। ৪৯ নম্বর পৃষ্ঠার দ্বিতীয় উদাহরণে দুটি প্রবাদেই পাশে সংখ্যা চিহ্ন ১ ব্যবহার করা হয়েছে। হবে যথাক্রমে ১ ও ২। ৫৩ নম্বর পৃষ্ঠায় একটি প্রবাদ উল্লেখ করা হয়েছে, ‘ষোল চাষে মুলা, তার অধিক তুলা।’ প্রবাদটি মূলত খনার বচন। বচনটি এমন ‘ষোল চাষে মুলা, তার অর্ধেক তুলা/তার অর্ধেক ধান, বিনা চাষে পান।’ ৬৭ নম্বর পৃষ্ঠার দ্বিতীয় প্যারার প্রথম লাইনে আছে ‘…বাঙালি সমাজের অন্তনির্গত বিভিন্ন শ্রেণি,…’ হবে ‘…বাঙালি সমাজের অন্তর্গত বিভিন্ন শ্রেণি, …’। ৭৩ নম্বর পৃষ্ঠায় একটি প্রবাদ উল্লেখ করা হয়েছে ‘যার নাই পির, বার নাই শির।’ সম্ভবত হবে ‘যার নাই পির, তার নাই শির।’ ৮৫ পৃষ্ঠায় একটি ধাঁধার উত্তর লেখা আছে ‘[ঘোড়ার পাড়ি]’ হবে ‘[ঘোড়ার গাড়ি]’। ১১৮ নম্বর পৃষ্ঠার ১৯ নম্বর লাইনে আছে, ‘… ন’রানি জল তোলেন, করে রানি…’। ‘করে রানি’র অর্থ অস্পষ্ট। ১২৮ নম্বর পৃষ্ঠায় ‘মলুয়া’ থেকে দেওয়া উদ্ধৃতির সঙ্গেই একই ফন্টে লেখা আছে, ‘বিত্তবানের ঘরের দুয়ারে হাতি বাঁধা থাকত।’ বাক্যটি উদ্ধৃতির সঙ্গে নয় পরের স্তবকের সঙ্গে হবে। ১৩৫ নম্বর পৃষ্ঠার শেষ থেকে তৃতীয় লাইনের শেষে আছে ‘আয়না বিবি গীতিকায়’… হবে ‘আয়না বিবি গীতিকায়’। ২৭৪ নম্বর পৃষ্ঠায় আছে ‘…পূর্ণচন্দ্র বিদ্যাবিনোদ সংগৃহীত বাইদ্যানীর গান-এর (সংগ্রহ: ১৯৫২, গ্রন্থাকারে প্রকাশ: ১৯৪৪)…’। গ্রন্থাকারে প্রকাশের সাল ভুল আছে। সংগ্রহের আগে প্রকাশ কী করে হবে! ২৮০ নম্বর পৃষ্ঠার শেষ বাক্যটি ‘তাকে বিবেচনা করতে বিনোদনমূলক আগ্রহ মেটানোর দেশজ উপাদান বলে।’ অসংগতিমূলক। বাক্যটি হতে পারে ‘তাকে বিবেচনা করতে হবে বিনোদনমূলক আগ্রহ মেটানোর দেশজ উপাদান বলে।’ ২৮৪ নম্বর পৃষ্ঠায় শেষ লাইনে আছে, ‘চলবে না।’ হবে ‘চলবে না।’ মাঝে স্পেস কম হবে। ২৯১ পৃষ্ঠার শেষ স্তবকের প্রথম লাইনে আছে ‘ভাটিয়াল দেখে ছিল এক সওদাগর।’ হবে ‘ভাটিয়াল দেশে ছিল এক সওদাগর।’ ৩০৭ নম্বর পৃষ্ঠার দ্বিতীয় প্রবাদটি আছে, ‘ইল্লত যায় না ধুলে স্বভাব যায় না মলে।’ সম্ভবত হবে ‘ইজ্জত যায় না ধুলে স্বভাব যায় না মলে।’ ফরিদপুর অঞ্চলে প্রবাদটি এভাবেই প্রচলিত। ৩৩০ নম্বর পৃষ্ঠার শেষ লাইনে আছে, ‘… মৌসুমি বাযু বইলে…’ হবে ‘… মৌসুমি বায়ু বইলে…’। ৩৫১ নম্বর পৃষ্ঠার ১৩ নম্বর লাইনে আছে ‘(নাড়)’, হবে ‘(নাড়ু)’। ৩৫৪ নম্বর পৃষ্ঠার প্রথম লাইনের সঙ্গে আছে ‘আরাকানি খাদ্যের প্রভাব’…। ‘আরাকানি খাদ্যের প্রভাব’ অংশটুকু উপশিরোনাম হিসেবে লাইনের উপরে যাবে। ৩৬০ নম্বর পৃষ্ঠার দ্বিতীয় প্যারার ষষ্ঠ লাইনের ‘বিতারণের’ স্থলে ‘বিতাড়নের’ হবে। ৩৭১ নম্বর পৃষ্ঠার দ্বিতীয় লাইনে আছে, ‘বৃক্ষ ঘদি…’ সম্ভবত হবে ‘বৃক্ষ যদি…’। ৪০০ নম্বর পৃষ্ঠার শেষ থেকে তৃতীয় লাইনে আছে, ‘লোকদর্মকেন্দ্রিক…’। হবে ‘লোকধর্মকেন্দ্রিক…’। একই পৃষ্ঠায় এর পরের লাইলে আছে ‘আম্রমকেন্দ্রিক’, হবে ‘আশ্রমকেন্দ্রিক’। পরবর্তী সংস্করণে ভুলগুলো সংশোধন করা হলে গ্রন্থটির মর্যাদা আরও বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা যায়।

৫.

ভূমিকায় প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ধারণা করা যায় গ্রন্থটির প্রবন্ধসমূহ মোটামুটিভাবে ১৯৯৯ সাল থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে রচিত। সব প্রবন্ধ সুপরিকল্পিতভাবে এই গ্রন্থটির জন্য রচিত হয়নি। গ্রন্থটি বলা যায় লেখকের বাংলার লোকসংস্কৃতি : সমাজ ও সাহিত্য বইয়ের পরিমার্জিত, পরিবর্ধিত ও পরিবর্তিত সংস্করণ। একটি বিশেষ পরিকল্পনাকে সামনে রেখে সুনির্দিষ্টভাবে কোনও গ্রন্থ রচনার জন্য রচিত হয়নি বলে প্রবন্ধগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও সামগ্রিকভাবে সকল প্রবন্ধ সমমানের নয়। ফোকলোর সম্পর্কিত তাৎপর্যপূর্ণ প্রায় সকল বিষয়কে একটি গ্রন্থে ধারণ করতে গিয়ে বিষয়বিন্যাস কিছুটা হলেও শিথিল হয়েছে। বিষয়গুলো নিয়ে একাধিক পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ রচিত হতে পারে। 

৬.

মাহবুবুল হকের লোকসংস্কৃতি চর্চা বাংলাদেশের ফোকলোর চর্চার সামগ্রিক অগ্রগতির স্মরণীয় স্মারক।  গ্রন্থটি এক অর্থে লোকসংস্কৃতি চর্চার একটি পূর্ণাঙ্গ পাঠ। দ্বিধাহীনভাবেই বলা যায় শুধু ফোকলোর নয়, বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তির অনুশীলনেও লোকসংস্কৃতি চর্চা এক অনন্য সংযোজন। গ্রন্থটির বহুল প্রচার বাঙালির মনন ঋদ্ধির সহায়ক হবে। এমন একটি গ্রন্থ প্রকাশ করার জন্য আগামী প্রকাশনীকে সাধুবাদ জানাই। গবেষক মাহবুবুল হকের সর্বৈব কল্যাণ কামনা করি।

লেখক : অধ্যাপক, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ^বিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button