অনুবাদ গল্পআর্কাইভবিশ্বসাহিত্য

অসীম জীবন : ইসাবেল আইয়েন্দে

বিশ্বসাহিত্য : অনুবাদ গল্প

স্প্যানিশ থেকে বাংলা অনুবাদ : জয়া চৌধুরী

[ইসাবেল আইয়েন্দে (Isabel Allende) নাম সম্পর্কে বাঙালি পাঠক যথেষ্ট ওয়াকিফহাল। চিলির সালভাদোর আইয়েন্দের ভাইঝি ইসাবেল অসংখ্য বইয়ের লেখক এবং পাঠক ও সমালোচক উভয় মহলেই অত্যন্ত সমাদৃত। গারসিয়া মারকেসের ম্যাজিক রিয়ালিস্টিক ধারার সবচেয়ে সফল উত্তরসূরী হিসাবে পরিচিত।]

সব ধরনের গল্প পাওয়া যায়। কেউ কেউ গল্প হয়ে ওঠার জন্যই জন্মায়। তাদের সার বস্তুটি হলো ভাষা। কোনও আবেগ, বা মনের এক টুকরো কোনও ছলনা, কোনও কল্পনা বা অস্পর্শযোগ্য কোনও স্মৃতি কেউ তাদের ভাষায় প্রকাশ করে দেবার আগেই সেগুলো গল্পে পরিণত হয়। অন্যেরা আসে পরিপূর্ণ হয়ে, ঠিক যেমন আপেল। কোনও ঝুঁকি ছাড়াই, অর্থ বদলানোর ঝুঁকি না নিয়েই অনন্তকাল তারা পুনরাবৃত্ত হয়। কাউকে বাস্তব থেকেই পাওয়া যায়। তারা উঠে আসে কোন উৎসাহের ফলে তৈরি হয়ে।

কিন্তু বাকিরা কোনও উৎসাহের মুহূর্তে সৃষ্টি হয় এবং পরে বাস্তবে পরিণত হয় যাতে তাদের নিয়ে আমরা গল্প করতে পারি। গোপন গল্পেরাও থাকে যারা স্মৃতির পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকে। তারা যেন জীবন্ত অঙ্গ। শিকড়, কর্ষিকা বের করে যায় তারা। অনুগত পারিষদ আর ছত্রাকে ভরপুর থাকে আর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়। আবার মাঝে মধ্যে স্মৃতির ভূতগুলোকে ঝাড়বার জন্যও কোনও কোনও গপ্পোকথারা এভাবে গল্প করে।

আনা আর রোবের্তো ব্লাউম এক সঙ্গে বুড়ো হয়েছিলেন। তারা এমনই একসঙ্গে থাকতেন যে লোকে তাদের ভাইবোন বলে ভাবত। কোনও কিছু দেখে দুজনে একই রকম সদাশয়ভাবে হাসতেন। দুজনের গায়ের চামড়াই একইরকম কুঁচকে গেছিল। তাদের হাত নাড়ানোর ভঙ্গি, কাঁধদুটো একসঙ্গে ঝাঁকানোর ভঙ্গি এক ছিল। দুজনের একরকম চাওয়া, এক চালচলনের জন্য খ্যাতি ছিল। জীবনের বেশির ভাগটাই তারা দিনের অধিকাংশ সময় একসঙ্গে কাটাতেন। এমন হাত ধরাধরি করে হাঁটা, জড়াজড়ি করে এমনভাবে শোয়া দুজনের এক স্বপ্ন দেখার সম্ভাবনা নিশ্চিত করত। আধ শতাব্দী আগে হওয়া আলাপের পর থেকে ওঁরা কখনও আলাদা থাকেননি। সেসব দিনে রোবের্তো ডাক্তারি পড়তেন। আর ততদিনে আনার অস্তিত্ব নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল তাঁর প্যাশন যে তিনি গোটা পৃথিবীকে ধুয়ে দেবেন। আনা তরুণদের দলের একজন ছিলেন যার ক্ষমতা ছিল অকপটতার সঙ্গে সব সুন্দর করে ফেলার। সঙ্গীতের মাধ্যমে সে জিনিষ আবিষ্কার করেছিল তরুণের দল। আনা ছিলেন চেম্বার অফ অর্কেস্ট্রার এক বেহালাবাদক। প্রতিভাশালী পরিবার থেকে আসার কারণে রোবের্তো পিয়ানো বাজাতে পছন্দ করতেন। কোনও কনসার্ট পারতপক্ষে হাতছাড়া করতেন না। মঞ্চের ওপর যে মেয়েটা কালো ভেলভেটের পোশাক পরে বসে কাঁধে যন্ত্র নিয়ে চোখ বুজে বাজাচ্ছে, তাকে দূর থেকে দেখামাত্রই তার প্রেমে পড়ে গেছিলেন। তাকে বলে ওঠার সাহস জোগাড় করতে বেশ কয়েক মাস কাটিয়ে দিয়েছিলেন, আর যখন ওঁরা দেখা করে এ কথা মেয়েটার সামনে বললেন সে ছিল চারটে মাত্র শব্দ। আর তাতেই ওঁরা বুঝে গেছিলেন যে নিখুঁত মননের জন্য তারা নিয়তি নির্দিষ্ট। বিয়ে পর্যন্ত পৌঁছনোর আগেই যুদ্ধ এসে তাদের অবাক করে দিয়েছিল। হাজার হাজার ইহুদি নিপীড়িত হবার আশঙ্কায় ভুগছিল। তাই তাদের ইউরোপে পালিয়ে যেতে হলো। হল্যান্ডের এক বন্দরে এসে নামলেন তাঁরা। সঙ্গে কেবল পরনের কিছু জামাকাপড়, রোবের্তোর কিছু বই আর আনার বেহালাটা ছাড়া কিচ্ছু না। দুবছর ধরে তিনি জাহাজ করে ভেসেছিলেন। কোনও জেটিতেই থামবার মতো আকর্ষণীয় কিছু পাননি। কেননা পৃথিবীর সেই গোলার্ধের দেশগুলোর কোনওটাই তাদের উদ্বাস্তু হিসাবে নিতে চায়নি। অনেকগুলো সমুদ্রে চরকি পাক খাবার পরে শেষে ওঁরা কারিব দ্বীপে পৌঁছলেন। জাহাজের মাথায় তখন শ্যাওলা খোলের ফুলের মতো বর্ম। ভেতরকার শ্যাওলাগুলোয় নাছোড় প্রতিধ্বনিত হত স্যাঁতস্যাঁতে ভাব। তার যন্ত্রগুলো সব সবুজ হয়ে গেছিল। আনা আর রোবের্তো ছাড়া জাহাজের সব কর্মচারী ও যাত্রীরা ছিল ভালোবাসার ধারণার বেজায় বেপরোয়া সমর্থক। দুশো বছরের প্রাচীন হতেও রাজি ছিল তারা। কিন্তু জাহাজের ক্যাপ্টেন অনন্তকাল ধরে নিরাশ্রয় হয়ে অতলান্তিক সমুদ্রে জাহাজ চালাতে রাজি ছিলেন না। তিনি দ্বীপের বাঁকে স্টিয়ারিং যন্ত্রটি নিয়ে ফসফরাসের মতো জ্বলজ্বল করতে থাকা বালির সামনে পাহাড়ের গায়ে তালগাছের সারির সামনে এসে জাহাজ থামালেন। যাতে করে নাবিকেরা নেমে বাকিদের জন্য মিষ্টি পেয় জল নিয়ে আসে। কিন্তু ততদূর কেউই পৌঁছতে পারেনি। পরদিন ভোরে যন্ত্রটাকে চালানো অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল। ভালো ভালো যন্ত্রপাতির অভাবে ধুলা নুন মাখা জলে নড়ার শক্তি চলে গিয়েছিল চাকার। জ্বালানির তেল ফুরিয়ে যাওয়াতে জারিত হয়ে গিয়েছিল। মাঝ-সকাল বরাবর সবচেয়ে কাছের বন্দর কর্তৃপক্ষের লোকেরা নৌকা করে এসে হাজির। বোতাম খোলা ইউনিফর্ম পরা সহৃদয় কয়েকজন মুলাতো (সাদা কালো মিশ্র রক্তের মানুষদের মুলাতো বলা হয়) মানুষ তারা। নিয়ম মাফিক তাদের নিজেদের জলসীমার মধ্যে ছিল তারা। কিন্তু নাবিকদের এই বিপদের খবর পেয়ে আদেশ পালন করতে এল। জাহাজটার শোচনীয় অবস্থা দেখে ক্যাপ্টেন তাদের কদিন সেখানে থেকে যেতে বললেন। বরাবর যেমন করে সেরকমই যাতে এর মধ্যে তারা সারিয়ে ফেলতে পারে সেটা। জাহাজের হতভাগ্য যাত্রীরা সারারাত ধরে নৌকা করে নেমে যায় জাহাজ থেকে। সে দেশের গরম বালির ওপর হাঁটে যে দেশটার নাম পর্যন্ত তারা উচ্চারণ করতে পারছিল না। তারপর তাদের দাড়ি কাটার ইচ্ছে নিয়ে, তাদের ছাতাপরা পরনের পোশাক খুলে ফেলার ইচ্ছে নিয়ে, আর সমুদ্র থেকে ভেসে আসা যে বাতাস তাদের বুক শক্ত করে দিচ্ছিল তা ঝেড়ে ফেলার জন্য সে দেশের ঘন সবুজ অরণ্যে হারিয়ে যায় তারা।

আনা আর রোবের্তোর অভিবাসী জীবন এভাবেই শুরু হয়েছিল। টিকে থাকার জন্য প্রথমে শ্রমিকের কাজ করা। পরে যখন ওঁরা শিখে গেলেন এই পরিবর্তনশীল সমাজটার নিয়ম কানুন, শিকড় গেঁড়ে বসলেন। এবং রোবের্তো যুদ্ধের জন্য বাধা পেতে পেতে অবশেষে তাঁর ডাক্তারি পড়াটা শেষ করলেন। ওঁরা কফি আর কলা খেতেন। আর পেনশনের সামান্য টাকায় জীবন ধারণ করতেন। আর একটা অভাবের চিহ্ন মাখা একটা বাড়িতে বসবাস করতেন, যার জানলা দিয়ে রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলো আসত। তাতেই তারা কাজ সারতেন। ওই আলোতেই রোবের্তো তার পড়াশুনা চালাতেন আর আনা সেলাই। কাজ শেষ হয়ে গেলে বসে প্রতিবেশির ছাদের ওপর ওঠা আকাশের তারাদের দেখতেন। আনা বেহালায় পুরোনো গানের সুর তুলতেন। ব্যাপারটা ওরা দিন শেষ করার অভ্যাস হিসাবে নিয়ে নিয়েছিলেন। অনেক বছর পরে ব্লাউমদের নাম যখন খুব বিখ্যাত হয়ে গেছিল এইসব দিনগুলো তাঁরা বইয়ের ভূমিকায় কিংবা সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে রোম্যান্টিক স্মৃতির মতো উল্লেখ করতেন। ওঁদের ভাগ্য বদলে গিয়েছিল, কিন্তু নিজেদের জীবনযাত্রা একই রকম সাদামাটা রেখেছিলেন। কেননা ওঁরা দুঃখের ছাপগুলোকে মুছতে পারেননি, অথবা নির্বাসনের অনিশ্চয়তার দিনগুলোর অনুভূতি থেকে মুক্তই হতে পারেনি। ওঁদের দুজনের গঠন একই রকম ছিল, চোখের তারা ছিল ঝকঝকে আর হাড়গোড় শক্তপোক্ত। রোবের্তোকে ঋষির মতো দেখতে ছিল। অবিন্যস্ত লম্বা চুল তার কানের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত। কুমীরের খোলের মতো দাগ বসানো পুরু কাচের চশমা পরা। সব সময় ধুসর কোট পরতেন। যেটা ছিঁড়তে ছিঁড়তে অবশেষে আনা কাফ সেলাই করা থেকে হাত তুলে নিতেন তখন আবার অন্য একটা তার জায়গা নিত। হাতে থাকত ভারত থেকে এক বন্ধুর এনে দেওয়া একটা লাঠি। স্বল্পভাষী ছিলেন তিনি। বাকিদের মতো করেই কথা বলতেন, তবে মজার মোড়কে বলতেন যাতে তার কথার ভার একটু নরম হালকা হয়ে যায়। তার ছাত্রদের তাঁকে সবার চেয়ে সেরা শিক্ষক হিসাবে মনে রাখতেই হত। আনার স্বভাব ছিল হাসিখুশি, বিশ্বস্ত। খারাপ কিছু দূরতম কল্পনা করাও ওঁর পক্ষে অসম্ভব ছিল, আর তাই ফলস্বরূপ সেসব ওঁর কাছও ঘেঁষত না। রোবের্তো জানতেন যে স্ত্রীর বাস্তব বুদ্ধি বেশ প্রশংসাজনক। প্রথম থেকে সেজন্য সিদ্ধান্ত নেবার দায়িত্ব আর টাকা পয়সা সামলানোর ভার তাঁর ওপরেই ছেড়ে দিয়েছিলেন। আনা ওঁর স্বামীকে মায়ের মতো সামলাতেন। তাঁর নখ চুল কেটে দিতেন, খাবার ঘুম স্বাস্থ্যের ওপর খেয়াল রাখতেন, সব সময় স্বামীর এক ডাকের দূরত্বে থাকতেন। একে অন্যর কাছে এতটাই অপরিহার্য ছিলেন যে বাড়ি সামলানোর জন্য আনা তাঁর বাজনার কেরিয়ার ছেড়ে দিয়েছিলেন। কারণ এই কেরিয়ারের জন্য তাঁকে বাড়ি ছেড়ে ঘনঘন ঘুরতে হত। আর রোবের্তোর সঙ্গে রাতের বেলায় মর্গে যাওয়া কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে যাওয়ার অভ্যেস গড়ে তুলেছিলেন তিনি, যেখানে রোবের্তো ঘন্টার পর ঘন্টা গবেষণায় কাটাতেন। ওঁরা রাত দুটোর নিস্তব্ধতা আর বন্ধ বাড়িগুলোর নিঃশব্দতা উপভোগ করতেন।

তারপর ফাঁকা রাস্তা দিয়ে ওঁরা ফিরতেন গরিব লোকেদের এলাকার দিকে যেখানে ওঁদের বাড়ি ছিল। শহরের নিয়ন্ত্রণহীন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ওই এলাকাটাও চোর, পকেটমার আর বেশ্যাতে পূর্ণ হয়ে উঠছিল, যেখানে পুলিশের গাড়িও টহল দেবার সাহস করত না, কিন্তু ওঁরা ভোরবেলায় সে জায়গা পার হতেন পায়ে হেঁটে, কিচ্ছু হত না তাঁদের। সবাই ওঁদের চিনত। এলাকার কোনও অসুখই রোবের্তোর কাছে নিরাময়ের জন্য না এসে থাকত না বা এলাকার কোনও শিশুই আনার হাতের বিস্কুট না পেয়ে বড় হত না। এলাকার লোকজনের কাছে বহিরাগতদের ব্যাখ্যা শুনতে হত যে কেন এই বৃদ্ধ দম্পতিকে কেউ বিরক্ত করে না। তারা একমত ছিল যে ব্লাউমরা জাতির গর্ব ছিলেন। এতটাই যে রাষ্ট্রপতি স্বয়ং নিজের হাতে এলাকার সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি হিসাবে ওঁদের সংবর্ধিত করেন। এমনকি যুদ্ধের সময় যখন সেনারা একটার পর একটা বাড়ি অস্ত্র দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল তখনও তারা কেউ এঁদের বিরক্ত করেনি।

সত্তর দশকের শেষ দিকে আমার ধর্ম-মা যখন পাগলামি করে নিজের ঘাড় ব্লেড দিয়ে চিরে দেয়, তাকে হাসপাতালে নেবার সময় আমি ওঁদের প্রথম বার দেখি। গলগল করে রক্ত বের হতে থাকলে আমি তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। তখন কেউই সত্যি সত্যি ধর্ম-মায়ের প্রাণের আশা করছিল না, কিন্তু ভাগ্যক্রমে রোবের্তো ব্লাউম সেখানে ছিলেন আর ধীরে ধীরে ঠান্ডা মাথায় মাথাটাকে জুড়ে সেলাই করে দিলেন। অন্য সব ডাক্তারদের অবাক করে দিয়ে আমার ধর্ম-মা ক্রমে সেরে উঠল। যখন তড়কা লাগত সে সব দিনগুলোয় সপ্তাহের পর সপ্তাহ তার বিছানার পাশে আমায় কাটাতে হয়েছিল। তখন রোবের্তোর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল বেশ কয়েকবার। ক্রমশ আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। ব্লাউমদের কোনও সন্তান ছিল না আর আমার বিশ্বাস এর জন্য তাঁদের মনে একটা শূন্যতা ছিল। কারণ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা আমার চিকিৎসার জন্যও আসতেন সে রকম কিছু ভেবেই। তাঁদের প্রায়ই দেখতাম, যাতে আশেপাশে একা না বের হই সেজন্য কখনও কখনও রাতের বেলায়ও আসতেন। কোনও বিশেষ পদ খাবার জন্য আমায় দুপুরের ভোজে নিমন্ত্রণ করতেন মাঝে সাঝে। রোবের্তোকে বাগানের কাজে আর আনাকে রান্নাঘরের কাজে সাহায্য করার জন্য হাত লাগাতে আমার খুব ভালো লাগত। কখনও কখনও আনা কাঁধে ওঁর বেহালা তুলে নিতেন আর কয়েকঘন্টা সঙ্গীতময় সন্ধ্যা উপহার দিতেন আমায়। বাড়ির চাবিটাও আমায় দিয়ে রেখেছিলেন। যখন বেড়াতে যেতেন সে সময় আমি ওদের কুকুর পাহারা দিতাম, গাছে জল দিতাম।

যুদ্ধের ফলে ক’বছর দেরি হয়ে গেলেও রোবের্তো ব্লাউমের কেরিয়ারের সাফল্য তুলনামূলকভাবে তাড়াতাড়িই শুরু হয়েছিল। যে বয়সে অন্য ডাক্তারেরা অপারেশনের কাজ শিখতে শুরু করে সে সময় ওঁর সমৃদ্ধ কয়েকটি লেখা প্রকাশিত হতে শুরু করে। কিন্তু ‘শান্তিপূর্ণ এক মৃত্যু-র অধিকার’ বইটি প্রকাশের পর থেকে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে থাকে। প্রতিবেশি বা বন্ধুর চিকিৎসার সময় ছাড়া উনি কখনওই লোভে পড়ে প্রাইভেট চিকিৎসা করতেন না। হাসপাতালে যেখানে প্রত্যেক দিন অনেক মানুষের চিকিৎসা করা সম্ভব, আর প্রত্যেক দিনই নতুন কিছু শেখার অবকাশ আছে সেইখানে অনামা মানুষের চিকিৎসার কাজটিই মন দিয়ে করতেন। মৃতদের সঙ্গে ঘন্টার পর ঘন্টা ওইসব প্যাভিলিয়নে কাটানোর ফলে তিনি সেসব জরাজীর্ণ শরীর যেখানে প্রাণটুকু কোনও মতে খাঁচায় আটকে আছে তাঁদের জীবনকে যন্ত্রের মাধ্যমে পাল্টে দেবার জন্য সুতীব্র আবেগ অনুভব করতেন। যে কোনও উপায়ে তাঁদের প্রাণটুকু বাঁচিয়ে রাখতে হবে, সে জন্য বিজ্ঞান যাদের শেষ সম্মানটুকু দেবার ইচ্ছাকেও অস্বীকার করেছে তিনি তাদের ওইসব সূচ পাইপ ইত্যাদি দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করতেন শেষ পর্যন্ত। এ পৃথিবীতে কোনও রকম সাহায্য না করে, যত্ন না করে ফেলে দিতে তাঁর যন্ত্রণা হত। বরং আর একটু বাঁচিয়ে রাখার জন্য সেসব রোগীর মৃত্যুশয্যায় তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধেও বাঁচাতে তিনি প্রাণপণ চেষ্টা করতেন। কখনও কখনও এই সব রোগীর ভয়ংকর যন্ত্রণা তাঁর কাছে অসহনীয় হয়ে উঠত, যে এক মুহূর্তের জন্যও তাদের মন থেকে সরিয়ে রাখতে পারতেন না তিনি। আনাকে তখন তাঁকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলতেই হত, কারণ ঘুমের মধ্যে চিৎকার করে উঠতেন তিনি। চাদরের আশ্রয়ে তিনি তখন স্ত্রীর বুকে মুখ গুঁজতেন, হতাশ। কেন তুমি এইসব নল টল খুলে রেহাই দাও না, যখন দেখছ বেচারি কত কষ্ট পাচ্ছে ? ওর প্রতি সবচেয়ে বেশি করুণা তুমি এভাবেই করতে পার। ও তো এমনি বা ওমনি কোনওভাবেই তো বাঁচবে না আর, কিছু আগে বা কিছু পরে এই যা…

পারব না আনা, আইন খুব পরিষ্কার এ ব্যাপারে। অন্যের জীবনের ওপর কারও অধিকার থাকে না, তবে আমার ক্ষেত্রে বিষয়টা বিবেকের ব্যাপার।

এরকম আমরা আগেও ভুগেছি। প্রতিবার তুমি এই এক ঘটনা ঘটাও। কেউ জানবে না এটা কেবল কয়েক মিনিটের ব্যাপার।

কোনও বার যদি রোবের্তো এরকম করেও থাকতেন কেবলমাত্র আনাই একথা জানতেন।

ওঁর বইয়ে তিনি প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে এই অকেজো খোলসটাকে ত্যাগ করার জন্য মৃত্যু তার সমস্ত প্রাচীন আতংক নিয়েও হবে একমাত্র রেহাই। কেননা আত্মা তার এই মহাবিশ্বের সবটুকু শক্তি নিয়ে এইখানে ফিরে আসে। জন্মের মতোই এই যন্ত্রণা একটা যাত্রাপথের অংশ মাত্র। তারও তো একই করুণা প্রাপ্য। স্বাভাবিক মৃত্যুর বাইরে হওয়া একটা শরীরের প্রতিটি ধাক্কা ও কাঁপুনিকে দীর্ঘায়িত করা কম গুণের নয়। মৃত্যুর এই তথাকথিত ব্যুরোক্রেসির জন্য অপেক্ষা করার চাইতে ডাক্তারদের উচিৎ পরিশ্রম দিয়ে এ কাম্য মৃত্যুকে এগিয়ে আনা। কিন্তু সেই মৃত্যু যেন কেবল আত্মীয়দের করুণা কিংবা ডাক্তারের সূক্ষ্ম বিচারের ওপর নির্ভর না হয়। আইন যাতে নিশ্চিত একটি মানদণ্ড ঠিক করেন তার প্রয়োজন।

ব্লাউমের এই প্রস্তাব পুরোহিত, ডাক্তার আর উকিলদের মধ্যে তুমুল মতান্তর এনে দিল। দ্রুত বিষয়টি বিজ্ঞানীদের গণ্ডির বাইরে রাস্তায় বিভিন্ন মুখে মুখে বিতর্ক ছড়িয়ে দিল। এই বিষয় নিয়ে কেউ প্রথমবার কোনও কথা বলল। তখনও পর্যন্ত মৃত্যু ছিল নীরব কোনও বিষয়। প্রত্যেকের ভেতরে যে লুকোনো অমরত্বের বাসনা থাকে সেইখানে সেটাকে অমরত্বে নিয়ে যাওয়া হয়। যে সময় লোকেরা বিষয়টার দার্শনিক ব্যাখ্যায় মগ্ন থাকছিল রোবের্তো ওটা নিয়ে সমস্ত জায়গায় সওয়াল করছেন। কিন্তু যখন সেটা আম-জনতার হাসির খোরাক হয়ে গেল, তাঁর ভাবনাটির বাণিজ্যকরণের দিকে ঝুঁকে গেল তিনি কাজের ভেতর আশ্রয় নিলেন। মৃত্যু তখন প্রথম প্ল্যানিং-এ চলে গেল, বাস্তবের সব কিছু থেকে সরে গিয়ে একটি আনন্দময় ফ্যাশনে পরিণত হলো।

সংবাদমাধ্যমের একাংশ রোবের্তোকে দুষতে লাগল তিনি ইউথ্যানশিয়া বা স্বেচ্ছামৃত্যুকে উৎসাহ দিচ্ছেন। তারা এটাকে নাৎসিদের কাজকর্মের সঙ্গে তুলনা করতে লাগল। আবার সেসময় আর এক দল লোক তাঁকে দেবদূত বলে ভাবতে শুরু করল। তিনি এসব আলোড়নকে আমল না দিয়ে তাঁর গবেষণা চালিয়ে যেতে লাগলেন, এবং সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে শ্রম দিতে থাকলেন। বইটি বহু ভাষায় অনূদিত হতে শুরু করল। ছড়িয়ে পড়তে লাগল অন্যান্য দেশগুলোতেও যেখানে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করল এই বই। বিজ্ঞানের জার্নালগুলোতে ঘনঘন তাঁর ছবি প্রকাশ হতে লাগল। এই বছরেই একটি মেডিক্যাল বিদ্যালয় তাঁদের শিক্ষা বিভাগের অধ্যাপক হবার প্রস্তাবনা দিল। শিগগিরি তিনি ছাত্রছাত্রীদের কাছে সবচেয়ে চাহিদার অধ্যাপক হয়ে উঠলেন। রোবের্তো ব্লাউমের ভেতরে ঔদ্ধত্যের ছিটেফোঁটাও দেখা গেল না। এই দ্রুত সেলিব্রিটি স্ট্যাটাস এর ফল হলো এই যে উনি এতে ভয় পেয়ে গেলেন। এবং তাঁর অতি ঘনিষ্ঠ মহলের কাছে সেকথা বলেও ফেললেন।

রোবের্তো-তত্ত্ব যে দ্রুততায় ফ্যাশনের শীর্ষে উঠেছিল ততই দ্রুত বিস্মৃতির অতলে চলে গেল। আইন বদলালো না। মার্কিন কংগ্রেসে সে নিয়ে আলোচনা পর্যন্ত হলো না কিন্তু বিদ্বান ও বিজ্ঞান মহলে এ নিয়ে আলোচনা বাড়তে লাগল। পরের ত্রিশ বছরে ব্লাউম বহু প্রজন্মের সার্জেন গড়লেন, নতুন নতুন ওষুধ আবিষ্কার করলেন, সার্জারির নতুন নতুন রীতি পদ্ধতি আবিষ্কার করলেন, মোবাইল চিকিৎসা ব্যবস্থা তৈরি করলেন, রেলের ওয়াগন, জাহাজ, এরোপ্লেন ইত্যাদিতে জন্ম দেওয়া থেকে মহামারীর মোকাবেলা করা পর্যন্ত সব রকম চিকিৎসা পাবার ব্যবস্থা করলেন। সেসব রাষ্ট্রীয় সীমার কেন্দ্র থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত তা ছড়িয়ে দিলেন যেখানে এতদিন পর্যন্ত কেবল মিশনারিরাই যেতেন। অসংখ্য পুরষ্কার পেলেন, এক দশক ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টর হয়ে রইলেন, দু সপ্তাহের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রী হলেন। সে সময়টা জুড়ে শাসনতন্ত্রের দুর্নীতি আর তহবিল তছরুপেরর সাক্ষ্য জোগাড়ে ব্যস্ত রইলেন, এবং সেসব রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করলেন, যিনি সেসবই বাতিল করার বেশি কিছু করলেন না। কারণ তিনি কিছুতেই চাননি কোনও আদর্শবাদীর জন্য সরকারের ভিত ধরে নাড়া দিতে। এই সব দশক জুড়ে ব্লাউম মৃতপ্রায়মানুষদের নিয়ে তাঁর গবেষণা বন্ধ করেননি। মৃত্যু আসন্নপ্রায় ব্যক্তির সামনে ‘সত্য’টা প্রকাশ করবার সপক্ষে বহু প্রবন্ধ প্রকাশ করেছেন, যাতে করে তারা যখন মৃত্যুকে দেখে তখন যেন চমকে না যায়, আর আত্মহত্যার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে নিজের অকর্মণ্য জীবনকে যন্ত্রণাহীন শেষ করার জন্য তারা নিজেদের মনকে প্রস্তুত করার জন্য সময় নেন।

ব্লাউমের শেষ বইটা প্রকাশ পাবার পরে পথেঘাটে তাঁর নাম উচ্চারিত হতে থাকে। তিনি যে শুধু ঐতিহ্যশালী বিজ্ঞানের মূল ধরে নাড়াই দিয়েছেন তা নয় উপরন্তু বহু দেশের কল্পনার হিমশৈল প্রলুব্ধ করেছেন। হাসপাতালে দীর্ঘ কেরিয়ারে রোবের্তো বহু ক্যানসার রোগীর চিকিৎসা করেছেন। আর লক্ষ্য করেছেন এরকম রোগীদের একদল যখন মৃত্যুর আতঙ্কে ভেঙে পড়েছে অন্যদিকে একই ওষুধ খেয়ে আর একদল রোগী সুস্থ হয়ে উঠেছে। তাঁর বইতে রোবের্তো দেখাতে চেয়েছেন রোগ এবং মানসিক অবস্থার ভেতরের সম্পর্ককে। এবং দেখিয়েছেন যে দুঃখ ও একাকিত্ব নিশ্চিত করেই আক্রান্ত কোষের সংখ্যা বাড়িয়ে দেয়। কেননা রোগী যখন বিষণ্ন থাকে তখন তাঁর রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতাও কমে যায়। আর উল্টোদিকে মন প্রফুল্ল থাকলে রোগের বিপরীতে লড়াই করার ইচ্ছেটাও বেড়ে যায়। তিনি দেখাতেন যে চিকিৎসা কেবল অস্ত্রোপচারে, কেমিক্যাল ও অন্যান্য ওষুধের কোর্সের ওপরেই সীমাবদ্ধ থাকে না। চিকিৎসাপদ্ধতি কেবল আক্রমণ করে যে লক্ষণগুলো দেখা যায় তার বিরুদ্ধে। দরকার বরং সবার ওপরে মনের অবস্থার চিকিৎসা করা। বইয়ের শেষ অধ্যায়ে তিনি বলেছিলেন যে এসব ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো হয় যদি কোনও দম্পতির মধ্যে বিষয়টা ঘটে। কেননা ভালোবাসার কথার প্রভাব পৃথিবীর যে কোনও ওষুধের চেয়ে বেশি কাজ করে।

সংবাদ মাধ্যম এই তথ্যের অসংখ্য সম্ভাব্য ফল কল্পনা করার সুযোগ লুফে নেয়, এবং তা ব্লাউমের মুখে বসিয়ে প্রচার করতে শুরু করে এমন সব কথা যা কস্মিনকালেও তিনি বলেননি। মৃত্যু এলে যদি তালগোল পাকিয়ে যায় নোংরা হয়ে যায় সব সে সব ক্ষেত্রে এটি একটি প্রাপ্তি।

তারা সবাই দার্শনিকের ভালোবাসার গুণগুলোর ওপরে সব অর্পণ করল, যা দিয়ে তারা সব কিছু ভালো করে দেয়। বইটার কথা সবাই বলত, তবে খুব কমজনই সেটা পড়েছিল। সাধারণ আন্দাজ হলো প্রভাব পড়া যেটা স্বাস্থ্যের জন্য ভালোও হতে পারে। কিংবা এটা এতটাই জটিল হয়ে পড়ে যে তাতে গোটা দুনিয়াই যোগ দিতে পারে বা কিছু মানুষকে সরিয়েও দিতে পারে। এসব চলল যতদিনে না ব্লাউমের দর্শন একদিন সকালে অসম্ভব বলে এক বিপুল সংশয় রেখে হারিয়ে গেল। অন্য সব বদমাশরাও ছিল যারা বিষয়টি থেকে ফায়দা লুটে নিল আর ভালোবাসাকে নিজের করে রাখল যেন সেটি তাদের নিজস্ব আবিষ্কার। নতুন নতুন তত্ত্ব বের হতে লাগল। সাইকোলজির স্কুল, প্রাথমিক শ্রেণির রোগীদের জন্য কোর্স, একা মানুষদের ক্লাব, ভেঙে ফেলার মতো গন্ধ ছড়াল, আর প্রচুর দ্বিতীয় শ্রেণির সাইকিকেরা চার পয়সায় সেন্টিমেন্ট বেচে তাঁদের কার্ড আর কাচের বল ব্যবহার করতে লাগল। তারা কেউই লক্ষ্য করেনি যে আনা ও রোবের্তোও এক জোড়া বৃদ্ধ আবেগপ্রবণ দম্পতি যারা বহু বছর একসঙ্গে বেঁচে রয়েছেন, নিজেদের শরীর স্বাস্থ্য মজবুত রেখেছেন, মস্তিষ্কের সতেজতা অক্ষুণ্ন রেখেছেন, তাঁদের ভালোবাসার মান ইত্যাদি তাঁদের জীবন্ত রূপকথায় পরিণত করেছে। বিজ্ঞানীরা থেকে অবসাদগ্রস্তরা লোকেরা ছাড়াও ক্যান্সার রোগীরাও অযথা হই চৈ না করে বইটা পড়েছেন। যাই হোক তাঁদের জন্য নিশ্চিত করে সুস্থ হয়ে ওঠা একটা নিষ্ঠুর রসিকতায় পরিণত হলো। কারণ বাস্তবে কেউই বলতে পারত না ভালোবাসা কোথায় খুঁজতে হবে, কিভাবেই বা তা পেতে হবে, আর ন্যূনতম কী উপায়ে তা ধরে রাখতে হবে। তবে বোধহয় ব্লাউমের দর্শনে যুক্তির অভাব ছিল না। তবে বাস্তবে প্রয়োগ অসম্ভব ছিল।

কেলেঙ্কারির আকারের কাছে ব্লাউম আতঙ্কে থাকতেন। কিন্তু আনা তাঁকে মনে করিয়ে দিতেন আগে কি কি হয়েছিল, আর এখন কেবল কী হয় দেখার জন্য শান্ত হয়ে বসে অপেক্ষা করতে বলতেন। কারণ গোলমাল বেশিদিন থাকে না। এমনই ঘটেছিল। এইসব গণ্ডগোলের সময়টায় ব্লাউম দম্পতি শহরে ছিলেন না। রোবের্তো হাসপাতাল থেকে অবসর নিয়েছিলেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও। ক্লান্তি এবং এই বয়সে শান্তভাবে অবসর যাপন করার কারণ দেখিয়ে অবসর নিয়েছিলেন। কিন্তু সেলিব্রিটি স্ট্যাটাস থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে শেখেননি। ওনার বাড়িটা চিকিৎসা পাবার অর্থী, সাংবাদিক, ছাত্র, অধ্যাপক, কৌতূহলী এসে ভিড় করত সারাদিন ধরে। আমায় বলেছিলেন তিনি যে তাঁর নির্জনতা দরকার, কারণ তিনি আর একটি বই লিখতে চান। আর আমি ওঁকে একটা নিরিবিলি জায়গা খুঁজে পেতে সাহায্য করেছিলাম যেখানে উনি আশ্রয় নিতে পারবেন।

লা কোলোনিয়া তে আমরা একটা ঘর দেখলাম। একটা অদ্ভুত জায়গা, কর্কটরেখা অঞ্চলের পাহাড় দিয়ে বেষ্টন করা একটা জায়গা, উনিশ শতকের কোনও ব্যাভারিয়ান গ্রামের মতো। ছবি আঁকা কাঠের দেওয়ালে শুদ্ধ একটা বিচিত্র বাড়ি, তাতে কুকু দেওয়াল ঘড়ি টাঙানো, জেরেনিয়াম ফুলে ভরা টব, গথিক অক্ষরে খোদাই লিপি, যেখানে বসবাস করে লাল চুল ওয়ালা এক রকম জিপ লাইন দেওয়া স্যুট পরা একই লালচে সোনালি গালের মানুষজন, যে পোশাকগুলো তাদের প্রপিতামহেরা এই সেলভা নেগ্রা অঞ্চলে প্রথম আসবার সময় পরতেন। যদিও ততদিনে আজকের মতোই লা কোলোনিয়া পর্যটকদের এক গন্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল, রোবের্তো এমন জায়গায় বাড়ি ভাড়া করতে পেরেছিলেন যেখানে সপ্তাহান্তে ট্রাফিকের ভিড় বাড়ত না। আমায় ওঁরা বলেছিলেন রাজধানীতে ওদের কাজের দায়িত্ব যেন আমি নিই। আমি ওদের রিটায়ারমেন্টের পরে পাওনা টাকাকড়ি, বিলপত্র আর চিঠিগুলো সংগ্রহ করে আনতাম। প্রথম প্রথম ঘন ঘন যেতাম, কিন্তু দ্রুত লক্ষ্য করলাম আমার যাওয়াটাকে ওঁরা কিছুটা জোর করেই ভদ্র আচরণ করতেন, আগে যেমন আন্তরিক উষ্ণতায় আমাকে অভ্যর্থনা করতেন তার চেয়ে সেটা খুবই অন্যরকম ছিল। আমি একথা ভাবিনি যে ওঁরা আমার বিরুদ্ধে কিছু ভাবছেন, কিন্তু ব্যাপারটা তার চেয়ে কম কিছুও ছিল না। আমি সবসময়ই আত্মশ্রদ্ধা ও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কথা বলতাম ওঁদের সঙ্গে। কিন্তু লক্ষ্য করলাম, ওঁরা নির্জনে থাকতে চান। ঠিক করলাম চিঠি ও ফোনেই ওঁদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখব।

শেষবার যখন রোবের্তো ব্লাউম আমায় টেলিফোন করে ডেকেছিলেন, সে প্রায় এক বছর হলো। তারপর আমি আর ওঁদের দেখিনি। ওঁর সঙ্গে খুব কম কথা হয়েছিল সেদিন। কিন্তু আনার সঙ্গে বহুক্ষণ কথা বলেছিলাম। দুনিয়ার সব খবরাখবর দিয়েছি, আর উনি ওঁদের পুরোনো দিনের কথা এমনভাবে বলছিলেন যেন সেই সব স্মৃতি বর্তমানেই চারপাশে ঘিরে আছে। মাঝে মাঝে আমার জন্য ওঁর নিজের হাতে বানানো বিস্কুট উনুন থেকে এনে খেতে দিচ্ছিলেন। এমনকী গত ক’মাসে আমাকে উনি বিশেষ কিছু উপহারও পাঠাচ্ছিলেন। সেই রুমালটা যা ওঁর স্বামী ওঁকে দিয়েছিলেন, ওঁদের যৌবনের ফোটোগ্রাফ, একটা পুরোনো ব্রোচ। ওটা বোধহয় আমাকে দূরে সরিয়ে রাখার চেয়েও বড় একটা কাজ যাতে রোবের্তো ওঁর যে বইটা লেখার উদ্যোগ নিচ্ছিলেন তার সম্বন্ধে কথা বলা এড়াচ্ছিলেন। নিশ্চিত ওঁরা আমায় ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন কিন্তু সত্যি বলতে কি আমি বিন্দুমাত্র আঁচ করতে পারিনি পাহাড়ের ওপর সেই বাড়িটায় কি ঘটছিল। বহু পরে আনার ডায়রি যখন আমি পড়ি তখন জানতে পারি যে রোবের্তো একটি লাইনও লেখেননি। এই পুরো সময়টা জুড়ে উনি শুধু ওঁর নারীকে ভালোবাসছিলেন। কিন্তু সেটা ঘটনাগুলো ঘটবার রাস্তা থেকে সরিয়ে দিতে পারছিল না। চাকার সোজা উল্টো ঘর্ষণে সপ্তাহান্তের ছুটির দিনগুলোয় লা কোলোনিয়ায় বেড়াতে যাওয়াটা উষ্ণ মোটর ইঞ্জিনের তীর্থযাত্রা হয়ে উঠত। কিন্তু অন্য দিনগুলোয়, বিশেষ করে বৃষ্টির দিনগুলোতে ওটা ছিল নির্জন বেত পামের জঙ্গল আর আশ্চর্য খাদের মাঝে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ আকাশটাকে পাহাড় দিয়ে কেটে দিয়েছিল। সেদিন বিকেলটা পাহাড় আর প্রকৃতির দৃশ্যের মধ্যে সুতোর মতো ঝুলছিল। পাখিদের কাছে বৃষ্টি থেমে গেছিল, কেবল স্ফটিকের গায়ে ধাক্কা লাগা জলের আওয়াজ ছাড়া আর কিচ্ছু শোনা যাচ্ছিল না। পাহাড়ে চড়তে গিয়ে ঠান্ডা অনুভব করতে লাগলাম। মনে হলো একটা ঝড় যেন দম আটকে কালো মেঘের মধ্যে আছে, ঠিক যেন অন্য অক্ষের আবহাওয়া সেটা। হঠাৎ রাস্তার বাঁকে সেই জার্মান গ্রামটার উদয় হলো। ক্বচিৎ কখনও পড়া বরফ ঠেকানোর জন্য তাদের ছাদ হেলানো। সব বসতি ভেদ করে যেখানে ব্লাউম দম্পতি সাহস করে বাস করতে গেছিলেন সেখানে পৌঁছে দেখলাম এলাকা শুনশান। ওঁদের সাদামাটা বাড়িটাও অন্যদের মতোই দেখতে, কালো কাঠে তৈরি, বাঁকানো ছাঁচের আর ঘরকাটা ডিজাইনের পর্দা ওড়ানো জানলা, সামনের দিকে খুব যত্নে কেয়ারি করা ফুলবাগান, আর পেছন দিকে ছোট্ট স্ট্রবেরি ফলের ঝোপ। গাছের ফাঁক দিয়ে বয়ে যাওয়া শীতের শিস দেওয়া হাওয়া কিন্তু চিমনির ধোঁয়া দেখতে পেলাম না। বহু বছরের সঙ্গী কুকুরটা, সদরের সামনে বসে আছে, ডাকলেও উঠে দাঁড়াল না, মাথা তুলে চাইল, লেজ নাড়াল না একটুও, যেন আমায় একটুও চিনতে পারেনি। কিন্তু যখন দরজা খুললাম আমার পিছু পিছু এল। দরজায় চাবি লাগানো ছিল না। আমি চৌকাঠ ডিঙালাম। অন্ধকার ছিল। হাতড়ে হাতড়ে সুইচ খুঁজে আলো জ্বাললাম। সব কিছু ঠিকঠাক সাজানো। ফুলদানিতে ইউক্যালিপ্টাসের ডাল সাজানো। সেটা বাতাসে একটা পরিষ্কার গন্ধ ছড়িয়ে দিচ্ছে চারদিকে। সেই ভাড়া বাড়িতে আমি ঢুকলাম, যেখানে কটা বই আর পিয়ানো ছাড়া কেউ ব্লাউমদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে না। আমার অবাক লাগছিল; আমার বন্ধুরা দেড় বছরেও আমাকে বলেননি যেখানে তাঁরা থাকেন তাদের সেই বাড়িটি কীরকম।

সিঁড়ি দিয়ে অ্যাটিকে চড়লাম। সেখানেই বড় শোবার ঘর। বেশ ছড়ানো জায়গা জুড়ে। যেটার উঁচু ছাদ কড়িবরগায় মরচে পরা, দেওয়াল থেকে খসে পড়ছে ছেঁড়া ওয়াল পেপার, সাধারণ প্রাদেশিক আসবাবে সাজানো। টেবল ল্যাম্পের আলো বিছানা আলো করে দিচ্ছে যেখানে আনা বহুবার দেখা মুক্তার কলার বসানো নীল রেশমের পোশাক পরে শুয়ে আছেন। মৃত মুখে একই রকম নির্মল সরলতা, যেমনটি বহু বছর আগে তোলা ওঁর বিয়ের ছবিতে দেখা যায়। যে সময় জাহাজের ক্যাপ্টেন ওঁকে তীর থেকে সত্তর মাইল দূরে রোবের্তোর সঙ্গে বিবাহ দিয়েছিলেন। সে বিকেলটা ছিল দুর্দান্ত যখন উড়ুক্কু মাছেরা ভেসে উঠছিল একথা জানান দিতে যে তীর আর বেশি দেরি নেই। কুকুরটা আমার পিছু পিছু আসছিল, কুঁকড়ে গিয়ে ঘরের কোণায় বসে কাঁদতে লাগল।

রাতের খাবার টেবিলের ওপর আধ শেষ হওয়া এমব্রয়ডারি সেলাইটার পাশে আনার ডায়রি পড়ে ছিল। দেখলাম রোবের্তোর লেখা একটা কথা আমাকে লিখেছেন তিনি―যেখানে তিনি আমায় কুকুরটার ভার নিতে অনুরোধ করেছেন, আর সেই গ্রামেই একই কবরে দুজনকে সমাধিস্থ করার কথা বলে গেছেন। ওঁরা একসঙ্গে মৃত্যুর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কেননা আনার কর্কট রোগ হয়েছিল, শেষ পর্যায়। অন্য জগতে বেড়াতে যেতে চেয়েছিলেন ওঁরা হাতে হাত ধরে, বরাবর যেমন করে এসেছেন।

রোবের্তোকে পাবার জন্য গোটা বাড়িটা খুঁজতে লাগলাম। রান্নাঘরের পেছনে একটা ছোটো শোবার ঘরে যেখানে পড়াশোনা করবার ঘর ছিল, সেখানে ওঁকে পেলাম। একটা পরিষ্কার কাঠের টেবিলের সামনে বসে আছেন, মাথায় হাত রাখা, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। টেবিলের ওপরে একটা সিরিঞ্জ রাখা যেটায় ভরে বিষ নিয়ে তিনি তাঁর স্ত্রীকে ইঞ্জেক্ট করেছেন। যেটার মধ্যে এখন নিজের জন্য বিষ পুরে রেখেছেন। আমার দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে রইলেন অনেকক্ষণ ধরে। বোধহয় আনার কষ্ট দূর করতে চেয়েছিলেন। দুজনে একসঙ্গে বিদায় নিতে চেয়েছিলেন সেই মুহূর্তটির একই পবিত্রতায়। তাই বাড়ি পরিচ্ছন্ন করেছিলেন, ফুলদানির ফুলের ডাল ছেঁটেছিলেন। স্ত্রীকে পোশাক পরিয়ে, চুল আঁচড়ে দিয়েছিলেন, এবং সব কিছু হয়ে যাবার পরে স্ত্রীকে ইনজেকশন দিয়েছিলেন। তাঁকে সান্ত্বনা দিতে দিতে ইঞ্জেকশন দিয়েছিলেন যে কয়েক মুহূর্ত পরেই ওঁরা এক জায়গায় মিলিত হবেন আবার। নিজের পাশে স্ত্রীকে শুইয়ে দিয়েছিলেন, জড়িয়ে রেখেছিলেন হাত দিয়ে যতক্ষণ না প্রাণ বায়ু বের হয়। সিরিঞ্জে নতুন করে বিষ ভরেছিলেন। শার্টের হাতা গুটিয়েছিলেন, কাঁপা কাঁপা হাতে বিষ ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু ঘটনাগুলো তেমন ঘটল না যেমনটি তিনি ভেবেছিলেন। তারপর আমাকে ফোন করে ডেকে এনেছিলেন। আমি করতে পারলাম না এটা, এভা। আমি শুধু তোমার কাছে একটা জিনিষ চাই… আমাকে মরতে সাহায্য কর প্লিজ।

কলকাতা থেকে

সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button