আর্কাইভবিশ্বসাহিত্য

শব্দঘর পত্রিকার দশম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর জাঁকজমক অনুষ্ঠান : মনি হায়দার

সাহিত্য-আড্ডা

চলো যাই, ডানা মেলে, দিক থেকে দিগন্তে…

বাঙালি কখনও ভেঙে পড়ে না। বাঙালি কখনও পরাজয় মানে না। বাঙালি কখনও স্বপ্ন হারায় না। চলতে চলতে পথে নানা ধরনের বাঁধা, কিন্তু সব অতিক্রম করে সীমাহীন সাহসে স্বপ্ন বুকে এঁকে এগিয়ে চলে দুর্বার গতিতে। বাঙালির পকেটে যদি একটা পয়সাও না থাকে তাহলে কুচ পরোয়া নেই। বুকের গহিনে স্বপ্ন চাষ করতে করতে এগিয়ে যায় বাঙালি। বাঙালিরা রুক্ষ পাথরের জমিনেও রোপণ করতে পারে স্বপ্ন, অবলীলায়। স্বপ্ন চাষের ধারাবাহিকতায় অনন্য এক পথিক শব্দঘর পত্রিকার সম্পাদক মোহিত কামাল। মোহিত কামালের স্বপ্ন শব্দঘর।

শব্দঘর শুরুতে ছিল―দশ বছর আগে মোহিত কামালের একার, এখন বাঙালির। বাংলাদেশের বাঙালির সীমানা অতিক্রম করে শব্দঘর ছুটছে দেশের বাইরে। শব্দঘর প্রতিটি সংখ্যা পরিকল্পনা করে, লেখকদের কাছ থেকে লেখা আদায় করে সময়কে হাতের মুঠোয় রেখে প্রকাশিত হচ্ছে দশ বছর ধরে। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে এমন সুরম্য সঞ্চরণশীল একটি নিখুঁত নিপাট সাহিত্য পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশ করা কেবল জটিল নয়, ভয়বাহ ঘটনাও বটে। কিন্তু যত বিপদ বা বিড়ম্বনা সামনে আসুক না কেন বাঙালি যে স্বপ্নরথের সারথি, স্বপ্ন বুনে দিতে পারঙ্গম―মোহিত কামাল এবং শব্দঘর সম্পাদনা সহযোগীরা জানেন তীব্রভাবে। সুতরাং এগিয়ে যাচ্ছেন এক এক করে দশ বছরের দিকে।

শব্দঘর লেখকদের স্বপ্ন দেখিয়েই ক্ষান্ত নয়, নিজেও স্বপ্নরথে চড়তে পছন্দ করে। বিশেষ করে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সামনে রেখে। দশম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী সামনে রেখে গত ২৪ জানুয়ারি বিশ^সাহিত্য কেন্দ্রের দোতলার ইসফেনদিয়ার জাহেদ হাসান মিলনায়তনে হয়ে গেল জমজমাট অনুষ্ঠান। হালকা আলোয় শীতের সন্ধ্যায় মন্দ্রিত বাতাসে মিলনায়তনে উপচে পড়া অতিথিদের হাসি, গান আর স্মৃতির সম্ভারে ভরে উঠেছিল শব্দঘর-পরিবারের অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল তরুণ রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী প্রমিলা রায়ের গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীতের মধ্য দিয়ে। শিল্পী পরপর দুটি গান শুনিয়ে উপস্থিত শ্রোতাদের মুগ্ধ করেন।

রবীন্দ্র সঙ্গীতের পর মাইক্রোফোনে আসেন কথাসাহিত্যিক মনি হায়দার। উপস্থাপক হিসেবে তিনি মনোরমভাবে  সজ্জিত মঞ্চে ডেকে নেন অতিথিদের একে একে। মঞ্চে আসন গ্রহণ করেন বিশ^সাহিত্য কেন্দ্রের কেন্দ্রবিন্দু আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক সুব্রত বড়ুয়া, বিশিষ্ট শিশুসাহিত্যিক আখতার হুসেন, বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ড. বিশ^জিৎ ঘোষ, শব্দঘর সাহিত্য পত্রিকার লন্ডন সমন্বয়ক কবি শামীম আজাদ, বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক, শব্দঘর পত্রিকার প্রকাশক মাহফুজা আখতার এবং পত্রিকার নিবিষ্ট সম্পাদক মোহিত কামাল। মঞ্চটা মনে হচ্ছিল বাংলা সাহিত্যের তারায় তারায় খচিত একটা পূর্ণ আকাশ, জ¦লে উঠেছিল সুন্দরে আর বক্তব্যে।

অনুষ্ঠানের শুরুতেই স্বাগত বক্তব্য রাখেন সম্পাদক মোহিত কামাল। ‘তিনি শব্দঘর পত্রিকার শুরুর গল্প বলতে বলতে চলমান সময়ের রুগ্ন মানসিকতার মধ্যে কীভাবে সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করেন, পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন। পত্রিকার সঙ্গে তরুণ লেখকদের নিবিড় যোগাযোগ এবং নিজেদের প্রকাশের প্রধান অবলম্বন হিসেবে শব্দঘর পত্রিকাকে ভাবার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন―লেখক, প্রকাশক, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ীদের ভালোবাসায় শব্দঘর ১০ বছর টিকে আছে এবং তাদের ভালোবাসা এবং সহযোগিতায় ভবিষ্যতের ভালো কাজ করে টিকে থাকবে।’

শব্দঘর গোটা অনুষ্ঠানকে সাজিয়েছে তিনটি পর্বে।

পাঠকদের ভোটে প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত করা হয় একগুচ্ছ বই। এর মধ্য থেকে পাঁচ ক্যাটাগরির পাঁচটি সেরা বই নির্বাচন করেন জুরিবোর্ড। এই পাঁচজন লেখককে পুরস্কার প্রদান করা হয়। লেখক ও পাঁচটি বই যথাক্রমে―পারভেজ হোসেন (উপন্যাস, সুবর্ণপুরাণ), খালেদ হোসাইন (কাব্যগ্রন্থ, পথ ঢুকে যায় বুকে), বদিউদ্দিন নাজির (প্রবন্ধগ্রন্থ, বই প্রকাশে লেখকের প্রস্তুতি), ফারহানা আজিম (অনুবাদগ্রন্থ, শূন্য বিন্দুতে নারী, মূল লেখক মিসরীয়-নাওয়াল আস সাদাবি) এবং আনজীর লিটন (কিশোর উপন্যাস, নীল ঘোড়া খেলা)। বিজয়ী প্রত্যেক লেখককে অনন্য দৃষ্টিকাড়া সম্মাননাপত্র, শংসাপত্র এবং নির্দিষ্ট অর্থমূল্যের চেক। পুরস্কারপ্রাপ্তদের শংসাপত্র পাঠ করেন যথাক্রমে নিঝুম শাহ্, হাসান রাউফুন, স্বপন নাথ, এলহাম হোসেন এবং ফাতেমা আবেদীন নাজলা।

পুরস্কার পাওয়া লেখকগণ নিজেদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেছেন―শব্দঘর কেবল পত্রিকা বের করেই ক্ষান্ত হয় না, দেশের প্রকৃত লেখক ও লেখকদের বই পাঠক পাঠ জরিপের মধ্য দিয়ে অনন্য দায়িত্ব পালন করছে। আরও বাড়তি আনন্দ―এই সংবর্ধনার মনোজ্ঞ আয়োজন। আমরা লেখক, পুরষ্কার পাওয়ার জন্য আমরা লিখতে আসিনি কিন্তু স্বীকৃতি পেলে আনন্দে ভেসে যাই। শব্দঘর পত্রিকা এবং শব্দঘর সম্পাদক ও প্রকাশকের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ―আড়াল থেকে আমাদের সামনে আনার জন্য। আমরা আরও আশা করি, শব্দঘর এই যাত্রা অব্যাহত রাখবে।

প্রথম পর্বের শেষে শুরু হয় দ্বিতীয় পর্ব। বাংলাদেশের দুজন প্রবীণ এবং সাহিত্যে নিবেদিত প্রাণ কথাসাহিত্যিক সুব্রত বড়ুয়া এবং শিশুসাহিত্যিক আখতার হুসেনকে দেয়া হয় বিশেষ সংর্বধনা। শব্দঘর পত্রিকার চলতি সংখ্যা বিশেষ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী হিসেবে প্রকাশ করেছে মোহিত কামাল। এই সংখ্যায় দুজন প্রবীণ লেখককে নিয়ে প্রকাশ করেছে বিশেষ সংখ্যা। সুব্রত বড়ুয়ার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রাবিন্ধক ও গবেষক সৈকত হাবিব আর আখতার হুসেনের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শিশুসাহিত্যিক আনজীর লিটন। আলপ্তগীন তুষারের আঁকা দুজনের প্রতিকৃতি দিয়ে প্রচ্ছদ সাজিয়েছেন ধ্রুব এষ। দুজনেই সাক্ষাৎকারে নিজেদের বিকাশ সময় এবং সাহিত্য সাধনার অতীত ও বর্তমানের পরিস্থিতি জানিয়েছেন পাঠকদের। দুই সাক্ষাৎকার পাঠের মধ্যে দিয়ে তরুণ পাঠকেরা তো বটেই, সব শ্রেণির পাঠকেরাই সমৃদ্ধ হবেন, তৃপ্তি পাবেন।

সুব্রত বড়ুয়া এবং আখতার হুসেনের হাতে পোট্রেট তুলে দেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদাসহ উপস্থিত অতিথিরা। তার আগে সুব্রত বড়ুয়ার জীবনী পাঠ করেছেন সালমা আক্তার। আখতার হুসেনের জীবনী পাঠ করেছেন ইফফাত ইসলাম রুম্পা। সংবর্ধনার প্রতিক্রিয়ায় বীর মুক্তিযোদ্ধা কথাসাহিত্যিক সুব্রত বড়ুয়া বলেন, জীবনে যা কিছু করেছি নিষ্ঠার সঙ্গে করেছি। বিজ্ঞান নিয়ে লিখেছি, প্রবন্ধ লিখেছি, অনুবাদ করেছি, শিশুসাহিত্য করেছি কিন্তু গল্প আমার প্রিয় জায়গা। যদিও গল্প লিখেছি তুলনামূলক কম। জীবনে অনেক পুরস্কার পেয়েছি কিন্তু সব চেয়ে বড় পুরষ্কার পাঠকদের ভালোবাসা। আপনাদের সামনে আসতে পারা বড় পুরস্কার। বিশেষ করে শব্দঘরের এই আয়োজন হৃদয়ে অনেক দিন জেগে থাকবে।

বিশিষ্ট শিশুসাহিত্যিক বীর মুক্তিযোদ্ধা আখতার হুসেন প্রতিক্রিয়ায় বলেন, আমি জীবনে নানা ধরনের সংবর্ধনা ও পুরস্কার পেয়েছি। জীবনটা উৎসর্গ করেছি শিশুদের কল্যাণ কামনায় এবং শিশুদের জন্য রচনায়। কারণ শিশুরাই আগামী। শিশুরাই ভবিষৎ। সুন্দর পৃথিবী গড়বার জন্য সে সাধনা, সেই সাধনা করে যাচ্ছেন সম্পাদক, কথাশিল্পী মোহিত কামাল, শব্দঘর সম্পাদনা করার মাধ্যমে।

অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ নিজের সম্পাদিত কণ্ঠস্বর পত্রিকার সেই সময়ের সঙ্গে এই সময়ের তুলনা করে বলেন, পত্রিকা সম্পাদনা একটি দুরূহ ও সাধনালব্ধ কাজ। মোহিত কামাল সেই শুরু থেকেই নিষ্ঠার সঙ্গে যত্ন করে শব্দঘর সম্পাদনা করে যাচ্ছেন। আমি শব্দঘর পত্রিকার সাফল্য কামনা করি।

আনিসুল হক বলেন, আমি অবাক হয়ে যাই, প্রতিটি শব্দঘর সংখ্যা যখন আমার কাছে আসে, কীভাবে এমন সুন্দর পরিপাটি করে প্রকাশ করেন সম্পাদক! সম্পাদকের কাজই তো সবাইকে হাতের তালুতে রেখে নিজের মতো কাজ করিয়ে নেয়ার অদম্য স্পৃহা। মোহিত কামালের সেই স্পৃহাকে আমি ঈর্ষা করি।

ড. বিশ^জিৎ ঘোষ বলেন, আমার বাসা আর সম্পাদক মোহিত কামালের বাসা ধানমন্ডিতে। আমার বাসার বারান্দা থেকে সম্পাদকের বাসা দেখা যায়। আমি মাঝে মাঝে সম্পাদক, আমার বন্ধু মোহিত কামালের বাসার দিকে তাকিয়ে থাকি আর ভাবি, মোহিত কামাল কেমন করে এমন রুচিস্নিগ্ধ পত্রিকা প্রকাশ করেন! আমি শব্দঘর পত্রিকার সাফল্য কামনা করছি।

অনুষ্ঠানের শেষের দিকে ছিল শব্দঘর পত্রিকার দশ বছর পূর্তিতে কেক কাটার আয়োজন। দুটি বিশাল কেক কেটে সবার মুখে মুখে তুলে দেয় পত্রিকার কর্মীরা। শব্দঘর পত্রিকার প্রকাশক মাহফুজা আখতার বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেন―শব্দঘর পত্রিকার এই পর্যায়ে আসার কৃতিত্ব লেখক পাঠক সংগঠক শুভানুধ্যায়ী সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই। লেখক পাঠক এবং বিদগ্ধজনেরা সম্মিলিতভাবে আজ হাজির হয়ে শব্দঘর পরিবারকে অনুপ্রাণিত করেছেন, আপনাদের জানাই অকৃত্রিম কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ।

শব্দঘর সাহিত্য পত্রিকার দশ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক মোজাম্মেল হক নিয়োগী, আমীরুল ইসলাম, মশিউল আলম, আহমাদ মোস্তফা কামাল, মাসউদ আহমাদ, সাইদ আজাদ, কাজী রাফি, জয়দীপ দে, ফারহানা রহমান, পিওনা আফরোজ। আরও ছিলেন কবি বিমল গুহ, ফারুক মাহমুদ, ফরিদ আহমদ দুলাল, জুয়েল মাজহার। উপস্থিত ছিলেন প্রাবন্ধিক তপন বাগচী, মাসুদুজ্জামানসহ অনেক তরুণ লেখক।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button