আর্কাইভবিশ্বসাহিত্য

বোরিস পাস্তেরনাক এবং সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার : মাহবুবুল হক

বিশ্বসাহিত্য : প্রবন্ধ

একটি বই আর একটি মানুষের নাম উনিশ শ ষাটের দশকে পৃথিবীর শিক্ষিত মানুষের চেতনায় বিস্ময়ের চমক এনেছে। আলোড়ন তুলেছে বিভিন্ন দেশের সাহিত্যিক মহলে। বাদানুবাদের-ঝড় উঠেছে দেশে দেশে, রাজধানীতে, ভাবধারা বিভক্ত দুই পৃথিবীতে। সারা পৃথিবীর মানুষ বিস্ময়ের সঙ্গে একটি বই উল্টে পাল্টে পড়েছেন আর আশ্চর্যান্বিত হয়ে গেছেন বইটির লেখকের কথা ভেবে।

বইটির নাম ডাক্তার জিভাগো (১৯৫৭)। বইটির জন্যই রুশ কবি বোরিস পাস্তেরনাক ১৯৫৮ সালের নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। সাহিত্যে নোবেল প্রাইজ তো প্রত্যেক বছরই এক একজন সাহিত্যিক পেয়ে থাকেন। যেমন পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, ইভান বুনিন এবং আরও অনেকে। কিন্তু তাদের কাউকে নিয়ে তো এমন বির্তকের ঝড় ওঠেনি। হয়নি এত আলোচনা। তবে এই বই আর এর লেখককে নিয়ে কেন এই আলোচনা?―এই বাদানুবাদ?

এই কেনর উত্তর দুটি। (এক) পাস্তেরনাক এত বড় সম্মান পেয়েও তাকে গ্রহণ করেননি, প্রত্যাখ্যান করেছেন। (দুই) যে রাশিয়ার ভাষা ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক পটভূমিকায় এই বই লেখা সেই দেশে এই বইয়ের প্রচার ও প্রকাশ নিষিদ্ধ।

বোরিস পাস্তেরনাক সম্বন্ধে প্রথম উত্তেজনার সেই তীব্রতা এতকাল পরে অনেকটা মিলিয়ে গিয়েছে আর তাতেই তাঁকে অনেক বেশি করে চিনতে পারা সম্ভব হচ্ছে।

১৮৯০ সালের ২৯ জানুয়ারি রাশিয়ার মস্কোতে পাস্তেরনাকের জন্ম। পিতা লিওনিদ পাস্তেরনাক ছিলেন প্রখ্যাত রুশ সাহিত্যিক লেভ তলস্তোয়ের বন্ধু এবং প্রতিভাবান চিত্রকর। তাঁর মা রোজা কাউফ্ম্যান ছিলেন নামজাদা পিয়ানো বাদিকা। অবস্থা তত স্বচ্ছল না হলেও লেখাপড়া ও শিক্ষা-সংস্কৃতির দিক থেকে তাঁদের পরিবারের গৌরব ছিল যথেষ্ট। মা-বাবা দুজনের শিল্পী-সত্তার প্রভাব পাস্তেরনাকের পড়েছে জীবনে। ছোটবেলায় তাঁর মনে জন্ম নেয় সংগীতনিষ্ঠা থেকেই। যার ফলে প্রথম যৌবনে তিনি মনোনিবেশ করেছিলেন সুর সাধনায়। কিন্তু এতে তাঁর মন ভরেনি। সুর ছেড়ে ছন্দের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন তিনি। ঝুঁকে পড়েছেন কবিতা লেখার দিকে।

এর ফল হিসেবে ১৯১৫ সালে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ মেঘের মধ্যে যমজ। তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ জীবন আমার বোন প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালে। এই সময় সমসাময়িক কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে তার যোগাযোগ ঘটেছে। রাশিয়ার তখন জারের স্বেচ্ছাতন্ত্রের বিরুদ্ধে এক প্রচণ্ড বিদ্রোহ দানা বাঁধতে শুরু করেছে। পঞ্চাশ বছর ধরে যে বিদ্রোহের আগুন কখনও ধিকিধিকি জ্বলে, কখনও বা খণ্ড বিদ্রোহের রূপ নিয়ে রাজতন্ত্রের পরাক্রমের বিরুদ্ধে ব্যর্থ বিষোদ্গার করছিল, এই সময় তা রূপ নেয় এক বিরাট গণবিপ্লবের। রাশিয়ার ঐতিহাসিক প্রয়োজনে সম্পূর্ণ নতুন এক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে  নতুন আদর্শ নিয়ে যিনি এই বিপ্লবের সূচনা করেন তাঁর নাম লেনিন। তাঁর দলের নাম হলো বলশেভিক। তাদের দলের আদর্শ হলো মার্কস্বাদ―জগতে কম্যুন অর্থাৎ মেহনতি জনগণের আত্মপ্রতিষ্ঠাকে স্বীকার করে নেয়া যার উদ্দেশ্য। ১৯১৭ সালে রাশিয়ার গণবিপ্লব জ্বলে ওঠে শত শিখায় এবং জারতন্ত্রের ধ্বংস হয়ে জন্ম হয় নব আদর্শে গঠিত রাশিয়ায়।

রুশ বিপ্লবের পূর্ব পর্যন্ত প্রত্যেকটি রুশ সাহিত্যিকই জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে রাশিয়ার নব জাগরণের কথা প্রচার করে আসছিলেন তাঁদের সাহিত্যে। কিন্তু রুশবিপ্লবের পর এই সমস্ত সাহিত্যিক এবং চিন্তানায়কেরা প্রধানত দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন। একদল নতুন আদর্শকে মেনে নেন সর্বতোভাবে (ম্যাকসিম গোর্কি এঁদের অন্যতম), আর একদল গেলেন এই আদর্শের সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে (এঁদের অনেকেই নির্যাতনের ভয়ে দেশ ত্যাগ করেন। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ইভান বুনিন ছিলেন এই দলে)। এছাড়া তৃতীয় কিছু সাহিত্যিক বিপ্লবকে সমর্থনও করেননি কিংবা বিরোধিতা করে দেশত্যাগর পথ ও বেছে নেননি কেবল নীরবে নতুন শাসকদের পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন। তাঁদের এই নীরবতাই ছিল প্রতিবাদের অন্য রূপ। বোরিস পাস্তেরনাক এই তৃতীয় দলের প্রধান প্রবক্তা।

এই সময় পাস্তেরনাক কবিতা লেখা কমিয়ে দেন। অনেকের মতে, রুশ বিপ্লবের প্রথম দিককার নিষ্ঠুরতা রক্তপাত আর শক্তির অপব্যবহার ইত্যাদি তার মনকে পীড়িত করেছিল বলে তিনি কবিতা লেখা ছেড়ে দেন। মতান্তরে আবার কেউ কেউ বলেন বিপ্লবকে সমর্থন না জানানোর জন্য উদ্দেশ্যমূলকভাবে তাঁর কবিতাকে ‘দুর্বোধ্য’ ‘রীতিপ্রধান’, ‘জনগণের সংযোগ বিচ্ছিন্ন’ ইত্যাদি বলে নস্যাৎ করা হতো বলে তিনি কবিতা লেখা ছেড়ে দেন। কিন্তু মনে হয়, কবিতা প্রকাশে কবির এই নিশ্চুপতা কিছুটা রাজনীতি-নিয়ন্ত্রিত এবং কিছুটা তাঁর মনের ওপর বিশ্বব্যাপী ঘটনার ফল। আন্তর্জাতিক এত সব বিস্ফোরণ এবং আলোড়নের মধ্যে কবিতার সার্থকতা নিয়ে তিনি নিশ্চিত হতে পারেননি। এই মনোভাবের প্রকাশ সুস্পষ্ট তাঁর The Exalted Melody কবিতার প্রথম স্তবকে :

I am ashamed and ashamed every day

That in an age so overshadowed

A certain exalted malady

Should still be called melody.

Is this the time to burst into loud song?

অর্থাৎ

আমি লজ্জিত এবং লজ্জিত গভীরভাবে প্রতিদিন

কেননা তমসা-আবৃত এই সময়ে

দেহ কিংবা মনের এক গভীর অসুখ

আখ্যায়িত হয়েছে সুর মাধুর্য বলে।

সংগীতের উচ্চ গ্রামে ফেটে পড়ার সময় কি এই?

(বর্তমান লেখকের অনুবাদ)।

গ্লানি, দুঃখ, যন্ত্রণা ও বিষাদ নিশ্চয়ই গভীরভাবে ব্যথিত করেছিল কবির হৃদয়কে এবং তাইই বোধ হয় তিনি ১৯৪৫ সালের পর থেকে আর কবিতার খাতা খোলেননি। দীর্ঘকাল―মুলতবি রাখেন কবিতা চর্চা এবং মনোনিবেশ করেন শেকস্পিয়র, গ্যেটে, শিলার, শেলি প্রমুখ বিশ্ববরেণ্য সাহিত্যিকদের বিভিন্ন সাহিত্যকর্মের অনুবাদে।

কবিতা চর্চা বন্ধ করে তিনি অনুবাদে মনোনিবেশ করলেন বটে কিন্তু এক মহৎ সৃষ্টির বাসনা উদগ্র হয়ে উঠল। কৈশোর থেকে পরিণত বয়স পর্যন্ত রাশিয়ার ঐতিহাসিক বিপ্লবের যে বিচিত্র প্রকাশ তিনি দেখেছেন তাকেই তিনি মানবীয় এবং মহৎ কবির দৃষ্টিতে বিচার করে তার উপলব্ধিকে অকপটভাবে লিখে রাখতে চাইলেন।

ঐতিহাসিক কিংবা রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে রুশ বিপ্লবের ইতিহাস অনেকেই লিখেছেন। কিন্তু মরমি কবির দৃষ্টিতে―যে কবি রাজনৈতিক দলের কেউ নন, যিনি কেবল মানবিক স্বচ্ছতার মধ্য দিয়ে বস্তুকে উপলব্ধি করতে চেষ্টা করেন এবং যিনি কেবল অন্তরসঞ্জাত সত্যানুভূতির স্বাক্ষর ছাড়া অন্য কিছুকেই স্বীকার করেন না―এই বিরাট আন্দোলন সম্পর্কে তেমন কোনও সত্যদ্রষ্টা কবির নির্ভীক কোনও রচনা নেই। কেননা হয় কবিরা বিজয়ী দলের প্রভাবে দলের ইঙ্গিতে আন্দোলনকে দেখেছেন নয়তো শাসকদের ভয়ে নীরব থেকে গেছেন। পাস্তেরনাকের দুর্বার ইচ্ছা―তিনি অকপটভাবে এই আন্দোলনের হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনার ইতিহাসকে বিধৃত করবেন তার কাহিনিতে।

প্যাস্তেরনাক জানতেন, তিনি যে এই রকম একটা বই লিখছেন তা যদি ঘুণাক্ষরেও প্রকাশ পায় তবে স্তালিনের রাশিয়ার বাস করা তার পক্ষে সম্ভব হবে না। তাই তিনি গোপনে, একান্ত নিভৃতে লিখতে লাগলেন উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি। ভাষা, ভাবনা ও কল্পনার সমন্বয় ঘটাতে তীক্ষè রাখলেন তাঁর লেখনী। সারা জীবন ধরে, বহু বছরের অভিজ্ঞতায় যে ছবি তার মনের পর্দায় পরতে পরতে অঙ্কিত হয়েছিল তাকে তিনি তিল তিল করে নিখুঁত রূপ দিতে লাগলেন তাঁর এই উপন্যাসের পাতায় পাতায়।

এবং অবশেষে একদিন লেখা শেষ হলো। পাস্তেরনাক এই উপন্যাসের নাম দিলেন ডাক্তার জিভাগো। এবং এই বইয়ের জন্যই পরবর্তীকালে তিনি পেলেন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সম্মান নোবেল পুরষ্কার।

এই সময় স্তালিনের মৃত্যু হলো। স্পষ্ট পরিবর্তন এল সোভিয়েত রাশিয়ার। এই পরিবর্তন আনলেন ক্রুশ্চেভ। কবি-সাহিত্যকেরা যে যার শিল্পধর্ম এবং দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী আবার লিখতে শুরু করলেন স্বাধীনভাবে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার সম্পাদকদের কাছ থেকে পাস্তেরনাক আবার তাগিদ পেলেন কবিতা লেখার। প্যাস্তেরনাক তাঁর উপন্যাস ডাক্তার জিভাগোর পাণ্ডুলিপি পাঠালেন রাশিয়ার অন্যতম বিশিষ্ট সাহিত্য পত্রিকা নোভি মির (নয়া দুনিয়া)-এর সম্পাদকের কাছে। কিছুদিন পরে নোভি মির-এর সম্পাদকমণ্ডলীর কাছ থেকে পত্র এল। তারা ডাক্তার জিভাগো ছাপতে পারার অক্ষমতা জানিয়ে পাস্তেরনাককে জানালেন যে, এই বইতে পাস্তেরনাক যে জীবন দর্শনকে তুলে ধরেছেন তা তাঁদের পত্রিকার দৃষ্টিভঙ্গির পরিপন্থি। এই বই প্রকাশ করলে তাদের পত্রিকার আদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গি ক্ষুণ্ন হবে। তাছাড়া পাস্তেরনাক যে জীবন―আদর্শকে এ বইতে ফুটিয়ে তুলেছেন তা এই বইয়ের প্রতিটি শব্দের মধ্যে এমন সজীব ও প্রাণবন্ত যে, সম্পূর্ণ নতুনভাবে না লিখলে এর কোনও পরিবর্তন বা নবরূপ দেওয়া সম্ভব নয়।

অনেকেই এরপর ডাক্তার জিভাগোর পাণ্ডুলিপি পড়েছেন কিন্তু তাদের কেউই এই বই প্রকাশ করতে রাজি হননি। কিন্তু তবু এই বই প্রকাশিত হয়েছে, লাভ করছে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্মান, অনূদিত হয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায়।

ডাক্তার জিভাগো প্রথম কোথায় এবং কীভাবে প্রকাশিত হলো সে কথায় আসা যাক। রাশিয়ার বইটি প্রকাশ করার ব্যাপার কেই সাহস না করলেও বইটির বৈশিষ্ট্য অনেককেই কিন্তু মুগ্ধ করেছে তখন। বেশকিছু কানাঘুষা শুরু হয়েছে রাশিয়ার শিক্ষিত মহলে বইটি সম্পর্কে। এমন সময় সাজিয়ে দ্যনজেলো নামে একজন ইতালীয় কম্যুনিস্ট ইতালি থেকে মস্কো আসেন। বিখ্যাত ইতালীয় প্রকাশক ফেলত্রিনেলি (তিনি একজন কম্যুনিস্ট। ইতালিতে কম্যুনিজমের প্রচারে তার দান অপরিসীম। তিনিই বহু অর্থ ব্যয়ে ইতালিয়ান ভাষার কম্যুনিস্ট আদর্শের নানা রকম বই প্রকাশ করেন। তিনি দ্যন্জেলোকে রাশিয়ার পাঠিয়েছিলেন বইয়ের সন্ধানে। দ্যন্জেলো কানাঘুষায় পাস্তেরনাকের উপন্যাসটির কথা জানতে পেরে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। ডাক্তার জিভাগোর পাণ্ডুলিপি পড়ে দেখে দ্যন্জেলো এতই মুগ্ধ হন যে পাস্তেরনাকের সম্মতি নিয়ে তিনি এই পাণ্ডুলিপি ইতালিতে নিয়ে আসেন এবং ফেলত্রিনেলিকে পড়তে দেন। ডাক্তার জিভাগো পড়ে ফেলাত্রিনেলিকে এতই মুগ্ধ হন যে, বইটি প্রকাশ না করার জন্য রাশিয়ার কম্যুনিস্ট পার্টির অনুরোধ উপেক্ষা করে তার মতো একজন কম্যুনিস্ট মতবাদ প্রচারকও বইটি না ছাপিয়ে পারেননি। ইতালিতে প্রকাশিত এই বই-ই নোবেল পুরস্কার পাওয়ার সম্মান অর্জন করে।

পাস্তেরনাক প্রথমে নোবেল প্রাইজ পাওয়ার সংবাদ শুনে উল্লসিত হলেন এবং এই পুরষ্কার স্বীকার করে নিলেন। বিশ্বের বিভিন্ন খ্যাতনামা সাহিত্যিকেরা তাঁকে জানাতে লাগলেন অভিনন্দন। কিন্তু সাহিত্যিক মহলে তখনও বিস্ময়ের বজ্রপাত হয়নি। শুরু হয়নি আলোড়ন। বাদানুবাদে রূপ নেয়নি রাজনৈতিক মল্ল যুদ্ধের। সবই শুরু হলো তখন, যখন সংবাদ পাওয়া গেল পাস্তেরনাক তাঁর প্রথম বারের সিদ্ধান্ত বাতিল করে নোবেল প্রাইজ পাওয়ার সম্মানকে প্রত্যাখ্যান করেছেন।

শুরু হয়ে গেল বাদানুবাদের ঝড়। কম্যুনিস্ট বিরোধী সাহিত্যিকেরা তীব্র ভাষায় সোভিয়েত রাশিয়াকে নিন্দা করতে শুরু করল। তাঁদের ধারণা, সোভিয়েত রাশিয়ার শাসকরা জোর করে পাস্তেরনাককে এই সম্মান থেকে বঞ্চিত করতে বাধ্য করছেন এবং বিশ্বের সাহিত্যিকদের করেছেন অপমান। সোভিয়েত রাশিয়ার পক্ষ থেকে এর জবাবে এল তুমুল প্রতিবাদ―সোভিয়েত রাশিয়াকে অপদস্থ করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপুষ্ট বর্তমান নোবেল প্রাইজ কমিটি ডাক্তার জিভাগো বইটিকে নোবেল প্রাইজ দিয়েছেন এবং বিপন্ন করেছেন পাস্তেরনাককে। নিজের দেশ  ও রাষ্ট্র সম্পর্কে এতটুকু মর্যাদাবোধ যার আছে সে এ সম্মান নিতে পারে না, একথা বুঝেই পাস্তেরনাক নোবেল প্রাইজ প্রত্যাখান করেছেন।

নিজের দেশ ও রাষ্ট্র সম্পর্কে মর্যাদাবোধ পাস্তেরনাকের ছিল। রুশ দেশের তুষার, বৃষ্টি আর উইলো বন, অল্ডার ঝোপ আর জলপাই বাগান, প্রকৃতি আর মানুষ সবসময় বিরাজিত ছিল তার নিষ্ঠা এবং প্রেমের গভীরে। দুঃখ ও দুর্দশায়, মর্মজ্বালা এবং গ্লানিতে, যাতনা ও অস্বস্তিতেও জন্মভূমির মাটি আঁকড়ে থেকেছেন তিনি। নোবেল পুরস্কার লাভের পর যখন কম্যুনিস্ট বিরোধী দেশগুলো পাস্তেরনাককে মাথায় তুলে নেবার জন্য তৈরি তখন তিনি বুঝতে পারলেন তাঁর ভুল হয়ে গেছে। বুঝলেন তাঁকে কেন্দ্র করে উঠেছে তর্কের ঝড়, পরিপন্থি মতবাদে বেঁধেছে নতুন সংঘাত। নবলব্ধ বাইরের সংবর্ধনায় তিনি সায় দিলেন না। বরঞ্চ দুঃখে অভিভূত হলেন। কিন্তু রুশ দেশ, আশ্চর্য শহর মস্কো তাঁর স্বপ্নে, তার আগ্রহে আরও বড় হয়ে উঠল : A departure beyeond the borders of my country would for me be equivalent to death, for that reason I request you not to take that extreme measure in relation to me.  (নিকিতা ক্রশ্চেভকে লেখা পাস্তেরনাকের চিঠির অংশ)

পাস্তেরনাকের দুর্ভাগ্য, তাঁর উপন্যাস হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে সোভিয়েত তন্ত্রের মুখে চুনকালি মাখাতে। একদিকে বাড়ন্ত লোফালুকি অন্যদিকে বর্জন, বিবদমান টানাপোড়েনে কবি অপ্রস্তুত। কী ক্ষোভে ও খেদ তার। অতি দুঃখে নিশ্চয়ই, তিনি বলেছিলেন, ‘আমাকে নিয়ে যারা নাচানাচি করে, ডাক্তার জিভাগো কে মাথায় তুলে আতিশয্য দেখায়, তাঁরা একই প্রশংসার পৌনঃপুনিকতামুখর, উদ্ধৃতিও তাঁদের হুবহু এক এবং তা মাত্র আমার সাত শো পাতার বইয়ের মাত্র তিন পাতা।’

প্রকাশ্য প্রশস্তি কিংবা স্বীকৃতি না পেলেও পাস্তেরনাক স্বদেশে অপাঙ্ক্তেয় ছিলেন না। তিনি যে সৎ শক্তিশালী কবি ছিলেন। এ স্বীকৃতির তত প্রচার না থাকলেও রাশিয়ার বুদ্ধিজীবী মহলে এ স্বীকৃতি সজ্ঞানতায় প্রচ্ছন্ন ছিল। রাশিয়ার এক শক্তিশালী সাহিত্য শিল্পী ইলিয়া এরেনবুর্গ পাস্তেরনাক সম্পর্কে বলেছেন, ‘তিনি বিশ্বের জীবন্ত মহান কবিদের একজন।’  এরেনবুর্গের স্পষ্ট ধারণা, পাস্তেরনাকের কবিতাকে হেলায় ফেলে দেয়া যায় না। নোবেল পুরস্কার লাভের পর পাস্তেরনাক সম্পর্কে তদানীন্তন সোভিয়েত সংস্কৃতি বিভাগীয় মন্ত্রী নিকোলাই মিখাইলভের মন্তব্য এই বক্তব্যকে সমর্থন করে : ‘আমি জানি, পাস্তেরনাক সত্যিকারের একজন কবি ও দক্ষ অনুবাদক। কিন্তু তাঁর সেরা কবিতাগুলো প্রকাশিত হওয়ার এত বছর পরে তিনি কেন পুরস্কার পাবেন?’

বস্তুত বোরিস পাস্তেরনাক লেখক হিসেবে যতটুকু, কবি হিসেবে তার চেয়ে কোনও অংশে কম নন। আর কবি হিসেবে যদি তিনি নোবেল প্রাইজ লাভ করতেন তা হলে হয়তো রাজনীতি ও ভাবধারা বিভক্ত দুই পৃথিবীতে এমন বাদানুবাদের ঝড় উঠতো না এবং তাঁকেও এমন অপ্রস্তুত হতে হতো না। তাঁর উৎকৃষ্ট কবিতা প্রকাশের দীর্ঘদিন পর হঠাৎ তাঁর কণ্ঠে এ জয়মাল্য কেন?―এ প্রশ্ন শুধু নিকোলাই মিখাইলভের নয় সমগ্র সোভিয়েত রাশিয়ার সাহিত্যসেবী, সমালোচক ও বুদ্ধিজীবীর।

এই পরিপ্রেক্ষিতে যদি বলা হয় রুশত্যাগী ইভান বুনিনকে নোবেল প্রাইজ দিয়ে সম্মানিত করার মতন উদ্দেশ্যমূলকভাবে রাশিয়ায় প্রকাশ ও প্রচার নিষিদ্ধ একটা বইকে এই সম্মান দেওয়া হয়েছে, পাস্তেরনাকের প্রতিভাকে নয়―তাহলে নিশ্চয়ই ভুল করা হয় না।

অবশ্য এর মানে এই নয় যে, ডাক্তার জিভাগো নোবেল পুরস্কার পাওয়ার মতো বই নয়। ডাক্তার জিভাগো পাস্তেরনাকের কল্পিত চরিত্র হলেও একাধারে কবি ও ডাক্তার এই চরিত্রে পাস্তেরনাকের প্রকাশ ঘটেছে বহুলাংশে। অংশত আত্মজৈবনিক এই উপন্যাসের পটভূমিকায় ভিড় করে এসেছে অসংখ্য এবং বিচিত্র ধরনের নারী ও পুরুষ। শ্রমিক ও অভিজাত, সৈনিক এবং মনীষী, রুগ্ণ ও উন্মাদ, কর্মী ও ধ্যানী ইত্যাদি বিভিন্ন চরিত্র নিদারুণ সংকটের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে এই উপন্যাসে। এদের নিষ্ঠুরতা ও করুণার অভিযান ঐতিহাসিক আর্তির আকাশে প্রেমের জ্বলন্ত ব্রুবতারা। এই উপন্যাসে বিধৃত হয়েছে রাশিয়ার পঞ্চাশ বছরের ইতিহাস। বিপ্লবের উত্তেজনায় স্তালিনের রাশিয়া যে সমস্ত অন্যায়কে প্রচারের জোরে সত্য ও ন্যায় বলে চালাতে চেষ্টা করছে পাস্তেরনাক এই উপন্যাসে সেসব অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন, জীবন ধর্মের বিরোধী বলে রুখে দাঁড়িয়েছেন। যুদ্ধ, বিপ্লব ও দুর্ভিক্ষের পরপারে মানুষের যে সত্তা অমর তারই পরম আকাক্সক্ষা ও মূল্যবোধের দলিল এই উপন্যাস। এই উপন্যাস বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সম্মান পাওয়ার যোগ্যতা রাখে। কিন্তু নোবেল প্রাইজ কমিটির যদি সেই সাহিত্য অনুসন্ধিৎসাই থাকত তাহলে তারা গোর্কিকে নোবেল প্রাইজ দিতেন, তলস্তোয়কে নোবেল প্রাইজ দিতেন, নোবেল প্রাইজ দিতেন শেখভকে। কিন্তু রাজনীতির কাছে মানুষ আজ জলাঞ্জলি দিয়েছে সবকিছু, জলাঞ্জলি দিয়েছে তার ন্যায়-নিষ্ঠা। তাই পাস্তেরনাককে নোবেল প্রাইজ দেওয়ার পেছনে আজ যদি কেউ রাজনীতিকে আবিষ্কার করে ফেলেন তবে তাকে দোষ দেয়া যায় না কিছুতেই।

পাস্তেরনকা মূলত কবি, মহৎ কবি। ডাক্তার জিভাগো উপন্যাসটিতেও তাঁর কাব্যের নির্ঝর নিরন্তর ধারায় রয়েছে। সংলাপের সঙ্গে বেজেছে সংগীত-উপন্যাসের ধারাকে করেছে সম্পূর্ণ। ডাক্তার জিভাগোয় মার্কসবাদ, রুশবিপ্লব, যৌথীকরণ সম্পর্কে যেসব উক্তি আছে সেসব তীর্যক দৃষ্টিতে না দেখলে শুধু একটি মানুষের আশাহত প্রাণের বেদনা-সঞ্জাত আত্মদর্শনই পরিস্ফুট হবে। রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি যে তাঁর শিল্প সৃষ্টি করেননি―এ কথা তিনি নিজেও বলেছেন : ‘আমার উপন্যাস রাজনৈতিক বিবৃতি হোক তা আমি চাইনি। জীবনের সম্পদ ও গভীরতা যেমন আমি তাকে সেভাবেই দেখাতে চেয়েছি। আমি কোনও প্রচারক নই।’ মৃত্যুর কয়েকমাস আগে তিনি বলেছেন, ‘আমি আমার বুকের রক্ত দিয়ে ডাক্তার জিভাগো লিখেছিলাম। কিছু প্রমাণ করতে বা কোনও কিছুকে আক্রমণ করতে চাইনি। জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতে একটি জীবনের ভাঙ্গাগড়া―এই শুধু দেখাতে চেয়েছিলাম আমি।’ তাঁর রচনার প্রতি অবজ্ঞা, নিজের দেশে তাঁর চেয়ে অনেক কঠিনভাবে বেজেছে নোবেল প্রাইজ পাওয়া পর তাঁর বই সম্পর্কে অনভিপ্রেত তর্কদীর্ণ প্রচারণা। সেই বেদনা ক্ষরিত তাঁর নোবেল প্রাইজ শীর্ষক কবিতায় :

আমি যেন এক খাঁচায় বদ্ধ জন্তু।

স্বস্থ, স্বাধীন আলোকে আনন্দিত

আজো কোনখানে রয়েছে মানুষ কিন্তু

আমি পরিবৃত্ত শিকারির পদশব্দে।

কিন্তু বলো তো কী আমার দুষ্কৃতি?

আমি কি দস্যু অথবা পিশুন ধূর্ত?

মাতৃভূমির রূপের পুণ্যস্মৃতি

জাগিয়ে, যে আমি জগতে করেছি আর্ত?

(বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদ)

পেরেডেলকিনো গ্রামে, যেখানে জীবনের শেষ কুড়িটি বছর পাস্তেরনাক কাটিয়েছিলেন, সেখানেই তার মৃত্যু হয় ১৯৬০ সালে। ঘরের জানালা দিয়ে যে গ্রাম্য কবরখানা দেখা যেতো সেখানে যেন তাঁকে সমাধিস্থ করা হয় ধর্মীয় অনুষ্ঠান সমতে―এ ইচ্ছা তিনি বহুবার প্রকাশ করেছেন। আনন্দের কথা তাঁর অন্তিম ইচ্ছা অপূর্ণ থাকেনি। জীবিত অবস্থায় দেশবাসীর স্বীকৃতি না পেলেও মৃত্যুর পর তাঁর শবাধারের ধারে অন্তত দেড় সহস্র দেশবাসীর অকুণ্ঠ সমর্থন তিনি পেয়েছেন। ধর্মীয় অনুষ্ঠান সমেত করা হয়েছে তাঁর শেষ ক্রিয়া। পিয়ানোতে একজন বাজিয়েছেন শোঁপার শেষ যাত্রা ও বিথোভেনের Funeral March। পাইনবীথির তলায় দাঁড়িয়ে আর একজন উদাত্ত কণ্ঠে মৃত কবির লেখা ‘হ্যামলেট’ কবিতা পাঠ করে চিরবিদায় দিয়েছেন কবিকে :

স্তুতিবাকরা মরুক, আবার আমি

মঞ্চে আসি। দুয়ার খুঁটিতে হেলান পীড়িত

আমি দূরান্তরী সময়াভিমুখে তাকাই

না জানি কী আছে সমকালীন সময়ভাগ্যে।

তোমার মহান ইচ্ছা আমি ভালোবাসি

সানন্দে আমি দুঃখে ভূমিকায় নামি

কিন্তু মঞ্চে তখন অন্য অভিনয়

তাহলে আমাকে বাদ দাও, যেতে দাও।

(সানাউল হকের অনুবাদ)

সহায়ক রচনাপঞ্জি 

১. অসিত গুপ্ত, এই বিশ্বের কথা সাহিত্য

২. নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টপাধ্যায়, সাহিত্য নোবেল প্রাইজ ও বোরিস পাস্তেরনাক

৩.          বুদ্ধদেব বসু বরিস পাস্টেরনাক

৪.           বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত, ডাক্তার জিভাগো

৫.           সানাউল হক, বরিস পাস্তারনক : কবিতা

৬.          সোভিয়েট লিটারেচার, জুন ১৯৬৭

 লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button