আর্কাইভবইকথা

মোহীত উল আলমের বঙ্গবন্ধু : বাংলাদেশ

মিল্টন বিশ্বাস

বঙ্গবন্ধু : বাংলাদেশ (২০২১) মোহীত উল আলমের প্রবন্ধ সংকলন। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা, করোনাভাইরাস, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশ, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বিদ্যাসাগর, বাংলাদেশের ধর্মীয় সংস্কৃতি, সমাজ এবং সাম্প্রতিককালের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে স্বতন্ত্র দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা স্থান পেয়েছে যার সবগুলোই বর্তমান সময়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। লেখক বিভিন্ন প্রবন্ধে বিচিত্র মতামত প্রকাশ করেছেন। সবকিছুর মধ্য দিয়ে বলা চলে বাংলাদেশ পরিব্যাপ্ত হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সমাজ সংস্কৃতি এবং বাংলাভাষী মানুষ, বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব, সমাজ ও সংস্কৃতি এবং বাংলাদেশের মানুষের চিন্তা-ভাবনা বাংলাদেশের গতিপ্রকৃতি বর্তমান সময়ে বিভিন্ন পরিস্থিতি ইত্যাদি ছিল মূল লক্ষ্য।

মোহীত উল আলম এই গ্রন্থটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবর্ষে পদার্পণের মাহেন্দ্রক্ষণটি নিজের মতো করে নিজের দিক থেকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য রচনা করেছেন বলে জানিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু মহান মানুষ সেজন্য তাঁকে মূল্যায়ন করার কাজটি বেশ জটিল তারপরও অনেক চেষ্টা করেছেন নিজে কিছু করার জন্য। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা, সমাজ ও সংস্কৃতি শিক্ষা ও ধর্মসহ কিছু প্রাসঙ্গিক আলোচনা অন্তর্ভুক্ত করেছেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ওপর বেশ কিছু রচনা রয়েছে আলোচ্য গ্রন্থে। বেশকিছু প্রবন্ধে সমকালীন চিন্তাভাবনা তুলে ধরেছেন লেখক। বর্তমান সময়ে করোনাভাইরাসসহ বিভিন্ন মহামারির চিত্র এবং মানুষের মধ্যে এসব নিয়ে চিন্তাভাবনা, মানুষের সেবা প্রদানে বিভিন্ন চিকিৎসাব্যবস্থার অরাজকতা এবং দুর্বলতার বিভিন্ন দিক থেকে তুলে ধরা হয়েছে।

লেখক ৩৬টি প্রবন্ধের মাধ্যমে এই বইটি সাজিয়েছেন। এগুলোকে আবার বহুকৌণিকতায় বিভাজন করেছেন। বঙ্গবন্ধু, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, ভাষা, মুক্তিযুদ্ধ, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, করোনাভাইরাস নিয়ে প্রবন্ধগুলো উল্লেখযোগ্য। যেমন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা প্রবন্ধগুলোর মধ্যে ‘শতবর্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’, ‘বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের যুগান্তকারী ভাষণ’, ‘বঙ্গবন্ধু : প্রকৃত দেশপ্রেমের ছবি’, ‘ট্র্যাজিক নায়ক বঙ্গবন্ধু’ তথ্যসমৃদ্ধ। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখা প্রবন্ধগুলোর মধ্যে ‘রবীন্দ্রনাথ ও বাংলাদেশ : জাতীয়তাবাদের নতুন সংজ্ঞা’, ‘রবীন্দ্রনাথের অমরত্বের ধারণা’, ‘রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর’প্রভৃতি নতুন ধারণার জন্ম দেয়। নজরুলকে নিয়ে লেখা প্রবন্ধগুলোর মধ্যে ‘কবি নজরুলের বিদ্রোহী সত্তার স্বরূপ’ ‘কবি নজরুল জেগে আছেন আমাদের জীবনে’ গুরুত্ববহ। এছাড়া ‘উচ্চশিক্ষার সংকটের আয়তন এবং চেহারা’, ‘ভাতের দান’, ‘প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি অবহেলা’ এবং সংস্কৃতি বিষয়ক রচনাগুলোর মধ্যে ‘পহেলা বৈশাখের অর্থনীতি-সংস্কৃতির বলয়’, ‘সংস্কৃতির মিশ্রণ : সংঘাত ও বিকল্প’, ধর্ম নিয়ে রচিত প্রবন্ধগুলোর মধ্যে ‘ধর্মীয় অপপ্রচারের স্বরূপ’, ‘ঈদ সবার যদিও কিছু কিন্তু থেকে যায়’,  ‘চাঁদের এতো আলো : বুদ্ধপূর্ণিমা’ ও করোনাভাইরাস নিয়ে রচিত প্রবন্ধগুলোর মধ্যে ‘স্পর্শ-সংস্কৃতি : বাংলাদেশ : করোনাভাইরাস’, ‘করোনার যুগে স্বাধীনতা’ প্রভৃতি পাঠককে নিশ্চিতভাবে আলোড়িত করবে।

গল্পকার, কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও শিক্ষক মোহীত উল আলম সাহিত্যের বিভিন্ন অঙ্গকে ব্যবহার করে বঙ্গবন্ধু : বাংলাদেশ বইয়ের বিভিন্ন প্রবন্ধ সাজিয়েছেন। তিনি তুলে এনেছেন বাংলাদেশ ও বিশ্বের সংস্কৃতি এবং বিভিন্ন মানুষের সাহিত্য, বই, চিন্তা ভাবনা, গান ও কবিতার নানা অনুষঙ্গ। এই বইয়ের প্রত্যেক পাতায় পাতায় রচিত হয়েছে চিন্তার ফসল। একজন মানুষ হিসেবে তিনি নিজের মস্তিষ্ককে শানিত করেছেন নিজের দেখা জ্ঞানের আলোকে। শিক্ষাবিদ লেখক এই বইয়ের জন্য অমর হয়ে থাকবেন। বিভিন্ন বিষয় ব্যক্ত করার জন্য তিনি যে গদ্যভাষার আশ্রয় নিয়েছেন তা সহজ সরল। যা পড়ার সময় এক নিঃশ্বাসে শেষ করা যায়। এই বই পড়লে বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ, শিক্ষা, বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানার্জন হবে, সেই তলাবিহীন ঝুড়ির বাংলাদেশ থেকে বর্তমান উন্নয়নশীল দেশে পদার্পণের পেছনের মানুষের শ্রম এবং চিন্তা কর্ম জানা যাবে।

 মোহীত উল আলম বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ গ্রন্থটিতে বাঙালি ও বাংলাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চিরন্তন অবস্থান নির্ণয় করার চেষ্টা করেছেন। তাঁকে নিয়ে রচিত প্রবন্ধগুলোতে লেখক বলতে চেয়েছেন যে মানব সমাজের মৌলিক নিয়ন্ত্রণ চালিকা আসলে অর্থনীতি যদিও আদর্শভিত্তিক ঘেরাটোপে পড়ে অনেক সময় এই উপলব্ধি আমরা করতে পারি না। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সেটি করেছেন। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িক লাইনে বিভাজিত হয়ে গেলেও বঙ্গবন্ধু বুঝেছিলেন বাঙালি জাতির সংগ্রাম কেবল শুরু হয়েছে। তিনি ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের আন্দোলন শুরু করেন এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনায় অর্থনৈতিক স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা করার নিমিত্তে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন করলেন। এই আলোকেই রচিত ধর্ম বিষয়ক প্রবন্ধগুলোতে অসাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে মানবতার মেলবন্ধনের গুরুত্ব ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচিত প্রবন্ধগুলোতে রবীন্দ্রনাথের আন্তর্জাতিক মানবতাবাদী দর্শনের সঙ্গে বাংলাদেশের তথা বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক চেতনার একটি মেলবন্ধন তৈরির প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছে। কবি নজরুলের উপর রচিত প্রবন্ধগুলোতে সাম্প্রতিক সময়ে নজরুল বেঁচে থাকলে কী করতেন সে সম্পর্কে একটি ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন লেখক। এ বইটিতে শিক্ষাবিষয়ক প্রবন্ধগুলোতে মৌলিক এবং ক্ষেত্রবিশেষে এই সেক্টরের দুর্বলতাগুলোকে তুলে ধরা হয়েছে। করোনাভাইরাসের পরিস্থিতি নিয়ে রচিত প্রবন্ধগুলোতে সাধারণ কিছু সমস্যার সঙ্গে মহামারির সম্পর্ক আলোচিত হয়েছে। বর্তমান সময়ে মানুষের বিভিন্ন চেতনা নিয়ে লেখক আলোচনা করেছেন। এ দেশের মানুষের ধর্মীয় উৎসব, ধর্মীয় চেতনা সংস্কৃতির স্থান, বর্তমান সময়ে দেশের উন্নতির পেছনে প্রতিবন্ধকতাসমূহ এবং মানুষের চিন্তা-ভাবনা বিভিন্ন মানুষের ষড়যন্ত্র নিয়ে বিভিন্ন প্রবন্ধে আলোচনা করা হয়েছে।

‘শতবর্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ প্রবন্ধে লেখক বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি ধরে বলেছেন ‘যেদিন বঙ্গবন্ধু মারা যান সেদিন আমার কাছে মনে হয়েছিল আমার নিজের বাবা মারা গেছেন।’ এ প্রবন্ধে বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর জীবন ও কর্ম বাংলাদেশের জন্য, বাংলাদেশের মানুষের জন্য চিন্তা ও কাজ, বাংলাদেশকে স্বাধীনতার স্বপ্নের গোড়াপত্তন থেকে স্বাধীনতা এবং মৃত্যুর দিন পর্যন্ত বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন। ভারত-পাকিস্তান সৃষ্টির দিন থেকেই বঙ্গবন্ধু মনে করেছিলেন বাংলাদেশের মানুষকে আবার উপনিবেশে পরিণত করা হলো তাই তিনি নতুন আরেকটি দেশের স্বপ্ন দেখতেন। এজন্য তিনি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন। ভাষাভিত্তিক আন্দোলন শুরু করেন, মানুষকে একত্রিত করতে থাকেন, ধর্ম-সম্প্রদায় সংস্কৃতি বলয়ে সবাইকে এক কাতারে দাঁড় করান। ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম শব্দটি কর্তন করা হয় এবং এর ফলে দলটির অসাম্প্রদায়িক চরিত্র নির্দিষ্ট হয়। এরপর ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রদেশগুলোকে জোড়া লাগিয়ে যখন শুধু পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান নামে দুটি পদের সৃষ্টি করা হয় তখন বঙ্গবন্ধু অতিশয় খেদ নিয়ে বলেছিলেন, বেঙ্গল শব্দ টা তো ‘বে অফ বেঙ্গল’ ছাড়া আর কোথাও রইল না।’ (পৃ ১৬) তখন থেকেই তিনি বাংলা শব্দটাকে পৃথিবীর বুকে তুলে ধরার জন্য চেষ্টা করেছেন এবং বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে একটি দেশ ‘বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলাদেশকে নতুন একটি রাষ্ট্রে পরিণত করার যে কথা সেটা তিনি ছাত্র কর্মীকে নিয়ে কলকাতায় বসেই করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ‘আমাদের সব শেষ হয়ে গেছে বাঙালির অধিকার আদায়ে আবার নতুন করে সংগ্রাম করতে হবে।’ এসব তিনি বলেছিলেন পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পরপরই। আর বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তার যে জীবনের সংগ্রাম এবং জেল-জুলুম কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে সেটা মেনে নিয়েই তিনি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেন।

বাংলাভাষী অঞ্চলকে নিয়ে এ অঞ্চলের মানুষ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সংকটের কথা বলেছেন এবং সংকট থেকে উত্তরণের জন্য একজন মানুষের কথা চিন্তা করেছিলেন। তিনি আসবেন মানুষের ত্রাণকর্তা হিসেবে এদেশের মানুষের স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করবেন। এদেশের মানুষকে একটি স্বাধীন দেশ দেবেন, স্বাধীন মুক্ত জীবন দেবেন। বঙ্গবন্ধু সেই ব্যক্তি যিনি বাংলার মানুষকে একটি স্বাধীন দেশ দিয়েছেন মুক্ত জীবন দিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশের পরিত্রাণদাতা।

‘বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের মার্চের যুগান্তকারী ভাষণ’ প্রবন্ধে স্বাধীনতা এবং সে ভাষণের তাৎপর্য তুলে ধরেছেন বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে। কেন তিনি সেদিন স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি, স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে সেদিন বাংলাদেশের মানুষের কি অবস্থা হতো সেসব বিষয় তুলে ধরে এই ভাষণকে তিনি যুগান্তকারী ভাষণ বলে উল্লেখ করেছেন। অলিখিত মাত্র ১৯ মিনিটের ভাষণ পৃথিবীর ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে―এজন্য তিনি রাজনীতির কবি হিসেবে অভিহিত। একজন মানুষ দেশকে কতটা ভালোবাসলে এমন বক্তৃতা দিতে পারেন, নিজের জীবন উৎসর্গ করতে পারেন, নিজের জীবনের মায়া না করে দেশ ও দেশের মানুষের কথা চিন্তা করেন তা এই ভাষণের তাৎপর্য। লেখক  এ প্রবন্ধে দুটি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করেছেন তাহলো স্বাধীনতা এবং মুক্তি। স্বাধীনতা আর মুক্তি এক বিষয় নয় সেটা তিনি সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। ‘বঙ্গবন্ধু প্রকৃত দেশপ্রেমের ছবি’ প্রবন্ধে লেখক বঙ্গবন্ধুর মানুষের প্রতি ভালোবাসার চিত্র তুলে ধরেছেন। বঙ্গন্ধু মানুষকে এতটাই ভালোবাসতেন যে তিনি নিজে বলেছিলেন, ‘ক্ষুধার্ত মানুষের গ্রাস যারা কেড়ে নেয় তারা মানুষ নয়, মানুষ রুপী পশু।’ বাংলার দুখী মানুষের জন্য বঙ্গবন্ধু সারাজীবন কাজ করেছেন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, এদেশের মানুষ শিক্ষিত, কেউ জ্ঞানহীন নয়, বোধ সম্পন্ন জনতা। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু দেখেছেন এ দেশের মানুষকে উন্নত করে দেশকে উন্নত করতে হলে একমাত্র পথ কৃষিখাত। কৃষি সেক্টরকে উন্নত  করলে মানুষ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে, মানুষের অভাব দূর হবে, মানুষ খাবার পেয়ে বেঁচে থাকবে। আর এসব কাজে যারা নিয়োজিত তাদেরকে সবার উপরে স্থান দিয়েছেন। তাদেরকে কেউ যেন অবহেলা না করে সেদিকে দৃষ্টি দিয়েছেন।

স্বাধীনতার পর অন্নদাশংকর রায় বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন বাংলাদেশের আইডিয়াটা ঠিক কখন বঙ্গবন্ধুর মাথায় এসেছে। এর উত্তরে তিনি বলেছিলেন যেদিন পাকিস্তান হয়েছে সেদিন থেকে। এভাবেই বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি জীবনের কথা উল্লেখ করেছেন লেখক। এ থেকে বোঝা যায় বঙ্গবন্ধু ছাত্রজীবন থেকেই এ বাংলার মানুষের জন্য একটি স্বাধীন দেশের কথা চিন্তা করতেন।

‘রবীন্দ্রনাথ ও বাংলাদেশ : জাতীয়তাবাদের নতুন সংজ্ঞা’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের দেশপ্রেমের কথা, স্বাধীন বাংলাদেশের কথা উঠে এসেছে। এদেশের মানুষ ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করে নিজেদের পরাধীন করে রেখেছিল সেই কথা বঙ্গবন্ধু রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন বই পাঠের মাধ্যমে জানতে পারেন। রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন যতদিন হিন্দু মুসলমান তাদের মধ্যকার শত্রুতাকে বজায় রাখবে ততদিন স্বাধীন বাঙালি স্বাধীন জাতি হিসেবে গড়ে উঠতে পারবে না। রবীন্দ্রনাথ নিজেও বাংলাকে একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে দেখতে চেয়েছেন বঙ্গবন্ধুর যে স্বাধীন দেশের স্বপ্ন তা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেখা সেই স্বপ্ন। আর তা জানতে পেরেছিলেন কবির বই পাঠের মাধ্যমে। বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কবিগুরুর সেই কথা উল্লেখ করেছিলেন এক ভাষণে। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ‘সাত কোটি বাঙ্গালীরে হে বঙ্গ জননী রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি, কবিগুরুর কথা আজ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে আমার বাঙালি আজ মানুষ।’ রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশকে আমার সোনার বাংলা বলে উল্লেখ করেছেন।

‘রবীন্দ্রনাথের অমরত্বের ধারণা’ প্রবন্ধে লেখক উল্লেখ করেছেন রবীন্দ্রনাথের মানুষের মাঝে অমর হয়ে থাকার কথা। মানুষ তার কর্মের মাধ্যমে পৃথিবীতে অমর হয়ে থাকেন। তার কর্ম তাকে বাঁচিয়ে রাখে যুগ যুগ ধরে। কত মানুষ তার কাজের মাধ্যমে পরবর্তী মানুষের মনে বেঁচে আছেন এবং বেঁচে থাকবেন সেই অমরত্বের ধারণা রবীন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন শিক্ষার মাধ্যমে। রবীন্দ্রনাথের সাথে বঙ্গবন্ধুর জীবনের মিল সে দিক থেকে। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য-সৃষ্টির মাধ্যমে আমাদের মাঝে বেঁচে আছেন জীবন্ত হয়ে আছেন, বঙ্গবন্ধু তেমনি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের প্রাণে এমনকি বিশ্বের মানুষের কাছে জীবন্ত কিংবদন্তি। এই ধারণা মানুষ যুগ যুগ ধরে ধারণা করে আছে―এগুলো উল্লেখ করতে প্রাবন্ধিক শাহজাহানের প্রেমের কাহিনি তুলে ধরতে ভোলেননি। মানুষের জীবন সংক্ষিপ্ত কিন্তু তার কর্ম অনেক দিন বেঁচে থাকে আর এর মাধ্যমেই মানুষ বেঁচে থাকে। যেমন বেঁচে আছেন রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। রবীন্দ্রনাথ নিজে বলেছেন ‘তোমার সৃষ্টির চেয়ে তুমি যে মহৎ।’ কর্মের মাধ্যমেই মানুষ জীবন্ত হয়ে থাকে।

‘রবীন্দ্রনাথের চোখে বিদ্যাসাগর’ প্রবন্ধে লেখক দেখিয়েছেন বিদ্যাসাগরের লেখায় অনুপ্রাণিত ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সাহিত্য ও জ্ঞানচর্চার বিভিন্ন বিষয়ে বিদ্যাসাগরের লেখায় যেভাবে চিন্তা-চেতনা প্রকাশ পেয়েছে―রবীন্দ্রনাথ সেগুলো তুলে ধরেছেন। মোহীত উল আলম বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বলেছেন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলার মানুষের জন্য যে কাজ করেছেন, ভারতবর্ষের স্বাধীনতার চিন্তা করেছেন, বিধবা বিবাহ নিয়ে কাজ করেছেন, ধর্ম সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করেছেন, হিন্দু-মুসলিম এককথায় অসাম্প্রদায়িক দেশের কথা চিন্তা করেছেন, মানুষের সাথে মানুষের ভালোবাসার কথা চিন্তা করেছেন, রবীন্দ্রনাথ ঠিক একই ধরনের শিক্ষা পেয়েছিলেন বিদ্যাসাগরের লেখনি থেকে,  বঙ্গবন্ধু তাদের মাধ্যমে পরম্পরা পেয়েছেন সেই চেতনা। বিদ্যাসাগরের সময় বাল্য বিবাহ রোধ হয়েছে, সমাজে স্বাধীনভাবে চলার পথ পেয়েছে, বহুবিবাহ রদ হয়েছে, বিদ্যাসাগরের প্রেরণায় মানুষ স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল তারই ফলে ভারত স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় ইত্যাদি বিষয় তুলে ধরেছেন।

‘কবি নজরুলের বিদ্রোহী সত্তার স্বরূপ’ প্রবন্ধে নজরুলের বিদ্রোহী হওয়ার চিত্র ফুটে উঠেছে। বিদ্রোহী কবিতা যে মানুষের মাঝে আমিত্বকে জাগ্রত করে, আমি আমার প্রেরণা, আমি সবার চেয়ে উচ্চশির এই চিন্তা ধারণ করতে বলেছিলেন এবং দেশকে স্বাধীনতার পথে এগিয়ে নিতে বলেছিলেন, শত্রুমুক্ত করতে চেয়েছিলেন সেই পথ নজরুল দেখিয়েছিলেন । সেই পথ ধরেই পরবর্তী কালে মানুষ আন্দোলন শুরু করে একটি স্বাধীন দেশের। মানুষ বিদ্রোহী হয়ে ওঠে ইংরেজদের তাড়ানোর জন্য। বাংলার মানুষ, ভারতবর্ষের মানুষ স্বাধীন উন্নত শির হিসেবে বিশ্বকে জানান দেয় এবং একটি স্বাধীন দেশ সৃষ্টি হয়। যুগে যুগে বিভিন্ন মানুষের আগমন ঘটে ত্রাণকর্তা হিসেবে নজরুল সেই হিসেবে বাংলার তথা ভারতবর্ষের বুকে এসেছিলেন। তাঁর লেখনীর মাধ্যমে ফুটে উঠেছে সেই বিদ্রোহী। বিদ্রোহী কবিতার ১০০ বছরপূর্তি উপলক্ষে লেখক নজরুলের বিদ্রোহী কবিতার সমালোচনা লিখেছেন। নজরুল বলেছিলেন পূর্ণ স্বাধীনতা পেতে হলে সকলের আগে আমাদের বিদ্রোহ করতে হবে, সকল কিছু নিয়ম-কানুন বাঁধন শৃঙ্খলা মানা নিষিদ্ধের বিরুদ্ধে। আর এই বিদ্রোহ করতে হলে সকলের আগে আপনাকে চিনতে হবে। বুক ফুলিয়ে বলতে হবে -আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ। বিভিন্ন শব্দ দিয়ে নজরুল বিদ্রোহী কবিতা সাজিয়েছেন তা নিয়ে গভীরভাবে আলোচনা করেছেন প্রাবন্ধিক। নজরুলের প্রভাবে বাংলার মানুষ স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখতে থাকে এবং একটি স্বাধীন দেশ পেয়ে যায় বিভিন্ন সংগ্রামের মাধ্যমে।

‘উচ্চশিক্ষার সংকটের আয়তন এবং চেহারা’ প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করেছেন। শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড, শিক্ষা ছাড়া কোনও জাতি উন্নত হতে পারে না কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা প্রাবন্ধিকের পছন্দ হয়নি। তিনি শিক্ষা বলতে যেটা বুঝিয়েছেন সেটা বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে যায় না। তিনি মাতৃভাষায় শিক্ষা প্রদানের কথা বলেছেন এবং জোরদারের কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন কোনও জাতি নিজের ভাষায় শিক্ষা ছাড়া উন্নত হতে পারে না। তবে বিশ্বকে জানার জন্য বিভিন্ন ভাষা শিক্ষা জরুরি। তবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তিনি মাতৃভাষায় দেওয়ার পক্ষপাতী। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে সঠিক শিক্ষা হচ্ছে না তার ওপর জোর দিয়েছেন তিনি এবং প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা এবং শিক্ষকের মর্যাদার কথা তুলে ধরেছেন।

‘ভাতের দান’ প্রবন্ধে মোহীত উল আলম বাংলাদেশের মানুষের কথা বলেছেন, কৃষকের কথা লিখেছেন, কৃষিতে ফসল উৎপাদনের কথা বলেছেন, এদেশের মানুষ প্রধান খাদ্য হিসেবে ভাতকে বেছে নিয়েছে এবং ভাতকে জীবনে বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে ধান চাষের কথা বলেছেন এবং এসব ধান চাষিরা বাংলার  কোটি মানুষের মুখে অন্ন জুগিয়েছে। কিন্তু কিছু মানুষ সেই কৃষকদের ঘৃণা করে, কৃষিতে উন্নতির কথা বলে না, কৃষিকাজে মানুষকে অনুপ্রাণিত করে না, বঙ্গবন্ধু তাদের সম্মানের কথা বলেছিলেন এবং বর্তমান সময়ে কৃষির দুরবস্থার কথা, উন্নতির কথা সেগুলো বলা হয়েছে বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ বলেই। সেই প্রাচীনকাল থেকে কৃষি কাজের মাধ্যমে মানুষ জীবন পরিচালনা করছে। বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত, খাদ্য অথবা যে কোনও কারণের জন্য সেই কৃষিকাজের বিশ্লেষণ করে ভাতের কথা উল্লেখ করা এজন্যই স্বাভাবিক।

‘পহেলা বৈশাখের অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক বলয়’ প্রবন্ধে বাংলাদেশের পহেলা বৈশাখ কেন্দ্রিক সংস্কৃতির একটা দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন লেখক। পহেলা বৈশাখের আগমন, পহেলা বৈশাখে মানুষের জীবন এবং সংস্কৃতির ধারা কীভাবে এসেছে সেগুলো নিয়ে বিশ্লেষ করে প্রাবন্ধিক উল্লেখ করেছেন এই পহেলা বৈশাখ বাঙালি জাতির প্রাচীন ইতিহাস এবং সেটাকে আন্তর্জাতিক একটি উৎসবের দিন হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করতে হবে। উৎসবটিকে সার্বজনীন করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন তিনি। মাছে ভাতে বাঙালির পহেলা বৈশাখ বাংলাদেশের সংস্কৃতির মূল কেন্দ্র। দিনটিতে বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষও ভালোবাসার কথা বলছে, এক কাতারে দাঁড়াচ্ছে। এ দিনের মতো সারা বছর মানুষ অসাম্প্রদায়িক চেতনায় জীবন-যাপন করবে এই অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন লেখক বিভিন্ন অনুষঙ্গ উপস্থাপনের মাধ্যমে।

করোনাভাইরাস নিয়ে লেখা প্রবন্ধগুলোতে প্রাবন্ধিক করোনা ভাইরাসের সময়ে দেশের মানুষের সংকটের কথা, জ্ঞানের কথা, চিকিৎসাব্যবস্থায় দুর্দিনের কথা বলেছেন এবং বাংলাদেশের মানুষ করোনাভাইরাসকে নিয়ে যে ভয়াবহ সংস্কৃতি তৈরি করেছে সেগুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন। করোনাভাইরাসের চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং সমালোচনাও করেছেন বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে।

মূলত মোহীত উল আলম বঙ্গবন্ধু : বাংলাদেশ গ্রন্থে নিজের মতামত নিজের মতো করে উপস্থাপন করেছেন। গ্রন্থটি পাঠককে নিয়ে যাবে উন্নতির সোপানে আরোহিত বাংলাদেশের জীবন্ত গল্পের অন্তরলোকে। বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে নেতৃত্বের আলোতে সমৃদ্ধ শেখ হাসিনার বাংলাদেশ গৌরবে আসীন। এই গৌরব অর্জনের পেছনের কাহিনিও জানা যাবে গ্রন্থটি পাঠ করলে।

লেখক : প্রাবন্ধিক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button