আর্কাইভপ্রচ্ছদ রচনা

কবিতার ভাষা : কামাল চৌধুরী

প্রচ্ছদ রচনা : বাংলা ভাষা

আমরা সবসময় বলি, কবিকে তার নিজস্ব কাব্যভাষা তৈরি করতে হবে। বলি রবীন্দ্রনাথের ভাষা আলাদা, সকল বড় কবিরই ভাষা আলাদা। এ ভাষা আসলে কী ? আমরা সবাই জানি এটি কাব্যভাষা, মাতৃভাষা নয়। এই ভাষা কীভাবে আলাদা হয় ? ভাষা আমাদের সংস্কৃতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ আর আমরা যখন মাতৃভাষায় সাহিত্য রচনা করি তাতে আমাদের সংস্কৃতির রূপও প্রতিফলিত হয়। প্রতিটি জাতি-গোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা আছে, লিখিত রূপ না থাকলেও অন্তত কথ্যরূপ আছে। ভাষার প্রমিত, মৌখিক, আঞ্চলিক নানা রূপ আছে―বলা হয় কবিতা ভাষার মাধ্যমে কথা বলে কারণ কবিতা ভাষার সকল উপাদান একসঙ্গে ধারণ করতে পারে―সাহিত্য বা শিল্পকলার অন্য কোনও মাধ্যম এভাবে সামগ্রিকভাবে ভাষাকে ধারণ করতে পারে না। ভাষার ভেতরে শুধু বর্ণ, ধ্বনি, অক্ষর নয়―এর ভেতরে আছে শব্দার্থ ও নিহিতার্থ, গতি, ছন্দ, চিত্রকল্প, উপমা, রূপক, উৎপ্রেক্ষা; জীবন-যাপনের অভিজ্ঞতা, সমকাল এবং আগামীর স্বপ্ন―সবকিছু। এসবই আমাদের চারপাশে আছে―যেগুলো আমাদের অতি পরিচিত, চেনা। কবি এ থেকেই শব্দচয়ন করেন, শব্দকে নবরূপ দেন। কবির কবিতায় আলাদা এক স্বর তৈরি হয় তা থেকে জন্ম নেয় স্বতন্ত্র এক কণ্ঠস্বর যাকে আমরা কাব্যভাষা বলি। এ কাজটা করতে গেলে কবিকে গভীর অভিনিবেশ সহকারে আত্মস্থ করতে হয় ভাষার অন্তর্হিত উপাদান। নিজস্ব ভাষা তৈরি করতে গেলে চেনা জগৎকে আলাদা রূপ দিতে হয়―কবি কীভাবে কাজটি করবেন তা কবির নিজস্ব কাব্য ক্ষমতার উপর নির্ভর করে। এজন্য বহু কবি হারিয়ে যান, কেউ কেউ জীবন্ত থাকেন পাঠক হৃদয়ে।

ইংরেজিতে একটা শব্দ আছে diction―এর অর্থ শব্দ নির্বাচন বা বাছাই। বলা হয় এটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ ফরপবৎব থেকে। কালক্রমে এর অর্থ দাঁড়িয়েছে কোনও কিছু শব্দ দিয়ে প্রকাশ করার পদ্ধতিতে। ফরাসি কবি মালার্মে বলেছেন, ‘শব্দই কবিতা’ বস্তুত শব্দের মাধ্যমেই প্রাণ পায় কবিতা। শব্দের ভেতরে যে অপরিমেয় ঐশ্বর্য, কবি এর ভেতরে অবগাহন করেন সৃজনক্ষমতা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে। আমেরিকান কবি ম্যারি অলিভার ডিকশনের তিনটি উপাদানের কথা বলেছেন : শব্দ, শব্দের যথার্থতা এবং নিহিতার্থ। কবিকে যেমন শব্দ খুঁজতে হয়, তেমনি শব্দকে হতে হয় যুৎসই। শব্দের জন্য কোনও লাগসই, টেকসই প্রযুক্তি নেই। কিন্তু শব্দ কবিতার সঙ্গে মেলাতেই হয়। শব্দের যথার্থতাও আপেক্ষিক―কবিভেদ নানা রূপ হতে পারে কিন্তু কবিকে যথার্থ শব্দ ব্যবহারেরর ওপর গুরুত্ব দিতেই হয়। অমিয় চক্রবর্তী লিখেছিলেন ‘মেলাবেন তিনি ঝোড়ো হাওয়া আর/ পোড়ো বাড়িটার/ ঐ ভাঙা দরজাটা।/ মেলাবেন।’―বৈপরীত্যকেও এভাবে মেলাতে হয় কবিতায়। সেইসঙ্গে শব্দের বা বাক্যের আভিধানিক অর্থের বাইরে বিস্তার ঘটাতে হয় কবিতার। নদীর শব্দ সবসময় জলের শব্দ নয়―এটি গতিরও শব্দ, প্রবাহেরও শব্দ। সব শব্দের যেমন অন্তর্নিহিত ধ্বনি আছে তেমনি ভিন্ন অর্থও আছে―এই নিহিতার্থের উন্মোচন ঘটাতে হয় কবিতায়। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলেছেন, ‘মানচিত্রের ভেতর ছোট জায়গার মধ্যে গোটা পৃথিবীতে যেমন ধরে দেওয়া যায় তেমনি শব্দের মধ্যে গোটা পৃথিবী আঁটিয়ে নেওয়া যায়।’

বাংলা ভাষায় শব্দসংখ্যা আনুমানিক দেড় লক্ষ। এতে প্রমিত শব্দের পাশাপাশি আঞ্চলিক শব্দ, তৎসম, তদ্ভব, দেশি ও বিদেশি শব্দ আছে। এর সঙ্গে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষাও আছে। কিন্তু কবিতায় সব শব্দ ব্যবহৃত হয় না। সকল লেখকের নিজস্ব সক্রিয় শব্দভাণ্ডার থাকে। কবি পছন্দমতো কিছু শব্দ ব্যবহার করেন। ইদানীং কবিতায় আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার শুরু হলেও মূলত প্রমিত বা মান ভাষাই বেশি ব্যবহৃত হয়। কবি কোন ভাষা ব্যবহার করবেন সেটি তার বিবেচ্য। তবে কবি শুধু শব্দচয়ন করেন না, কবি শব্দ নির্মাণও করেন―সকল শক্তিমান কবির ভেতর নতুন শব্দ নির্মাণ, শব্দ ভাঙার প্রবণতা থাকে। মধুসূদন দত্তের লেখায় এ উদাহরণ প্রচুর। মোহিতলাল মজুমদার ‘কবি শ্রী মধুসূদন ‘গ্রন্থে দৃষ্টান্ত সহযোগে দেখিয়েছেন কীভাবে মধুসূদন অপরিচিত ও অতিপরিচিত শব্দ এক বন্ধনে বেঁধেছেন, সামান্য আকার পরিবর্তন করে পুরাতন শব্দে নতুনত্ব দিয়েছেন। ‘কৃশকটিদেশে, ’ ‘নিতম্ব-বিম্বে, ‘হৈমবতী পুরী,’ ‘অনম্বর পথে’ এ ধরনের অনেক শব্দ তিনি কবিতায় ব্যবহার করেছেন। এসব করতে গিয়ে তিনি আভিধানিক রীতি ক্ষুণ্ন করেও শব্দ তৈরি করেছেন। যেমন মুক্তিল, বৃষ্টিল, হিল্লোলিছে, পুষ্পিয়া―এভাবে ক্রিয়াপদ ভেঙেছেন। শব্দ প্রয়োগের এই অভিনবত্ব শব্দ ও ধ্বনিতে ভিন্ন ব্যঞ্জনা এনেছে।

বোর্হেস লিখেছেন যখনই তিনি সাদা পাতায় লিখতে যান―মনে হয় তার নিজের জন্যই সাহিত্যিকে নতুন করে আবিষ্কার করতে হবে। এভাবেই নব আবিষ্কারের নেশায় প্রতিটি কবিতার পেছনে কবি সক্রিয় থাকেন। আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা চেনা জগত থেকে কবিকে শব্দ আহরণ করতে হয়, বাছাই করতে হয় তার কাক্সিক্ষত শব্দ। সেজন্য শব্দগুলো বাজিয়ে নিতে হয়। অনেকটা তুড়ি বাজিয়ে দেখার মতো। এভাবে শব্দ ও কবির মাঝখানে একটা আন্তরিক সম্পর্ক তৈরি হয়। যেখানে শব্দ ও কবির যুগলবন্দি-জগৎ তৈরি হয়। শব্দের ধ্বনিরূপ ও চিত্রময়তার জগতে পরিভ্রমণ কবির আত্মবিশ্বাসও সৃষ্টি করে। এ আত্মবিশ্বাস কবিকে তার নিজের পছন্দের শব্দ নানাভাবে ব্যবহারের সক্ষমতা দেয়। অনেক কবির কবিতায় বহু শব্দ বারবার ঘুরে ফিরে আসে। নানা অর্থে এই শব্দ ব্যবহৃত হয়। ভাষা বা শব্দ ব্যবহারে এ স্বাতন্ত্র্য কাব্যভাষাকে আলাদা রূপ দেয়।

শব্দের ভেতরেই ধ্বনি থাকে। ধ্বনি বুঝতে হলে ধ্বনিবিজ্ঞান জানা কবির জন্য জরুরি নয়―কবির প্রয়োজন ধ্বনি সৃষ্টির জন্য শব্দ অন্বষণের কৌশল জানা, শব্দের নিহিতার্থ বোঝা। কবিকে সেই ধ্বনি তৈরি করতে হয়―সে ধ্বনি অনুরণিত হবে কবিতায়, পাঠক হৃদয়ে। এ ধ্বনি আকস্মিক বিষয় নয়। হঠাৎ বজ্রপতনের শব্দ নয়―নির্বাচিত শব্দ। সব শব্দ একরকম নয়―পুকুরে টিল ছোড়ার শব্দ, পাথরে আঘাত করার শব্দ, বৃষ্টি পতনের শব্দ, গুলির শব্দ―এসব এক নয়। শব্দের তীব্রতাও এক নয়। সে জন্য কবিকে শব্দ বাছাই করতে হয়। তা থেকে আনতে হয় ধ্বনি বৈচিত্র্য। এর মাধ্যমে শব্দ বা ধ্বনির সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের সংযোগ ঘটাতে হয়।

কেউ যদি প্রথাগত ছন্দে কবিতাকে সাজাতে চান সেখানে মাত্রার হিসাবে শব্দ বা ধ্বনি বিন্যাস করতে হয়। কিন্তু একই ছন্দরীতি অনুসরণ করলেও কবিতার ভাষা এক হয় না। সমকালের কবিরা অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত, স্বরবৃত্ত, মুক্তছন্দ, গদ্য সব ছন্দেই লেখেন কিন্তু ভাষা আলাদা। কবিকে তাই বিকল্প ভাষাও খুঁজতে হয়। অনুশীলন করতে হয় বিকল্প শব্দ, পঙ্ক্তির জন্য। কবিকে ভাষা খুঁজতে হয় মুখের ভাষায়, সামাজিক অসাম্য, ভালবাসা, ক্ষুধা, দারিদ্র্য সবকিছু থেকে। এ জন্য অনুশীলনও জরুরি।

বর্তমান সময়ের কবিতা সৃজন ও মননের সমাহার, যুগপৎ স্বতঃস্ফূর্ত ও বুদ্ধিদীপ্ত। তাই অনুশীলনের মাধ্যমে কবিতাকে স্বাভাবিক কবিতায় রূপান্তর করতে হয়। এ কাজ করতে হয় সচেতনভাবেই, কারণ এ থেকেই কবি ও কবিতার কণ্ঠস্বর আলাদা হয়ে যায়।

আমরা ‘স্বভাব কবিতা’, ‘স্বতঃস্ফূর্ত কবিতা’―এ ধরনের কবিতার কথা বলি। যেমন চারণ কবিদের কবিতা স্বভাব কবিতা হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। আবার কোনও কেনও কবিকে (যেমন গোবিন্দ দাস) স্বভাব কবিও বলা হয়। স্বভাব কবিতায় আবেগ আছে, তাৎক্ষণিকতা আছে। তবে মুখের ভাষা আর কবিতার ভাষা সবসময় সমরূপ নয়। শিল্প সৃষ্টি করতে হলে আবেগ, স্বতঃস্ফূর্ততা এসবের সঙ্গে কিছু যোগ করতে হয়। প্রবোধচন্দ্র সেন তাঁর ‘ছন্দ পরিক্রমা’ গ্রন্থে লিখেছেন ‘স্বভাবকে অনুবর্তন করেও তাকে অতিক্রম করে যাওয়ার মধ্যেই শিল্পের সার্থকতা।’ বুদ্ধদেব বসু সাহিত্যচর্চা গ্রন্থে লিখেছেন, “একথা সত্য যে কবিতায় আবেগের তাপ না থাকলে কিছুই থাকল না কিন্তু সেই আবেগ পাঠকের মনে পৌঁছে দিতে হলে তার দাস হলে চলে না, তাকে ছাড়িয়ে গিয়ে শাসন করতে হয়। এই শাসন করার, নিয়ন্ত্রণ করার শক্তি যেখানে নেই, সেখানেই এই বিশেষ অর্থে ‘স্বভাব কবিত্ব’ আরোপ করতে পারি।” সুধীন্দ্রনাথ দত্ত এ জন্যই অনুশীলনের মাধ্যমে কবিতাকে স্বাভাবিক কবিতায় রূপান্তরের কথা বলেছেন। অনুশীলন সকল কবিই করে থাকেন। এর মাধ্যমেই কবিতা স্বাভাবিক কবিতায় রূপ নেয়। সেটাই প্রকৃত কবিতা। তবে অনুশীলনে জন্য কবিতার কৌশল সম্পর্কে জানা প্রয়োজন।

কবিতা মূলত কবির নিজস্ব পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতাজাত। সেই সঙ্গে যোগ হয় স্বপ্ন কল্পনা। এটি সকল কবির ক্ষেত্রই প্রযোজ্য, কখনও কখনও সামাজিক সংকটে সময়ের অভিঘাতে কবিতায় সমষ্টির প্রবণতা প্রতিধ্বনিত হয়―সে প্রবণতা থেকে সময়ের আবেগ, সময়ের কবিতাকে চিহ্নিত করা করা সম্ভব হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কবিতারও পরিবর্তন হয়, রবীন্দ্রনাথ একে বলেছেন, ‘ঋতু পরিবর্তন―সময়ের প্রবাহে নানা অনুষঙ্গ ভিড় করে, ভাষা পরিবর্তন হয়।’ রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘আমার কাব্যের ঋতু পরিবর্তন ঘটেছে বারে বারে। প্রায়ই সেটা ঘটে নিজের অলক্ষ্যে। কালে কালে ফুলের ফসল বদল হয়ে থাকে। তখন মৌমাছির মধু-জোগান নতুন পথ নেয়। ফুল চোখে দেখবার পূর্বেই মৌমাছি ফুলগন্ধের সূক্ষ্ম নির্দেশ পায়, সেটা পায় চার দিকের হাওয়ায়। যারা ভোগ করে এই মধু তারা এই বিশিষ্টতা টের পায় স্বাদে। কোন কোন বনের মধু বিগলিত তার মাধুর্যে, তার রঙ হয় রাঙা; কোন পাহাড়ি মধু দেখি ঘন, আর তাতে রঙের আবেদন নেই, সে শুভ্র; আবার কোন আরণ্য সঞ্চয়ে একটু তিক্ত স্বাদেরও আভাস থাকে।’

কাব্যে এই যে হাওয়াবদল থেকে সৃষ্টিবদল―এ তো স্বাভাবিক, এমনই স্বাভাবিক যে এর কাজ হতে থাকে অন্যমনে। কবির এ সন্বন্ধে খেয়াল থাকে না। বাইরে থেকে সমজদারের কাছে এর প্রবণতা ধরা পড়ে।

এ সমজদারই প্রকৃত পাঠক। তার কাছে পৌঁছাতেই হবে কবির কণ্ঠস্বর।

বাংলা কবিতায় বিদ্রোহী ঘারানা সৃষ্টি করেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর সমকালে কবিতার আলাদা এক ভাষা নিয়ে তিনি আলোড়ন তুলেছিলেন। আমরা দেখি নজরুল ঔপনিবেশিকতার শৃঙ্খল আবদ্ধ সমাজের মুক্তির আকাক্সক্ষাকে রূপায়িত করতে গিয়ে সংগ্রাম আন্দোলনের সমান্তরাল শব্দ বাছাই করেছেন। মানব, জয়ধ্বনি, শৃঙ্খল, দাবানল, সাম্য, জাগরণ, মুক্তি কবিতায় এ ধরনের শব্দ প্রাধান্য পেয়েছে। এছাড়া যৌগিক শব্দ সৃজনের দিকে ছিল তাঁর ঝোঁক। যেমন―চির বিস্ময়, চির উন্নত, চির দুর্জয় ইত্যাদি। পরবর্তীসময়ে এ ধারার কবিতা গতি পেয়েছে সুকান্ত ভট্টাচার্য, সুভাষ মুখাপাধ্যায়সহ অনেকের লেখায়। কিন্তু প্রত্যেকের ভাষাই আলাদা। সমকালের রাজনীতি ও ক্ষোভ এসেছে ভিন্নভাবে।

বিদ্রোহী কবিতায় নজরুল লিখছেন―

আমি মানব দানব দেবতার ভয়

বিশ্বের আমি চির দুর্জয়

চল্লিশের দশকে সুকান্ত লিখেছেন―

আদিম হিংস্র মানবিকতার যদি আমি কেউ হই

স্বজনহারানো শ্মশানে তোদের

চিতা আমি তুলবই

সেখানে একই সময়ে সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন―

প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য

ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা

তিন জনের কণ্ঠই বিদ্রোহী, কণ্ঠস্বর কিন্তু আলাদা। এই আলাদ কণ্ঠস্বর চিনতে কোনও অসুবিধে হয় না।

প্রসঙ্গক্রমে জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ কবিতা থেকে দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়―

বনলতা সেন

হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে

সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে

অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে

সেখানে ছিলাম আমি; আরও দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে

আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন

আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।

চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা

মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের ’পর

হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা

সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর

তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন ?’

পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।

সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন

সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল

পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন

তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল

সব পাখি ঘরে আসেÑসব নদীÑফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন

থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।

শব্দ চয়ন, শব্দের নিহিতার্থ বহুমাত্রিকভাবে ব্যবহার করার প্রকৃষ্ট উদাহরণ এ কবিতা। কবি ‘বনলতা সেন’ কবিতায় শুধু অন্ধকার শব্দটি ব্যবহার করেছেন ৫ বার। আবার এক পঙ্ক্তি এসেছে ‘পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে ‘এভাবে। ‘অন্ধকার’ শব্দটি এতবার ব্যবহার না করে বিকল্প শব্দ ব্যবহার করতে পারতেন―কিন্তু তিনি তা করেননি। তাঁর শব্দ চয়নে, প্রতীক ও উপমা ব্যবহারের পৌনঃপুনিকত আছে, শিথিলতা আছে কিন্তু কবিতায় আছে এক আবিষ্ট করা কণ্ঠস্বর। শিশিরের শব্দ, অন্ধকার, পেঁচা, আঘ্রাণ, বুনোহাঁস, জোৎস্না―এসব শব্দ এসেছে নানা অনুভবে ও ব্যঞ্জনায়। কবিতায় ব্যবহৃত ‘হাজার বছর’ শব্দটি আমরা অন্য কবিতায়ও পাই। অর্থাৎ এ কবিতায় ব্যবহৃত শব্দ তাঁর নিজ পছন্দ―এ থেকে তাঁর কবিতার যে ভাষা আমরা খুঁজে পাই, তাতে কবির ইতিহাস চেতনা, নিসর্গ, সময়, প্রেম ও মৃত্যুচিন্তা একাকার হয়ে আছে। সেই সঙ্গে অক্ষরবৃত্তের প্রলম্বিত লয়ের পাশাপাশি এক অন্তর্গত যাত্রার ধ্বনিও পাই আমরা। এ কবিতায় তিনি অনুপ্রাসের ব্যবহার করেছেন চমৎকারভাবে :

‘চুল তার কবেকারÑঅন্ধকার বিদিশার নিশা।’

তার-কার-কার-শারÑঅনুপ্রাসের এ ঝংকার পাঠকেকে মোহিত করে।

ধ্বনি-বৈচিত্র্য বোঝার জন্য শক্তি চট্টাপোধ্যায়ের ‘জরাসন্ধ’ কবিতা থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি―

আমাকে তুই আনলি কেন, ফিরিয়ে নে।

যে মুখ অন্ধকারের মতো শীতল, চোখ দুটি রিক্ত হ্রদের মতো কৃপণ করুণ, তাকে তোর মায়ের হাতে ছুঁয়ে ফিরিয়ে নিতে বলি। এ মাঠ আর নয়, ধানের নাড়ায় বিঁধে কাতর হলো পা। সেবন্নে শাকের শরীর মাড়িয়ে মাড়িয়ে আমাকে তাই আনলি কেন, ফিরিয়ে নে।

[জরাসন্ধ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়]

এ কবিতা মুক্ত ছন্দে লেখা। গদ্যের মতো মনে হলেও দোলা পদ্যের। ‘আমাকে তুই আনলি কেন, ফিরিয়ে নে’―এর ধ্বনিমাধুর্যও আলাদা।

কিন্তু আমরা দেখি শামসুর রাহমানের কাব্যভাষায় প্রতীক বা উপমা এসেছে অনেকটা সরাসরি―তাতে আলাদা একটা ধ্বনি তৈরি হয়েছে। মাত্রাবৃত্তের কবিতা ‘ইলেকট্রার গান’-এ তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যা পরবর্তী শোক ও প্রতিকূল সময়ের চিত্রকে রূপায়িত করেছেন মিথের অবয়বে :

শ্রাবণের মেঘ আকাশে আকাশে জটলা পাকায়

মেঘময়তায় ঘন ঘন আজ একি বিদ্যুৎ জ্বলে।

মিত্র কোথাও আশপাশে নেই, শান্তি উধাও

নির্দয় স্মৃতি মিতালি পাতায় শত করেটির সঙ্গে।

নিহত জনক, অ্যাগামেমনন, কবরে শায়িত আজ।

[ইলেকট্রার গান/ শামসুর রাহমান]

তিনি ‘নিহত জনক অ্যাগামেমনন কবরে শায়িত আজ’ এ পঙ্ক্তি ব্যবহার করেছেন প্রতি চার পঙ্ক্তির পর পর। এতে কবিতায় আলাদা একটা দোলা এসেছে যা মাত্রাবৃত্তের দোলার বাইরেও হৃদয়সংবেদী। ‘মেঘময়তায় ঘনঘন একি বিদ্যুৎ জলে’ কিংবা ‘নির্দয় স্মৃতি মিতালি পাতায় শতকরোটির সাথে’―এ ধরনের রূপকের ব্যবহার পাঠকের অনুভবে নাড়া দেয়।

ছন্দবদ্ধ কবিতায় ধ্বনি ও সুরের দোলা আছে তা অনায়াসে লক্ষ করা যায়। মিশ্ররীতি কিংবা মুক্ত ছন্দে এ সুর খুঁজে পাওয়া যায় কারণ এসব রীতি পদ্যের অনুবর্তী। গদ্য ছন্দের অভিমুখ গদ্যের দিকে―যদিও শেষ বিচারে একে কবিতা হয়ে উঠতে হবে। কিন্তু গদ্যের আপাত কঠিন বাক্যবন্ধে কীভাবে এই ধ্বনি খুঁজে পাওয়া যাবে ? শঙ্খ ঘোষের মতে রবীন্দ্রনাথ ‘ছন্দের অভাব ঘুচিয়ে দিয়েছিলেন গদ্য ছন্দের বাচনিক চাতুর্যে’―একে তিনি মনে করেন ছন্দকে গদ্যের দিকে নমিত করে আনা। কিন্তু বাচনিক চাতুর্য যথেষ্ট নয়। শব্দ ও বাক্যের মাঝখানে একটা কলস্বর থাকে যা প্রতীকায়িত, এর গতিপ্রবাহ চিত্রময়তা মিলে মিশে থাকে। সেখানেও অন্তর্লীন থাকে যে সুর সেটি স্বরধ্বনি ব্যাঞ্জনধ্বণির মতো বা কিংবা অনুপ্রাসের মতো প্রকাশ্য দোলা দেয় না। সেটা প্রত্যক্ষ নয় কিন্তু অনুভবের এক ধরনের বিস্তার―কবির ভাষায় যা অনুরণিত হয়।

মোদ্দা কথা হলো, কবিকে তার বাকপ্রতিমায় আলাদা হতে হবে। কবিতার ভাষার সঙ্গে কবিতার অঙ্গিকের একটা সম্পর্ক আছে। কবিতার নানা ধরন আছে―গীতি কবিতা, দীর্ঘ কবিতা, শোকগাথা, বর্ণনামূলক কবিতা, ছন্দোবদ্ধ কবিতা, গদ্য কবিতা―সব ধরন একইরূপ শব্দ দাবি করে না। তবে যেটি জরুরি তাহলো কবিতার ভাষা আনুষ্ঠানিক কোনও ভাষা নয়। আনুষ্ঠানিকতা কবিতাকে প্রাণহীন করে তোলে। কবি কীভাবে শব্দ আহরণ করবেন, তার কৌশল কী হবে, কোথা থেকে আসবে সে নিয়ে পাঠক চিন্তিত নয়। ভøাদিমির মায়াকোভস্কি তাঁর ‘কীভাবে কবিতা কবিতা তৈরি হয়’ গ্রন্থে বলেছেন―শব্দ নিয়ে নাডাচাড়া করার ‘কৌশল ও দক্ষতা’ কবির একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। পাঠক চায় কণ্ঠস্বরটা চিনতে―কবির সঙ্গে একটা নিবিড় সম্পর্ক গড় তুলতে। সেখানে ব্যক্তি অনুপস্থিত, শব্দই মুখ্য। বেশির ভাগই চেনা শব্দ, আটপৌরে কিংবা অভিজাত, মানভাষা কিংবা আন্তরিক―সবই জীবন থেকে নেওয়া। শুধু পরিবেশনের পদ্ধতি আলাদা। একদিকে স্বতঃস্ফূর্ত, অন্যদিকে কবির নিরন্তর অনুশীলনে হয়ে ওঠে স্বাভাবিক কবিতার ভাষা। কবির স্বাতন্ত্রও দৃশ্যমান হয় এই ভাষা শৈলীর প্রয়োগ ও ধ্বনিময়তায়।

 লেখক : কবি

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button