আর্কাইভবইকথা

থিয়েটার ৫০ বছর পূর্তি সংখ্যা : একটি নিকট বিশ্লেষণ : আনোয়ার কামাল

লিটল ম্যাগ

বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তীর পথ বেয়েই বাংলাদেশে প্রথম নাটকের পত্রিকা থিয়েটারের পঞ্চাশ বছর পূর্তি সংখ্যা বেরিয়েছে। এটা নাট্য আন্দোলনকর্মীদের যেমন আনন্দের বিষয় তেমনি নাটকপ্রিয় মানুষের এবং নাটক নিয়ে কাজ করেন এমন সবার জন্যই একটি আনন্দ সংবাদ। সবচেয়ে বড়ো কথা হলো, দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ধরে ধৈর্য সহকারে নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে এর প্রধান কাণ্ডারি আমাদের দেশবরেণ্য নাট্যব্যক্তিত্ব শ্রদ্ধেয় রামেন্দু মজুমদার পত্রিকাটি টিকিয়ে রেখেছেন। সে কারণে তাঁকে ধন্যবাদ শুধু নয়―অভিবাদন জানাতে চাই। লেখক-পাঠকের সহযোগিতায় নাট্যবিষয়ক একটি সাময়িকী পঞ্চাশ বছর বেঁচে আছে―এ আনন্দ যেমন থিয়েটারের লেখক, পাঠক, বিজ্ঞাপনদাতা, নাট্যকর্মী ও শুভানুধ্যায়ীদের, তেমনি যারা নাট্যআন্দোলনে স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত কাজ করে যাচ্ছেন তাদের জন্য তো বটেই।

পঞ্চাশ বছরের পূর্তি সংখ্যাটি ডিসেম্বর ২০২১ সালে বেরিয়েছে। এ সংখ্যায় গত পাঁচ দশকের পাঁচটি মঞ্চসফল এবং দর্শকনন্দিত নাটক পুনর্মুদ্রিত হয়েছে। নাটক পাঁচটির রচয়িতা বাংলাদেশের নাট্যসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন তাঁদের সৃষ্টিশীলতা দিয়ে, পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে পথ কেটেছেন। তাঁদের মধ্যে প্রয়াত চারজন হলেন―সৈয়দ শামসুল হক (পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়), আবদুল্লাহ আল-মামুন (সুবচন নির্বাসনে), সেলিম আল দীন (কিত্তনখোলা) এবং এসএম সোলায়মান (এই দেশে এই বেশে)। এছাড়া মামুনুর রশীদের (জয়জয়ন্তী) নাটকটি এখানে প্রকাশিত হয়েছে।

এ সংখ্যার বিশেষত্ব হলো― থিয়েটার পত্রিকার পঞ্চাশ বছরের সংখ্যাগুলোর সূচি। প্রথম চল্লিশ বছরের সূচি তৈরি করেছেন― প্রভাতকুমার দাস। পরবর্তী দশ বছরের সূচি তৈরি করেছেন―তরুণ নাট্যকর্মী অপু শহীদ।

পত্রিকাটির সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে―‘সাম্প্রতিককালে দুটি ঘটনা আমাদের সংস্কৃতি অঙ্গনের জন্য বেদনা এবং অত্যন্ত ক্ষতির কারণ হয়েছে। বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান নাট্যকর্মীদের সমবেত শক্তির একটি গৌরবের জায়গা ছিল। কিন্তু ফেডারেশানের কর্মকাণ্ড নিয়ে যা হচ্ছে তা মোটেও অভিপ্রেত ছিল না। ইদানীং আমরা লক্ষ্য করছি, ফেডারেশানে কাজের চেয়ে নেতৃত্বের ক্ষমতার ব্যাপারটিই বড়ো হয়ে দেখা দিয়েছে। একটা বিভক্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সংগঠনটি। কিন্তু আমরা আন্তরিকভাবে কামনা করি নাট্যকর্মীদের ঐক্য অটুট থাকুক। সেজন্য এগিয়ে আসতে হবে ফেডারেশানের সচেতন ও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সদস্যদলের প্রতিনিধিদের…’

‘আমাদের সমাজের একটি প্রবণতা দেখে খুব হতাশ লাগে। আগে শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীরা সমাজের সচেতন মানুষ হিসেবে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে একটা অবস্থান নিতেন। এখন সমাজটা যেন প্রতিবাদহীন হয়ে গেছে। বেশির ভাগ শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীই ক্ষমতার কাছাকাছি থাকতে চান। ক্ষমতাধর কাউকেই চটাতে চান না এবং তাদের অন্যায় নীরবে সমর্থন করে যান। কবীর চৌধুরী বা আনিসুজ্জামানের মতো বিবেকী কণ্ঠস্বর আমরা শুনতে পাব না আর ? বিশ^াস করি, এমন বন্ধ্যা সময় কেটে যাবে।’ এ সম্পাদকীয়তে রামেন্দু মজুমদার অত্যন্ত দৃঢ়চেতা হয়ে সময়ের চাহিদাকে তুলে ধরেছেন। আসলেই এখন আর বুদ্ধিজীবীদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সুতীব্র আহ্বান আর দেখি না। বেশির ভাগই মিউমিউ স্বরে তার মতো করে প্রতিবাদ করছে কিংবা প্রতিবাদীদের কাতারে সামিল হয়। এতে আমরা ক্রমশই বুদ্ধিজীবীদের বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনার ভোতা দিকটাই কেবল দেখতে পাচ্ছি। সম্পাদককে অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনি চরম সত্য কথাটি স্পষ্ট ভাষায় তুলে ধরেছেন। আমরা আপনাকে এদেশের সংকটময় মুহূর্তে অনেক আন্দোলন সংগ্রামে কাছে থেকে দেখেছি। নাট্যান্দোলন থেকে শুরু করে কি স্বৈরাচারী আন্দোলন, কি গণতান্ত্রিক আন্দোলন, সবখানেই আপনার সরব উপস্থিতি আামদের উজ্জীবিত করেছে। 

এ সংখ্যায় নিবন্ধ লিখেছেন : মামুনুর রশীদ, আশিস গোস্বামী, মলয় ভৌমিক, বিপ্লব বালা, অভীক ভট্টাচার্য, রবিউল আলম, রহমান রাজু, হাসান শাহরিয়ার, অপু শহীদ, মিলন কান্তি দে, গোলাম সারোয়ার, ইউসুফ ইকবাল, সাইমন জাকারিয়া, পিয়াস মজিদ, জাহিদ মুস্তাফা, অভিজিৎ সেনগুপ্ত, লুৎফর রহমান রিটন, রামেন্দু মজুমদার ও প্রভাত কুমার দাস।

‘থিয়েটার ৫০ : একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা’ শিরোনামে মামুনুর রশীদ লিখেছেন―‘গত বছর বাংলাদেশের জন্যে একটা বড় ঘটনা ঘটেছে। শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র এবং তলাবিহীন ঝুড়ি কুখ্যাতি নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করেছে। অবস্থাদৃষ্টে এটাও প্রমাণিত হয় আমাদের সবচেয়ে বড় শত্রু পাকিস্তানের চাইতে সব দিক থেকেই আমরা অনেক অনেক ভালো আছি। শুধু তাই নয় নানা ধরনের রাষ্ট্রীয় সংকট সামরিক শাসনের মাধ্যমে সমাধান করিনি বরং সামরিক শাসনকে আমরা উচ্ছেদ করেছি একটা দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের মাধ্যমে।… বাঙালির নাট্যপ্রেম শত শত বছর ধরেই স্বীকৃত। অথচ এই শিল্পের যাতে কোনও চর্চা না হয় তার সব রকম ব্যবস্থা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কায়েম করেছিল নির্দয়ভাবে। তাই দেশ স্বাধীন হবার পর মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই এই সুপ্ত আকাক্সক্ষা ফল্গুধারার মতো দুকূল ছাপিয়ে প্রকাশ পেতে শুরু করল। সেই অর্থে নাটকের সুবর্ণজয়ন্তীও এবছর।… থিয়েটার পত্রিকার প্রকাশনা সেক্ষেত্রে একটি প্রামানিক দলিল হিসেবে গত পঞ্চাশ বছর ধরে আমাদের নাট্যসংস্কৃতিতে যুক্ত হয়েছে। এ সময়ে থিয়েটারের প্রকাশনায় স্থান পেয়েছে অভিনীত নাটকগুলোর পাণ্ডুলিপি, নাট্য সমালোচনা, নাটক সম্পর্কিত মৌলিক রচনা, বিশ^ নাটকের গুরুত্বপূর্ণ রচনার অনুবাদ নানা ধরনের নাট্যবিষয়ক প্রবন্ধ ইত্যাদি। যখন থিয়েটারের চল্লিশ বছরের প্রকাশনার একটি সারসংক্ষেপ দেখি তাতে প্রতীয়মান হয় যে, গত পঞ্চাশ বছরে সকল নাট্য ঘটনাই গুরুত্বের সঙ্গে থিয়েটারে সন্নিবেশিত হয়েছে। যদি ঐ সময়ে থিয়েটার পত্রিকার প্রকাশ না ঘটত তাহলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ নাট্য বিষয়ই হারিয়ে যেত।… পঞ্চাশ বছর যাবত একাদিক্রমে কোনও নাট্যসাময়িকী টিকে আছে কি না সেটাও কিন্তু জানবার বিষয়। আমি যতটা জানি এতদিন উপমহাদেশে কোনও নাট্যসাময়িকী টেকেনি।’  আসলেই তাই। এতদিন কোনও নাট্যসাময়িকী টিকে থাকা বিরল। থিয়েটার পত্রিকাটির জন্ম না হলে দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরে যেসব নাটক এখানে স্থান পেয়েছে, পাঠকের হাতে পৌঁছতে পেরেছে তা সম্ভব হতো না। হয়তো-বা হারিয়ে যেত। সেদিকগুলো চমৎকার ভাবে তুলে ধরেছেন মামুনুর রশীদ তাঁর এ নিবন্ধে। 

আশিস গোস্বামী তার ‘পায়ে পায়ে ৫০’ শিরোনামে লিখেছেন― ‘বাংলাদেশের থিয়েটারের ইতিহাস জানতে হলে ‘থিয়েটার’ পত্রিকা জানতে হবে। মঞ্চ নাটকের জীবনের স্থায়িত্ব যতদিন তার অবস্থান থাকে মঞ্চে ততদিনই। আর নাট্যপত্রের অবস্থান ঠিক তারপর থেকে অনাদিকাল সময়। মঞ্চ নাটকের হাল-হকিকত খুঁজতে হয় নাট্যপত্রের গহ্বরে। সেই সন্ধানে দিন যত গড়ায় পত্রিকার মূল্যমান তত বাড়ে। অথচ মাজার বিষয় হলো, মঞ্চকারীদের কাছে, পত্রিকাকারীদের তত দাম নেই। ধন্যবাদহীন এক কাজ। তবু কিছু মানুষ কাজটা করে চলেন, একেবারে বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে। আরও এক ট্র্যাজেডি হলো, যখন প্রয়োজন হয় তখন সেই অবজ্ঞাকারীর দল ছুটে আসেন পত্রিকার দরজায়। এ অবশ্যম্ভাবী এক সমাপতন। এই যে ৫০ বছর ধরে বাংলাদেশের থিয়েটার আন্দোলনের শুরু থেকে একটি নাট্যপত্র পাশাপাশি হেঁটে চলেছে, কতটুকু নজর করে দেখেছি আমরা ? দেখা দরকার মনে করেছি আমরা ? সেই ব্যক্তিগত ভালোবাসা, কিছু মানুষের সাহচর্য, এ দোর ও দোর ঘুরে অর্থ সংগ্রহ করে কাজটা চালিয়ে যাওয়া। ক্লান্ত লাগলেও থামা যাবে না, তাহলে বন্ধ হয়ে যাবে কাগজ। গত ৫০ বছর ধরে রামেন্দু মজুমদার এক কাঁধে বয়ে চলেছেন এই তরী। পাশে অবশ্যই ছিলেন অনেকেই কিন্তু তিনি না থাকলে আশপাশটা হয়তো দেখতে পেতাম না আমরা।… মজার তথ্য এই যে একটি নাট্যদলের জন্মলাভের পর দুবছর অপেক্ষা করতে হয়েছে তার নিয়মিত প্রযোজনা মঞ্চায়নের কিন্তু তাঁদের নাট্যপত্রের জন্ম হয়েছে তার অনেক আগে। ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ থিয়েটার দলের জন্ম, ‘থিয়েটার নাট্যপত্রের জন্ম নভেম্বর ১৯৭২, প্রথম প্রযোজনা একটি হলেও নিয়মিত অভিনয় শুরু ১৯ এপ্রিল।’ থিয়েটার পত্রিকা নিয়ে তাঁর লেখাটি পত্রিকাটির পথচলার এক সরল বয়ান যা পাঠককে পত্রিকা পাঠে প্রলুব্ধ করবে। 

‘নবনাট্যের পঞ্চাশ থিয়েটার-এর পঞ্চাশ’ শিরোনামে মলয় ভৌমিক লিখেছেন―‘স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর, বাংলাদেশে নবনাট্য আন্দোলনের পঞ্চাশ বছর আর নাট্যকাগজ থিয়েটার-এর পঞ্চাশ বছর। এই তিনের এক বিন্দু থেকে যাত্রা ও বিকাশের ঘটনা কি নেহায়েত কাকতালীয়, নাকি পারস্পরিক নির্ভরশীলতার কোনও মিথষ্ক্রিয়া ? বিশেষ করে নবনাট্য আন্দোলন ও নাট্যপত্রিকা ‘থিয়েটার’ কি একে অন্যের পরিপূরক ?… আমি নিজে দেখেছি সম্পাদক শ্রদ্ধেয় রামেন্দু মজুমদার দেশের কোথাও কোনও নাট্য আয়োজনে উপস্থিত হলে এবং সেখানে কোনও ভালো নাটকের পাণ্ডুলিপি সুসম্পাদিত থিয়েটার-এর কোনও এক সংখ্যায় ছাপা হয়ে গেছে। এভাবে প্রতিভাবান নতুন নাট্যকারকে উৎসাহিত করার প্রকৃত ভরসাস্থল হয়েছে থিয়েটার।… বাংলা নাট্যচর্চার অতীত ঐতিহ্য থেকে শুরু করে সমসাময়িক সময়ে দুই বাংলার নাট্য ধারা ও বিশ^-নাট্যচর্চার গতি-প্রকৃতির সঙ্গে ক্রমাগত আমাদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে ‘থিয়েটার’। নাটক প্রকাশের পাশাপাশি, নতুন নাট্যভাবনা বা তত্ত্ব, মঞ্চায়নের নানা কারিগরি বিষয়, নাট্য-সমালোচনা, বিকল্প নাট্যচর্চা― এসব বিষয়ে নিয়মিত উঁচু মানের প্রবন্ধ-নিবন্ধ ছেপে থিয়েটার আমাদের নিরবচ্ছিন্নভাবে ঋদ্ধ করে চলেছে। দুই বাংলার প্রয়াত বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্বদের নিয়ে প্রকাশিত থিয়েটার-এর বিশেষ সংখ্যাগুলো কেবল প্রয়াত নাট্যজনদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্যই নয় বরং উত্তর প্রজন্মের জন্য তথ্যসমৃদ্ধ এক দলিল।’ একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় থিয়েটার দুই বাংলার নাট্যজনদের নানাভাবে প্রাণিত করে চলেছে বিগত পঞ্চাশ বছর ধরে। একজন তরুণ নাট্যকার যদি তার নাটকের স্ক্রিপ্টটি ছাপার হরফে থিয়েটারর মতো কাগজে স্থান পায় তবে তো তার জন্য একটা বড় পাওয়া। একদিকে সেই তরুণ প্রাণিত হচ্ছে, পাশাপাশি নাট্যজনরা সেই তরুণ নাট্যকারের লেখার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পাশাপাশি সেই নাটক হাতে পেয়ে মঞ্চস্থ করারও সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। সেদিক দিকে থিয়েটার যথার্থ ভূমিকা পালন করে চলেছে পঞ্চাশ বছর ধরে।

অভীক ভট্টাচার্য ‘নাট্যপত্রের পাঁচ দশক ছাপার অক্ষরে জীবনবোধের চিত্র’ শিরোনামে লিখেছেন―একটি নাট্যচর্চানির্ভর পত্রিকা তখনই নির্মিত হয় যখন কোনও জনপদ বা অঞ্চল কিংবা গোষ্ঠীর নাট্যচর্চাধারা বহমান থাকে। অর্থাৎ নাট্যচর্চা, অনুশীলন, নির্মাণ ও প্রদর্শন বা প্রয়োগ হলে তবেই সেসব উদ্যোগ ও আয়োজন নিয়ে নানা কথা, নানা মত ও পথ চর্চিত হয় এবং ইতিহাসের হাত ধরে নাট্যপত্র তৈরি হয়। যে অঞ্চলে নাট্যচর্চার ফলন নেই সেখানে নাট্যপত্র নেই। তাহলে অনুমান করতে অসুবিধা নেই যে, একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মধ্যে পাঁচ দশক অথবা পঞ্চাশ বছর ধরে একটি সংস্কৃতিচর্চাকে কেন্দ্র করে একটি নাট্যপত্র প্রকাশিত হওয়ার ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই কোনও সূক্ষ্মতর হলেও অভিঘাত তৈরি হয়েছে যা প্রতি মুহূর্তে নিজের মতো করে বুঝে নিতে চাইছে তার সংস্কৃতির নিজস্ব রূপ এবং সঙ্গে নির্মাণ করে চলেছে ইতিহাসের বিস্তৃত আখ্যান। আসলে আমি বলব, একটি পত্রিকা শুধু ছাপার অক্ষরে শব্দছক নির্মাণ করেনি, ধীরে ধীরে গড়ে তুলেছে নিজস্ব সংলাপ। সমাজের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তলে তলে বিছিয়েছে আমাদের কৃষ্টির কথকতার শীতলপাটি ভবিষ্যতে বিশ্রামের নেশায়।… নাট্যক্ষেত্রের বাইরেও যেকোনও ব্যক্তি বা পাঠক যদি ধারাবাহিকভাবে কয়েকটি সংখ্যা পাঠ করেন তাহলে অবশ্যই নাট্য ও বৃহত্তর সমাজচিত্র তাঁর সামনে উঠে আসবে যা একটি শিল্পপত্রের প্রকৃত গুণমানকে প্রকাশ করে। সেদিক থেকে আমার কাছে ‘থিয়েটার’ পত্রিকা তেমনই একটি প্রকাশ।’ অভীক ভট্টাচার্য যথার্থই বলেছেন, ‘থিয়েটার’ সমাজের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তলে তলে কৃষ্টির কথকতার শীতলপাটি হয়ে বিশ্রামের নেশায় নাট্যচর্চার পথনির্দেশনা দেবে। তিনি চমৎকার লিখেছেন।

‘অভিবাদন রামেন্দু দা’ শিরোনামে রবিউল আলম লিখেছেন―‘১৯৭৪ সালের কথা। স্বল্প পরিচয়ের সূত্র ধরে রামেন্দুদাকে আমার ‘অথচ অন্ধকার’ নাটকটি দিয়েছিলাম তাঁর পত্রিকায় ছাপার আকাক্সক্ষায়। নাটকটি ছিল আমার প্রথম পূর্ণাঙ্গ রচনা, অফিস পাড়ার প্লাটফর্মে যার প্রথম মঞ্চায়ন হয়েছিল চট্টগ্রামের মুসলিম হলে (১৯৭৩)। পরে আরও কয়েকটি অফিসে আরও কিছু প্রদর্শনী হয়েছিল এর। মঞ্চসফল নাটক ভেবে অতি উৎসাহে তড়িঘড়ি করে তা ছাপতে দিয়েছিলাম থিয়েটারে। বছর পার হয়ে যায়, নাটকটি ছাপা হয় না। আমিও লজ্জায় খবর নিই না।

ইতোমধ্যে তির্যক নাট্যগোষ্ঠী (১৯৭৪) আত্মপ্রকাশ করেছে। দলের জন্য নাটক লেখা শুরু করেছি তার জন্মলগ্ন থেকেই। তবে থিয়েটারে আর নাটক পাঠাই না।… বন্ধুরা আমাকে প্ররোচিত করলেন। তাদের মধ্যে দু-তিনজন নাট্যকারও ছিলেন, যাদের নাটক থিয়েটার ছাপেনি। তারা সবরকমের সহযোগিতার আশ^াস দিয়ে আমাকে ময়দানে নামিয়ে দিলেন। অন্যের সঙ্গে নিজের নাটকও ছাপতে পারব এই আবেগে আপ্লুত হয়ে আমি চট্টগ্রাম থেকে বের করলাম দেশের দ্বিতীয় নাট্যপত্রিকা ‘তির্যক’ (১৯৭৬)। হয়ে গেলাম সম্পাদক।… নাট্যকর্মীদের কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছিল পত্রিকাটি। এত কিছুর পরেও চার বছরের মাথায় (১৯৭৯) বন্ধ করে দিতে হলো ‘তির্যক’।… স্বল্পকালীন সেই অভিজ্ঞতা থেকে হাড়ে হাড়ে বুঝেছি নিয়মিত পত্রিকা চালানো মুখের কোনও বিষয় নয়। লেখা সংগ্রহ ও সম্পাদনা, প্রকাশনা ও বিপণন, সর্বক্ষেত্রে মান নিয়ন্ত্রণ এবং সর্বোপরি অর্থের সংকুলান―এর কোনওটিই সহজ প্রক্রিয়া নয়। এই সমস্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে পঞ্চাশ বছর টিকে আছে থিয়েটার।… তবে সবার শীর্ষে এখনও থিয়েটার। থিয়েটার দেশের প্রথম নাট্য পত্রিকা। এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র নাট্য পত্রিকা যা পঞ্চাশ বছর ধরে প্রকাশিত হচ্ছে। প্রথমদিকে বছরে ৩/৪টি সংখ্যা বের হতো এখন বের হয় ২টি সংখ্যা। বাংলাদেশের নাট্যচর্চার সমান বয়সি থিয়েটার। দুই বাংলা মিলে আর কোনও নাট্যপত্রিকা এত দীর্ঘজীবন লাভ করেনি।’ একথা মানতেই হবে একটি নাট্যসংশ্লিষ্ট কাগজ পঞ্চাশ বছর ধরে নিয়মিত বের করা যে কতখানি ঝক্কি ঝামেলার কাজ তা কেবল ভুক্তভোগীরাই জানেন। জীবনের বাস্তবতার আলোকে লেখাটি বেশ সুখপাঠ্য। রবিউল আলমের লেখাটি ভালো লাগল।

হাসান শাহরিয়ার ‘পঞ্চাশে থিয়েটার পত্রিকা : টিকে থাকার অদম্য প্রচেষ্টার ফল’ শিরোনামে লিখেছেন―‘প্রথম সংখ্যা বের করি মুনীর চৌধুরী স্মারক সংখ্যা (নভেম্বর ১৯৭২)। সেটারও একটা ছোট ইতিহাস আছে। প্রথমে আমি ভাবলাম পত্রিকাটা বড় ফরমেটে ছাপাব। তো  দুই ফর্মা ছাপিয়েছিও, এমন সময় আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সাহেবের সঙ্গে দেখা, তিনি শুনে বললেন―সর্বনাশ আপনি তো ওই ফরমেটে করলে মারা যাবেন, খরচ প্রচুর, এক কাজ করুন আমার ‘কণ্ঠস্বর’-এর সাইজে করুন (বর্তমান থিয়েটার যে সাইজে আছে)। তো আমিও মেনে নিলাম। পত্রিকা বের হবার সঙ্গে সঙ্গে বেশ রেসপন্স পেলাম। কেউ ভাবতেই পারেনি যে, কেবল নাটক আর নাটকবিষয়ক-প্রবন্ধ দিয়ে একটা পত্রিকা বের হতে পারে।’Ñ এক সাক্ষাৎকারে কথাগুলো বলেছিলেন রামেন্দু মজুমদার, আর এভাবেই আমরা জানতে পারি তাঁর সম্পাদনায় বাংলাদেশের প্রথম নাট্যবিষয়ক-পত্রিকা থিয়েটার-এর জন্মকথা।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে নিয়মিত মঞ্চনাট্যচর্চা শুরুর সঙ্গেই পথচলা আরম্ভ করে থিয়েটার। শহুরে নাট্যচর্চার সূচনায় আমাদের জাতীয় দৈনিকগুলো নাট্যসমালোচনা প্রকাশ করে নাটককে সমৃদ্ধ করতে অবদান রাখা শুরু করে। দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংবাদ, চিত্রালী, পূর্বাণী, দৈনিক বাংলা, দ্য বাংলাদেশ অবজারভার, হলিডেসহ প্রায় সব দৈনিক ও সিনে-ম্যাগাজিনে ছাপা হতো মঞ্চনাটকের সমালোচনা। তাদের সমান্তরালে থিয়েটার পত্রিকাও প্রকাশ করতে থাকে নাট্যসমালোচনা। কথা থেকে যায়, তাহলে জাতীয় দৈনিক আর থিয়েটার-এর মধ্যে থিয়েটারকে কেন নিজেদের পত্রিকা মনে করা শুরু করল নাট্যজনেরা ? উত্তরটা সম্পাদকের মুখ থেকেই শোনা যাক―‘পত্রিকাটা ক্রমেই জনপ্রিয় হচ্ছিল। কারণ তখন কোনও প্রকাশক কিন্তু নাটকের বই ছাপত না। থিয়েটার পত্রিকা  নিয়মিতভাবে মঞ্চে আসা নাটকগুলো ছাপাত। নাট্যবিষয়ক প্রবন্ধ ছাপাত, নাট্যসমালোচনা ছাপাত কিন্তু নাটক থাকতই, একটা-দুটা না, বেশিও ছাপা হতো কোনও কোনও সংখ্যায়। ফলে নাটকের লোকজনের কাছে পত্রিকাটা আসলে একটা গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে গিয়েছিল’।… থিয়েটার পত্রিকায় ছাপানো নাটকগুলো সম্পাদক স্বপ্রণোদিত হয়ে ‘মুক্তধারা’র কর্ণধার চিত্তরঞ্জন সাহার আন্তরিক সহযোগিতায় গ্রন্থাকারে প্রকাশ করে যাচ্ছিলেন এবং এই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে ঢাকার বাইরের বৃহত্তর বাংলাদেশ সাক্ষাৎ পায় একের পর এক মঞ্চে-আসা তরতাজা নাটকের পাণ্ডুলিপি। ফল হলো গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে গড়েওঠা জেলা-শহরের নাট্যদলগুলোও মঞ্চে হাজির করতে থাকে ভালো পাণ্ডুলিপির ভালো প্রযোজনা। আমরা লক্ষ্য করলে দেখব, ঢাকার বাইরে, পুরো-বাংলাদেশে, আবদুল্লাহ আল-মামুন, মমতাজউদ্দীন আহমদ, মামুনুর রশীদসহ হাতেগোনা কয়েকজনের নাটক যে বহুল মঞ্চায়ন হয়েছে, তার একটা বা প্রধান অবদান এই ‘থিয়েটার’ পত্রিকার।

‘আমার ভালোবাসার থিয়েটার’ শিরোনামে মিলন কান্তি দে লিখেছেন―‘বাংলাদেশে থিয়েটারর জন্মকে সংস্কৃতি জগতের এক বড় ধরনের বিপ্লব বলে মনে করি। বিপ্লব এ জন্য যে, থিয়েটার আমাদের নাট্য-আন্দোলনকে বেগবান করেছে, আন্তর্জাতিক নাট্য আঙ্গিক ও এর সমকালীন ভাবনার সঙ্গে যোগসূত্র ঘটিয়েছে, এদেশে নাটকের ক্ষেত্রে সাংগঠনিক শক্তির উন্মেষ ঘটিয়েছে। সবচেয়ে বড় অর্জন, থিয়েটারের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের দেশের খ্যাতিমান নাট্যকারদের সুলিখিত রচনাগুলোর সঙ্গে পরিচিত হতে পেরেছি। এই ৫০ বছরের থিয়েটার নিয়ে এত হইচই, এত স্মৃতিকথার পদাবলি, এত মহাযজ্ঞের আয়োজন―এতসব ঘটনার মহানায়ক যিনি, তিনি আমাদের সর্বজনশ্রদ্ধেয় দাদা রামেন্দু মজুমদার। ৫০ বছর আগে যে হাত ধরেছিলেন তিনি, সেটি এখনও তাঁর হাতে। তারুণ্য গেছে, যৌবনের সিংহদ্বার পেরিয়ে এখন তিনি পৌঢ়ত্বের কোঠা অতিক্রম করছেন। তবু থিয়েটারকে ভোলেননি, থিয়েটার তাঁর শয়নে-স্বপনে, নিদ্র-জাগরণে। থিয়েটার এদেশের সংস্কৃতিকর্মীদের প্রাণশক্তি। ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে একটা সাংস্কৃতিক জাগরণ যে ঘটানো যায়, এই আলোর পথরেখা ভাষায়, নাটকে, কবিতায় বারবার দেখিয়ে যাচ্ছে থিয়েটার। থিয়েটার ৫০ বছর অতিক্রম করল। একটি ইতিহাস।’ হ্যাঁ। ইতিহাস তো বটেই। সম্পাদক একদিন যৌবনের তারুণ্যে যে থিয়েটার পত্রিকাটির স্বপ্নদ্রষ্টা হয়ে এর হাল ধরেছিলেন, এখন বয়সের ভারে পৌঢ়ত্বে এসেও তাঁর ভেতর, তাঁর কর্মে সেই তারুণ্য দেদীপ্যমান।

গোলাম সারোয়ার ‘থিয়েটার পত্রিকা : পঞ্চাশ বছরের প্রতিচ্ছবি’ শিরোনামে লিখেছেন―‘মুক্তিযুদ্ধে অনন্য বিজয় এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে বিনোদন শিল্পে নাটক আমাদের সোনালি ফসল। স্বাধীনতার পরপর নাটকবিহীন সমাজে এমনভাবে নাট্যশিল্পের জাগরণ হবে কে ভেবেছে ? সেই জাগরণে বিস্ময়করভাবে একটি পরিপাটি ত্রৈমাসিক নাট্যপত্রিকা ‘থিয়েটার’-এর আবির্ভাব হবে কেইবা তা জানত! এমনটাই হলো ১ নভেম্বর ১৯৭২ মুনীর চৌধুরী স্মারক সংখ্যা নিয়ে প্রকাশিত হলো নাট্য ত্রৈমাসিক থিয়েটার। আজ গর্বের সঙ্গে পত্রিকাটির পঞ্চাশ বছরপূর্তি সেই গৌরবোজ্জল ভূমিকার কীর্তন করছি।… এছাড়াও দেশের বিশিষ্ট নাট্যজন ও নাট্যব্যক্তিত্বের উপর বিশেষ স্মারক সংখ্যা প্রকাশিত হওয়ায়, আমাদের নাট্যান্দোলনের গৌরবকে অনেক এগিয়ে দিয়েছে। তাঁদের মধ্যে অন্যতম অভিনেতা মো. জাকারিয়া, অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, অধ্যাপক মমতাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ শামসুল হক, আবদুল্লাহ আল মামুন, সেলিম আলদীনসহ অনেকেই স্মারক সংখ্যায় রয়েছেন।

থিয়েটার পত্রিকার আর একটি আকর্ষণীয় দিক এর সম্পাদকীয়। যার বিষয়বস্তু কেবলি নাটক নয়, নাটকের সঙ্গে দেশ, দেশের মানুষ, রাজনীতি, বিশ^াঙ্গনের স্থবিরতা, অস্থিরতা, সামাজিক সংকট সব কিছুকেই স্পর্শ করেছে। সম্পাদকের নিবেদনে রয়েছে সেই সত্তর দশক থেকে ঢাকায় মঞ্চের দারুণ সংকটের কথা, নাটক করার মতো উপযুক্ত মঞ্চ নেই, মঞ্চ তৈরির জন্য দাবি। অভিনয় আইন বাতিল, শেষাবধি সেন্সরবিহীন নাটক করার সাহসী উদ্যোগ গ্রহণ করার কথা। সত্তর দশকের নাট্যদলসমূহের উদ্দেশ্য আদর্শ ও লক্ষ্য কী ? এ নিয়ে সাক্ষাৎকার প্রকাশ, বিশ^ নাট্যাঙ্গনে বাংলাদেশের প্রচার প্রসারে আইটিআই (বাংলাদেশ কেন্দ্র) এর ভূমিকার কথা, বিভিন্ন সময়ে মুক্তবুদ্ধি ও সংস্কৃতিচর্চায় প্রধান প্রতিবন্ধকতা হিসেবে মৌলবাদী জঙ্গিদের ক্রমাগত আক্রমণ বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এছাড়াও নাটক নিয়ে নান সংকটের কথা সম্পাদকীয়তে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে। এজন্য আজও পত্রিকাটি বাংলাদেশের নাট্যচর্চায় বিশ^স্ত সহযাত্রী।’

‘থিয়েটার পত্রিকার গবেষণা উপাদান’ শিরোনামে সাইমন জাকারিয়া লিখেছেন―‘না বাংলাদেশের নাট্যচর্চার ইতিহাস সংরক্ষণে রামেন্দু মজুমদার সম্পাদিত থিয়েটার নাট্য ত্রৈমাসিক পত্রিকা গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমিকা পালন করে আসছে। এই ভূমিকার কয়েকটি দিক আছে―১. মৌলিক নাটক প্রকাশ ২. আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমাদৃত ভিন্ন ভাষার নাটকের বাংলা অনুবাদ প্রকাশ ৩. নাট্যকলাবিষয়ক মননশীল প্রবন্ধ প্রকাশ ৪. মঞ্চস্থ নাটকের নাট্য-সমালোচনা বা আলোচনা প্রকাশ ৫. নাটকের বইয়ের আলোচনা ৬. নাটকের সংবাদ এবং ৭. সাম্প্রতিক নাট্যচর্চার প্রবণতা অন্বেষণ প্রভৃতি। পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, উপর্যুক্ত প্রতিটি ক্ষেত্রেই থিয়েটার নাট্য ত্রৈমাসিক পত্রিকা যথেষ্ট উদার দৃষ্টিভঙ্গির স্বাক্ষর রেখে চলেছে।

থিয়েটার’-এর পুরনো সংখ্যাগুলোর দিকে চোখ দিলে একথা স্পষ্টভাবেই বোঝা যায় যে, বাংলাদেশের শহরকেন্দ্রিক নাট্যচর্চার পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস গ্রন্থনের কাজটি থিয়েটার নাট্য ত্রৈমাসিক পত্রিকা এতটাই সুচিন্তিতভাবে ও সুসংগঠিতভাবে করেছে যে, থিয়েটার নাট্য ত্রৈমাসিক খোলা চোখে এদেশের প্রান্তিক নাট্যচর্চার বিচিত্র বিষয়, এমনকি বাঙালি ও অবাঙালি তথা আদিবাসী নাট্যকারদের নাটক প্রকাশে থিয়েটার যথেষ্ট দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের নাট্যচর্চার সামগ্রিকতাকে ধারণ করতে থিয়েটার পত্রিকা যথেষ্ট আন্তরিকতার পরিচয় দিয়েছে।’

জাহিদ মুস্তাফা ‘থিয়েটারের পঞ্চাশে প্রচ্ছদ ব্যবচ্ছেদ’ শিরোনামে নিবন্ধে পঞ্চাশ বছরের প্রচ্ছদ নিয়ে লেখাটি বেশ গোছানো। সদ্য স্বাধীন দেশের সেই সময়কার প্রচ্ছদ শিল্পীরা প্রকাশনা ও অন্যান্য বিষয়ে মানুষের রুচি গঠনের কর্তব্যে এগিয়ে এসেছেন। এখানে তিনি নামকরা অনেক শিল্পীর নাম উল্লেখ করেছেনÑশিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন, কামরুল হাসান থেকে শুরু করে ইমদাদ হোসেন, কাইয়ুম চৌধুরী, দেবদাস চক্রবর্তী, নিতুন কুণ্ডু, এ কে এম আদুর রউফ, আবদুল মুকতাদির, সমরজিৎ রায় চৌধুরী, হাশেম খান, প্রাণেশ কুমার মণ্ডল, কালাম মাহমুদ, রফিকুন নবী, গোলাম সরওয়ার, সৈয়দ আবুল বারক আলভী, বীরেন সোম, সৈয়দ লুৎফুল হক, সৈয়দ ইকবাল প্রমুখ।

থিয়েটার-এর পঞ্চাশ পূর্তিতে লুৎফর রহমান রিটনের সম্পাদককে নিবেদিত একটি কবিতাও এখানে স্থান পেয়েছে : বাংলাদেশের মঞ্চ নাটক, নাট্যকর্মী, তথাÑ/তার ইতিহাস, কুশীলবদের নেপথ্য সব কথা/ধারাবাহিক দৃশ্য-চিত্র, অপ্রাপ্তি-অর্জনে/ পত্রিকাটি এক জড়িয়ে আছে নিবিড় আলিঙ্গণে।/…পাঁচ দশকের পূর্তিকালের এই মাহেন্দ্রক্ষণে/কবির প্রণাম-ভালোবাসা সকল নাট্যজনে।

সম্পাদকের জবানবন্দিতে রামেন্দু মজুমদার লিখেছেন :

থিয়েটার পত্রিকার ৫০ বছর পূর্তি সংখ্যার নিবন্ধগুলোর চূড়ান্ত প্রুফ দেখতে গিয়ে মনে হলো, সম্পাদক হিসেবে আমারও একটা লেখা থাকা দরকার। বেশির ভাগ লেখকই পত্রিকাটির গুরুত্ব তুলে ধরেছেন, আমার প্রশাংসা করেছেন। এ ধরনের উপলক্ষে এটাই রেওয়াজ। কেউ বিরুপ সমালোচনা করেন না, পত্রিকাটির অপূর্ণতার দিকগুলো তুলে ধরেন না।… আমি একটা কথা সবসময় বিশ^াস করি সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে থিয়েটার পত্রিকা প্রকাশ কিংবা গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট গঠনে ভূমিকা, আইটিআই বাংলাদেশ কেন্দ্র স্থাপন করে আমি কেবল সময়ের দাবি মিটিয়েছি। আমি না করলেও একসময়ে অন্য কেউ তা নিশ্চয়ই করতেন। তাই এ নিয়ে আমি তেমন কোনও কৃতিত্বের দাবি করি না। অনেক মানুষের সঙ্গে একসঙ্গে পথচলার সুযোগ পেয়েছি। সুখস্মৃতিগুলো মনে করে আনন্দ পাই। বেদনার স্মৃতি ভুলে যেতে চেষ্টা করি।… কলকাতার একটি উন্নতমানের সাহিত্য পত্রিকা ‘এবং মুশায়েরা’র সম্পাদক-প্রকাশক সুবল সামন্তকে আমি ব্যক্তিগতভাবে জানি। তিনি একজন স্কুল শিক্ষক, সম্পূর্ণ নিজের অর্জনের উপর ভরসা করে পত্রিকাটির ব্যয়নির্বাহ করেন―যা সচরাচর দেখা যায় না। এবং মুশায়েরার প্রতিটি সংখ্যাই বিষয়ভিত্তিক। আমাদের দেশে ‘মীজানুর রহমানের সাহিত্য পত্রিকা’ও তেমনই ছিল।… পত্রিকা প্রকাশ করতে গিয়ে আরেকটি সমস্যা বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। পত্রিকার বিপণন। অতীতে আমরা নানাভাবে চেষ্টা করেছি, কোনওটাই সফল হয়নি। পত্রিকা ছেপে কি লাভ যদি সেটা পাঠকের হাতে পৌঁছাতে না পারি। সংস্কৃতি-মনস্ক কোনও তরুণ উদ্যোক্তা যদি আগ্রহী হয়ে কয়েকটি সাহিত্য পত্রিকা নিয়ে একটা বিপণন সংস্থা করেন তবে তা সকলের জন্যেই লাভজনক হবে বলে আমার বিশ^াস।

৪৩২ পৃষ্ঠার থিয়েটার পত্রিকাটি নাট্যজনদের জন্য একটি অত্যন্ত সমৃদ্ধ পত্রিকা। পত্রিকাটি সংগ্রহে রাখার মতো। শুধু নাট্যজনদের বলি কেন, সাহিত্য পিপাসুদের জন্যও পত্রিকাটি সংগ্রহে রাখতে পারেন। এতে একদিকে অনেক সমৃদ্ধ লেখা আপনাকে ঋদ্ধ করবে, অপরদিকে পাঁচটি মঞ্চসফল ও দর্শকনন্দিত এবং বহুল আলোচিত নাটক এক মলাটে পাওয়া কম বিষয় নয়।

লেখক : কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button