আর্কাইভপ্রচ্ছদ রচনা

সুব্রত বড়ুয়ার সৃজনে আনিসুজ্জামান জীবনকথা : সালমা আক্তার

সুব্রত বড়ুয়ার সাহিত্যকর্ম : আলোচনা

কথাসাহিত্যিক সুব্রত বড়ুয়ার সাহিত্য পাঠের প্রতি প্রবল আগ্রহের সৃষ্টি হয় কৈশোরে। লেখালেখি শুরু করেন কলেজে পড়ার সময়। প্রথম প্রকাশিত বই চাঁদে প্রথম মানুষ প্রথম গল্পগ্রন্থ জোনাকি শহর। এরপর কবিতা, গল্প, উপন্যাস, ইতিহাস ও বিজ্ঞানবিষয়ক বই, জীবনী, প্রবন্ধ, অনুবাদগ্রন্থ সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থ প্রায় অর্ধশত। স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, অগ্রণী ব্যাংক, শিশু একাডেমি শিশুসাহিত্য পুরস্কার, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান পরিষদ স্বর্ণপাদক, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার এবং একুশে পদকে ভূষিত হন। তাঁর বেশকিছু জীবনী গ্রন্থের মধ্যে আমার আলোচ্য বিষয় আনিসুজ্জামান জীবনকথা।

আনিসুজ্জামান জীবনকথা বইটি প্রকাশিত হয় অনুপম প্রকাশনী থেকে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে। উৎসর্গ করা হয়েছে প্রয়াত প্রিয় সুহৃদ অধ্যাপক আহমদ কবিরকে। অনুপম প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী শ্রী মিলন নাথের তাগিদে এবং অনুরোধে কথাসাহিত্যিক সুব্রত বড়ুয়া অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের এ জীবনী গ্রন্থ লেখেন। লেখাটি প্রথমে আটটি কিস্তিতে ধারাবাহিকভাবে পত্রস্থ হয়েছিল বেঙ্গল পাবলিকেশন্স প্রকাশিত মাসিক সাহিত্যপত্র কালি ও কলমে।

বইটি অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের জীবন ও সার্বিক কর্মসাধনার বিস্তারিত বিবরণমূলক কোনও রচনা নয়। এটি লেখা হয়েছে মূলত তাঁর ব্যক্তিপরিচয় এবং অধ্যাপনা-গবেষণা-চিন্তাভাবনার একটি প্রাথমিক ধারণা সকলের সামনে তুলে ধরতে। সেটি করা হয়েছে প্রধানত তাঁর আত্মকথামূলক তিনটি বই কাল নিরবধি, আমার একাত্তর ও বিপুলা পৃথিবী অবলম্বনে।

ইতোমধ্যে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের জীবনের ও ভাবনাচিন্তার বিভিন্ন দিক নিয়ে বেশকিছু বই এবং কয়েকটি স্মারকগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। বইটি লেখার সময় সেগুলো থেকে সাহায্য নেওয়ার চেষ্টা করেছেন লেখক। তবে অনেকখানি সাহায্য পেয়েছেন আনিসুজ্জামান পত্নী সিদ্দিকা জামান এবং তাঁর লেখা বিপুলা পৃথিবী বইটি থেকে।

জীবনীমূলক এ গ্রন্থে আনিসুজ্জামানের পরিবার, সমাজ এবং তৎকালীন পারিপার্শ্বিক নানা দিকের চিত্র ফুটে উঠেছে। একই সঙ্গে বাল্যকাল, শিক্ষাজীবন, কর্মজীবন, পিএইচডি, আদর্শ শিক্ষক বা গবেষণা কর্ম, বাংলা একাডেমিতে যোগদান, ১৯৫২ সালে তাঁর অবস্থানসহ বিভিন্ন পদক বা পুরস্কার ও উপাধিতে ভূষিত হওয়া; এছাড়া সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিচরণের তথ্য, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ততা এবং মানুষ হিসেবে কেমন ছিলেন সে বিষয়গুলো আমরা জানতে পারি কথাসাহিত্যিক সুব্রত বড়ুয়ার লেখা আনিসুজ্জামান জীবনকথা থেকে।

আনিসুজ্জামান ছিলেন একাধারে প্রবাদপ্রতিম শিক্ষক, অভিনিষ্ঠ গবেষক এবং অসাধারণ রকমের সংস্কৃতিসচেতন ব্যক্তিত্ব। একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবেও তিনি ছিলেন অসাধারণ! খুব সহজেই মানুষকে কাছে টেনে নিতে পারতেন। তাঁর সম্পর্কে বরেণ্য শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও সমাজচিন্তক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ‘সুহৃদ আনিসুজ্জামান’, উত্তরাধিকার, আনিসুজ্জামান সংখ্যায় বলেছেন, ‘আমাদের সময়ে আনিসুজ্জামানের মতো পরিপূর্ণ মানুষ কম ছিলেন। বেশি থাকলে আমরা সবাই সৌভাগ্যবান হতাম।’ (আনিসুজ্জামান জীবনকথা, পৃ. ৯)

আনিসুজ্জামানের মৃত্যুর আগে এবং পরে তাঁর সম্পর্কে যাঁরা লিখেছেন তাঁরা সবাই একই কথার অবতারণা করেছেন ভিন্ন আঙ্গিকে, একই অনুভূতিতে শুধু প্রকাশের তারতম্যে। তিনি মূলত শিক্ষাবিদ ও গবেষক ছিলেন। কিন্তু তাঁর কর্ম ও চিন্তা প্রধানত আবর্তিত হয়েছে শিক্ষা ও সাহিত্য বিষয়ক গবেষণাকে কেন্দ্র করে। এমেরিটাস এ অধ্যাপক বাংলা সাহিত্যে অধ্যাপনা করেছেন ঠিকই কিন্তু গবেষণায় ছাপিয়ে গেছেন সাহিত্যের পরিসীমা। তা কেবলই একাডেমিক প্রথাবদ্ধতার মধ্যে কখনও সীমিত ছিল না। এছাড়া সম্পৃক্ত থেকেছেন দেশের বিভিন্ন প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে। সুব্রত বড়ুয়ার মতে, ‘তাঁর কর্মপ্রবাহ ও জীবনদৃষ্টির মধ্যে মানুষ এবং মানুষের জীবন ও সমাজই মূলত কেন্দ্র হিসেবে দৃঢ়মূলে প্রোথিত। তবে এই অবস্থান মোটেই বহির্বাস্তবতার বিষয় ছিল না; এ ছিল তাঁর অন্তর্বাস্তবতার গভীর বোধের অন্তর্গত একাত্মবোধ। সম্ভবত এ কারণেই তাঁর সমাজভাবনা ও অ্যাকাডেমিক বিচার-বিশ্লেষণ বৃহত্তর পাঠকগোষ্ঠীর ভাবনাচিন্তাকে যেমন বিশেষভাবে নাড়া দিতে সমর্থ হয়েছে  তেমনি মানুষের অন্তর্লোককে ক্রমাগত আলোকিত করে গেছে।’ (আনিসুজ্জামান জীবনকথা, পৃ. ১০)

আনিসুজ্জামানের জন্ম ১৯৩৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি কলকাতায়। পিতা মাতার ৬ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন পঞ্চম। কাল নিরবধি বইয়ে নিজ পারিবারিক পরিচয় ও পৈতৃক নিবাস সম্পর্কে আনিসুজ্জামান লিখেছেন : ‘আমার পূর্বপুরুষদের বাস ছিল চব্বিশ পরগনা জেলার বসিরহাট মহকুমার কাদুড়িয়া থানার অন্তর্গত গ্রামে। চব্বিশ পরগনা অতি প্রাচীন জনপদ।…

“আমার বৃদ্ধ প্রপিতামহ (দাদার দাদা) শেখ নাসিরুদ্দীন খাসপুরের কাছে জহরপুর গ্রাম থেকে উঠে এসে মোহাম্মদপুরে বসতি স্থাপন করেন। তাঁর পুত্র-পৌত্রেরা সবাই শেখ উপাধি ব্যবহার করতেন তবে বানান করতেন বোধ হয় সেখ। ১৮৮৮ সালে প্রকাশিত আমার পিতামহের প্রথম গ্রন্থে তাঁর নাম মুদ্রিত হয়েছিল ‘শ্রীসেখ আবদ্র রহিম।’ ওই বইয়ের পরবর্তী সংস্করণে এবং অন্যান্য বইতে লেখকের নাম লেখা হয় ‘শেখ আবদুর রহিম’।” (আনিসুজ্জামান জীবনকথা, পৃ. ১০, ১১)

আনিসুজ্জামানের বাল্যকালের স্মৃতিচারণের চিত্রও বইটিতে পাই। তাঁর একমাত্র খেলার সাথি ছিল বনি। আনিসুজ্জামানের ভাষাতে, ‘বনি ও আমার খেলার উপকরণ ছিল খুব সীমাবদ্ধ। যদিও বনির একটু বেশি এবং আমার একটু কম সংখ্যায় স্প্রিংয়ের খেলনা ছিল, তবু দম দিয়ে তা চালিয়ে আর কতক্ষণ কাটানো যায়! ট্রাম লাইনের পশ্চিমে যাওয়া আমার পক্ষে নিষিদ্ধ ছিল―পাছে ট্রাম বা গাড়ি-চাপা পড়ি, এই ভয়ে, বনিকেও কখনও সে গণ্ডি পার হতে দেখিনি। আমাদের খেলা ছিল ট্রামের টিকিট, সিগারেটের খালি প্যাকেট ও দেশলাইয়ের বাক্স কুড়িয়ে জমা করা এবং সময় শেষ হলে তা গুণে জয়-পরাজয় স্থির করা। আরেকটা খেলা ছিল, আমাদের সামনে চলে যাওয়া গাড়ির নম্বর লিখে রাখা―যে বেশি নম্বর লিখতে পারত, তাকেই জয়ী মানা হতো। ফুটপাথে অবশ্য লাট্টু খেলা চলত, পরে ঘুড়িও খেলেছি এবং কখনও কখনও বোনদের ভীতি উপেক্ষা করে ঘুড়ির সুতোর মাঞ্জা নিজে বানিয়েছি। তবে ঘরের মধ্যে―সাধারণত বনিদের বাড়িতে―লুডু ও ক্যারাম খেলাই ছিল সবচেয়ে উপভোগ্য।’ (আনিসুজ্জামান জীবনকথা, পৃ. ১৩ )

বইটিতে আনিসুজ্জামানের স্কুলে ভর্তি হওয়ার মজার ঘটনা, কোন্ কোন্ স্কুলে পড়েছেন, কত সালে এসএসসি, এইচএসসি, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেছেন সেসব বিষয় এখানে চমৎকারভাবে তুলে ধরা হয়েছে। আনিসুজ্জামানের প্রথম পাঠাভ্যাস গড়ে ওঠে ১৯৪২ সালে যোগীন্দ্রনাথ সরকারের হাসিখুশি গ্রন্থ দিয়েই। ১৯৪৩ সালে মার্চ মাসে কলকাতা পার্ক সার্কাস হাই স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন।

৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর বাবা-মায়ের সঙ্গে কলকাতা ত্যাগ করে খুলনায় আসেন। সেখানে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি। আবার বাবার সঙ্গে ট্রান্সফার হয়ে ঢাকায় প্রিয়নাথ হাই স্কুলে নবম শ্রেণিতে ভর্তি, ১৯৫০ সালে গোলাম মোস্তফা পরিচালিত নওবাহার পত্রিকায় প্রথম ছোটগল্প ‘টেলিফোন’ প্রকাশ পায়। ১৯৫১ সালে প্রিয়নাথ হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ। ঢাকা জগন্নাথ কলেজে প্রথম বর্ষে ভর্তি হন। ১৯৫১-৫২ সালে দফতর সম্পাদক হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের কর্মতৎপরতায় এবং ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন কী ও কেন ?’ শীর্ষক প্রথম প্রকাশিত পুস্তিকা ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন কি ও কেন ?’ রচনা করেন।

১৯৫৩ সালে কলেজ থেকে পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে সম্মান শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের বাংলা সমিতির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৫৫ সালে প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী বুলবুল চৌধুরীর স্মরণে প্রতিষ্ঠিত ঢাকার বুলবুল ললিতকলা একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য তিনি।

১৯৫৬ সালে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার এবং সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে বাংলায় বিএ সম্মান ডিগ্রি অর্জন করায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘নীলকান্ত সরকার স্বর্ণপদক’ লাভ করেন। ১৯৫৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে এমএ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। কাজী জহিরুল হক-সম্পাদিত সোভিয়েত দূতাবাসের সাপ্তাহিক জনমত পত্রিকার জন্য অনুবাদের কাজে সম্পৃক্ত হন।

১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্ট্যানলি ম্যারন রচনা পুরস্কার’ এবং পিএইচডি গবেষক হিসেবে বাংলা একাডেমির বৃত্তিলাভ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষণায় তাঁর গবেষণার বিষয় : ঞযড়ঁমযঃং ড়ভ ঃযব ইবহমধষর গঁংষরসং ধং ৎবভষবপঃবফ রহ ইবহমধষর খরঃবৎধঃঁৎব ফঁৎরহম ঃযব ইৎরঃরংয ঢ়বৎরড়ফ (১৭৫৭-১৯১৮) [ইংরেজ আমলের বাংলা সাহিত্যে বাঙালি মুসলমানের চিন্তাধারা (১৭৫৭-১৯১৮)]। গবেষণা-তত্ত্বাবধায়ক : মুহম্মদ আবদুল হাই।

১৯৫৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অ্যাডহক ভিত্তিতে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। পরবর্তীকালে ১৯৬২ সালে স্থায়ী ভিত্তিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক পদে নিয়োগ লাভ এবং পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন কমিটির সদস্য হিসেবে চার দিনব্যাপী অনুষ্ঠান আয়োজনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। এছাড়া রবীন্দ্র-জন্মশতবর্ষ উদযাপন বিষয়ে আরও নানা তথ্য ও প্রসঙ্গের বিবরণ আনিসুজ্জামান তাঁর কাল নিরবধি বইতে দিয়েছেন। সবশেষে তিনি লিখেছেন, ‘রবীন্দ্র-জন্মশতবর্ষের অনুষ্ঠান আসলে রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন অতিক্রম করে গিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথকে আমাদের চাই, কেননা তিনি না থাকলে আমাদের আর কী থাকে। কিন্তু তার চেয়ে বড় কথা, আমাদের বাঙালি সত্তাকে ধরে রাখতে হবে না, পাকিস্তান সরকারকে তা গ্রাস করতে দেওয়া যাবে না। ‘বাধা দিলে বাঁধবে লড়াই’―এই মনোভাবই কাজ করেছিল সেদিন। তখন মনে হয়েছিল, এখনও মনে হয়, সকল প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে আমরা সেদিন জয়ী হয়েছিলাম―ভাষা আন্দোলনের মতো আরেকটি আন্দোলনে।’ (আনিসুজ্জামান জীবনকথা, পৃ. ৩০)

১৯৬৩ সালে ইউনাইটেড স্টেটস এডুকেশনাল ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে করাচিতে অনুষ্ঠিত ঈঁষঃঁৎবং ড়ভ ঞড়ি ডড়ৎষফং বিষয়ক আন্তর্জাতিক সেমিনারে যোগদান করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ-আয়োজিত বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সপ্তাহ ১৩৭০ অনুষ্ঠানে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের সম্পাদনায় এবং রফিকুল ইসলাম ও আনিসুজ্জামানের সহকারী সম্পাদনায় ভাষা ও সাহিত্য সপ্তাহ ১৩৭০ স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ (বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) পায়। এ সম্পর্কে আনিসুজ্জামান লিখেছেন, ‘ভাষা ও সাহিত্য সপ্তাহ ১৩৭০ বিশেষ আলোড়ন সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছিল। এত অধিক লোকসমাগম ছিল অপ্রত্যাশিত। মানুষ যেমন আগ্রহ নিয়ে প্রদর্শনী দেখেছে, উৎসাহ নিয়ে পাঠ ও সংগীত শুনেছে, তেমনি কৌতূহল নিয়ে আলোচনা-সভায় উপস্থিত থেকেছে। মন্তব্যের খাতা আনন্দ-উচ্ছ্বাসের অভিব্যক্তিতে ভরে গিয়েছিল।… একাধিক পত্রিকায় সম্পাদকীয় মন্তব্য করা হয়েছিল। পরে এর সবকিছু সংগ্রহ করে এবং স্মরণিকার বিষয়বস্তু, অনুষ্ঠান-সূচি ও সকল বক্তৃতা দিয়ে ভাষা ও সাহিত্য সপ্তাহ ১৩৭০ নামে একটি বই প্রকাশ করা হয়েছিল আমার একার তত্ত্বাবধানে। তার সম্পাদক ছিলেন মো. আব্দুল হাই এবং সহকারী সম্পাদক রফিকুল ইসলাম ও আমি। ষাটের দশকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে ধারা ক্রমে পুষ্টি লাভ করেছিল তাতে এই সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠানমালা কিছু দান করতে সমর্থ হয়েছিল।’ (আনিসুজ্জামান জীবনকথা, পৃ. ৩১, ৩২)

১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে সিনিয়র প্রভাষক হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। ঢাকায় অনুষ্ঠিত ঞযব ডৎরঃবৎ ধহফ ঐরং ঝড়পরধষ জবংঢ়ড়হংরনরষরঃু শীর্ষক আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন। অক্টোবরে পোস্ট-ডক্টরাল ফেলো হিসেবে এক শিক্ষাবর্ষের জন্য শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ‘উনিশ শতকের বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাস : ইয়ং বেঙ্গল ও সমকাল।’

১৯৬৫ সালে সানফ্রানসিসকোয় অনুষ্ঠিত ‘অ্যাসোসিয়েশন অব এশিয়ান’ স্টাডিজের বার্ষিক সম্মেলনে যোগদান করেন। জুনে ইন্ডিয়ানার ব্লুমিংটনে শিক্ষাবিষয়ক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। শিকাগো থেকে প্রত্যাবর্তনের পথে মাসাধিককাল লন্ডনে অবস্থান করেন। ব্রিটিশ মিউজিয়াম লাইব্রেরি ও ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে অধ্যয়ন। ব্রিটিশ মিউজিয়াম লাইব্রেরি সম্পর্কে তাঁর অনুভূতি ছিল, ‘সেখানকার বৃত্তাকার পাঠকক্ষে ঢুকলেই একটা শিহরন জাগে―পৃথিবীর কত মনীষী এই ঘরে, হয়তো এই চেয়ারে বসেই অসাধারণ সব গবেষণা, অমূল্য সব রচনা উপহার দিয়েছেন মানবজাতিকে―সেখানে আমার মতো ক্ষুদ্র ব্যক্তির পক্ষে প্রবেশ করাও একটা সৌভাগ্য। (আনিসুজ্জামান জীবনকথা, পৃ. ৩৩, ৩৪)

অবশ্য পরবর্তীসময়ে এই দুই লাইব্রেরি এক হয়ে আধুনিক স্থাপত্যকলার অসামান্য নিদর্শনস্বরূপ অট্টালিকায় উঠে যাওয়ার পর তিনি যখন পরে সেখানে কাজ করতে গেছেন তখন আর সেই অনুভূতি তাঁর মনে জাগেনি বলেও জানিয়েছিলেন।

দেশভাগের পর প্রতিটি আন্দোলনে তিনি অংশগ্রহণ করেছিলেন প্রত্যক্ষভাবে। সমাজ ও সংস্কৃতির বিচিত্র ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়েছিল তাঁর অন্তর্দৃষ্টিময় গবেষণা। পাকিস্তান সরকারের প্রচণ্ড রবীন্দ্রবিরোধিতার সময়েও যেমন রবীন্দ্রশতবর্ষ পালনে রেখেছিলেন সক্রিয় ভূমিকা তেমনি একইসঙ্গে সাহসিকতার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে এক সংকলনগ্রন্থ সম্পাদনা করেছিলেন ১৯৬৭ সালে। ঢাকার সুপরিচিত প্রকাশনা-প্রতিষ্ঠান স্টুডেন্ট ওয়েজের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ ওয়াহিদউল্লাহ সংকলন গ্রন্থটি প্রকাশের দায়িত্ব নেন। এই সংকলন গ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে কাল নিরবধি গ্রন্থে আনিসুজ্জামান লিখেছেন, ‘কাইয়ুম চৌধুরীর আঁকা রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতি দিয়ে ছাপা হলো সংকলনে লেখার জন্য আমন্ত্রণপত্র। প্রায় জন পঞ্চাশেককে চিঠি পাঠিয়েছিলাম, প্রবন্ধের বিষয় ও প্রস্তাব করেছিলাম। অনেকে সম্মতিজ্ঞাপন করলেন, অনেকে বিষয়ান্তরে লেখার প্রস্তাব করলেন, অনেকে নতুন লেখার পরিবর্তে তাঁদের প্রকাশিত লেখা গ্রহণ করার অনুরোধ করলেন। সরকারি প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কায় লিখতে বিরত থাকলেন কেউ, কেউ কেউ কর্মব্যস্ততার কারণে শেষপর্যন্ত লিখে উঠতে পারলেন না। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে কোনও বিষয় নির্ধারণ করে দিইনি, তিনি নিজেই তা স্থির করেছিলেন এবং আমাকে বলেছিলেন শ্রুতিলিখন নিতে। একদিন তাঁর বেগমবাজারের বাড়িতে, আরেক দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে তাঁর কক্ষে (তিনি তখন এই এমেরিটাস প্রফেসর) তিনি মুখে মুখে বলে গিয়েছিলেন, আমি লিখে নিয়েছিলাম। পরে অনুলিপি তিনি সংশোধন করে দিয়েছিলেন। অন্তিম অসুস্থতার আগে এই ‘মরমি রবীন্দ্রনাথ’ই হয়তো ছিল তাঁর শেষ লেখা। ততদিনে অবশ্য পানি অনেক দূর গড়িয়েছে।’ (আনিসুজ্জামান জীবনকথা, পৃ. ৩৬)

সংকলনটির কাজ চলাকালেই তৎকালীন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় তথ্য ও বেতারমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দীনের পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে প্রদত্ত রবীন্দ্রসংগীত সম্পর্কিত একটি বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে তিনি বলেন যে, রেডিও পাকিস্তান থেকে ভবিষ্যতে পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধবিরোধী রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচারিত হবে না এবং রবীন্দ্রনাথের অন্যান্য গানের প্রচারও কমিয়ে দেওয়া হবে। এ কথা শুনে আনিসুজ্জামান অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের বাসায় গেলেন। তাঁর পরামর্শেই স্থির করলেন তাঁরা প্রতিবাদ করবেন। তাই ১৯৬৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানি লেখকদের লেখা প্রবন্ধ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের নীতির বিরুদ্ধে ১৮ জন নাগরিকের বিবৃতিতে স্বাক্ষর সংগ্রহ এবং তা প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। শেষপর্যন্ত ৩০ জন লেখকের প্রবন্ধ নিয়ে আনিসুজ্জামান-সম্পাদিত রবীন্দ্রনাথ সংকলনটি প্রকাশিত হয় ১৯৬৮ সালের আগস্টে। তাঁদের এই প্রতিবাদের বিবরণটি কাল নিরবধিতে চমৎকারভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে! এছাড়া ১৯৬৮ সালেই তিনি আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির যুগ্ম সম্পাদক (১৯৬৮-৬৯) হন। শিক্ষকতাকালে তাঁর কর্মতৎপরতা কেবল অধ্যয়ন, অধ্যাপনা, গবেষণার বিচ্ছিন্ন জগতেই সীমাবদ্ধতা ছিল না। এছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির নানাবিধ কর্মসূচি এবং সমিতির কর্মকর্তা নির্বাচন ইত্যাদি বিষয়েও তিনি বেশ উৎসাহের সঙ্গে জড়িত হয়েছিলেন। তাঁর এই সক্রিয়তার মাধ্যমে কী ধরনের অভিজ্ঞতা তিনি লাভ করেছিলেন তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনাও কাল নিরবধিতে দিয়েছেন। ১৯৬৭ সালেই এশিয়াটিক সোসাইটি অব পাকিস্তানের কাউন্সিল-সদস্য হিসেবেও নির্বাচিত হন।

তিনি ১৯৬৯ সালে জানুয়ারির গণ-অভ্যুত্থানে শিক্ষকদের পক্ষে অংশগ্রহণ করেন। ৩ জুন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে রিডার হিসেবে যোগদান করতে গিয়ে অ্যাকসিডেন্টের কবলে পড়েন। এই দুর্ঘটনাকালীন নিরুপায় গৃহবাসকালে এক বিকেলে তাঁকে দেখতে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান―তাঁর সঙ্গে ছিলেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের দুই নেতা―তাজউদ্দীন আহমদ ও আব্দুল মমিন। আনিসুজ্জামান লিখেছেন, ‘আমার বিশ্বাস, তাজুদ্দীনই তাঁকে নিয়ে এসেছিলেন, কেননা তাঁর সঙ্গে পরিচয় থাকলেও ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ আমার ঘটেনি।’ (আনিসুজ্জামান জীবনকথা, পৃ. ৪১)

পরে সুস্থ হয়ে ৩০ জুন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন।

অবশ্য ৩ জুন ঢাকায় আরেকটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটেছিল। এতে প্রাণ গিয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মুহম্মদ আব্দুল হাইয়ের। তবে তাঁর মৃত্যুর ঘটনাটি সে সময় জনমনে বেশ আলোড়ন এবং প্রশ্ন তুলেছিল। আনিসুজ্জামান তাঁর কাল নিরবধিতে এর পটভূমি প্রসঙ্গে অনেক কিছুই উল্লেখ করেছিলেন।

১৯৪৭ সালে কলকাতা ছেড়ে আসার পর ১৯৫৯ সালে তিনি একবার কলকাতা গিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে কলকাতায় তিনি শরণার্থী হিসেবে এসেছিলেন। তখন তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি গঠনে ভূমিকা পালন এবং এর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘সহায়ক সমিতির অফিসই ছিল শিক্ষক সমিতির অফিস। আমি রোজ যেতাম সকালে, সন্ধ্যা পর্যন্ত সেখানে থেকে কিংবা বিকেলে সেখান থেকে বেরিয়ে অন্য কোনও কাজ সেরে ফিরতাম রাতে। ফুপুর বাড়িতে রাতে রুটি খাওয়া হতো, তাই ওই ক’মাস রোববার ছাড়া ভাত খাওয়ার সুযোগ পাইনি―তাতে আমার কোনও অসুবিধে হয়নি।’…  (আনিসুজ্জামান জীবনকথা, পৃ. ৫২)

বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি নিয়ে কয়েকটি দল গঠন করা হয়। উত্তর ভারতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ও জনসভায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে প্রচার অভিযানে শিক্ষক সমিতির প্রতিনিধিদল উত্তর ভারত সফর করেছিলেন। সে সময়ে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। আমেরিকা থেকে রেহমান সোবহানও এসেছিলেন কলকাতায়। তখন তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে তিনি প্রস্তাব করেন যে, বাংলাদেশ সরকারের উচিত একটা পরিকল্পনা কমিশন গঠন করা। তাজউদ্দীন আহমদ এ ব্যাপারে প্রথমে উৎসাহ না দেখালেও প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর হাতে দেন এবং কয়েকজনের নামও উল্লেখ করেন। প্রধানমন্ত্রী স্থির করেন যে, পুরোপুরি পরিকল্পনা কমিশন গঠন না করে প্রথমে একটা পরিকল্পনা সেল গঠন করা হোক। পরে এটাকে কমিশনের রূপ দেওয়া যেতে পারে। মুজিবনগরে গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা সেলের (পরে পরিকল্পনা কমিশনের) সদস্য হিসেবে তিনি নিয়োগ পান।

তিনি শিক্ষক ছিলেন মুক্তবুদ্ধি চর্চার, অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক চেতনার। শিক্ষক ছিলেন বাঙালি জাতীয়তা, বাংলা ভাষা প্রীতির ও সর্বোপরি দেশকে ভালোবাসার। এদিক বিবেচনায় কিন্তু তিনি আমাদের সবারই শিক্ষক ছিলেন। তিনি শুধু একজন শিক্ষকই ছিলেন না, সেই বলয়ের বাইরে নিজেকে বিস্তৃত করেছেন সর্বক্ষেত্রে। ছাত্রজীবনে ভাষা আন্দোলনের সংগঠনে গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত হয়ে তিনি যেমন ঝুঁকিপূর্ণ সব কাজ করেছেন তেমনি মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সময়েই সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে সংগঠিত করেছেন এ দেশের শিক্ষক, বুদ্ধিজীবীদের। নিজে যুক্ত হয়েছেন প্রবাসী সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সঙ্গে।

১৯৭২ সালে বাংলাদেশে ফিরে তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান বাহাত্তরের সংবিধানের ইংরেজি থেকে বাংলা ভাষান্তর। তাঁর সেই বাংলাই সংবিধানে প্রাধান্য পেয়েছে। সংবিধান প্রণয়ন-সংক্রান্ত কাজে নিজের শ্রম ও সংশ্লিষ্টতার বিবরণ উপস্থাপন করতে গিয়ে আনিসুজ্জামান তাঁর ব্যক্তিগত ভাবনা ও বিবেচনার দিকটিও বিপুলা পৃথিবীর সপ্তম অধ্যায়ে লিপিবদ্ধ করেছেন এবং প্রাসঙ্গিক নানা বিষয় তাতে যুক্ত করেছেন। তেমনি যুক্ত ছিলেন কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনে।

এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পদে নিয়োগের বিষয়টি নিয়ে একটি অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি ও নানারকম গুজব প্রচার বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছিল। এসব ঘটনা সম্পর্কে আনিসুজ্জামান তাঁর বিপুলা পৃথিবী বইটিতে যা লিখেছিলেন তা এখানে উদ্ধৃত করা যেতে পারে। তিনি লিখেছেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সচিব একদিন আমাকে পাকড়াও করে বললেন, ভিসি আপনার একটা সিভি চেয়েছেন, এই সপ্তাহে দিয়ে যাবেন।’ কদিন পরে আমার জীবন তাঁর হাতেই সমর্পণ করলাম। তিনি পাকা লোক, জানতে চাইলেন, ওতে আমার স্বাক্ষর আছে কি না। উত্তর শুনে বললেন, এখনই স্বাক্ষর করে দিয়ে যান। (আনিসুজ্জামান জীবনকথা, পৃ. ৬৪)

যদিও পরবর্তীসময়ে এ কারণে অনেক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে, যার বর্ণনা আমরা আনিসুজ্জামান জীবনকথাতে দেখতে পাই। তবে নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়টির একটি সমাপ্তি-কাণ্ডও আছে। সে অবশ্য অনেক পরের কথা আনিসুজ্জামান লিখেছেন, ‘সমস্ত ঘটনার দুটি পাদটীকা আছে। যেসব ছাত্র ১৯৭২ সালে আমার নিয়োগের বিরোধিতা করে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিল, অনেক বছর পর তাদের অন্তত দুজন আমার কাছে নিজেদের আচরণের জন্য ক্ষমা চেয়েছিল এবং অন্তত আরও দুজন তাদের ব্যবহারের দ্বারা বুঝিয়ে দিয়েছিল যে, তারা অনুতপ্ত।’ (আনিসুজ্জামান জীবনকথা, পৃ. ৬৭)

১৯৭৩ সালে বিশ্ব শান্তি পরিষদের আমন্ত্রণে বুদাপেস্ট সফর করেন। মস্কোতে বিশ্ব শান্তি পরিষদ-আয়োজিত ডড়ৎষফ চবধপব ডধাব শীর্ষক সম্মেলনেও যোগদান করেন। এছাড়া প্যারিসে অনুষ্ঠিত ঙৎরবহঃধষরংঃ ঈড়হমৎবংং-এর দ্বিশতবর্ষ উৎসবে যোগদান এবং একটি অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘরের ট্রাস্টি বোর্ডের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য নির্বাচিত হন।

১৯৭৪ সালে মনট্রিলে অনুষ্ঠিত ওহবয়ঁধষরঃু-বিষয়ক আন্তর্জাতিক সভায় যোগদান করেন। মে মাসে নিজের ভূমিকা-সংবলিত মীর মশাররফ হোসেনের ‘এর উপায় কি ?’ প্রকাশিত (বাংলা সাহিত্য সমিতি, বাংলা বিভাগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়) হয়। কমনওয়েলথ অ্যাকাডেমিক স্টাফ ফেলো হিসেবে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজে গবেষণা : বিষয় : প্রাক-উনিশ শতকের বাংলা গদ্য। সম্পাদিত গবেষণা পত্রিকা পাণ্ডুলিপিতে (চতুর্থ সংখ্যা) প্রকাশিত (বাংলাসাহিত্য সমিতি, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়) হয়।

১৯৭৫ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে অক্সফোর্ডের নাফিল্ড কলেজে ঈঁষঃঁৎধষ ঞৎবহফং রহ ইধহমষধফবংয: ধ জবফবভরহরঃরড়হ ড়ভ ওফবহঃরঃু শীর্ষক প্রবন্ধ পাঠ করেন। ১৯৭৫ সালের মার্চ মাসে সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব আফ্রিকান অ্যান্ড এশিয়ান স্টাডিজে ঞযব ডড়ৎষফ ড়ভ ঃযব ইবহমধষর গঁংষরস ডৎরঃবৎং রহ ঃযব ঘরহবঃববহঃয ঈবহঃঁৎু শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন। আগস্ট মাসে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫ সালের দ্বিতীয় বারের মতো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সভাপতির দায়িত্ব লাভ করেন। ২৮ নভেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ভারপ্রাপ্ত ডিনের দায়িত্ব গ্রহণ। ২৬ আগস্ট ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সভাপতি হিসেবে পদাধিকারবলে বাংলা একাডেমির কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য (১৯৭৫-৭৭)।

১৯৭৮ সালে জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে জাপানের কিয়োতোতে অনুষ্ঠিত ঝড়পরধষ অংঢ়বপঃং ড়ভ ঊহফড়মবহড়ঁং ওহঃবষষবপঃঁধষ ঈৎবধঃরারঃু বিষয়ে এশীয় সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন।

১৯৭৯ সালে জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে মেক্সিকো সিটিতে অনুষ্ঠিত উল্লিখিত বিষয়ে লাতিন আমেরিকান সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয় (টোকিও) থেকে প্রবন্ধ ঝড়পরধষ অংঢ়বপঃং ড়ভ ঊহফড়মবহড়ঁং ওহঃবষষবপঃঁধষ ঈৎবধঃরারঃু পুস্তিকাকারে প্রকাশ পায়। ক্রিশ্চান মিকেলসন ইনস্টিটিউটের আমন্ত্রণে সপ্তাহকাল নরওয়ের বারগেনে অবস্থান করেন।

১৯৮০ সালে ১২ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের নির্বাচিত ডিন হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ। ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৮২ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন। জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদোগে কুয়েতে অনুষ্ঠিত পূর্বোক্ত বিষয়ে আরব সম্মেলনে অংশগ্রহণ। জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত ঊহফড়মবহড়ঁং ওহঃবষষবপঃঁধষ ঈৎবধঃরারঃু ধহফ ঃযব ওহঃবমৎধঃরড়হ ড়ভ ঞৎধফরঃরড়হ ধহফ গড়ফবৎহ অঃঃরঃঁফবং রিঃয ঝঢ়বপরধষ জবভবৎবহপব ঃড় ইধহমষধফবংয ধহফ ঃযব ওহফরধহ ঝঁনপড়হঃরহবহঃ বিষয়ে কর্মশালা পরিচালনা করেন।

১৯৮১ সালে জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে ঊহফড়মবহড়ঁং ওহঃবষষবপঃঁধষ ঈৎবধঃরারঃু ধহফ ঃযব ওহঃবমৎধঃরড়হ ড়ভ ঞৎধফরঃরড়হ ধহফ গড়ফবৎহ অঃঃরঃঁফবং রিঃয ঝঢ়বপরধষ জবভবৎবহপব ঃড় ইধহমষধফবংয ধহফ ঃযব ওহফরধহ ঝঁনপড়হঃরহবহঃ বিষয়ে দ্বিতীয় কর্মশালা পরিচালনা করেন। জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে ঞৎধহংভড়ৎসধঃরড়হ ড়ভ ঃযব ডড়ৎষফ পর্যায়ে আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত ঈঁষঃঁৎব ধহফ ঞযড়ঁমযঃ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদান করেন।

আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের কার্যবিবরণী রচনার জন্য প্যারিসে অবস্থান করেন এবং আমস্টারডাম ভ্রমণ করেন। এছাড়া লন্ডন থেকে গবেষণাগ্রন্থ ঋধপঃড়ৎু ঈড়ৎৎবংঢ়ড়হফবহপব ধহফ ড়ঃযবৎ ইবহমধষর উড়পঁসবহঃং রহ ঃযব ওহফরধ ঙভভরপব খরনৎধৎু ধহফ জবপড়ৎফং প্রকাশ পায় ।

১৯৮২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ‘বাংলা একাডেমি বক্তৃতামালা’র প্রথম বক্তৃতা হিসেবে ‘পুরোনো বাংলা গদ্য’ বিষয়ে বক্তৃতা দেন। আমাদের একটি ধারণা ছিল যে, বাংলা গদ্যের জন্ম হয়েছে উপনিবেশের গর্ভে। কিন্তু ‘পুরোনো বাংলা গদ্য’ বইয়ে তিনি দেখিয়েছেন, উপনিবেশের বহু আগে থেকেই বাংলা গদ্য ছিল এবং ইতিহাসের অভিজ্ঞতার ভেতর সেটি ক্রমশ স্পষ্ট আকার পাচ্ছিল। উপনিবেশের হস্তক্ষেপ ছাড়াই বাংলা গদ্য নিজ পায়ে দাঁড়াতে পারত। এছাড়া নানা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বাংলা গদ্য ক্রমাগত বিকশিত হয়ে উঠেছিল। নানা ক্ষেত্রে গদ্যের ব্যবহার বাড়ছিল। শুধু ব্যাবহারিক ক্ষেত্রে নয়, ভাবের বাহন হিসেবেও এটি বিকাশ লাভ করে। কিন্তু বাঙালির জীবনে পদ্যের অসাধারণ প্রভাব গদ্যকে আড়ষ্ট করে রেখেছিল। গদ্যে লেখা উচিত এমন বহু জিনিসও পদ্যেই লেখা হতো। গ্রিস, ইতালি বা ইংল্যান্ডে মধ্যযুগের কবিরা যেসব ধর্মগাথা রচনা করেছেন এবং যুগ যুগ ধরে যা তাদের ভাষাভাষীর মনকে প্রভাবিত করেছে, সেসব উচ্চ সাহিত্যের মর্যাদা পেয়েছে। আমাদের প্রাচীন সাহিত্যেও এমন কিছু আছে যা তেমন মর্যাদা পেতে পারত, কিন্তু আধুনিকতার গর্বে আমরা তা দিতে পারিনি। হয়তো বৈষ্ণব জীবনী-সাহিত্য যে গুরুত্ব পেতে পারত আমরা তা দিইনি। তাছাড়া অন্য বিষয়ে আমরা কার্পণ্য করিনি। ইংরেজের সংস্পর্শে আসার আগে আমাদের সাহিত্যে অনুকরণ আর পুনরাবৃত্তিই ছিল প্রধান। তার মধ্যেও যে পালাবদল হয়নি তা নয়। তবে তা হাতে গোনা। একেক শতাব্দীতে আমরা মাত্র একজন-দুজন করে বড় কবির নাম পাচ্ছি―চণ্ডীদাস, আলাওল, মুকুন্দরাম, ভারতচন্দ্র। এই বদল অবশ্যই বাঙালি সমাজের অন্তর্নিহিত প্রাণশক্তির পরিচয়। শক্ত একটি কাঠামো বজায় থাকছে যুগের পর যুগ। আবার সে কাঠামো ভেঙে হঠাৎ করে কেউ কেউ বেরিয়েও যাচ্ছেন। এটা অনিবার্যভাবে আমাদের সামনের দিকে ঠেলে দিয়েছে। আবার এসব পরিবর্তনের মধ্যে কিছু কিছু বিষয় স্থিরও থেকে গেছে।

৪ নভেম্বর ১৯৮২ সালে দ্বিতীয়বারের মতো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের নির্বাচিত ডিন হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। স্বাধীনতা-উত্তর যুগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিপন্থী শিক্ষক গ্রুপের তিনিই ছিলেন আহ্বায়ক। এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক অনুপম সেনের একটি মূল্যায়ন উদ্ধৃত করা যায়: ‘ড. আনিসুজ্জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাওয়ার ফলে আমরা এমন একজনকে হারাই, যিনি ছিলেন অত্যন্ত স্থিতধী। খুব কম ক্ষেত্রেই তাঁকে বিচলিত হতে দেখেছি। তাঁর সিদ্ধান্ত প্রায়ই সব পক্ষ মেনে নিত।’ (আনিসুজ্জামান জীবনকথা, পৃ. ৯০)

এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগের জন্য যে প্যানেল নির্বাচন করা হয় তাতেও একবার নির্বাচনপ্রার্থী হয়েছিলেন আনিসুজ্জামান। সে বিবরণ তিনি দিয়েছেন তাঁর বিপুলা পৃথিবী বইটিতে।

১৯৮৫ সালে জানুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ নিরীক্ষণ কেন্দ্র-আয়োজিত ‘সমাজ নিরীক্ষণ বক্তৃতা-১৯৮৪’ পর্যায়ে ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস : প্রাসঙ্গিক জিজ্ঞাসা’ বিষয়ে বক্তৃতা দেন। ১৫ই ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমিতে ‘অমর একুশে বক্তৃতা’ পর্যায়ের প্রথম বক্তৃতা হিসেবে ‘বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশ’ বিষয়ে বক্তৃতা প্রদান করেন। ১৯ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যাপক পদে যোগদান করেন। চট্টগ্রামের যোগেশ স্মৃতি প্রকাশনা পরিষদের সভাপতি হন।

১৯৮৭ সালে স্বৈরশাসনের অবসানের আহ্বান জানিয়ে প্রদত্ত ৩১ জন নাগরিকের বিবৃতিতে স্বাক্ষর দেন। ৩১ বুদ্ধিজীবী বা ৩১ নাগরিকের এই বিবৃতি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তার কিছু প্রতিক্রিয়া ঘটে এবং পক্ষে বিপক্ষে নানা বক্তব্য আসে। আনিসুজ্জামানের বিপুলা পৃথিবীতে সেসবের সংক্ষিপ্ত উল্লেখ রয়েছে।

৩১ বুদ্ধিজীবীর এই বিবৃতি বাংলাদেশের তৎকালীন রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশকিছুটা আলোড়ন তুলেছিল সে কথা অস্বীকার করা যায় না। এর পরিপ্রেক্ষিতে তাঁদের প্রস্তাবের একটি সাংবিধানিক ব্যাখ্যা উপস্থাপন করার প্রয়োজন দেখা দেয়। এই বিবৃতি প্রক্রিয়ার পরবর্তী ঘটনা সম্পর্কে আনিসুজ্জামান  লিখেছেন, ‘জেনারেল এরশাদের পতন পর্যন্ত অর্থাৎ পরবর্তী তিন বছর আট মাস পর্যন্ত ৩১ জনের এই গোষ্ঠী সক্রিয় ছিল, তবে সকলে আমরা একযোগে থাকতে পারিনি। অনেকের ওপর চাপ আসছিল নানারকম, কেউ কেউ উৎসাহ হারিয়ে ফেলছিলেন, পরিবারের সদস্যদের অস্বাচ্ছন্দ্যের কারণে কেউ কেউ আর একসঙ্গে থাকতে চাইছিলেন না।’… ‘আমাদের বেশির ভাগ বৈঠক হতো মুশারফ হোসেন কিংবা আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসস্থানে। বক্তব্য স্থির করার পর মুসাবিদা করার ভার অধিকাংশ সময় তাঁর ওপর পড়ত। বিবৃতি তৈরি হয়ে গেলে মইনুল হোসেন ইত্তেফাকের লোকবলের সাহায্যে তা বিভিন্ন পত্রিকায় পাঠাতেন।’ (আনিসুজ্জামান জীবনকথা, পৃ. ১০৪)

খুব অল্প সময়ের মধ্যেই জনসমাজে সে বিবৃতির একটা গ্রহণযোগ্যতা দাঁড়িয়ে যায়।

১৯৮৭ সালে ভারতের নয়া দিল্লিতে অনুষ্ঠিত হয় এশিয়ান রিলেশনস কমেমোরেটিভ কনফারেন্স-এর দ্বিতীয় সম্মেলন। সেখানে অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, অধ্যাপক মুশারফ হোসেন এবং অধ্যাপক আনিসুজ্জামান এই তিনজন যুক্ত হয়েছিলেন। এই সম্মেলন প্রসঙ্গে  আনিসুজ্জামান তাঁর বিপুলা পৃথিবী গ্রন্থে লিখেছেন, ‘এশিয়ার নানা দেশ থেকে প্রতিনিধি এসেছিলেন এই বিশাল আনন্দযজ্ঞে। ভারতের উপ-রাষ্ট্রপতি ড. শঙ্কর দয়াল শর্মা সম্মেলন উদ্বোধন করেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী স্বাগত ভাষণ দিয়েছিলেন। শঙ্কর দয়াল শর্মা উদ্ধৃত করেছিলেন বৈদিক মন্ত্র, রাজীব গান্ধী বাংলায় ও ইংরেজিতে উদ্ধৃত করেছিলেন নজরুল ইসলামের কবিতার চরণ।’ (আনিসুজ্জামান জীবনকথা, পৃ. ১০৫-১০৬)

১৯৯০ সালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন প্রবল হয়ে ওঠে। তিনি তাঁর বিপুলা পৃথিবী বইটিতে ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণায় স্বৈরাচারী এরশাদের পতনের কাহিনি তুলে ধরেছেন।

১৯৯২ সালে শহিদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত গণআদালতে বাদীরূপে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ উত্থাপন করা হয়। এ প্রসঙ্গে আনিসুজ্জামান তাঁর বিপুলা পৃথিবীতে লিখেছেন, ‘জাহানারা ইমাম আমার ছাত্রী ছিলেন। সেই দাবিতে তিনি বললেন, গণ-আদালতে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে আমাকেই অভিযোগ উত্থাপন করতে হবে। আমি তাঁকে বললাম, এতে আমার আপত্তি নেই, তবে যেহেতু ১৯৭১ সালে আমি দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম, তাই গোলাম আযমের তখনকার কার্যকলাপ সম্পর্কে আমার অভিযোগ হবে শোনা কথার সামিল। আমি বরঞ্চ ১৯৭২ সাল থেকে গোলাম আযম বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যা যা করেছেন, সে সম্পর্কে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে অভিযোগ আনবো। আর কেউ ১৯৭১ সালে তাঁর ভূমিকা সম্পর্কে অভিযোগ করুক।’ (আনিসুজ্জামান জীবনকথা, পৃ. ১২৩)

এর জন্য ২৮ মার্চ সরকার কর্তৃক ২৪ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি ও রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হয়। ৩০ মার্চ হাইকোর্ট থেকে জামিন লাভ করেন। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার কর্তৃক মামলা প্রত্যাহৃত হয়।

২০০৯, ২০১০ ও ২০১১―তিনটি বছর আনিসুজ্জামান অস্ট্রেলিয়া গিয়েছিলেন আমন্ত্রিত হয়ে। প্রথমবার গিয়েছিলেন সিডনিতে অস্ট্রেলিয়ার বাংলা একাডেমি আয়োজিত বাংলা বইমেলার প্রধান অতিথি হিসেবে। দ্বিতীয়বার গিয়েছিলেন সিডনির ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন সিডনিতে ঞযব ইবহমধষর ওফবহঃরঃু শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করার জন্য। আর তৃতীয় বার যান জুন মাসে মেলবোর্নে সড়হঁং ঁহরাবৎংরঃু-তে রবীন্দ্রনাথের সার্ধশতজন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আয়োজিত সেমিনারের যোগ দিতে। এই সেমিনারে তিনি ‘ঞধমড়ৎব’ং ডড়ৎষফ-ঠরব’ি বিষয়ে ভাষণ প্রদান করেন।

২০১২ সালের শুরুতেই দ্বিতীয়বারের জন্য বাংলা একাডেমির সভাপতি পদে নিয়োজিত হন। এ বছরেই যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন তিনি। তাঁকে একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি কর্তৃক জাহানারা ইমাম স্মারক সম্মাননা প্রদান করা হয়।

বাংলা ভাষার প্রশ্নে যেমন, তেমনি শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তাঁর অবাধ ও সাবলীল বিচরণ। আনিসুজ্জামান শিক্ষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য একাধিক পুরস্কার লাভ করেছেন। প্রবন্ধ গবেষণায় অবদানের জন্য ১৯৭০ সালে তিনি বাংলা একাডেমি থেকে প্রদত্ত বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। শিক্ষায় অবদানের জন্য তাঁকে ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। সাহিত্যে অবদানের জন্য ২০১৫ সালে তাঁকে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করা হয়।

তাঁর বিদগ্ধ মনন দেশের মধ্যে যেমন দেশের বাইরে থেকেও তেমনি সম্মান বয়ে এনেছে। শিক্ষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য তাকে ভারত সরকার কর্তৃক প্রদত্ত তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদ্মভূষণ পদক প্রদান করা হয় ২০১৪ সালে। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির হাত থেকে এ সম্মাননা গ্রহণ করেন তিনি। এছাড়া তিনি ১৯৯৩ ও ২০১৭ সালে দুইবার আনন্দবাজার পত্রিকা কর্তৃক প্রদত্ত আনন্দ পুরস্কার, ২০০৫ সালে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি. লিট. ডিগ্রি এবং ২০১৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জগত্তারিণী পদক লাভ করেন। ২০১৮ সালের ১৯ জুন বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ‘জাতীয় অধ্যাপক’ হিসেবে নিয়োগ দেয়। দেশ-বিদেশে আরও কত সম্মাননা পেয়েছেন, তার তালিকা বেশ দীর্ঘ হবে।

২০১৫ সালটি নিশ্চিন্ত মনে শেষ করতে পারেননি আনিসুজ্জামান এবং তাঁর পরিবারের লোকেরা। নভেম্বর মাসে প্রাণ নাশের হুমকি পেলেন আনিসুজ্জামান। থানায় ডায়েরি করেন। জাতীয় গণমাধ্যম সমূহে খবরটি প্রকাশিত হয়। তাঁর জন্য একজন গানম্যান নিযুক্ত করা হয় এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সে শুধু দায়িত্বই পালন করেনি তাঁদের পরিবারের একজন নির্ভরযোগ্য সদস্য হয়েও উঠেছিল।

২০২০ সালের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে শারীরিক অসুস্থতার জন্য রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখানে কিছুদিন চিকিৎসার পর বাড়ি ফিরে আসেন। পুনরায় শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে ২৭ এপ্রিল তাঁকে ইউনিভার্সেল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ৯ মে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে স্থানান্তর। তিরাশি বছর বয়সে ১৪ মে জীবনাবসান ঘটে এই মহান শিক্ষাব্রতীর। স্ব-কাল, স্ব-দেশ ও স্ব-সমাজের স্বরূপসন্ধানী আনিসুজ্জামান, ঋদ্ধ মানবিক চেতনার সম্পন্ন মানুষ আনিসুজ্জামান চির অম্লান ও উষ্ণ থাকবেন আমাদের সবার হৃদয়ে।

সমাজে বহুল আলোচিত স্বল্পভাষী ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। আনিসুজ্জামান পেশাজীবনে ছিলেন চট্টগ্রাম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। কিন্তু তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ ছিলেন না। সীমানার ভেতরে ও বাইরে গিয়ে করেছেন নানা কাজ।

বিচার-বুদ্ধিতে পরিচিতি পেয়েছেন দেশের শীর্ষ গবেষক, চিন্তাবিদ ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে। নিজেকে শুধু গবেষণা কাজের মধ্যে আটকে রাখেননি আনিসুজ্জামান। সমাজ জীবনের অসংগতি ও সংকট মোচনের জন্যে বাঙালি যে সংগ্রাম করে চলছে, তাতে অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। অর্থাৎ সংবিধানের বাংলা অনুবাদক আনিসুজ্জামান তাঁর সব কাজের মধ্য দিয়ে জাতির শেকড় অনুসন্ধান করেছেন। এছাড়া নানা বিষয়ে লিখে গেছেন। সরস গদ্যে বিগত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকেই তাঁর গবেষণা বাঙালি মুসলমানের মানসযাত্রা প্রসঙ্গ বাংলাদেশের গবেষকদের মধ্যে চিন্তার বীজ বপন করেন। শিক্ষকতা, গবেষণা, কর্মী ইত্যাদি প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাঁর অবদান আকাশচুম্বী। যেকোনও সংকটকালে তিনি হয়ে উঠেছিলেন জাতির নির্ভরতার জায়গা। বর্তমানকালে বাঙালি জাগরণে তাঁর অবদান পাহাড়সম। ভাষা, সংস্কৃতি, উদার গণতন্ত্রের প্রসঙ্গ কোনও কিছু বাদ যায়নি। কাল নিরবধি, আমার একাত্তর ও বিপুলা পৃথিবী তিনটি বইয়ে আত্মস্মৃতি লিখেছেন আনিসুজ্জামান। আর তা বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের বাংলাদেশের সামাজিক ইতিহাস বোঝার জন্য এক দলিল হয়ে রইল। তাঁর জীবন, প্রতিটি কর্ম ও গবেষণার কাছে বাঙালি নিজের আত্মানুসন্ধানের জন্য বারবার ফিরে আসবে। বাঙালির প্রতিটি গৌরবজনক অধ্যায়, ইতিহাসের পাতায় তাঁর উজ্জ্বল ও নির্ভীক উপস্থিতি থাকবে। কারণ একজন আনিসুজ্জামান ছিলেন আমাদের বাঙালির জাগরণের পুরোধা, একজন অভিভাবক, একজন কিংবদন্তি। এই বাংলাদেশের এগিয়ে চলার প্রতিটি ধাপে রয়েছে তাঁর দৃপ্ত পদচারণা। সক্রিয় ছিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রথম উন্মেষ ভাষা আন্দোলনে, ছিলেন পাকিস্তান আমলে বাঙালির সকল অধিকার সংগ্রামে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ভূমিকা ছিল অসীম।

নিজের কর্মজীবন, সামাজিক অবস্থান এবং ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ঘনিষ্ঠতা ইত্যাদির মধ্যে থেকেও তাঁর জীবনদৃষ্টি যে বহুলাংশে যৌক্তিকতার প্রতিই নিবেদিত ছিল তার পরিচয় কাল নিরবধি শীর্ষক স্মৃতিকথায় উজ্জ্বল। এতে তিনি যে কেবল নিজের কথা বলেছেন তা নয়, বিভিন্ন পরিস্থিতি ও ঘটনার পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় সে সময়ের রাজনৈতিক বিষয়াদির বর্ণনাও উঠে এসেছে এবং সে বর্ণনা বা বিবরণে তাঁর নিজের চিন্তা ও অবস্থান সন্দেহাতীতভাবে স্পষ্ট। ভারসাম্যপূর্ণ একটা চৈতন্য আনিসুজ্জামানের এক বড় পরিচয়। তাঁর জীবন কেটেছে এক দারুণ রাবীন্দ্রিক সৌম্যে। আনিসুজ্জামান সেই ব্যক্তিত্ব যিনি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম প্রক্রিয়ার অন্যতম সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক কর্মী। তিনি কেবল দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও শান্তি ও প্রগতির বাণী নিয়ে সাবলীল ছিল তাঁর পদচারণ। যৌবনে সাম্যবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ অধ্যাপক আনিসুজ্জামান সেই বোধকে লালন করেছেন জীবনভর। ছিলেন আফ্রো-এশীয় পিপলস সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের সভাপতি। সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের পরও আশা ছাড়েননি এই আন্তর্জাতিক মৈত্রীর। শান্তি আন্দোলনেও ছিলেন অগ্রণী। তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান মুক্তবুদ্ধির চর্চা। এখানে তিনি কোনও বেড়ার মধ্যে আটকে থাকেননি। নিজে যেমন উন্মুক্ত ব্যক্তি ছিলেন তেমনি উন্মুক্ত ছিল তাঁর চিন্তাধারা।

একইসঙ্গে সুব্রত বড়ুয়ার আনিসুজ্জামান জীবনকথা শীর্ষক গ্রন্থটিতেও তাঁর সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাই। অন্যের চোখে আনিসুজ্জামান কেমন, তারই চমৎকার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বইটিতে। পাঠক যেন পুরো বইটি পড়ে সালের সঙ্গে ঘটনার যোগসূত্র স্থাপন করে মনে রাখতে পারে সেজন্য বইয়ের শেষে আনিসুজ্জামান: জীবনপঞ্জি (পৃ. ১৭৯-১৯৯) তিনি আলাদাভাবে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে নিখুঁতভাবে উত্থাপন করেছেন। এছাড়া অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের গ্রন্থপঞ্জি (পৃ: ২০০-২০১), সহায়ক গ্রন্থ (পৃ. ২০১), বইয়ের শেষে বিভিন্ন পুরস্কার তথ্য এবং কিছু দুর্লভ আলোকচিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ভবিষ্যতে কেউ যদি তাঁর সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পেতে চান এবং তাঁকে নিয়ে পূর্ণতর ও অধিকতর উপভোগ্য জীবনী রচনা করতে চান তাদের জন্যই সুব্রত বড়ুয়ার কাজটি সূচনাবিন্দু রূপে বিবেচিত হতে পারে। এই একটি বই পাঠককে আনিসুজ্জামানের খুব কাছে নিয়ে যাবে। আলোচ্য বইয়ে আনিসুজ্জামানের আন্তর্জাতিক চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, এমফিল গবেষক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

প্রাবন্ধিক ও সাহিত্যবিশ্লেষক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button