আর্কাইভপ্রচ্ছদ রচনা

সুব্রত বড়ুয়ার সাহিত্য সমাজ ও বিজ্ঞান চিন্তাসূত্রের এক অভিনব প্রবন্ধগ্রন্থ : নিঝুম শাহ্

সুব্রত বড়ুয়ার সাহিত্যকর্ম : আলোচনা

সাহিত্যের চিরন্তন সত্য সৌন্দর্য সৃষ্টি ও আনন্দ দান। প্রবন্ধের মূল উদ্দেশ্যও তাই দুটিই হওয়া উচিত। কিন্তু ঔচিত্যবোধ এর সীমা-পরিসীমার বাইরেও প্রবন্ধের নানা মাত্রিক দায়িত্ব দাঁড়িয়ে গেছে। প্রবন্ধের সাথে তাই শিক্ষা দান ও চিন্তাসূত্র তৈরির প্রত্যাশা অস্বীকার করা যায় না। saintsbury প্রবন্ধকে বলেছেন, work of prose art. সাহিত্যের যেকোনও শাখায় কল্পনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ বা বলা যেতে পারে কল্পনাই সাহিত্যের প্রধান নিয়ামক। প্রবন্ধে এই কল্পনার সাথে যুক্ত হয় বুদ্ধিবৃত্তি ও যুক্তি। বস্তুনিষ্ঠ বা ব্যক্তিগত যে ধরনেরই হোক না কেন প্রবন্ধে যুক্তি দ্বারা প্রতিষ্ঠার অংশটি থাকতে হয়। অর্থাৎ কল্পনা অংশে একজন কথাসাহিত্যিক বা কবি আকাশে একপাল হাতি উড়িয়ে দিতেই পারেন, প্রাবন্ধিকের কাজ হবে সেটিকে জাদুবাস্তব বা পরাবাস্তবের আলোকে মনের অযৌক্তিক, অবচেতন অংশের ক্রিয়াকলাপ কার্যকরণসূত্রে যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করা। সুব্রত বড়ুয়া মূলত গল্পকার। কবিতা ও গল্প তাঁর ক্ষেত্র হলেও ক্রমে প্রবন্ধও লেখা শুরু করেন। সাহিত্য সমাজ ও বিজ্ঞান মূলত তাঁর প্রবন্ধের সংকলন। ভূমিকা অংশে তিনি বিনীতভাবে জানাচ্ছেন―‘প্রবন্ধ আমি খুব বেশি লিখিনি। তাছাড়া এসব গদ্য রচনাকে গুরুগম্ভীর ও জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ বলা যাবে বলেও আমার মনে হয় না। তবু নানা সময়ে নানা উপলক্ষে কিছু প্রবন্ধ-জাতীয় গদ্যরচনা লেখা হয়েছে।’ প্রাবন্ধিকের প্রবন্ধ সম্পর্কে জানাশোনা ও পঠনের পরিধি বিস্তৃত থাকার কারণেই এই বিনয় তিনি দেখালেও প্রবন্ধের অবকাঠামোগত ব্যাখ্যায় বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধ বলে একটা টার্ম থাকলেও তার পাশাপাশি ব্যক্তিগত প্রবন্ধ বলেও এক ধরনের প্রবন্ধ পাওয়া যায়। বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধ (familiar or intimate essay)  সাধারণত গুরুগম্ভীর ও জ্ঞানগর্ভ হলেও আমাদের বুদ্ধিকে তীক্ষèতর, দৃষ্টিকে সমুজ্জ্বল ও জ্ঞানের পরিধিকে প্রশস্ত করে তোলে। অপরদিকে ব্যক্তিগত প্রবন্ধ (formal or informative essay) জ্ঞানের বিষয়কে ‘হাস্যরসমণ্ডিত পুষ্প-পেলবিত’ করে উপস্থাপন করে। সুব্রত বড়ুয়ার এই গ্রন্থের প্রবন্ধগুলো অবকাঠামোগত দিক দিয়ে ব্যবচ্ছেদ করলে কোনও আদলেরই পুরোপুরি শর্ত পূরণ করে না একথা যেমন সত্য তেমন ‘পর্দার আড়ালেই থাকে আসল সত্যে’র মতো এটাও সত্য যে, কোনও সাহিত্যকর্মকেই একটা নির্দিষ্ট ফ্রেমিংয়ে বেঁধে ফেলা সম্ভব নয়। কারণ সাহিত্যের কাজই হলো প্রতিনিয়ত ফ্রেমিং ভেঙে ফেলা। লেখকের সামাজিক অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ প্রয়াস প্রতিনিয়ত সেখানে নতুন চিন্তার সূত্রপাত ঘটানো। সাহিত্য সমাজ ও বিজ্ঞান গ্রন্থের প্রবন্ধগুলো বিষয় নির্বাচনের দিক দিয়ে বস্তুনিষ্ঠ মনে হলেও প্রকাশভঙ্গি, ভাষা ও চিন্তাসূত্রের অভিনবত্বে সেগুলো ব্যক্তিগত প্রবন্ধই বলা চলে। সেখানে কল্পনা ও যুক্তির একটা সমন্বিতভাব আছে। আছে ভাষার তরলতা ও পেলব মসৃণ স্নিগ্ধতার চ্যালেঞ্জ, যে চ্যালেঞ্জ কবি ও গল্পকার হওয়া সত্তেও সুব্রত বড়ুয়া বেশ দারুণভাবেই উতরে গেছেন। বিশেষ করে সাহিত্য-বিষয়ক প্রবন্ধগুলোতে কল্পনার লাগাম টেনে ধরে যুক্তির প্রাধান্য সাহিত্য-বিষয়ক প্রবন্ধগুলো একটা আলাদা সৌন্দর্য দান করেছে।

প্রবন্ধের বিষয় নির্বাচনে প্রাবন্ধিকের স্বাধীনতা অবাধ। প্রবন্ধের বিষয়ক্ষেত্র নিয়ে কোনও সীমা নির্ধারণ সম্ভব নয়। উপন্যাসে যেমন জীবনের বর্ণনাত্মক রূপ অঙ্কিত হয়, দার্শনিক যেমন জীবনের পরমসত্য উদঘাটনে আত্মনিয়োজিত, নাটকে জীবনের কর্মময় শোভাযাত্রা প্রতিফলিত হয় সে অর্থে প্রবন্ধে ফুটে ওঠে পর্যবেক্ষণ। বিশেষ করে ব্যক্তিগত প্রবন্ধের বিষয়ক্ষেত্র ‘পরমেশ্বর থেকে উপলখণ্ড’ এবং বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে অবলীলায় পর্যটন করার ক্ষমতা রাখে। Robert Lynd প্রবন্ধের বিষয় সম্পর্কে  বলেছিলেন―Sometimes it is nearly a sermon; sometimes it is nearly a short story. It may be a fragment of autobiography or a piece of nonsense. It may be satirical or vituperative or sentimental. It may be deal with any subject from the day of judgment to a pair of scissors. সুব্রত বড়ুয়ার প্রবন্ধের বিষয়বৈচিত্র্য আমাদের সে কথাই মনে করিয়ে দেয়। রবীন্দ্রনাথ এই বিষয়বৈচিত্র্যের অন্যতম উপমা ছিলেন। সামাজিক, শিল্পবিষয়কও বিজ্ঞানকে সরল গদ্যে একীভূত করে সমন্বয়সাধন করা সহজ নয়। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ তো দূরের কথা, বিজ্ঞান নিয়ে যেকোনও ধরনের লেখাই আমাদের এখানে কম। এর একটা প্রধানতম কারণ বিজ্ঞানবিষয়ক লেখা মানেই আমাদের কাছে ভারিক্কিচালের, গুরুগম্ভীর, যন্ত্রপাতিবিষয়ক কিছু। বিজ্ঞানচর্চাকে প্রযুক্তি বাযন্ত্রপাতি নির্ভরতার সাথে অবলীলায় গুলিয়েও রেখেছি অনেক আগে থেকেই। সুব্রত বড়ুয়া পাঠককে এই জায়গা থেকে মুক্তি দিয়েছেন। বিজ্ঞান নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা ভেঙে দেবার জন্য ‘বিজ্ঞানচর্চা : প্রসঙ্গ ও অনুষঙ্গ’ প্রবন্ধটি অসাধারণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে আমার বিশ্বাস। ভেতরের যুক্তিহীনতা, কুসংস্কারের সাথে লড়াইটাও যে বিজ্ঞানের অংশ; বিজ্ঞানের সে সার্বিক দিক ভুলে অন্ধের হাতি দেখার মতো বিজ্ঞানচর্চাকে তিনি প্রবন্ধে যুক্তি দিয়ে নতুন ভাবনার খোরাক জুগিয়েছেন। সাহিত্য-বিষয়ক মুক্তগদ্যগুলোতে তিনি বিজ্ঞান চিন্তাকে মিশ্রিত করে চমৎকার সমন্বয় সাধন করেছেন। নতুন চিন্তার সলতে পাকিয়ে তাতে আগুনের ব্যবস্থাও করেছেন। রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের বিজ্ঞান ভাবনা অন্বেষণ করা এমন একটা গদ্য। ‘বেগম রোকেয়ার বিজ্ঞানচিন্তা’ প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক বলছেন, ‘বস্তুত বিজ্ঞান চিন্তার মধ্যে যে বিষয়টি প্রধানতা বৈজ্ঞানিক তথ্য আহরণ ও উপস্থাপন নয় বরং বৈজ্ঞানিক যুক্তি শৃঙ্খলার মাধ্যমে নিমোর্হভাবে সত্যানুসন্ধান। বেগম রোকেয়ার জীবন ও কর্মে এবং সাহিত্যচর্চায় এর দৃষ্টান্ত প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। রোকেয়ার অবরোধবাসিনী কেবল পর্দান্তরালের অবরোধবাসিনী নয়। বাইরের অবরোধের চেয়ে ভেতরের তথা মানসিকতার অবরোধ যে অনেক বেশি সুকঠিন সে বিষয়টি তিনি যথার্থভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। আলস্য, পরিশ্রমবিমুখতা, কুসংস্কার, কুশিক্ষা, অশিক্ষা ইত্যাদির বিরুদ্ধে তাঁর সংগ্রাম আংশিকভাবে সফল হয়েছে মাত্র।’ গ্রন্থটির নাম থেকেই আমরা তিনটি অংশ খুঁজে পাই― সমাজ, সাহিত্য ও বিজ্ঞান। তিন ধরনের প্রাসঙ্গিক প্রবন্ধই এখানে স্থান পেয়েছে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তবে ধরনে ভিন্ন হলেও প্রবন্ধগুলো একসূত্রে গ্রন্থিত করেছে লেখকের ভাষা ও আঙ্গিক ছক। স্ট্রাকচারাল দিক দিয়ে প্রবন্ধগুলো প্রধান ৩টি অংশে বিভক্ত করে আলোচনা সংঘবদ্ধ করেছেন বলেই মনে হয়েছে। প্রথম অংশে যে বিষয় যেমন―গ্রন্থ আলোচনা বা কোনও সাহিত্যিককে নিয়ে আলোচনার সময় ভূমিকা বা পরিচয় অংশ রেখেছেন; এরপর মাঝ অংশে ঐ বিষয়ে পূর্বতন প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত এবং নিজস্ব চিন্তা যুক্ত করেছেন; শেষ অংশে উপসংহার টেনেছেন। এই গ্রন্থের ৩৮টি প্রবন্ধের মধ্যে ৮টি প্রবন্ধ বাদ দিলে বাকি ৩০টি প্রবন্ধেই এই চারিত্র্য রক্ষিত হয়েছে। মৌলপ্রবন্ধ বা নিজস্ব চিন্তাগোত্রীয় প্রবন্ধগুলো আবার খানিকটা ভিন্ন আঙ্গিকের। ব্যক্তিকভাবে শিল্পসাহিত্য-বিষয়ক এসব প্রবন্ধই আমার কাছে এই গ্রন্থের পাওনা বলে মনে হয়েছে। ‘জটিলতা ও কবিতা প্রসঙ্গ’, ‘শব্দশিল্প: সত্য ও সাধনা’, ‘সৃষ্টিশীলতা প্রসঙ্গে’, ‘প্রত্যয় ও নৈরাজ্যের সাহিত্য’, ‘বহু সাধনায় প্রাণপণে চাই’, ‘ভাবনাকণিকা’ প্রবন্ধগুলোতে লেখকের কবি মনের ভাব ও ভাষার বহমানতা এবং গল্পকার ও কবি হলেও সুব্রত বড়ুয়ার মধ্যে যে প্রাবন্ধিকের নিরাবেগ, যুক্তিনিষ্ঠতা এবং চিন্তার সমন্বয়ের ব্যত্যয় ঘটেছে তা খুঁজে পেতে পাঠকের কষ্ট করতে হয় না।

সুব্রত বড়ুয়ার প্রবন্ধ সম্পর্কে বলতে গেলে একবাক্যে বলা চলে, wisdom in a smiling mood. কারণ প্রবন্ধ মাত্রই চিরপুরাতন ও সীমাবদ্ধ; সুব্রত বড়ুয়ার বয়ানভঙ্গিই তাকে চলমান ও প্রাণবান করে তোলে। ভাব ও ভাষা সেখানে ছন্দবদ্ধভাবে খেলা করে। ‘আমি’ কথনেই প্রবন্ধগুলো শুরু হয় এবং ক্রমশ বিষয়ে প্রবেশের পর সেই ব্যক্তি আমি সামষ্টিক আমিতে রূপান্তরিত হতে সময় নেয় না। যদিও স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশে এই আমি বা আত্মকথন ধরনে লেখার প্রবণতা বেড়েছে। তরুণ লেখকেরাও এই আত্মকথনমূলক প্রবন্ধ ধারাটি গ্রহণযোগ্য বলেই মনে করছেন। আবহাওয়া ও ভৌগোলিক কারণেই বাঙালির প্রধানত ভাববাদ ও আধ্যাত্মবাদের দিকে ঝোঁক। জীবনকে অপেক্ষাকৃত সহজ, সরল রস-সৃষ্টির মধ্য দিয়ে অবলোকনের একটা সহজাত তাগিদ এ ভূমির বৈশিষ্ট্য। সুব্রত বড়ুয়ার সাহিত্য সমাজ ও বিজ্ঞান প্রবন্ধগ্রন্থটির ভাষাও এমন পেলব-মসৃণ। বিষয়ের বৈচিত্র্যে, আঙ্গিকের নতুনত্বে, যুক্তি ও চিন্তা এ গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে―এ বিষয়ে পাঠকের সংশয় প্রকাশ করবার মতো তেমন কোনও সুযোগ বা অবকাশ নেই।  অপ্রচলিত ও গুরু-গম্ভীরতাকে সম্ভবত তিনি সচেতনভাবেই পাশ কাটিয়ে গেছেন এবং তাতে শিল্পসফলও হয়েছেন, আর এখানেই সম্ভবত প্রাবন্ধিক সুব্রত বড়ুয়ার অর্জন।

লেখক : প্রাবন্ধিক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button