আখতার হুসেনের উপদেশমূলক কবিতা : তপন বাগচী
আখতার হুসেনের সাহিত্যকর্ম : আলোচনা
কবি মদনেমোহন তর্কালঙ্কারের ‘আমার পণ’, হরিশচন্দ্র মিত্রের ‘বড় কে ?’, কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের ‘সুখী দুঃখীর দুঃখ বোঝে না’, কালিপ্রসন্ন ঘোষের ‘পারিব না’, রজনীকান্ত সেনের ‘স্বাধীনতার সুখ’, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘উত্তম ও অধম’, শেখ ফজলুল করীমের ‘স্বর্গ ও নরক’, সুনির্মল বসুর ‘সবার আমি ছাত্র’, কুসুমকুমারী দাশের ‘আদর্শ ছেলে’, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের ‘কে ?’, কালিদাস রায়ের ‘মাতৃভক্তি’, শেখ হবিবর রহমানের ‘নবীর শিক্ষা’, জসীমউদদীনের ‘প্রতিদান’, কাজী কাদের নওয়াজের ‘শিক্ষকের মর্যাদা’, আবুল হোসেন মিয়ার ‘একটুখানি’ প্রভৃতি কবিতা এখনও মানুষের মুখে মুখে ফেরে। ওসব কবিতায় ধরা রয়েছে জীবনগঠনের উপদেশ যা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য উপযোগী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুলপ্রসাদ সেন, কাজী নজরুল ইসলাম, বন্দে আলী মিয়া, কুমুদরঞ্জন মল্লিক, অন্নদাশঙ্কর রায়, সুকুমার রায়, পবিত্র সরকার, সুকুমার বড়ুয়া, মাহমুদুল্লাহ, খালেক বিন জয়েনউদ্দিন, লুৎফর রহমান রিটন, ফারুক নওয়াজ, রহীম শাহ, সুজন বড়ুয়া, আমীরুল ইসলাম প্রমুখের কবিতায় আমরা উপদেশের উপকরণ খুঁজে পাই। এই ধরনের কবিতা পাঠকের হৃদয়ে দাগ কাটে। এগুলো একই সঙ্গে বিনোদন ও শিক্ষার খোরাক জোগায়।
লক্ষণীয় বিষয় হলো তিরিশি আধুনিকতার অভিঘাতে ছন্দ-অন্ত্যমিলের গুরুত্ব কমে যেতে থাকলে উপদেশমূলক কবিতার চর্চাও কমতে থাকে। এমনকি চল্লিশ দশকের পরে কবিদের কলম থেকে উপদেশ যেন হারাতে বসে। তবে ছন্দ-অন্ত্যমিলযুক্ত রচনায় ছড়াকারগণ এই ধরনের কবিতা লেখা থেকে বিযুক্ত হননি। ছড়াকারদের মধ্যে যাঁরা কাব্যধর্মী চরণ রচনায় সিদ্ধহস্ত, তাঁরাই ধারাটি টিকিয়ে রেখেছেন। এবং বলতে দ্বিধা নেই যে, ষাটের দশকের কবি আখতার হুসেনই উপদেশমূলক কবিতাচর্চায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চলছেন। প্রথমত নিজে উপদেশমূলক কবিতা লিখে এবং দ্বিতীয়ত এই ধরনের কবিতার সংকলন প্রকাশ করে। ‘বাংলা সাহিত্যের সেরা উপদেশমূলক কবিতা’ এবং ‘বাংলা সাহিত্যের সেরা গল্পভিত্তিক উপদেশমূলক কবিতা’ তাঁর সম্পাদিত দুটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। দুটি গ্রন্থ থেকে কবিতা নিয়ে ছড়াকার রবীন আহসান সম্পাদনা করেছেন ‘বাংলা ভাষায় উপদেশমূলক কবিতা’ নামে আরেকটি সংকলন। এটিও পাঠকচাহিদা পূরণ করে চলছে। তবে আমাদের দৃষ্টি এখন কবি আখতার হুসেনের ‘সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি’ (শৈশব, ঢাকা, ২০১৯) গ্রন্থের দিকে। ৫৪টি কবিতায় তিনি তুলে এনেছেন এমন সব মান্য উপদেশ, যা সকল বয়সের পাঠকের কাছে শিক্ষণীয়।
বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক সুবলকুমার বণিক ‘দুটো কথা’ শিরোনামে এই গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন―
‘গত দুই দশকে রচিত উপদেশমূলক কবিতার সম্ভার নিয়ে এবারের বইমেলায় তিনি আমাদের সামনে এসে হাজির হয়েছেন। বইয়ের নাম রেখেছেন সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি। ভালো হয়ে ওঠার এই প্রতিজ্ঞার কথা এ যুগে এ রকম উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করার জন্য একজন কবি প্রস্তুত রয়েছেন, এটা একটা ঘটনা বটে। আখতার হুসেন একজন আপাদমস্তক আধুনিক মানুষ কিন্তু প্রাচীনগন্ধী নীতিকবিতা রচনাতে তাঁর কোনও অরুচি কিংবা অনাগ্রহ নেই। কেননা তিনি জানেন, শুভচিন্তা ও মূল্যবোধের কোনও কালাকাল নেই বরং তা জগৎ ও জীবনের সর্বকালীন মূল্যবোধকে ধারণ করে আছে।’ (দুটো কথা, পৃ. ৬) এই বক্তব্য থেকেই কবি আখতার হুসেনের কর্মের পরিচয় মেলে।
জ্ঞানের আধার যে বই, একথা সকলেই জানি এবং মানি। তা নিয়ে রচিত কবিতাটি মুদ্রিত হয়েছে এই গ্রন্থের প্রথম কবিতা হিসেবে। কেবল বই হলেও হবে না, তাতে ‘সার’ থাকতে হবে। কবিতাটি এমন :
হোক না সে বই ক্ষুদ্র যতই
ক্ষীণ কলেবর
থাকে যদি সার ছোট সে আধার
বিশাল সাগর।
(হোক না সে বই, পৃ. ০৯)
তিরিশি আধুনিকতার অভিঘাতে ছন্দোবদ্ধ কবিতাচর্চার প্রবণতা কমে গেছে। ছড়া ও গীতিকবিতায় ছন্দ ও অন্ত্যমিল বর্জনের সুযোগ এখনও তৈরি হয়নি। তাই উপদেশমূলক কবিতা এসে ভর করেছে কেবল ছড়ায় গানে, এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। আখতার হুসেন যেহেতু ছড়া লেখেন, গান লেখেন―তাই উপদেশমূলক কবিতায় তিনি স্বীয় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। বলা যেতে পারে, বাংলা ভাষায় তিনিই ধারাটি জারি রেখেছেন। অনেকের লেখাতেই উপদেশ খুঁজে পাই কিন্তু উপদেশ প্রদানের উদ্দেশ্য নিয়ে কবিতা লেখার চেষ্টা যাঁরা করেছেন তাঁদের মধ্যে আখতার হুসেনের নামই বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। আখতার হুসেনের লেখা কবিতা থেকে কিছু স্মরণযোগ্য উপদেশ উল্লেখ করা যেতে পারে :
১. ধরেছি বুঝি-বা জ্ঞানবৃক্ষের গুঁড়ি
দেখি সে তো ছোট এক পাথরের নুড়ি।
(ধরেছি বুঝি-বা জ্ঞানবৃক্ষের গুঁড়ি, পৃ. ১৪)
২. যে জ্ঞানী বলেন শিখিনি এখনও কিছু
শেখার চেষ্টা মাত্র করেছি শুরু
জ্ঞানভাণ্ডার তার হাতে ধরা দেয়
তিনিই তো হন প্রকৃত শিক্ষাগুরু।
(যে জ্ঞানী বলেন, পৃ. ২২)
৩. মানুষের পরিচয় বিশুদ্ধ মনে
নয় মোটে জমকালো বহিরাবরণে।
(মানুষের পরিচয়, পৃ. ২৭)
৪. পরের উপর ভর করে বড় যারা
সঠিক অর্থে বড় নয় মোটে তারা।
(সঠিক অর্থে, পৃ. ২৮)
৫. তাই বলি অস্ত্রের নেই প্রয়োজন
নৈতিক বলে যদি ভরা থাকে মন।
(দেহে নয়, মনে, পৃ. ৩২)
নমুনা হিসেবে পাঁচটি কাব্যাংশ উল্লেখ করে কবি আখতার হুসেনের উপদেশমূলক কবিতার ধরন বোঝাতে চেয়েছি। এসব উপদেশ তিনি অর্জন করেছেন নিজের জীবনাভিজ্ঞতা থেকে। কখনও পঠিত গ্রন্থ যেমন বাইবেল এবং চাণক্যর শ্লোক থেকেও তিনি বাণী ও ভাব গ্রহণ করেছেন। চাণক্যশ্লোক থেকে ভাব নিয়ে তিনি লিখেছেন :
যে পুরুষ জ্ঞানহীন; ষাড়ের মতোই
বয়স্ক হতে থাকে এবং ততই
বাড়তে থাকে তার মাংস দেহের
বাড়ে না কেবল তার সীমাটা জ্ঞানের।
(যে পুরুষ, পৃ. ১২)
জ্ঞানের শ্রেষ্ঠত্বের কথা বলা হয়েছে এখানে। তৃতীয় চরণে এক মাত্রা কম পড়লেও বিষয়ের গভীরতার কারণে এই দুর্বলতা ধরে পড়ে না পাঠকের মনে। আখতার হুসেন যেহেতু উপদেশকেই উদ্দেশ্য মেনেছেন, তাই এর ছন্দকে তুড়ি মেরে বক্তব্য প্রকাশ করেছেন আরও কয়েকটি কবিতায়। যেমন ‘কেবল একটি দোষ রয়েছে তার’ কবিতার প্রথম চরণেও রয়েছে মাত্রাচ্যুতি। তা সত্ত্বেও কবিতাটি খুবই ভালো :
পোষমানা সেই তোতা পাখিটা
দেখতে কী সুন্দর
খুবই মিষ্টি মধুর সুরেলা
তার সে গলার স্বর।
কেবল একটি দোষ রয়েছে তার
শেখানো সে কিছু বুলি আওড়ায়
সারাদিন বারবার।
শেখানো বুলির শেকড় গভীরে নয়
তাই তো কারুর হৃদয় করে না জয়
ঠোঁটেই জন্ম, ঠোঁটেই মৃত্যু হয়।
(কেবল একটি দোষ রয়েছে তার, পৃ. ১৩)
অন্ত্যমিলের মুন্সিয়ানা ছাড়া ছন্দের কবিতা সফলতা লাভ করে না। কেবলই বক্তব্যের পরিস্ফুটনের জন্য ‘চোনা/ফণা’র মতো দুর্বল অন্ত্যমিল একবার লিখে ফেললেও গোটা গ্রন্থে আর কোনও দুর্বলতা নেই। বরং স্বরসঙ্গতিকে প্রাধান্য দিয়ে তিনি দুই মাত্রার মিলের সঙ্গে ছয়মাত্রার শব্দ থেকে মধ্যখণ্ডন করে মিলবাচক শব্দ বেছে নিয়ে চমৎকার আবহ সৃষ্টি করেছেন :
মানুষের পরিচয় বিশুদ্ধ /মনে
নয় মোটে জমকালো বহিরাব/রণে।
(মানুষের পরিচয়, পৃ. ২৭)
কিংবা
সবকিছু থাকে যদি নখদর্পণে (দর/পণে)
কাণ্ডারি ঘুম যান ভয়হীন /মনে।
(দেশের কাণ্ডারি যিনি, পৃ. ২৯)
কিংবা তিন ও চার মাত্রার শব্দের মধ্যখণ্ডন করে অপূর্ণ দুই মাত্রার মিল প্রয়োগ করেছেন মুন্সিয়ানার সঙ্গে। যেমন―
ঠিক সেই ক্ষণে এক সরল র/মণী
কোলে তুলে নেয় তাকে বলে ‘সোনা/মণি’।
(ঠিক সেই ক্ষণে, পৃ. ৩০)
অন্ত্যমিলের এই কারুকাজ নতুন নয় কবি আখতার হুসেনের জন্য। কিশোর-উপযোগী দীর্ঘ কবিতা লিখতে তিনি পছন্দ করেন। কাহিনি কবিতাকে তিনি আয়ত্তে রেখেছেন। সেইসব কাহিনি ও চরিত্র থেকে তিনি উপদেশের উপকরণ খুঁজে নেন। এর জন্য কেবল মনুষ্য চরিত্র নয়, প্রাণিকুল থেকেও চরিত্র বেছে নেন। যেমন :
গাধাদের ডেকে বলে অশ্বেরা
তোমাদের চেয়ে আমরা সেরা।
গতির খেলায় তোমরা কি পারো
আমাদের কাছে সর্বদা হারো।
(তুলনা, পৃ. ৬০)
অপূর্ণ পর্ব ছাড়া ছয় মাত্রার প্রবহমান মাত্রাবৃত্তে গল্প বলার কৃতিত্ব আখতার হুসেন ভালো করে দেখিয়েছেন। বিশেষ করে ৭+৭+৭ মাত্রার প্রবহমান মাত্রাবৃত্তে কবিতা লেখার মতো কঠিন কাজটিও তিনি ভালো পারেন। যেমন :
আমার কাছে সেই/ বাগান গোলাপের/ সত্যি দামহীন
সকালে সব গাছে/ যেখানে গোলাপের/ ফোটে সে প্রতিদিন।
যেখানে একযোগে/ ফুলেরা ছড়ায় না/ গন্ধ মধুময়
তেমন উদ্যান/ নামেই আছে শুধু/ সত্যি খাঁটি নয়।
(মূল্যহীন সেই বাগান, পৃ. ৪১)
ষাটের দশক থেকে বাংলাদেশের কবিতায়, বিশেষ করে কিশোর কবিতা, ছড়া ও গানে আখতার হুসেনের অবদানকে অস্বীকার করার উপায় নেই। দেশের প্রতিটি গণ-আন্দোলনেও সক্রিয় ছিলেন ছড়া হাতিয়ার করে। প্রগতিশীল উদার অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বলীয়ান শিশুদের জন্য কাজ করেছেন ‘কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসরে’র মাধ্যমে। সারা দেশের শিশু-কিশোরদের গড়ে তুলতে চেয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়। শিশু-কিশোরদের সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চায় উদ্বুদ্ধ করেছেন। শিশু-সাহিত্যচর্চাকেও উৎসাহিত করেছেন তিনি। বড়দের জন্য লেখার চেয়ে শিশুদের জন্য লেখাকেই তিনি জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছেন। শিশু-সাহিত্যচর্চায় অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার এবং বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেছেন। তার চেয়ে বড় পুরস্কার হলো শিশু-কিশোরদের ভালোবাসা। শিশুরা যাতে ভবিষ্যৎ জীবনের দিকনির্দেশনা পায় তার জন্য তিনি লিখে চলছেন উপদেশমূলক কবিতা। সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি গ্রন্থটি আখতার হুসেনের সেই শুভ উদ্যোগেরই স্মারক। লক্ষ্য ছোটোরা হলেও বড়োদের জন্যও উপাদেয় এই গ্রন্থ। গল্প, নাটক, জীবনী রচনা করলেও আখতার হুসেন মূলত কবি, এই গ্রন্থ তারই প্রমাণ। কবি আখতার হুসেনের উপদেশমূলক কবিতা পাঠ করে সকল বয়সের পাঠকই চেতনাকে ঝালিয়ে নিতে পারে। তাঁর মাধ্যমেই আবার এই ধারার কবিতা চর্চা শুরু হলে পাঠক হিসেবে আমরা আনন্দিত হব।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক