আর্কাইভপ্রবন্ধ

উপন্যাসের রূপশ্রেণি

মাহবুবুল হক

পর্ব-২

২. ৪. দার্শনিক উপন্যাস (Philosophical Novel)

ঔপন্যাসিকেরা প্রায়শ তাঁদের সাহিত্যকর্মে মানবসমাজ, বিশ্বজগৎ, নৈতিক মূল্যবোধ বা এই ধরনের ভাবধারণা সম্পর্কিত তত্ত্ব ও অভিমত সন্নিবেশ করে থাকেন। যে সমস্ত উপন্যাসে এ ধরনের মননগত অন্বেষণ মুখ্য উদ্দেশ্য হিসেবে প্রতীয়মান হয় সেগুলিকে দার্শনিক উপন্যাস হিসেবে বিবেচনা করা চলে। এ ধরনের উপন্যাসে কখনও কখনও প্রধান বা অন্য কোনও চরিত্রকে কোনও ভাবধারণা, তত্ত্ব বা দৃষ্টিভঙ্গির প্রবক্তা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়ে থাকে।

দার্শনিক উপন্যাসের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার যে, তা উপন্যাস―কোনও দার্শনিক গ্রন্থ নয়। দার্শনিক গ্রন্থ পুরোপুরিভাবে ভাবধারণা-নির্ভর হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে দার্শনিক উপন্যাসের মূল বিষয় হচ্ছে, সাধারণ মানুষের জীবনে দর্শনের প্রভাবের দিককে ফুটিয়ে তোলা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় গ্রিক দার্শনিক প্লাতো কিংবা ফরাসি লেখক জাঁ জাক রুশো তাঁদের গ্রন্থে শিশুর লালন ও শিক্ষার বিষয়ে তত্ত্ব উপস্থাপন করেছেন। কিন্তু ইংরেজ ঔপন্যাসিক চার্লস ডিকেন্স তাঁর হার্ড টাইমস (১৮৫৪) উপন্যাসে দেখিয়েছেন পারিবারিক জীবন সম্পর্কিত তত্ত্ব কীভাবে দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োগের ক্ষেত্রে বদলে যায়। উপন্যাসে দেখা যায়, শিক্ষাতত্ত্ব তার প্রবক্তার সন্তানদের জীবনে ট্র্যাজিক পরিণতি বয়ে আনে। জার্মান লেখক টমাস মান তাঁর ডের জাউবারবার্গ (দি ম্যাজিক মাউন্টেন, ১৯২৪) উপন্যাসে আধুনিক সভ্যতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক অন্বেষণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকের আত্মপীড়নের দিকটি তুলে ধরেছেন। আধুনিক জগতে ব্যক্তিমানুষ যে প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয় তা নিয়ে রচিত হয়েছে চেক লেখক ফ্রাঞ্জ কাফকার ডের প্রোজেস (দ্য  ট্রায়াল, ১৯২৫) নামের দার্শনিক উপন্যাসটি। নরওয়েজীয় লেখক ইয়স্তেন গার্ডার-এর লেখা দার্শনিক উপন্যাস সোফির জগৎ-ও (১৯৯১) এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।

রুশ সাহিত্যে মিখাইল লেরমন্তভের আমাদের সময়কার নায়ক (১৮৪০) দার্শনিক উপন্যাস রচনার প্রথম প্রয়াস হিসেবে গণ্য।

২.৫ রাজনৈতিক উপন্যাস (Political Novel)

রাজনৈতিক উপন্যাসে রাজনীতি ও উপন্যাসের মেলবন্ধন ঘটে। এ ধরনের উপন্যাসে রাজনৈতিক মতাদর্শ, ভাবনা-চিন্তা, দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও রাজনৈতিক পরিবেশ প্রাধান্য পায়। রাজনৈতিক ঘটনাবর্তে মুখ্য চরিত্রগুলোর মনোজগৎ ও কর্মজীবন আলোড়িত হতে দেখা যায়। রাজনৈতিক উপন্যাসে রাজনৈতিক প্রতিবেশে ব্যক্তির চিন্তা ও কর্মে রাজনীতির ভূমিকা  প্রধান হয়ে ওঠে।

রাজনৈতিক উপন্যাস রচিত হয় রাজনৈতিক ঘটনা ও কাহিনিকে অবলম্বন করে। তাতে দেশ ও জাতির, সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাষ্ট্রিক ব্যবস্থা, তার দ্বন্দ্ব-সমস্যা-সংকট, রাজনৈতিক উত্তেজনাময় ঘটনা, সর্বজনীন জাতীয় ভাবাবেগ ইত্যাদি পরিস্ফুট হয়ে ওঠে।

কখনও কখনও ঐতিহাসিক উপন্যাসের বিষয় ও উপকরণে রাজনীতির প্রভাব ও ছাপ থাকে, থাকে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত। আবার সামাজিক উপন্যাসেও থাকতে পারে বৃহত্তর রাজনৈতিক পটভূমি। এগুলিকে রাজনৈতিক উপন্যাস আখ্যা দেওয়া কতটা সমীচীন ? এ ক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার, কোনও উপন্যাস তখনই রাজনৈতিক উপন্যাস হিসাবে বিবেচ্য যখন ঐতিহাসিক বা সামাজিক প্রসঙ্গ ছাপিয়ে  রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও আন্দোলন উপন্যাসের মুখ্য ব্যাপার হয়ে ওঠে। বস্তুত, রাজনৈতিক ঘটনাক্রমের মধ্য থেকেই, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতময় পরিমণ্ডলেই রাজনৈতিক উপন্যাসের উদ্ভব। রাজনৈতিক ঘটনাবলি চিত্রণের মধ্য দিয়েই গড়ে ওঠে এ জাতীয় উপন্যাসের আখ্যানবস্তু। অর্থাৎ যদি রাজনৈতিক সমস্যাই উপন্যাসের প্রধান অবলম্বন হয়, যদি রাজনৈতিক ঘটনাই উপন্যাসের চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে এবং তা প্রধান চরিত্রগুলির ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে তখনই কোনও উপন্যাসকে রাজনৈতিক উপন্যাস হিসেবে গণ্য করা চলে।

সার্থক রাজনৈতিক উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে লেখককে কয়েকটি বিষয়ে সচেতন হতে হয়।  প্রথমত, তাঁকে লক্ষ্য রাখতে হয় উপন্যাস যেন কোনওভাবেই বিশেষ রাজনৈতিক তত্ত্ব বা মতাদর্শের প্রচার-মাধ্যমে পরিণত না হয়। দ্বিতীয়ত, সামাজিক-রাজনৈতিক সমস্যার রূপায়ণ ঘটানোর ক্ষেত্রে ঔপন্যাসিককে বিশেষ যত্নবান হতে হয় উপন্যাসের শিল্পরূপ নির্মিতিতে। তৃতীয়ত, রাজনৈতিক ঘটনা ও তথ্য পরিবেশনের মধ্য দিয়ে উপন্যাসে গভীর জীবন-সত্যকে খুঁজে নিতে হয়।

বিশ্বসাহিত্যে রাজনৈতিক উপন্যাসের সূচনা ফরাসি লেখকদের হাতে। উনিশ শতকের বিখ্যাত ফরাসি ঔপন্যাসিক স্তাঁদাল (Stendhal) তাঁর লাল ও কালো (লা রগ লা নোইল, ১৮৩১) ও পার্মার চার্টারহাউস (লা চার্টারাউস দ্য পার্মা, ১৮৩৯) উপন্যাসে সে যুগের ফরাসি সমাজে বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যেকার রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র, ক্ষয়িষ্ণু অভিজাত সম্প্রদায়ের সঙ্গে নবোদ্ভূত ধনিক শ্রেণির বিরোধ, মতাদর্শজনিত দ্বন্দ্ব, ক্ষমতার লালসা ও অপব্যবহার,  রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে প্রাধান্য বিস্তারের লড়াই ইত্যাদি রাজনৈতিক দ্বন্দ্বজটিল পরিবেশ সার্থকভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।

উনিশ শতকেই রুশ লেখক ইভান তুর্গেনেভ তাঁর বাবুদের বাসা (The House of Gentlefolk, ১৮৫৮), পিতা ও পুত্র (আৎসি ই দেইতি, ১৮৬১) প্রভৃতি উপন্যাসে রাজনৈতিক পরিবেশ ও দ্বন্দ্বসংঘাতকে সার্থক ও নিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। প্রখ্যাত রুশ ঔপন্যাসিক দস্তয়েভস্কির ভূতাবিষ্ট (বেসি, ১৮৭২) উপন্যাসে উনিশ শতকের রাশিয়ার রাজনৈতিক দ্বন্দ্বসংঘাত, সন্ত্রাসবাদ ইত্যাদি রাজনৈতিক ঝড়ো হাওয়ার উত্তালতায় যে তীক্ষèতায় বর্ণিত হয়েছে তাতে পাঠক সহজেই সে যুগের রাজনৈতিক স্পন্দনের সঙ্গে পরিচিত হন। রুশ লেখক মাক্সিম গোর্কি রচিত মা (মাত, ১৯০৬) বিপ্লবী রাজনৈতিক উপন্যাস হিসেবে বিশ্বখ্যাত। জর্জ অরওয়েল-এর নাইনটিন এইটি ফোর (১৯৪৯) সম্পূর্ণত রাজনৈতিক উপন্যাস। এ উপন্যাসে স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের সর্বগ্রাসী রূপ ও তার ভয়াবহ নির্মমতা পাঠকের সামনে হাজির করেছেন লেখক।

বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ (১৮৮২) উপন্যাসে লক্ষণীয় স্বদেশব্রত, স্বাধীনতা স্পৃহা ও দেশের জন্যে আত্মত্যাগের আকাক্সক্ষা। তাঁর দেবী চৌধুরাণী (১৮৮৪), সীতারাম (১৮৮৭) প্রভৃতি উপন্যাসে রাজনীতি এসেছে পটভূমিকা হিসেবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষণ থাকলেও এগুলিকে খাঁটি রাজনৈতিক উপন্যাস হিসাবে গণ্য করা চলে না।

রবীন্দ্রনাথের ঘরে বাইরে (১৯১৬) উপন্যাসে স্বদেশি আন্দোলনের পটভূমিতে জাতীয়তা, রাজনৈতিক লক্ষ্য ও কর্মপন্থাকে বিচার ও মূল্যায়ন করা হয়েছে। এই আন্দোলনের অভিঘাতে প্রধান চরিত্রগুলোর অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্য তাৎপর্যপূর্ণভাবে ফুটে ওঠে। রবীন্দ্রনাথের চার অধ্যায় (১৯৩৪) উপন্যাসটি সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী রাজনৈতিক কর্মতৎপরতার পটভূমিতে রচিত। ভারতবর্ষে ব্রিটিশবিরোধী ভারতীয় স্বাধীনতা-আন্দোলনে সশস্ত্র বিপ্লবী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রতিবেশ এবং উপন্যাসের চরিত্রগুলোর ওপর সেই প্রতিবেশের প্রভাব বিশেষভাবে বর্ণিত হয়েছে এ উপন্যাসে।

শরৎচন্দ্রের পথের দাবী (১৯২৬) দেশপ্রেমমূলক রাজনৈতিক উপন্যাস। এ উপন্যাসে ভারতবর্ষে ব্রিটিশবিরোধী গোপন বিপ্লবী রাজনৈতিক তৎপরতার রোমাঞ্চকর কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। একদিকে গান্ধীজির আন্দোলন এবং অন্যদিকে সন্ত্রাসবাদ―এ দুইয়ের প্রেক্ষাপটে এখানে বিধৃত হয়েছে সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী পন্থায় ভারতবর্ষের মুক্তির প্রয়াস। ব্রিটিশরাজ উপন্যাসটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করায় তা সেকালে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং ব্রিটিশবিরোধী কর্মতৎপরতায় অনুপ্রেরণা জোগায়।

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ধাত্রীদেবতা (১৯৩৭) উপন্যাসে সমকালীন রাজনীতির প্রসঙ্গ এসেছে। এ উপন্যাসে সন্ত্রাসবাদ থেকে গণ-আন্দোলনের দিকে রাজনীতির পালাবদলের ইঙ্গিত রয়েছে। উপন্যাসে  দেখা যায়, রাজনৈতিক ঘটনাবর্তের ভেতর দিয়ে শিবনাথ চরিত্র এক নতুন তাৎপর্য আবিষ্কার করে। তাতে চরিত্রটি যেন একটি যুগের প্রতিনিধি হয়ে ওঠে।

গোপাল হালদারের একদা (১৯৩৯), অন্যদিন (১৯৫০) ও আর এক দিন (১৯৫১)―এই ত্রয়ী উপন্যাসকে রাজনৈতিক উপন্যাস হিসেবে বিবেচনা করা চলে। এই ত্রয়ী উপন্যাসের পাতায় পাতায় লিপিবদ্ধ হয়েছে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে লেখকের অভিজ্ঞতা। সতীনাথ ভাদুড়ীর জাগরীও (১৯৪৬) সার্থক রাজনৈতিক উপন্যাস। ১৯৪২ সনের আগস্ট আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত এ উপন্যাসে একটি পরিবার সেই সময়ের রাজনৈতিক ঘটনাবর্ত ও রাজনৈতিক মতাদর্শের  সংঘাতের মুখোমুখি হয়েছে। অসীম রায়ের আবহমানকাল (১৯৭৮) উপন্যাসে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির রূপান্তরকে কয়েক দশকের পটভূমিতে দেখা হয়েছে। রাজনৈতিক ঘটনাবর্তে আলোড়িত জীবনের ছবি পাওয়া যায় আরও অনেক উপন্যাসে। উল্লেখযোগ্য হলো : মনোজ বসুর ভুলি নাই (১৯৪৩), মহাশ্বেতা দেবীর হাজার চুরাশির মা (১৯৭৪) ও চোট্টি মুণ্ডা এবং তার তীর (১৯৮২), গজেন্দ্রকুমার মিত্রের পাঞ্চজন্য (১৯৭৭-১৯৭৯), সমরেশ মজুমদারের উত্তরাধিকার (১৯৮০) ও কালবেলা (১৯৮৩) ইত্যাদি।

২.৬. আঞ্চলিক উপন্যাস (Regional Novel)

আখ্যান ও চরিত্র, ঘটনা ও সমস্যা রূপায়ণের দিক থেকে আঞ্চলিক উপন্যাসে বিশেষ ভৌগোলিক অঞ্চলের মানুষের জীবনের রূপচিত্র অঙ্কিত হয়। এই শ্রেণির উপন্যাসে কোনও বিশেষ অঞ্চলের জীবনযাত্রা, আচার-সংস্কার, বিশ্বাস-ধারণা, পরিবেশ-প্রতিবেশ ইত্যাদির শৈল্পিক রূপায়ণ ঘটে।

এ ধরনের উপন্যাসে কোনও বিশেষ অঞ্চলের জলবায়ু, জনপদ, জনজীবন ও জীবনসংগ্রাম উপন্যাসের ভাববস্তুর অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে ওঠে এবং চরিত্রগুলোর আচার-ব্যবহার, রীতিনীতি, সংস্কার-বিশ্বাস প্রভৃতিতে আঞ্চলিক বা স্থানীয় বৈশিষ্ট্যের (ষড়পধষ পড়ষড়ঁৎ) প্রতিফলন ঘটে।

মার্কিন সাহিত্যতাত্ত্বিক এম এইচ অ্যাব্রাম্স্-এর মতে, এই শ্রেণির উপন্যাস সুনির্দিষ্ট অঞ্চলের প্রতিবেশ, ভাষা, প্রথাকে কেবল স্থানীয় বৈশিষ্ট্যসমেত ফুটিয়ে তেলে না, সেগুলোর দ্বারা প্রভাবিত চরিত্রের মেজাজ ও চিন্তাধারা, তাদের অনুভূতি ও কর্মধারাকেও পরিস্ফুট করে। 

যদি কোনও বিশেষ অঞ্চল উপন্যাসের অপরিহার্য পটভূমি হিসাবে ব্যবহৃত হয় এবং সেই বিশেষ অঞ্চলের বৈশিষ্ট্যগুলোই উপন্যাসের কাহিনি ও চরিত্রের ক্রিয়াকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে, তখনই তাকে যথার্থ আঞ্চলিক উপন্যাসের পর্যায়ভুক্ত করা চলে।

আইরিশ লেখিকা মারিয়া ওজওয়ার্থই আঞ্চলিক উপন্যাসের প্রথম স্রষ্টা। তাঁর ক্যাসেল র‌্যাকরেন্ট (Castle Rackrent, ১৮০০) উপন্যাসটি আঞ্চলিক উপন্যাসের বিশেষ রূপবৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। এ উপন্যাসে ঔপন্যাসিক আয়ারল্যান্ডের আঞ্চলিক জীবনচর্যা, সেখানকার কথ্য ভাষাভঙ্গি ইত্যাদি নিখুঁত বাস্তবতায় ফুটিয়ে তুলেছেন। ইংরেজ লেখিকা এমিলি ব্রন্টির উইদারিং হাইটস (১৮৪৭) উপন্যাসে রয়েছে পার্বত্যভূমি ও জলাভূমির পরিবেশে ক্যাথারিন আরন্শ-এর প্রতি অনাথ হিথক্লিফ-এর ভালোবাসা।

ইংরেজি সাহিত্যে উপন্যাসের বিশেষ শ্রেণি হিসেবে আঞ্চলিক উপন্যাসের উদ্ভব ঘটেছে উনিশ শতকের  অন্যতম  শ্রেষ্ঠ ইংরেজ ঔপন্যাসিক টমাস হার্ডির ওয়েসেক্স  নভেল্স্ প্রকাশিত হবার পর। হার্ডি তাঁর ফার ফ্রম দ্য ম্যাডিং ক্রাউড (১৮৭৪), দ্য রিটার্ন অব দ্য নেটিভ (১৮৭৮), দ্য মেয়র অব দি ক্যাস্টারব্রিজ (১৮৮৬) প্রভৃতি উপন্যাসে ইংলন্ডের ওয়েসেক্স অঞ্চলের ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার, জনজীবন ও জীবনধারা, প্রাকৃতিক পরিবেষ্টন ও জনজীবনে তার প্রভাব, লোকবিশ্বাস ও সংস্কার ইত্যাদি তুলে ধরেছেন। তাঁর দ্য রিটার্ন অব দ্য নেটিভ পুরোপুরি আঞ্চলিক উপন্যাস। প্রাকৃতিক পটভূমি তথা ঊষর প্রান্তরই এ উপন্যাসটির প্রকৃত নায়ক, চরিত্রগুলোর ভাগ্যেরও নিয়ামক।

ইংরেজ ঔপন্যাসিক আর্নল্ড বেনেটের আনা অফ দ্য ফাইভ টাউনস (১৯০২), দি ওল্ড ওয়াইভস টেল (১৯০৮), ক্লেহ্যাংগার (১৯১০), প্রভৃতি গ্রন্থও খাঁটি আঞ্চলিক উপন্যাস হিসাবে বিবেচ্য। এই উপন্যাসগুলিতে বেনেট কয়েকটি মফস্সল শহরের আঞ্চলিক জীবন ও পরিবেশ স্থানীয় ঐতিহ্যের আলোয় নিখুঁত ও অনুপুঙ্খভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। সাম্প্রতিক কালের উল্লেখযোগ্য আঞ্চলিক উপন্যাস আইসল্যান্ডের বিখ্যাত ঔপন্যাসিক হ্যারল্ড ল্যাকস নেকস-এর দি ইনডিপেন্ডেন্ট পিপল (১৯৩৪-১৯৩৫)।

বাংলা সাহিত্যে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ই প্রথম আঞ্চলিক উপন্যাস রচয়িতা। হাঁসুলি বাঁকের উপকথা (১৯৪৭) নিঃসন্দেহে বাংলা সাহিত্যে সর্বশ্রেষ্ঠ আঞ্চলিক উপন্যাস। উপন্যাসটি গড়ে উঠেছে একটি বিশেষ অঞ্চলের হিন্দু সমাজের নিম্নবর্ণের কাহার গোষ্ঠীর জীবন নিয়ে। উপন্যাসে বর্ণিত তাদের পৌরাণিক কল্পনা, ধর্মবিশ্বাস ও সংস্কার, আচার ও প্রথা, সমাজ ও সংস্কৃতি, কিংবদন্তি ও আখ্যান ঐ নৃগোষ্ঠীর জীবনধারার পরিচায়ক ও নিয়ামক।

শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় কয়লাকুঠি (১৯২৯) উপন্যাসে সাঁওতাল-কোল-মুণ্ডা প্রভৃতি নৃগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা, আচার-ব্যবহার, রীতি-নীতি, সংস্কার-বিশ্বাস প্রভৃতিকে যথাযথ নির্লিপ্ততায় ফুটিয়ে তুলেছেন। অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৫৬), সমরেশ বসুর গঙ্গা (১৯৫৭) প্রভৃতি বাংলা আঞ্চলিক উপন্যাসের ধারায় অনবদ্য সংযোজন। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের উপনিবেশ (১ম, ১৯৪২, ২য় ১৯৪৫, ৩য় ১৯৪৬), প্রফুল্ল রায়ের পূর্ব পার্বতী (১৯৫৮), প্রভৃতিও উল্লেখযোগ্য আঞ্চলিক উপন্যাস। বাংলাদেশের সাহিত্যে শামসুদ্দীন আবুল কালামের কাশবনের কন্যা (১৯৫৪) ও সমুদ্রবাসর (১৯৮৬) আঞ্চলিক উপন্যাস হিসেবে স্মরণীয়।

২.৭ কারা উপন্যাস

কারাগারের চার দেয়লের অন্তরালে নানা ঘটনা, সেখানকার পরিবেশ-পরিস্থিতি, নিয়মকানুন, ব্যবস্থাপনা, বন্দিদের জীবন ও কর্তৃপক্ষ তথা পুলিশ-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ক্রিয়াকলাপ ইত্যাদি―এক কথায় কারাজীবন ও পরিবেশ নিয়ে লেখা উপন্যাসকে বলা হয় ‘কারা উপন্যাস’। কারাবন্দিদের মধ্যে প্রথমেই উল্লেখযোগ্য চোর, ডাকাত, খুনি ইত্যাদি অপরাধী ও সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি এবং বিচারাধীন হাজতি। দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত কয়েদিদের কাছে জেলখানা ঘর-বাড়ির মতো, কারাপ্রাচীরের অন্তরালেই চলে তাদের জীবন-পরিক্রমা। কারাগারে আরও থাকেন রাজনৈতিক বন্দি। রাষ্ট্রব্যবস্থা ও শাসক-শোষকদের বিরুদ্ধে যাঁরা রাজনৈতিক আন্দোলনে সামিল হন তাঁদের অনেক সময় রাজনৈতিক দমন-পীড়নের শিকার হতে হয়। তাদের ক্ষেত্রে  কারাগার ও কারাযন্ত্র হচ্ছে শাসকশ্রেণির দমনপীড়নের হাতিয়ার। কারান্তরালের এইসব নানা ধরনের বন্দি ও কারাকর্মীদের নিয়ে রচিত উপন্যাস ‘কারা উপন্যাসে’র পর্যায়ে পড়ে।

কারাবন্দি অবস্থায় লেখা উপন্যাস হলেই তা কারা উপন্যাসের পর্যায়ে পড়ে না। কারাগারে লেখা হোক বা কারাগারের বাইরে লেখা হোক কারা উপন্যাস হতে হলে তার বিষয়বস্তু অবশ্যই হতে হবে কারাজীবন। এ ক্ষেত্রে তুলনীয় গোপাল হালদারের একদা (১৯৩৯) ও সতীনাথ ভাদুড়ীর জাগরী (১৯৪৬)। একদা কারাগারে বসে লেখা, তাতে রয়েছে একজন রাজবন্দির প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। কিন্তু তার বিষয় কারাজীবন নয়। তাই একে কারা উপন্যাস বলে বিবেচনা করা হয় না। পক্ষান্তরে সতীনাথ ভাদুড়ীর জাগরীকে অন্যতম সেরা কারা উপন্যাসের মর্যাদা দেওয়া হয়। এর কারণ, কারাজগতের সার্বিক, অনুপুঙ্খ ও বস্তুনিষ্ঠ পরিচয় এ উপন্যাসে শিল্পরূপ পেয়েছে।

পাশ্চাত্য সাহিত্যে কারাজীবনের প্রতিফলন ঘটেছে হাঙ্গেরীয়-ব্রিটিশ লেখক আটুর কোয়েস্টলারের ডার্কনেস অ্যাট নুন (জার্মান Sonnenfinsternis, ১৯৪০) উপন্যাসে। এ উপন্যাসে রুবাশভ নামে এক বৃদ্ধ বলশেভিকের  গ্রেফতার, শাস্তি ও কারাজীবনের বর্ণনা আছে। রুশ ঔপন্যাসিক আলেকসান্দ্র সোলজেনৎসিন রচিত ইভান দেনিচোভিচের জীবনের একদিন (রুশ : আদিন দেন ইভানা দানিচেভিচা, ১৯৪০) উপন্যাসে সোভিয়েত শ্রমশিবিরে নায়কের এক দিনের কারা জীবনের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে।

বাংলা সাহিত্যে কিছু উল্লেখযোগ্য কারা উপন্যাস রয়েছে। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাষাণপুরী (১৯৩৩) উপন্যাসে কারাপরিবেশের আশাহীন নিরুদ্দম ও নিস্তেজ জীবনের এবং অদ্ভুত ও বিচিত্র চরিত্রের ছবি অঙ্কিত হয়েছে। অতীন্দ্রনাথ বসুর বি কেলাসও (১৯৪১) কারাজীবন নিয়ে লেখা উপন্যাস হিসেবে বিবেচ্য। জরাসন্ধের [চারুচন্দ্র চক্রবর্তী] লৌহকপাট (তিন পর্ব : ১৯৫৪, ১৯৫৫, ১৯৫৮), তামসী (১৯৫৮) ও ন্যায়দণ্ড (১৯৬০) বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য কারা উপন্যাস। কর্মসূত্রে কারাগাররক্ষক ছিলেন এমন একজন লেখকের বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে এসব উপন্যাসে কারাবন্দি মানুষের জীবনের সহানুভূতিময় চরিত্র অঙ্কিত হয়েছে। বাংলাদেশের সাহিত্যে সত্যেন সেনের রুদ্ধদ্বার মুক্তপ্রাণ (১৯৭৩) উল্লেখযোগ্য কারা উপন্যাস। এটি রাজবন্দির জবানিতে এটি একটি আত্মজৈবনিক উপন্যাস।

২.৮ গথিক উপন্যাস (Gothic Novel)

যে উপন্যাসে কোনও অন্ধকার ক্ষয়িষ্ণু বা ধ্বংসপ্রাপ্ত দুর্গ কিংবা মধ্য যুগের কোনও স্থাপত্যভবন বা পরিবেশকে (ভূগর্ভস্থ কক্ষ, গোপন কুঠরি, রহস্যময় দরজা-জানালা ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট গা ছম ছম করা পরিবেশ) পটভূমি করে সৃষ্ট কাহিনিতে রহস্য ও অলৌকিকতাজনিত ভীতি ও আতঙ্কের সঞ্চার করা হয় সে উপন্যাস সাধারণত গথিক উপন্যাস নামে পরিচিত। সাহিত্যের রূপশ্রেণি হিসেবে গথিক উপন্যাসকে রোমান্টিক সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত করা চলে। আঠারো ও উনিশ শতকের ইউরোপে, বিশেষ করে ইংল্যান্ডে, এই ধরনের উপন্যাস বিশেষ জনপ্রিয় হয়। এ উপন্যাসগুলির গথিক নামকরণের পেছনকার কারণ হলো, এসব উপন্যাসের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঘটনা ঘটেছে গথিক স্থাপত্য রীতিতে তৈরি মধ্যযুগীয় দুর্গে। এসব দুর্গে অনেক গোপন পথ, ভূগর্ভস্থ অন্ধকার কারাকক্ষ, অন্ধকূপ, টাওয়ার ইত্যাদি থাকে যা রহস্যময় আশ্চর্যজনক ঘটনা তৈরির অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে। অধিকাংশ গথিক উপন্যাসের কাহিনি গড়ে উঠেছে ইতালি কিংবা স্পেনে। এর কারণ হলো, এসব দেশকে ইংল্যান্ডবাসী দূরবর্তী ও রহস্যময় মনে করত।

গথিক উপন্যাসের মূল ভিত্তি হচ্ছে কোনও অলৌকিক বা লোমহর্ষক ঘটনা বা কাহিনি। কাহিনি উপস্থাপনায় থাকে গভীর রহস্য, তীব্র সংশয়, মারাত্মক ভয়, ব্যাপক উত্তেজনা ইত্যাদি। এ ধরনের রচনা রোমান্সধর্মী এবং গঠনের দিক থেকে অনেকটা সরলরৈখিক। তা পাঠককে রহস্য ও বিস্ময়ের ঘোরের মধ্যে রাখতে সচেষ্ট হয় এবং মুহূর্তে মুহূর্তে চমকের জন্ম দেয়।

ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম উল্লেখযোগ্য গথিক উপন্যাস হচ্ছে, ইংরেজ লেখক হোরেস ওয়ালপোলের দ্য ক্যাসল অব অটর‌্যান্টো (১৭৬৪)। উপন্যাসের কাহিনি গড়ে উঠেছে তেরো শতকের ওটর‌্যান্টো দুর্গকে কেন্দ্র করে যেখানে অভিশাপ, খুন, অতি প্রাকৃতিক শুক্তর লীলা ইত্যাদির ছায়পাতে শিহরণ জাগানো পরিবেশের সৃষ্টি হয়। কাহিনি গড়ে উঠেছে ইতালির একটি দুর্গ দখলে নেওয়ার লড়াইকে কেন্দ্র করে। এই লড়াইয়ে একটি চরিত্রকে বিষ খাওয়ানো হয়, অন্য একজনকে খুন করা হয় আর তৃতীয় জন থেঁতলে মরে দৈত্যাকার হেলমেটের তলায় পড়ে।

গথিক উপন্যাসের সবচেয়ে সফল রচয়িতা হিসেবে পরিচিত ইংরেজ লেখিকা অ্যান র‌্যাডক্লিফ। কাহিনিতে অতিলৌকিক ও ভতিপদ উপাদান উপস্থাপনা ও লোমহর্ষক পরিবেশ সৃষ্টিতে তিনি ওয়ালপোলেল তুলনায় অনেক বেশি দক্ষতার পরিচয় রেখেছেন। কাহিনি বয়ানে তিনি বাস্তবতার সঙ্গে অতিপ্রাকৃতের সমন্বয় সাধনে যেমন কৃতিত্ব দেখিয়েছেন তেমনি সূক্ষ্ম মনস্তত্ত্বের যোগ সাধনেও সফল হয়েছেন। চার খণ্ডে রচিত দ্য মিস্ট্রিজ অফ উডোলফো (১৭৯৪) তাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় গথিক উপন্যাস। এ উপন্যাসের কাহিনি অলৌকিকতায় ভরপুর। কিন্তু কাহিনির পরিণতিতে যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা হাজির করে লেখিকা তাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে সচেষ্ট হয়েছেন। ইংরেজি সাহিত্যে অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গথিক উপন্যাস হচ্ছে : ম্যাথু গ্রেগরি লুইস রচিত দ্য মংক (১৭৯৬), মেরি উলস্টেনক্র্যাফ্ট শেলী রচিত ফ্রাংকেনস্টাইন (১৮১৮), আইরিশ ঔপন্যাসিক চার্লস মাচুরিন রচিত মেলমাউথ দ্য ওয়ানডারার (১৮২০), আইরিশ লেখক ব্রাম স্টোকারের ড্রাকুলা (১৮৯৭) প্রভৃতি।

বাংলা গথিক উপন্যাসের উল্লেখযোগ্য উদাহরণ প্রমথনাথ বিশীর লালকেল্লা (১৯৬৪), আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কাল তুমি আলেয়া (১৯৬২) প্রভৃতি।

২.৯ শিক্ষামূলক উপন্যাস (Educational Novel)

সাহিত্য-তাত্ত্বিক অ্যাব্রাম্্স্ উপন্যাসের শ্রেণিকরণে শিক্ষামূলক উপন্যাস নামে একটি শ্রেণি বিবেচনা করেছেন। এ ধরনের উপন্যাসে সাধারণত শৈশব থেকে বয়োপ্রাপ্তি পর্যন্ত প্রধান চরিত্রের ব্যক্তিত্ব বিকাশের স্তরগুলি বর্ণিত হয়। যেসব বিচিত্র অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে নায়কের চরিত্র ও মানস গঠন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় তা এ ধরনের উপন্যাসে মুখ্য হয়ে ওঠে। কখনও কখনও নানা ধরনের সংকট ও প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়ে তার চরিত্রের বিকাশ ঘটে।

উদাহরণ হিসেবে চার্লস ডিকেন্সের গ্রেট এক্সপেক্টেশনস (১৮৬০-১৮৬১) উপন্যাসের কথা এখানে উল্লেখ করা যায়। এ উপন্যাসে পিপ নামে একটি ছেলের জীবনের কথা বর্ণিত হয়েছে। সে যতই বড় হতে থাকে ততই নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়। মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাসের উদ্ভব ও বিকাশের আগে কোনও কোনও শিক্ষামূলক উপন্যাস মানুষের আবেগ ও স্মৃতিকে আবিষ্কার করায় প্রয়াসী হয়েছে। এমনটি দেখা যায় চার্লস ডিকেন্সের এই উপন্যাসে। ফরাসি লেখক স্তাঁদাল-এর লাল ও কালো (লে রগ এট লে নোইর, ১৮৩০) উপন্যাস গড়ে উঠেছে জুলিয়ান সোরেল নামে এক যুবকের পরিণতি অর্জনের কাহিনি নিয়ে। আইরিশ লেখক জেমস জয়েসের এ পোরট্রেট অফ দি আর্টিস্ট অ্যাজ এ ইয়ং ম্যান (১৯১৬) উপন্যাসে চরিত্র-বিকাশের ক্ষেত্রে প্রকাশ্য অবাধ্যতার দিক ফুটে উঠেছে। প্রধান চরিত্র স্টিফেন ডেডুলাস যতই বড় হতে থাকে ততই অবাধ্যতা ও বিশ্বাসঘাতকতার সঙ্গে পরিচিত হতে থাকে। কোনও কোনও শিক্ষা উপন্যাস ব্যক্তির স্বরূপ সন্ধান প্রয়াসী। যেমন মার্কিন লেখক জেমস ওয়েলডেন জনসনের এ অটোবায়োগ্রাফি অফ এন এক্স কালার্ড ম্যান (১৯১২)। শিক্ষামূলক উপন্যাস হিসেবে এ ছাড়া সমারসেট মমের অফ হিউম্যান বন্ডেজ (১৯১৫), টমাস মানের দ্য ম্যাজিক মাউন্টেন (১৯২৪) উপন্যাসের নাম উল্লেখ করা যায়।

২.১০ রূপক উপন্যাস (Allegorical Novel)

উপন্যাসের মূল আখ্যান সার্বিকভাবে কোনও প্রতীকী তাৎপর্যমণ্ডিত হলে তাকে রূপক উপন্যাস বলে গণ্য করা চলে। এ ধরনের উপন্যাসে লেখক সচেতনভাবে প্রতীকতা আরোপ করে থাকেন। উপন্যাসের দৃশ্যমান ভাববস্তু ও অর্থের সমান্তরাল কোনও অন্তর্নিহিত ভাববস্তু ও অর্থকে ব্যঞ্জিত করে তোলাই রূপকের কাজ।

রূপক উপন্যাসে পাঠকের কাছে এক ধরনের লুকোনো অর্থ তুলে ধরা হয়। এ ধরনের উপন্যাসে মূল আখ্যানবস্তুর অন্তরালে ভিন্নতর আখ্যানবস্তু নিহিত থাকে। বহিরঙ্গের  রূপ ও অর্থের সমান্তরাল কোনও অন্তর্নিহিত অর্থকে ব্যঞ্জিত করে তোলা হয় রূপকের মাধ্যমে। ঔপন্যাসিক কাহিনির গভীরে যে কথাটি বলতে চান তা বুঝতে হলে উপন্যাসের ভেতরটা ভালোভাবে লক্ষ্য করতে হয়।

এ ধরনের উপন্যাসে যে আখ্যানবস্তু বর্ণিত হয় তার আড়ালে লুকোনো থাকে কোনও গভীর অর্থ। রূপকের মাধ্যমে তা পাঠকের সামনে হাজির করা হয়। রূপক ব্যবহার করে লেখক কোনও গুরুতর বিষয় বা ইস্যু সম্পর্কে তাঁর বক্তব্যকে পাঠকের কাছে তুলে ধরতে চান। কোনও গভীর সত্যকে উপস্থাপন করার দিকেও তাঁর মনোযোগ থাকে। এ ধরনের উপন্যাসের চরিত্রগুলো বিশেষ ভাবাদর্শ, মতাদর্শ বা ধারণার (সাম্যবাদ, মানবতাবাদ, স্বৈরতন্ত্র, লোভ, অমঙ্গল ইত্যাদি) প্রতীক হিসেবে কাজ করে। সচেতনভাবে প্রতীকতা আরোপ করেই সার্থক রূপক নির্মাণ করা হয়। এর ফলে উপন্যাসে আক্ষরিক অর্থ ও পাঠ্যবস্তুর অতিরিক্তি নিহিত অর্থ আলাদা হয়ে থাকে।

রূপক উপন্যাসে প্রায়শ আলংকারিক ভাষা ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যে পন্থায় লেখক পাঠকের মেজাজ, সুর কিংবা ভাববস্তুর উন্নয়ন ঘটান তা কাহিনির মধ্যে দ্বিতীয় কাহিনি তৈরিতে সহায়ক হয়। তা গভীর অর্থ প্রকাশক শব্দ ব্যবহার করে পাঠকের আক্ষরিক অর্থকে ছাপিয়ে যায়।

ইংরেজি সাহিত্যে জোনাথান সুইফটের গালিভার্স ট্রাভেলস (১৭২৬) রূপক উপন্যাস হিসেবে স্বীকৃত। লিলিপুট ও ব্রবডিগনাগের ঘটনা সংস্থাপনের ভেতর দিয়ে তিনি সাহসের সঙ্গে সেকালের ইউরোপের সামাজিক রাজনৈতিক রীতিনীতিকে ব্যঙ্গ করেছেন। মার্কিন লেখক রবার্ট কুপারের দি ইউনিভার্সাল বেজবল অ্যাসোসিয়েশন (১৯৬৮) বেজবল খেলার প্রতীকী কাহিনিবস্তুর ভেতর দিয়ে দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে সৃষ্টিতত্ত্বকে রূপকায়িত করা হয়েছে। এই উপন্যাসে পাঠক দুটো জগতের অভিজ্ঞতা লাভ করেন। একটি হচ্ছে সেই জগৎ যে বাস্তব জগতে আমরা বাস করি, আর অন্যটি হচ্ছে সেই ফ্যান্টাসির জগৎ যা বেজবল লিগের মালিকের সৃষ্টি। উপন্যাসে হেনরি বেজবল খেলার ঈশ্বর হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। খেলায় সে নিজেই নির্ধারণ করে দেয় কে সফল কবে আর কার মৃত্যু হবে। তাঁর নামের শেষাংশ ‘ওয়াহ’ ঈশ্বরের হিব্রু নাম থেকে নেওয়া।

ইংরেজ লেখক জর্জ অরওয়েলের অ্যানিমেল ফার্ম (১৯৪৫) রূপক উপন্যাস। এ উপন্যাসের চরিত্রগুলি মানুষ নয়―জন্তু জানোয়ার। এরা ফার্মের মানুষ মালিকের বিরুদ্ধে নতুন সমাজ গঠনের আশায় বিদ্রোহ করে যেন জন্তু জানোয়ারেরা মুক্ত, সম মর্যাদার ও সুখি নয়।

বাংলায় রূপক উপন্যাসের উদাহরণ রমাপদ চৌধুরীর হৃদয় (১৯৭৬)। এ উপন্যাসের বিষয় সমাজ জীবনের চারপাশের অবক্ষয়, বিপর্যয় ও পতন। মানুষের হৃদয় যেন অসুস্থতা-আক্রান্ত। উপন্যাসে হৃদরোগে আক্রান্ত বাবাকে বাঁচানোর জন্যে পেসমেকার বসাতে হয়। এই উপন্যাস যেন এই রূপক অর্থের আভাস দেয় যে, এই সমাজজীবনের চারপাশের ভাঙন, বৈকল্য ও অবক্ষয়জনিত সংকটে সমাজও যেন চলছে পেসমেকারের বদৌলতে। সমাজ জীবনের এক হৃদয়হীন যান্ত্রিকতা ও নিষ্ঠুরতার গভীর বেদনা পাঠককে ছুঁয়ে যায় এ রূপক উপন্যাসে। বিমল করের যদুবংশ (১৯৬৮), সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নবজাতক (১৯৭৯) উপন্যাসেও রূপকধর্মিতা স্পষ্ট।

বাংলাদেশের সাহিত্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য রূপক উপন্যাস হচ্ছে শওকত ওসমানের ক্রীতদাসের হাসি (১৯৬২)। এ উপন্যাসে প্রতীকী কাহিনি ও চরিত্র তৈরি করে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বাঙালির প্রতিবাদী সংগ্রামকে রূপকাকারে তাৎপর্যমণ্ডিত করা হয়েছে। উপন্যাসে তাতারি সংগ্রামী প্রতিবাদী বাঙালির এবং বাদশাহ হারুন পাকিস্তানি সামরিক স্বৈরশাসক আইযুব খানের প্রতীক। শওকত ওসমানের অন্যান্য রূপক উপন্যাসের মধে রয়েছে সমাগম (১৯৬৮), রাজা উপাখ্যান (১৯৭০), পতঙ্গ পিঞ্জর (১৯৮৩) প্রভৃতি।

২.১১ থিসিস উপন্যাস (Thesis Novel)

এ ধরনের উপন্যাসে সমাজিক বা জাতীয় পর্যায়ের কোনও বিশেষ সমস্যা মূল বিষয় হয়ে ওঠে। তারই অনুষঙ্গ হিসেবে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি এবং ভৌগোলিক, নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক রূপ উদ্ঘাটিত হয়। প্রাসঙ্গিক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বক্তব্যও গুরুত্ব পায়।

ইংরেজি সাহিত্যে এ ধরনের উপন্যাসের উদাহরণ মার্কিন মহিলা ঔপন্যাসিক মিসেস হ্যারিয়েট বিচার স্টো-র আংকল টমস কেবিন (১৮৫২)। এ উপন্যাসে ক্রীতদাস প্রথার নির্মমতার স্বরূপ উদ্ঘাটন করা হয়। দাসত্ব প্রথাবিরোধী উপন্যাসটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। জার্মান ঔপন্যাসিক এরিক মারিয়া রেমার্ক রচিত অল কোয়ায়েট অন দি ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট-ও (১৯২৯)  এ ধরনের উপন্যাস। এ উপন্যাসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা ও মর্মস্পর্শী করুণ পরিস্থিতি চিত্রিত হয়েছে।

এমনিভাবে বাংলা সাহিত্যে শ্রমিকদের সমস্যা উপস্থাপন করেছেন শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় তাঁর কয়লা কুঠি (১৯৩২) উপন্যাসে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মানদীর মাঝি (১৯৩৬) উপন্যাসে জেলে সম্প্রদায়ের ও অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৫৭) উপন্যাসে মালো জাতির সমস্যা তুলে ধরা হয়েছে। সমরেশ বসুর গঙ্গা (১৯৫৭) উপন্যাসে ফুটে উঠেছে মাঝিদের জীবনের সমস্যা।

গ. জনপ্রিয়তা ভিত্তিক রূপশ্রেণি

জনপ্রিয় উপন্যাস বলতে সেসব উপন্যাসকেই বোঝায় যেগুলির প্রাথমিক লক্ষ্য হলো আনন্দ দান। এগুলি সর্বস্তরের পাঠকদের কাছে গ্রহণযোগ্য করার লক্ষ্য সামনে রেখে রচিত হয়। পাঠককে চমৎকার ও আকর্ষণীয় কাহিনি উপহার দিয়ে বাণিজ্যিক সাফল্য অর্জন করাও এ ধরনের উপন্যাসের অন্যতম লক্ষ্য থাকে।

জনপ্রিয় উপন্যাস বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। এর মধ্যে পড়ে : ৩.১. রোমান্স উপন্যাস, ৩.২. কল্পবিজ্ঞান উপন্যাস, ৩.৩. গোয়েন্দা উপন্যাস, ৩.৪. গুপ্তচর উপন্যাস, ৩.৫. হাস্যরসাত্মক উপন্যাস, ৩.৬. আজগুবি উপন্যাস, ৩.৭. রোমহর্ষক উপন্যাস. ৩.৮. দুর্বৃত্ত উপন্যাস, ৩.৯. ওয়েস্টার্ন উপন্যাস।

৩.১ রোমান্স উপন্যাস (Romance Novel)

রোমান্স উপন্যাস হচ্ছে প্রেমের গল্প। মধ্য যুগের ইউরোপীয় সাহিত্যে পদ্য বা গদ্য আখ্যানে প্রেম ও বীরত্বের এক ধরনের জমজমাট কাহিনি রচিত হয়, যেগুলি রোমান্স নামে অভিহিত হয়। পরবর্তীকালে বাস্তব জীবনের সঙ্গে দূর-সম্পর্কিত, কল্পনাশ্রয়ী প্রেম-বীরত্বের আখ্যান মাত্রই রোমান্স হয়ে দাঁড়ায়। বাস্তবতার আলোয় বিচার করলে এ ধরনের উপন্যাসে অলৌকিকতা-আচ্ছন্ন কাল্পনিক ঘটনা, রহস্যঘেরা পরিবেশ এবং বিস্ময় ও দূরস্মৃতির প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। রোমান্স কমবেশি কাব্যধর্মী হয়ে থাকে।

সাধারণ উপন্যাসের সঙ্গে রোমান্সের এক ধরনের সূক্ষ্ম পার্থক্য করা হয়ে থাকে। রোমান্সের তুলনায় উপন্যাস অনেক বেশি আধুনিক। উপন্যাসে প্রাধান্য পায় সামাজিক ও পারিবারিক অবস্থার চিত্রণ, পক্ষান্তরে রোমান্সের জগৎ অতিপ্রাকৃতিক বিশ্বাস, কবিত্বময় কল্পনাসমৃদ্ধ ছায়াচ্ছন্ন অতীতের জগৎ। তাই বাস্তব জীবনমুখিতা ও বস্তুনিষ্ঠতার মাপকাঠিতে বিচার করলে রোমান্সকে উপন্যাসের সঙ্গে এক করে দেখা চলে না। তবে আধুনিক উপন্যাস কখনও কখনও রোমান্সের লক্ষণযুক্ত হতে পারে। এ ধরনের উপন্যাসকে রোমান্সধর্মী উপন্যাসের পর্যায়ভুক্ত করা চলে। তবে ইংরেজি সাহিত্যে বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্কহীন, কল্পনাঋদ্ধ, বীরত্বব্যঞ্জক যেসব রোমান্স রচিত হয়েছে আধুনিক রোমান্সধর্মী উপন্যাস তা থেকে একেবারে আলাদা। আধুনিক রোমান্সে অতিপ্রাকৃতিক ঘটনা থাকলেও তাকে বাস্তব সম্ভাব্যতার আদলে উপস্থাপন করতে হয়।

আঠারো শতকের ইংরেজ লেখক হোরেস ওয়ালপোলের দ্য ক্যাসল অফ ওটর‌্যান্টো (১৭৬৪), মিসেস র‌্যাডক্লিফের দ্য মিস্ট্রিজ অফ উডোলফো  (১৭৯৪), ম্যাথু গ্রেগরি লিউসের দ্য মংক (১৭৯৬) প্রভৃতি রচনা গথিক রোমান্স হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। এসব উপন্যাস শিল্পবিচারে ততটা উৎকর্ষমণ্ডিত না হলেও এগুলিতে মধ্যযুগীয় অলৌকিক বিশ্বাস, ভয়ভীতির শিহরণ জাগানো নানা বিস্ময়, বিভীষিকা ও রহস্যময়তায় উদাহরণ পাওয়া যায়। স্কটল্যান্ডের লেখক ওয়াল্টার স্কটের দ্য ব্রাইড অফ ল্যামারমুর (১৮১৯), আইভ্যানহো (১৮২০), কেনিলওয়ার্থ (১৮২১) ইত্যাদি উপন্যাসে দূর অতীতের যে জীবনছবি আঁকা হয়েছে তা রোমান্স।

ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম দিককার সেরা রোমান্সের একটি হচ্ছে ইংরেজ ঔপন্যাসিক শার্ল ব্রন্টির (Charlotte Brontë) জেন আয়ার (১৮৪৭)। এতে বর্ণিত হয়েছে এক এতিম বালিকার কাহিনি যে গৃহশিক্ষিকার কাজ পায় এবং চাকরিদাতার প্রেমে পড়ে। উনিশ শতকের মার্কিন ঔপন্যাসিক ন্যাথানিয়েল হর্থনের দ্য স্কারলেট লেটার্স (১৮৫০) রোমান্সের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। এ উপন্যাসে অতিপ্রাকৃত ও দৈবশক্তির রোমহর্ষক শিহরন, প্রকৃতির রহস্যাচ্ছন্ন ব্যবহার বাস্তব জগতের সঙ্গে কল্পনার মেলবন্ধন ঘটিয়ে রোমান্সের জগৎ সৃষ্টি করেছে। বিশ শতকের উল্লেখযোগ্য রোমান্স হচ্ছে ব্রিটিশ লেখক দাফনে দু মরিয়ে-র (Daphne du Maurier) রেবেকা (১৯৩৮)। এ উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে এক তরুণীর গল্প যে একজন বিপত্নীককে বিয়ে করে এবং তারপর বিভোর হয়ে যায় লোকটার প্রথম স্ত্রী কেমন ছিল সেই ভাবনায়। একটি ধ্রুপদী রোমান্স হচ্ছে মার্কিন লেখক এরিখ সেগালের লাভ স্টোরি (১৯৭০)। এ উপন্যাসে একটি অবস্থাসম্পন্ন পরিবারের একজন লোক গরিব ঘরের এক সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করে। কিন্তু মেয়েটির অকাল মৃত্যু হয়। অন্যান্য রোমান্স ঔপন্যাসিকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ইংরেজ রোমান্স ঔপন্যাসিক জ্যাকি কলিন্স, মার্কিন লেখিকা জুডিথ ক্রান্টজ, নোরা রবার্টস ও ডানিয়েল স্টিল প্রমুখ।

বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রোমান্স রচয়িতা হলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর কপালকুণ্ডলা (১৮৬৬) বাংলা সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ রোমান্স। সমুদ্র ও অরণ্যের রহস্যগম্ভীর পরিবেশ ও কাপালিকের তান্ত্রিক সাধনার ভয়ংকর প্রতিবেশে প্রতিপালিত ও সমাজ-সংসার-বিচ্ছিন্ন কপালকুণ্ডলা সামাজিক ও গার্হস্থ্যজীবনে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারবে কিনা এ উপন্যাসে সেই পরীক্ষা করেছেন বঙ্কিম। উপন্যাসে কাব্যসৌন্দর্যময় ব্যঞ্জনাসমৃদ্ধ যে রোমান্টিক পরিবেশ চিত্রিত হয়েছে এবং প্রকৃতি ও মানবচৈতন্যের যে ঐশ্বর্যময় রোমান্টিক সুর-সঙ্গতি নির্মিত হয়েছে তা সত্যই অপূর্ব। বঙ্কিমচন্দ্রের দুর্গেশনন্দিনী (১৮৬৫), ঐতিহাসিক রোমান্সের পর্যায়ে পড়ে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষের কবিতা (১৯২৯), মণীন্দ্রলাল বসুর রমলা রোমান্সধর্মী উপন্যাস।

৩ .২  কল্পবিজ্ঞান উপন্যাস (Science-Fiction Novel)

বিজ্ঞানের কোনও উদ্ভাবন, সেই উদ্ভাবন সংক্রান্ত কোনও চাঞ্চল্যকর ঘটনা, কিংবা বিজ্ঞানের নানা তথ্যের ভিত্তিতে লেখা কল্পকাহিনি এ ধরনের উপন্যাসের পর্যায়ে পড়ে। কল্পবিজ্ঞান উপন্যাসের বিষয়ের মধ্যে পড়ে : মহাশূন্য ভ্রমণ, মহাকালের অতীত বা ভবিষ্যতে ভ্রমণ, গ্রহ-গ্রহান্তরের কোনও বুদ্ধিমান সত্তার আবিষ্কার, বৈজ্ঞানিক তথ্য অবলম্বনে ভবিষ্যতের সম্ভাবনা কল্পনা, পৃথিবীতে গ্রহান্তরের আগন্তুক, বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবোট তৈরি ইত্যাদি। এ ধরনের উপন্যাসের কাহিনি গড়ে ওঠে সাধারণত ভবিষ্যতে বা কোনও কাল্পনিক বিশ্বে। এ ধরনের উপন্যাসের আখ্যান, চরিত্র, প্রতিবেশ, ভাববস্তু ইত্যাদি গড়ে তোলা হয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত জল্পনা-কল্পনার ওপর। এ ধরনের রচনাকে আজগুবি বিজ্ঞান বলেও অভিহিত করা চলে।

ইংরেজ ঔপন্যাসিক মেরি শেলি-র ফ্রাংকেনস্টাইন (১৮১৮) উপন্যাসকে কল্পবিজ্ঞান উপন্যাসের প্রারম্ভিক নিদর্শন হিসেবে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। এটি একজন ডাক্তারের কাহিনি যিনি মানুষের অঙ্গ ব্যবহার করে কৃত্রিম দানব তৈরি করতে চান। উনিশ শতকের মধ্য ভাগে বৈজ্ঞানিক কল্পনাশক্তির ভিত্তিতে উপন্যাস রচনায় অসামান্য অবদান রাখেন ফরাসি সাহিত্যিক জুল ভের্ন। তাঁর বেলুনে পাঁচ সপ্তাহ (সাঁক সেমেইন অঁ বাল, ১৮৬২), ভূকেন্দ্রে অভিযাত্রা (ভোয়াইআজ অ্যান সাঁতর দ্য লা ত্যার, ১৮৬৪), ভ্যাঁ মিল লি উসু লেমের (টুয়েন্টি থাউজ্যান্ডস লিগস আন্ডার দ্য সি, ১৮৬৯) ইত্যাদি গ্রন্থ বৈজ্ঞানিক ভবিষ্যৎ কল্পনার অনন্য উদাহরণ। তবে কল্পবিজ্ঞান উপন্যাসের জনক বিবেচনা করা হয় ইংরেজ লেখক এইচ জি ওয়েলসকে। উনিশ শতকের শেষ দিকে তিনি রোমান্স-রসস্নিগ্ধ কল্পবিজ্ঞান উপন্যাস রচনায় এগিয়ে আসেন এবং এই ধারায় ব্যাপক প্রভাব ফেলেন। তাঁর টাইম মেশিন (১৮৯৫) উপন্যাসের কাহিনিতে একজন উদ্ভাবক ভবিষ্যৎ কালে ভ্রমণের যন্ত্র আবিষ্কার করে তাতে চড়ে ভবিষ্যৎ কালে ভ্রমণ করে আসে। দি ইনভিজিবল ম্যান (১৮৯৭) উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে একজন মানুষের কাহিনি যে নিজেকে অদৃশ্য করে ফেলে। দি ওঅর অফ দ্য ওয়র্ল্ড (১৮৯৮) উপন্যাসের বিষয় মঙ্গল গ্রহের অধিবাসী কর্তৃক পৃথিবী অধিকার। আর তাঁর দ্য ফার্স্ট মেন অন দ্য মুন (১৯০১) উপন্যাসের ভবিষ্যৎ কল্পনা সফল হয়েছে ৬০ বছর পরে।

বিশ শতকের মধ্যভাগে বেশ কিছু কল্পবিজ্ঞান উপন্যাস প্রকাশিত হয়। যেমন : পোলান্ডের স্তানিস্লাভ লেম-এর সোলারিজ (১৯৬১), রাশিয়ায় জন্মগ্রহণকারী মার্কিন লেখক আইজাক আসিমভের দ্য ফাউন্ডেশন ট্রিলোজি (১৯৫১-১৯৫৩), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্র্যাংক হার্বার্টের ডিউন  (১৯৬৫) এবং মহিলা ঔপন্যাসিক উরসুলা কে লে গুইনের দ্য লেফট হ্যান্ড অফ ডার্কনেস (১৯৬৯) ইত্যাদি।

বাংলা সাহিত্যে কল্পবিজ্ঞান উপন্যাস রচনার একটি ধারা ইতমধ্যেই তৈরি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য জগদানান্দ রায়ের শুক্র ভ্রমণ (১৮৭৯), হেমলাল দত্তের রহস্য (১৮৮২), জগদীশচন্দ্র বসুর নিরুদ্দেশের কাহিনি (১৮৯৬), প্রেমেন্দ্র মিত্রের কুহকের দেশে, হেমেন্দ্রকুমার রায়ের দেবদূতের মর্ত্যে আগমন (১৯৩০), অমানুষিক মানুষ (ব্রাক স্টোকারের ড্রাকুলার অনুবাদ, ১৯৫০), হুমায়ূন আহমদের তোমাদের জন্য ভালোবাসা (১৯৭৩), মুহম্মদ জাফর ইকবালের কপোট্রনিক সুখদুঃখ (১৯৭৬), ক্রুগো (১৯৮৮), মহাকাশে মহাত্রাস (১৯৭৭), শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ভূতুড়ে ঘড়ি (১৯৮৩), পাতাল ঘর (১৯৯৬), সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের আকাশ দস্যু (১৯৯৫) ইত্যাদি। সত্যজিৎ রায়ের প্রফেসর শঙ্কুর সিরিজের কাহিনিগুলিও এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। তবে এর অনেকগুলি ফ্যান্টাসির পর্যায়ে পড়ে।

৩.৩ গোয়েন্দা বা ডিটেকটিভ উপন্যাস (Detective Novel)

এ ধরনের উপন্যাসে কোনো গোয়েন্দার বুদ্ধি, দক্ষতা ও সাহসী ভূমিকার মধ্য দিয়ে খুন-জখম-চুরি-ডাকাতি ইত্যাদি কোনো অপরাধমূলক ঘটনার রহস্য উন্মোচিত হয়। বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে এ ধরনের উপন্যাস গোয়েন্দা, অপরাধমূলক বা রহস্য উপন্যাসের পর্যায়ে পড়ে।

রহস্যময় গুপ্তহত্যা কিংবা কোনও অপরাধের ভেতরকার রহস্য উদ্ঘাটন ও অপরাধীকে সনাক্ত করার লক্ষ্যে পুলিশ ও গোয়েন্দাদের বুদ্ধিমত্তাযুক্ত রোমাঞ্চকর তৎপরতার কাহিনি এ ধরনের উপন্যাসের বিষয়।

অনেক ক্ষেত্রে পুলিশের পক্ষে অপরাধী খুঁজে বের করা অসাধ্য এমন খুন জখম ও চুরির ঘটনার তথ্য উদঘাটনের কিংবা নিরুদ্দিষ্ট কোনও ব্যক্তিকে খুঁজে বের করার ক্ষেত্রে রহস্যানুসন্ধানী গোয়েন্দা বা ডিটেকটিভের বুদ্ধিমত্তা ও কৌশলদীপ্ত ভূমিকার রোমহর্ষক কাহিনি নিয়ে এ ধরনের উপন্যাস লেখা হয়। গোয়েন্দা বা ডিটেকটিভ উপন্যাসে কাহিনিই মুখ্য। সাধারণত একই রকম সাধারণ ছকে এ ধরনের উপন্যাসের কাহিনি গড়ে ওঠে। কাহিনির শুরুতে দেখা যায় এমন একটি অপরাধ সংঘটিত হয় যার কোনও সূত্র খুঁজে পাওয়া যায় না। পুলিশ এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়। তখন অপরাধীকে খুঁজে বের করা ও রহস্য সমাধানের দায়িত্ব এসে পড়ে একজন পেশাদার বা সৌখিন গোয়েন্দার ওপর। তিনি বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে একবারে সূক্ষ¥াতিসূক্ষ¥ভাবে বিশ্লেষণ করে বিভিন্ন সূত্রের আলোকে অপরাধের কারণ, উপায় খুঁজে বের করেন এবং একসময় অবলীলাক্রমে অপরাধীকে শনাক্ত করেন।

গোয়েন্দা কাহিনির আকর্ষণের কেন্দ্রে থাকে কোনও রহস্যভেদী গোয়েন্দা চরিত্র। (যথা শার্লক হোম্স, এরকুল পোয়ারো, ব্যোমকেশ, ফেলুদা ইত্যাদি) অধিকাংশ গোয়েন্দা কাহিনিতে থাকে গোয়েন্দার সহযোগী (যথা শার্লক হোম্সের ওয়াটসন, ব্যোমকেশের অজিত, ফেলুদার তোপসে ইত্যাদি) এবং একটু আলাদা ধরনের একটি চরিত্র যার মাধ্যমে প্রায়শ গল্পটি বর্ণিত হয়ে থাকে। গোয়েন্দা উপন্যাসের আর একটি প্রয়োজনীয় চরিত্র হচ্ছে অপরাধী। যে অপরাধ সে সংঘটিত করে তার রহস্যভেদের জন্যই হয় গোয়েন্দার আগমন। গোয়েন্দা তাঁর বুদ্ধিমত্তা ও দক্ষতার সাহায্যে অপরাধীকে খুঁজে বের করেন, অকাট্য সাক্ষ্য-প্রমাণ হাজির করে অপরাধীকে শনাক্ত করেন। তাকে তুলে দেন যথাযথ কর্তৃপক্ষের হাতে।

গোয়েন্দা-কাহিনিতে ঘটনাস্রোত দুটি সমান্তরাল ধারায় এগিয়ে যায়। একটি ধারায় থকে অপরাধীর কর্মতৎপরতা, যা কাহিনিতে জটিলতা সৃষ্টি করে। অন্যটি ঘটনাসূত্রের জট খুলে গোয়েন্দার রহস্যভেদ, যার ফলে কাহিনি স্বস্তিকর পরিণতি পায়।

গোয়েন্দা-উপন্যাসের কাহিনিকে হতে হয় রহস্য, রোমাঞ্চ, উৎকণ্ঠায় ভরা। সমগ্র কাহিনিতে সেই রহস্য- রোমাঞ্চের শিহরন অক্ষুণ্ন রেখে শেষে হঠাৎ সেই রহস্য নিরসন করে পাঠককে চমৎকৃত করার ওপরই নির্ভর করে এ ধরনের উপন্যাসের সার্থকতা। রহস্যভেদ করার ক্ষেত্রে গোয়েন্দা সাধারণত প্রযোজনীয় তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করেন। তারপর সেসব সূত্রের ভিত্তিতে প্রথমে অনুমান ও পরে সংঘটিত অপরাধ সম্বন্ধে একটি যুক্তিগ্রাহ্য সমাধানমূলক সিদ্ধান্তে উপনীত হন। এ ক্ষেত্রে লেখক কাহিনিতে দুর্ভেদ্য জটিল রহস্য, অপরাধীর কর্মতৎপরতা, ঘটনাধারার অনুুপুঙ্খ বিবরণ, রহস্য উদঘাটনে গোয়েন্দার যুক্তিগ্রাহ্য পদ্ধতি ইত্যাদির এমন সুবিন্যস্ত উপস্থাপন করেন যেন প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত কাহিনি পাঠকের কৌতূহলকে ধরে রাখে।

সাধারণত কোনও হত্যাকাণ্ড বা অনুরূপ কোনও অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর শুরু হয় গোয়েন্দা কাহিনি।   সেই রহস্যভেদের লক্ষ্যে এরপর দৃশ্যপটে অসেন পুলিস ও গোয়েন্দা। প্রাথমিক তদন্তে অস্পষ্ট ও অসংলগ্ন কিছু তথ্য বা সূত্র পাওয়া যায়। তারপর বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পারিপার্শ্বিক ঘটনা ও সাক্ষ্যের ভুল বিশ্লেষণের ফলে প্রকৃত অপরাধীর বদলে পুলিশ আটক করে অন্য কাউকে। এভাবে পুলিশের আনাড়িপনা প্রতীয়মান হয়। এতে কখনও কখনও পুলিশ বনাম গোয়েন্দার ঠাণ্ডা লড়াই খুবই উপভোগ্য হয়ে ওঠে। এই অবস্থায় রহস্য সমাধানে তৎপর হন তীক্ষè ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন গোয়েন্দা। তথ্যপ্রমাণ, সন্দেহ, অনুমান ও যুক্তিজাল বিস্তার করে এবং সংঘটিত অপরাধের ‘মোটিভ’ ও সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের ‘অ্যালিবি’ বিচার করে  শেষে তিনিই রহস্যের সমাধান করতে সক্ষম হন।  এ ধরনের কাহিনিতে থাকে নাটকীয়তা, উৎকণ্ঠা ও কৌতূহল, থাকে পদে পদে পাঠককে বিভ্রান্ত করার মতো ঘটনা, আর কখনও কখনও থাকে বিনোদনের খোরাক জাগানোর জন্যে কোনও কৌতুক চরিত্র। কথাসাহিত্যের অত্যন্ত জনপ্রিয় শাখা এটি। এ ধরনের উপন্যাস সাধারণত বিনোদনমূলক। সাহিত্যিক উৎকর্ষ এ ক্ষেত্রে বিবেচ্য হয় না। তবে নাটকীয় ঘটনা বর্ণনা ও পরিবেশ চিত্রণের নৈপুণ্য, প্লটের বিন্যাস, ও চরিত্র চিত্রণে দক্ষতা প্রভৃতির গুণে এ ধরনের উপন্যাস সাহিত্যের স্তরে উন্নীত হতে পারে।

ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম এ জাতীয় রচনার সূত্রপাত ১৮৪০-এর দশকে এড্গার অ্যালান পোর হাতে। এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য তাঁর মার্ডারস ইন দ্য রুয়ে মর্গ (১৮৪১)। এ উপন্যাসে খামখেয়ালি গোয়েন্দা ডুপিন  অপূর্ব সন্ধানী দক্ষতায় রহস্যভেদ করেন চমকপ্রদভাবে। তবে ইংরেজি সাহিত্যে গোয়েন্দা ও রহস্যমূলক কাহিনির সর্বশ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক হলেন আর্থার কোনান ডয়েল। তাঁর ডিটেকটিভ উপন্যাসগুলিতে বিশ্বখ্যাত ডিটেকটিভ চরিত্র হলো শার্লক হোম্স। বিস্ময়কর বুদ্ধিমত্তা ও চমৎকার বিশ্লেষণী ক্ষমতার অধিকারী হোমস ও তাঁর ডাক্তার বন্ধু ওয়াটসন বিশ্বের গোয়েন্দা উপন্যাসের ধারায় অমর। তাঁর আ স্টাডি ইন স্কারলেট (১৮৮৭), দ্য সাইন অফ ফোর (১৯২৩), দ্য হাইজ অফ দ্য বাস্কারভিলস (১৯০২) ইত্যাদি উপন্যাস জনপ্রিয় গোয়েন্দা উপন্যাসের প্রথম সারিতে স্থান করে নিয়েছে। এ ছাড়াও জনপ্রিয় শার্লক হোম্স গ্রন্থমালায় তাঁর বিখ্যাত উপন্যাসগুলির মধ্যে  রয়েছে : দি অ্যাডভেঞ্চার অফ শার্লক হোমস (১৮৯২), দি রিটার্ন অফ শার্লক হোমস (১৯০৪), দ্য কেস-বুক অফ শার্লক হোমস (১৯২৭) ইত্যাদি। ইংরেজি সাহিত্যে এ ছাড়া এডগার ওয়ালস্, আগাথা ক্রিস্টি প্রমুখ ডিটেকটিভ উপন্যাস রচনায় পারদর্শিতার স্বাক্ষর রেখেছেন। আগাথা ক্রিস্টি ইংরেজি সাহিত্যের সেরা গোয়েন্দা ঔপন্যাসিক। তাঁর দ্য মিস্ট্রিয়াস অ্যাফেয়ার অ্যাট স্টাইলস (১৯২০) উপন্যাসের বেলজিয়ান গোয়েন্দা এরকুল পোয়ারো বুদ্ধিমত্তা ও বিশ্লেষণ-ক্ষমতায় শার্লক হোমসের প্রায় প্রতিদ্বন্দ¦ী। অগাথা ক্রিস্টির সেরা লেখাগুলির মধ্যে রয়েছে : মার্ডার অন দি ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস (১৯৩৪) ও টেন লিটল নিগারস (১৯৩৯) ইত্যাদি।

বাংলা সাহিত্যে প্রথম দিককার গোয়েন্দা কাহিনি হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের ডিটেকটিভ পুলিশ (১৮৯৩-১৯০০), শরচ্চন্দ্র সরকারের গোয়েন্দা কাহিনি, অম্বিকাচরণ গুপ্তের গোয়েন্দা গল্প ইত্যাদি গ্রন্থকে। এই ধারায় পাঁচকড়ি দে মায়াবিনী, নীলবসনা সুন্দরীর, হত্যাকারী কে ? বিনোদনমূলক গোয়েন্দা কাহিনি রচনা করে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। তাঁর উপন্যাসের গোয়েন্দারা কেউই সৌখিন গোয়েন্দা নন, তাঁরা পুলিশ কর্মচারী অথবা অবসরপ্রাপ্ত পুলিস কর্মী।

বাংলা গোয়েন্দা কাহিনিকে প্রথম সাহিত্য পদবাচ্য করে তোলেন হেমেন্দ্র কুমার রায়। তাঁর গোয়েন্দা উপন্যাস কেবল মনোরঞ্জনই করেনি, সাহিত্য-রসও জুগিয়েছে যথেষ্ট। তাঁর লেখা যখের ধন গোয়েন্দা কাহিনি ইত্যাদি বিশেষ জনপ্রিয় হয়েছিল। নীহাররঞ্জন গুপ্তও গোয়েন্দা উপন্যাসে হাত পাকিয়েছিলেন। তাঁর কালোভ্রমর (১৯৪৭-১৯৪৮) এক সময়ে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল।

বাংলা সাহিত্যে রসমণ্ডিত গোয়েন্দাকাহিনির প্রথম সেরা লেখক হলেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। দুর্গরহস্য (১৯৫২), চিড়িয়াখানা (১৯৫৩) ইত্যাদি নাতিদীর্ঘ উপন্যাসে শরদিন্দু যেমন কাহিনিতে নতুনত্ব এনেছিলেন তেমনি প্রখর বুদ্ধিমত্তার অধিকারী ও প্রত্যুৎপন্নমতি গোয়েন্দা চরিত্র সৃষ্টি করে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। বাংলা সাহিত্যে অন্য যাঁরা গোয়েন্দা কাহিনি লিখে খ্যাতি অর্জন করেছেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন : দীনেন্দ্রকুমার রায়, নীহাররঞ্জন গুপ্ত, স্বপনকুমার, সত্যজিৎ রায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ।

বাংলা সাহিত্যে সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা-সিরিজের গোয়েন্দাকাহিনিগুলির কথা এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁর হাতে ষাটের দশকের মাঝামাঝি গোয়েন্দা প্রদোষচন্দ্র মিত্র ওরফে ফেলুদার আবির্ভাব সর্বস্তরের অ্যাডভেঞ্চার-প্রিয় বাঙালি পাঠকের মন জয় করে। ফেলুদার মতো বাঙালি গোয়েন্দা-ব্যক্তিত্বের প্রখর বুদ্ধিমত্তা, চমকপ্রদ বিচারবোধ, ব্যক্তিত্বময় আচরণ, সূক্ষ্ম রসবোধ, অনন্য সাহসিকতা, ধারালো কথাবার্তা বাংলা সাহিত্যে অভিনব। ‘ফেলুদা সিরিজে’র আর একটি বিশেষ আকর্ষণীয় চরিত্র রহস্যকাহিনিকার লালমোহন গাঙ্গুলি (জটায়ু)। আর একটি বিশিষ্ট চরিত্র গোয়েন্দা ফেলুদার কিশোর সাকরেদ তোপসে। এ তিনটি চরিত্রের মাধ্যমে কাহিনিতে রহস্যভেদ, ঘটনাধারা সম্পর্কে অপরিসীম কৌতূহল ও হাস্যরসের চমৎকার মেলবন্ধন ঘটেছে। ফেলুদা সিরিজের তিরিশটিরও বেশি কাহিনিতে সত্যজিৎ মূলত কিশোরদের বুদ্ধিমার্জিত ও কৌতুক রসমণ্ডিত রহস্য-রোমাঞ্চ কাহিনি পরিবেশন করেছেন। বয়স্ক-অপরাধের জটিল অন্ধকার ঘূর্ণাবর্তের ছবি ফেলুদার কাহিনিগুলিতে আঁকেননি তিনি। ফেলুদার গোয়েন্দা কাহিনিগুলির মধ্যে রয়েছে : গ্যাংটকে গণ্ডগোল (১৯৭১), কৈলাশে কেলেঙ্কারি (১৯৭৪), রয়েল বেঙ্গল রহস্য (১৯৭৫), জয় বাবা ফেলুনাথ (১৯৭৬), যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে (১৯৮২), বোম্বাইয়ের বোম্বেটে (১৯৭৬), ভূস্বর্গ ভয়ঙ্কর (১৯৮৭) ইত্যাদি। বাংলাদেশে কাজী আনোয়ার হোসেন মাসুদ রানা সিরিজের গোয়েন্দা উপন্যাস লিখে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।

গোয়েন্দা কাহিনিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে গোয়েন্দা চরিত্র। বাংলা সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য ও জনপ্রিয় গোয়েন্দা চরিত্র হচ্ছে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের গোয়েন্দা ব্যোমকেশ বক্সি, নীহাররঞ্জন গুপ্তের কিরীটী রায়, সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা ও জটায়ু এবং কাজী আনোয়ার হোসেনের মাসুদ রানা। এই শাখায় গুপ্তচর কাহিনিভিত্তিক রোমাঞ্চকর উপন্যাসের নতুন ধারা গড়ে উঠেছে।

৩.৪ গুপ্তচর উপন্যাস (Spy Novel)

জনপ্রিয় উপন্যাসের একটি শাখা হচ্ছে গুপ্তচর উপন্যাস। কোনও কোনও লেখক আগ্রহী হন গুপ্তচরের জাঁকজমকপূর্ণ জীবনকে ফুটিয়ে তুলতে। এমনটি দেখা যায় ইংরেজ লেখক আয়ান ফ্লেমিং-এর ক্যাসিনো রয়েল (১৯৫৩), গোল্ডফিংগার (১৯৫৯), থান্ডারবল (১৯৬১) ইত্যাদি বেশ কয়েকটি উপন্যাসে। এসব উপন্যাসে দেখা মেলে ব্রিটিশ গুপ্তচর জেমস বন্ডকে। বন্ড যে জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত তাতে থাকে দ্রুতগামী মোটরগাড়ি, সুন্দরী নারী, চৌকস অস্ত্রশস্ত্র ও জমকালো প্রতিবেশ। কোনও কোনও গুপ্তচর উপন্যাস লেখা হয়েছে গুপ্তচরদের জীবনের অন্ধকারময় দিক নিয়ে। এর উদাহরণ ইংরেজ লেখক জোসেফ কনরাডের দ্য সিক্রেট এজেন্ট (১৯০৭)। গুপ্তচর উপন্যাসের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ লেখক জন লে ক্যারে-র দ্য স্পাই হু কাম ইন ফ্রম দ্য কোল্ড (১৯৬৩) গ্রন্থটিও উল্লেখযোগ্য।

প্রধানত বিশেষ বিশেষ রাষ্ট্রীয় ঘটনার সঙ্গে যুক্ত করে গুপ্তচর উপন্যাস লেখা হয়ে থাকে। মার্কিন লেখক জেমস ফেনিমোর কুপারের দ্য স্পাই অর দ্য টেল অফ দ্য নিউট্রাল গ্রাউন্ড (১৮২১) আমেনিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের এক গুপ্তচরের সত্য ঘটনাকে অবলম্বন করে রচিত উপন্যাস। ইংরেজ-আইরিশ লেখক ইংরেজ-আইরিশ লেখক এরসকিন চিল্ডার্স-এর দ্য রিডল অফ দ্য স্যান্ড : ঐ রেকর্ড অফ দ্য সিক্রেট সার্ভিস রিসেন্টলি অ্যাচিভড (১৯০৩) উপন্যাসের কাহিনি গড়ে উঠেছে দুজন গুপ্তচরকে নিয়ে। জার্মানি ইংল্যান্ড আক্রমণের পরিকল্পনা করেছে মর্মে তারা একটি তথ্য সংগ্রহ করে। পোলিশ-ব্রিটিশ লেখক জোসেফ কনরাডের দ্য সিক্রেট এজেন্ট : ঐ সিম্পল টেল (১৯০৭) একজন নৈরাজ্যবাদী গুপ্তচরের কাহিনি। সে লন্ডনের রুশ দূতাবাসের পক্ষে কাজ করে। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গুপ্তচর কাহিনির মধ্যে রয়েছে : স্কটিশ লেখক জন বুচানের দ্য থার্টি নাইন স্টেপস (১৯১৫), ব্রিটিশ লেখক সমারসেট মমের অ্যাশেনডেন অর দ্য ব্রিটিশ এজেন্ট (১৯২৮), আইরিশ কথাসাহিত্যিক লায়ামও ফ্ল্যাহার্টির দি ইনফরমার (১৯২৫), মার্কিন লেখক ড্যাশিয়েল হ্যামেট-এর রেড হারভেস্ট (১৯২৯), মার্কিন লেখক স্টার্লিং হাইডেনের ওয়ান্ডারার (১৯৬৩), ইংরেজ ঔপন্যাসিক গ্রাহাম গ্রিনের দ্য কোয়াইট আমেরিকান (১৯৫৫) ইত্যাদি।

৩.৫ হাস্যরসাত্মক উপন্যাস (Humorous novel)

এ ধরনের উপন্যাসে লেখক বুদ্ধিতীক্ষè, শাণিত বাগবৈদগ্ধ্য, তীব্র বিদ্রুপ কিংবা বিশুদ্ধ কৌতুক রসের মাধ্যমে হাস্যরসের সৃষ্টি করে থাকেন। হাস্যরসাত্মক উপন্যাসের হাসির উৎস-উপাদান নানারকম হতে পারে। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিচরিত্রের অসংগতি কিংবা সামাজিক অসংগতি। তাছাড়া প্রচলিত প্রথা ও প্রতিষ্ঠিত মতবাদ ও দৃষ্টিভঙ্গি কিংবা কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ব্যঙ্গ করেও উপন্যাসে হাস্যরস সৃষ্টি করা যেতে পারে।

আঠারো শতকে ইংরেজ ঔপন্যাসিক হেনরি ফিল্ডিং ও লরেন্স স্টার্নে এবং উনিশ শতকের চার্লস ডিকেন্সের রচনায় হাস্যরসের ব্যাপকতা লক্ষ্য করা যায়। স্টার্নে নয় খণ্ডে তাঁর ট্রিস্ট্রাম শ্যান্ডি (Tristram Shandy, ১৭৫৯-১৭৬৭) উপন্যাসের আংকল টোবি চরিত্রের মধ্য দিয়ে উচ্চাঙ্গের সূক্ষ¥ হাস্যরস সৃষ্টি করেছেন। উপন্যাসে টোবির আচরণ ও মন্তব্যের ভেতর দিয়ে হাসির উৎসার ঘটেছে। তবে তাঁর হাসিতে করুণার প্রকাশ লক্ষ করা যায়।

উনিশ শতকের প্রথম বাংলা উপন্যাস-রচয়িতা প্যারীচাঁদ মিত্র বা টেকচাঁদ ঠাকুরের আলালের ঘরের দুলাল-এ (১৮৫৮) হাস্যরসের উপাদান প্রধান। পঞ্চানন্দ ছদ্মনামধারী ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কল্পতরু (১৮৭৪) ও ক্ষুদিরাম (১৮৮) হাস্যরসপ্রধান রচনা। যোগেন্দ্রচন্দ্র বসুর বিদ্রুপাত্মক উপন্যাস মডেল ভগিনী (১৮৮৫) সে যুগে হাস্যরসাত্মক রচনারূপে পরিচিতি পেয়েছিল। বিদ্রুপাত্মক অতিরঞ্জনের মধ্য দিয়ে হাস্যরস সৃষ্টিতে এখানে যোগেন্দ্রচন্দ্রের দক্ষতার পরিচয় মেলে। ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় তাঁর কঙ্কাবতী (১৮৯২) ও ডমরুচরিত (১৯২৩) উপন্যাসে প্রাকৃতিক ও অলৌকিক ঘটনার মিশ্রণে আপাত-উদ্ভট কল্পনায় ভৌতিক রসিকতা সৃষ্টিতে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। তাঁর কৌতুকরসের আড়ালে নিহিত রয়েছে সমাজ সমালোচনার দৃষ্টিভঙ্গি। কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোষ্ঠীর ফলাফল (১৯২৯) উপন্যাস হাস্যরস সৃষ্টির উজ্জ্বল উদাহরণ। পরশুরাম কচিসংসদ উপন্যাসে হাস্যরস সৃষ্টি করেছেন রাবীন্দ্রিক আচার-আচরণের প্যারডির মাধ্যমে।

৩.৬ আজগুবি উপন্যাস (Fantasy Novel)

এ ধরনের উপন্যাস জাদুকরি বা অতিপ্রাকৃতিক চরিত্র ও ঘটনা অবলম্বনে রচিত হয়। অনেক আজগুবি উপন্যাস গীতল ও হাস্যরসাত্মক রীতিতে লেখা হয়ে থাকে। এগুলোর আবেদন প্রধানত শিশুকিশোরদের কাছে।

ইংরেজি সাহিত্যে আজগুবি উপন্যাসের দুটি বিখ্যাত উদাহরণ হচ্ছে লিউইস ক্যারোল-এর এলিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড (১৮৬৫) ও থ্রু দ্য লুকিং গ্লাস অ্যান্ড হোয়ট এলিস ফাউন্ড দেয়ার (১৮৭১)। এ দুটো বই এলিস নামের একটা মেয়েকে নিয়ে। সে নিজেকে এক অদ্ভুত জগতে আবিষ্কার করে যেখানে সে কখনও বড় কখনও ছোট হয়ে যায় এবং স্বপ্নের মতো বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়। সাম্প্রতিক কালে ইংরেজ ঔপন্যাসিক জে কে রৌলি-এর হ্যারি পটার সিরিজের উপন্যাসগুলো বিশ্বব্যাপী সব বয়সের পাঠকের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এই উপন্যাসটি গড়ে উঠেছে প্রশিক্ষণরত একটি ছেলেকে নিয়ে যে জাদুকর হতে চায়।

বাংলা সাহিত্যে কল্পবিজ্ঞান উপন্যাসগুলোর বেশির ভাগকে ফ্যান্টাসি জাতীয় রচনা হিসেবে বিবেচনা করা চলে। কারণ সেগুলির পাত্র-পত্রীরা বিচরণ করে গ্রহান্তরে কিংবা অন্য সৌরজগৎ ইত্যাদি অঞ্চলে। সত্যজিৎ রায়ের প্রফেসর শঙ্কু সিরিজের কাহিনিগুলি বেশির ভাগই ফ্যান্টাসির পর্যায়ে পড়ে।

৩.৭ রোমহর্ষক উপন্যাস (Horor Novel)

এ ধরনের উপন্যাস গথিক উপন্যাসের ঐতিহ্যের সম্প্রসারিত রূপ। এতে বিশেষ জোর দেওয়া হয় ভয়ংকরতা ও অতিপ্রাকৃতকে। সাধারণত ভালো ও মন্দের মধ্যে অতিপ্রাকৃতিক শক্তির লড়াইয়ের কাহিনি নিয়ে গড়ে ওঠে এ ধরনের উপন্যাস। এ ধরনের উপন্যাসের সাফল্য নির্ভর করে ভয়ের শিহরন তৈরির ক্ষমতার ওপর।

রোমহর্ষক উপন্যাসের প্রথম দিককার নিদর্শন হচ্ছে মেরি শেলির ফ্রাংকেনস্টাইন (১৮১৮) এবং ব্রাম স্টোকারের ড্রাকুলা (১৮৯৭)। ড্রাকুলা উপন্যাস গড়ে উঠেছে এক রক্তপিশাচকে নিয়ে। অধিকতর সমসাময়িক রোমহর্ষক উপন্যাস রচয়িতা হলেন মার্কিন লেখক অ্যান রাইস। তাঁর ইন্টারভ্যু উইথ দ্য ভ্যাম্পায়ার (১৯৭৬) ও দ্য ভ্যাম্পায়ার লেসট্যাট (১৯৮৫) প্রকাশের পর তিনি ভ্যাম্পায়ার বা রক্তপিশাচ বিষয়ক লেখক হিসেবে পরিচিত হন। মার্কিন লেখক উইলিয়াম ব্ল্যাটির দি একজোরসিস্ট (১৯৭১) উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে এক নারীর ওপর এক দানবের দাপটের কাহিনি। মার্কিন লেখক ডিন কুন্ট্স কয়েক ডজন রোমহর্ষক উপন্যাস লিখেছেন। বিখ্যাত হচ্ছে ওয়াচার (১৯৮৭)। এ উপন্যাসের বিষয় হচ্ছে বংশগতির পরীক্ষা-নিরীক্ষা।

সাম্প্রতিক কালে রোমহর্ষক উপন্যাস লিখে নাম করেছেন মার্কিন ঔপন্যাসিক স্টিফেন কিং। তাঁর প্রথম উপন্যাস এক স্কুল ছাত্রীকে নিয়ে যে ইচ্ছে করলেই যে কোনও জিনিস জায়গা বদলায়। তাঁর ক্রিস্টাইন (১৯৮৩) একটি মোটর গাড়ির গল্প যা নিজে নিজেই চলতে পারে। এই রূপশ্রেণির অন্যান্য উদাহরণের মধ্যে রয়েছে : ডেনিস হুইটলির দ্য ডেভিল রাইডস আউট (১৯৩৫), এইচ পি লাভক্র্যাফটের অ্যাট দ্য মাউন্টেন অফ ম্যাডনেস (১৯৩৬), স্টিফেন কিংয়ের ক্যারি (১৯৭৪) ও দ্য সাইনিং (১৯৭২) ইত্যাদি।

৩.৮ দুর্বৃত্ত উপন্যাস (Picaresque Novel)

ইংরেজি সাহিত্যে যা পিকারেস্ক উপন্যাস (The Picaresque Novel) নামে পরিচিত তাকে বাংলায় বলা যায় দুর্বৃত্ত উপন্যাস। স্পেনীয় ভাষার ‘পিকারো’ শব্দের অর্থ ‘rogue’ বা দুর্বৃত্ত। এ জাতীয় উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্রে থাকে কোনও পিকারো বা দুর্বৃত্ত। তার জীবনে জাল-জুয়াচুরি-প্রতারণা বা নানা রোমাঞ্চকর ঘটনা ঘটে। সেসব ঘটনা তার জীবনকে প্রভাবিত করে। এই ঘটনাগুলিকে বাস্তবরূপে এবং বিদ্রুপ ও কৌতুকরসের মধ্য দিয়ে লেখক বর্ণনা করেন।

‘পিকারো’ বা দুর্বৃত্ত সামন্ত সমাজের উপজাত সৃষ্টি। কিন্তু সমাজে তাঁর মর্যাদা বা ঠাঁই নেই। তাই কোনও সামাজিক বন্ধন বা কোনও সামাজিক মূল্যবোধ সম্পর্কে তার কোনও আনুগত্য দেখা যায় না। বুদ্ধির চাতুর্য ও শঠতার সাহায্য নিয়ে তাঁকে বাঁচতে হয়। ফলত সামন্ত সমাজের উপজাত হয়ে ‘পিকারো’ যেন সামন্ততান্ত্রিক মূল্যবোধগুলিকেই বিদ্রুপ করে।

স্পেনদেশীয় অজ্ঞাতনামা লেখকের লাজারিলো ডি টর্মেস (Lazarillo de Tormes, ১৫৫৪) এই শ্রেণির উপন্যাসের প্রথম উদাহরণ। পরে স্পেনীয় ঔপন্যাসিক মাতিও আলমান এর দুর্বৃত্ত-উপাখ্যান Guzman de Alfarache (১৫৯৯-১৬০৪) এই ধরনের উপন্যাস হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পায়।

ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম দুর্বৃত্ত-উপন্যাস লেখেন টমাস ন্যাস। তাঁর দি আনফরচুনেট ট্র্যাভেলার (১৫৯৪) উপন্যাসের নায়ক যুবক-ভৃত্য জ্যাক উইলটনের চরিত্র-বৈশিষ্ট্য স্পেনীয় লেখক আলেমানের স্পেনীয় উপাখ্যানের দুর্বৃত্ত নায়কের অনুরূপ। তার ভ্রাম্যমাণ জীবনের ভয়ংকর ও লোমহর্ষক কীর্তিকলাপ এ উপন্যাসের উপজীব্য। তাতে হত্যা, ধ্বংস, প্রতিহিংসা ও নারীলাঞ্ছনার নানা ঘটনার ভেতর দিয়ে শ্বাসরোধকারী উপাখ্যান গড়ে উঠেছে।

সতেরো শতক থেকে সমগ্র ইউরোপে বিভিন্ন ভাষায় দুর্বৃত্ত-উপন্যাস রচিত হতে থাকে। জার্মান ভাষায় রচিত হয় গ্রিমেলসাউজেন-এর Der Abentheurliche Simplicissimus Teutsch (১৬৬৯)। ফরাসি ঔপন্যাসিক Le sage- লেখেন পৃথিবী-বিখ্যাত দুর্বৃত্ত উপন্যাস গিল ব্লাজ Gil Blas (১ম ১৭১৫, ২য় ১৭২৪, ৩য় ১৭৩৫)। ইংরেজ ঔপন্যাসিক টোবিয়াস স্মোলেটের রোডেরিক র‌্যানডম (১৭৪৮) এই ধারার উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। লেসাজ-এর গিল ব্লাজ অনুসরণে লেখা এ উপন্যাসে লক্ষ্য করা যায় দুর্বৃত্ত উপন্যাসের প্রচণ্ড গতি ও উদ্দামতা। পিতা-পরিত্যক্ত ও আবাল্য-লাঞ্ছিত রোডিরিক কীভাবে নাবিক―জীবনে ছিটকে পড়ে এবং প্রেম, প্রতিহিংসা ও নিষ্ঠুরতার পথ ধরে অভাবনীয় গতিতে আবর্তিত হয় জীবনের পঙ্কিল ঘূর্ণিপাকে, তার বিস্ময়কর কাহিনি নিয়ে গড়ে উঠেছে এ উপন্যাস।

ইংরেজ ঔপন্যাসিক ড্যানিয়েল ডেফোর মল ফ্ল্যান্ডার্স-এর (১৭২২) নায়িকা পুরোপুরি ‘পিকারো’ বা দুর্বৃত্ত শ্রেণির পর্যায়ে পড়ে না। বিশেষ পারিবারিক-সামাজিক পরিস্থিতিতে, ঘটনাচক্রে সে দৃষ্কতকারীর জীবনে ছিটকে পড়েছে। জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতে জর্জরিত মল ফ্ল্যান্ডার্সের চরিত্র লেখক গভীর সহানুভূতির সঙ্গে এঁকেছেন। এদিক থেকে দুর্বৃত্ত উপন্যাসের সঙ্গে এর মিল কেবল বহিরঙ্গের।

উনিশ শতকের জনপ্রিয় ইংরেজ ঔপন্যাসিক চার্লস ডিকেন্সের পিকউইক পেপার্স (১৮৩৬-১৮৩৭) দুর্বৃত্ত উপন্যাসের ঐতিহ্য অনুসরণ করেছে।            

বাংলা সাহিত্যে যথাযথ দুর্বৃত্ত উপন্যাসের উদাহরণ বিরল। কারও কারও মতে, বাংলা সহিত্যে প্রথম দুর্বৃত্ত উপন্যাস সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জাল প্রতাপচাঁদ (১৮৮৩)। জগদীশচন্দ্র গুপ্তের অসাধু সিদ্ধার্থ-কে (১৯২৯) কেউ কেউ দুর্বৃত্ত উপন্যাসের উদাহরণ হিসেবে গণ্য করেন। বাংলায় দুর্বৃত্ত উপন্যাসের উদাহরণ হিসেবে মনোজ বসুর নিশিকুটুম্ব (১৯৬৩) গ্রন্থের নাম করা যায়। এর নায়ক সাহেব তস্কর দলের পাণ্ডা। উপন্যাসে সাহেব ও তার তস্কর সঙ্গীদের চৌর্যবৃত্তির বাস্তবানুগ বিবরণ সত্ত্বেও তাদের নানা কীর্তিকলাপের আড়ালে এক রোমান্স রসের প্রাবল্য, ভাবাবেগের আতিশয্য ও মন্দের আড়ালে ভালোর উপস্থিতি পাঠকের মনকে ছুঁয়ে যায়। তাছাড়া সৎ ও নিষ্ঠাবান পুলিশ কর্মচারীর চরিত্র ও দূর পল্লিগ্রামের গৃহস্থবাড়ির বহুবিচিত্র জীবনধারার আবেদনের কাছে তস্করদের জীবনবাস্তবতা অনেকটা আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।

৩.৯ ওয়েস্টার্ন উপন্যাস (Western Novel)

এ ধরনের উপন্যাসের কাহিনি রচিত হয় আমেরিকার পশ্চিম অঞ্চলের প্রতিবেশে। তাতে থাকে কাউবয় ও আমেরিকার আদিবাসীদের জীবন-বৈশিষ্ট্য। এ ধরনের উপন্যাসের ঘটনা হিসাবে প্রাধান্য পায় পশুচুরি, ট্রেনদস্যুতা ও বন্দুকযুদ্ধ। কোনও কোনও ওয়েস্টার্ন উপন্যাসে আমেরিকার পশ্চিম অঞ্চলের প্রতিবেশ, জীবনযাত্রা ও নৃগোষ্ঠীগত বৈচিত্র্যকে বিশেষভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়। 

প্রথম দিককার ওয়েস্টার্ন উপন্যাসের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন মার্কিন ঔপন্যাসিক ওয়েন উইস্টার-এর দ্য ভার্জিনিয়ান (১৯০২)। অনেক মার্কিন লেখক ধ্রুপদী ওয়েস্টার্ন উপন্যাস লিখেছেন। জেইন গ্রের রাইডার অফ দ্য পারপল সেইজ (১৯১২) উপন্যাসের কাহিনির নায়ক একজন বন্দুকবাজ। সে একজন নারীকে তার সম্পত্তি রক্ষায় সাহায্য করে। ওয়াল্টার ভ্যান টিলবার্গ ক্লার্ক-এর দি অক্স-বোউ ইনসিডেন্ট (১৯৪০) উপন্যাসের কাহিনি গড়ে উঠেছে পশুচোরদের খোঁজা নিয়ে। কাহিনি শেষ পর্যন্ত ট্রাজিক পরিণতি পায়। জ্যাক শেইফারের শেইন (১৯৪৯) উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে এক নিঃসঙ্গ বন্দুকযোদ্ধার কাহিনি। সে একটি শহরে এসে সহিংসতার কবলে পড়ে। বিশ শতকের শেষভাগে ও একুশ শতকের গোড়ায় বেশ কয়েকজন মার্কিন ঔপন্যাসিক ওয়েস্টার্ন উপন্যাস লিখেছেন। উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে রয়েছেন : লুইস এল আমোর, শেলম্যান আলেকজি, রুডলফো আনায়া, লুইস এনড্রিক ও ল্যারি ম্যাকমারি।

 লেখক : ভাষাতত্ত্ববিদ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button