জিল্লুর রহমান সোহাগ
তিনি নিজের নামকে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন না, কারণ তিনি পেশায় একজন ব্যাংকার। ব্যাংকারদের স্বভাবের এই বিশেষ দিকটা নিয়ে আপনাদের কোন আপত্তি থাকলে আপনারা তা নিজ দায়িত্বে সরেজমিনে গিয়ে যাচাই করে দেখতে পারেন। তবে আমার মতো আপনাদেরকেও এটা মানতে হবে যে নামের কারণে ঝামেলাটা হয় অফিসের কাজের বাইরে অন্যান্য সব সামাজিকতায়। তার ক্ষেত্রে এমন অনেক সময়ই ঘটেছে যে হুটহাট কেউ খুব চেনা ও আন্তরিক ভঙ্গিতে কুশল জিজ্ঞেস করতে আসলে তাকে বেশ কয়েকবার পড়তে হয়েছে বিব্রতকর সব পরস্থিতির ভেতর। তবে তার ভাগ্য ভালো যে শেষমেষ এই সমস্যার মোটামুটি একটা সমাধান খুঁজে পাওয়া গেছে। কায়দাটা হলো, অফিস আওয়ারে লাইনে দাঁড়ানো গ্রাহকদের সেবা দেবার সময় বেশিরভাগ ব্যাংকারদের ঠোঁটে যে প্লাস্টিক হাসিটা ঝুলে থাকে সেটাকে জায়গামত ঠিকঠাক কপি পেস্ট করতে পারলে ওসব সামাজিকতা সহজেই উৎরে যাওয়া যায়। কেন না আজকাল হাসির ফাঁক খুঁজে বের করার জন্য অযথা সময় নষ্ট করার ব্যাপারে কেউই বিন্দুমাত্র উৎসাহী নয়।
এটার মানে আবার এই নয় যে, তার অফিসটা একেবারেই নিরানন্দ এবং অপেক্ষা-কামরায় বসে থাকা গ্রাহকদের জিজ্ঞেস করলে অনেকেই এটার পক্ষে মতামত দেবেন। এদের ভেতর অন্তত কয়েকজনকে তো নিশ্চিত পাওয়া যাবে যারা পরিপাটি পোশাকে সজ্জিত, সদা হাস্যোজ্জ্বল এইসব ব্যাংকারদেরকে দেখে মনে মনে আক্ষেপ করবেন তাদের মতো একজন ব্যাংকার না হতে পারবার।
তিনি দীর্ঘদিন কাজ করছেন ক্যাশ ডিভিশানে, সুতরাং কাজের ফাঁকে ফাঁকে সহকর্মীদের আড্ডায় তিনি কখনওই ঠিকঠাক অংশগ্রহণ করতে পারেন না। বহুদিন আগে কাকে যেন তিনি একবার বলতে শুনেছিলেন যে যারা ব্যাংকে চাকরি করে তাদের কোমরের নিচ থেকে শরীরের বাকি অংশ একসময় অনুভূতিশূন্য হয়ে পড়ে। সেখানে বারোমাসই তুষারপাত চলে। কোন প্রকার উত্তাপেই সে বরফ গলে না। এটার সত্যতা যাচাই করতে তিনি অনেকটা বেখেয়ালে প্রায়শই শরীরের নিচের অংশ একহাতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দ্যাখেন এবং প্রতিবারই আশ্বস্ত হোন সব ঠিকঠাক দেখে।
অফিসের বাকি কলিগদের সাথে যেহেতু তিনি আলাপে সহজ নন, একারণেই বাকিরাও তার সাথে প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাতির এড়িয়ে চলে। এতে অবশ্য তার ভালোই হয়েছে, কেননা তাতে করে মনোযোগসহকারে ও নির্বিঘ্নে কাজ করা যায়। ক্যাশ ডিভিশানের কাজে সাবধানী হওয়াটা পেশাগত কারণেই ভীষণ জরুরি। বিগত বছরগুলো থেকে আজ পর্যন্ত তিনি বেশ সাফল্যের সাথেই কাজ করে যাচ্ছেন। খাতাপত্রে টুকটাক কাটাকুটি ছাড়া হিসেবে গরমিল তার কখনওই হয়নি। তাছাড়া আপনারা তো সবাই জানেনই যে ব্যাংকে ক্যাশের হিসেবে গরমিল হওয়া মানেই সাক্ষাৎ কেয়ামত।
এই মুহূর্তে তাকে বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথেই নিজের চেয়ারে বসে হিসাব-নিকাশের কাজ করতে দ্যাখা যাচ্ছে। অফিস ছুটি হতে আরও ঘন্টা খানেক বাকি। তার উপর আজ আবার এই মাসের শেষ কর্মদিবস। সুতরাং পুরো মাসের হিসেব ঠিকঠাক করাটা অন্যান্য সপ্তাহের থেকে অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু তাকে মোটেও দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখাচ্ছে না, মনে হচ্ছে বরাবরের মতো তিনি ঠিকই হিসেব মেলানোতে দক্ষতার পরিচয় দেবেন। ব্যাংকের লেনদেন বন্ধ হয়ে গেছে বেলা তিনটার ভেতর। গ্রাহকদের ভিড়-বাট্টা তাই একেবারে নেই বললেই চলে।
তিনি কাজ করছেন সাবধানী ভঙ্গিতে, চোখ-মুখ থেকে ঠিকরে পড়ছে প্রবল আত্মবিশ্বাসের ছটা। তার একমাত্র ছেলে যার বয়স আজকের দিনে পাঁচে পড়েছে, সে-ই মনে করিয়ে দিচ্ছে যে বাসায় ফিরতে হবে একটু তাড়াতাড়ি। ছেলেটার জন্মদিন উপলক্ষে তার স্ত্রী বাসায় আয়োজন করেছে ছোটখাটো। মজার ব্যপার হলো বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয় স্বজনের কাউকেই নয়, দাওয়াত দেওয়া হয়েছে তারা যে ভাড়াবাড়িতে থাকেন সেখানকার উপরতলা-নিচতলার ফ্লাটের মোটামুটি পরিচিত কয়েকজনকে। বরাবরের মতোই এই আইডিয়াটাও তার স্ত্রীর এবং সবকিছুর মতো এটাতেও তিনি সায় দিয়েছিলেন কথা না বাড়িয়ে।
আপ্যায়নের ঝামেলাটা তার স্ত্রী একাই মোটামুটি সামলে নেবে, তার উপর শুধু দায়িত্ব পড়েছে বাসায় ফিরবার পথে একটা জন্মদিনের কেক নিয়ে যাবার। তিনি অবশ্য আগেই অর্ডার দিয়ে রেখেছেন, শুধু ডেলিভারি নেবার আগে কেকের উপরকার লেখাটা লিখিয়ে নিতে হবে। এবার তাহলে তার দিকে আরেকবার নজর দিয়ে দেখুন, দেখবেন তাকে অন্যান্য দিনের থেকে আজ বেশ ঝরঝরে লাগছে, চোখ এড়াবে না তার মেজাজের ফুরফুরে ভাবটাও।
আপনারা চাইলে লোকটাকে আমি খানিকটা নাড়িয়ে দিতে পারি, আপাতত কলকাঠিটা আমার হাতে। কারণ এখন থেকে লোকটার বাড়ি ফিরে যাওয়া ও পরবর্তী কি ঘটবে তা নির্ধারণ করব আমি। নিজেকে হঠাৎ এরকম ক্ষমতাসীন ভেবে বেশ আনন্দ হচ্ছে। নিজেকে মনে হচ্ছে অলিম্পাসবাসী দেবরাজ জিউসের মতো অথবা সেই নিরাকার প্রবল ক্ষমতাধর ঈশ্বর অথবা খেলোয়াড় স্বভাবের কিশোর। কিন্তু এখানে আমি করতে চাই ছোট পরিসরে গণতন্ত্রের চর্চা। আপনারাই বলুন কি চান ? ক্যাশের হিসেবে ভজঘট লাগিয়ে দিব ? যাতে করে তার আগেভাগে বাসায় ফেরাটা মাথায় ওঠে ? অথবা উস্কে দেওয়া যাক তার বহুপুরোনো মাইগ্রেনের যন্ত্রণাটা অবশ্য তাতে করে আপনা আপনিই ভজঘট লেগে যাবে হিসেবে কেননা এ যাবতকাল এটাই দ্যাখা গেছে যে লোকটা কাবু একমাত্র মাইগ্রেনের কাছেই। অথচ কি আশ্চর্য আপনারাও দেখি আটকে গেলেন দৃশ্যের ফাঁদে। আর আপনাদের সাথে সাথে আমিও অপলক চোখে দেখছি সচরাচর মুখ গোমড়া করে রাখা লোকটার আজকের ফুরফুরে মেজাজের জিওমেট্রি।
দেখতে দেখতে অফিস ছুটির সময়ও এগিয়ে আসছে এবং তাকে দেখা যাচ্ছে টেবিলের কাগজপত্র শব্দ করে গুছিয়ে রাখতে। সম্ভবত হিসেব নিকেশের কাজটা তিনি শেষ করেছেন বরাবরের মতোই সফলভাবে। হাত ইশারায় অফিসের পিওনকে ডেকে কি যেনো একটা বুঝিয়ে দিচ্ছেন, আপনাদের মতো আমিও একটু দূর থেকে সেটা অনুমান করতে পারছি না। কিছুক্ষণ পর চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পুরো অফিসটাকে তিনি একবার দেখে নেন, তা দেখে যে কেউ ভেবে বসতে পারে যে লোকটা মনে মনে কিছু একটার মতলব আটছেন নিশ্চিত।
দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক মন্দার সাথে তাল মেলাতে তাদের অফিসে টয়লেটের টিস্যু পেপারের সাথে কাটা পড়েছে পিক এন্ড ড্রপ সার্ভিস। একারণেই আজকাল অতিরিক্ত খরচ করে করে তাকে রোজই ফিরতে হয় বাসায়। অসন্তুষ্টিটা অবশ্য অল্প কদিনের ভেতরই ঠেকেছে অভ্যস্ততায়। বাসায় ফিরবার প্রক্রিয়া বিষয়ক বাহুল্য আলাপে না গিয়ে আপনারাও আমার সাথে সাথে নিয়ে নিতে পারেন স্বল্প চা কিংবা কফি বিরতি। ততক্ষণে তিনি বরং ফিরতে থাকুন বাসার দিকে। চা কফিতে আমার আবার অতটা নেশা নেই, তবুও বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতির সাথে নিজেকে মানিয়ে নেবার জন্য অনেক কিছুই যেমন করতে হয় তেমনি আমিও চা-কফি খাই। আপনারাও এই বিরতিতে ভাবুন গল্পটা কোন দিকে গড়াচ্ছে।
এখন মনে হচ্ছে এটাই বরং ভালো ছিল যদি তার আজকের হিসেবটা খানিকটা উল্টে-পাল্টে দিয়ে রাত পর্যন্ত আটকে রাখা যেত অফিসে। কিন্তু আপনাদেরকে একটা প্রশ্ন করি বলুন তো লোকটাকে কেনইবা আমি ঝামেলায় ফেলতে চাইছি ? আমার মনে হয় এই মুহূর্তে আপনাদের ইচ্ছেটাও ঠিক তেমন। মনে হচ্ছে আমি এবং আপনারা উভয়ে মিলে ফিরে গেছি প্রাচীন গ্রিক অ্যাম্ফিথিয়েটারে হিংস্র পশুর সাথে গন্টাডিয়েটরদের সেই নৃশংস যুদ্ধ-উৎসবের মঞ্চে। আমাদের হাত-পা নিশপিশ করছে প্রবল উত্তেজনায়, আমরা যেন ঠিক করেই এসেছি মানুষ হত্যা না দেখে আজ অন্তত ফিরছি না ঘরে।
আমাদের বিবিধ আলাপের ফাঁকে লোকটাকে দেখতে পাচ্ছি কেকের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে। দোকানে বেশ অনেক লোকজনের ভিড়। অপেক্ষমান কাস্টমারদের ভিড়ে তিনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটু পর পর হাতঘড়ি দেখছেন ঠিকই কিন্তু তার চোখ-মুখ থেকে এখনও হারিয়ে যায়নি সেই ফুরফুরে মেজাজের চিহ্ন। একটা সাদা চুলের বৃদ্ধকে দেখা যাচ্ছে হামাগুড়ি দেবার মতো করে হেঁটে হেঁটে তার দিকে হেঁটে আসতে। তিনিও অপেক্ষা-লাইনে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন তার সাথে আন্তরিক ভঙ্গিমায়। একসময় বৃদ্ধটিও কাঁপা কাঁপা হাতে তার পিঠ ছুয়ে দিয়ে চলে যায় খুশিমনে। হয়তবা বৃদ্ধ লোকটি এসেছিল ভুলে যাওয়া কোন ঠিকানার সন্ধান করতে আর পেয়েও গেছেন সেটি। এ থেকে অনুমান করা যায় ব্যাংকার হওয়া সত্ত্বেও তার ভেতর থেকে একদম মরে যায়নি মানবিক অনুভূতির বোধ।
একটু পর লাইনের সামনে থেকে লোক সরে যাওয়ায় তিনি পৌঁছে যান ডেলিভারি বুথের কাছে। দোকানের চেকশার্ট পরা যুবক ছেলেটি হাসিমুখে তার সামনে কেকের বাক্সটি এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করেন কেকের উপরে কি লেখা হবে। গল্পটা জমে যাবে এখনই কারণ কিছুতেই তিনি মনে করতে পারবেন না তার একমাত্র ছেলের নাম যার বয়স আজই পড়েছে পাঁচে। কারণটা পরিষ্কার এবং শুরুতেই বলে নিয়েছি যে যেহেতু তিনি ব্যাংকার তাই নামের ব্যাপারটা কখনওই তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল না।
তাকে দেখা যাচ্ছে বিভ্রান্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকতে। ডেলিভারি বুথের সামনের ছেলেটা ডানহাতের আঙ্গুলের ফাঁকে রাইটিং কোণটা ধরে অপেক্ষা করছে তার উত্তরের। তিনি কিছুতেই মনে করতে পারছেন না তার ছেলের নাম। একই সাথে ক্রমেই লম্বা হচ্ছে তার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা বিরক্ত মুখের কাষ্টমারদের লাইন। শেষমেষ কেকের উপর ‘হ্যাপি বার্থডে টু মাই বিউটিফুল সন’ কথাটি লিখে নিয়েই তাকে সরে পড়তে হয় লাইন থেকে। আমার সাথে আপনারাও হয়ত ভাবছেন যে এ যাত্রায় তিনি কোনমতে উৎরে গেলেও বাসায় ফিরবার পরের ঝড় তিনি সামলে উঠতে পারবেন না কোনভাবেই। আপাত দৃষ্টিতে কেকের উপর ছেলের নাম লেখার ব্যপারটা এই মুহূর্তে খুব বড় মনে না হলেও তার স্ত্রীর কাছে ঠিকই এটা গণ্য হবে বড়সড় অপরাধ হিসেবে।
অথচ এসবের কিছুই ঘটল না দেখে আপনাদের মতো আমিও পড়ে গেছি দুশ্চিন্তায়। বাসায় উপস্থিত অতিথিদের সাথে এই মুহূর্তে তাকে দ্যাখা যাচ্ছে হেসে হেসে কথা বলতে। এরই মধ্যে অফিসের পোশাক পাল্টে তিনি পরে নিয়েছেন বুকের উপর সামান্য জরির কাজ করা হালকা ঘিয়ে রংয়ের একটা পাঞ্জাবি এবং তাতে করে বেশ অনেকখানিই বেড়েছে তার চেহারার রোশনাই। ড্রয়িংর রুমের একপাশে জন্মদিনের যে ছোট স্টেজ বানানো হয়েছে সেটা পাহারা দিচ্ছে কিনে আনা কেকটা। কেকের চারপাশে দাঁড় করানো পাঁচটা স্টাইলিশ মোমবাতিগুলো এখনও জ্বালানো হয়নি। সাউন্ড স্পিকারে মৃদু ভল্যিউমে বাঁজছে স্লো ইনস্ট্রুমেন্টাল যেটা এই পরিবেশের সাথে মোটেও মানানসই নয়। তবে এটাকে উপেক্ষা করলে যে কেউ বলবে যে এই আয়োজনের ধরনটা নিঃসন্দেহে অভিজাত।
এসবের ভেতর কয়েকজনকে বেশ কয়েকবার প্রশ্ন করতে শোনা যায় যে যার জন্মদিন সে ছেলেটা কোথায় ? অথচ ছেলের মা-বাবাকে দিব্যি দ্যাখা যাচ্ছে অতিথিদের সাথে কথা-বার্তায় ব্যস্ত। তাহলে কি ছেলেটাকে কেউ নতুন জামা-কাপড় পরিয়ে তৈরি করছে অনুষ্ঠানের জন্য ? অথচ তার মতো একজন সাধারণ ব্যাংকারের ছেলের এতটা আদিখ্যেতা বড্ড বেমানান দ্যাখায়। ঘরভর্তি ম ম করছে ইভিনিং স্ন্যাকস্ এর নানা পদের সুস্বাদু খাবারের গন্ধ। কিন্তু তারপরও তা যথেষ্ট নয় উপস্থিত অতিথিদের কৌতূহল ভুলিয়ে দিতে। প্রশ্নটা ক্রমেই মুখ থেকে মুখে ঘুরতে ঘুরতে একসময় ঘরের ভেতর বাঁজতে থাকা ইনস্ট্রুমেন্টালের শব্দকেও ছাপিয়ে যায়। আর তখনই ছেলের বাবা-মা তাদের অতিথিদের কে ‘এক্সকিউজ মি’ বলে ড্রয়িংরুম থেকে সরে গিয়ে একসাথে ঢুকে পড়ে শোবার ঘরের ভেতর যেখানে সেই শুরু থেকেই কারও সাড়াশব্দ ছিল না।
আচমকা লোডশেডিংয়ে অন্ধকার হয়ে যাওয়া সিনেমা হলের ভেতরকার দৃশ্যের মতো আমিও হঠাৎ ঢুকে পড়ি অন্ধকারে। একেবারে শুরুতেই এই গল্পের নিয়ন্ত্রণটা নিজের হাতে আছে বলে যে ঐশ্বরিক অহম তৈরি হয়েছিল নিজের ভেতর, বুঝতে পারছি সেটাই এখন পাঁয়তারা শুরু করেছে আপনাদের সামনে আমাকে নিতান্তই খেলো বানিয়ে ফেলবার।
শোবার ঘরে এই মুহূর্তে কি চলছে এটা ওখানে উপস্থিত করাও অনুমানে আসে না, আমার নিজের তো নয়ই। আপনারা অবশ্য অনুমান করতেই পারেন অনেকগুলো সম্ভাব্য ঘটনার এবং মিলেও যেতে পারে। সেক্ষেত্রেও কিন্তু শতভাগ নিশ্চয়তা আছে আনন্দ পাবার, অনেকটা বাজি জেতার মতো। আসলে সবই কিছুর উপরে আনন্দ পাওয়াটাই আসল কথা, তা সে যেভাবেই পাওয়া যাক না কেনো।
দেখতে পাচ্ছি ইতোমধ্যেই উপস্থিত অতিথিদের সবারই আলোচনার বিষয়বস্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে আজকের জন্মদিনের প্রধান কুশিলবকে ঘিরে। তারা সবাই একই ফ্লাটের অধিবাসী হওয়া সত্ত্বেও পড়ে যাচ্ছে অদ্ভুত এক দ্বিধাদ্বন্দ্বের ভেতর। এর মধ্যে হঠাৎ একজনকে বলতে শোনা যায় যে তিনি এই ব্যাংকার ও তার স্ত্রীকে বেশ ভালোভাবে চিনলেও তাদের সন্তানের সাথে কখনওই তার দেখা হয়নি। আর তার এই কথাটি দ্রুত সংক্রামক ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়ে উপস্থিত প্রায় সবার ভেতর। তাদের সবাই তখন মনে করবার চেষ্টা করে তারা ঠিক কবে এই দম্পতিকে তাদের ছেলেসমেত দেখতে পেয়েছে। এই সংশয় যখন দ্রুতই বাড়তে বাড়তে আকাশচুম্বি হবে ঠিক তখনই খুলে যায় শোবার ঘরের দরজা। তারা তিনজন একসাথে বেরিয়ে আসে হাসিমুখে। সদ্য পাঁচ বছরে পা দেওয়া ছেলেটির ঝলমলে হাসিমুখের দিকে চোখপড়া মাত্রই আমন্ত্রিত অতিথিদের মনে পড়ে তারা সবাই এই ছেলেটিকে অজস্রবার দেখেছে লিফ্ট ও সিঁড়িঘরে। অনেকে আবার নিজ থেকে ডেকে কথাও বলেছে তার সাথে, কেননা এই ছেলেটার মুখে অদ্ভুত মমতা মাখানো একটা সারল্য আছে যা এড়িয়ে যাওয়া যাবে না সহজেই।
এই তিনজন আসামাত্রই খানিক আগেকার প্রায় ঝিমিয়ে পড়া আয়োজনটাতে প্রাণ ফিরে আসে। সাউন্ড স্পিকারে ঢিমেতালে বাঁজতে থাকা ইন্স্ট্রুমেন্টাল বদলে সেখানে বাজতে শুরু করে দ্রুত লয়ের গান। তারই সাথে আড্ডাও জমে ওঠে আমন্ত্রিত অতিথিদের। তারা জড়ো হয় জন্মদিনের প্রধান কুশিলবকে ঘিরে। তাকে পরানো হয়েছে লাল জরির একটা টুপি। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে ছেলেটা একটা সাক্ষাৎ দেবদূত। আপনারাও হয়ত আমার মতো দৃষ্টি সরাতে পারছেন না ছেলেটার উপর থেকে।
জন্মদিনের কেকের চারপাশে যে পাঁচটা রঙ্গিন মোমবাতি দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল, কেউ সেগুলো জ্বালিয়ে দিয়েছে ইতিমধ্যেই। সাউন্ড স্পিকারে বাঁজতে থাকা দ্রুত লয়ের ইন্সট্রুমেন্টাল থামিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং এই মুহূর্তে উপস্থিত সবাইকেই দ্যাখা যাচ্ছে একসাথে গলা মিলিয়ে জন্মদিনের গান গাইতে।
গল্পটার নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নেই বলে আমার আনন্দটা মাঠে-মারা গিয়েছিল বহু আগেই। সেই যন্ত্রণাকে দ্বিগুণ করতেই বোধহয় দেখতে পাই এই আনন্দ উল্লাসের ভেতর ব্যাংকার লোকটি উধাও। ব্যাপারটা ঠিক এমনই মনে হচ্ছে যে তিনি যেন কখনওই এই দৃশ্যে ছিলেন না। বিশেষ করে তার স্ত্রী যাকে এই মুহূর্তে এক হাতে ছেলেকে নিজের শরীরের সাথে চেপে ধরে কেকটার সামনে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে কথা বলতে শোনা যাচ্ছে আমন্ত্রিত অতিথিদের উদ্দেশ্যে, তারও যেন বিকার নেই এই দৃশ্যে তার স্বামীর অনুপস্থিতি বিষয়ে। আমাদেরও জানার উপাই নেই যে তিনি এই মুহূর্তে ঠিক কোথায় অবস্থান করছেন।
অনেকক্ষণ পর অনুষ্ঠানের একবারে শেষ পর্যায়ে যখন অতিথিরা একে একে বিদায় নেবার প্রস্তুতি নেবে নেবে করছে, ঠিক তখনই হঠাৎ দৃশ্যে তার আবির্ভাব ঘটে। ঘরে ঢোকামাত্রই উচ্চস্বরে ছেলেকে বেশ কয়েকবার তার নাম ধরে ডাকতে ডাকতে মঞ্চের দিকে ছুটে যান। তিনি হাতে ধরে আছেন একটা বড়সড় কেকের প্যাকেট। অতিথিদের দিকে না তাকিয়েই তাড়াহুড়ো করে প্যাকেটটা মেলে ধরতেই দ্যাখা যায় সেখানে সুন্দর ডিজাইন করে লেখা ছেলের নাম। উপস্থিত সবাই আবারও একে একে ভিড় জমায় কেকটার সামনে, দেখে মনে হচ্ছে আসল অনুষ্ঠানটা শুরু হবে এবার।
এই দৃশ্য আমি নিতে পারছি না। মনে হচ্ছে গল্পের নিয়ন্ত্রণ লোকটার হাতে গেছে বলে তিনি এখন যা খুশি তাই করছেন। ভিড়ের ভেতর থেকে হঠাৎ চোখে পড়ে তার কুৎসিত হাসিমুখ। দেখে মনে হচ্ছে এই হাসিটা দিয়েই তিনি আমাকে ও আপনাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলতে চাইছেন যে ব্যাংকার বলেই তিনি টাকার সাথে সাথে নিজের জীবনের হিসেবটাও মিলিয়ে নিতে পেরেছেন ঠিকঠাক।
সচিত্রকরণ : ধ্রুব এষ