আর্কাইভকবিতা

কবিতা

শিহাব সরকার

এই নদী, এই সেতু

চুয়ান্ন বসন্ত পেরিয়ে প্রথম গিয়েছি পদ্মার পাড়ে

আমি মেঘনার মানুষ, শরীরে নদীর জলছাঁকা ঘ্রাণ

এই গন্ধ শরীরে মেখে কৈশোর, যৌবন থেকে আজ।

এক শীতের বিকেলে পদ্মা আমার স্বপ্নে

রবিঠাকুরের বোটের ছাদে বসে ছিলাম আমি

কূলহীন কিনারাহীন পদ্মা বয়ে চলেছে

কোথায় চলেছ নদী?

‘জানি না তো আমি, শুধু এইটুকু জানি

আমাকে শুধু বয়ে যেতে হবে

নইলে এরা যে বেনোজলে ভেসে যাবে।’

দেখলাম আমি, খোলা নৌকায়

জলোচ্ছলো নর-নারীদের জলখেলা

একলা-মাঝি রাশি রাশি ভারা ভারা ধান নিয়ে

ঝালরে ছাওয়া বর-কনেদের ডিঙি কোন কূলে গিয়ে ভেড়ে

পদ্মার পারে এলে এই সব ছবি দেখে দেখে…

এক দুপুরে ঘুমের ভিতর সহসা সন্ধ্যা নামে

মধ্যগাঙে উড়ছে পুড়ছে কত আতশবাজি

স্লোগান জেগেছে―

‘তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’

পদ্মাসেতু ধরে গাড়ির স্রোত, রেলের হুইসিলে

জাহাজের ভেঁপু শুনে শতায়ু বৃদ্ধ চোখ মোছে

আমিও চোখ মুছি গোপনে

বন্ধু আমার, যাওয়া হলো না আর নৌকায় তোমার গ্রামে

পদ্মা বয়ে যাবে নিরবধি, এই সেতু রয়ে যাবে চিরকাল

বৈঠা ধরে আমরা এগুবো শুধু সামনের দিকে

আমাদের মায়াজীবনে ভেসে চলে অবিনাশী নৌকা

তবু সেতু ধরে যেতে হয় সমুদ্র মোহনার দিকে

মোহনা পেরিয়ে আরও দূরের গন্তব্যে যাব।

সামনে খোলা কাণ্ডারির স্বপ্নের মানচিত্র

স্বপ্নের নাবিকেরা নির্ঘুম। তবু ওরা স্বপ্ন দেখে যায়

পদ্মাসেতুতে রেখেছি পা।

আমাদের সবই আছে―অকূল দরিয়া-নদী, অবিচল নাবিক

পদ্মা বয়ে যায় নিরবধি, পদ্মাসেতুতে বিজয়ের মিছিল

বিজয়ের স্লোগান চারদিকে। জয় বাংলা। জয়। জয়।


মাহবুব বারী

তন্ত্রমন্ত্র কিছুই জানি না

আমার মন আজ সুরে সুরে পাখির মতো

ঘুরে বেড়ায়―শাখায় শাখায়

কী কথা বলে, কান পেতে শুনি তার ভাষা…

লা লা লা লা লা লা লা লা লা লা

আর সাধন সাধনা করি মনে মনে

তন্ত্রমন্ত্রের মতো

আর দেহ থেকে আত্মার দিকে যেতে যেতে বলি―

কি কি কি কি কি কি কি কি কি কি

তবু আমার হৃদয় যা চায় তা কি পায়!

কিন্তু আমি যে

আর কোনো তন্ত্রমন্ত্র কিছুই জানি না।


নাসরীন নঈম

উড়তে চাই

মাঞ্জা দেয়া সুতোর মতো ধারালো শরীরটা

নিয়ে ঘুড়ি হয়ে পুরনো শহরের আকাশে

উড়ে যেতাম―এ ছাদ থেকে এক লাফে ঐ ছাদে

হাতে লাটাই।

জিন্না ভাই, বাবুল মুশতাক আর রেবার মামার

সাথে আমার শাদা ঢাউস ঘুড়িটার কাটাকাটি চলে

ঘণ্টা ধরে। কোনও ভয়-ডর নাই―নাই করোনার আতঙ্ক

সবাই খুব আনন্দে জানলা খুলে দেখত।

মুখে মাস্ক নেই হাতে গ্লাবস্ নেই

ছোঁয়াছুঁয়ির তোয়াক্কাও করি নাই, শুধু

দৃষ্টি ছিল মধ্য আকাশে ঘুড়ির সুতায়

খালি পায়ে ছুটতে থাকি, উড়তে থাকি।

ঐভাবে ওড়াউড়ি আজ বন্ধ

চোখের কোনায় কুয়াশার চাদর

মধ্যরাস্তায় দাঁড়াতে পারি না এখন

জানালা দিয়ে আকাশ দেখি।

কবে শেষ হবে এ বন্দিদশা

ঘুড্ডির মতো উড়ব কবে?


জাহিদ হায়দার

একজন কেক-আর্টিস্টের সন্ধ্যা

লাবণ্য রচয়িতা। দূরতর মায়া।

উজ্জ্বল পুতুল।

চোখে দিগন্তজাত ভোর।  

ফুলের বাগানে শিশু।

মাথায় বার্থডের আইফেল-টাওয়ার ক্যাপ।

ফ্রকের তরঙ্গে আনন্দ রংধনু :

সিনথি, লাভ, হ্যাপি বার্থ ডে।

তিনতলা কেক।

সিঁড়িতে আলো। ওঠানামা অন্য বসুমতী।

শঙ্খচিলের ডানায় সূর্য।

বারান্দায় নীল মেঘ।

‘ওই চিরকুটমায়া কবে উড়েছিল ?’

বলতেই শিল্পী তাকান দূরের সন্ধ্যায়।

কসাইপট্টি থেকে আসা অতিথি

কিছু হেসে পছন্দ জানান :

আমার প্রিয় কলিজাকালারের কেক।

স্মার্টফোনেরা ক্লান্ত সেলফির নার্সিসিস্টিক আহ্লাদে।

‘কাটারও নান্দনিক শিল্প আছে।’

নিজেকেই বলল তার শূন্যক্ষত হৃদয়।

আদিম দাঁতেরা ব্যস্ত।

কামড়াচ্ছে মেঘের স্বাধীনতা, পাপড়ির ক্ষত

রংধনু-স্মৃতি সিঁড়ির সমাজ ফ্রকের সেলাই

আর হ্যাপি বানানের পাঁচটি অক্ষর।

খেতে খেতে বলল একজন :

ধর্মব্যবসায়ীরা কী চাঁদের কেক খায় ?

ক্রিমের কাদায় ডুবে আপাতত ঘুমাচ্ছে ছুরি।

জাগরণে হত্যা বাড়ে।

নিভে যাবার সময় সাতটি মোম সব বুঝে গেছে।


সোহরাব পাশা

শরতের ভোর

মানুষের ছায়ার নিজস্ব গল্প নেই

পৃথিবীর নানা রঙ

বাউল বাতাসে উড়ে যায় মিনেকরা স্বপ্নদিন

নিকানো উঠোনে ঝরে দীর্ঘ হারানো

জ্যোৎস্নার গল্প

নদীর প্রতিভা পায় মধু পূর্ণিমায় যৌথ

ছায়া পড়ে জলে

দুঃখগুলো উড়ে উড়ে ভিজে যায় স্নিগ্ধ

রোদের ঘ্রাণে

নিরালা পাতার নিচে ওড়াউড়ি করে শিউলির শাদা ভোর।

রঙিন মেঘের উপমায় গোলাপের ছায়া পড়ে মনে

সে কী শুধু স্বপ্ন স্মৃতি ছায়া

কোথাও মেলে না যার ছায়াপথ বাড়ি

শুধু আছে তার অন্বেষণের বিস্মৃত ইতিহাস

হৃৎপিণ্ডে জটিল ভূগোল

কোনও শরৎ প্রভাতে কিংবা সন্ধে, রাতে

কেউ কি ছুঁয়েছে তার হাসি?

‘তোমাকেই শুধু ভালোবাসি’―এই প্রাচীন কথার

শেকড় খুঁজতে জীবন ফুরিয়ে যায়।


আইউব সৈয়দ

কাহ্নপার ইশারা

প্রত্যাশারই শিল্প লাবণ্যে

ফিরে আসে

শিকড় সমেত

পরিবর্তনের আলোকিত পুথি।

হ্যাঁ, বৃত্তের ভিতরেই সিঁড়ি বেয়ে

সোজা নেমে পড়ে।

অভ্যর্থনা জানায় ; তরঙ্গিত

আগামীকালের মুক্তির রোদে !

ঐ পিপাসায় আলাদা করেছি দুই যুগ বর্ষা

সরে গেছে নগ্ন মেঘের চক্রান্ত ।

ক্রমশ, প্রথাগতভাবে জেগে ওঠে ক্ষুধা

হাত নেড়ে ডেকেছি পৌরাণিক পদ্য লেখার ভাঁজকে।

যেখানে পোশাক পরা পয়ার বিশুদ্ধ রঙে উল্কি এঁকে

শব্দের খোঁজে ছুটে চলেছে অসংখ্য জ্যোৎস্নার অঙ্গীকার

সম্পর্কের বংশ তালিকা জোগানে ঘুম ভাঙে, দেখেছি

শুনি নিদ্রাহীন ঋণ।

প্রত্যাশারাই ঠিকই বস্তুবাদী মহলে―

শিল্পিত আভাস নিয়ে ঢুকে পড়ে, মুছে ফেলে উৎকণ্ঠা

অনুকূলের উদ্যোগ কম্পমান যে। শোভিত

উজ্জ্বল সত্যের মতো শ্রমশীল সমধিক পাণ্ডুলিপি

সেই কৃতজ্ঞতা বোধে দৃশ্যের ভিতর

কাহ্নপার

তন্ত্ররূপের উপযুক্ত ইশারা হউক

একুশ শতকে।


গোলাম কিবরিয়া পিনু

হোমো স্যাপিয়েন্স 

প্যাঁচার মতন মুখ করে বলছ―

     প্যাঁচার ছবিটা তোমার হাতে কেন?

প্যাঁচা কি শুধু এক সম্প্রদায়ের গাছে থাকে?

তুমি যে ধর্মের বা সম্প্রদায়ের

             তোমাদের গাছে প্যাঁচা থাকে না?

দোয়েল কি শুধু তোমার ফুলবাগানে থাকে

ওদের ফুলবাগানে থাকে না?

নিরীহ পাখিরা মানুষের মতো

এত শক্তিশালী ও বুদ্ধিমান প্রাণীর ক্যাচাল দেখে―

যেন চেঁচিয়ে বলে―

আমাদের কিচিরমিচির বা গান যা-ই বলো

          তা আর কানে তুলবে না

                  ―শুনবে না!

আমাদেরও তোমরা ঘৃণা করো―বিভাজন করো!

বিভাজনের বাজনা এতটা কানে এসে লাগছে―

শিমুল তুলো উড়ে যেতে ভয় করছে!

       কার উঠানে গিয়ে পড়ে যায়!

কার গাছের শিমুল কার উঠানে গিয়ে পড়ে?

এ নিয়ে দাঙ্গা বাঁধে কি না!

মৌসুমী বায়ুর খামখেয়ালিপনার মতো

    মৌসুমি মানুষের উৎপাত বেড়ে যাচ্ছে বলে

কাণ্ডজ্ঞান লুপ্ত হচ্ছে!

সন্দেহ ও অবিশ^াস বাড়িয়ে মানুষকে বিভক্ত করা হচ্ছে।

বিপরীত ভাবনা থাকবে

             সহনশীলতা থাকবে না?

জাদুকরী মোহন বাঁশিতে শাস্ত্রের নামে

স্বার্থপর উদ্দেশ্যে ছলনা ও প্রতারণায়

শ্রীলংকার ফা-হিয়েন গুহায় থাকা

           শিলীভূত কঙ্কালকেও টেনে এনে রঙ লাগিয়ে

বিভক্ত করা হবে!

গন্ডোয়ানা শিলায় ডাইনোসার অথবা সরীসৃপের

          জীবাশ্ম-চিহ্নকেও বিভক্ত করা হবে?

ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কৌটায়―পুঁতি রাখো, বালা রাখো, মালা রাখো

বোতাম রাখো, পিন রাখো ও খুচরো পয়সা রাখো

             শেষমেষ নিজেকেও রাখছ?

মানুষ আরও কোটরে কোটরে বিভক্ত হয়ে

কূটচালাকিতে কবে যে আকাশটাকেও

                         টুকরো টুকরো করে ফেলে?

এসব দেখে দেখে রাগে-ক্ষোভে ও লজ্জায়

                   ব্রহ্মপুত্র নদও ফিরে যেতে চাইছে

লক্ষ লক্ষ বছর আগের ইয়োসিন কালে

              হিমালয়ের আদি কোটরে!

ব্রহ্মপুত্র আরও বলছে―

কেন যে হিমালয়ের বিশাল টেথিস সাগর থেকে

সিন্ধু ও গঙ্গার সাথে আমি জন্ম নিলাম!

আমি তো হাজার হাজার বছর ধরে বয়ে চলেছি

কখনো কাউকে নিষেধ করিনি

           আমার জলে গোসল করতে!

জানতেও চাইনি তুমি কোন ধর্মের

কোন সম্প্রদায়ের? কোন্ বর্ণের? কোন্ শ্রেণির?

                       কে আর্য? কে অনার্য?

মানুষের সাথে পশু ও পাখিরাও গোসল করে আসছে!

ওরা তো নিঃশ্বাস নেয় বাতাসে

তাহলে তুমি বাতাস ত্যাগ করো!

ওরা তো বিদ্যুৎ ব্যবহার করে

তাহলে তুমি বিদ্যুৎ ত্যাগ করো!

ওরা তো আগুন ব্যবহার করে

তাহলে তুমি আগুন ত্যাগ করো!

অন্য সম্প্রদায়ের গোয়ালার দুধ খাও কেন?

অন্য ধর্মের মানুষের বাগানের আপেল খাও কেন?

অন্য জনের বানানো ওষুধ গ্রহণ করো কেন?

পুতুল বুঝতে পারে না পুরাতত্ত্ব কী?

তার গায়ে সিলমোহর থাকলেও―

   বুঝতে পারে না কবে তৈরি হয়েছে?

তার করোটি নেই―করোটির ভেতর মগজ নেই!

এমন কিছু মানুষ―যারা পুতুলের চেয়ে ভয়াবহভাবে

                  ইন্দ্রীয়হীন-বোধহীন!

তাদেরই খপ্পরে পড়ে―

আবারও আসবে তুষার-প্লাবন ও বরফ যুগ?

নবীন জগৎ দেখতে পারবে না নবীনেরা!

বালিয়াড়িতে পা রেখে পাণ্ডুরোগে আক্রান্ত হয়ে

এক চোখ রোববারে হারিয়ে

            দ্বিতীয় চোখ মঙ্গলবার হারিয়ে

হোমো স্যাপিয়েন্স না হয়ে―

অগ্ন্যুৎপাতের মধ্যে পড়ে যাবে!


মাহমুদ কামাল

আশ্রয়

সবুজ প্রকৃতি খুঁজি

হলুদের বনে…

উদ্দীপিত লোহিত কণিকা

খুঁজে ফিরি কালো আবরণে

একদিন নীল ছিল উদার আকাশ

সোনালি রুপালি ছিল

প্রজাপতি দিন…

এখন সাদার কাছে আশ্রয় নিয়েছি।


জুয়েল মাজহার

গিরিশিখরের দিকে

আমাদের মধ্যে যারা প্রেম চেয়েছিল

গলা খুলে যারা গান গাইতে চেয়েছিল

তারা আজ সর্বরিক্ত পরিত্যক্ত মৃত!

গিরিশিখরের দিকে একদিন তারা আমাকেও

পাকদণ্ডি পথ বেয়ে নুলো পায়ে, বুকে হেঁটে

                           যেতে বলেছিল।

আমি তা করিনি। আমি নিজেকেই

বহুবার খণ্ড করে ভেঙেচুরে দিয়ে

রক্ত আর অহিফেনে বুঁদ হয়ে, ডুবে

রঙহীন গোলাপের ছবি একা আঁকছি ধুলা।


সৈকত হাবিব

আমার অস্তিত্ব

যখন আর জীবিত থাকব না

কোথাও কি থাকবে না এই শরীর ও সত্তা

                              এই ব্রহ্মাণ্ড-ভূগোলে?

কারও স্মৃতির কথা বলছি না―

সে বড় ভঙ্গুর, দ্রুত বিলীয়মান

বলছি না কাগজে কথা ধরে রাখা

           নয় কোনও কাজ কিংবা কীর্তি―

এই যে এখন আমি, সশরীর

যখন হয়ে যাব মৃত ও লুপ্ত, আমি কি কোথাও

                  থাকব আর আমারই সত্তারূপে!

অমরত্বে বিশ্বাস নেই বরং সংশয়ী

পরলোক বলেও কি আদৌ আছে কিছু?

অথচ এই আমি, সজ্ঞান-সক্রিয় আমি

           আমার রক্ত ও হাড়ের শরীর

            আমার ঘুম জাগরণ পথহাঁটা

আমার কাম ঘাম, ঘুমন্ত ও জাগর স্বপ্নরাশি

                  কথা ব্যথা বোধ ও বাসনাÑ

         সে কেন কোথায় মিলিয়ে যাবে শূন্যে!

কাগজ ধরে রাখবে কথা, রেকর্ডে থাকবে কণ্ঠস্বর

চলচ্ছবি দেখাবে হারানো জীবন, ক্যামেরা রাখবে সব স্থিরচিত্র

শিল্পী ও ভাস্কর তুলি আর পাথরে করে তুলবে নিখুঁত জীবন্ত

―এই মুহূর্তেরা কী জীবন্ত অথচ তখন আমি মৃত!

পঞ্চভূতে আমিও হবো ভূত, অদ্ভুত

কবরে হব মাটি কিংবা আগুনে ছাই

যে আমি সশরীর সচল সপ্রাণ

আমাকে কোথায় রাখবে প্রকৃতি

থাকব কোথায় এই সত্তারূপী আমি?

কী জিঘাংসা এই জীবনের

কী প্রচণ্ড ভোগের পিপাসা

কী রক্তাপ্লুত জীবন ও জীবিকা

কী তীব্র প্রেম শরীরে ও হৃদয়ে

          বাৎসল্য কী সুমহান

আর রুগ্ণ ছিন্ন গলিত হয়েও

          কী প্রবল জীবন-বাসনা

হায় এত প্রেম ঘৃণা পূজা ও প্রার্থনা

কিছুই কেন আর তোমায় ফেরাবে না!

সূর্যের মৃত্যু হবে একদিন

এই গ্রহ মিলাবে হাওয়ায়

মানুষ যদিও যাবে দূরতম নক্ষত্রমণ্ডলে

তাতে তোমার কী-ই বা এসে যাবে?

তখন তুমি শুধু মৃত নও, চিরবিস্মৃত নও

কণারূপ অস্তিত্বেও পাবে না কেউ তোমাকে

অনন্ত অন্ধকারের গহ্বরে কীভাবে থাকবে তুমি

যখন শূন্যতায় মিলাবে স্বয়ং এই গ্রহজননী?

এত দুঃখ তোমার, এত আনন্দ

এত বর্ণিল তুমি এত স্বপ্নীল

জীবনকে মহামহার্ঘ্য আর অনিঃশেষ ভেবে

নিজেই লেহন করো নিজের শরীর

প্রতি রোমকূপে জাগাতে চাও জীবনবীজ

আর স্বপ্ন দেখো দিগন্তহীন ব্রহ্মাণ্ডসমান

তবু কোথাও কেন থাকবে না তুমি?

——————-

মিলু শামস

অলড্রিনের স্পেস্যাকেট

এডউইন-ই-অলড্রিনের বয়স এখন বিরানব্বই

সেই যে চাঁদে গিয়েছিল

তিন মার্কিন নভোচারী―

মাইকেল কলিন্স, নীল আর্মস্ট্রং আর এডউইন-ই-অলড্রিন।

চতুর্থ শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে সাদাকালো ছবি

এখনও জ্বলজ্বলে স্মৃতিতে, সঙ্গে সোভিয়েত দেশের

মিস ভ্যালেন্তিনা―

প্রথম নভোচারী মানুষ

তাঁর আগে পৌঁছনো

চতুষ্পদী লাইকা

কী প্রখর জীবন্ত ছিল দূর রাশিয়ার

কুকুর, শিশু কল্পনায়!

সোভিয়েত-মার্কিন তুমুল ঝগড়ার সেই কালে

আমাদের শিশু বয়স, অলড্রিন তরুণ

পৃথিবীও ছিল কম বয়সি আরও

পৃথিবীর দখল কোন্ পক্ষে যাবে

ওয়ারশ নাকি ন্যাটো?

এ দ্বন্দ্বের অবসানে যেতে

অনেক নাটক সাজিয়েছিল রুজভেল্ট, কিসিঞ্জারের দেশ

বিষিয়ে দিয়েছে তিল তিল করে

মানুষের মন, মানবিক সমাজ বিষয়ে

বহুরূপী কারুকাজ, কৌশলী ছলে।

শেষমেষ পৃথিবী গিয়েছে তাদেরই দখলে

মানুষের চেয়ে মুনাফা যাদের প্রিয়

শান্তির চেয়ে সমরাস্ত্র

তারপর থেকে অস্ত্র ও তেলের মধুকুঞ্জ

হয়েছে যমজ শব্দ পৃথিবী পৃষ্ঠের

ইরাক ইরান আফগানিস্তান

যেখানে তেলের ভান্ডার সেখানেই নাটকের ট্রুপ

মগজ ধোলাই আর দুর্দান্ত অভিনয় শেষে

মহা প্রলয়।

এডউইন-ই-অলড্রিন এখন বিরানব্বই

আমাদের মধ্যবয়স

পৃথিবীও প্রাচীন হয়েছে কিছু

গায়ে মেখে নিরীহ মানুষের রক্তের দাগ

আর প্রাচীন সভ্যতার পতাকাবাহী

বিধ্বস্ত দেশের ধূলি।

অলড্রিনের মহাকাশ জ্যাকেট

নিলামে উঠেছে আজ

কি আর এমন দাম, ইসরাইলি অস্ত্রের গুদাম

একবার আড়মোড়া ভাঙে যদি

কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের মধুকুঞ্জে বাজে

সমরাস্ত্রের ধ্বনি, তা হলেই উসুল সহস্রগুণ

প্রচারের ঢাক বেজেছে পৃথিবীময়

ঢাকের তলায় চাপা পড়ে যায়

লাইকা ভ্যালেন্তিনা ইউরি গ্যাগারিন নাম

আর আমাদের বেড়ে ওঠা কাল―

দুই পক্ষের পৃথিবীতে

একটি স্বপ্নের জয়জয়কার

মানুষের হবে ভুবন দেশ রাষ্ট্র ও সমাজ।


হাশিম কিয়াম

আয়না

আমাদের আয়নারা যদি প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকে

প্রতিভোরে আলোর আগায় সেঁটে দিতে পারত

আঁধার ধোয়া আত্মা নবজাতকের

চোখের মতো জ্বলে উঠত; চকচকে আয়নাগুলোয়  

রক্তের ফোটা ফেলি মরিচা ধরে ক্ষয়ে যায়

বিকলাঙ্গ সভ্যতার কামড়-ক্লান্ত

জীবনের আঙিনায় ক্রমবর্ধমান মচ্ছপে আগুন আগুন

খেলায় একসময় তারাও অভ্যস্থ হয়ে যায়…

হু হু করে বেড়ে যায় জীবন-সাগরের

তরল আগুন, তলিয়ে যায় রোদের কাগজে

মোড়ানো সবুজ স্বপ্নের হিমালয়; ভাসতে থাকে

বরফ-প্রজন্ম পাহারা দেয়া টুকরো টুকরো

নীল আকাশের গলিত লাশ…


তিথি বালা

মিথ্যের আস্তিনে

আমার ব্যথার সারথি নিজেই, হারাইনি সুর-তাল

দিগন্তে নীল হয় পাণ্ডুর, এভাবে কাটছে কাল।

কে আছে আমার, সাড়া দাও এসে এই চৈতালি দিনে

আর কত আমি লুকোব আমাকে মিথ্যের আস্তিনে।

দুষ্ট মেঘেরা যতবার চায় চাঁদকে আাড়ালে রাখতে

তার স্নিগ্ধতা তবুও ভুবনে পারেনি যে কেউ ঢাকতে।

আমি চলি আজ জলাধার বেয়ে সঙ্গীরা কাছে নাই

নীরবতা ঠেলে ভাসে কলতান, শুনতে পেয়েছি তাই।

রাত বেয়ে নামে ধুম পাহাড়ের পেলব শরীর ছুঁয়ে

নিবিড় প্রকৃতি স্বাগত জানায় উঁচু মাথা নুয়ে নুয়ে।

অবাক দু-চোখে সকলি দেখছি, আমাকে খুঁজে না পাই

অজানার মাঝে হারিয়ে নিজেকে, ফিরে ফিরে পেতে চাই।

—————-

সচিত্রকরণ : নাজিব তারেক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button