আর্কাইভবিশেষ আয়োজন

প্রাণের স্পন্দনে জেগে ওঠা : নিউ ইয়র্ক বাংলা বইমেলা : শামীম আল আমিন

নিউ ইয়র্ক বাংলা বইমেলা

‘যত বই, তত প্রাণ’। বই যে প্রাণের উৎস হতে পারে এই তথ্য আজ সর্বজনস্বীকৃত। আর ভাষা মানুষের অস্তিত্ব। ফলে দেশ ছেড়ে যত দূরেই যাই না কেন, বাংলা ভাষা আর সংস্কৃতির টানে আমরা ফিরি শেকড়ের কাছে। আর এ কারণেই হয়তো, প্রবাসের প্রধান সাংস্কৃতিক উৎসবটির নাম এখন ‘নিউ ইয়র্ক বাংলা বইমেলা’। ঢাকা ও কলকাতার পর, এটিই বাংলা বইয়ের সবচেয়ে বড় মেলা। কেবল এটুকু বলেই নিউ ইয়র্ক বইমেলার যে মাহাত্ম্য সেটা বোঝানো সম্ভব নয়। এর ব্যাপকতা ও সৌন্দর্য আরও অনেক বেশি।

এবার ৩২তম এই আয়োজনে বাংলাদেশ ছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লেখক, প্রকাশক ও পাঠকেরা এসেছিলেন নিউ ইয়র্কে। এসেছিলেন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও কলকাতা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি ও লন্ডন থেকে। এতে অংশ নিয়েছে ২৫টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ১০টি প্রতিষ্ঠান যোগ দেয়। ১৪ জুলাই শুক্রবার বিকেলে শুরু হয় এই বইমেলা। চলে একটানা চারদিন, যা শেষ হয় ১৭ জুলাই যুব উৎসবের মাধ্যমে। নিউ ইয়র্কের জ্যামাইকা পারফর্মিং আর্টস সেন্টার প্রাঙ্গণ সেজে উঠেছিল বাংলার আবহে। খোলা মাঠে অনেকটা বাংলা একাডেমির আদলে এবারের মেলায় বইয়ের সংখ্যা যেমন ছিল; বিক্রিও ছিল মন রাঙিয়ে দেওয়ার মতো। আর প্রাণে প্রাণে যে সাড়া দেখা গেছে, তা রীতিমতো অভূতপূর্ব।

এবারের বইমেলার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন যুক্তরাজ্যের সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও কথা-সাহিত্যিক শাহাদুজ্জামান। কথাসাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য যিনি ২০১৬ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। এ ছাড়া প্রধান অতিথি ছিলেন ডা. সিতারা বেগম বীরপ্রতীক। সাহস ও ত্যাগের অন্য নাম ডা. সিতারা বেগম। স্বাধীনতা যুদ্ধে আহত ও অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য স্থাপিত ‘বাংলাদেশ হাসপাতাল’ নামে ২ নম্বর সেক্টরের একটি হাসপাতালের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন। বিশেষ অবদানের জন্য তাঁকে দেওয়া হয়েছে বীরপ্রতীক খেতাব। বক্তব্য রাখেন মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ সাহা। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেছেন শামীম আল আমিন ও উর্বি হাই। 

মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের আয়োজনে মেলার প্রথম দিনই পরিণত হয়েছিল লেখক, পাঠক ও প্রকাশকদের মিলনমেলায়। ৩২তম এই আয়োজনকে সামনে রেখে ৩২জন বিশিষ্ট ব্যক্তি প্রদীপ জ্বালিয়ে মেলার কার্যক্রম শুরু করেন। নিউইয়র্ক বাংলা বইমেলার এবারের আহ্বায়ক ড. আব্দুন নূর স্বাগত বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন নিউ ইয়র্কে নিযুক্ত বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল ড. মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম, মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. নুরুন নবী, কলকাতা বইমেলার সভাপতি ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়, ডা. জিয়াউদ্দিন আহমদ, বিশিষ্ট শিশুসাহিত্যিক লুৎফর রহমান রিটন, কবি বিমল গুহ, কবি সুবোধ সরকার ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক আহকামউল্লাহ। এবারের মেলার সার্বিক সমন্বয় করেন মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের সহসভাপতি ও লেখক হাসান ফেরদৌস।

অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, ৩২ বছর পেরিয়ে এসে এই আয়োজন আন্তর্জাতিক বইমেলায় পরিণত হয়েছে। বক্তাদের মধ্য থেকেই প্রস্তাব আসে, এই মেলার নাম হওয়া উচিত ‘নিউ ইয়র্ক বাংলা আন্তর্জাতিক বইমেলা’। 

এ প্রসঙ্গে আলাপকালে মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, মানুষের আস্থা ও ভালোবাসাই আমাদের বইমেলার শক্তি। দিন যত যাচ্ছে, সেই শক্তি ততই বাড়ছে। প্রতি বছর নতুনত্ব আনার চেষ্টা আমাদের আছে। এবার যেমন একটি আন্তর্জাতিক মানের ভেন্যুতে টানা চারদিনের আয়োজন করা হলো। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চার একটি তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে এই বইমেলা। ভবিষ্যতে মেলার পরিসর ও দিনের সংখ্যা আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা আমাদের আছে। এ জন্য বরাবরের মতো সবার সমর্থন ও সহযোগিতা আমরা চাই।

মেলার উদ্বোধনী দিনে সঙ্গীত পরিবেশন করার কথা ছিল উপমহাদেশের খ্যাতিমান শিল্পী পবন দাস বাউলের। ‘যাও আনন্দপুরে’ শিরোনামে অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার জন্য শিল্পী নিউ ইয়র্কেও ছিলেন। জরুরি প্রয়োজনে তাকে যেতে হয় তার আবাস ফ্রান্সের প্যারিসে। তবে মেলার আগের দিন পবন দাস বাউল অংশ নেন গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায়। বইমেলার উদ্যোক্তা, অংশ নেওয়া লেখক, প্রকাশকরাও যোগ দেন এতে। সেখানে পবন দাস বাউল গেয়ে শোনান দুটি গানের অংশ বিশেষ। ‘তোমার দিল কি দয়া হয় না’ এবং ‘তুমি ভক্তি লয়ে যাও আনন্দপুরে’ গান সবাইকে আপ্লুত করে।    

এদিকে শুক্রবার ছিল আনন্দধ্বনির উদ্বোধনী পরিবেশনা ‘তুমি নব নব রূপে এসো প্রাণে’। এই পর্বটি পরিচালনা করেন অর্ঘ্য সারথি শিকদার। নজরুল কবীরের পরিচালনায় এদিন অনুষ্ঠিত হয়েছে ‘পৃথিবী বদলাতে পারে কবিতা’ শীর্ষক একটি অনুষ্ঠান। এতে অংশ নেন লুৎফর রহমান রিটন, আলফ্রেড খোকন, সুবোধ সরকার, কাজল চক্রবর্তী, বিমল গুহ, রোমেন রায়হান, কণা বসু মিশ্র, মইনুদ্দিন মুনশী, ফারুক হোসেন, জাফর আহমেদ রাশেদ এবং শামস আল মমীন।

তরুণ প্রজন্মের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত  ‘জয়ধ্বনি’ সবার প্রাণ জুড়িয়ে দেয়। অংশ নেন ভাষা সাহা, ফাসির কবীর কাব্য, লিয়ানা মানহা, অন্তরা সাহা ড্যান্স ট্রুপ, ঋতুজা ব্যানার্জী, আলভান চৌধুরী, সাগ্নিক মজুমদার, আলী ফাহমিদা ময়ূরী, সুকন্যা শৈলী, আদি পাল, নীলা ড্যান্স একাডেমি। সঞ্চালনায় ছিলেন চন্দ্রিমা দে। হুমায়ূন আহমেদ স্মরণে সঙ্গীত পরিবেশন করেন শিল্পী সেলিম চৌধুরী।

মেলার দ্বিতীয় দিন ১৫ জুলাই শনিবারের কর্মসূচি শুরু হয় বিরুপাক্ষ পালের সঞ্চালনায় বিশেষ অনুষ্ঠান ‘বাঙালি আড্ডা’ দিয়ে। এরপর ছিল মনজুর কাদেরের সঞ্চালনায় ছড়া বিষয়ক অনুষ্ঠান ‘আমরা ছড়াকে ধরা জ্ঞান করি’। এতে ছড়া পাঠ ও আলোচনায় অংশ নেন লুৎফর রহমান রিটন, ফারুক হোসেন, রোমেন রায়হান ও শামস চৌধুরী রুশো।

এবারের বইমেলার অন্যতম একটি দিক ছিল প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনী। দ্বিতীয় দিনে তানভীর মোকাম্মেলের পরিচালনায় মুক্তিযুদ্ধের উপর নির্মিত ছয়টি প্রামাণ্যচিত্র এতে দেখানো হয়। প্রামাণ্যচিত্রগুলোর প্রযোজনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের মেয়ে শারমিন আহমদ। তিনিও যোগ দিয়েছিলেন এবারের মেলায়। এ ছাড়া শামীম আল আমিনের পরিচালনায় কবি নির্মলেন্দু গুণের কবিতা অবলম্বনে নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’ প্রদর্শিত হয়। দেখানো হয় নজরুল কবীরের পরিচালনায় নির্মিত ‘রূপালী ডানায়’। এ সময় আলোচনায় অংশ নেন শারমিন আহমদ, ড. আহমাদ আহসান, ডা. প্রতাপ দাস ও নজরুল কবীর। সঞ্চালনা করেন শামীম আল আমিন।

এরপর  আদনান সৈয়দের পরিচালনায় ছিল ২০২৩ সালের অভিবাসী লেখকদের নতুন বইয়ের পরিচিতি অনুষ্ঠান। এদিন ছিল প্রিন্ট বনাম ডিজিটাল মিডিয়াবিষয়ক একটি সেমিনার। তানভীর রাব্বানীর সঞ্চালনায় এতে অংশ নেন ত্রিদিব কুমার চট্টোপাধ্যায়, আবেদীন কাদের, মুহাম্মদ ফজলুর রহমান ও হাসান ফেরদৌস। ‘অজানা বেগম রোকেয়া’ বিষয়ে একক বক্তব্য রাখেন ড. আশরাফ আহমেদ। ‘বঙ্গবন্ধু থেকে বিশ্ববন্ধু’ বিষয়ে নির্বাচিত কবিতা আবৃত্তি ছিল মেলার অনবদ্য অনুষঙ্গ। আবীর আলমগীরের সঞ্চালনায় এতে অংশ নেন ডা. ফারুক আজম, মুমু আনসারি, জি এইচ আরজু, শুক্লা রায়, পারভীন সুলতানা, গোপন সাহা, নজরুল কবীর, সাবিনা নীরু, তাহরিনা পারভীন প্রীতি ও পাপড়ি বড়ুয়া।

এছাড়া ‘একুশ থেকে একাত্তর’  বিষয়ে আলোচনা অনুষ্ঠানে যোগ দেন শারমিন আহমদ, অধ্যাপক এ বি এম নাসির, অধ্যাপক দেলোয়ার আরিফ। ফাহিম রেজা নূরের সঞ্চালনায় এতে সভাপতিত্ব করেন ড. নুরুন নবী। ‘বাংলা গানের ঐতিহ্য’বিষয়ক অনুষ্ঠানে অংশ নেন মাহমুদ হোসেন দুলু ও সুবর্ণা মজুমদার। তমিজ উদ্দিন লোদীর সঞ্চালনায় ‘সাহিত্য ও রাজনীতি’বিষয়ক অনুষ্ঠানে অংশ নেন সুবোধ সরকার, আনিস আহমদ, লুৎফর রহমান রিটন ও বিরুপাক্ষ পাল।

এরপর বাংলাদেশ একাডেমি অব ফাইন আর্টস-বাফার অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয় নৃত্যালেখ্য ‘আমার জন্মভূমি’। ছিল কবি নজরুলের কবিতা ও গান নিয়ে সাজানো বিশেষ অনুষ্ঠান ‘অঞ্জলি লহ মোর’। এতে সঙ্গীত পরিবেশন করেন বিজয়া সেনগুপ্ত ও লিমন চৌধুরী। আবৃত্তি করেন নজরুল কবীর ও কবীর কিরণ। এই অনুষ্ঠানটির ভূমিকা তুলে ধরেন ডা. জিয়াউদ্দিন আহমেদ। আনন্দধারা আর্টস (লন্ডন)-এর পরিবেশনায় ছিল আলেখ্যানুষ্ঠান ‘পশ্চিমের রবি’। এতে অংশ নেন ইমতিয়াজ আহমদ, উর্বী মধুরা ও পূর্বা অধরা। শিল্পীদের পরিচয় করিয়ে দেন শামসাদ রানা। একই দিন ‘বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখে’ বিষয়ে কবিতা আবৃত্তি করেন আহকাম উল্লাহ।

এরপর ‘সুহৃদ’ নামে একটি অনুষ্ঠানের শুরুতেই জর্জ হ্যারিসনের ‘বাংলাদেশ’ গানটি পরিবেশন করেন দেবযানী বর্ষা। মেহের কবীরের সঞ্চালনায় এই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ও তার জনগণের সমৃদ্ধি ও উন্নয়নে ভূমিকা রাখার জন্য স্মারক সম্মাননায় ভূষিত হন সুবীর চৌধুরী ও নূরজাহান বোস। প্রধান অতিথি হিসেবে সম্মাননায় ভূষিত হন ডা. সিতারা বেগম বীরপ্রতীক, উদ্বোধক হিসেবে সম্মাননায় ভূষিত হন কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামান।

দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠানে ছিল সঙ্গীত পরিষদের পরিবেশনায় ধামাইল গান। লেখক জসিম মল্লিকের সঞ্চালনায় কাবেরী দাস ও সহশিল্পীরা এতে অংশ নেন। দিনের উল্লেখযোগ্য আকর্ষণ ছিলেন দুই বাংলার জনপ্রিয় রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী অনিমা রায়। তার একক সঙ্গীত পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শেষ হয় মেলার দ্বিতীয় দিনের কর্মসূচি।

মেলার তৃতীয় দিনের সূচনা হয় মোশারফ হোসেনের সঞ্চালনায় স্বরচিত কবিতা পাঠ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। সাহিত্য একাডেমির তত্ত্বাবধানে এতে অতিথি কবি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সুবোধ সরকার ও কাজল চক্রবর্তী। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কবি এতে কবিতা পাঠ করেন।

অপরাধ ও শাস্তি: একাত্তরের জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির আন্দোলন―এই বিষয়ে অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন ফাহিম রেজা নূর। অংশ নেন ড. নুরুন নবী, আনিস আহমদ ও ড. ওবায়দুল্লাহ মামুন। হুমায়ুন কবিরের সঞ্চালনায় ডায়াসপোরা সাহিত্যবিষয়ক একটি সেমিনারে অংশ নেন শাহাদুজ্জামান, লুৎফর রহমান রিটন ও নাজমুন নেসা পিয়ারি।

তৃতীয় দিনের আয়োজনে ছিল স্মৃতি ভদ্রর পরিচালনায় নতুন বইয়ের পরিচিতি অনুষ্ঠান। ফকির ইলিয়াসের সঞ্চালনায় একটি আলোচনা অনুষ্ঠান ছিল। এতে অংশ নেন বইমেলায় অংশ নেওয়া প্রকাশক ও বিভিন্ন শহরের বইমেলার সংগঠকরা। রোকেয়া হায়দারের সঞ্চালনায় ‘গানের ছোঁয়ায় কবিতা’ এই শিরোনামে ডিসি বইমেলার পরিবেশনা ছিল এদিন।

অনুবাদকলা বিষয়ক অনুষ্ঠানে অংশ নেন অনন্ত উজ্জ্বল, আনিসুজ জামান ও শাহাব আহমেদ। মৈত্রেয়ী দেবীর একক সঙ্গীত ছিল এদিন। ‘মুক্তিযুদ্ধের চিকিৎসা ইতিহাস’ বিষয়ে এবারের ‘মুক্তধারা ভাষণ’ দেন শাহাদুজ্জামান। তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেন ডা. জিয়াউদ্দিন আহমদ। অনুপ দাস ড্যান্স একাডেমির পরিবেশনায় ছিল ‘হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ, চেতনায় নজরুল’ বিষয়ক বিশেষ অনুষ্ঠান। তৃতীয় দিনে ‘মূলধারায় বাংলা নাটক’ বিষয়ে একটি অনুষ্ঠানে অংশ নেন গার্গী মুখার্জী ও গোলাম সারোয়ার হারুন। নতুন প্রজন্মের লেখকদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন ড. আব্দুন নূর। এ সময় তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেন শিরীন বকুল। এরপর ছিল তানভীর আলম সজীবের পরিবেশনায় একক সঙ্গীত অনুষ্ঠান।

একই দিনে ‘একাত্তর ও সঙ্গীত’ বিষয়ক অনুষ্ঠানে অংশ নেন মিলিয়া আলী ও জাফর বিল্লাহ। মুক্তধারা-জেএফবি সাহিত্য ও চিত্তরঞ্জন সাহা সেরা প্রকাশক পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। এবার মুক্তধারা-জিএফবি সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন কবি আসাদ চৌধুরী। মেলার তৃতীয় দিন রোববার সন্ধ্যায় কবি আসাদ চৌধুরীর পক্ষে ক্রেস্ট ও তিন হাজার ডলার প্রাইজমানি গ্রহণ করেন তার সহধর্মিণী সাহানা চৌধুরী ও কন্যা নুসরাত জাহান চৌধুরী। পুরস্কারটি তুলে দেন জিএফবি গ্রুপের চেয়ারম্যান গোলাম ফারুক ভূঁইয়া। বইমেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা সংস্থা থেকে ‘চিত্তরঞ্জন সাহা শ্রেষ্ঠ প্রকাশনা’ পুরস্কার পেয়েছে নালন্দা ও কথাপ্রকাশ। এই পুরস্কার তুলে দেন সমাজসেবী ডা. জিয়াউদ্দিন আহমদ।

হাসান ফেরদৌসের সঞ্চালনায় বইমেলার লেখকদের মুখোমুখি একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ‘মরমিয়া’ শিরোনামে একক সঙ্গীত পরিবেশন করেন শাহ মাহবুব। এ ছাড়া ‘মাটির পিঞ্জিরা’ শিরোনামে অনুষ্ঠানে গান গেয়ে শোনান সেলিম চৌধুরী।

নিউ ইয়র্ক বাংলা বইমেলার শেষ দিন সোমবার ছিল সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবস। তার উপর নিউ ইয়র্কের আবহাওয়াও বেশ উত্তাপ ছড়িয়েছে। এরপরও নিউ ইয়র্ক বাংলা বইমেলার শেষদিনে, মানুষের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। এদিন শিশু কিশোরদের অংশগ্রহণে ছিল নানা আয়োজন। মেলার শেষ দিনটি মূলত ছিল যুব উৎসব। আমেরিকায় বেড়ে ওঠা বাংলাদেশি আমেরিকান তরুণ- তরুণীদের অংশগ্রহণে সব আয়োজন হয়ে ওঠে প্রাণবন্ত। অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করেন মাটি। তরুণদের মধ্য থেকে কবিতা পাঠ করেন চারুলতা সৈয়দ, তামান্না আহমেদ, শান্তি আহমদ ও প্রমিত মহান আচার্য্য। কবিতা পাঠ ও প্রশ্নোত্তরে অংশ নেন আশনা আলী। ‘মূলধারায় প্রকাশনা: কীভাবে প্রস্তুত হবেন’ এ বিষয়ে কথা বলেন নাদিয়া কিউ আহমদ, নাহিয়ান ইলিয়াস ও ফাবলিহা ইয়াকুব। ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স ও সাইবার সিকিউরিটি’ বিষয়ে কথা বলেন রুহুল আমিন, তাজিন খান নোরেলিয়াস। এ ছাড়া ‘মূলধারায় শিল্পোদ্যোগ’ বিষয়ে কথা বলেন ইশিতা মিলি, অন্তরা সাহা ও নীলা জারিন। ছিল নৃত্য, একক সঙ্গীতসহ আরও নানা আয়োজন। 

বইমেলার আহ্বায়ক ড. আব্দুন নূর বলেন, চারদিন সবাই মিলে একটি পরিবারের মতো ছিলাম। যারা এসেছেন মেলায় বেশির ভাগই পরিবার নিয়েও এসেছিলেন। এ মিলনমেলা ভেঙে যাওয়ায় খারাপ লাগছে। একই সঙ্গে ভালো লাগছে মেলাটি সুন্দর ও সুচারুরূপে সম্পন্ন হয়েছে বলে।

এবারের মেলায় বই বিক্রিতে নিজেদের সন্তুষ্টির কথা জানিয়েছেন প্রকাশকরাও। বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘অনন্যা’র প্রধান মনিরুল হক যোগ দিয়েছিলেন এবারের মেলায়। তিনি বলেন, নিউ ইয়র্ক বাংলা বইমেলা এবার ছিল অনেক বেশি গোছানো। বাইরে খোলা প্রাঙ্গণে বইয়ের স্টল দেওয়ার কারণে প্রবাসেই বাংলা একাডেমির অনুভূতি পেয়েছে সবাই। অনেক নতুন বই এসেছে। মানুষ বই কিনেছেও। 

মূলত যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রধান সাংস্কৃতিক উৎসবের নাম ‘নিউ ইয়র্ক বাংলা বইমেলা’। বাংলাদেশ ও ভারতের কলকাতার পর এটিই সবচেয়ে বড় বাংলা বইয়ের মেলা। গোটা দুনিয়া থেকে বাংলা সাহিত্যপ্রেমীরা জড়ো হন প্রাণের এই উৎসবে। সেই জোয়ারে মিলে মিশে একাকার হয়ে যান প্রবাসীরা। আর নানা কারণে আমাদের কৃতজ্ঞতার কোনও শেষ নেই এই বইমেলার প্রতি। কেননা বাংলা ভাষার বিকাশ ও সাহিত্যচর্চায় এই বইমেলার অবদান অনবদ্য। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে আমাদের অদম্য একটি সাহসের নাম ‘নিউ ইয়র্ক বাংলা বইমেলা’। যার কারণে বাঙালির সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক চর্চা গতি পেয়েছে, এগিয়ে গেছে আমেরিকাজুড়ে। এবার নিউ ইয়র্ক বাংলা বইমেলা পা দিয়েছিল ৩২ বছরে। অবস্থা এমন যে এই বইমেলায় অংশ নিতে না পারলে এখন নিজেকেই শূন্য মনে হয়। এটি এমন একটি ভালোবাসার আঙিনা তৈরি করেছে যে, তার মমতায় সবার স্থান আছে। ফলে নারী পুরুষ শিশু সববয়সী মানুষ ছুটে আসে এখানে। ভালোবাসায় গভীর তৃপ্তিতে তারা নিজেদের খুঁজে ফেরে।

নিউ ইয়র্ক থেকে

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button