আর্কাইভপ্রচ্ছদ রচনা

সুব্রত বড়ুয়ার মধ্যাহ্নের পাখি : প্রথম যৌবনের প্রেম-অপ্রেমের স্মৃতি, বিস্মৃতির আখ্যান : জাকিয়া রহমান

সুব্রত বড়ুয়ার সাহিত্যকর্ম : আলোচনা

লেখক সুব্রত বড়ুয়া ১ জানুয়ারি চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি উপজেলার ছিলনীয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি নিজ গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবনের সূচনা করেন। ১৯৬১ সালে চট্টগ্রামের মিউনিসিপ্যাল মডেল হাই স্কুল থেকে প্রবেশিকা পাস করেন এবং ১৯৬৩ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। তিনি ১৯৬৬ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক এবং ১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। বাংলা একাডেমির অনুবাদ বিভাগে ১৯৭০ সালে যোগদান করেন এবং বাংলা একাডেমির পরিচালক পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি অগ্রণী ব্যাংক শিশু সাহিত্য পুরস্কার (১৩৮৮, ১৩৯১, ১৩৯৪ বঙ্গাব্দ), চট্টগ্রাম বিজ্ঞান পরিষদ স্বর্ণপদক (১৯৯৭) লাভ করেন। এছাড়াও ছোটগল্পে অবদানের জন্য তিনি ১৯৮৩ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। ভাষা ও সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য ২০১৮ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন। বহুমাত্রিক লেখক সুব্রত বড়ুয়া একাধারে লিখেছেন কবিতা, উপন্যাস, কিশোর উপন্যাস, ছোটগল্প, গবেষণা প্রবন্ধ, জীবনীগ্রন্থ, বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ, অনুবাদ এবং সম্পাদনা গ্রন্থ। প্রকাশিত গ্রন্থ তালিকার মধ্যে রয়েছে, কবিতা―হলুদ বিকেলের গান (১৯৮৫), উপন্যাস―গ্রহণের দিন (১৯৮৫), ধলপহর (২০০০), কিশোর উপন্যাস―দিনগুলি হয় সোনার খাঁচায় (১৯৮৮), ছোটগল্প―জোনাকি শহর (১৯৭০), কাচপোকা (১৯৭৫), অনধিকার (১৯৭৭), আত্মচরিত ও অন্যান্য গল্প ১৯৮৯), ভালোবাসা ভালোবাসা (১৯৮৯), তৃণা (১৯৯৩), মধ্যাহ্নের পাখি (২০১৬), প্রবন্ধ-গবেষণা―দোস্তয়েভস্কি (১৯৮৫), মো. আবদুল জব্বার : জীবন ও কর্ম (১৯৯৫), বিজ্ঞানচর্চা: প্রসঙ্গ ও অনুষঙ্গ (১৯৮৭), আমাদের এই বাংলাদেশ (১৯৯০), বাংলাদেশের ইতিহাস: প্রাচীন থেকে পলাশী (১৯৯৪), ইতিহাসের পলাশী (২০০৪), ইতিহাসে; ইতিহাস বাংলাদেশ (২০০৫)। জীবনী―অশোক বড়ুয়া (১৯৯০), শহীদুল্লাহ কায়সার (১৯৮৮), বিজ্ঞান― চাঁদে প্রথম মানুষ (১৯৬৯), বিদ্যুতের কাহিনি (১৯৮৪), বিজ্ঞানের ইতিকথা: সন্ধানী মানুষ (১৯৮৮), সৌরজগত (১৯৮৫), বিজ্ঞান ও মহাশূন্য (১৯৮৯), পরমাণু শক্তি (১৯৮৯), শিশু-কিশোর বিজ্ঞান সমগ্র (২০০১), গ্রিনিচ মানমন্দির (২০০২), অনুবাদ-দি রাইট স্টাফ; কণা, কোয়ান্টাম ও তরঙ্গ (১৯৮৪), আমেরিকার ভৌগোলিক রূপরেখা (১৯৮৬), শঙ্খচিল (১৯৯৪), এমিল ও গোয়েন্দা বাহিনী (১৯৭২), নিশ্চয়তার সমীরণ (২০০৪), সরল পথে চলা (২০০৫), গণিতের রাজ্যে এলিস (২০০৫), সম্পাদনা―অমর একুশের বক্তৃতা (যৌথ, ১৯৮৪), বাংলা একাডেমি ৪০ বছর পূর্তি স্মারকগ্রন্থ (যৌথ, ১৯৯৬), ছোটদের অভিধান (যৌথ, ১৯৮৩), ভাষা সম্পাদক: বাংলা একাডেমি বিজ্ঞান বিশ্বকোষ (৩য় খণ্ড ২০০১ ও ৪র্থ খণ্ড ২০০২)।

সুব্রত বড়ুয়ার মধ্যাহ্নের পাখি গল্পগ্রন্থে ১২টি গল্প স্থান পেয়েছে। প্রতিটি গল্পই ব্যক্তি জীবনের চলমানতায় একটি বিশেষ সময়ের স্মৃতি-বিস্মৃতির আখ্যান হয়ে উঠেছে। সময়ের বিবর্তনে আজ যা বর্তমান কাল তা স্মৃতির নামান্তর। এ স্মৃতি মানুষের অস্তিত্বের অংশ। গল্পগ্রন্থের ফ্ল্যাপে প্রকাশিত তথ্য উপাত্তে লেখক সুব্রত বড়ুয়ার আত্মজিজ্ঞাসা, স্মৃতিকাতরতা, ভাববিহ্বলতার সুস্পষ্ট প্রকাশ ঘটেছে। মধ্যাহ্নের পাখি গল্পগ্রন্থের ফ্ল্যাপে লেখকের মন্তব্য, ‘প্রথম যৌবনের আবেগানুভূতির প্রাবল্য এবং প্রেম ও অপ্রেমের দ্বন্দ্ব এ বইয়ের গল্পগুলোর প্রধান বিষয়।’ মানবজীবনের বিপুল বৈচিত্র্যময় জীবনাভিজ্ঞতার সকল সম্ভারই স্মৃতিরূপে মানসপটে স্থায়ী ছাপ ফেলে না। তেমনি আবার কিছু স্মৃতি বিস্মৃত হয়েও কখনও কখনও বিশেষ সময় বা বিশেষ মুহূর্তে মানবসত্তাকে আন্দোলিত করে ঘুমন্ত সত্তাকে জাগিয়ে তোলে। প্রথম যৌবনে আবেগানুভূতির প্রাবল্যে প্রেম ও কামের সমান্তরাল আকর্ষণে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি ঝোঁক এবং সম্পর্ক শুধুই প্রেমে নয় অপ্রেমেও ঘটে। মধ্যাহ্নের পাখি গল্পগ্রন্থের একাধিক গল্পের কাহিনি পরিক্রমায় সময়ান্তরে তা প্রকৃত অবয়বে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। একটি সম্পর্ক চলাকালীন অপর সম্পর্কে জড়িয়ে যাওয়া; উভয় সম্পর্ককে একসঙ্গে টিকিয়ে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা; একজনের অনুপস্থিতিতে অন্যজনকে সর্বস্ব জ্ঞান করা; দ্বিতীয় সম্পর্কে মনোসংযোগে ব্যাঘাত ঘটায় মুহূর্তে প্রথম সম্পর্কের প্রতি ঘৃণাবোধ সৃষ্টি হওয়া; দ্বিতীয় সম্পর্কের সংস্পর্শে প্রথম সম্পর্কের অস্তিত্বের অনুভব; বেকার প্রেমিককে ত্যাগ করে নিশ্চিত ভবিষ্যতের আশায় অন্যকে বিয়ে করা, স্বামীর সঙ্গে মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব, সময়ান্তরে প্রেমিকের সম্মুখে সংসারী মানুষের সত্যকে মেনে নিয়ে বাস্তবতার বেলাভুমিতে অবতরণ অথবা পুরানো বোঝাপড়াটা মিটিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা, কখনও ফিরে আসা বা ফিরে পাবার আকাক্সক্ষা; কখনও স্মৃতিকাতরতায় বৃথা কালক্ষেপণে শূন্যতা বা অস্পষ্টতা-সবই সম্পৃক্ত চরিত্রের অস্তিত্বের অংশ হয়ে উঠেছে! প্রকৃতপক্ষে একটি জীবনে যা কিছু ঘটমান তার সবই তার অস্তিত্বের অংশ। সময়ের সঙ্গে সম্পর্ক বিলুপ্ত হলেও অস্তিত্বের অংশ বিলুপ্ত হয় না। অস্তিত্বের অংশ বিস্মৃত হলেও অবচেতনে অক্ষত আবেদনে বিরাজমান থাকে। হতেই পারে এ স্মৃতি শুধুই ক্ষণিক সময়ের বা বয়সের আবেগ বিহবলতা অথবা ফ্রয়েডের কাম সর্বোস্বতা। সুব্রত বড়ুয়ার গল্পে নারী ও পুরুষ উভয় চরিত্রের মধ্যেই পাস্পরিক মোহমুগ্ধতা এবং স্মৃতিকাতরতার বিষয়টি প্রধান্য পেয়েছে। সম্পর্কের স্মৃতিচারণ অর্থাৎ একথা সুস্পষ্ট যে গল্পে কোন বিরহী ব্যথাতুরা হৃদয়ের স্মৃতিকথন আলোচিত হয়েছে। গল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে একটি নারী বা পুরুষ চরিত্রের উপস্থিতিতে গল্পগুলো দ্বিপাক্ষিক সময়বেদনার অন্তক্ষরণ হয়ে উঠেছে।

অন্তর্গত বারোটি গল্পের মধ্যে সাতটি (মেঘমেদুর, দৃশ্য ও অদৃশ্য, ছায়াবৃতা, ফেরা, শাদা হাওয়া, পূর্বরাত্রি, মধ্যাহ্নের পাখি) গল্পের প্রেক্ষণবিন্দুতে নারী এবং পাঁচটিতে (প্রতিপক্ষ, কাকতালীয়, ভালোবাসা ভালোবাসা, দুপুরে দারুণ বৃষ্টি, ধূপছায়া) পুরুষ চরিত্রের প্রতিনিধিত্ব লক্ষ্য করা যায়। ঔপনিবেশিক প্রভাবে রবীন্দ্র ছোটগল্পে যে বিচ্ছিন্নতাবাদ বা আমি সত্তার উন্মেষ ঘটেছিল। মধ্যাহ্নের পাখি গল্পগ্রন্থের কথক চরিত্রের আমিও যেন সে বিচ্ছিন্নতাবাদ বা আমি সত্তার উত্তরসূরী। গল্পের শেষাবধি আমি চরিত্রের নামটিও উহ্য থেকেছে। ‘প্রতিপক্ষ’ গল্পের কথক ‘আমি’ একজন একুশ বছরের বেসামাল হৃদয়ের তরুণ। পর্যায়ক্রমে প্রথমে লীলা এবং পরে লীলার ছোটবোন নীলার সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে লীলা এবং নীলার সত্তাকে গুলিয়ে ফেলেছে। লীলার সঙ্গে সম্পর্ক চলাকালীন তার সমস্ত চেতনা জুড়ে লীলার অস্তিত্বের একছত্র আধিপত্য ছিল। লীলা পরীক্ষার আগে ইংরেজি শেখার উদ্দেশ্যে তিন মাস কলেজ হোস্টেলে থাকাকালীন কিছুটা বেপোরোয়া হয়ে উঠেছিল। তখনই সম্পর্কে দূরত্বের সূচনা। লীলার মন্তব্যে ইঙ্গিত পাওয়া যায় হয়ত লীলাও সে সময়ে অন্য একাধিক প্রস্তাব ও সম্পর্কের ঘোরটোপে ব্যস্ত ছিল। একইভাবে লীলার দীর্ঘ অনুপস্থিতি এবং ক্রমশ আচরণিক পরিবর্তন আমি নামক কথক তরুণকে লীলার ছোটবোন নীলার প্রতি আকৃষ্ট করেছে। এ বিষয়ে আমি চরিত্রের চেতনায় ধ্বনিত হয়―‘সচরাচর এই যেমন ঘটে, বিষয়াবলির পুনরাবৃত্তি মানুষকে ক্লান্ত করে, ভালোবাসা ক্লান্ত করে, প্রেম ক্লান্ত করে অপ্রেমও ক্লান্ত করে―লীলা তেমনি আবার চোখের আড়ালে অন্য লীলা হয়ে যায়।’ (পৃ. ১১) লীলার বদলে যাওয়া এবং আমি চরিত্রের নীলার প্রতি আকর্ষণের মূলে কি তবে পুনরাবৃত্তি বা একঘেয়েমি দায়ী ? তবু আমি চরিত্রের মনে প্রথম মানবী লীলার অবস্থান নীলার চেয়ে দৃঢ়। নীলার আগমন নিঃসঙ্গ সময়ের প্রয়োজনে এবং অপ্রেম-তাড়িত কাম সর্বস্বতা থেকে। পারস্পরিক অবিশ্বাস,অভিযোগে লীলার সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েনে কথক ‘আমি’ বলে উঠেছে―‘বিশ্বাস না থাকলে ভালোবাসা থাকে না! অবিশ্বাসের ভালোবাসায় আনন্দ নেই, শুধু কষ্ট! (পৃ. ১১) দেখা যায় ‘আমি’ চরিত্রটি কখনও নীলার উপস্থিতিতে লীলাকে আবার লীলার অনুপস্থিতিতে নীলাকে কামনা করেছে। সময়ের ব্যবধানে লীলা এবং নীলা দুই বোনই পরের ঘরণী এবং চাকরির সুবাদে আমি চরিত্রটি শহর থেকে অনেক দূরে। প্রায় দশ বছরের ব্যবধানেও লীলার মতো কাউকে দেখলেই তার লীলাকে মনে পড়লে ভাবতে থাকে, ‘এই এমনি, এমন সব কথা, সব স্মৃতি মানুষ কেমন করে বুকের মধ্যে পুষে রাখে, কোথায় সব ঠাসাঠাসি করে জমা হয়! তারপর একদিন হঠাৎ ক্যাঙ্গারুর বাচ্চার মতো একটুখানি মুখ বের করে জগত-সংসারকে দেখে। কিংবা এই রকম সবকিছু ধীরে ধীরে ক্লান্ত হওয়ার মতো মুছে যায়। সত্যিই কি যায় ?’ আত্মভাবনায় বিমর্ষ বিষণ্ন লেখকের অনুসন্ধান ও জিজ্ঞাসা যেন পাঠকের ব্যক্তিজীবনেও প্রেম অপ্রেমের ক্ষণিক ঝড় তুলতে সক্ষম হয়ে উঠে।

‘কাকতালীয়’ গল্পের কথক আমি চরিত্রের সঙ্গে কাকতালীয়ভাবে নায়িকা অলকার রেলস্টেশনে দেখা হয়ে যায়। অলকার বিয়ের পরে এটাই তাদের প্রথম দেখা। অলকা তার স্বামীকে এবং নায়ক তার বন্ধুকে ট্রেনে উঠিয়ে দিতে এসেছিল। ভেঙে যাওয়া সম্পর্কের প্রতিনিধি দুজন নর-নারী বা এক্স বয়ফ্রেন্ড, গার্লফ্রেন্ড যদি গার্লফ্রেন্ডের স্বামীসহ আকস্মিকভাবে ট্রেনের একই কম্পার্টমেন্টে মুখোমুখি হয়ে যায়, তাতে উভয়ের অস্বস্তি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। ট্রেন ছেড়ে গেলে অলকাকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চা খাওয়ার উদ্দেশ্যে রিফ্রেশমেন্ট রুমে দুজনে নিরিবিলিতে বসে। এ সময় একাকী নির্জনে অলকা তার প্রেমিকের সঙ্গে অতীতের হিসাব মিলাতে বসেছে। আমি চরিত্রের ভাষায়, ‘অলকা এখন তীব্র প্রগলভা। যেন কথা বলছে না―শব্দ নিয়ে খেলছে।’ (পৃ. ২২) বিচ্ছেদ শেষে অভিমানী অলকা আজ যেন না পাওয়া হাজারো প্রশ্নের জবাব পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। অলকার কণ্ঠের আবেগ, আগ্রহ অভিযোগ, আন্তরিকতার সকল আবেদনকে গ্রাহ্য করে আমি চরিত্রটি তার ভাবমূর্তিতে চা পান শেষে রিফ্রেশমেন্ট রুম থেকে বেরিয়ে আসে। প্রথমে এক্স বয়ফ্রেন্ডের একাধিকবার সিগারেট খাওয়ার বিষয়ে অলকা যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিল তা ছিল অলকার অধিকারবোধের প্রয়োগ। শেষ মুহূর্তে সিগারেট খাওয়া দেখেও অলকা নিশ্চুপ থেকেছে। এ অবস্থায় অধিকার শূন্যতার হতাশা অলকাকে আবেগহীন করেছে।

যদিও অলকার প্রতি আকর্ষণ ও ভালোবাসা আমি চরিত্রের হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত রয়েছে তবু হৃদয়ের আবেগের প্রতি রয়েছে এই চরিত্রের কঠোর নিয়ন্ত্রণ। অলকাকে এক নজর দেখার জন্য ব্যতিব্যস্ত ছিল তার হৃদয়। সে অস্থিরতা প্রসূত গভীর অন্তর্বেদনায় কখনও আমি চরিত্রের মুখে ইঙ্গিতবাহী বিরহব্যথা ধ্বনিত হয়ছে, ‘অলকা সেদিন সে বলেছিল, বেঁচে যাও―সেই বেঁচে যাওয়া খুব একটা সহজ ব্যাপার নয়।’ (১৯) অলকাকে ফিরিয়ে দিয়ে আমি চরিত্রটির বিরহবেদনার ইঙ্গিত রয়েছে বেঁচে যাওয়ার সহজ ব্যাপার নয় কথাটির মধ্যে। তবু এই চরিত্রের শুদ্ধ চেতনা পরস্ত্রীর অন্ধ আবেগের সুযোগে তাকে ভুল পথে ধাবিত করার দিকে ক্রিয়াশীল হয়নি। ‘বাইরে মরা রোদের বিকেলটা ধীরে ধীরে খুব জমে উঠেছে আমরা দুজন পাশাপাশি হাঁটছিলাম।’ (পৃ. ২৩) মরা রোদের বিকেলের মতো অলকা এবং আমি চরিত্রের প্রেম ও সম্পর্কের আবেগবিহ্বলতাও মরে গেছে। পাশাপাশি হাঁটায় মরা রোদের বিকেলের শহরটার মতোই মরা সম্পর্কের মাঝে জমে উঠেছে দুজনের আলাপ।

‘ভালোবাসা ভালোবাসা’ গল্পটি মূলত প্রতারণার গল্প। ভালোবাসার প্রতারণা! কথক আমি চরিত্রটি একটি পুরুষ চরিত্র যে কিনা ছন্দাকে গভীরভাবে ভালোবাসে। ছন্দা প্রেমিকের সঙ্গে প্রতারণা করে বড় শহরে বড় ঘরের ঘরণী হয়েছে। প্রতারিত হয়েও কথক আমি চরিত্রটি দীর্ঘ সময় ধরে ছন্দাকে বুকে লালন করে বিরহ যাতনায় অধীর হয়েছে। এও সত্যি যে শারীরিক সম্পর্কের স্মৃতি, বিস্মৃত হওয়া এত স্বভাবিক নয়। এমনি পরিস্থিতিতে ছন্দার বন্ধু অরুনাকে নিয়ে আমি চরিত্রটি ইংরেজি সিনেমা দেখতে যেয়ে সিনেমা হলের অন্ধকারে আদিম আবেগে পরস্পরকে স্পর্শ করে তারা একটি নতুন সম্পর্কের সূচনা করেছে। শারীরিক বর্ণনায় অরুণা বেশ কালো ও কদাকার। স্বাভাবিক দৃষ্টিকোণে অরুণা সম্পর্কে জড়ানোর মতো আকর্ষণীয় নয় তবু কথক ছন্দাকে কাছে পেতে অরুণাকে প্রশ্রয় দিয়েছে। কেননা অরুণাকে আপন করতে যেয়ে বার বার মানসপটে ছন্দা উঁকি দিয়েছে। অর্থাৎ ছন্দা ভিন্ন অরুণার কোন অস্তিত্ব নেই। ছন্দা যেন অরুণাতে বিলীন হয়েছে। এ পর্যায়ে মনে হয় যেন গোবেচারা অরুণা কথক আমি চরিত্রের মায়াজালে আবদ্ধ হয়ে প্রতি মুহূর্তে প্রতারিত হয়েছে। কথকের ভাষায়, ‘তুমি ছাড়া অন্য কাউকে এই প্রথম এত গভীরভাবে স্পর্শ করলাম এবং ঠিক তখনই তোমাকে মনে পড়ল। তোমার সারা শরীরের উষ্ণতা যেন আমার আপন সত্তায় আবার ফিরে এল।’ (পৃ. ২৯) কথকের দীর্ঘ বিরহ যাতনা মনে ক্ষণিক দার্শনিকচিন্তার জন্ম দিয়েছে। ছন্দার সারা জীবন তার পাশে থাকার অভিব্যক্তি স্মরণ করে তার মনে হয়েছে, ‘আমরা কত স্বপ্ন দেখি কত আকাক্সক্ষার সিঁড়ি তৈরি করি। কিন্তু বাস্তবে তার কতটুকু মূল্য’ ? (পৃ. ৩০) প্রথম যৌবনের আবেগে, প্রেমে, কামে, সম্পর্কে জীবনসঙ্গী নির্বাচনে সফলতা কতটুকু! সে সম্পর্ক প্রসূত রঙিন স্বপ্ন শেষ অবধি কয়জনের টিকে থাকে ? এমনতর জীবন জিজ্ঞাসায় স্মৃতি কাতর নায়ক এক সময়ে যেন ছন্দার অস্তিত্বকে মুছে ফেলে অরুণাকেই কাছে পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। নিজের সৌন্দর্য সম্পর্কে অবগত অরুণা পরিহাসের প্রশ্ন তুললে কথক চরিত্রটি যেন সত্যিই ভালোবাসার চোখে অরুণার সৌন্দর্য অবলোকন করতে থাকে। ছন্দার স্থানে অরুণাকে বসিয়ে জীবনকে মেনে নেওয়ার মধ্যেই জীবনের পরম সত্য ও চরম বাস্তবতা নিহিত। বাস্তবতার নিরিখে কথকের মনে হয়েছে ভালোবাসা একটা কল্পনা মাত্র। সঙ্গবিলাসী নিঃসঙ্গ মানুষের প্রয়োজন ছাড়া কিছু নয়।

‘মেঘমেদুর’ গল্পের কতিপয় চরিত্র নাজ, জিনাত, আবিদ ভাই এবং জামান স্যার কেন্দ্রিক নাজের স্মৃতিচারণার মধ্যদিয়ে কাহিনি শেষ হয়েছে। ছাত্র জীবনের দুষ্টুমিতে প্রেম বা সম্পর্কের প্রতি কৌতূহল ও অধিক আগ্রহ থাকে। এ সময়ে কাউকে ভালো লাগা বা ভালোবাসায় সহপাঠীদের একটা বড় ভূমিকা থাকে। এ গল্পে জিনাত চরিত্রটি নাজের তেমনি একজন বন্ধু। নাজের বান্ধবী জিনাত আবিদ ভাইকে নাজের সঙ্গে জড়িয়ে নানা কথা বলে নাজকে আবিদ ভাইয়ের দিকে উসকে দিত। নাজ প্রথমদিকে বিব্রত হলেও পরে এ খুনসুটি স্বাভাবিক বিষয় হয়ে উঠেছে। আবিদ ভাই নাজের স্কুলের নীনাকে পছন্দ করে। বান্ধবী জিনাতের রসিকতা নাজের মনকে আবিদ ভাই কেন্দ্রিক নানা ভাবকল্পনায় নিমগ্ন করে। অন্যদিকে নাজের ভাবনায় নীনা নাজকে প্রতিযোগী ভাবে। এমনি পরিস্থিতিতে নাজ যেন তাদের শিক্ষক অবিবাহিত তরুণ অধ্যাপক জামান স্যারের মধ্যে মুক্তির আলো খুঁজে পায়। জামান স্যারকে দেখে তার মনে হয়, ‘লোকটা যেন অনন্ত যন্ত্রণাকে ধারণ করতে পারেন অনায়াসে।’ (পৃ. ৩৮) নাজের অনুভূতি গল্পে সুস্পষ্ট নয়। সে গল্পের শুরুতে আবিদ ভাই প্রসঙ্গে পুলকিত হয়ে উঠলেও শেষাংশে অধ্যাপক জামান স্যার যেন তার দৃষ্টিতে মহামানব রূপে ধরা দিয়েছে। নাজের সত্তা যেন এক স্নিগ্ধভাবনায় সদ্য স্নাত হয়ে উঠেছে। মেঘমেদুর গল্পের নামকরণে নাজের অন্তর্ভাবনার মেঘাচ্ছন্নতায় নামকরণটি যথাযথ হয়েছে বলা যায়।

‘দুপুরে দারুণ বৃষ্টি’ গল্পে নীতার সঙ্গে কথক আমি চরিত্রের সম্পর্কের স্মৃতিচারণ করেছেন নায়ক। নীতার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের পাঁচ বছর পরের এক দুপুরে আচমকা ঝুমবৃষ্টিতে অতীত প্রেম স্বপ্নের মতো কোনও এক যাদুকরী শক্তি নিয়ে কথকের চোখে জীবন্ত হয়ে উঠছে। উল্লেখ্য যে মধ্যাহ্নের পাখি গল্পগ্রন্থের প্রায় সবকয়টি গল্পের আখ্যানে ফ্লাসব্যাক পদ্ধতির প্রয়োগ রয়েছে। সঙ্গত কারণে গল্পের আখ্যানে অতীত ও বর্তমান সময় মিলেমিশে একাকার হয়েছে। কথকের প্রথম যৌবনের প্রেমানুভূতির সুখস্মৃতি এই একপশলা ঝুমবৃষ্টিতেই শুধু নয়, হয়তো বাকি জীবনের বৃষ্টিভেজা মুহূর্তেও তার ভাবুক হৃদয়কে আচ্ছন্ন করবে।

‘দৃশ্য ও অদৃশ্য’ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র রোকেয়া। সে বাইশ বছরের যুবক সাজ্জাদকে ভালোবেসে তাকে নিজের করে পাবার জন্য প্রয়োজনে হাজার বছর অপেক্ষা করেতেও রাজি। সাজ্জাদ বাইশ বছরের যুবক হলেও সে জানে রোকেয়াকে কাছে পেতে হলে তাকে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। রোকেয়ার প্রেমের প্রস্তাবের প্রত্যুত্তরে সাজ্জাদ বলেছিল, ‘পথ অনেক দূর। সময় লাগবে অনেক।’ (পৃ. ৫১) সাজ্জাদ ঢাকায় চলে গেলে রোকেয়ার শরীর ও মন জুড়ে রাজত্ব করে প্রথম প্রেমের অনুভূতি। সাজ্জাদের স্পর্শ, আলিঙ্গন, ভালোবাসা সবই রোকেয়ার স্মৃতিতে রোমন্থিত হতে থাকে। সাজ্জাদের স্বপ্নে বিভোর থাকা অবস্থায় ছোট বোন হাস্নার মুখে জানতে পারে পরিবার থেকে তার বিয়ের বিষয়টি প্রায় ঠিক করা হয়েছে। ‘দৃশ্য ও অদৃশ্য’ গল্পের শেষ লাইন, ‘রোকেয়া কিছুই ভাবতে পারছিল না। শুধু পাথরের মতো বসে রইল। কী করবে সে এখন ?’ (পৃ ৫২) রোকেয়ার কিছু ভাবতে না পারা, শুধু পাথরের মতো বসে থাকা এবং সবশেষে কি করবে অর্থাৎ কীভাবে এ বিষম সমস্যা থেকে মুক্তি পাবে সে উপায় অন্বেষণের মধ্যেই সুস্পষ্ট যে, পরিবারের ঠিক করা পাত্রটি সাজ্জাদ নয়। গল্পটিতেও ফ্ল্যাশব্যাক পদ্ধতিতে রোকেয়া চরিত্রের স্মৃতির অনুরণন ঘটেছে।

‘ছায়াবৃতা’ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র সাহানা। আকস্মিকভাবে বিয়ের পাঁচ বছর পরে সাহানার বাড়িতে প্রেমিক শাহজাদ এর আগমন। স্বামী অফিসে থাকায় শাহজাদকে বসতে এবং চা খেতে দিলেও সাহানা এই মুহূর্ত জীবনের চরমবাস্তবতার কাছে বন্দি। পুরানো প্রেমিককে বসতে বলতে পারছে না, কেননা আর মাত্র দুই-তিন ঘণ্টা পরেই স্বামী দুপুরে খাবার খেতে বাড়ি আসবে। শাহজাদকে নিয়ে সংসারে জটিলতার সৃষ্টি হোক সাহানা তা চায় না। বর্তমানে শাহজাদ সাহানার কাছে এক মূর্তিমান আতঙ্ক। তবু কিছুটা কথোপকথন, স্মৃতির আনাগোনা, কিছুটা নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া, উভয়ের আত্মকথনে দীর্ঘ বিরতির পরের দেখাপর্ব অবশেষে শেষ হয়। সাহানার সংকট এবং বাস্তবতা অনুধাবনে শাহজাদ সত্য মেনে সাহানারা বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। শাহজাদ চলে গেলে সাহানা মুহূর্তে অন্য মানুষ হয়ে যায়। সে বাঙালি বিবাহিত নারীর ধর্মপালনে সর্বসত্তা নিয়ে সংসারে ফিরে আসে। স্বামীর দুপুরে খেতে আসার আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। লেখকের ভাষায়, ‘এই হলো মানুষের জীবন। ছোট ছোট টুকরো টুকরো গল্প। সে গল্প প্রতিদিনের কাজকর্মে, জীবনযাপনে কোথায় যেন লুকিয়ে থাকে। হঠাৎ একদিন তাতে নাড়া পড়লে একটুখানি এলোমেলো হয়ে ওঠে মন। কিন্তু সে আর কতক্ষণ!’ (পৃ. ৫৮, ৫৯)।

‘ধূপছায়া’ গল্পের আলো-আঁধারি সময় যেন প্রতিটি মানুষের বিশেষ স্মৃতিকে নাড়া দিয়ে মুহূর্তে আলো আঁধারি জীবনচেতনার সৃষ্টি করে। এই গল্পের নায়ক বা কথক আমি চরিত্রটি রীতুর প্রাইভেট টিউটর। গল্পের তরুণ প্রাইভেট টিউটর এবং সুন্দরী নবযৌবনা ছাত্রীর মন দেওয়া-নেওয়ার বিষয়টি অস্বাভাবিক নয়। প্রায়শই ঘটতে থাকা স্বাভাবিক বিষয়টি শিল্পের ছাঁচে উৎকৃষ্ট গল্প হয়ে উঠেছে। গল্পে লক্ষ্য অর্জনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ পরিণামদর্শী প্রাইভেট টিউটর ছাত্রীর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েও তার প্রেমের আবেদনকে অগ্রাহ্য করেছে। প্রকৃতপক্ষে ব্যক্তিজীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মনোসংযোগে বিঘ্ন ঘটাতে সক্ষম এমন সবকেই চরিত্রটি এড়িয়ে চলতে চেয়েছে। অবশেষে মানব মনের অপার রহস্যের কাছে হার মেনেছে বাস্তবতার কঠিন তপস্যা। অনিচ্ছা সত্ত্বেও টিউটর রীতুর কাছে অনায়াসেই ধরা দিয়েছে। কাহিনি পরিক্রমায় সময়ের ব্যবধানে সম্পর্কের দূরত্বে ফিকে হয়ে এসেছে প্রথম যৌবনের প্রেমাবেগ ও স্মৃতি। এমন পরিস্থিতিতে অকস্মাৎ ডাক্তার রীতুর সঙ্গে কথকের দেখা। যেন আট বছরের পুরোনো সম্পর্ক, পুরোনো আবেগ আবারো কথককে আবিষ্ট করছে। গল্পের প্রথমেই সে ইঙ্গিত রয়েছে, ‘আজ তোমার সঙ্গে দেখা হলো রীতু। তোমাকে দেখার পরই অবসন্ন সত্তার বৃত্তে দাঁড়িয়ে আজ আবার মনে পড়ল―তোমাকে এখনও ভুলতে পারিনি আমি।’ (পৃ. ৬০) এক কন্যা সন্তানের জননী রীতুর বাসা থেকে বেরিয়ে যেন এক অজানা অপ্রত্যাশিত ঘোরের মধ্যে কথক আমি চরিত্রটি এগিয়ে চলেছে। লেখকের ভাষায়, ‘ঠিক তখনই হতচ্ছাড়া শব্দ করতে করতে একটি পুরোনো ট্যাক্সি আমাকে পেরিয়ে গিয়েছিল।’ পুরোনো ট্যাক্সির মতোই যেন পুরোনো স্মৃতিও কথককে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। অবশেষে অটোরিকশার নরম গতিতে হেলান দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যায় ঘরবাড়ি, দোকানপাট মানুষের মুখ। অর্থাৎ রীতুর মুখটাও। সময় ও প্রয়োজন মানুষকে যতটাই আপন করে, বিপরীতে তার উল্টোটাই ঘটে। তবু কিছু স্মৃতি মনে দাগ কেটে যায়। অজানা এক প্রত্যাশা এবং হতাশায় গল্পের আমি চরিত্রের মনে হয়, ‘আবার কি কোনও দিন এই এমনিভাবে একেবারে হঠাৎ করে তোমার সঙ্গে দেখা হবে রীতু ? হয়তো হবে, হয়তো হবে না। একজন মানুষের জীবনে কতকিছুই না ঘটে―সময়ের বুকে তুচ্ছ একটা বুদবুদের মতো।’ (পৃ. ৬৬)।

তিন মাসের ব্যবধানে ফরিদার বাড়ি ফিরে আসার ট্রেনজার্নিতে পাশে বসা কামালের সঙ্গে নিছক আলাপচারিতার স্মৃতি ‘ফেরা’ গল্পের বিষয় হয়ে উঠেছে।

‘শাদা হাওয়া’ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র ইতি ও অতীন। অতীনের সম্পর্ককে ত্যাগ করে ইতি মা, ভাইবোনের কথা ভেবে নিশ্চিত ভবিষ্যতের আশায় পরিবারের পছন্দের পাত্রকে বিয়ের সীদ্ধান্ত নেয়। অতীনের কাছে বিয়ের সীদ্ধান্ত জানালে অতীন তা নীরবে মেনে নিয়েছে। ইতি চেয়েছিল অতীন তাকে সম্পর্কে বেঁধে রাখুক, বিয়েতে বাধা দিক। প্রেমিকের নীরব ভূমিকায় অনেকটা রাগে, দুখে, অভিমানে অথবা পরিবারের মঙ্গলকামনায় অনেকটা নিরুপায় হয়ে বিয়েতে রাজি হয়েছে। ইতির শরীর ও মন অতীনের কাছে বাধা। সঙ্গত কারণেই বিয়ের পরে স্বামীকে আপন ভাবতে অপরাগ হয়েছে। ভালোবাসা এবং সমর্থন ব্যতীত দাম্পত্য সম্পর্ক যে কতটা ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে তা শাদা হাওয়া গল্পে সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। ইতির মনে এই অনাকাক্সিক্ষত সম্পর্ক ও চাপিয়ে দেয়া স্বামীর প্রতি ঘৃণাবোধ এতই প্রবল যে, গল্পে দেখা যায় সে স্বামীকে লোকটি নামে সম্বোধন করেছে। মুহুর্মুহু তার মনে একটি প্রশ্ন ধ্বনিত হয়, ‘ইতি! তুমি কার!’ (পৃ. ৭৯) ইতির মন ও শরীরের ব্যবচ্ছেদে মন অতীনের আর শরীরের অধিকার লাভ করেছে লোকটি। প্রশ্ন থাকে যে অতীনকে ইতি এতটা ভালোবেসেছে, অতীনের ভালোবাসাও কী এত প্রবল ছিল ? নাকি অতীন সৌভাগ্যে জোড়েই সে ভালোবাসা অর্জন করেছিল ? ভালোবাসা সম্পর্কিত প্রশ্নে অতীনের প্রত্যুত্তর, ‘ইতি! সত্যি কথা বলব ? ভালোবাসাটা আসলে কি তা আমি এখনও বুঝি না। এই যে বারবার তোমার কাছে আসি, তোমার সঙ্গে সময় কাটে, কখনও কখনও অনেকদিন তোমাকে না দেখলে মনে ভীষণ অস্থির হয়ে ওঠি। তবু মনে হয় আমি তোমাকে ঠিক বুঝতে পারি না।’ (পৃ. ৭৮) অতীনের কাছে ইতির বিশেষত্ব কি শুধুই একজন নারী ? হয়তো অতীনের কাছে যেকোনও নারী ইতি হয়ে উঠতে পারে! সঙ্গত কারণে ইতির বিয়েতে অতীনের কোনও আপত্তি ছিল না। এমনকি গল্পের শেষাবধি অতীনের পরিণতির বা বিরহ বেদনার আর কোন বর্ণনা পাওয়া যায় না।

‘পূর্বরাত্রি’ গল্পে নীপুর মেজপার বিয়ের আয়োজন চলাকালীন নীপুর মনস্তাত্ত্বিক টানাপড়েন গল্পের বিষয় হয়ে উঠেছে। পূর্বরাত্রি বলতে এখানে বিয়ের আয়োজন, বিয়ে সম্পন্ন হওয়া এবং বাসর রাতকে নির্দেশ করা হয়েছে। এ সময়ের সাময়িক উত্তেজনা, মানসিক অস্থিরতা, নিত্য নতুন সাজপোশাক, বাড়িঘর সাজানোসহ আসবাবপত্রের বিন্যাসে আকর্ষণীয় করে তোলার যে প্রয়াস তা রাতশেষে বাসি সাজপোশাকে পরিণত হয়। কাজ শেষে রঙিন কাগজের আচ্ছাদন অনাবৃত হয়ে পড়ে থাকে খটখটে কাঠের পাঁজর। গল্পের শেষাংশের এমনতর বর্ণনার মাধ্যমে রূপকের মাধ্যমে লেখক যেন জীবনের দার্শনিক চিরসত্যকে উপস্থাপন করেছেন। শুধু চাকরি নেই বলে নীপুর জামানের সঙ্গে দীর্ঘ সম্পর্কের অবসান ঘটিয়ে অন্য কাউকে বিয়ের জন্য মনোনীত করেছে। যদিও জামানকে প্রেমের চিঠিতে একসময়ে সে অবলীলায় লিখেছিল, ‘জামান, আমার সমস্ত ভালোমন্দ নিয়ে আমি চিরদিন তোমার কাছে থাকব।’ (পৃ. ৮৫) মেজোপার ভণ্ডামি নীপু মেনে নিতে পারছে না বলেই তার মানসপটে তীব্র সংকট সৃষ্টি হয়েছে। মেজপা, জুঁই, রীতা এদের সবার চালচলন পর্যবেক্ষণে ভালোবাসা হীনতা ও বিশ্বাসঘাতকতায় নীপু মনোযন্ত্রণায় নেহাল ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বিড়বিড় করে বলেছে, ‘আমরা সব মেজপা নেহাল। আমাদের তুমি কখনও বিশ্বাস করো না।’ (পৃ. ৮৫) নীপু সদ্য স্কার্ট ছেড়ে শাড়ি পড়েছে অর্থাৎ নিপুর শাড়ি পড়ার মধ্যেই সে তার বাৎসল্য কাটিয়ে পরিণত নিপু হওয়ার পথে এগিয়ে চলেছে। হয়তো জীবনের ভুল, কদর্যতা, পঙ্কিলতা, কলুষতা তার মানচেতনাকে তখনও গ্রাস করে নি। নীতুর চেতনার শুদ্ধতা এবং পারিপার্শ্বিক অশুচিতার দ্বন্দই যেন এ চরিত্রের মাধ্যমে আলোচিত গল্পের কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে উঠেছে।

সুব্রত বড়ুয়ার মধ্যাহ্নের পাখি গল্পগ্রন্থের নাম গল্প এবং বারটি গল্পের শেষগল্প ‘মধ্যাহ্নের পাখি’। এ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র নন্দিতা এবং শাদা হাওয়া গল্পের ইতি চরিত্রের দ্বন্দ্ব ও হাহাকার যেন একই পথে ধাবিত হয়েছে। ইতি ও নন্দিতা যেন একে অপরের পরিপূরক। তারা দুজনেই প্রেমিকের উদাসীনতায় হতাশা ও অভিমানে অন্যজনকে বিয়ে করলেও তাকে স্বামী হিসেবে মেনে নিতে পারেনি। ইতি স্বামীর পরিচয় উপস্থাপনে ‘লোকটা’ বলে সম্বোধন করেছে। অন্যদিকে নন্দিতা স্বামীকে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেছে ‘স্বামী ভদ্রলোক’ নামে। প্রেমিক সুমিত্রের বিশ্বাস যা তার প্রাপ্য তা সে পাবেই। প্রেমিকা নন্দিতার বিয়ে ঠিক হয়ে গেলেও সুমিত্র তার বিশ্বাস ধরে রাখে। নন্দিতাকে নিজের করে বেঁধে রাখার প্রচেষ্টায় সে নীরব ভূমিকা পালন করেছে। যা একজন নারীর কাছে অপমান, অবহেলা এবং প্রেমিকের প্রতি অধিকার হীনতাবোধের সামিল। সুমিত্রকে ভুলতে না পারার ব্যর্থতা নন্দিতার দাম্পত্য জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। এমনি এক পরিস্থিতিতে সুমিত্রের সঙ্গে অকস্মাৎ দেখা হলে নন্দিতা অতীত প্রসঙ্গে বোঝাপড়ার উদ্দশ্যে বলেছে, ‘তোমার একি নিদারুণ খেলা। তুমি যা চাও হাত বাড়িয়ে তা নিতে পারো না কখনও। তুমি স্থির বিশ্বাস নিয়ে বসে আছ―তোমার যদি সত্যি কারের পাওয়ার মত কিছু হয়, তাহলে সে তোমার কাছেই ফিরে আসবে। এমন পুরুষের কাছে কে আর স্বেচ্ছায় ছুটে এসে পায়ে মাথা কুঁটে মরবে! আমি সেদিন ফিরে এসেছিলাম। (পৃ. ৯১) জীবনে অসময়ের বোঝাপড়া কোন কাজে আসে না। নন্দিতার জীবনের রেলগাড়ি জুড়ে যায় স্বামী ভদ্রলোকের সঙ্গে। সুমিত্রের সঙ্গে দেখা হওয়ার পরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে মধ্যাহ্নের পাখি কাক দেখতে দেখতে সে স্মৃতির অতলে ডুবেছে। প্রকৃতপক্ষে সে স্বামীর সঙ্গে সাগরপারের দেশে যাচ্ছে। সেখানে মধ্যাহ্নের পাখি বা কাক দেখা যাবে না! কাক এই গল্পে প্রতীকি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কাক মূলত নন্দিতার চেনা পরিবেশ, প্রেমিক সুমিত্রের প্রতিনিধি। সুমিত্রকে মধ্যাহ্নের পাখির প্রতীকে দীর্ঘশ্বাসে নন্দিতা বার বার তা দেখার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছে।

প্রথম যৌবনের ক্ষণিক ভালো লাগা বা গভীর ভালোবাসার সম্পর্ক যা ওই সময়ের আবেগে মহামূল্যবান বা অপরিবর্তনীয় সত্যরূপে প্রতীয়মান হয়ে উঠে। মানুষ যেন ভবিষ্যৎদ্রষ্টা জ্ঞানে স্মৃতিরবাহক সঙ্গীর প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে ওঠে। ওই সময়ের আবেগের প্রাবল্য সময়ের ব্যবধানে নিজের কাছেই অবাঞ্ছিত, হাস্যকর, শূন্যের চেয়েও মহাশূন্য বলে মনে হয়। তবু কৈশোর পেরিয়ে যৌবনের প্রথম ভালো লাগা, প্রথম স্পর্শ, মনোদৈহিক টানাপড়েন অর্থাৎ ক্ষণিক ঘটে যাওয়া প্রেমস্মৃতি আজীবন স্মৃতির আতর হয়ে সুবাস ছড়ায়। প্রায় প্রতিটি গল্পে প্রেমিক প্রেমিকা দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে আকস্মিকভাবে পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। মুহূর্তে ছাইচাপা আগুনে বাতাস লেগে ঝলসে উঠেছে পুরনো স্মৃতি। মধ্যাহ্নের পাখি গল্পগ্রন্থের গল্পগুলোতে এ সময়ের ব্যবধান এক বছর থেকে সর্বোচ্চ দশ বছর পর্যন্ত দেখানো হয়েছে। দশ বছর পরেও যে স্মৃতি সত্তাকে আচ্ছন্ন করে তা নিছক স্মৃতিমাত্র নয়। এর অবস্থান অস্তিত্বের অন্তর্গভীরে। গল্পে নিরুপায় স্মৃতিকাতর মনের হাহাকার আস্ফালনে নিমজ্জিত সত্তার বাস্তবতা অনুধাবনের মধ্যদিয়ে কাহিনির পরিসমাপ্তি ঘটেছে। বিষয় সংশ্লিষ্ট যথাযথ নামকরণ এবং গল্পের কাহিনি জীবনঘনিষ্ঠ হওয়ায় গল্পগুলো প্রাণবন্ত ও জীবন্ত হয়ে উঠেছে।

মধ্যাহ্নের পাখি গল্পগ্রন্থের প্রতিটি গল্পই স্বতন্ত্রভাবে অসাধারণ জীবনসত্য নিয়ে ক্ষণিক স্মৃতির আখ্যান হয়ে উঠেছে। তবে বারোটি গল্পের বিষয়ভাবনার পুনরাবৃত্তি পাঠক মনে একঘেয়েমি সুর তুলতেও পারে। সুব্রত বড়ুয়ায় এই গল্পগ্রন্থের প্রথম গল্প ‘প্রতিপক্ষ’তে তিনি বলেছেন, ‘সচরাচর এই যেমন ঘটে, বিষয়াবলির পুনরাবৃত্তি মানুষকে ক্লান্ত করে, ভালোবাসা ক্লান্ত করে, প্রেম ক্লান্ত করে, অপ্রেমও ক্লান্ত করে’… : (পৃ. ১১) একইভাবে একটি গল্পগ্রন্থের গল্পগুলোর বিষয়ভাবনার পুনরাবৃত্তি পাঠকের চেতনায় ক্লান্তির ছায়া ফেললে তাও অস্বাভাবিক বিষয় হয়ে উঠবে না। এও সত্য যে সৃষ্ট একঘেয়েমি লেখক স্বেচ্ছায় সৃষ্টি করেছেন। কেননা লেখকের অভিপ্রায় প্রথম যৌবনের আবেগ-অনুভূতির প্রাবল্য এবং প্রেম ও প্রেমের দ্বন্দ্ব নথিভুক্ত করা। লেখক একজন পুরুষ হওয়ায় বারোটি গল্পের প্রেক্ষণবিন্দুতে যে পুরুষ চরিত্র রয়েছে সে চরিত্রের দায় যেন তিনি নিজেই গ্রহণ করেছেন। সঙ্গত কারণে পুরুষ চরিত্রের নাম উহ্য রেখে ‘আমি’ নামেই তাকে উপস্থাপন করেছেন। যা দৃষ্টিগ্রাহ্য বিষয় হয়ে ধরা দেয়। কেননা নারীর বিরহ যাতনার স্মৃতিচারণায় উত্তম পুরুষে বা আমি নামটি ব্যবহার না করে তিনি নারী চরিত্রকে বিভিন্ন নামে উপস্থাপন করেছেন। গল্পগুলোর বিষয়ের পুনরাবৃত্তিকে উহ্য রেখে গল্পের বর্ণনা কৌশল, চিত্রকল্প, উপমা, রূপকের প্রয়োগ তথা ভাষা প্রয়োগের বলিষ্ঠতায়, ফ্লাশব্যাক পদ্ধতিতে জীবনের খণ্ডস্মৃতি উপস্থাপনে লেখক সুব্রত বড়ুয়া দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন। নিঃসন্দেহে গল্পগুলো অনবদ্য গল্প হয়ে উঠেছে।

লেখক : প্রভাষক, বাংলা বিভাগ, এমফিল গবেষক, প্রাবন্ধিক ও সাহিত্যবিশ্লেষক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button