আর্কাইভপ্রচ্ছদ রচনা

কাছের কবি দূরের কবি বেলাল চৌধুরী : ইয়াসমিন মাসহুদা

প্রচ্ছদ রচনা : সৃজন-আলোয় কীর্তিমান পাঁচ সাহিত্যিক

আধুনিক বাংলা কবিতায় এক বিস্ময় কবি বেলাল চৌধুরী। তাঁর রচনা বহুবৈশিষ্ট্যমণ্ডিত, বিষয়বৈচিত্র্যে অনন্য। বিচিত্র কর্মময় জীবনের অধিকারী এই গুণী শিল্পী একাধারে কবি, সাংবাদিক, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক ও সম্পাদক হিসেবে খ্যাতিমান। জ্ঞান, প্রজ্ঞা, হৃদয়ের উদারতা আর সুমধুর মিশুকে স্বভাব দিয়ে তিনি জয় করে নিয়েছেন প্রথিতযশা এবং নিতান্ত সাধারণের মন। কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে ছিল তাঁর আত্মিক সম্পর্ক। কেবল বাংলা সাহিত্য অঙ্গন নয়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও ছিল তাঁর ব্যাপক জানাশোনা। শৈশব থেকেই বইয়ের সঙ্গে কবি বেলাল চৌধুরীর মিতালি। সে সময় কুমিল্লা শহরের বেশ কিছু পাঠাগার তাঁর মনের দুয়ার খুলে দেয়। বসন্ত স্মৃতি পাঠাগার, অমূল্য পাঠাগার, জাগরণী সংঘ, জামতল্লার পড়ার ঘর―এইসব পাঠাগারের প্রত্যেকটি থেকে একটি করে বই নিয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতেন, রাতে পাঠ্য বইয়ের নিচে লুকিয়ে সেগুলো পড়তেন। এর মধ্যে নীহাররঞ্জনের কীরিটি সিরিজও ছিল।

বেলাল চৌধুরীর জন্ম ১৯৩৮ সালের ১২ নভেম্বর ফেনীর শর্শদি গ্রামে। ১৯৫৬ সালে কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। স্কুলে পড়াকালীন তাঁকে বাউণ্ডুলেপনার পেয়ে বসে। বোহেমিয়ান মনের সঙ্গে ছিল তাঁর নিত্য বোঝাপড়া। চিন্তায় ও কর্মে তিনি চালিত হয়েছেন বিশ্ববোধের মনোভঙ্গি নিয়ে। মৌলিক রচনার পাশাপাশি বিশ্বসাহিত্যের অঙ্গনের খ্যাতিমান কবিদের কবিতা অনুবাদে প্রয়াসী ছিলেন। বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু অ্যালেন গিন্সবার্গের সঙ্গে ছিল তাঁর দারুণ সখ্য। নোবেল জয়ী ঔপন্যাসিক গুন্টার গ্রাস এবং আরেক নোবেলজয়ী গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ ছিলেন পরম বন্ধু।

শ্রেণির ঊর্ধ্বে সব কাতারের মানুষের মর্যাদায় আস্থাবান ছিলেন কবি বেলাল চৌধুরী। ছিলেন সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। মানুষের কাছে প্রাণের মানুষ হয়ে ওঠার ঈর্ষণীয় ক্ষমতা ছিল তাঁর। বন্ধু-অন্তপ্রাণ ও মজলিশি মেজাজের অধিকারী কবি বেলাল চৌধুরী অবলীলায় মিশে যেতেন তরুণ কবিদের সঙ্গে। তাঁর জীবনের বিশাল অংশজুড়ে ছিল আড্ডা। জার্নিম্যান বুকস থেকে প্রকাশিত প্রাণের পত্রাবলী তারই স্বাক্ষর বহন করে। এটি কবিকে লেখা দুই বাংলার কবি-লেখকদের পত্রগুচ্ছের সংকলন।

এই সংকলনের একেকটি চিঠি যেন এক-একটি অবয়ব, এক-একটি ইতিহাস। কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এক চিঠিতে কবিবন্ধু বেলাল চৌধুরীকে আমন্ত্রণ জানিয়ে লেখেন, ‘তোমার আরেকটি আমন্ত্রণ কলকাতার। জুলাই মাসে কৃত্তিবাস-এর পঞ্চাশ বছর উপলক্ষ্যে তিন দিনের একটা উৎসব ও হইচই করা হবে বলে ঠিক হয়েছে। তোমার উপস্থিতি ছাড়া সেটা জমবে কী করে?’ অন্যদিকে কবি শামসুর রাহমানের পত্র কষ্টের সুতোয় বোনা। তিনি লেখেন, ‘আপনার কর্মস্থলে নিশ্চয়ই আগের মতো আড্ডা জমে নিয়মিত। আমি এখন খুবই নিঃসঙ্গ, আপনাদের সঙ্গসুখ থেকে বঞ্চিত। এটা নিয়ে হা-পিত্যেস করি না; তবে আপনাদের নৈকট্য আমাকে আনন্দ দেয়, জানবেন।’

সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক এবং প্রগতিশীল রাজনৈতিক আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন কবি বেলাল চৌধুরী। চুয়ান্নোর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টির হয়ে কাজ করছিলেন। এ সময় তিনি গ্রেপ্তার হন। কিন্তু কারাগারের বন্দি জীবন তাঁকে সন্ধান দেয় নতুন পথের। এখানে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় কারাবন্দি খ্যাতিমান লেখক, বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক কর্মীদের সঙ্গে। এঁদের সান্নিধ্য তাঁর মনোজগতে বহুমাত্রিক প্রভাব বিস্তার করে। কারাজীবনে দেশি-বিদেশি সাহিত্য পড়েছেন। কারামুক্ত হয়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায় আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা পড়ে মুগ্ধ বেলাল কলকাতায় যাওয়া স্থির করেছিলেন হয়তো!

ষাটের দশকের শুরুতে তরুণ কবি কলকাতায় পাড়ি জমান। কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে যৌথভাবে কৃত্তিবাস পত্রিকা সম্পাদনা করেন। পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে সম্পাদনা করেছেন পল্লিবার্তা, সচিত্র সন্ধানী, ভারত বিচিত্রা। দীর্ঘ সময় পশ্চিমবঙ্গে বসবাসের কারণে সেখানকার কবি, সাহিত্যিকদের সম্পর্কে তাঁর অগাধ জ্ঞান ছিল।

বেলাল চৌধুরী রচিত উল্লেখযোগ্য গদ্য গ্রন্থ : নিরুদ্দেশ হাওয়ায় হাওয়ায় (২০১০), সাত সাগরের ফেনায় ফেনায় মিশে (২০১১), জীবনের আশ্চর্য ফাল্গুন, শামসুর রাহমান : রূপালি আঙুলের ঝর্নাধারা ইত্যাদি তাঁর কবিতাগ্রন্থের মতোই শিল্পসফল ও সাহিত্য-অবদান চিহ্নিত।

উল্লেখযোগ্য কবিতাগ্রন্থ : নিষাদ প্রদেশে (১৯৬৪), বেলাল চৌধুরীর কবিতা (১৯৬৮), আত্মপ্রতিকৃতি স্থির জীবন ও নিসর্গ (১৯৭৫), স্বপ্নবন্দী (১৯৭৯),  সেলাই করা ছায়া (১৯৮০), জলবিষুবের পূর্ণিমা (১৯৮৫), প্রতিনায়কের স্বগতোক্তি (১৯৮৬), কবিতার কমল বনে (১৯৯২), যাবজ্জীবন সশ্রম উল্লাসে (১৯৯৭), বত্রিশ নম্বর (১৯৯৭), মুক্তিযুদ্ধের কবিতা (২০১১)।

অন্যান্য রচনার মধ্যে রয়েছে প্রবন্ধ-গবেষণা : কাগজে কলমে (১৯৯৭), স্ফুলিঙ্গ থেকে দাবানল (২০০১), একুশের ভাবনা (২০১১); ভ্রমণ কাহিনি : সূর্যকরোজ্জল বনভূমি (১৯৬৪); শিশুসাহিত্য : সপ্তরত্নের কাণ্ডকারখানা (উপন্যাস ১৯৮০), সবুজ ভাষার ছড়া (ছড়া ১৯৭১), বত্রিশ দাঁত (১৯৮১), সাড়ে বত্রিশ ভাজা; সম্পাদিত গ্রন্থ : বিশ্ব নাগরিক গ্যেটে, জলের ভেতরে চাঁদ ও অন্যান্য গল্প, লঙ্গরখানা, পদাবলী কবিতা সংকলন। এছাড়া তিনি অনুবাদ করেছেন গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের মৃত্যুর কড়ানাড়া।

বেলাল চৌধুরী সাংবাদিকতা করেছেন বাংলাদেশ টুডে পত্রিকায়। সম্পাদনায়ও কবি ছিলেন সমর্পিত মন। দীর্ঘদিন সম্পাদনা করেছেন ঢাকাস্থ ভারতীয় দূতাবাসের পত্রিকা ভারত বিচিত্রা। এছাড়া সাপ্তাহিক সন্দ্বীপ ও সচিত্র সন্ধানী সম্পাদনা করেন। সাহিত্যপত্রিকা সম্পাদনার ক্ষেত্রে তিনি কুশলী কারিগর। সাপ্তাহিক পত্রিকার আকৃতি, বিষয়বস্তু, ছবি, ভাষাশৈলী, প্রচ্ছদ ও অঙ্গসজ্জা সম্পর্কে তিনি ছিলেন অনেক বেশি ওয়াকেবহাল। তাঁর সম্পাদিত সচিত্র সন্ধানীর প্রথম দিককার সংখ্যাগুলো সম্পাদক হিসেবে তাঁর কুশলতা-চিহ্নিত হয়ে আছে। সচিত্র সন্ধানী লেখার উঁচুমান, সম্পাদনার আধুনিকত্ব, প্রচ্ছদ ও অঙ্গসজ্জার নিপুণ কারুকৃতির জন্য ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা পায়।

কলকাতায় বেলাল চৌধুরীর বোহেমিয়ান জীবনের নানা দিক সম্পর্কে জানা যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অর্ধেক জীবন, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতিকথা, ও কলকাতার আরও আরও লেখকদের স্মৃতিচারণা থেকে। নিরুদ্দেশ হাওয়ায় হাওয়ায় (২০১০) নামে বেলাল চৌধুরীর আত্মস্মৃতি-র কথাও এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়। তাঁর কবিতা ও গদ্য রচনায় আত্মস্মৃতির অনেক তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়।

বিশিষ্ট ও বিখ্যাত লেখকদের সঙ্গে বেলাল চৌধুরীর পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। সেসব স্মৃতি স্থান পেয়েছে তাঁর সাত সাগরের ফেনায় ফেনায় মিশে (২০১১) গ্রন্থে।

ঢাকায় পঞ্চাশের দশকে বাংলাদেশের কবিতার মূল স্রোতে মিশে যাওয়া, পরে কলকাতায় ভবঘুরে জীবনে সেখানকার সাহিত্যজগতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংযোগ, তারপর স্বাধীন বাংলাদেশে ঢাকায় পত্রিকা সম্পাদক হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতায় চালচিত্র ফুটে উঠেছে তাঁর স্মৃতিকথায়।

পিতার কর্মসূত্রে রেলস্টেশনে ও রেলওয়ে স্টাফ কোয়ার্টারে কেটেছে ছোটবেলা। এই পর্ব কেটেছে চট্টগ্রাম, লাকসাম ও ফেনীর মাঝামাঝি কোনও জায়গায় এবং কুমিল্লায়। মেইল ট্রেন, লোকাল ট্রেন, আপ ট্রেন, ডাউন ট্রেনের হুইসেল শুনে শুনে চলত তাঁর জীবনের রুটিন।

ঢাকা পর্বে কবির ভবঘুরে জীবনের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো বিউটি বোর্ডিং কেন্দ্রিক আড্ডা। সে আড্ডাতেই শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, সৈয়দ শামসুল হক ও অন্যান্য বন্ধুদের সঙ্গে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা।

চুয়ান্নের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক কারণে এক বছরের জন্যে তাঁকে কারাগারে থাকতে হয়। সেই স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন তখনকার বহু ত্যাগী কমিউনিস্ট রাজবন্দির নাম। সেই সঙ্গে পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করেছেন শেখ মুজিবুর রহমানের স্নেহস্পর্শে ধন্য হওয়ার ঘটনা।

ষাটের দশকের সূচনায় শুরু হয়েছে তাঁর জীবনের কলকাতা পর্ব। পরিচয়, চতুরঙ্গ, কবিতা ইত্যাদি পত্রিকা পাঠের সূত্রে যেসব লেখক ও কবির লেখার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন―কলকাতায় ক্রমে তাঁদের সঙ্গে পরিচয় নিবিড় হলো। কমলকুমার মজুমদার, সাগরময় ঘোষ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মতো সাহিত্যিকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হলেন। কলকাতায় তিনি বেশির ভাগই লেখেন কবিতা। অনুবাদ করেন কিছু গল্প। সেই সঙ্গে দৈনিক পত্রিকায় জন্য ফিচার লেখেন। সম্পাদনা করেন কৃত্তিবাস পত্রিকার কয়েকটি সংখ্যা।

বেলাল চৌধুরীর কবিতায় আবেগের সঙ্গে ঘটে রাজনৈতিক ভাববস্তুর মেলবন্ধন। কবিতা ছিল বেলাল চৌধুরীর আমৃত্যু সঙ্গী। লেখার মধ্য দিয়ে তিনি কখনও মানব মনের গোপন চোরা কুঠুরিতে বিচরণ করেন, কখনও স্বদেশচিন্তা আর সমাজভাবনা তাঁর রচনার অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে। আমাদের চারপাশের চিরচেনা অলিগলি, অপরূপ প্রকৃতি তাঁকে ভীষণভাবে আবেগে আপ্লুত করে। আবার কখনও হাহাকার আর বেদনার অনুভবে ভারাক্রান্ত হয় হৃদয়। কখনও ফিরে যান শৈশবে। একটি নীল জামার জন্যে তাঁর হৃদয় ব্যাকুল হয়। যে জামাটি তাঁর দুরন্তপনার সঙ্গী : ‘রোদে পোড়া, ঘামে ভেজা হাওয়ায় ওড়া/ যেন অস্থির এক প্রজাপতির রঙিন প্রগলভতা/নীল পাহাড়ের নিরুদ্দেশে মেঘের রেশম স্বাধীনতা।’ (বাল্যকালের গন্ধমাখা নীল জামাটি : জল বিষুবের পূর্ণিমা)। এ যেন লুপ্ত অতীতের প্রতি বেদনা আর স্মৃতিমেদুর পথে পরিভ্রমণ।

বেলাল চৌধুরী তাঁর কবিতায় প্রচুর উপমার প্রয়োগ ঘটিয়েছেন যা পাঠককে চমৎকৃত করে। তিনি বলেন : ‘জটিল অরণ্যে তুমিই একমান বিটপী/ শালের মত অটল, সেগুনের মত, নমনীয় ও কোমল/ঝাউয়ের মত তোমার মর্মরিত মাধুর্যের দিকে/ কাঠুরেও হাতলে আলতো হাত রেখে দাঁড়ায় ফিরে/ বৃষ্টি তবু তুমি, তোমার উড়ন্ত উজ্জ্বল সবুজ চুল/ দূরের বাতিঘরের মতই করে প্রলোভিত/ ‘তুমি সেই বৃক্ষ’/ অথবা ‘মানুষ তো ডাহুক নয় অথচ ডাহুকের (বেদনার ভেতরে মানুষ ডুবে যেতে পারে) ডুব দেয় চিরকাল’ (‘মানুষের ডাহুকী ভাবনা’) বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ কবির অন্যতম প্রেরণা বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম ও বঙ্গবন্ধু। তিনি লেখেন :

‘বাংলাদেশ ও বাঙালির গৌরবগাথা দেখতে হলে/ যেতে হবে বত্রিশ নম্বর/ বাঙালি ও বাংলাদেশের স্থাপত্য ইতিহাস জানতে হলে পাতা উল্টে দেখতে হবে বত্রিশ নম্বর/ বাংলাদেশ ও বাঙালির কলঙ্ক চিহ্ন দেখতেও যেতে হবে বত্রিশ নম্বর/ বত্রিশ বলতে একটি সড়ক মাত্র নয়, নয় খালি একটি প্রতীকী সংখ্যা/ শুধু একটি সংখ্যাবাচকেই সীমাবদ্ধ নয় এ বাড়ি।’ (‘বত্রিশ নম্বর’ : বত্রিশ নম্বর)

তাঁর সকল কবিতাই জীবনবোধে উদ্বুদ্ধ, সুখপাঠ্য। কলকাতাতে কবির সাহিত্যপ্রতিভার বিকাশ শুরু হয়। ১৯৭৪-এ কলকাতা থেকে ফিরে আসেন। বাংলাদেশে প্রগতিশীল রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। জাতীয় কবিতা পরিষদ ও পদাবলি কবিতা সংগঠনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তিনি। স্বনামের পাশাপাশি বল্লাল সেন, ময়ূরবাহন, সবুক্তগীন ইত্যাদি ছদ্মনামেও লেখালেখি করেছেন।

বেলাল চৌধুরী গল্পও লিখেছেন। ১৯৬৩ সালে সচিত্র সন্ধানীতে ছাপা হয় গল্প ‘অপরা‎হ্ণ’। এই গল্পে কার্তিকের এক ঘোরলাগা অপরাহ্ণের বর্ণনায় তিনি লেখেন, ‘ইদানীং লতাগুল্প, উদ্ভিদ, তৃণদাম, গাছপালা, পত্রপল্লব, পুষ্পিত কানন, শীতল জল, শৈবাল―এসবের গন্ধ কী নির্মম আর অসহ্য মনে হয়।’ এই গল্পটি বোদ্ধা পাঠককে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করেছিল। অনেকে তাঁর মধ্যে কমল মজুমদারের ছায়া দেখতে পান সে সময়।

১৯৮৪ সালে অর্জন করেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার। এছাড়া ১৯৯৭ সালে আলক্ত সাহিত্য পুরস্কার; ২০১৪ সালে একুশে পদক পান। ১৯৯২ সালে নীহাররঞ্জন পুুরস্কারে ভূষিত হন তিনি।

২০১৭ সালের আগস্টে কিডনিজনিত সমস্যায় হাসপাতালে ভর্তি হন। ২০১৮ সালে শারীরিক অবস্থায় অবনতি ঘটলে তাঁকে লাইফ সাপোর্ট নেওয়া হয়। ২৪ এপ্রিল বেলা ১২টায় আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

বিখ্যাত ইংরেজ কবি টি.এস. এলিয়টের কবিতা ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’-এর প্রথম পঙ্ক্তি ছিল ‘এপ্রিল ইজ দ্য ক্রুয়েলেস্ট মানথ’―এই লাইনটি গভীরভাবে দাগ কেটেছিল কবি বেলাল চৌধুরীর মনে। কেননা ২০১৪ সালের ১৭ এপ্রিল মারা যান তাঁর অন্যতম প্রিয় ঔপন্যাসিক, নোবেলজয়ী গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ। পরের বছর ২০১৫ সালের ১৬ এপ্রিল নোবেলজয়ী ঔপন্যাসিক বন্ধু গুন্টার গ্রাস প্রয়াত হন। এপ্রিলে প্রিয় দুই সাহিত্যিকের মৃত্যু কবির মনে কষ্টের দাগ গভীর করে তোলে। আর এপ্রিলেই কবি বেলাল চৌধুরীর প্রস্থান অবচেতনে যেন মনে করিয়ে দেয় সত্যিই―এপ্রিল একটি নিষ্ঠুরতম মাস।

 লেখক : প্রাবন্ধিক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button