আর্কাইভগল্প

কাঁথামামা, শীতবুড়ি এবং একটি মৃত্যু : আখতার হুসেন

আবার পড়ি : আখতার হুসেনের কিশোরগল্প

শহরের দোকানপাটগুলো আজ কদিন ধরেই সকাল সকাল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আজও যখন এমনটি হলো, পথঘাটগুলো প্রায় জনশূন্য হয়ে এল, দু-একটা নেড়ি কুকুরের ডাকও যখন দূর থেকে শুনতে পাওয়া গেল না, ঠিক তখনকার ঘটনা এটা। হ্যাঁ, ঠিক তখনকারই।

ছেলেটা কাঁদতে পারছিল না। আস্তে আস্তে তার সারা শরীর হিম হয়ে আসতে লাগল। থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বেশ কষ্টে সে তার গায়ে জড়ানো ছেঁড়া ছোট্ট কাঁথাটার গায়ে হাত রাখল, ‘আমাকে আরও ওম দাও, কাঁথামামা, আরও…।’

কাঁথামামা ছেলেটার মুখের দিকে চেয়ে চাপা স্বরে উত্তর করল, ‘আমি আমার সাধ্যমতো তোমার জন্যে করে যাচ্ছি। সাধ্যের বাইরে আর কী করা যেতে পারে, বলো ?’

‘মা কোথায় গেছে, মা ?’ ছেলেটা কাশতে লাগল। ‘তোমাকে কিছু বলে যায়নি ? মা আসছে না কেন ?’

‘মার জন্যে চিন্তা কোরো না। এক্ষুনি এসে পড়বে। কাগজপত্তর আর আগুন জোগাড় করতে দেরি হচ্ছে হয়তো।’

‘কিন্তু আমি যে আর শীত সইতে পারছিনে। কথা বলতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। কাঁথামামা, শীতবুড়িকে তুমি একটু জিজ্ঞেস করো না, সে আমাকে অত কষ্ট দিচ্ছে কেন ? আমাদের অবস্থার কথা তাকে একটু বুঝিয়ে বলো, সে নিশ্চয়ই বুঝতে পারবে,’ টেনে টেনে কোনওমতে তার কথাগুলো শেষ করল ছোট্ট ছেলেটা।

কাঁথামামা ছেলেটার কথার কোনও জবাব না দিয়ে চুপ করে রইল। ভাবতে লাগল, কতই বা বয়স ছেলেটার ? ও কী বুঝবে দুষ্টু শীতবুড়ির আচার-আচরণের ? আর বেয়াড়া শীতবুড়িকে সে কী করে বোঝাবে যে পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষ এখনও উলঙ্গ আর আকাশের ছাউনির নিচে থাকে। তার কি উচিত, ওদের সঙ্গে এ রকমের ব্যবহার করা ?

কাঁথামামা এসব যখন ভাবছিল, ঠিক তখুনি শীতবুড়ি হি হি করে হিম-নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে তাদের কাছে এসে দাঁড়াল এবং ছেলেটার গায়ে হিম-হিম হাতটা রেখে দাঁত বের করে হাসতে লাগল, ‘আমাকে ভয় করছে বুঝি! যত ভয় করবে, ততই কাছে আসব। বুঝেছ, কারও কষ্ট-কান্নায় আমি ভুলিনে।’

কাঁথামামা শীতবুড়ির কথায় বেশ ভয় পেয়ে গেল। তার সারা শরীর ভয়ে কাঁপতে লাগল, ‘শীতবুড়ি, তুমি অমন করে আর হিম-নিঃশ্বাস ফেলো না। আমার অবস্থা তো তুমি দেখতেই পাচ্ছ, ঝুরঝুরে থুত্থুরে আমার শরীর। এতটুকু ওম দিতে পারছি নে ছেলেটাকে। তুমি যদি দয়া না করো, তবে কী করে সে বাঁচবে ? জবাব দাও শীতবুড়ি, জবাব দাও।’

কাঁথামামার চোখে জল এল। বুকটা ধুকধুক করে কাঁপতে লাগল, ‘আহা, যাদের গায়ে কিছুই নেই, তাদের কত কষ্টই না হবে এই শীতে! শীতবুড়ি, তোমার পায়ে পড়ি, তুমি দেশ ছেড়ে চলে যাও!’

কাঁথামামার কথা শুনে শীতবুড়ি আরও জোরে জোরে হাসতে লাগল। সে হাসির শব্দে ছেলেটা চমকে উঠল। কথা বলার শক্তি আস্তে আস্তে হারিয়ে ফেলছে সে। তবু খুব কষ্টে উচ্চারণ করল, ‘কাঁথামামা, আমি কেন কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলছি ? মা এখনও ফিরে আসছে না কেন ? শীতবুড়িকে তুমি কিছু বলেছ ?’

‘হ্যাঁ, বলেছি’, কাঁথামামা জবাব দিল। ‘কিন্তু সে আমার কথা কানে তুলতে চাইছে না। মার জন্যে তুমি চিন্তা কোরো না। সারা রাত আগুন পোহানোর জন্যে হয়তো বেশি বেশি করে কাগজপত্তর জোগাড় করছে। তুমি ঘুমোও, কেমন।’

ছেলেটা তারপর ঘুমাবার চেষ্টা করতে লাগল কিন্তু ঘুম কী করে আসবে ? চোখ বন্ধ করে রাখলেই তো আর ঘুমানো যায় না ? ঘুমের জন্যে চাই পরিমাণমতো উষ্ণতা। ছেলেটা শেষবারের মতো তার ঝিমিয়ে পড়া শক্তির ওপর ভর করে কোনওমতে ঠোঁট দুটো ফাঁক করল, ‘কাঁথামামা, কাঁথামামা, আমার বুকের ওপর থেকে, আমার গলার ওপর থেকে শীতবুড়ির হাতটা সরিয়ে দাও। আমি যে আর কথা বলতে পারছিনে।’

কাঁথামামা ছেলেটার কথাগুলো শুনল। তারপর লড়তে লাগল শীতবুড়ির সঙ্গে। কিন্তু লড়াইয়ে সে খুব সহজেই হেরে গেল। আর হেরে যাওয়ার দুঃখে কাঁথামামা কাঁদতে শুরু করল। চোখের পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল অঝোরে। আর তাই দেখে শীতবুড়ি খিলখিল করে হেসে উঠল, ‘হারবে না তো কী! অমন ঝুরঝুরে শরীর নিয়ে কি আমার সঙ্গে লড়াইয়ে জেতা যায় ? তোমার আদরের ছেলেটার গায়ে এবার হাত দিয়ে দেখো তো, বাছাধন কথা বলতে পারে কি না ? হুম, আমার সঙ্গে লড়াইয়ে জিতবে!’

শীতবুড়ির কথায় কাঁথামামা চমকে উঠল। চমকে উঠল ঘরের ওপর বাজ পড়ার শব্দে মানুষ যেমন চমকে ওঠে, তেমনি করে। ছেলেটার গায়ে সে হাত রাখল। শরীর ধরে বারবার ঝাঁকাল, কিন্তু ছেলেটার টুঁমাত্র সাড়াশব্দ নেই। হিম বরফ টুকরো হয়ে গেছে। ক্ষোভে-দুঃখে কাঁথামামা থরথর করে কাঁপতে লাগল, কাঁদতে লাগল। আর ঠিক তখুনি এক কোঁচা ছেঁড়া কাগজপত্রের টুকরো, একটা ভাঙা ম্যাচের খোল এবং কয়েকটা কাঠি নিয়ে ছেলেটার মা সেখানে এসে দাঁড়াল। সে এসেই কোঁচড় থেকে কাগজ-পত্তরগুলো নামিয়ে ঝুঁকে পড়ে তার ছেলেটার গায়ে হাত রাখল। তারপর ছেঁড়া কাঁথাটার দিকে ঝাপসা দৃষ্টিতে তাকিয়ে এক অব্যক্ত যন্ত্রণায় মাথার চুলগুলো মুঠি করে ধরে কাঁদতে লাগল। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ কাঁদার পর সে কিছুটা শান্ত হলো এবং ভাবল, কী হবে কেঁদে ? কান্নায় তো আর শীতবুড়ির মন গলবে না। এর আগেও শীতবুড়ি তার হিম হাত দিয়ে গলা টিপে মেরেছে তার দু-দুটো ছেলেমেয়েকে। শীতবুড়িকে হাজার বুঝিয়েও সে তার হিংস্রতা থামাতে পারেনি। কী হবে কেঁদে ? কেঁদে আর কোনও লাভ নেই। মনে মনে মা সান্ত্বনা পেতে চাইল। চোখের পানি মুছল।

ভাবনা শেষে মা ছেঁড়া কাগজ-পত্তরগুলো জড়ো করে আগুন জ্বালল। কেননা, তখনও শীতবুড়ির ঠাণ্ডা হিম-নিঃশ্বাস তার গায়ে ঘন ঘন এসে আছড়ে পড়ছিল। মা বুঝতে পারল, শীতবুড়ি তার ধারকাছ থেকে এখনও সরে যায়নি। তাই আগুন জ্বালতেই শীতবুড়ি ভয় পেয়ে গেল কিন্তু সে ভাবল, ‘কতক্ষণই-বা ও আগুন জ্বালিয়ে রাখবে। অল্প কয়েকটা কাগজের টুকরো মাত্র। তারপর যাবে কোথায় ? ওকেও আমি দেখে নেব!’

আগুন জ্বলছিল, আর সে আগুন থেকে ওম নিচ্ছিল মা। কিন্তু রাত যতই বাড়তে লাগল, শীতবুড়ির হিম-নিঃশ্বাস ততই তার গায়ে এসে তিরের ফলার মতো বিঁধতে লাগল। মা থরথরিয়ে কাঁপছিল। আগুনটা তাকে ততটা ওম দিতে পারছিল না, যতটা তার এই মুহূর্তে প্রয়োজন। আর কী দুর্ভাগ্য, কিছুক্ষণের মধ্যেই কাগজগুলো জ্বলে শেষ হয়ে গেল। আবার আগুন জ্বালবার মতো আর এক টুকরো কাগজও নেই। মা দুর্ভাবনায় পড়ল। শরীরটা তার হিম থেকে আরও হিম হতে লাগল। দুপা হেঁটে গিয়ে যে দুটো কাগজের টুকরো কুড়িয়ে আনবে, সে শক্তিও তার নেই। হঠাৎ করেই মার ছেঁড়া-ঝুলো কাঁথাটার কথা মনে হলো। সে ভাবল, ওটাকে এখন গায়ে জড়ালে কেমন হয় ? কিন্তু না, ওটা তাকে মোটেও ওম দিতে পারবে না। তাহলে কী করবে সে ? মা ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেল। তার কথা বলার শক্তি আস্তে আস্তে কমে আসছে। কাশতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। ‘না, আর পারা যাচ্ছে না। আগুন জ্বালতেই হবে এবং এক্ষুনি,’ মা ভাবল। তারপর মৃত ছেলেটার শরীরের ওপর থেকে ছেঁড়া কাঁথাটা তুলে নিল।

কাঁথামামা কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। হঠাৎ হিম কার হাতের ছোঁয়ায় জেগে উঠল। চোখ মেলে দেখল, মা তার গায়ে হাত রেখেছে। সে ভাবল, মা হয়তো তার নিজের গায়ে তাকে জড়িয়ে নেবে। কিন্তু কী হবে জড়িয়ে ? শীতবুড়ির এই অসহ হিম-নিঃশ্বাসের ছোবল থেকে মাকে সে কিছুতেই বাঁচাতে পারবে না। বাঁচানোর মতো এতটুকু শক্তি তার নেই। মার জন্যে তার মনে ভীষণ কষ্ট হলো; কিন্তু মুখ ফুটে কিছুই বলতে পারল না।

মা ততক্ষণে কাঁথাটাকে হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরেছে। কিন্তু দেরি আর সহ্য হচ্ছে না। দম ফেলতে তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। তাড়াতাড়ি করে কাঁথাটা ফুটপাতের ওপর রাখল এবং ম্যাচ থেকে কাঠি বের করল। কিন্তু কাঠি জ্বালতে গিয়ে তার হাতটা থরথর করে কেঁপে উঠল। কত পুরোনো এই কাঁথাটা! কত স্মৃতি ওর সঙ্গে জড়ানো। মা বুকের মাঝখানটায় একটা তীব্র জ্বালা অনুভব করল। ঠোঁটটা কেঁপে উঠল থরথর করে। চোখ ভেঙে পানি পড়তে লাগল অঝোরে। আর সেই অবস্থাতেই মা ম্যাচের কাঠির আগুন জ্বালিয়ে দিল সেই ছেঁড়া-ঝুলো পুরোনো কাঁথাটার গায়ে।

আর কাঁথামামা আগুনে জ্বলতে জ্বলতে ভাবতে লাগল, ‘এটাই সবচেয়ে ভালো হলো। আমার মনে আর এতটুকু দুঃখ নেই। দুঃখ নেই, আমি আমার বুড়ো বয়সেও কারও কাজে লাগতে পারছি বলে। কেউ যদি এখন আমাকে জিজ্ঞ্যেস করে, আগুনে জ্বলতে তোমার কেমন লাগছে ? আমি জবাব দেব, এত ভালো লাগছে যে, বর্ণনা করতে গেলে হাজার বছর লাগবে। আমার চেয়ে সুখী পৃথিবীতে আর কেউ নেই! কেউ নেই! কেউ নেই!’

সচিত্রকরণ : ধ্রুব এষ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button