আর্কাইভভাষা গবেষণা

ভাষা-গবেষণা ধারাবাহিক : শব্দবিন্দু আনন্দসিন্ধু : মানবর্দ্ধন পাল

অষ্টম পর্ব

[প্রাচীন ভারতীয় আলংকারিকেরা শব্দকে ‘ব্রহ্ম’ জ্ঞান করেছেন―শব্দ যেন ঈশ্বরতুল্য। পাশ্চাত্যের মালার্মেসহ নন্দনতাত্ত্বিক কাব্য-সমালোচকদেরও বিশ্বাস, শব্দই কবিতা। যা-ই হোক, শব্দের মাহাত্ম্য বহুবর্ণিল ও বহুমাত্রিক। বাংলা ভাষার বৃহদায়তন অভিধানগুলোর পাতায় দৃষ্টি দিলেই তা প্রতিভাত হয়। আগুনের যেমন আছে অসংখ্য গুণ তেমনই ভাষার প্রায় প্রতিটি শব্দেরও আছে অজস্র অর্থের সম্ভার। কালস্রোতে ও জীবনের প্রয়োজনে জীবন্ত ভাষায় আসে নতুন শব্দ, তা বিবর্তিতও হয়। পুরানো শব্দ অচল মুদ্রার মতো ব্যবহার-অযোগ্য হয়ে মণি-কাঞ্চনরূপে ঠাঁই নেয় অভিধানের সিন্দুকে।

বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডার সমুদ্রসম―মধুসূদনের ভাষায় : ‘ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন’। বৈঠকি মেজাজে, সরস আড্ডার ভঙ্গিতে লেখা, এই ‘শব্দবিন্দু আনন্দসিন্ধু’। ব্যক্তিক ও নৈর্ব্যক্তিক―সবকিছু মিলিয়ে শব্দের ভেতর ও বাইরের সৌন্দর্য-সৌগন্ধ এবং অন্তর্গত আনন্দধারার ছিটেফোঁটা ভাষিকরূপ এই ‘শব্দবিন্দু আনন্দসিন্ধু’ ধারাবাহিক।]

আড়

সর্বত মঙ্গল রাধে বিনোদিনী রাই

বৃন্দাবনের বংশীধারী ঠাকুর কানাই।

একলা রাধে জল আনিতে যমুনাতে যায়

পেছন থেকে কৃষ্ণ তখন আড়ে আড়ে চায়। (বৈষ্ণব পদাবলি)

‘আড়’ শব্দটি চোখে পড়লেই আড়বাঁশির কথা মনে পড়ে যায়। আর আড়বাঁশির কথা মনে হলেই মনে পড়ে ‘নন্দের নন্দন নবঘনশ্যাম’-এর কথা―যার সর্বজনশ্রুত নাম শ্রীকৃষ্ণ। এই কৃষ্ণকে তো কেউ বাস্তবে দেখেনি, সবাই পড়ে-শুনে জেনেছে। কাশীরাম দাসের মহাভারত, বড়ুচণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, মধ্যযুগের গীতিকবিতা, চৈতন্যচরিতামৃত ইত্যাদি পড়ে জানা হয়েছে বৃন্দাবন-মথুরার গোপিনী-বিলাসী শ্রীকৃষ্ণকে। এই কৃষ্ণ বংশীধারী, মুরলীবাদক―আড়বাঁশি বাজিয়ে বিমুগ্ধ করে রাধিকাসহ ষোলোশ গোপিনীর মন।

প্রাচীনকাল থেকে বাংলার ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীত-সংস্কৃতিতে বাঁশিই সম্ভবত প্রথম বায়ুবাহী বাদ্যযন্ত্র। অন্য যেকোনও বাদ্যযন্ত্রের চেয়ে লোকায়ত জীবনে বাঁশির ব্যবহার ও জনপ্রিয়তা বিপুল। বালক রাখাল, কৃষক ছেলে, যুবক মাঝি―সবারই বিনোদন ও অবসরের সঙ্গী বাঁশি। উদাস-করা দুপুর, ক্লান্ত বিকেল, ঝোপঝাড়ের ছায়ায়, সাঁঝ-ঘনায়িত গোধূলিতে এখনও গ্রামবাংলায় করুণ বাঁশির সুর শোনা যায়। তাই লোকগানে আছে, ‘ওই শোন কদম্ব তলে বংশী বাজায় কে!’ এই সুর যেন বিরহী আত্মার ক্রন্দন। এ যেন শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রাধিকার বিরহবিলাপ―‘কে না বাঁশী বাএ বড়াই কালিনী নৈ কূলে/ কে না বাঁশী বায়ে বড়াই এ গোঠ গোকুলে।/ আকুল শরীর মোর ব্যাকুল মন/ বাঁশীর শবদে মোর আউলাইল রান্ধন।’ রবীন্দ্রবাণীতে আমাদের জাতীয় সঙ্গীতেও পাই : ‘চিরদিন তোমার আকাশ তোমার বাতাস আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি।’ এই বাঁশি প্রতীকী চেতনার হলেও বড়ুচণ্ডীদাস ও রবীন্দ্রনাথ আড়বাঁশির সুমধুর সুরকেই বুঝিয়েছেন। এই মোহনীয় আড়বাঁশিকে আন্তর্জাতিক মর্যাদায় মহিমান্বিত করেছেন ভারতের খ্যাতিমান বংশীবাদক হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়া।

সরু নলবাঁশের দুপাশের গিট বাদে মাঝের অংশে আট/দশটি ছিদ্র করে আড়বাঁশি তৈরি করা হয়। এটি বায়ুনির্ভর বাদ্যযন্ত্র। ভূমির সমতল অবস্থায় আড়ভাবে ধরে ছিদ্রপথে নিচের ঠোঁট লাগিয়ে ফুঁ দিয়ে বাজানো হয় বলে এটিকে আড়বাঁশি বলে। বিভিন্ন অভিধান ঘেঁটে লক্ষ্য করা যায়, অর্থে ও ভাবপ্রকাশের ভিন্নতায় ‘আড়’ শব্দটির ছয়টি ভুক্তি আছে।

★ আড় = বাঁকা বা তীর্যক, অর্ধ।

★ আড় = প্রস্থ ও চওড়া, জড়তা, আড়ষ্টতা।

★ আড় = আড়াল, অন্তরাল, আবডাল।

★ আড় = বক্র, কুটিল, কটাক্ষ।

★ আড় = হাঁড়ি, বাসনপত্র, কাপড়চোপড় রাখার তাক। পাখি বসার দণ্ড।

★ আড় = এক প্রকার মাছ, আইড়।

অর্থভিন্নতার ভিত্তিতে প্রায় সকল ভুক্তির ভেতরই আছে সূক্ষ্ম পার্থক্যের ভাবপ্রকাশক অনেক শব্দ ও শব্দবন্ধ। সেকাল ও সমকালের কৃতী কবি ও লেখকদের রচনা থেকে কয়েকটি উদাহরণ বিচয়ন করে আমরা সেই সূক্ষ্ম অর্থপার্থক্য ও ভাববৈচিত্র্য উপস্থাপন করতে পারি। ‘আড়’ শব্দটি তদ্ভব। ভাষাবিজ্ঞানীরা মনে করেন, অর্থভেদে তিনটি সংস্কৃত শব্দ থেকে ‘আড়’ এসেছে। এর বুৎপত্তি―অন্তরাল > আড়াল > আড়া > আড়, অর্ধ > অড্ঢ > আঢ > আড় এবং আটি > আডি > আইড় > আড়। আড়া এবং আড় শব্দ হিন্দি ও তুর্কি ভাষায়ও পাওয়া যায়। অসমিয়া ভাষায় আড়কে বলে ‘আঁর’। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় ‘আঁর’ মানে আমার।

* চাহিল রাধা কাহ্নক আড় নয়নে। (বাঁকা চোখে, বড়ুচণ্ডীদাস, ১৪৫০)।

* নান্দের নান্দন কাহ্ন আড়বাঁশী বাএ। (শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, ১৪৫০)।

* না করে আঁখির আড় নিজ পতিজন। (আড়াল, বিদ্যাপতি, ১৪৬০)।

* আড়কুলি কত কৈল আত্তারি আত্তারি। (অন্য কথা, মালাধর বসু, ১৫০০)।

* সমুদ্রের আড়ে আইল। (বাঁধ, কৃষ্ণদাস, ১৫৮০)।

* উকটিয়া ঝোপঝাড় নেহালি পর্বত আড়। (লুকানোর স্থান, মুকুন্দরাম, ১৬০০)।

* আড় হইয়া বোড়া ক্ষেত্রমধ্যে পড়ে। (লম্বা হয়ে, বিজয় গুপ্ত, ১৬৫০)।

* লুকায় মেঘের আড়ে পলাতক শীর্ণ ম্লান শশী। (আড়ালে, মোম)।

* সোফায় অত্যন্ত আড় হয়ে বসতেন। (তেরছা, রবীন্দ্রনাথ, ১৮৮১)।

তাছাড়া সমাসবদ্ধ হয়ে যমজ শব্দ বা বিশেষণ পদ হিসেবে আরও বিচিত্র অর্থে বাংলা ভাষায় আড় শব্দের প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়। যেমন―

* আড়কাঠ = ঘরের চালা-সংলগ্ন দেয়ালের দুই প্রস্থে ব্যবহৃত লম্বা কাঠ।

* আড়খেয়া = নদী পারাপারের ছোট নৌকা।

* আড়খেমটা = সঙ্গীত ও নৃত্যের তালবিশেষ।

* আড়কোলা = আসন করে অর্ধশায়িত অবস্থায় কোলে রাখা কিংবা পিঠ ও দুই উরুর নিচে ধরে কোলে রাখার অবস্থা।

* আড়গড়া = কাঠগড়া।

* আড়কাটি = কুলিদের মাল গণনার কাঠি।

* আড়চোখ = তীর্যক চাউনি।

* আড়মোড়া = আলস্য-ভাঙা।

* আড়ভাঙা = বক্রতা সোজা করা।

* আড়পাড় = অন্য পাড়।

* আড়কালা = এক কানে শোনে না।

* আড়পাগলা = আধা পাগল।

* আড়বুঝ = বিপরীত অর্থ বোঝে এমন।

* আড়ঘোমটা = অর্ধ অবগুণ্ঠন বা আধা ঘোমটা।

* আড়গড়া = আস্তাবল। আড্ডাঘোড়া > আড়ঘোড়া > আড়গড়া।

* আড়গেলা = অর্ধেক চিবানো অবস্থায় গিলে ফেলা।

একালের সাহিত্যেও আড় শব্দের ব্যবহার অলক্ষণীয় নয়―

 * মুখে পড়ল একটা আড়হাসির রেখা। (বাঁকা হাসি, রবীন্দ্রনাথ, ১৯২৯)।

 * সে আড়বাঁশি বাজায় আর আড়চোখে তাকায়। (বক্র দৃষ্টি, নজরুল, ১৯৩৫)।

 * মনটা আড়মাল ষাঁড়ের মতো রুখে ওঠে। (খ্যাপা, সেলিনা হোসেন, ১৯৭৫)।

আড়-এর অর্থবৈচিত্র্যের যত কারিশমাই থাকুক, আড়বাঁশির মতো শ্রুতিমাধুর্য এবং আড়চোখের চাউনির মত দৃষ্টিমাধুর্যের বিস্তার আর অন্য কোনও শব্দজোড়ে নেই। আড়চোখের দৃষ্টি মানে, বক্রদৃষ্টি, গোপনে দেখা, লুকিয়ে চাওয়া, আত্মগোপন চাউনি, কটাক্ষ, আড়াল থেকে দেখার চেষ্টা। একটি বিশেষ বয়সে, তারুণ্যে ও যৌবনে এই সবিশেষ অঙ্গভঙ্গির শৈল্পিক দৃষ্টি লক্ষ্য করা যায়। নিজেকে অন্তরালে রেখে বিশেষ কিছু বা কাউকে প্রত্যক্ষণের গুপ্তসুপ্ত প্রচেষ্টাকেই বলা যায় আড়চোখের চাউনি। এই দৃষ্টিতে থাকে কিছু লজ্জা, সামান্য ভয়, আংশিক সুখতৃষ্ণা এবং বাকিটুকু ভালো লাগার নিভৃত প্রকাশ। তাতে থাকে লিয়োনার্দো দ্য ভিঞ্চির বিশ্বখ্যাত মোনালিসা চিত্রের মতো মুখমণ্ডলে লাজ-রক্তিমাভা, চোখে প্রকাশ ও অপ্রকাশের দ্বন্দ্ব, কৌতুক, কৌতূহল এবং নিজেকে গুপ্ত রেখে আংশিক ব্যক্ত করার নিভৃত অভিলাষ। আড়চোখে দৃষ্টি-বিনিময়ের মধ্যেও থাকে অব্যক্ত রহস্যময় অনুভূতি। নতুন রূপ-সৌন্দর্য দর্শনের বিপুল কৌতূহল এবং এক পলক দর্শন-তৃষ্ণার উষ্ণপ্রস্রবণের মিথস্ক্রিয়া থাকে সেই প্রায়-অলৌকিক দৃষ্টিতে। তাই শ্রীরাধার দৃষ্টি-বর্ণনায় বড়ুচণ্ডীদাস লেখেন―‘চাহ মোরে আড় করী দিঠে।’ (শ্রীকৃষ্ণকীর্তন)।

উত্তর

প্রথম দিনের সূর্য

প্রশ্ন করেছিল

সত্তার নূতন আবির্ভাবে―

কে তুমি

মেলেনি উত্তর।

বৎসর বৎসর চলে গেল

দিবসের শেষ সূর্য

শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল পশ্চিম-সাগরতীরে

নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়―

কে তুমি

পেল না উত্তর। (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

প্রশ্ন ও উত্তর বিপরীতার্থক শব্দ। আবার উত্তরের বিপরীত দিক অর্থে দক্ষিণও হয়। তবে আপাতত দিকের বিষয়টি বামে রাখি। এ জীবনে আমরা সবাই কমবেশি প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছি―লিখিত পরীক্ষায় নয়তো মৌখিক নির্বাচনী বোর্ডে। শিক্ষক বা প্রশ্নকর্তা সর্বদাই একাগ্নি বাণের মত প্রশ্ন নিয়ে প্রস্তুত থাকেন উত্তরদাতাকে ধরাশায়ী করতে। প্রশ্নকর্তা তখন যেন সর্বজ্ঞ ঈশ্বরের প্রতিভু আর উত্তরদাতা শরবিদ্ধ কোমল কপোত কিংবা ঈশ্বরের বড়শি-গাঁথা সদ্যতোলা মাছ। এমন অসহায় অভিজ্ঞতা নেই, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রাপ্ত এমন মানুষ কম। বাঙালি নারীরা তো বিবাহ-বৈতরণী পার হতে বহুবার এমন নির্বাচনী ‘পরীক্ষায়’ তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন―সন্দেহ নেই! তাই নিরীহ উত্তরদাতার পক্ষাবলম্বন করে ‘উত্তর’ শব্দটির আগপাছতলা একটু অনুসন্ধান করা যাক।

অভিধানে উত্তর শব্দটির অর্থ-সন্ধান করলে জানা-অজানা-অল্পজানা অনেক অর্থ পাওয়া যায়। এর মধ্যে প্রধান হলো―জবাব, কথা, অভিপ্রায়, সাড়া, চারদিকের অন্যতম দিক, পরে বা শেষে, ওপরের দিক বা ঊর্ধ্ব, সেরা, বিশিষ্ট, উত্তীর্ণ বা পেরিয়ে যাওয়া, ভবিষ্যৎ বা আগামী, অন্তিম, বাম, প্রশ্নখণ্ডন, গ্রন্থের শেষভাগ, পরিণাম, আধিক্য, পরিশিষ্ট ইত্যাদি। উত্তর শব্দটি সংস্কৃত (অব + √ৎ > লি > ওতর)। সংস্কৃত শব্দ হিসেবে সেই ভাষায় আরও অন্যতর অনেক অর্থ আছে তবে তা বাংলায় প্রয়োগহীন বলে এখানে উল্লেখ নিষ্প্রয়োজন। বাংলা ভাষার গুণী ও খ্যাতিমান লেখকদের রচনা থেকে এবার কিছু চুম্বক উদ্ধৃতি চয়ন করা যায়―

 * আপণার মুখে বড়ায়ি কহ তোঁ উত্তর। (বিশেষ্য পদ, জবাব অর্থে, বড়ুচণ্ডীদাস)।

 * লজ্জায়ে রহিলাম কিছু না করে উত্তর। (বিশেষ্য, সাড়া অর্থে, বৃন্দাবন দাস)।

 * উত্তরে হিমালয় দক্ষিণে ক্ষীর নদী। (বিশেষ্য, দিক অর্থে, বিজয় গুপ্ত)।

 * রাজা গৌড়েশ্বর কথা শুনিব উত্তরে। (ক্রিয়া-বিশেষণ, পরে বা শেষে অর্থে, রূপরাম)।

 * ক্রোধ করি দ্বিজবর বুলিল উত্তর। (বিশেষ্য, উচ্চবাচ্য অর্থে, ময়নামতির গান)।

 * মুকুন্দ কহেন তার মনের উত্তর। (অভিপ্রায় অর্থে, চৈতন্য ভাগবত)।

 * তোহ্মার লাগিয়া রাধা তেআগিল ঘর।/ তভোঁ মোর বচনে না দিলেঁ উত্তর। (সম্মতি অর্থে, বড়ুচণ্ডীদাস)।

 * মেয়েদের উত্তর অঙ্গ অনাবৃত। (বিশেষণ, উর্ধ্ব বা ওপর অর্থে, রবীন্দ্রনাথ)।

 * ভুলে যাই উত্তর চল্লিশ আমি। (বিশেষণ, উত্তীর্ণ বা পার হওয়া অর্থে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত)।

বিচিত উদ্ধৃতিতে বোঝা যাচ্ছে, হাজার বছর ধরে উত্তর শব্দটি বাংলা ভাষায় প্রচলিত এবং অদ্যাবধি অপরিবর্তিত। সংস্কৃত থেকে প্রাচীন ও প্রাকৃত বাংলা বাহিত হয়ে শব্দটি একুশ শতকেও অবিকৃত ও আধুনিক। বাক্যপ্রয়োগে উত্তর শব্দের অর্থ এবং ভাববৈচিত্র্যও লক্ষযোগ্য। তাছাড়া শব্দটির সঙ্গে যখন সন্ধি ও সমাস যুক্ত হয় তখনও এর নতুন অর্থের প্রাণসঞ্চার হয়―এর সঙ্গে যুক্ত আছে ভারতীয় পৌরাণিক তাৎপর্যও। এসব নতুন মাত্রা শব্দটিকে মহিমাময় করেছে।

প্রাচীনতম বাংলা কাব্য চর্যাপদের সমসাময়িক অষ্টম শতকে ভবভূতি নামে সংস্কৃত ভাষার এক পণ্ডিত ছিলেন। তিনি বিখ্যাত কবি ও নাট্যকার। সমালোচকরা তাঁকে মহাকবি কালিদাসের সমতুল বিবেচনা করেন। তাঁর বিখ্যাত কাব্যের নাম ‘উত্তররামচরিত’। কথাশিল্পী নীহাররঞ্জন গুপ্তের উত্তরফাল্গুনী উপন্যাসের কথা তো আজও প্রবীণ অনেক পাঠকের স্মৃতিতেই বিদ্যমান। উত্তরফাল্গুনী একটি নক্ষত্রের নামও। তাছাড়া বিশ শতকের চল্লিশ দশকে বাংলাদেশের ছান্দসিক কবি আবদুল কাদিরের একটি কাব্যগ্রন্থের নাম উত্তরবসন্ত। বইটিতে বসন্তবন্দনা ও বসন্তোত্তর কবিমনের ভাববেদনা কাব্যপিপাসুদের অন্তর স্পর্শ করেছে। বর্তমানের অন্যতম প্রধান কবি আসাদ চৌধুরীর প্রশ্ন নেই উত্তরে পাহাড় গ্রন্থের কাব্যসৌন্দর্য তো কবিতাপ্রেমীদের হৃদয়ে বাতিঘর হয়ে আছে। সমরেশ মজুমদারের উপন্যাস এবং শহীদ কাদরীর কাব্যগ্রন্থের নামকরণ উত্তরাধিকার শব্দের সঙ্গে সন্ধিবদ্ধ হয়ে আছে উত্তর শব্দটি (উত্তর + অধিকার)। উত্তরাধিকার শব্দের সঙ্গে আছে বংশগতির সম্পর্ক আর উত্তরসাধকের সঙ্গে কালস্রোত ও ভাবিকালের চেতনাধারণ এবং বহনের। বাঙালির বিলুপ্তপ্রায় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য মঙ্গলকাব্য, কবিগান, গম্ভীরা, বাউলগান ও পুথিসাহিত্যে সৃষ্টিকর্তাসহ চারদিক বন্দনার রীতি আছে―‘পুবেতে বন্দনা করি পুবের ভানুশ্বর… উত্তরে বন্দনা করি হিমালয় পর্বত’―ভক্তিবাদী এমন সুরারোপিত পঙ্ক্তি আজও গ্রামবাংলার শ্রোতাদের আবেগাপ্লুত করে।

জ্যোতির্বিদ্যায় উত্তর আকাশের অত্যুজ্জ্বল তারকাটির নাম উদীচী―যাকে আমরা ধ্রুবতারাও বলি। উত্তর বলতে যেমন দিক ও কাল বোঝায় তেমন দেশ বা স্থানও বোঝায়। উদীচী শব্দের অন্য অর্থ―বায়ু ও ঈশান কোণের মধ্যবর্তী দিক। কৈশোরে পাঠ্য ভূগোল বই থেকে পৃথিবীর উত্তর মেরুর কথা তো আমরা সবাই জানি। আবার উদীচ্ + ষ্ণ্য = উদীচ্য শব্দের অন্য অর্থ―উত্তর দিকের দেশ। অমরকোষ টীকাগ্রন্থ থেকে জানা যায়, সরস্বতী বা শরাবতীনদীর উত্তর-পশ্চিমের দেশকে বলা হয় উদীচ্য। উত্তরায়ণ (উত্তর + অয়ন) মানে, সূর্যের বিষুবরেখার উত্তরে গমন। বিষুবরেখার উত্তরে প্রায় সাড়ে তেইশ ডিগ্রি অন্তরে উত্তরায়ণের কল্পিত সীমারেখা।

ভারতীয় পুরাণে উত্তর-এর অর্থ আবার ভিন্ন―বিরাট-এর রাজপুত্র। তার অন্য নাম ভূমিঞ্জয়। মহাভারতের কাহিনিতে তিনি উত্তর-গোগৃহে কুরুযুদ্ধে অর্জুনের সারথি ছিলেন। ‘উত্তরকুরু’ শব্দের পৌরাণিক তাৎপর্য হল, জম্বুদ্বীপের বর্ষা-বিদায়ের বর্ষ। এটা আর্যদের আদি বাসভূমি বলে অনুমিত। এটা মেরুর দক্ষিণে শৃঙ্গী পর্বতের অপর পাশে অবস্থিত। দেবতাদের প্রিয় বাসস্থান। সেখানে মন্দাকিনী নদী, চৈত্ররথ বন ও সপ্তর্ষিদের বাস। রাজধানী ঢাকার উত্তরাংশের নাম ‘উত্তরা’ হলেও পুরাণে এর অর্থ―বিরাট-এর রাজকন্যা ও মহাভারতের অর্জুনপুত্র অভিমন্যুর পত্নী। আর উত্তরীয় অর্থ হলো― গায়ের আচ্ছাদন, উর্ধ্বাঙ্গের বরণীয় বস্ত্র, ওড়না বা চাদর। তাই শিবের বর্ণনায় পাওয়া যায়―‘অঙ্গরাগ চিতাধূলি, কান্ধেতে ভাঙ্গের ঝুলি, বিষধর উত্তর-বসন।’ রামায়ণের শেষ পর্বকে বলা হয় ‘উত্তরকাণ্ড’। বাংলা ব্যাকরণে উত্তর শব্দটির আছে ভিন্ন তাৎপর্য। সমাসের ক্ষেত্রে ব্যাসবাক্যের শেষের পদকে ‘উত্তরপদ’ বা ‘পরপদ’ বলে। উত্তরপদের অর্থের প্রাধান্য বা গৌণতার ওপর অনেক ক্ষেত্রে নির্ভর করে সমাসের চরিত্র।

খ্যাতিমান সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যের বিস্তৃত বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ‘মাইকেলী ক্রিয়াপদ’ বলে একধরনের ক্রিয়ার উল্লেখ করেছেন। ব্যাকরণের ভাষায় এগুলো মূলত ‘নামধাতু’। নামধাতু মানে, সহজ কথায় বিশেষ্য, বিশেষণ বা সর্বনাম পদকে ক্রিয়ায় রূপান্তর করা। মধুসূদন প্রধানত মেঘনাদ মহাকাব্যে এ ধরনের ক্রিয়াপদের ব্যাপক ব্যবহার করেছেন : নীরবিলা (নীরব রইল), নিষ্কোষিলা (নিষ্কাশন করল বা বের করল), বিলাপিলা (বিলাপ করল)। তেমন ক্রিয়াপদ ‘উত্তরিলা’ (উত্তর দিল)। ‘মেঘনাদবধ’ ও এই মাইকেলী ক্রিয়াকে বিদ্রƒপ করে কবি জগদ্বন্ধু ভদ্র ‘ছুছুন্দরীবধ’ (চিকামারা) নামে একটি ব্যঙ্গাত্মক কাব্য (প্যারডি) লিখেছিলেন। সেখানে একটি পঙ্ক্তি এ রকম―‘টেবলিলা (টেবিল তৈরি করল) সূত্রধর কণ্ঠালের কাষ্ঠে।’ মাইকেলী এই ক্রিয়াপদের ব্যবহার পরবর্তীকালে আর কোথাও পরিলক্ষিত হয়নি।

উত্তর-এর দ্বিত্বও হয়―(উত্তর + উত্তর) উত্তরোত্তর, মানে ক্রমেক্রমে। দ্রব্যমূল্য উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে একথা তো আমরা জীবন থেকে সবাই জানি। কিন্তু অনেকেই জানি না যে, ‘উত্তরচ্ছদ’ মানে বিছানার চাদর। এত কথার পরেও একথা বলতে হয় যে, প্রশ্ন যতই কঠিন হোক, অনেক ক্ষেত্রে প্রশ্নের মধ্যেই উত্তর থাকে। কেবল একটু বুদ্ধি খাটিয়ে খুঁজে নিতে হয়। কৈশোরে আমরা খেলাচ্ছলে একে অপরকে প্রশ্ন করতাম―‘সীতার আরেক নাম জান কী’ ? কিংবা ‘পৃথিবীটা কার গোলাম’ ? উত্তর : ‘পৃথিবী টাকার গোলাম।’ প্রশ্নে থাকা ‘জান কী’ এবং ‘টা কার’ মাঝের ফাঁকদুটি যুক্ত করে দিলেই উত্তর হয়ে যায়। আহা! কী মজা বাংলা ভাষায়!

উদাস

উদাস-করা হৃদয়-হরা

না জানি কোন ডাকে

সাগর-পারের বনের ধারে

কে ভুলালো তাকে ? (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

‘উদাস’ শব্দটি বড় মনোময়, জটিল, ও মনস্তাত্ত্বিক। মূলত ব্যাখ্যাতীত একটি হৃদয়সঞ্জাত ভাবের নাম উদাস। মন কেমন-করা ভাব―যেন নজরুলের গানের কথার মতো―‘উচাটন মন ঘরে রয় না’―এমন একটা মানসক্রিয়ার নাম বোধকরি ‘উদাস’। নাহ, তাও মনে হয় যুৎসই প্রকাশ হলো না! উদাস ভাব বোঝানোর জন্য ‘উড়নচণ্ডী’ শব্দটা কি লাগসই হবে ? তাও বোধকরি না! কোনও প্রতিশব্দ বা বিকল্প শব্দই অন্যটির সমতুলে শতভাগ মিলে না―যেমন মিলে না যমজ ভাই বা বোনও। জীবন ও জগতের প্রতি একধরনের হতাশা বিভ্রান্তি বিবমিষা অপ্রাপ্তি অভিমান ক্ষোভ ইত্যাদি থেকেও সৃষ্টি হতে পারে উদাসভাব। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, উদাস ভাব বা ঔদাসীন্য একপ্রকার মনোবিকলন। মতো, প্রায়, যেন―এমন তুলনাত্মক শব্দ দিয়ে উদাস শব্দের মূলভাবের কাছাকাছি আসা যায় কিন্তু উনিশ-বিশ ভিন্নতা থেকেই যায়।

রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের প্রেম-বিরহের কবিতা যখন পড়ি তখন মনে উদাস ভাব জাগে। বিশেষত বর্ষা, বসন্ত ও বিরহের গান যখন শুনি তখন মনের মধ্যে প্রকাশ-অক্ষম একটি বিস্রস্ত আবেগ মনকে তাড়িত করে। হৈমন্তিক কুজ্ঝটিকার মতো কিংবা ‘আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে’র মতো মন আচ্ছন্ন করে রাখে সেই কবিতা ও গান। সেই আনমনা অনুভূতির নামই বোধকরি উদাস ভাব।

উদাস + ঈ = উদাসী। তদ্ধিত প্রত্যয়ান্ত শব্দ। উদাস-করা ভাবের সংক্রমণে আক্রান্ত যে ব্যক্তি তিনিই উদাসী। নজরুলের গানে পাই : ‘কে বিদেশি মন উদাসী/ বাঁশের বাঁশি বাজাও বনে।’ রবীন্দ্রনাথের ‘উৎসর্গ’ কাব্যের ‘আমি চঞ্চল হে’ কবিতায় আছে―‘আমি চঞ্চল হে/ হে সুদূর, আমি উদাসী।’ তাঁর গানে পাই―‘এই উদাসী হাওয়ার পথে পথে মুকুলগুলি ঝরে।’ আরও আছে অগণন উদাস যুক্ত পঙ্ক্তি―যেন ‘শেষ নাহি যে শেষ কথা কে বলবে!’ কবির প্রেম ও প্রকৃতির গানে ‘উদাস’ শব্দের প্রয়োগ পাঠক ও শ্রোতাকে সত্যি উদাস করে। এক লহমায় মনে পড়ে―‘উদাস-করা হৃদয়-হরা না জানি কোন ডাকে/ সাগরপারের বনের ধারে কে ভুলালো তাকে।’ কিংবা ‘উদাসিনী বেশে বিদেশিনী কে সে নাই বা তাহারে জানি…।’ তাই ভাবাবেগপূর্ণ শব্দ উদাসের কোনও সুনির্দিষ্ট স্বরূপ নেই। কারণ তা বস্তুগত নয়―আত্মগত মানসক্রিয়া।

উদাস-এর শাব্দিক গঠনগত রূপ― উদ্ + আস + অ। সংস্কৃত ভাষার নিয়মে পুংলিঙ্গবাচক বিশেষণ পদ। আ প্রত্যয় যুক্ত হয়ে (উদাস+আ)

 স্ত্রীলিঙ্গবাচক হয়। উদাস + ঈন/ নীন = উদাসীন। সংস্কৃতে এর অর্থ বিরাগী, বিষয়বিতৃষ্ণ। বাংলায় এর অর্থ বসা বা থাকা। মানে, যে সংসার ত্যাগ করে বিরক্ত হয়ে বসে থাকে। এর অন্য অর্থ―গৃহত্যাগী, সন্ন্যাসী। সংস্কৃত ব্যাকরণ মতে উদাসের স্ত্রীবাচক শব্দ উদাসা বা উদাসীনা। বাংলায় এর প্রয়োগ দেখা যায় না। বাংলায় ‘ইনী’ প্রত্যয় যুক্ত করে (উদাস + ইনী) উদাসিনী। এটি কি তবে সুপ্রচলিত ভুল―যেমন ভুল ‘সুকেশিনী’! কারণ সুকেশ থেকে স্ত্রীলিঙ্গ ‘সুকেশা’―সুকেশিনী নয়। কিন্তু উদাসিনী, সুকেশিনী, সুহাসিনী, সুভাষিনী―শব্দগুলো তো বাংলায় সুপ্রচলিত।

সংসারত্যাগী সন্ন্যাসী, আসক্তিহীন, বিষয়বাসনা-বিরাগী―এসব তো উদাসী মানুষের কুললক্ষণ। ‘উদাস’ শব্দটি যেন বহু ভাবের আকর। অভিধান ঘাঁটলে শব্দটির শতাধিক অর্থ মিলে। এবার মহৎ লেখকদের উদাহরণ থেকে ‘উদাস’ শব্দটির অর্থবৈচিত্র্যের দিকে লক্ষ্য করা যাক―

* শ্মশান বাস সদা উদাস। (বিরাগী অর্থে, সারদামঙ্গল, বিহারীলাল)।

* হইব উদাস আমি তোমার লাগিয়া। (গৃহত্যাগী অর্থে, গঙ্গামঙ্গল, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ)।

* আওল তোহে মিলব করি আশ।/ কপট প্রেম তুহুঁ ভেলি উদাস।  (অনুরাগহীন অর্থে, বলরাম দাস)।

* সর্বনাশ হয় তার জুয়ার কারণ।/ সর্ব্বলোকে বলে বেটা উদাস টেটন। (ভবঘুরে অর্থে, বাইশ কবি মনসা)।

* ভক্ত যদি নাহি থাকে, মোরে কেহ নাহি ডাকে, ত্রিভুবন সকলি উদাস। (বিচ্ছিন্ন অর্থে, দুর্গাপঞ্চরাত্রি)।

* কৃষ্ণ বান্ধিয়া রাখিলে পাণ্ডব উদাস। (হতাশ অর্থে, মহাভারত, বিজয় পণ্ডিত)।

* ভার্য্যাহীন লোকে কেহ না করে বিশ্বাস।/ সর্ব্বদা দুঃখিত সেই সর্ব্বদা উদাস। (সংসারবিরাগী অর্থে, কাশীদাসী মহাভারত)।

* কোথা গেল চারি পুত্র করিয়া উদাস। (অসহায় অর্থে, কৃত্তিবাসী রামায়ণ, অযোধ্যাকাণ্ড)।

* অন্তরে সব জানে প্রভু, বাহিরে উদাস। (অচেতন অর্থে, চৈতন্য চরিতামৃত)।

* ইহা সুনি কৈল তার বন্ধন উদাস।’

(শিথিল অর্থে, কৃত্তিবাসী রামায়ণ, উত্তরকাণ্ড)।

* অজয় পাণ্ডব সব গেল বনবাস।/ কোন দোষে তারে মুঞি করিনু উদাস। (আবাসশূন্য বা নির্বাসিত অর্থে, মহাভারত, বিজয় পণ্ডিত)।

* হুহু করে ওঠে প্রাণ, মন করে উদাস উদাস! (অস্থির অর্থে, নজরুল)।

বিশেষণবাচক ‘উদাস’ শব্দটির মধ্যে কত যে বিচিত্র ভাবের বিকাশ ঘটে এবং এর মধ্যে কত- যে বহুমুখী প্রকাশ-ব্যাকুলতা তা প্রায় ব্যাখ্যাতীত। ‘তা’ বা ‘ষ্ণ্য’ প্রত্যয়যোগে উদাস-এর বিশেষ্যরূপ উদাসতা বা ঔদাস্য। আবার উদাসীন থেকে উদাসীনতা বা ঔদাসীন্য। ধনাত্মক ও ঋণাত্মক দুই বিপ্রতীপ আবেগানুভূতির আকাশ-ছোঁয়া ব্যাকুলতার প্রকাশ ঘটে এই শব্দটির মাধ্যমে। রবীন্দ্রনাথের কবিতা, গানে ও গদ্যে এই আবেগ-মথিত শব্দটির সূক্ষ্ম বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। কয়েকটি চমকপ্রদ উদাহরণ―

* কেঁদে ওঠে উদাস হৃদয়।

* ওগো কে তুমি বসিয়া উদাস-মূরতি, বিষাদ-শান্ত-শোভাতে।

* কুসুম সুবাস উদাস ভইল, সখি, উদাস হৃদয় হমারি।

* উড়িতেছে কেশ, উড়িতেছে বেশ, উদাস পরাণ কোথা নিরুদ্দেশ।

* নিরাশ্বাস উদাস বাতাসে, নিশ্বাসিয়া কেঁদে উঠে মন।’

* পরাণ কেন কে জানে উদাসে।’

* হুহু করি নিশ্বাসিয়া চলে যাবে উদাসিয়া, কেশপাশ আকাশে ছড়ায়ে।

* জন্ম মৃত্যু দুঃখ সুখ অস্ত অভ্যুদয়/ তরঙ্গিত চারিদিকে চরাচরময়/ তুমি উদাসিনী।

* বিফল কাকলী, কাঁদিয়া ফিরিতেছিল বনান্তর ঘুরে, উদাসিনী প্রতিধ্বনি।

* উদাসিনী স্মৃতি কাঁদিছে কি বসি, আশার সমাধি পরে।

* আমি তাহে ডুবে যাব, সঙ্গে সঙ্গে বহে যাব, উদাসীন বসন্তের বায়।

* উদাস পরাণে কোথা নিরুদ্দেশ… ভ্রমিতেছি আনমনে।

এ তো গেল চিরউদাসী রবীন্দ্রনাথের উদাস-ভাবনার এক পলকের পরিচয়। মানবমনের উদাস-ভাবনাকে তিনি কত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণে অনুভব করে কবিতা-গানে প্রকাশ করেছেন তার সৌন্দর্য অতুল। তবে ‘উদাস’ শব্দের আরেকটি অতিবিচিত্র অর্থ আছে বৈষ্ণবসাহিত্যে। তা হলো―দিগম্বর, বস্ত্রহীন, স্খলিতবসন বা অনাবৃত―সহজ কথা উলঙ্গ। এ অর্থে শব্দটি এখন অপ্রচলিত এবং অভিধানবন্দি। তবে মধ্যযুগের বৈষ্ণব সাহিত্যে এর প্রচুর প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়। কয়েকটি চুম্বক উদ্ধৃতি―

 * নীল বসন ভিগি অঙ্গে লাগিয়াছে, শ্রীঅঙ্গ দেখিতে উদাস। (গোবিন্দদাস)।

 * গুমানে গুহ্যক গুহ্য করিল উদাস। (শিবায়ন)।

 * খেনে কুচযুগ চীর করবি উদাস। (রায় শেখর পদাবলী)।

 * তেঞি উদাসল কুচজোড়া (স্তনযুগল)। (বিদ্যাপতি)।

 * তহি ছলে ভুজমূল বসন উদাসল পিয়া, হিয়া মদন জাগায়। (রায় শেখর পদাবলী)।

 * আধ নুকায়লি আধ উদাস/ কুচকুম্ভ কহি গেল অপনক আসে। (বিদ্যাপতি)।

 * নীবিবন্ধ করল উদস (উদাস)। (বৈষ্ণব পদাবলী)।

নারীদেহের বসনাবৃত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ উন্মোচন করা অর্থে যখন ‘উদাস’ ব্যবহৃত হয় তখন এর ব্যাখ্যার বোধকরি আর প্রয়োজন নেই। বৈষ্ণব সাহিত্য তো জীবাত্মা ও পরমাত্মার প্রেমারাধনার মোড়কে অনেকাংশেই আদিরসের আধার।

[চলবে]

সচিত্রকরণ : ধ্রুব এষ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button